পুনর্পাঠে সভ্যতার সংকট

সনৎকুমার সাহা

সম্ভবত এটি তাঁর চেতনায় সঞ্চিত ও উদ্ভাসিত মননশীল শেষ পূর্ণাঙ্গ গদ্য রচনা। ‘সম্ভবত’ বলছি, কারণ, আমি পড়িনি, এমন আরো লেখা থাকতেও পারে। টুকটাক কথোপকথনে তারপরেও তাঁর তখনকার মানসভুবনের আভাস ফুটে ওঠে নানা জায়গায়। তাদের স্মৃতিচারণ করে গেছেন কেউ-কেউ। কিন্তু সুসমন্বিত সুশৃঙ্খল গদ্যে তিনি তাকে বেঁধে একক বৈশিষ্ট্যে তার সবটুকুর প্রতি মানব-সমুদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তেমনটি আমার জানা নেই। আমি তাঁর সভ্যতার সংকটের কথা বলছি। শেষের বাণী যদি হয়ে থাকে, তবু তা কোনো পাদপূরণের তাৎপর্যহীন অবশেষ নয়। তার প্রবাহ প্রাণময়। অনুমান করি, অশেষ। এখনো বারবার পড়ি। শুধু যে উত্তর খুঁজি, তা নয়। প্রশ্নেরাও উঠে আসে।
অবশ্য এরও পরে, মানে, তাঁর শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠান, পয়লা বৈশাখ, ১৩৪৮-এর পরে, মন্ত্রের মতো তিনি কটি কবিতা লিখেছেন, যেন মর্ত্যজীবনের নিরাভরণ নির্যাস, ট্র্যাজিক মহিমায় পূর্ণতার পাত্রে নিখাদ বেদনার প্রশামত্ম সমর্পণ, যেন উত্তরহীন প্রশ্নের ধ্যানোৎসারিত,
অথবা জ্ঞানে-নির্জ্ঞানে সংশেস্নষিত উচ্চারণ। সত্তার নিরাবেগ সত্য আকুতি সে-সবে মিশে থাকে; কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থকে ছাড়িয়ে যায় বহুদূর। আমরা দেখি, ৩০ বৈশাখ তিনি লিখছেন ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন – / সত্যের দারম্নণ মূল্য লাভ করিবারে,/ মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে \’ (‘রূপনারানের কূলে’); ১১ শ্রাবণে ‘কে তুমি?’ এই প্রশ্নের সামনে তিনি দাঁড়ান, উত্তরহীন; কারণ, জীবনের সব-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির পরও তা তাঁর অজানা (‘প্রথম দিনের সূর্য’, ১১ শ্রাবণ)। ১৩ শ্রাবণ তিনি জানান, ‘দুঃখের অাঁধার রাত্রি বারে বারে/ এসেছে আমার দ্বারে’ এবং সেইসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়ার মর্মোত্থিত ভাষণ, ‘যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস/ ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।/ এই হার-জিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক,/ শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা – ’ (‘দুঃখের অাঁধার রাত্রি’, ১৩ শ্রাবণ), এবং সবশেষে ১৪ শ্রাবণ, মগ্নচৈতন্যের আর এক অবিনাশী বার্তা যেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী!’ যা শেষ হয় তাঁর বোধির অমিত্মম সাড়ায়, ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/ সে পায় তোমার হাতে/ শামিত্মর অক্ষয় অধিকার।’ (‘তোমার সৃষ্টির পথ’)। পরের একটি সপ্তাহ জীবন-মৃত্যুর টানাটানি। তাঁর আর কোনো ভূমিকা নেই। বাইশে শ্রাবণ তাঁর পার্থিব অসিত্মত্বের অনিবার্য পরিসমাপ্তি।
এখানে আর একটু যোগ করার – তখন প্রায় সব রচনাই তাঁর মুখে-মুখে বলা। যদিও কোনোটিই স্বতঃস্ফূর্ত নয়, সব শেষেরটিও রোগশয্যা থেকে নির্দেশ দিয়ে টুকটাক সংশোধন করেছেন পরদিন।
এভাবে কিছুদিন আগে থেকে গান বা গল্পও তিনি লিখেছেন কটি। গানে সুরও দিয়েছেন। সভ্যতার সংকটের পরিশিষ্ট, অথবা, একভাবে তার অমত্মর্জাত আবেদন, ‘ওই মহামানব আসে’র প্রাথমিক খসড়া মৈত্রেয়ী দেবীকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। পরে কাটছাঁট করে তিনি তাকে বর্তমান রূপে নিয়ে আসেন। সুর করেন পরদিন শামিত্মদেব ঘোষের গলায় তা তুলে দিয়ে। তাঁদের দুজনের স্মৃতিকথাতেই এর উলেস্নখ মেলে। শামিত্মদেব ঘোষ আরো জানান, ‘হে নূতন, দেখা দিক আরবার’ – এই গানটিও কবি পূরবীর ‘পঁচিশে বৈশাখ’ – কবিতাটির শেষ সত্মবকটি কিছু অদল-বদল করে বেঁচে থেকে তাঁর শেষ জন্মদিনের দুদিন আগে, ২৩ বৈশাখ, ১৩৪৮, একইভাবে তাঁকে সামনে বসিয়ে তাতে সুর যোজনা করেন। নির্মলকুমারী মহলানবিশ (রানী মহলানবিশ) তাঁর বাইশে শ্রাবণ বইতে লিখেছেন, ‘৩ জুলাই, ১৯৪১, (অর্থাৎ, ঠিক তার আগের মাস, আষাঢ়ের তৃতীয় সপ্তাহে) আমাকে কবি বললেন ‘মা মণি (প্রতিমা দেবী) আমাকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে অনেক লেখা লিখিয়েছেন। আমি মুখে বলেছি আর উনি কলমে ধরেছেন। এই রকম খোঁচা দিয়ে দিয়ে মা মণি দুটো গল্প আদায় করেছেন, তা জানো? একটার নাম ‘প্রগতিসংহার’ এবং অন্যটা ‘অরাজক’।’ এত কথা বলার উদ্দেশ্য, যখন তাঁর মাথায় সভ্যতার সংকটের বিষয়টি ঘুরছে, তখন তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির কাজ থেমে থাকেনি – শরীর যদিও অশক্ত এবং কঠিন রোগের মোকাবিলায় তিনি শ্রামত্ম। রোগশয্যায়
(কার্তিক-অগ্রহায়ণ, ১৩৪৭) থেকে শেষ লেখা (বৈশাখ-শ্রাবণ, ১৩৪৮) পর্যমত্ম তাঁর নানা কবিতায় এর আশ্চর্য বর্ণচ্ছটা, যদিও রাজসিক নয়, আমাদের অভিভূত করে। ক্ষয় ও বিনাশের অনিবার্যতার সামনে তিনি তাঁর মানুষী মর্যাদা এতটুকু নত হতে দেননি। ভাবনায় বৈচিত্র্য ধরা পড়ে আগের মতোই। অবশ্য মননের ও প্রজ্ঞার ছাপ গাঢ়তর, এবং উচ্ছ্বাস সিত্মমিত।
সভ্যতার সংকট নিয়ে আলোচনায় অনভিপ্রেত, কিন্তু এখানে তাঁর ‘প্রগতিসংহার’ গল্পটির কথা যখন উঠেছে, তখন পরোক্ষে তাঁর মানসভুবনটি আন্দাজ করার জন্যে বাড়তি কিছু কথার প্রক্ষেপ ঘটাই। ওই সময়ের এক প্রতিভাময়ী আশ্রমকন্যা, অমিতা সেন, খুকু নামে যাঁর পরিচয়, এই গল্পে তাঁর অকালপ্রয়াত জীবনের ছায়া গভীরভাবে পড়েছে মনে হয়। ১৪২১, আশ্বিন সংখ্যা কালি ও কলমে যশোধরা বাগচী তাঁকে নিয়ে এক হৃদয়স্পর্শী রচনা উপহার দিয়েছেন। (জানতে পাই, যশোধরা বাগচীও কমাস আগে হঠাৎ করেই আমাদের ছেড়ে গেছেন। আমি তাঁকে দেখিনি। তবে দূর থেকে তাঁর মনীষা ও সাহসকে শ্রদ্ধা করেছি। তাঁর স্বামী, বরেণ্য অধ্যাপক অমিয় বাগচীকে সামত্মবনা জানাই, এমন শক্তি বা অধিকার কোনোটিই আমার নেই)। এই অমিতা সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা, আবার, আশাভঙ্গেরও কারণ। