পোয়েটিশিয়ান ইয়েভতুশেঙ্কো

আন্দালিব রাশদী

নিঃসন্দেহে পাবলো নেরুদা বিংশ শতকের সর্বাধিক পঠিত কবি; কিন্তু কবিকণ্ঠে সর্বাধিক শ্রুত কবি নিশ্চয়ই (যদি বব ডিলানের কাব্যধারাকে দূরে রাখা যায়) ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো।

ইয়েভতুশেঙ্কোর জন্ম সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত সাইবেরিয়ার ছোট শহর জিমা জংশনে, জুলাই ১৯৩৩-তে। ‘জিমা জংশন’ নামের একটি কবিতায় ইয়েভতুশেঙ্কো স্মরণীয় করে রেখেছেন তাঁর জন্মভূমিকে।

তাঁর জন্মকালীন নাম ইয়েভগেনি আলেকসান্দ্রোভিচ গ্যাংনাস। তাঁর বয়স যখন সাত বছর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, লালিত হন মায়ের হাতে, মাতামহের বাড়িতে। পিতৃধারার গ্যাংনাস নাম বর্জন করে মাতৃধারার ইয়েভতুশেঙ্কো যোগ হয় তাঁর নামের সঙ্গে।

দশ বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন। ষোলো বছর বয়সে একটি ক্রীড়া সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। উনিশে পৌঁছে বের করলেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো

মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু কবিতার দুরারোগ্য সৃষ্টি-যাতনা যাকে পেয়ে বসে তার কি আর ক্লাসরুমের কাঠামোবন্দি পড়াশোনা ভালো লাগে? মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউট অব লিটারেচারে তিন বছর পড়াশোনা করে ১৯৫৪ সালে ড্রপ আউট হয়ে গেলেন। তারপর কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্ক্রিপ্ট-লিখন, প্রকাশনা, অভিনয়, সম্পাদনা, চলচ্চিত্র-পরিচালনা – হাজারো কাজ।

শৈশবের কবিতাতেই তিনি সোভিয়েত সীমান্তকে চিহ্নিত করেছেন তাঁর জীবন বিকাশের অন্তরায় হিসেবে। তাঁর শুরুর দিককার লেখার প্রশংসা করেছেন বরিস পাস্তেরনাক, কার্ল স্যান্ডবার্গ ও রবার্ট ফ্রস্ট। ইয়েভতুশেঙ্কোর কবিতা শুনতে স্টেডিয়াম ভরে যাওয়ার মিথ সমকালীন শক্তিশালী কিন্তু কম জনপ্রিয় কবিদের অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি।

কেউ তাঁকে দেখেছেন সরকারের ধামাধরা হিসেবে, কেউ বলেছেন সংবাদপত্রের নিত্যকার ভাঁড় লেখকদের একজন।

তাঁর সরকারবিরোধিতা, কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা অনেকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন, মনে করেছেন তাদেরই এজেন্ট। ইয়েভতুশেঙ্কো যদি সরকারের দিকে ঢিলও নিক্ষেপ করেন নিশ্চিত থাকুন, সরকারের অনুমোদন নিয়েই তা করেছেন – এ-কথা যেনতেন কারো নয়, নোবেলবিজয়ী রুশ কবি জোসেফ ব্রডস্কির।

ইয়েভতুশেঙ্কো রাষ্ট্রীয় সব পুরস্কার পেয়েছেন। একসময় নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রসত্মাবিত হয়েছেন।

‘বাবি ইয়ার’ কিংবা ‘স্টালিনের উত্তরাধিকারীরা’র মতো কবিতা তাঁর সরকার তোষণের সাক্ষ্য দেয় না। ইয়েভতুশেঙ্কো ১ এপ্রিল, ২০১৭ ওকলাহামায় ঘুমের মধ্যেই প্রয়াত হন।

ইয়েভতুশেঙ্কো কি একজন পলিটিশিয়ান? তিনিই বলেছেন, পোয়েটিশিয়ান।

ইয়েভতুশেঙ্কো যত বেশি সম্ভব পাঠক ও শ্রোতার কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। সেজন্যে কাব্যিক বিচ্ছিন্নতা এবং শিল্পের এলিটিস্ট ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর কবিতা সাধারণ মানুষের জন্য।

