পুরানো সেই দিনের কথা

পুরানা পল্টনের মোড় ঘুরে রাস্তা যেখানে হাইকোর্টমুখী, সেখান থেকে আমাদের বাসরুট। উত্তরদিকে সবুজের সমারোহ। সিদ্ধেশ্বরী, মালিবাগ একেবারেই জনাকীর্ণ। সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলের সামনে দিয়ে ছোট্ট এক চিলতে রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। চলন্তিকা চায়ের আসর পেরিয়ে পুরানা পল্টনের মোড়ে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা। এক সময় নবাবপুর রেলগেট পেরিয়ে মানসী সিনেমাহল, রথখোলা, কোর্ট-কাছারি, মুকুল সিনেমাহল, ভিক্টোরিয়া পার্ক – ভাড়া দুআনা। ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের সদর দরোজা দিয়ে ঢুকতাম না। চার্চের পাশ দিয়ে যে-গলিটা কলতাবাজার অভিমুখী সে-রাস্তা দিয়ে দু-কদম এগুলেই আর্ট স্কুলের প্রবেশদ্বার হাতের বামে। হাসপাতালের নিচের তলায় বাঁদিকে দুটো কামরা ঘিরে বাংলাদেশের চিত্রকলার অআঁতুড়ঘর। হানিফ মিয়ার বিরাট বপু, দারোয়ানসই চেহারা। আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিয়ে বাজখাই গলায় খবরটা দিতো – বড়া সাব আগয়ি। অর্থাৎ আমি লেট। প্রিন্সিপাল জয়নুল আবেদিন এসে গেছেন।

ঢাকা তখন খুবই ছোট্ট শহর। গুলিস্তান সিনেমার অস্তিত্ব নেই। ডিএফএ গ্রাউন্ড অর্থাৎ ঢাকা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মাঠ। রমনা রেস্ট হাউস, রেলওয়ে কলোনি, ব্রিটানিয়া সিনেমা, রিটজ রেস্তোরাঁ, ডিয়েনফা মোটরস আর ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের লাইব্রেরি – এই-ই ছিল পুরানা পল্টনের মোড় থেকে নবাবপুর রেলগেটের মধ্যেকার উল্লেখযোগ্য দালানকোঠা। রেলওয়ে কলোনির কয়েকটি বাড়ি ছাড়া আজ এর কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই। রোজকার দিন কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে ক্লান্ত পায়ে রমনা রেস্ট হাউসের সামনের বুকশপগুলোতে রিটজ রেস্তোরাঁয় অ্যাংলো তরুণ-তরুণীদের জটলা, ব্রিটানিয়া সিনেমার সামনে এসথার উইলিয়ামসের বেদিং বিউটি ছবির রঙিন পোস্টার, টিনে ঘেরা ডিএফএ গ্রাউন্ডে ওয়ারী রেলওয়ের খেলার তীব্র উত্তেজনা, নয়তো ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে পড়ুয়াদের নিবিষ্টমনে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটানো – কোনো ব্যতিক্রম নেই। রোজ দেখেছি। কোনোদিন ছুটির পরে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে বসে বসে দূরযাত্রীদের অপেক্ষমাণ উত্তেজনার ছবি এঁকেছি একের পর এক। খাতা ভরে তুলেছি চলমান জীবন নিয়ে। হুইলারের স্টলে বোম্বে, কলকাতা থেকে আসা ম্যাগাজিনগুলো আমাকে ভীষণভাবে টানতো। ব্রিটিশ ইনফরমেশনে বসে দেখতাম দি আর্টিস্ট পত্রিকাটি। সিনেমার দুটি সুন্দর কাগজ ছিল সিনেমাটোগ্রাফ উইকলি ও পিকচারগোয়ার।

