পোশাকশিল্প থেকে ভাস্কর্যশিল্পে

জাহিদ মুস্তাফা

 

প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘উইংস অব হোপ’ অর্থাৎ আশার ডানা। একদিকে ধ্বংসসত্মূপ থেকে উঠে এসে নতুন করে বাঁচার প্রত্যয় ফুটে উঠেছে এই প্রদর্শনীর শিল্পীদের কাজে, অন্যদিকে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দেশের  প্রতিষ্ঠিত নারীশিল্পীদের চিত্রকর্মে প্রত্যক্ষ করা গেল বেঁচে থাকার সংগ্রামে মানবিক যূথবদ্ধতার মূল্য কত বড়। ঢাকার অদূরে সাভারে বেশ কয়েকটি গার্মেন্ট কারখানার ভবন রানা পস্নাজা ধসের মর্মামিত্মক দুর্ঘটনায় আহত পোশাক-শিল্পকন্যাদের গড়া ভাস্কর্য এবং দেশের প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন নারীশিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে সম্প্রতি এই বিশেষ শিল্পকর্ম-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার অভিজাতপাড়া গুলশানের বেঙ্গল লাউঞ্জে।

সাভারের রানা পস্নাজা ধসে পড়ার মর্মামিত্মক ঘটনা শিল্পক্ষেত্রে সারাবিশ্বে সংঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে

তৃতীয় বৃহত্তম। এই ভবনধসে নিহত হয়েছেন এগারো শতাধিক পোশাকশ্রমিক। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ, কাজ করে বেঁচে থাকার ক্ষমতা হারিয়েছেন বহু শ্রমিক; এর মধ্যে অনেকেরই অঙ্গহানি হয়েছে। কী সংকটময় সময়টাই না গেছে! একদিকে অসহায় মানবতা, অন্যদিকে আর্তদের উদ্ধারে প্রাণামত্মকর মানবিক প্রচেষ্টা। ২৪ এপ্রিল সেই বিভীষিকাময় দিনের তিন বছর পার হয়েছে। একসঙ্গে এত মর্মন্তুদ প্রাণপাত, এত আহতের আহাজারি আজো আমাদের হৃদয়কে বিচলিত করে।

ওই মর্মামিত্মক ঘটনায় আহত নারীশ্রমিকদের নিয়ে বাংলাদেশের ঢাকায় নিযুক্ত ডেনমার্ক দূতাবাসের সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মীনা, আলোকচিত্রী আবির আবদুলস্নাহ, ভাস্কর কির্সটেন ফুগল ও ধামরাই মেটাল ক্রাফটস ২০১৫ সালে বেঁচে যাওয়াদের জন্য ভাস্কর্য শিরোনামে একটি শিল্পকর্মশালার আয়োজন করেছিল। সেই কর্মশালায় রানা পস্নাজা দুর্ঘটনায় আহত ছত্রিশজন পোশাককর্মী নারী অংশ নেন। তাঁরা যৌথভাবে ভাস্কর্য গড়েছেন, সংগ্রাহকদের কাছে সেগুলো বিক্রি করে

দুর্ঘটনা-পীড়িতদের সহায়তার জন্য তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে।

এ-বছর আমত্মর্জাতিক নারী দিবসে নরওয়ে দূতাবাস তাঁদের এবং নারীশিল্পীদের সংগঠন সাঁকোকে নিয়ে ভাস্কর কির্সটেন ফুগলের তত্ত্বাবধানে আয়োজন করে আরেকটি শিল্পকর্মশালার। সেখানে শিল্পীরা যে-কাজগুলো করেছেন তার সমন্বয়ে এ-প্রদর্শনী। প্রদর্শনী আয়োজনে আরো সহায়তা দিয়েছেন ঢাকার সুইডেন দূতাবাস, আর্য চলচ্চিত্র, ফ্যাশন রেভল্যুশন এবং বেঙ্গল লাউঞ্জ। ওই দুটি কর্মশালায় মাটি দিয়ে নারী-পুরুষ-শিশুদের শরীরকাঠামো গড়েছেন পোশাকশ্রমিক-শিল্পীরা দু-তিনজন করে দলবদ্ধ হয়ে। তাঁদের নির্মিতিকে ডাইসে রূপামত্মর করে মেটাল কাস্টিং করেছেন উদ্যোক্তারা। এভাবে তৈরি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সব ভাস্কর্য। সেসব ভাস্কর্য আর সাঁকোর শিল্পী ও অতিথি-শিল্পীদের িআঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে এই দলগত প্রদর্শনী। এটি উৎসর্গ করা হয়েছে সদ্য পরলোকগত শিল্পী ও চলচ্চিত্রকার খালিদ মাহমুদ মিঠুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।