 

পোয়েটিশিয়ান

পলিটিশিয়ান নয়, পোয়েটিশিয়ান পরিচিতিই ইয়েভতুশেঙ্কো নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন। ক্যাটরিনা ভ্যানডেন জিউভেল লিখেছেন  :

১৯৮৬-র এক শীতের রাতে আমার স্বামী স্টিফেন কোহেন এবং আমি মস্কোর রাসত্মায় দ্রম্নতগামী এক গাড়িতে। চালাচ্ছেন ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো। আমরা তাঁকে বলতাম জেনিয়া। ট্রাফিক পুলিশ আমাদের আটকায়। আমরা তখন অপেক্ষা করছি আর আমাদের বন্ধু ক্রমান্বয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন – কিন্তু তা গতিসীমা অতিক্রম করে চালানোর অপরাধের জন্য নয়।

সে-মুহূর্তে তিনি বিচলিত ছিলেন অন্য কারণে। কর্তৃপক্ষ যদি গাড়ি তলস্নাশি করে তাহলে তার ট্রাঙ্কে পাওয়া যাবে আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের দ্য গুলাগ আর্কিতো লাগো – বইটি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে নিষিদ্ধ, কিন্তু অন্য দেশে রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।

তিরিশ বছর পেছনে ফিরে আমরা হয়তো ভাবতে পারি, গস্নাসনসত্ম – খুলে দেওয়ার যুগ, অনিবার্যই ছিল। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, যারা সেই সময়টায় সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন, তাঁদের কাছে এই পরিবর্তনটা ছিল কল্পনাতীত।

এমনকি ১৯৮৫ সালে পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতা মিখাইল গর্বাচেভের আবির্ভাবের পরও সেন্সর উঠিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি অত্যন্ত ধীরে ধীরে, থেকে থেকে চলতে থাকে। সামনে যে বড় পরিবর্তন আসছে তা বুঝতে মানুষের তিনটি বছর লেগে যায়। বিশ্বখ্যাত এই কবি ছিলেন এই বাসত্মবতার মুখ্য বার্তাবাহক।

তাঁর স্মরণীয় জীবনের অবসানের পর রুশ ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে তাঁর অমোচনীয় অবদান নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু যে-বিষয়টি কম বোধগম্য হয়েছে বলে মনে হয় তা হচ্ছে, কবি কেন নিজেকে বলেছেন পোয়েটিশিয়ান, পলিটিশিয়ান নয় – এর ব্যাখ্যা।

মাতৃকুল ও পিতৃকুল উভয় দিক থেকে যারা স্ট্যালিনের শাসনামলে নির্যাতিত, সে-পরিবারের সমত্মান ইয়েভগেনি বেড়ে ওঠেন হিউম্যানিস্ট হিসেবে আর প্রায়শ দুরারোগ্য রোমান্টিক। থ্রি মাসকেটিয়ার্স চলচ্চিত্রটি কেবল পরিচালনাই করেননি, তিনজনের একজন হিসেবে অভিনয়ও করেছেন। তিনি একজন রুশ দেশপ্রেমিকের জীবনযাপন করেছেন এবং সামাজিক নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে প্রগতির জন্য লড়াই করাটাকে মনে করেছেন ব্যক্তিগত দায়িত্ব।

রাশিয়ার ভবিষ্যৎ যখন তাঁর কাছে অনিশ্চিত মনে হয়েছে, তিনি মাতৃভূমির জন্য খুঁজে বেরিয়েছেন উজ্জ্বল কোনো মহাসড়ক। প্রায়ই বলা হয়, ইয়েভতুশেঙ্কো একশ বছরের সর্বাধিক শ্রুত কবি। এটি মিথ্যে নয়।

 

কোল্ড ওয়ার ও সোভিয়েত সংস্কৃতি?

স্নায়ুযুদ্ধ সোভিয়েত সংস্কৃতিকে কেমন করে প্রভাবিত করেছে? স্নায়ুযুদ্ধে লাভবান কে?