আর্ট স্কুলের প্রথম দিন আমার এখনো মনে আছে। মনে হয় সেদিনের ঘটনা। বাবার চাকরিস্থল ময়মনসিংহে। থাকতাম আকুয়াতে। আবেদিন সাহেবের বাড়িও ওখানে। ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের ডিসট্যান্ট সিগন্যাল লাগোয়া। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট বেরোয়নি। ছবি অআঁকি – পেনসিল আর বক্সকালার হচ্ছে মাধ্যম। আর্ট স্কুলে ভর্তি হবো। বাবার আপত্তি নেই। শুধু আবেদিন সাহেবের সঙ্গে একটু আলাপ করবেন। শুনেছি, আবেদিন সাহেব আসবেন শিগগিরই। করাচিতে আছেন পাকিস্তান সরকারের ফিল্মস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের চিফ আর্টিস্ট হিসেবে। চলে আসছেন একেবারে। ঢাকা আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল হবেন তিনি। অদ্ভুত পরিবেশে আমি জয়নুল আবেদিনকে প্রথম দেখি। ইতিপূর্বে অবশ্যি তাঁর ছবির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। কাকের ছবি, দুর্ভিক্ষের ছবি। একদিন দুপুরবেলা আকুয়া মসজিদের পুকুরে গোসল করছি, হঠাৎ কে একজন আমাকে বললেন, আবেদিন সাহেবকে দেখেছো? ওই যে কানে আঙুল দিয়ে ডুব দিচ্ছেন। আমি তো হতবাক। এতো বড়ো একজন শিল্পীকে এভাবে সাধারণ পরিবেশে দেখবো ভাবতে পারিনি। একছুটে বাসায়। বাবাকে বললাম। বিকেলে আবেদিন সাহেব এলেন। আমার কাজ দেখলেন। শুধু বললেন, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।

১৯৪৯ সালের জুলাই মাসের কোনো একদিন। তারিখটা মনে নেই, আর্ট স্কুলের বারান্দায় জয়নুল আবেদিনের মুখোমুখি। ময়মনসিংহ থেকে আসছো? কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিলাম, জি। সফিউদ্দীন সাহেবকে ডেকে বললেন, একে বসিয়ে দিন। ক্লাসে ঢুকলাম। দেখলাম, একটা কলসিকে ঘিরে কয়েকজন না টুল, না চেয়ার এরকম একটা আসনে বসে আছে। সামনে বোর্ড আর কাগজ। আমিও বসলাম। পরে জেনেছি, ওগুলোকে ডঙ্কি বলে। পাশে তাকিয়ে দেখি, ছোটখাটো একজন ডঙ্কিতে বসে পা দোলাচ্ছে আর নিবিষ্টমনে কলসি অআঁকার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে ইঙ্গিতে বসতে বললো। আলাপ হলো – তিনি মুর্তজা বশীর। আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, হুমায়ুন কাদির সবাই আমরা পরীক্ষা দিলাম। রশিদ চৌধুরী টেস্ট পরীক্ষায় ফেল। মন খারাপ। পরে তিন মাস কাজ করে কাজের উন্নতির কড়ারে ভর্তি করে নেওয়া হলো। এখন মনে হয় আমরাও আজকাল টেস্ট পরীক্ষা নিই। ছাত্র ভর্তি করি। ফেল করা ছাত্রের ভর্তির সুযোগ এখন আর নেই। তখন যদি আজকের মতো অবস্থা হতো, তাহলে রশিদ চৌধুরীর মতো একজন শিল্পীকে আমরা নিশ্চয় হারাতাম। এ সমস্ত টেস্ট-ফেস্টের মূল্য কী? ভর্তি হলাম। আবেদিন সাহেব বললেন, কাল থেকে ক্লাস, চায়নিজ ইংক, ব্রাশ এগুলো কিনে নিও। বোর্ড তৈরি করে নেবে। আমি তো বেকুব। শুধালাম, চায়নিজ ইংকটা কী? আবেদিন সাহেব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখলেন, তারপর মুর্তজাকে বললেন, ওহে, এ তো দেখছি কিছুই চেনে না। তুমি একটু সাহায্য করো। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ছোট ছেলে মুর্তজা বশীর। বামপন্থী রাজনীতির গোঁড়া সমর্থক সে-সময়ে। আবার সিনেমার হিরো হবার দারুণ শখ ছেলেবেলা থেকে। হঠাৎ চোখ থেকে চশমা খুলে অশোক কুমার, দিলীপ কুমারের ঝটিতি পোজ – অবাক হতাম, মুগ্ধ হতাম। হিন্দি গানের কলি মুখে মুখে। ছবি অআঁকছে, গুনগুন গাইছে। সে-ই আমাকে দেখেশুনে সব কিনে দিলো। আমরা আর্ট স্কুলের ছাত্র হলাম।