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা উপেক্ষা করে আশ্রম ছেড়ে চলে যান, ও সেই সময়েই নিজের স্বাধীন সত্তার প্রকাশ ঘটান। বাড়তি চাপে ও শরীরের অবহেলায় মাত্র ছাবিবশ বছর বয়সে নেফ্রাইটিস রোগে আক্রামত্ম হয়ে তিনি মারা যান। তার কয়েক মাস পরেই ঘটে রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান। এই অমিতা সেন এখন এ-ভূখ– নারীবাদী চেতনার এক আইকন হয়ে উঠছেন। যশোধরা বাগচীর লেখায় তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বরূপ সুন্দর ফুটে উঠেছে। কিন্তু আজকাল অনেকে এই ধারালো ব্যক্তিত্বের কন্যাটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাময়িক মনোমালিন্যের কথা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে সেখানে কবির দিক থেকে কোনো উদ্দেশ্যের কারসাজি প্রমাণ করায় বেশি তৎপর হয়ে ওঠেন। আমরা দেখি, বাচ্চা মেয়ে বলে খুকু অমিতার গানের প্রতিভাকে শুধু পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে কবি খুশি করতে চেষ্টা করেননি। বরং এই চাইল্ড-প্রডিজিকেই দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্থানের পর করতে চেয়েছিলেন সংগীত-ভবনের কর্ণধার। অমিতা সে অনুরোধ না রেখে আপন প্রাণের টানে কলকাতা এসে প্রথমে স্কুলে, পরে কলেজে পড়ানোর কাজ নেন। রবীন্দ্রনাথ যদি এতে মনঃক্ষুণ্ণ হন, তবে তা অস্বাভাবিক নয়। অমিতা সেন যে-গানের সঙ্গে পড়াশোনাতেও অসামান্যা ছিলেন, এটাও এ থেকে স্পষ্ট হয়। তবে কবির সঙ্গে তাঁর ভেতরে যে কোনো দেয়াল খাড়া হয়নি, তা বোঝা যায়, আশ্রমে ওই সময়েরই আর এক অমিতা সেন, – আচার্য ক্ষেতিমোহন সেনের কন্যা, ও, পরে অমর্ত্য সেনের মা, – তাঁর এই স্মৃতিচারণ থেকে –
– মৃত্যুর আগে অমিতা শামিত্মনিকেতনে ফিরে এসে কিছুকাল বাস করে। সেই সময় সকাল-সন্ধ্যায় সে গুরম্নদেবকে গান শোনাতে যেত। গুরম্নদেব ওর গান শুনতে ভালোবাসতেন। আগ্রহে ওর জন্যে অপেক্ষা করে থাকতেন। অমিতা এলেই যেসব গান ওঁর শুনতে ইচ্ছে হত সে-সব গান ওকে ফরমাশ করতেন। অমিতা একটার পর একটা গান গেয়ে যেত।
এই সময় তিনি একদিন ‘আমি তোমার সঙ্গে…’ গানটি শুনতে চান। খুকু গানটি তাঁকে গেয়ে শোনালে তিনি হেসে তাকে বললেন, ‘কী রে, গানটা শুনে তোর কি কিছু মনে পড়ছে?’ উচ্চস্বরে হেসে উঠল খুকু। প্রাণখোলা হাসিইতো ছিল তার স্বভাব। রবীন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন, ‘ওকে উদ্দেশ করেই গানটি আমি বেঁধেছিলাম।’
সেখানে তখন যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা পরে অমিতাকে বলেছিলেন, ‘পরম সৌভাগ্যের এমন দামি কথাটা তুমি মনের মধ্যেই চেপে রাখলে? আমরা হলে উচ্চকণ্ঠে এই কথাটা গেয়ে বেড়াতাম।’ উত্তরে অমিতা বলেছিল, ‘ও কথা গুরম্নদেব মুখে বললেও আমি কি বুঝি না এই গানের কী গভীর অর্থ? এই গভীর অনুভূতি কি কোনো ছোট আধার ধারণ করতে পারে? ওঁর এই ভাব কোন গভীরে, কোন পরমার দিকে বয়ে যাচ্ছে, আমি তো উপলক্ষ মাত্র।’… (শামিত্মনিকেতনে আশ্রমকন্যা, পৃ ২২)।
কমাস পরেই এই কন্যা মারা যান। যখন কলকাতার এক হাসপাতালে তিনি মৃত্যুশয্যায়, তখন শৈলজারঞ্জন মজুমদার জানাচ্ছেন, ‘…যখন সেই খুকু বাঁচবে না বলে ডাক্তাররা শেষ
কথা জানালেন, তখন সে-খবর জেনে গুরম্নদেব আমাকে ডেকে এক বিশেষ চকোলেটের নাম করে বললেন – খুকু এই চকোলেট খেতে খুব ভালোবাসত। ও তো এমনিতেও বাঁচবে না, তুমি নিজে গিয়ে ওকে এই চকোলেট খাইও।…’ (যাত্রাপথের আনন্দগান, পৃ ৮৩)
বলতে চাই সভ্যতার সংকট নিয়ে। মাঝখানে এসব কথা খাপছাড়া ও অনাবশ্যক মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমি শুধু এইটে বোঝাতে চাইছি, সভ্যতার সংকটের ভাবনাটা রবীন্দ্রনাথের মাথায় দুর্ভাবনা হয়ে ঘুরপাক খেতে শুরম্ন করেছে অমত্মত ১৯৩৭ থেকে। বাইরে থেকে তা উসকে দেয় জাপানের চীন আক্রমণ (১৯৩৭) ও য়োরোপে মহাযুদ্ধের বিধ্বংসী দাবানল, যা জ্বলে ওঠে ১৯৩৯-এ। ভেতরে মানসিক শামিত্ম হরণ করে পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার কা-জ্ঞানহীন বিসত্মার ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজের ছলচাতুরীর, সেই সঙ্গে জবরদসিত্মর অন্যায় বিভীষিকা। তাঁর কবিতায় ও প্রবন্ধে এসবে তাঁর বিক্ষুব্ধ চিত্তের আক্ষেপ বেজে উঠেছে বারবার। ১৯৩৭-এর বড়দিনে তিনি লেখেন, ‘নাগিণীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস’ কবিতাটি। এতে তাঁর আহবান, ‘বিদায় নেবার আগে তাই/ ডাক দিয়ে যাই/ দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/ প্রস্ত্তত হতেছে ঘরে-ঘরে’ – এর অনুরণন শুনি ৬ অক্টোবর, ১৯৪০ প্রশামত্ম মহলানবিশকে যখন তিনি ডেকে আনেন শুধু এই কথাটি বলার জন্য, ‘…চীন দেশের লোকেরা চিরদিন যুদ্ধ করাকে বর্বরতা মনে করেছে। কিন্তু আজ বাধ্য হয়েছে লড়াই করতে দানবরা ওদের আক্রমণ করেছে বলে।…’ (নির্মলকুমারী মহলানবিশ, বাইশে শ্রাবণ, পৃ ৮৭-৮৮)। তার আগে ‘বুদ্ধভক্তি’ কবিতায় (১৯৩৮) চীনে জাপানি আগ্রাসনকে তিনি ধিক্কার জানান সরাসরি। ‘ঐকতান’ (জানুয়ারি, ১৯৪১), কি, ‘ওরা কাজ করে’ (ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৪১) তাঁর জীবনাবসানের মাত্র কমাস আগের ভাবনার ফসল। এদের নির্যাস অবশ্যই মিশেছে সভ্যতার সংকটে। লেখাটা হুট করে একদিনে নয়। কমাস ধরে বিষয়-ভাবনাকে এক জায়গায় করে যত্নের সঙ্গে তিনি একে রূপ দেন। অমিয় চক্রবর্তী, প্রশামত্ম মহলানবিশ, এঁদের সঙ্গে আলোচনা করে নিজের জায়গাটা ঠিক আছে কি না বোঝার চেষ্টা করেন। রানী মহলানবিশ জানাচ্ছেন, ৬ অক্টোবর, ১৯৪০ ‘দুপুরবেলা আমি (তাঁর) ঘরে একা আছি।… হঠাৎ চোখ তাকিয়ে আমাকে বললেন, ‘একটা কাগজ নিয়ে এসে যা বলছি তা লেখো।’ তারপর থেমে থেমে ভেবে ভেবে বলতে লাগলেন –
We have known the primitive Mongols, the most terrible cruel horde of mankillers and we have the habit of calling them barbarous, but the unalloyed sign of barbarism is revealed when all through the trapping of so-called civilization comes out the treason against humanity and that has been shown in the late history. We, who stand by the side of humanity, we may be victimized by the satanic power, we may be defeated in our enjoyment of human rights and yet we have the consolation to realize that man is great. And the time may or may not come when men will assert the dignity of freedom, but we have the consolation to proclaim that man is great. (বাইশে শ্রাবণ, পৃ ৮৭)
এই ভাবনা-সূত্রের সঞ্চারণ সভ্যতার সংকটে খুব স্পষ্টই ধরা পড়ে। কিন্তু এখানেই যদি আমাদের চোখ গেঁথে রাখি, তবে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-বিশ্বের ও কর্মপ্রতিভার এক খ-াংশই শুধু সামনে ধরা পড়বে। ‘নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা’ আর আমরা হাতে পাব না। সত্য কথা, সভ্যতার সংকটের মতো একই মেজাজের কবিতা এই কালপর্বে তিনি বেশকটি লিখেছেন। যেমন, ‘প্রচ্ছন্ন পশু’ –
দিকে দিকে হত্যা যারা প্রসারিত করে
মরণলোকের তারা যন্ত্রমাত্র শুধু,
তারা তো দয়ার পাত্র মনুষ্যত্বহারা!