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো বললেন, সবার আগে বিবেচনা করতে হবে, আমরা দীর্ঘ সময় পশ্চিমে আমাদের সতীর্থদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। যেমন আন্না আখমাতোভা, আমাদের বড় কবি। তিনি যখন তরুণী ছিলেন আমেদিও মোদিলিয়ানির মিসট্রেস ছিলেন। ১৯৪০-৪২ পর্যন্ত তিনি জানতেই পারেননি যে, মৃত্যুর পর আমেদিও বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। অনেকেই মনে করতেন (মার্ক) শাগাল নিশ্চয়ই মরে গেছেন। তাঁরা জানতেন শাগাল তখন বিশ্বখ্যাত শিল্পী। আমরা পশ্চিমের বহু বই পড়ার সুযোগ পাইনি। সেন্সরশিপ বহাল থাকার পরও আমরা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি – কারণ আমরাও উপন্যাস-কবিতা প্রকাশ করছি, স্ট্যালিনের শুদ্ধিকরণের ভয়ংকরতম বছর ১৯৩৭-এ আমরা দুটি চমৎকার কবিতার বই প্রকাশ করেছি, তিনটি আমেরিকান কবিতা সংকলনও এ-সময় আমরা বের করেছি।

যখন লৌহপর্দা ভেঙে গেল প্রবেশ করলেন রবার্ট ফ্রস্ট, কার্ল স্যান্ডবার্গ, এডওয়ার্ড স্টিশেন এবং আরো অনেক বড় আমেরিকান লেখক, ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ চিত্রশিল্প, এটা ছিল আমাদের সবার জন্য ছুটির উৎসব। আর এভাবেই আমরা… আমি বলতে চাই, পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের একটি আত্মিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বিদেশে কী হচ্ছে সে-সম্পর্কে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – এমনকি ব্রেজনেভ শাসনের শেষ বছরগুলোতেও জেরোক্স নিষিদ্ধ ছিল। আপনি চাইলেই নিজের প্রয়োজনে জেরোক্স (ফটোকপিয়ার) ফ্যাক্স মেশিন কিনতে পারতেন না। কাজেই তথ্যের ঘাটতি ছিল। মস্কোতে কোনো বিদেশি সংবাদপত্র পাওয়া ছিল একটি অসম্ভব কাজ। লাইব্রেরির বিশেষ শাখায় বিশেষ অনুমতি নিয়ে তা দেখা যেত। একই সময় আমার মনে হয়, আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও নিজেদের ওপর বিশ্বাস না হারিয়ে কষ্টের সময় পার করেছেন – তাঁরা তাঁদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো প্রকাশ করতে পারেননি। তাঁরা সম্ভবত তাঁদের আঁকা চিত্রগুলোর প্রদর্শনী করেননি, তাঁদের কোনো কোনো উপন্যাস, কবিতা বা অন্য কোনো লেখা প্রকাশ্যে আনেননি। কিন্তু তাঁরা লিখে গেছেন, তাঁরা অবরুদ্ধ কালের অবসানের অপেক্ষায় ছিলেন। যখন পেরেস্ত্রোইকা এলো আমরা অনেক নতুন ও চমৎকার বই প্রকাশ করলাম, আমাদের চিত্রশিল্প প্রদর্শিত হলো, আমরা নিজেদের আবিষ্কার করতে শুরু করলাম।

ইয়েভতুশেঙ্কো বললেন, স্নায়ুযুদ্ধে লাভবান হয়েছে আমলাতন্ত্র, কেবল আমলাতন্ত্র। দুর্ভাগ্যবশত অস্ত্র প্রতিযোগিতার চেয়ে অধিক লাভজনক কিছু নেই। ব্যবসাটা অত্যন্ত লাভজনক, অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও জোগায়। যখন স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল, আমরা আমাদের সমরাস্ত্র কারখানাগুলো বন্ধ করতে শুরু করলাম। বিজ্ঞানীদের জন্য বাজেট ছেঁটে দেওয়া হলো। অনেক লোক চাকরি হারাল। এটা বড় ট্র্যাজেডি। এটি একটি দূষিত চক্র। অস্ত্র প্রতিযোগিতা খুব ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। এটি মানুষকে ধনী করে, মানুষের হাতে টাকা তুলে দেয় – সে-কারণেই যুদ্ধ টিকে থাকে আর প্রতিমুহূর্তেই কেউ না কেউ নিহত হয়।

স্নায়ুযুদ্ধ কি অনিবার্য ছিল? ইয়েভতুশেঙ্কো কী মনে করেন?