রানা পস্নাজার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ছত্রিশজন পোশাককর্মীর সঙ্গে সাঁকোর নয়জন শিল্পী এবং তিনজন অতিথিশিল্পীর কাজ নিয়ে বিশেষ-এ আয়োজন। বাংলাদেশের নানা শ্রেণির নারীর ক্ষমতায়নের চিন্তা থেকে উদ্যোক্তারা এ-বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছেন। সাধারণ কর্মজীবী নারীর মেধা ও সৃজনশীল কর্মস্পৃহাকে সুধীসমাজে তুলে আনার এ-প্রচেষ্টা প্রশংসিত হয়েছে।

কী কাজ করলেন আমাদের পোশাকশ্রমিক মেয়েরা! গ্যালারিতে ঢুকে আমি যারপরনাই অবাক! একেবারে জাতশিল্পী ও ভাস্করের কাজের অনুরূপ সব ভাস্কর্য সাজানো আছে গ্যালারিতে। গত শতাব্দীর নববইয়ের দশকে কৃতী ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান একাত্তর স্মরণে যে একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেছিলেন, তাতে মেটালে ছোট-ছোট অনেক কাজের সমাহার দেখেছি। যেন তেমনই সংখ্যায় ও বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটেছে এ-প্রদর্শনীতে। মজার ব্যাপার হলো, শিল্পের সেই আদিকালের মতো দলগত সৃজন ধারণা তাঁরা যেন নতুন করে তুলে আনলেন। তাঁরা এখানে একক ভাস্কর্য গড়েননি, দু-তিনজন মিলে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করেছেন। তাঁদের উপস্থাপিত শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও দর্শক দলবদ্ধতার দেখা পেয়েছেন। কোনো ভাস্কর্যে দুজন আবার কোনোটাতে তিনজন আছে। প্রায় সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যসত্ম। কর্মজীবীদের সৃজন বলেই মনে হয় তাঁরা নিজেদের জীবনের কর্মিষ্ঠ হাতের কর্মকা-কে তুলে ধরেছেন নিজেদের সৃজনে। আবার নিজেদের ছোট-ছোট স্বপ্ন ও আহ্লাদকে তুলে ধরেছেন তাঁদের সৃজন পসরায়।

পরিবার হচ্ছে প্রাণীর প্রথম সংগঠন। ছোট সুখী পরিবার নামে মা, বাবা ও সন্তানের হাতে হাত রাখা একটি ভাস্কর্য গড়েছেন রাজিয়া, শাহানাজ ও লুৎফা। শত সংকটেও পরিবার যে মানুষের সবচেয়ে নিকটতম, সবচেয়ে বড় আশ্রয় সেই শাশ্বত সত্যকে তুলে ধরেছেন তাঁরা। এই শিল্পকর্মটি এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংগ্রহে।

আরেকটি পরিবার গড়েছেন ঝর্ণা ও রুবানা। মা-বাবার মাঝখানে পরম মমতায় দুজনের দুহাতে ধরা ছোট এক শিশুর উচ্ছল, প্রাণবমত্ম রূপটি যেন ফুটে উঠেছে এই ভাস্কর্যে। হাসিনা ও অজুফা গড়েছেন – গালগল্প। সারাদিনমান কাজের ব্যসত্মতার পর বন্ধুর সঙ্গে গালগল্প করার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে এতে। ভালোবাসার গল্প তুলে ধরেছেন মালেকা ও সালমা। আমরা দুজনে পাখির কূজনে কাটিয়ে দিয়েছি বেলা… বন্ধুতার এমন এক অনুভূতির প্রকাশ পাওয়া যায় এই ভাস্কর্যে। আরেক ধরনের অভিব্যক্তিতে বন্ধুত্বের নিবিড় বন্ধন চমৎকার প্রতীকায়িত করে তুলে ধরেছেন জেসমিন ও আনোয়ারা। উপবেশনরত নারীবন্ধুর দুহাত ধরে তাকে তুলে আনার আগ্রহ প্রতিফলিত হয়েছে এতে। পপি ও পারভীন মাটিকাটা নারী-শ্রমজীবীর শ্রমে দেশের