শিক্ষক হিসেবে দেখলাম সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, সৈয়দ আলী আহসান এবং কামরুল হাসানকে। কামরুলভাইকে খুব নিকট মনে হতো। মুকুল ফৌজে থাকাকালীন তাঁকে দেখেছি। আর বয়সের দিক দিয়েও তরুণ। তাজা, টগবগে। কামরুলভাই আমাদের স্কেচ দেখতেন। রোজ স্কেচখাতা খুলে টেবিলে জমা দিতে হতো। ক্লাসে এসে কামরুলভাই খাতা দেখতেন এক-এক করে। ডাকতেন, ভুলভ্রান্তি দেখিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন আউটডোর স্কেচে। বুড়ো শিবের মন্দির, নয়তো রমনা রেসকোর্সের কোনো পুরনো বটগাছের গোড়ায়। স্কেচিং টুল পেতে কামরুলভাই বসতেন, আমরা অআঁকতাম। কলেজে দুবছর পর আমাকে নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হতো। বাবা সব ভাইবোনের পড়ার খরচ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। কমার্শিয়াল কাজ করার ইচ্ছে। কামরুলভাইকে দেখতাম মাঝে মাঝে ক্লাসে কাজ করছেন। বুক কভার, ইলাস্ট্রেশন। দূর থেকে দেখতাম কেমন করে করেন। লাইনিং পেন কীভাবে টানেন, সেটস্কোয়ারের ব্যবহার কী রকম। আমি ফাইন আর্টসের ছাত্র। এগুলো শেখার সুযোগ কখনোই পাবো না। কামরুলভাই একটু ক্লাসের বাইরে গেছেন, অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়েছি কাজের ওপরে। কী অপূর্ব ড্রইং। রং চাপানোর কায়দা। কমার্শিয়াল কাজ শিখে নিলাম কামরুলভাইয়ের কাজ দেখে দেখে।

ওলন এনেছো? ওলন? বিভীষিকাময় ক্লাস ছিল আনোয়ারুল হকের। এমনিতে খুব স্নেহপরায়ণ, কিন্তু কাজের বেলায় ভীষণ কড়া। পার্সপেকটিভ শিখতাম তাঁর কাছে। রাবারের সঙ্গে সুতো বেঁধে ওলন বানিয়ে রেহাই পেতাম। খুব ভালো ওয়াটার কালার করতেন আনোয়ার সাহেব। ব্রিটিশ স্কুলের ওয়াটার কালার ট্র্যাডিশন আনোয়ার সাহেবই বজায় রেখেছিলেন।

সবচেয়ে ফিটফাট, ওয়েল ড্রেসড যাকে বলে, ছিলেন সফিউদ্দীন স্যার। আর ফিফটি টুর মাখমজিনের প্যান্ট। কড়া ইস্তিরি। সাদা টুইল অথবা পপলিনের শার্ট। পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। একবার কাজ দেখাতে গিয়ে সেই দুধসাদা প্যান্টে হঠাৎ করে চায়নিজ ইংকের ফোঁটা গিয়ে পড়লো। ওরেববাস! সে কী হইচই! অস্থির! কে যেন বললো, স্যার ছাগলের দুধ দিয়ে ধুয়ে দিলে দাগ থাকবে না। কোথায় ছাগলের দুধ! জলদি আনো। এই ছিলেন সফিউদ্দীন সাহেব। উডকাটের ক্লাস। নরুন, বাটালি, হাতুড়ি, বলি এই নিয়ে কারবার। আমার তো রীতিমতো জ্বর আসতো। প্রথম দিনেই রক্তারক্তি। খুব পরিহাসপ্রিয় সফিউদ্দীন স্যার। ক্লাসে আসতে প্রায়ই লেট হতো। মস্তবড়ো অজুহাত ছিল নবাবপুরের রেলগেট। স্যার, আজ যে রেলগেট পড়লো ঝাড়া দুঘণ্টা! ক্লাসের দরোজার কাছে স্যারের সামনে পড়লেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কী হে। ঢুকছ না বেরুচ্ছ? হবীবুর রহমান সাহেবও উডকাটের টিচার ছিলেন। সফিউদ্দীন সাহেবেরও টিচার। কানে কম শুনতেন। যখনই কোনো প্রবলেম নিয়ে গেছি, শুধু বলতেন, লাল লাগাও – লাল। আলী আহসান সাহেব শেখাতেন লেটারিং। ক্লাসে ঢুকেই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে দ্রুতলয়ে বলতেন, কাজ করো, কাজ করো। ব্যস, ওই পর্যন্ত। বকাঝকার মধ্যে নেই।