তাঁর সাফ জবাব : স্নায়ুযুদ্ধ একটি বাসত্মবতা। ফিল্মের মতো ইতিহাসকে তো গুটিয়ে এনে আবার প্রথম থেকে শুরু করা যায় না। শীতলই বলুন আর উষ্ণই বলুন, ইতিহাসের জন্য কোনো ধরনের যুদ্ধই প্রয়োজনীয় নয়। রেড স্কয়ারে ভিক্টোরি ডে-র কথা আমার মনে আছে : এটি সত্যিই মানুষের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় আনন্দ। আমার মনে আছে আমেরিকান, ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ নাগরিক, পাইলট স্মৃতিসত্মম্ভে, বসে বোতল থেকে পান করছেন। আমরা ভেবেছি, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ – আমরা একটি নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। তারপর এলো স্নায়ুযুদ্ধ। আমাদের সর্বোত্তম আশাগুলো ভেঙে গেল। এর কি প্রয়োজন ছিল? কার জন্য? আমি মনে করি স্নায়ুযুদ্ধ, যে-কোনো ধরনের উত্তেজক পরিস্থিতি সব দেশের চরমপন্থী, আমলা আর যারা অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়ী – তাদের সবার জন্য লাভজনক।

আর ইয়েভতুশেঙ্কোর জন্য স্নায়ুযুদ্ধের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত ছিল কোনটি?

যখন রুশ ট্যাঙ্ক চেকোসেস্নাভাকিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করল। সেটা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত, কারণ শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও আমি এটা বিশ্বাস করতে চাইনি। আমার মনে পড়ছে আমি আমার লেখকবন্ধুদের নিয়ে তখন ক্রিমিয়ায়, আমরা এসব নিয়ে আলাপ করছিলাম, … আমি সবসময়ই আদর্শবাদী ছিলাম, আমি সংশোধনের অযোগ্য আদর্শবাদী – আমার পক্ষে ভিন্ন মানুষ হওয়া সম্ভব নয়; আমি সবচেয়ে কঠিন সময়েও আশা হারাই না। কাজেই আমার মনে আছে আমি রোমান্টিকদের মতো বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম – ‘এটা হতে পারে না!’

একজন অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লেখক, যিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেরও সৈনিক, আমাকে বললেন, ‘জেনিয়া, জেনিয়া, আমি তোমার আদর্শবাদকে ঈর্ষা করি। সম্ভবত এখনই, যখন তুমি আর আমি এখানে বসে এ নিয়ে কথা বলছি ব্রেজনেভের ট্যাঙ্ক চেকোসেস্নাভাকিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করছে।’

পরদিন সকালে রেডিওতে শুনলাম এটি সত্য। আমি সত্যিই বলছি, জীবনে সেদিনই প্রথম আমি আত্মহত্যার কথা চিমত্মা করেছিলাম। আমি যখন এর প্রতিবাদ করে টেলিগ্রাম পাঠালাম, কেউ কেউ আমার সাহসের প্রশংসা করল। আমি একটি কবিতা লিখলাম – এটি কোনো সাহস ছিল না, এটি ছিল আমার ভয়। কারণ এই টেলিগ্রামটি পাঠিয়ে আমি নিজেকে আত্মহত্যা করা থেকে রক্ষা করেছিলাম। তা না হলে আমি যদি নিশ্চুপ থাকতাম আমার বিবেকের ওপর এত বড় বোঝা নিয়ে আমি বাঁচতে পারতাম না।

স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের মুহূর্ত তাহলে ইয়েভতুশেঙ্কোর কাছে কোনটি?