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক অংশগ্রহণকে উপস্থাপন করেছেন। রসিয়া ও সাহিদা তাঁদের ভাস্কর্যে তুলে ধরেছেন অসুস্থ জননীর মাথা সন্তান তার নিজের কোলে রেখে তাঁর কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছেন। মানব সেবার চিরায়ত ছবি এটি।

আরো ভাস্কর্য গড়েছেন আকলিমা, আল্পনা, আনোয়ারা, আশা, কল্পনা, নাসিমা, নাজমা, নাসরিন, জোহরা, রেহেনা, রেবেকা, রুনা, সালমা, শেফালি, শিপু, শিরিন, সুমা ও তাসলিমা। তাঁদের দলগত কাজে মানুষ ও তাঁর প্রেম-পরিবার-সন্তান এসব বিষয়কেই নানা ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। তবে এক বা একাধিক কর্মশালায় একই প্রশিক্ষকের কাছে তালিম নেওয়ায় প্রত্যেকের কাজের ধরন খুব কাছাকাছি।

সাঁকোর শিল্পী সুলেখা চৌধুরী ঢোলবাদকের ভাস্কর্য গড়েছেন দারুণ অভিব্যক্তিতে। দুই হাত-পা ছড়িয়ে নিবিষ্টমনে চলছে ঢোলক বাদন। ছবিও এঁকেছেন তিনি। একটি ছবিতে তিনি এঁকেছেন – কালো কাগজে সেলাইয়ের ইমেজে তার ও পস্নাগসহ এক বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি এবং ভালোবাসার লাল গোলাপ। এর মানে দাঁড়ায় এই –  পোশাককর্মীর কাজটি যান্ত্রিক হলেও তাঁর হৃদয়ে আছে ফুলের পবিত্রতা। আরো এঁকেছেন শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা, ফারেহা জেবা, নাইমা হক, ফারজানা ইসলাম মিল্কি, রেবেকা সুলতানা মলি, কির্সটেন ফুগল, লুৎফুন নাহার লিজা ও ফারজানা রহমান ববি।

শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা তাঁর স্বকৃত ধরনেই এঁকেছেন পাহাড়ি নারী ও বৌদ্ধভিক্ষুদের ছবি। বৌদ্ধধর্মের ত্যাগ ও ধৈর্যের মহিমা তুলে ধরেছেন শিল্পী তাঁর চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে। শিল্পী নাইমা হক কাগজে রশি ও সুতোর সমন্বয়ে মিশ্রমাধ্যমে এঁকেছেন – উদ্বাস্ত্তর প্রতিরোধ। সেলাইয়ের নকশায় শিল্পী ফারেহা জেবা পোশাকশিল্পকন্যার প্রতীক নিয়ে এঁকেছেন কালো গোলাপ শিরোনামে তিনটি ছবি। তিনটি ভিন্ন চিত্রপটে রেখাচিত্রে সুসজ্জিত নারীর অবয়ব এঁকেছেন শিল্পী রেবেকা সুলতানা মলি। ফারজানা ইসলাম মিল্কি মূলত ভাস্কর। তবে এ-প্রদর্শনীতে ভাস্কর্যের ফর্মে তিনি এঁকেছেন দম্পতির ছবি। রেখাচিত্রে নারীর পৃথুলা রূপ তুলে ধরেছেন শিল্পী লুৎফুন নাহার লিজা। ছবির শিরোনাম দিয়েছেন – সৌন্দর্যের সন্ধান। চিত্রপটে নানা রঙের মিশ্রণ ঢেলে শিরোনামহীন ছবি এঁকেছেন ফারজানা রহমান ববি।

২১ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার শুরু এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ২৪ এপ্রিল রোববার।