সজ্ঞানে নিষ্ঠুর যারা উন্মত্ত হিংসায়
মানবের মর্মতন্ত্র ছিন্ন ছিন্ন করে
তারাও মানুষ বলে গণ্য হয়ে আছে!
কোনো নাম নাহি জানি বহন যা করে
ঘৃণা ও আতঙ্কে মেশা প্রবল ধিক্কার –
হায়রে নির্লজ্জ ভাষা! হায়রে মানুষ!
ইতিহাস বিধাতারে ডেকে ডেকে বলি –
প্রচ্ছন্ন পশুর শামিত্ম আর কত দূরে
নির্বাপিত চিতাগ্নিতে সত্মব্ধ ভস্মসত্মূপে!
(জন্মদিনে, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৪০)
সভ্যতার সংকটের সমসময়ের কবিতা এটি। নৈরাশ্য ও বেদনার ছাপ আরো কালো, আরো ঘন। হাহাকার দিগমত্মপ্রসারী। কিন্তু এটিই তখনকার তাঁর সৃষ্টিকলার একমাত্র চরিত্রলক্ষণ নয়। আমরা আরো পাই যেমন আগেই বলেছি, মানব-সমগ্রের আশাজাগানিয়া এগিয়ে যাওয়ার ভাবনায় মুখর বেশকটি কবিতা, পাই খাপছাড়া (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) বা ছড়ার ছবির নির্মল ছেলেমানুষী, অথবা
‘পৃথিবী’, ‘আমি’ বা ‘আফ্রিকা’র (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) মতো চিরকালের সব মানুষের সম্পদ। শেষ বয়সেই তিনি রচনা করেন চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা ও চ-ালিকার মতো কালজয়ী নৃত্যনাট্য আর ফুটিয়ে তোলেন চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের নতুন পরিচয়। সৃষ্টির মৌলিকত্বে ও প্রাচুর্যে যা এক অকল্পনীয় বিস্ময়। এবং অবশ্যই ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণে’র মতো গান যা পার্থিব এক মুহূর্তকে অমরতায় উত্তীর্ণ করে। ‘প্রগতিসংহার’ ও ‘অরাজক’ গল্পদুটির উলেস্নখ, আমরা দেখেছি, তিনি নিজেই করেছেন। ‘অরাজক’ আমি পড়িনি। ‘প্রগতিসংহার’ গল্প হিসেবে ঠিক দানা বাঁধেনি। তবে কাছাকাছি সময়ের ‘ল্যাবরেটরি’ তাঁর অসামান্য সৃষ্টি। এখনো আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়।
সভ্যতার সংকট নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করতে এতসব কথা বলা। ইতিতে-নেতিতে এরা সবাই একই চিত্তভূমিতে নানা বীজে নানাভাবে নানা মরসুমে কর্ষণার ফসল। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।

দুই
বেশ কবছর ধরে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ২৫ বৈশাখ না হয়ে, নববর্ষের দিন, পয়লা বৈশাখ হওয়া রেওয়াজে দাঁড়িয়েছিল। জীবদ্দশায় তাঁর শেষ জন্মদিনের আয়োজনেও, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রকাশে, এর ব্যতিক্রম হয় না। কবির শরীর তখন প্রায় অচল। নিজেও বোঝেন, যাওয়ার সময় আসন্ন। তবু আসরে এসে বসেন। এখন মনে হয়, তাঁরও তাড়া ছিল। প্রামত্মবেলায় আপন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির শেষ কথা বলে যাওয়ার একটা তাগিদ তিনি নিজের ভেতরেও অনুভব করছিলেন। ‘যা মনে বাসা বেঁধে আছে, খোলাখুলি সব বলে দিলাম।’ – এমন মমত্মব্য তিনি নিজেই পরে করেছেন। মুমূর্ষু একজন এভাবে দীপ্ত সাহসে দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে নিরাসক্ত উদ্বেগ ও দুর্মর আশার সংগত প্রকাশ ঘটাবেন, এ অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। তাঁদের বিস্ময় তাঁরা চেপে রাখতে পারেননি। পরে কেউ-কেউ এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। তবে সভ্যতার সংকট তিনি নিজে পড়ে শোনাননি। আচার্য ক্ষেতিমোহন সেন তাঁর পাশে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এটি পাঠ করেন। তারপরে শামিত্মদেব ঘোষের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে ‘ওই মহামানব আসে’ গান। এও সবার চেতনায় শিহরণ জাগিয়ে তাকে উত্তুঙ্গ শিখরে তুলে আনে। আজো তার আবেদন অটুট। কবি যেন, যেমন চেয়েছিলেন সেদিন, তাঁর ‘শেষ বক্তব্য দেশের কাছে বলে চুকিয়ে’ (রবীন্দ্রসংগীত, শামিত্মদেব ঘোষ, পৃ ২২৩) দিলেন। কিন্তু অশেষ তার রয়ে গেল।
স্পষ্টতই সভ্যতার এই সংকট তিনি বিস্ফোরিত হতে দেখেছেন জীবনের শেষ সীমায় এসে। ১৯৩০-এর দশকের শুরম্ন থেকেই সমগ্র বিশ্বপটে ঘটে চলে নানা উলটোপালটা ঘটনা। অনিশ্চয়তা গ্রাস করছিল আগের চেয়ে বহুগুণ ক্ষেপ্রতায় মানবজীবনে নানা দিকের বিভিন্ন কর্মকা-কে। তাদের অনেক কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রস্ত্ততিটুকুও ছিল না। মহামন্দা য়োরোপ-আমেরিকার কল-কারখানাকেই শুধু অচল করে দেয়নি, তার প্রভাব
প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে কাঁপুনি ধরিয়েছে এই বঙ্গভূমিতে, সে-সময়ের প্রধানত গ্রামীণ কর্মনির্ভর সরল উৎপাদন ব্যবস্থাতেও। মন্দায় এখানেও ব্যাংক থেকে নগদ জোগানে টান পড়ে। মহাজনেরা গ্রামে সুদের কারবারে খাটানোর যথেষ্ট প্রয়োজনীয় মূলধন পায় না। মহাজনী ঋণে সুদের হার চরচর করে বাড়তে থাকে। চূড়ামত্ম চাপ গিয়ে পড়ে প্রধানত কৃষক ও কৃষি-শ্রমিকদের ওপর। মানুষে মানুষে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া ও বিশ্বাসের জায়গায় ফাটল ধরে। সমাজ-সম্পর্কের বন্ধন শিথিল হতে শুরম্ন করে। শহরেও কাজের যা নগণ্য সুযোগ চোখে পড়ত, তা আর বাড়ে না। যেটুকু ছিল, তাতেও সংকোচন দেখা দেয়। গড়-সাক্ষরতার হার এমনিতেই শতকরা তেরো-চৌদ্দো। শিক্ষেতের হার আরো কম। তবু যারা লেখাপড়া শেখে, তারা উপযুক্ত কাজ পায় না। যেটুকু প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুযোগ-সুবিধা কেউ নিজের দখলে আছে মনে করে, সে তা অাঁকড়ে থাকতে চায়, নিজের গ–র বাইরে কারো সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে রাজি থাকে না। এতে রেষারেষি বাড়ে। সাম্প্রদায়িক চেহারা তার নগ্ন হয়ে পড়ে। এদিকে ব্রিটিশ অধিকার থেকে মুক্তির আকাঙক্ষা যা উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে শিক্ষেত মহলের একটি অংশে দানা বেঁধে উঠছিল, ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের পরিণামে তা এতদিনে নানা আকারে হাত-পা ছোড়ার পর্যায়ে চলে আসে। ঔপনিবেশিক শাসন তাতে বিভক্তি আনায় নানা কৌশল খাটাতে এতটুকু দ্বিধা করে না।