সে-সময়ে আমাদের কলেজে কয়েকটি বিষয় ছিল যা এখন আর নেই। যেমন চার্ট ড্রইং। নন্দলাল বসুর ফ্রি হ্যান্ড ড্রইং অজন্তার ছবির ওপর। পেনসিল ড্রইং করে তুলি দিয়ে একটানে নাক, চোখ, মুখ ফুটিয়ে তুলতে হতো। ব্রাশ ওঠানো চলবে না। কাঁপা-কাঁপা হলে চলবে না। চিকন মোটা লাইন ব্রাশে চাপ দিয়ে আনতে হতো। খুব মজার ছিল। ব্রাশের ওপর একটা কন্ট্রোল তৈরি হতো। ব্ল্যাকবোর্ড ড্রইং বলে আর একটা বিষয় ছিল। চার্টের ড্রইংগুলোকে খড়িমাটি দিয়ে বড় করে অআঁকতে হতো। ড্রইংয়ের সমতা বজায় রাখা কী যে কঠিন মনে হতো। স্টিললাইফ ক্লাসে একবার খুব মজা হয়েছিল। স্টিললাইফ সাজানো হলো আপেল, কলা, আঙুর প্রভৃতি দিয়ে। কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, বোধকরি তিন দিনের দিন। চতুর্থ দিনে ক্লাসে দেখা গেল স্টিললাইফ উধাও। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। কে করেছে? আবেদিন সাহেব ক্লাসে এলেন। সববাইকে দেখলেন। ভাজা মাছ কেউ উলটে খেতে জানে না। কিচ্ছু বললেন না। পরদিন নতুন স্টিললাইফ সাজানো হলো। ড্রেপারিসহযোগে পিতলের থালা, বাটি এবং সঙ্গে ঘাড়-দোলানো হুঁকো হাতে গল্পবুড়ো। চুপচাপ ড্রইং করতে বসে গেলাম। পরদিন ক্লাসে আবার হইচই। স্টিললাইফ স্ট্যান্ডের ঠিক ওপরে ঘাড়-দোলানো বুড়ো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। আবেদিন সাহেব এলেন। দেখলেন। দেখেই অট্টহাসি। বললেন, বেশ করেছো। ঠিক আছে স্টিললাইফ তোমাদের। তবে কাজ শেষ হবার পর।

আবেদিন সাহেব কোনো ক্লাস নিতেন না। মাঝে মাঝে ক্লাসে ঢুকতেন। একবার কম্পোজিশন ক্লাস হচ্ছে। বিষয় ছিল – গোয়ালঘরের সামনে গরু বাছুর নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা বাইরে থেকে স্টাডি করে এনে কম্পোজিশন সাজাচ্ছি। এমনি সময়ে আবেদিন সাহেব এলেন। পড়বি তো পড় একেবারে আমার কাজের সামনে। টুল ছেড়ে উঠলাম। আবেদিন সাহেব দেখলেন। বসলেন। পেনসিল হাতে নিয়ে বললেন, গরুর সাইজ ছোট হলেই বাছুর হয় না। বাছুরের ঠ্যাং হবে হরিণের মতো। বলেই দ্রুত টেনে ড্রইং করলেন। লাফাতে লাগলো বাছুর। আমাদের সবার চক্ষু ছানাবড়া।