তিনি বললেন, আমার মনে হয় সম্ভবত ১৯৮৯ সালের সেই মুহূর্তটি, যখন গর্বাচেভ বুদ্ধিজীবীদের আন্তর্জাতিক ফোরামে গ্রাহাম গ্রিন, অর্থাৎ মিলার, পশ্চিমের আরো অনেক লেখক, রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ লেখক ও বৈজ্ঞানিকের সমাবেশে বললেন, মানবিক মূল্যবোধ রাজনীতি ও শ্রেণি-সংগ্রামের ঊর্ধ্বে। কারণ সোভিয়েত ডকট্রিন ছিল শ্রেণি-সংগ্রামই সমাজতন্ত্রের মূল ভিত্তি আর তিনি বললেন মানবিক মূল্যবোধের কথা। তিনি সম্ভবত বরিস পাস্তেরনাকের ডক্টর জিভাগো পড়েননি… কিন্তু এটিই ছিল পাস্তেরনাকের উপন্যাসের ভিত্তি – একটি ভালোবাসার গল্প, যা রাজনীতির ইতিহাসের চেয়েও ওপরে, যা গণযুদ্ধের চেয়েও ওপরে। কিন্তু ১৯৫৭ সালে যা ছিল বিপথগামিতা, ১৯৮৯-তে তাই হলো দাপ্তরিক সোভিয়েত ডকট্রিন। সেখানেই স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি।

 

শেষ পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধ কী অর্জন করল?

ইয়েভতুশেঙ্কো মনে করেন, ধনবাদী ও সমাজতান্ত্রিক উভয় স্নায়ুযুদ্ধ বহুকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।

তিনি বলছেন : আমি মনে করি, স্নাযুযুদ্ধ ধনতন্ত্রকে হতাশাবাদী করে তুলেছে; আমাদের আরো হতাশাবাদী। স্নায়ুযুদ্ধ বহু জীবন, বহু আশা, বহু মেধা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু যখন কেউ ভাবেন স্নায়ুযুদ্ধে কোনটা ভালো ছিল – একটা জিনিস সামনে উঠে আসে – তা হচ্ছে, দুটি পদ্ধতির প্রতিযোগিতা; কিন্তু এত ভয়ংকর বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা, পৃথিবীতে একটিই মাত্র রাজনৈতিক পদ্ধতি থাকবে, এটি আমার পছন্দ নয়। কিন্তু আমরা চাই স্নায়ুযুদ্ধবর্জিত প্রতিযোগিতা, কারণ এ-ধরনের প্রতিযোগিতা খুব সহজে স্নায়ুযুদ্ধকে রণাঙ্গনের যুদ্ধে পরিণত করতে পারে।

এখন এই সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতির প্রমিতকরণের সময়কে আমি বলি ‘পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ম্যাকডোনাল্ডকরণে’র মুহূর্ত। আমাদের আরো ভয় আছে… এই মুহূর্তে স্পষ্টত আমেরিকাই অন্যান্য রাষ্ট্রের একক নেতায় পরিণত হয়েছে, এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। তার মানে এই নয় যে, আমেরিকার প্রতি আমার শ্রদ্ধায় ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, একটি দেশ যখন সব দেশের বাকি পৃথিবীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এটি ভয়ংকর বিপজ্জনক একটি ব্যাপার। যখন কেউ সব দেশের নেতা, সেসব দেশ সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞানের অভাব বাকি পৃথিবীর জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। মেগালোমেনিয়া – অতি-আত্মম্মন্যতা আসলে একটি দুর্বলতা। আমি মনে করি, পৃথিবীর দায়িত্ব একক কারো নয়, এটি সম্মিলিত। জাতিসংঘ সঠিক সংস্থা নয়। আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে – হয়তো একে বিশ্বসরকার বলা হতে পারে, যার থাকবে যূথবদ্ধ দায়িত্ব।… এখন ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক বোমা বানানো অত্যন্ত সহজ কাজ। ব্যক্তি খাতেও সম্ভবত বোমা বানানো হচ্ছে। কাজেই (ন্যাটোর মতো) যে-কোনো ধরনের সামরিক মোর্চা অনিবার্যভাবে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করবে।

 

ক্রুশ্চেভের উদারীকরণ

আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের উপন্যাস ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একটি দিন কিংবা ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর কবিতা ‘স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারীরা’ প্রকাশের অনুমতি তো নিকিতা ক্রুশ্চেভই দিলেন, কিন্তু কেমন করে?