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সবটুকু ওই বাসত্মবতার ভেতরে থেকে রবীন্দ্রনাথ এভাবে দেখেছিলেন, পুরো দেখা হয়েছিল বা তেমনটাই তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল কি-না জানি না। তবে তাঁর মতো করে যা অমঙ্গল, তা তিনি শনাক্ত করেছিলেন এবং তা খোলাখুলি বলায় দ্বিধা করেননি। তাঁর কালামত্মরের নানা প্রবন্ধে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট ধরা আছে। সভ্যতার সংকটে গোড়ার দিকেই তিনি এদিকে ইঙ্গিত করেন, ‘…নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমসত্ম দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখ–ত হয়ে গেছে, সেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে গভীর দুঃখের কারণ আছে।’ তাঁর এই অনুমানে কোনো অতিরঞ্জন ছিল না। বাসত্মব তার নগ্ন বিভীষিকা পরে যা দেখিয়েছে, তাঁর সৌভাগ্যই বলব, তাঁকে তার ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। তবে তার মানবিকবোধশূন্য নির্মম আয়োজনের জাল বিসত্মার তাঁর নজর এড়ায়নি। গভীর বিষাদে তিনি এখানে তাঁর দুর্ভাবনার কথা শুনিয়েছেন; মূলে দায়ী করেছেন উপমহাদেশে ‘সভ্য’ ইংরেজের দীর্ঘস্থায়ী অনিষ্টকর আত্মস্বার্থতাড়িত সুদক্ষ অপশাসনকে। আমরা পড়ি : ‘সভ্য শাসনের চালনায় ভারতবর্ষের সকলের চেয়ে যে দুর্গতি আজ মাথা তুলে উঠেছে… সে হচ্ছে ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ, যার কোন তুলনা দেখতে পাইনি ভারতবর্ষের বাইরে মুসলমান স্বায়ত্তশাসনচালিত দেশে। আমাদের বিপদ এই যে, এই দুর্গতির জন্য আমাদেরই সমাজকে একমাত্র দায়ী করা হবে। কিন্তু এই দুর্গতির রূপ যে প্রত্যহই উৎকট হয়ে উঠেছে, সে যদি ভারত শাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বসত্মরে কোনো-এক গোপন কেন্দ্রে প্রশ্রয়ের দ্বারা পোষিত না হত কখনোই ভারত-ইতিহাসের এত বড়ো অপমানকর অসত্য পরিণাম ঘটতে পারতো না।…’
অথচ এই ব্রিটিশ-শাসনে য়োরোপীয় চিত্তের তুলনাহীন বিকাশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভিযানে চমকপ্রদ সব অর্জনের সঙ্গে পরিচয়ের উন্মাদনায় শুরম্নতে যে তিনিও বিপুল আশায় উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন, একথা অকপটে স্বীকার করেই তিনি তাঁর এই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। যেমন : ‘বৃহৎ মানববিশ্বের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় আরম্ভ হয়েছে সেদিনকার ইংরেজ জাতির ইতিহাসে।… দিবারাত্রি মুখরিত ছিল বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষা প্রকাশের তরঙ্গভঙ্গে। নিয়তই আলোচনা চলত সেক্সপিয়রের নাটক, বায়রণের কাব্য নিয়ে, এবং তখনকার পলিটিক্সে সর্বমানবের বিজয় ঘোষণায়।…’ তিনি আরো দেখেছেন, যাঁরা স্বজাতির জন্য, বিশ্বমানবতার জন্য ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে প্রাণপণ করছিলেন (যেমন, মার্কস, অ্যাঙ্গেলস, আমাদের রামমোহন রায়), তাঁদের অকুণ্ঠে আশ্রয় দিয়েছিল ইংল্যান্ড। মনুষ্যত্বের এই মহৎ রূপ সেদিন তাঁকে অভিভূত করেছিল। শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্বীকার করে নেওয়ায় তিনি কোনো সংকোচবোধ করেননি। এও তিনি বলেন, ‘সিভিলাইজেশন’ বা ‘সভ্যতা’র কোনো ব্যবহারিক ধারণা বা আকারের ঐতিহ্য আমাদের চেতনায় আগে ছিল না। এখানে ছিল মনুসংহিতার দাপট, তা কেবল সামাজিক বিধি-নিষেধের বন্ধন, কালের ধারায় মানবযাত্রায় সেইসব বন্ধনের অনেকই পেছনে টানে, অথবা অমানবিক নিষ্ঠুরতা কিংবা অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়। এসবের প্রেক্ষাপটে চিমত্মার মুক্তি, এমনকি ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্যেও, ইংরেজদের সহগামী হওয়ায়, এমনকি আদর্শ মানায়, রবীন্দ্রনাথ তখন আপত্তির কিছু দেখেননি, বরং এতে তিনি উৎসাহীই ছিলেন।
কিন্তু তিনি বলেছেন, একসময় ‘ছেদ আরম্ভ হল কঠিন দুঃখে। প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিত রূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কী অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।’
আগে তিনি লিখেছিলেন, এখনো চল তার মুখে-মুখে, ‘বণিকের মানদ- পোহালে শর্বরী/ দেখা দিল রাজদ-রূপে।’ এখানে ওই রাজদ– নিখাদ দ–র রূপটাই প্রকটভাবে ধরা দেয়। অথচ রাষ্ট্রের সভ্যশাসনের ভিন্নতর প্রয়াস তিনি দেখে এসেছেন রাশিয়ায়, যেখানে ‘জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিসত্মারের, আরোগ্য বিসত্মারের কী অসামান্য অকৃপণ অধ্যবসায়।’ নতুন-নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে শিল্প-বিপস্নব গ্রেট ব্রিটেনে সমৃদ্ধির দরজা খুলে দিয়েছে, অথচ এই উপমহাদেশে তার ছিটেফোঁটা প্রয়োগও খুব কম চোখে পড়ে। আফিম খাইয়ে চীনকে তারা বিবশ করে। এতে বিষম বাণিজ্যের দখল সেখানে তাদের কায়েম হয়, একচেটিয়া ব্যবসার স্বার্থে উপকূলীয় কোনো-কোনো বন্দরের কর্তৃত্বও তারা ছিনিয়ে নেয়। একই রকম প্রযুক্তিসফল জাপান হামলা চালায় চীনে। ওদিকে তাঁর আর্ত উদ্বেগ, সমসত্ম য়োরোপে বর্বরতা কী রকম নখদমত্ম বিকাশ করে বিভীষিকা বিসত্মার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগমত্ম থেকে দিগমত্ম পর্যমত্ম বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে। স্পষ্টতই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার ভেতর থেকে ফুঁসে-ওঠা মনুষ্যত্ববোধহীন নির্বিবেক আগ্রাসী উন্মত্ততাকে। ওই সময়ে সভ্যতার সংকটের কারণকে তিনি চিহ্নিত করেন সেখানেই।
এবং এই ভূখ–র দিকে তাকিয়ে তাঁর ঋষিদৃষ্টিতে সেই সংকটের পরিণাম তিনি দেখেন, আর শিউরে ওঠেন, ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে ত্যাগ করে যাবে, কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে?’