সে সময় আমরা গুটিকয় ছাত্র। মাস্টারও অল্প কয়েকজন। ছাত্র-মাস্টার সম্পর্ক আমাদের মধ্যে ছিল না। ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার খোঁজখবর তাঁরা নিতেন। একই পরিবারের মতো। আমরা ছিলাম আর্ট স্কুলের দ্বিতীয় ব্যাচ। প্রথম ব্যাচে ছিলেন আমিনুল ইসলাম, বিজন চৌধুরী, আবদুর রহমান ভুঁইয়া প্রমুখ। সমীহ করতাম। কিন্তু তাঁরা আমাদের কাছে টেনে নিতেন ছোটভাইয়ের মতো। আমিনুল থাকতেন মালিবাগে। আমার কাছেই। সে-সময়ে আমিনুল ইসলাম আর্ট স্কুলে একটি উজ্জ্বল নাম। সবার প্রিয়। কি শিক্ষক, কি ছাত্র। ফুলহাতা শার্ট, পাজামা, টায়ারের স্যান্ডেল পায়। পাজামার ডান পা রুমাল দিয়ে বাঁধা। বোধ করি সাইকেল চালনার সুবিধার জন্যে। সাইকেলের পেছনে বিরাট পোর্টফোলিও। সারাদিন টই-টই করে ঘুরছেন। ছবি অআঁকছেন। মাঝে মাঝে আমিও সঙ্গী হয়েছি। পড়াশোনা করতেন। আমিনুল ইসলাম বামপন্থী সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটান। কলকাতার পরিচয় এবং বোম্বের ক্রসরোড তাঁর কাছেই দেখি। কথাশিল্পী আলাউদ্দিন আল আজাদ, কবি শামসুর রাহমান এঁদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। শিল্প-সাহিত্য-সংগীত এই তিনের স্পর্শে আমিনুল তখন টইটম্বুর। ওয়ার্সী বুক সেন্টার ছিল মাহুতটুলীতে। বইয়ের সঙ্গে রংও আমদানি করতেন। আমিনুল একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেন। একটা নতুন জগৎ আমার সামনে খুলে গেল। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা সেই থেকে শুরু।

লিটন হলে ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রদর্শনী। ঢাকার প্রথম চিত্র-প্রদর্শনী। দশ পয়সা দর্শনী দিয়ে প্রদর্শনী দেখতে হতো সবার। সাধারণের সে কী উৎসাহ। ছবির মেলায় কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে যাওয়ার উত্তেজনা বোধকরি আজকাল শিল্পমেলাতেও মেলে না। আমার প্রথম ছবি বিক্রি হলো। জলরঙের ছবি। দুপুররোদে ঘাটে বাঁধা নৌকা। অগত্যা কাগজে রিভিউ বেরুল। লিখেছিলেন খুব সম্ভব ফজলে লোহানী। একগাদা ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীর নামবোঝাই সমালোচনার গূঢ় অর্থ বোঝার বয়স তখন নয়। খটমটে নামের ঝংকারেই ঝংকৃত তনুমন। সবার হাতে হাতে অগত্যা। ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের দিনগুলি সোনার খাঁচায় ছিল। সহপাঠীদের সঙ্গে ছবি অআঁকা। টিফিন পিরিয়ডে কষ্টে জমানো পয়সায় কোর্ট হাউস স্ট্রিটে মোহান্তের দোকানের এক আনা দামের সন্দেশ, এক আনা দামের শিঙাড়া, এক আনা দামের চা। মোট তিন আনা। যদি কোনোদিন কারো কৃপায় দুটো সন্দেশ আসতো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতাম। বুড়িগঙ্গা, জিঞ্জিরা, রামপুরা, কমলাপুর, টঙ্গী কোথায় না ঘুরেছি ছবি অআঁকার জন্যে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। ঊনত্রিশ বছর পরেও মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। শুধু অবাক হয়ে ভাবি, আমাদের জীবনেও পেছনে তাকাবার সময় এসে গেছে। জমেছে কত গল্প, উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে নানা রঙের ফেলে আসা দিন। r

প্রথম প্রকাশ : সন্ধানী, প্রথম বর্ষ, ৩০ সংখ্যা, ১৯ নভেম্বর ১৯৭৮।