ইয়েভতুশেঙ্কো বললেন, হ্যাঁ এই বই, সেই সঙ্গে আমার কবিতা ‘স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারীরা’ দীর্ঘ সময় প্রকাশের অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। ক্রুশ্চেভ যখন ককেশাসে ছিলেন অপখাজিচ যৌথ খামারের চেয়ারম্যান অশ্রুভেজা চোখে তাঁকে বলেছেন, স্ট্যালিনের শুদ্ধিকরণের সময় কেমন করে বহু মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। ক্রুশ্চেভ এই বিবরণ শুনে নিজেও কেঁদে ফেলেছিলেন। এ-সময় তাঁর সহকারী ক্রুশ্চেভের হাতে আমার ‘স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারীরা’ কবিতাটি দিলেন। তিনি অর্ধেক বছরেরও বেশি সময় কবিতাটি ধরে রেখেছিলেন। আর তখনই সামরিক উড়োজাহাজে মস্কো পাঠিয়ে দিলেন। কবিতাটি প্রাভদায় প্রকাশিত হলো – এ নিয়ে শুরু হলো মহাকেলেঙ্কারি। এই কবিতা প্রকাশের পেছনে যে ক্রুশ্চেভের অনুমোদন ছিল তা না জেনেই পার্টির কিছু বড় চাঁই এই লেখা প্রকাশের জন্য প্রাভদার প্রধান সম্পাদককে দোষীসাব্যসত্ম করে চিঠিপত্র লিখতে শুরু করলেন, এটা সোভিয়েতবিরোধী কর্মকা- – কেমন করে ইয়েভতুশেঙ্কোর এই কলঙ্ক রটানো কবিতা প্রকাশ করল?

আমার কবিতা পড়ার পর তিনি যখন ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান দেনিসোভিচ পড়লেন, একটি বিশেষ বৈঠকে এটি প্রকাশনারও আদেশ দিলেন, কারণ সেন্সর তখন আমার কবিতা আর এই বইয়ের প্রকাশনা আটকে দিয়েছিল। ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন, ‘আমি যদি এই কবিতাটি পছন্দ করি, আমি যদি এই ছোট উপন্যাসটিকে পছন্দ করি, তাহলে আমাকেও তো সোভিয়েতবিরোধী কর্মকা–র জন্য দায়ী করা যেতে পারে।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘মহাযুদ্ধের আগে স্ট্যালিনের শুদ্ধি অভিযানে আমাদের বহু জীবন ঝরেছে, তাদের স্বজনরাও দেশপ্রেমিক হয়েই লড়াই করেছে, তারা তাদের নিজেদের যন্ত্রণা এবং স্বজন হারানোর বেদনা ভুলতে চেষ্টা করছে। তাদের তো বিশ্বাস করতে হবে। আমরা যদি এই সেন্সরশিপ অব্যাহত রাখি তাহলে তাদের অপমান করা হবে, তার মানে এই যে, আমরা নিজেদের মানুষকে অবিশ্বাস করছি।’ তিনি তাঁর রাজনৈতিক সচিব ইলিচোভকে সেন্ট্রাল কমিটি অব কমিউনিস্ট পার্টিতে পেশ করার জন্য সেন্সরশিপ অবলুপ্ত করার একটি স্পেশাল ডিক্রি প্রস্ত্তত করতে বললেন। কিন্তু তারা ভয়ংকর সন্ত্রসত্ম হয়ে পড়েন, কারণ সেন্সরশিপের সমর্থন ছাড়া তারা তাদের জীবন, তাদের টিকে থাকা কল্পনা করতে পারছিলেন না। সেজন্য তারা জরুরিভিত্তিতে বড় ধরনের প্ররোচনামূলক কর্মকা- সংঘটিত করতে শুরু করেন।… প্ররোচনাকারীরা নিকিতা সের্গেয়েভিচ ক্রুশ্চেভকে বোঝালেন, এতো তাড়াহুড়ো করে সেন্সরশিপ লোপ করার দরকার হয়নি। এখনো সময় হয়নি। একটু অপেক্ষা করতে হবে। মানুষ ম্যাচিউরড হোক।