তারপরেও তিনি ভরসা রাখতে বলেন। আশা করে থাকেন, ‘পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে…’ এ-কোনো ভবিষ্যৎদৃষ্টি নয়, বাসত্মবের কালরেখায় আগামীর যৌক্তিক সম্ভাবনাও নয়, প্রাজ্ঞ সদৃষ্টির শুধু কল্পনায় বিসত্মার। আমাদের মনে এতে আশা জাগে, শক্তি জাগে, কিন্তু ইতিহাসের নির্মাণে এ সহায় হয় না। তিনি অবশ্য ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের সময় গেয়েছিলেন, ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে -।’ বুক বেঁধে দাঁড়ানোর আহবানও জানিয়েছিলেন। এখনো আমরা
সেসব গাই। আশাই আশার বীজ বোনে। এবং তারই অনুরণনে তিনি যোগ করেন, যা এখন প্রবাদতুল্য চিরমত্মনতা পেয়েছে, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যমত্ম রক্ষা করব।… মনুষ্যত্বের অমত্মহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।’ ভাষণের সমাপ্তিতে সমবেত কণ্ঠ সমস্বরে গেয়ে ওঠে, ‘ওই মহামানব আসে – ’
কদিন আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য মিস এলিনর র‌্যাথবোন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এই উপমহাদেশ কেন তাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধামত্ম নিচ্ছে না, এই অভিযোগ তুলে এক অপমানজনক খোলা-চিঠি লেখেন। কবি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় এক কড়া জবাব দেন, – ‘অহ রসঢ়বৎঃরহবহঃ পযধষষবহমবঃড় ড়ঁৎ পড়হংপরবহপব’. এই জবাব তখন খুবই আলোড়ন জাগিয়েছিল। নববর্ষের পরদিন সকালে তাঁর ঘরে অনেকে এসে জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা সভ্যতার সংকট ও তাঁর ওই চিঠির জবাব নিয়ে তাঁদের খুশি হওয়ার কথা জানালে কবি বললেন (রানী মহলানবিশের বাইশে শ্রাবণ থেকে টানা উদ্ধৃতি দিচ্ছি) :
‘কি করি বলো? যদিও এইরকম শরীর বলে আজকাল ইচ্ছা করে না কিছু পরিশ্রম করতে; কিন্তু ওই রকম মমত্মব্য তো মাথা পেতে নিতে পারি না, তাই বাধ্য হয়ে বলতে হ’ল আমার যা মনে ছিল।
‘এরা সভ্য জাত। আজ দুশো বছরের পরারষরুবফ রাজ্যশাসনের ফলে দেশে না আছে অন্ন, না আছে বস্ত্র, না আছে স্বাস্থ্য, না আছে শিক্ষা, এমনকি একটুখানি তৃষ্ণার জল তাও আমরা পাইনি, কিন্তু পেয়েছি শুধু ষধধিহফ ড়ৎফবৎ, এবং তার সঙ্গে র‌্যাথবোনের মতো ইংরেজের দাম্ভিক মমত্মব্য। এ যে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে – এ সহ্য করবো কী করে? তোমরা ত দেখনি, কিন্তু আমি দেখেছি এ দেশের গ্রামে গ্রামে মানুষের জলের জন্যে কী কষ্ট। জমিদারিতে যখন ছিলুম তখন দেখেছি, এমনকি পাঁচ মাইল দূর থেকেও মেয়েরা কলসী কাঁখে নদীতে আসছে এক কলসী জল নিয়ে যাবে বলে। আমি চোখে দেখেছি মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেই কাদা গোলা জল মানুষকে গামছা দিয়ে ছেঁকে কলসীতে ভরতে। কী করবো ‘ল এ্যান্ড অর্ডার’ দিয়ে, তার বদলে যদি এই দারম্নণ গ্রীষ্মের দিনে পিপাসায় ছাতি ফেটে মরে যেতে হয়? আগে সবাইকে নির্দোষ খাবার জল দাও তারপরে কথা বোলো।
‘এদের লজ্জা করে না নিজেদের সিভিলাইজড গভর্নমেন্ট বলতে? আমার ত এই জলকষ্টের কথা মনে করলে সমসত্ম শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, মনে হয় হাতে যদি বন্দুক থাকে দিই একেবারে গুড়ুম – ’ – উত্তেজনায় আর কথা বলতে পারলেন না, ঝর ঝর করে চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়লো।’
রানী মহলানবিশ তারপরে লিখছেন,
‘কবিকে কখনও এরকম উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে শুনিনি। মনে যাই থাক, কথা যখন বলতেন খুব শামত্ম হয়েই বলতেন। এখন বোধহয় শরীরের দুর্বলতার জন্যে বিদ্রোহী মনোভাবকে সংযত করে রাখতে পারলেন না। গ্রামের লোকদের জন্যে বহুদিনের সঞ্চিত অমত্মরবেদনা আজ চোখ দিয়ে ঝরে পড়লো। সত্মব্ধ হয়ে বসে সেই মরণপথ যাত্রী অশীতিপর বৃদ্ধের দুঃখীজনের বেদনায় ব্যথিত মনের প্রকাশ দেখলাম। সেই কথা বলতে বলতে মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে, উত্তেজনায় সমসত্ম শরীর কাঁপছে এবং হঠাৎ গলার স্বর বন্ধ হয়ে গিয়ে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ল – এ ছবি কোনদিন ভুলবার নয়।
‘রবীন্দ্রনাথ শেষ বেলাতেও সভ্যতার সংকট কেন লিখলেন তা সেদিন খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম।’ (পৃ ১০৭-১০৮)
আমাদেরও এ গভীরভাবে নাড়া দেয়। নিজেদের দিকে ফিরে তাকাই। সংকটের মূলে যে ছিল সেদিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক
শাসন-শোষণ এবং তার নির্মমতা তাঁর ভেতরেও যে কী অসহায় ধিক্কার জাগায়, তা শুধু সামত্মবনাহীন ক্ষক্ষাভের সঙ্গে নয়, প্রতিটি বাক্যে অমত্মরের বিশুদ্ধ মানবিক আকুতি পুরে তিনি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছেন। ঘৃণাহীন প্রতিবাদের সাহিত্যে এ চিরকাল মানুষকে প্রেরণা জোগাবে। আমরাও এক সত্য-সমৃদ্ধ উচ্চারণের গৌরবময় উত্তরাধিকার বয়ে চলব। এর আগে ১৯১৭-তে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা– বিবেকের তাড়নায় একক সিদ্ধামেত্ম ব্রিটিশ রাজের নাইটহুড সম্মান অবলীলায় বর্জন করে তিনি যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তা গোটা বিশ্বের প্রতিবাদ সাহিত্যে অমর হয়ে আছে। সভ্যতার সংকটও মানবিক দায়বোধের একই রকম উদাহরণ।
তারপরেও কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকে যায়। এর সত্য কি স্বয়ং প্রকাশ, না কি তা সমকালীন বাসত্মবতার প্রেক্ষাপটে পক্ষপাতমূলক? তাঁর সদিচ্ছায় কোনো খাদ নেই। কিন্তু পূর্ণদৃষ্টির প্রসাদ কি তাতে আছে? না কি তা তুচ্ছ-প্রাণের আকিঞ্চন শুধু? কবির এই অসামান্য কীর্তির সদিচ্ছাকে এতটুকু খাটো না করেও এই প্রশ্নগুলির এবার মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করি। কাজটা সহজ নয়। নিজেকে এখানে সচেতনভাবে ধারাবাহিক কর্মকা–র প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে হয়। তারপরেও প্রত্যক্ষের প্ররোচনা থাকে। থাকে ভালো-মন্দ বিবেচনাও। তা চলমান সময়ের একখ– জীবনযাপনেরই পরিণাম। তবু একবার বোঝার চেষ্টা করি।