 

মাইক্রোফোনের কবি

আনা নেমৎসভা লিখছেন, আমার শৈশব-স্মৃতিতে কবি ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে : লম্বা, দৃঢ়, চওড়া কাঁধের একজন মানুষ। হিপ জ্যাকেট এবং রঙিন টাই, মনোমুগ্ধকর চাহনি। লম্বা হাতের আঙুলে বাতাসে ঘা দিয়ে তিনি তাঁর গীতিকবিতা আবৃত্তি করছেন, যেন সংগীতের সঙ্গে তিনি নিজেকে মেলাচ্ছেন, যেখানে তাঁর কণ্ঠ ফিসফিস থেকে ক্রমান্বয়ে বজ্রকণ্ঠ হয়ে উঠছে, কণ্ঠের কোমলতায় তখন তীব্র ক্রোধ :

না, আমি চিরদিন থাকতে পারব না

আমার একটি প্রত্যাশা আছে

রাশিয়া কখনো মরবে না

তাহলে আমিও কখনো মরব না।

অনেক দশক ধরে রুশ কবিতা-প্রেমিকদের জন্য যেমন ইয়েভতুশেঙ্কো, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে বব ডিলান।

সারাজীবনই তাঁর আঙুল রাখা ছিল রাশিয়ার নাড়ির ওপর। তিনি ছিলেন অতিকায় লাউডস্পিকারের মতো, এমনকি বৈরী সময়েও যখন রাষ্ট্রও তাঁকে পরিত্যাজ্য মনে করেছে, তিনি দেশের হয়ে অখ- সোভিয়েতের সকল প্রামেত্ম বার্তা পাঠিয়েছেন।

তাঁর অন্যতম প্রধান একটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ‘রুশরা কি যুদ্ধ চায়?’ কবিতায়। অতিসাধারণ রুশ জনগণ এ-প্রশ্নে যে-উত্তর দিতেন, ইয়েভতুশেঙ্কো তা-ই বলেছেন কবিতায় :

অবশ্যই, আমরা জানি কেমন করে যুদ্ধ করতে হয়

কিন্তু আমরা আর একবার দেখতে চাই না

মৃত সৈনিক পড়ে আছে চারদিকে

তাদের গ্রামাঞ্চল তো এখন রণক্ষেত্র

সৈন্যদের যারা জীবন দেয় তাদের জিজ্ঞেস করুন

যান, মা-দের জিজ্ঞেস করুন, আমার স্ত্রীকে করুন

তাহলে আপনার আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না,

বলুন – ‘রুশ কি যুদ্ধ চায়?’

আর একটি অবিশ্বাস্য অবস্থান ছিল – তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাস করছেন, কিউবা গিয়ে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে আলাপ করে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবার্ট কেনেডির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে তাঁকে আগামী দিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে টোস্ট করছেন। সে-বছরই নিহত রবার্ট কেনেডিকে নিয়ে তাঁর লেখা কবিতা প্রাভদানিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হচ্ছে।
ইয়েভতুশেঙ্কোর গুরু

ইয়েভতুশেঙ্কোর দাবি, তাঁর গুরু হচ্ছেন হেমিংওয়ে, এসেনিন, মায়াকোভস্কি এবং পাস্তেরনাক।

আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে তিনি তাঁর একটি অত্যুত্তম কবিতা ‘এনকাউন্টার’ উৎসর্গ করেছেন। বরিস পাস্তেরনাকের সঙ্গে তাঁর একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং তিনি ইয়েভতুশেঙ্কোর প্রথমদিককার কবিতা সম্পর্কে গঠনমূলক মতামত দিতেন।