তিন
সভ্যতার সংকটের পশ্চাৎপটে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, এই বিভাজনের এক মানস-মানচিত্র, মনে হয়, ধরে নেওয়া আছে। এই উপমহাদেশ যেন প্রাচ্যের প্রতিনিধি, যেমন পাশ্চাত্যের গ্রেট ব্রিটেন। পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক অধিকার, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে, বিসত্মৃত গোটা
প্রাচ্য-ভূখ–। ব্রিটিশ শাসনের এক পর্বে এই উপমহাদেশে তার সুফল যে কিছু মেলেনি, তা নয়। কিন্তু তার শোষণের আবরণ আর নেই। প্রকট করাল নখদাঁত মেলে আগ্রাসনের উৎকট উন্মত্ততায় প্রাচ্যকে তা খুবলে খেয়ে ছিবড়ে করে ফেলছে। মনুষ্যত্বের অপমান চরমে গিয়ে পৌঁছোয়। বিজেতা ও বিজিত, উভয়েরই পতন ঘটে। ছিটকে পড়ে তারা পথের দুধারে। অথবা ক্রমবিকাশের পথই রম্নদ্ধ হয়ে যায়। এভাবেই সংক্রামিত তখন সভ্যতার সংকট। তা গ্রাস করে য়োরোপের মূল ভূখ-কেও। বলদর্পীর হামলার মুখে গোটা য়োরোপ ল-ভ-। অবশ্য মহাযুদ্ধের সূচনা ঘটে এশিয়াতেই – জাপানের চীন আক্রমণে। তারপরে যূথবদ্ধ জার্মানি, ইতালি ও জাপানের রণোন্মত্ত অগ্রাভিযান প্রতিহত করতে দুই গোলার্ধে একজোট হয়ে নামে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং পরে রাশিয়া ও আমেরিকা। বিশ্বযুদ্ধের তা-ব যখন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, গোটা য়োরোপই যখন তার কবলে এবং যুদ্ধের বাইরে যারা, তারাও যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অগ্নিমূল্যে তার পরোক্ষ শিকার, এরকম বাসত্মবে ধ্বংসযজ্ঞের প্রাত্যহিক বার্তার অভিঘাতে জর্জরিত কবি তখন তাঁর ন্যায়শুদ্ধ আক্ষেপ অবিচলিত দৃঢ়তায় উগড়ে দিতে এতটুকু দ্বিধায় ভোগেননি তাঁর এই চেতনাদীপ্ত ভাষণে। এবং তারপরেও আস্থা রাখেন মানুষেই। কারণ, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ তবে আমরা দেখি তাঁর প্রশামিত্ম বিপর্যসত্ম। প্রথম মহাযুদ্ধকালে, অথবা, তার পরে, এমনটি দেখিনি। শমন এবার সত্যিই শিরে দাঁড়িয়ে। তাঁর নিজের, এবং তিনি দেখেন তাঁর আশঙ্কায়, গোটা বিশ্বের, যদিও মানুষের বেলায় উদ্ধারের পথ যদি খোলা থাকে, তবে তা ওই মানুষেরই হাতে। সেখানেই তাঁর নির্ভরতা। তাঁর ‘বিশ্বাস’। আমরা জানি, বিশ্বাস কোনো যৌক্তিক সিদ্ধামত্ম হয় না। অবরোহী পন্থায় সিদ্ধামেত্মর ভিত্তি হতে পারে। তবে সে-ভিত্তিও তর্কাতীত হওয়া আবশ্যক। কবির কাছে এখানে, মনে হয়, বিশ্বাসের প্রয়োজনটাই বড়। এবং তা তিনি আর্তমানুষের হয়ে অাঁকড়ে ধরেন। প্রসঙ্গটি পরে আবার আলোচনায় আসবে। তার আগে অন্য কিছু কথা সেরে নিই।
বৃহৎ মানববিশ্বকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, এই দুভাগে ভাগ করে দেখার একটা অভ্যাস আমাদের ভেতর চালু আছে। এর শুরম্ন বর্তমানে অবসিত য়োরোপকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্ভবের সময় থেকে। পৃথিবী গোল। চবিবশ ঘণ্টায় একবার সূর্যকে প্রদক্ষেণ করে। কাজেই এখানে আপনা থেকে কোনো পুব-পশ্চিম আসে না। মানুষ তার সুবিধামতো একটা কেন্দ্রভূমি ধরে তার দুপাশে পুব-পশ্চিমের বিসত্মার নির্ধারণ করেছে। তখন সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ব্রিটিশের। কাজেই তার গ্রিনউইচ মানমন্দিরকে প্রারম্ভিক বিন্দু ধরে তার পূর্বে ১৮০ ডিগ্রি ও পশ্চিমে ১৮০ ডিগ্রি ধরে মোট ৩৬০ দ্রাঘিমারেখায় ভূপৃষ্ঠকে একই সময়ে এক সাধারণ মানে চেনার ব্যবস্থা করা হয়। এর প্রয়োজন পড়ে, কারণ পৃথিবী গোল বলে, এবং সবসময় ঘুরছে বলে স্থির অবস্থায় সূর্য থেকে এর পিঠে সব জায়গায় একসময়ে একভাবে আলো পড়ে না। আমরা যদি সবচেয়ে পুবের জায়গাটা নিজেদের পছন্দমতো একবার নিশ্চিতভাবে ঠিক করে নিই, তবে পুরো একচক্কর ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবী সূর্যকে ঘোরা পূর্ণ করলে পুব থেকে পশ্চিমে প্রতি কল্পিত দ্রাঘিমারেখা পার হতে সূর্যের আলোর লাগে চার মিনিট করে সময়। এভাবে ধরে নিলে জাপানে যখন সূর্যের প্রথম আলো পৌঁছোয়, তার ছয় ঘণ্টা পরে তা পৌঁছোয় আমাদের ঢাকায়, আরো ছয় ঘণ্টা পরে লন্ডনে। অবশ্য উত্তর-দক্ষেণেও অনুরূপ হিসাব আছে। গোল পৃথিবীতে সব জায়গায় সব দিনে সমপরিমাণ আলো পৌঁছোয় না। ঠিক মাঝখানে প্রতিদিন আলো-অন্ধকার সমান। ওপর-নিচে ঋতু বা কাল অনুযায়ী সূর্যের সঙ্গে দূরত্বের কম-বেশির ওপর নির্ভর করে দিনের আলোকিত অংশ বাড়ে-কমে। সেই অনুযায়ী উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল, দক্ষেণে তখন শীতকাল। আবার সূর্যের আলো যখন বিপরীতভাবে পড়ে, তখন উত্তর-দক্ষেণেও ঋতু বদলে যায়। বিষুবরেখা থেকে যত উত্তরে বা দক্ষেণে যাই, তত দিনের আলো-অন্ধকারের পরিমাণ বিপরীতভাবে বাড়ে ও কমে। এ-কারণে উত্তর ও দক্ষেণ মেরম্নতে বছরে টানা ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত। তবে উত্তর মেরম্নতে যা, দক্ষেণ মেরম্নতে তার উলটো।
এত কথা বলার কারণ এই যে, প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে
মানব-বসতিতে মেধার তারতম্যের কোনো কারণ নেই। কর্মোদ্যোগে ও নৈসর্গিক তাগিদে কেউ কখনো তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোয়, কেউবা তা না করে পিছিয়ে পড়ে। মানবসভ্যতার ইতিহাসেও দেখি, লন্ডনকে ঘিরে য়োরোপকেন্দ্রিক যে পাশ্চাত্য, তার উত্থান আজ থেকে পাঁচ-ছয়শো বছর আগে। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে তা অমত্মর্ভুক্ত করেছে আরো পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আগামীতে প্রভাববলয় তৈরি হতে পারে এশিয়াতেও। অবশ্য জনসংখ্যার বিস্ফোরণে তার সঙ্গে তাল মেলাতে আকস্মিকতার সম্ভাবনাও থেকে যায় সবসময়। তবে শুধুই সদিচ্ছা কোনো সমাধানের পথ দেখায় না। তা যদি রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো বিরল প্রতিভার হয়, তাও না। গত অর্ধসহস্রাধিক বছর ধরে পাশ্চাত্যের উত্থানের পেছনে অমত্মত কটি ঘটনাকে আমরা নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারি। এক. রেনেসাঁস (ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী), যা মধ্যযুগীয় ধর্মতান্ত্রিক অনুশাসনের বন্ধন থেকে মনকে মানবমুখী সৃষ্টিশীলতার দিকে টানে, যা প্রধানত চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও সাহিত্যে নতুন প্রাণের জোয়ার আনে; দুই. ধর্ম সংস্কার, যা মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে (১৫১৭) মানুষ ও ঈশ্বরের মাঝখানে পোপের অধিকারকে অস্বীকার করে চার্চকেই নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে প্রবল জনজোয়ারের জন্ম দেয়, প্রায় একই সঙ্গে কেলভিন পরিপূরক হিসেবে যোগ করেন, দারিদ্র্য কোনো গৌরবের বিষয় নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সৎভাবে অর্থোপার্জন কোনো অপরাধ নয়, বরং তা মানবসমাজকে কল্যাণের পথ দেখায়। এরকম পরিবেশেই কেপলার কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন ও ডিকার্টেসের মতো বিস্ময়কর বিজ্ঞান প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের তত্ত্বভূমি থেকে মানুষের উৎপাদন-ক্ষমতা বাড়ানোর বিবিধ সরঞ্জামের দেখা মেলে; ফ্যারাডে বিদ্যুৎকে
ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পথ দেখান। রেল ও স্টিম ইঞ্জিনের উদ্ভাবন উৎপাদনকে শিল্প-বিপস্নবের দোরগোড়ায় নিয়ে আসে। নানাভাবে এসবের মিশ্রণ ঘটে সমরসজ্জায় ও নৌশক্তির উত্থানে। এবং তিন. ফরাসি বিপস্নব ও তার অনুষঙ্গী সমাজবিপস্নবের ধ্যান-ধারণা গণমানুষের মুক্ত ইচ্ছাকেই রাষ্ট্রনির্মাণের মৌলিক উপাদান ও চালিকাশক্তি করে তোলে। সব মিলিয়ে ঘটে নতুন জ্ঞানকা– য়োরোপের উত্থান। গুণগত দিক থেকেও তা তার শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন রাখতে শুরম্ন করে।
তার মানে এই নয়, গোটা য়োরোপের সব মানুষ উন্নততর জীবনযাপনের অধিকার পেয়ে যায়, বা, তাতে অভ্যসত্ম হয়। রেনেসাঁস কোনো গণজাগরণের পরিণাম নয়। প্রধানত ইতালিতে ঘটে চিত্রকলায় মানুষী সম্ভাবনার অলজ্জ সুষমায় বিস্ময়কর উদ্ভাস। মুখের ভাষায় মানব-চৈতন্যের উদ্বোধনের আকুতি সাহিত্যের অমরতায় উঠে আসে গোড়ার দিকে ইতালিতে দামেত্মর ডিভাইন কমেডিতে, শেষ প্রামেত্ম ইংরেজিতে শেক্সপিয়রে। কালের ভাবনাকে তাঁরা যেমন আত্মস্থ করেন, তেমনি তাকে বিপুল বিশ্বে মুক্তি দেন। রিফর্মেশন কিন্তু ঢেউ তোলে গণমানুষের কর্মতৎপরতায়।
ক্যাথলিক চার্চের পোপ-নির্ভর মৌরসি পাট্টা অচল হয়ে পড়তে থাকে। প্রটেস্ট্যান্ট ঝড় অপ্রতিরোধ্য বয়ে যায়। অবচেতনে ক্ষেত্র প্রস্ত্তত হয় ফরাসি বিপস্নবের ও শিল্প-বিপস্নবের। দাম অবশ্য দিতে হয় মানুষকে দুটোতেই। অতিরিক্ত চড়া দাম। জীবনের অনিশ্চয়তা বাড়ে বই কমে না। জনসংখ্যার বেশিরভাগের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি মেলে না। ওদিকে অর্থ-পুঁজি-বিত্ত-ব্যবসা রমরমিয়ে বাড়ে। ভাগ্যান্বেষী যারা তাল মেলাতে পারে না, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাকাতি-রাহাজানি থেকে পাল-তোলা জাহাজে সমুদ্রপথে দূরদেশের বন্দরে-বন্দরে বাণিজ্যে। ডিকেন্স, জোলা, ব্যালজাক – এঁদের সাহিত্যে এই অস্থির জীবনের সত্য ছাপ ধরা পড়ে। সুখ-শামিত্ম বাড়ে না। কিন্তু মানুষ এগোয়। য়োরোপ বিশ্ব-শাসনের অধিকার আদায় করে। একক শক্তি হিসেবে একমুখী অভিযানে নয়, নিজেদের ভেতরেও প্রভুত্ব নিয়ে পরস্পর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালিয়ে গিয়ে।
এটা মনে করলে ভুল হবে, অমত্মত উনিশ শতক পর্যমত্ম এই উপমহাদেশে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন-অবস্থা তুলনীয় য়োরোপীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় হীন ছিল। উষ্ণম-লীয় অঞ্চলে কৃষি প্রাচুর্য, সরস ফলমূল-শাকসবজির যথেচ্ছ প্রাপ্তিযোগ্যতা, পশুপালনের অবাধ প্রামত্মর, ছায়াঘনশ্যাম বনানী ও সহনীয় জনসংখ্যা এখানে পরিবর্তনের কোনো তাগিদ সৃষ্টি করেনি। জন্ম-মৃত্যু ভাগ্যের বিধান বলে এ-নিয়ে কোনো ভাবনা-চিমত্মার সৃষ্টি হয়নি। তাছাড়া বাসত্মব আয়োজনেও রানী প্রথম এলিজাবেথের আমলের ইংল্যান্ডের চেয়ে সমসাময়িক সম্রাট আকবরের কালে এই উপমহাদেশ বেশি সমৃদ্ধ ছিল। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে তখন থেকে য়োরোপ যেভাগে এগিয়েছে, আমরা তা পারিনি। তার চেষ্টাও করিনি। কারণ, তা প্রয়োজন বলে মনে হয়নি। তফাতটা তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই। তা নইলে পুব-পশ্চিমের ব্যবধানের কোনো প্রকৃতিগত ভিত্তি ছিল না। তার আগের মানব-ইতিহাসে য়োরোপই বরং ছিল স্টেপভূমি, পারস্য বা অটোমান সাম্রাজ্যের তুলনায় অধমর্ণের জায়গায়। উপমহাদেশ
বা চীন হিসাবের ভেতরে আসে না। কারণ তারা তখন বহির্মুখী হয়নি, যদিও মোঙ্গল বা তুর্কি-আফগান শক্তি তাদের ওপর বারবার দাপট দেখিয়েছে।
তাহলে সভ্যতার সংকটে কবির আমত্মরিক উদ্বেগ ও দ্ব্যর্থহীন প্রতিবাদ যথার্থ ফুটে উঠলেও আমরা কি একে সমূহ সর্বনাশের হুঁশিয়ারি বলে সমুচিত গুরম্নত্ব দিয়ে এর দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করব? মানবভাগ্যের ওপর বিপর্যয়, তারপর বারে-বারে নানাভাবে নানা জায়গায় নেমে এসেছে। আমরাই দেখেছি ১৯৪৩-এ বঙ্গভূমিতে শাসকশক্তির কারসাজিতে মানুষের তৈরি মর্মামিত্মক দুর্ভিক্ষ, দেখেছি দেশভাগ উন্মূল মানুষের নরকযাত্রার হাহাকার, পার হয়েছি মুক্তিযুদ্ধে দুঃখ-বরণের অভিজ্ঞতা, সাক্ষী থেকেছি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু-নিধনের, কারাপ্রাচীরের নিরাপত্তার ভেতরে চার জাতীয় নেতার নজিরবিহীন হত্যারও। সংকটই কি তবে ধ্রম্নব? এবং তার বিসত্মার মুছে ফেলছে সভ্যতার সব দিকচিহ্ন?
আগেই বলেছি, কবি যে পর্বে সভ্যতার সংকট নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, সেই পর্বেও চলমান জীবনে বিবিধ রসের আরাধনা করেছেন। এ কেবল অভ্যাসের দাসত্ব নয়,
বিশ্ব-সংসারে রসের স্রোত অমত্মহীন অনুসরণ। ধারা তার অনিঃশেষ। তবে তিনি যে আশা করেছিলেন, ‘পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে’ – তাতে অতীত মায়ার পুনরম্নজ্জীবন আছে, আমরা অনুপ্রাণিত হই, কিন্তু বাসত্মব সেভাবে তার পুনরাবৃত্তি ঘটায় না। ইতিবাচক যা পাই, তাতে
পুব-পশ্চিমের বিগত যুগের বিভেদ ক্রমশ ক্ষয়ে আসে। আশা-নিরাশা,
পাওয়া-না-পাওয়া সবই সর্বজনীন আকার পেতে থাকে। পেনিসিলিনেরও অনুরূপ জীবনদায়িনী ওষুধের প্রাপ্তিযোগ্যতা মানুষের আয়ু দীর্ঘতর করায় সব জায়গাতেই সহায় হচ্ছে। ‘আনন্দ-উজ্জ্বল’ কতটা হচ্ছে, তার অবশ্য হিসাব পাওয়া দুষ্কর। কবি তাঁর জীবৎকালে এই ভূখ– সাক্ষরতার হার দেখে গিয়েছিলেন শতকরা পনেরোর আশেপাশে। এখন বাংলাদেশে তা অমত্মত চারগুণ বেড়েছে। কৃষিতে এসেছে নতুন উদ্ভাবনী কৌশল। যে কোনো ফসলের ফলন বেড়েছে অমত্মত দ্বিগুণ। মোট ফলন সে-সময়ের তুলনায় অমত্মত চারগুণ। পরনের কাপড় আর শুধুমাত্র কার্পাস তুলোর ওপর নির্ভর করে নেই।
সিন্থেটিক কাপড় আর এ নিয়ে অভাব বুঝতে দেয় না। আঠারো-উনিশ শতকে শিল্প-বিপস্নবের পর গত শতকের শেষভাগে তথ্য-প্রযুক্তি-বিপস্নব এখন মানবজীবনের প্রেক্ষাপট বদলে দিতে শুরম্ন করেছে। আমরাই তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছি। ঔপনিবেশিকতার যুগের অবসান ঘটেছে। ‘আত্মশক্তি’ কে কীভাবে বাড়াবে তার দায় এখন তাদের ওপরেই বর্তায়। বাইরের নাক-গলানো একটা গুরম্নতর বিষয় অবশ্যই। তবে কোথাও গণপ্রজাতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যদি সক্রিয়ভাবে গড়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাবালকত্ব পায়, তবে এ-বিষয়ে সিদ্ধামত্ম নেওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার দাবি করতে পারে তারাই। সব সিদ্ধামত্ম পুরোপুরি সঠিক হবে না। কোনো জায়গাতেই না। অতীতেও
কোথাও তা ঘটেনি। এটাও মনে রাখি, প্রকৃতির দান যা পাই, তার ওপর কিছু যোগ করতে গেলে কাউকে না কাউকে তার দাম শুধতেই হয়। এইখানে আসে মানুষের ন্যায়-ভাবনার কথা। শুধু একজনের নয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ সবটা মিলে।
‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরূপতা অবশ্য প্রবল। এবং এই ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ প্রাতিষ্ঠানিক নৈর্ব্যক্তিকতারই প্রতিফলন। তবে শাসন-কাঠামো যদি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সামাজিক বৈষম্য কমাতে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থার বিকল্প নেই। অবশ্যই এটুকু যথেষ্ট নয়, তবে প্রাথমিক প্রয়োজনীয় শর্ত বটে। উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা প্রজার হিতসাধনকে তার মূল লক্ষ্য কখনো করেনি। তেমন দাবিও তাদের ছিল না। তারপরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে একটা ব্যবস্থা তো তারা দাঁড় করিয়েছিল। তার নৈর্ব্যক্তিকতাকে অমত্মত অস্বীকার করা যায় না। এর বিকল্প যদি হয় গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থা তবে তার অজ্ঞতা ও ভয়াবহতার কথা ভেবে শিউরে উঠতে হয়। এখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে তাদের স্বার্থে হলেও রেললাইন পেতে গোটা ভূখ– এ-মাথা থেকে ও-মাথা, পুবে-পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষেণে, যোগাযোগ চালু হয় ১৮৭০-এর দশকে। য়োরোপেই তা তখন সব জায়গায় চালু হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম
মহিলা-গ্র্যাজুয়েট যখন বের হন – ১৮৮০-র দশকে – তখন খোদ গ্রেট ব্রিটেনেই কোনো মহিলা গ্র্যাজুয়েট হননি। বিষয়গুলো এখানে অাঁকাবাঁকা পথে পরস্পর স্বার্থবিরোধী উদ্যোগ নিয়ে হলেও একাধিক জাতীয় চেতনা জাগিয়ে তোলে। তার কল্পনাও কি করতে পেরেছি আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আগে? আবার বলি, এ ওই শাসনের কোনো সাফাই গাওয়া নয়। তাদের অন্যায় দুঃশাসন ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু আইনশৃঙ্খলার অাঁটোসাঁটো নৈর্ব্যক্তিক ব্যবস্থা তারা যে চালু করে, তা আমাদের যতটা ক্ষতি করে, তার চেয়ে উপকার করে বেশি। তখন কোনো গ্রামে জলকষ্ট দেখা দিলে তার জন্যে শুধু ব্রিটিশ রাজ নয়, স্থানীয় জমিদাররাও ছিল সমান দায়ী। এবং এই জমিদারি-রাজত্বের সূত্রপাত চিরস্থায়ী বন্দোবসেত্ম নয়, মুরর্শিদকুলী খাঁর রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায়। দায় যার ঘাড়েই পড়ুক, তা ছিল সর্বাংশে অন্যায়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষক্ষাভ আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি যে এই জলকষ্ট দূর করতে জমিদারি চালানোর সময় উদ্যোগী হয়েছিলেন, তা আমরা জানি। কিন্তু সফল যে হননি, তাও তিনি জানিয়ে গেছেন।
কবি নিজেই আগে বলেছেন, ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর-পন্থা
যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।’ সংকট তাই তাঁর চেতনালোকে আকস্মিক নয়। রাজা নাটকের অমিত্মম দৃশ্যে পড়ি :
সুদর্শনা।… তুমি সুন্দর নও প্রভু, সুন্দর নও, তুমি অনুপম।
রাজা। তোমারই মধ্যে আমার উপমা আছে।
সুদর্শনা। যাবার আগে আমার অন্ধকারের প্রভুকে, আমার নিষ্ঠুরকে, আমার ভয়ানককে প্রণাম করে নিই।
সুদর্শনা যেন সভ্যতার সংকটে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অথবা তাঁর মতো কোনো ব্যক্তি। আর, রাজা, কাল থেকে কালামত্মরে মানবযাত্রার মূলীভূত সত্তা। যত দুঃখ-কষ্ট-বেদনা থাক, তার অগ্রযাত্রায় বিরাম নেই। তার প্রতিই আস্থা রবীন্দ্রনাথের। মনে করেন, সে ‘বিশ্বাস হারানো পাপ’। ইতিহাসের ধারায় এভাবে যদি না দেখি, তবে তাঁর ওই ‘বিশ্বাস’ খাপছাড়া হয়ে মূল্য হারায়। একথা বলায় মানব-বিশ্বে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা যে কমছে, তা মেনে নেওয়া হচ্ছে না। তাদের বিসত্মার বরং বাড়ছেই। বাড়ছে বহুমুখী অনিশ্চয়তা। মানুষ যে তাদের মুখোমুখি হতে পারছে, সামষ্টিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে না, বরং
নতুন-নতুন উন্নততর সম্ভাবনার পথ খুলে দিচ্ছে, এতেই ওই ‘বিশ্বাস’ এখনো টিকে থাকছে।
তবে রবীন্দ্রনাথের কালের বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব-সম্পর্ক এখন আর নেই। প্রকৃতিকে স্থানচ্যুত করে মানুষ যেভাবে তার বসতির বিসত্মার ঘটিয়ে চলেছে, যেভাবে বনভূমি-গাছপালা নদী-নালা সব সেই আগ্রাসনে ক্রমাগত ক্ষয় পাচ্ছে, তাতে জীব-জগতের আদর্শ ভারসাম্য থেকে তা অনেক দূরে সরে এসেছে। আরো কোণঠাসা হলে প্রকৃতি হয়তো প্রতিশোধ নেবে তার বিলুপ্তির বা বিকৃতির উচিত মূল্যেই। হতে পারে সে-দাম বড় চড়া। সভ্যতার প্রকৃত সংকট বোধহয় অপেক্ষা করছে সেখানেই। অবশ্য যদি আমরা এখনো এ-বিষয়ে সচেতন না হই। শেষ গদ্য-বাণী উচ্চারণে নয়, গোটা জীবনের সৃষ্টিশীল রচনায় ও উন্নয়নের কর্মকা– রবীন্দ্রনাথ সেদিকে আমাদের চিমত্মাকে আকর্ষণ করেছেন বারবার। সভ্যতার সংকট পড়ার সময় তাঁর ওইসব কাজের নির্দেশনা যেন আমাদের ভাবনাবৃত্তের বাইরে চলে না যায়। ৎ