‘ইয়েভতুশেঙ্কোর কবিতাশৈলীতে এসেনিন কিংবা মায়াকোভঙ্কির প্রভাবের স্পষ্ট ছাপ নেই, যদিও প্রথম পাঠে তাঁকে মায়াকোভস্কির একান্ত শিষ্য মনে হতে পারে।’

‘ইয়েভতুশেঙ্কো এক ধরনের স্থানীয় কথ্যশৈলী অনুসরণ করেন, কিন্তু বিদেশি ভাষার প্রচুর শব্দ ব্যবহার করেন।’
মাতামহের স্মৃতি

আমার নানা আমার রুমে এলেন। আমি কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছি। তিনি আমার বিছানার প্রামেত্ম বসলেন। তার হাতে একবাক্স চকোলেট, চকোলেটের ভেতরে মদ। তাঁর চোখের চাহনিতে সাধারণ দুষ্টুমি ও হাসি। সে-রাতে তিনি তাঁর কাঁটার মতো দাঁড়ানো ক্রুকাট ধূসর মাথার নিচ থেকে ক্লান্ত অভিব্যক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন।

তিনি চকোলেটের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন আর নিজের পরনের অশ্বারোহণ প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনলেন এক বোতল ভদকা।

তিনি বললেন, ‘আমরা একসঙ্গে ড্রিংক করতে চাই। তুই খাবি চকোলেট আর আমি ভদকা।’

তাঁর সমতল করতলে ভদকার বোতলের তলদেশে চাটি মারলেন এবং কর্ক বের করে আনলেন। আর আমি বাক্স থেকে তুলে নিলাম চকোলেট। আমাকে যাতে বয়স্ক মানুষের মতো মনে হয় সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কার জন্য পান করব?’

একধরনের নির্মম সারল্য নিয়ে তিনি বললেন, ‘বিপস্নবের জন্য।’
খুন

তোমার চেয়ে সুন্দর করে আর কেউ ঘুমোয় না

কিন্তু আমি ভয় পাই

এই বুঝি তুমি জেগে উঠলে

আর আমাকে ছুঁয়ে দেবে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে, আলতো করে,

আর সুন্দরের হত্যাকা- ঘটাবে।
বাবি ইয়ার

ইতিহাসের ভয়ংকর নগ্ন ও পাশবিক একটি চাপাপড়া অধ্যায়ের পুনরুদ্ভব ঘটেছে ইয়েভতুশেঙ্কোর ‘বাবি ইয়ার’ কবিতায়। বাবি ইয়ার ইউক্রেনের কিয়েভের একটি গিরিখাত। ইতিহাসের জঘন্যতম নারকীয় হত্যাকা-টি ঘটেছে এখানেই, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১-এর এই হত্যাযজ্ঞে নিহত হয়েছেন ৩৩ হাজার ৭৭১ জন ইহুদি। জার্মান এসএসের পুলিশ কমান্ডার মেজর জেনারেল কুর্ট এবারহার্ড নির্দেশ দিয়েছেন কিয়েভের সব ইহুদিকে হত্যা করতে হবে।

২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ তারিখে জারি করা আদেশটি এমন :

কিয়েভ শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল ইহুদিকে ২৯ নভেম্বর সোমবার সকাল ৮টার মধ্যে মেলনিকোভা ও দরোহোজিসকা সড়কের প্রামেত্ম (ভিস্কোভা গোরসত্মানের পাশে) সমবেত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তারা সঙ্গে আনবে দলিল, টাকা, মূল্যবান দ্রব্য, গরম কাপড়, চাদর ইত্যাদি।

যেসব ইহুদি এ-আদেশ অমান্য করবে, অন্য কোথাও পাওয়া গেলে তাদের গুলি করে হত্যা করা হবে। কোনো বেসামরিক ব্যক্তি যদি ইহুদিদের ফেলে আসা ঘরবাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাদের জিনিসপত্র আত্মসাৎ করে, তাদের গুলি করে হত্যা করা হবে।

জার্মান এসএসের একটি স্পেশাল টিম স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। হোফার নামের একজন ট্রাক ড্রাইভারের বর্ণনা : প্রথমে নেংটা হওয়ার আদেশ, বাধা দিলে আঘাত। স্থানীয় ইউক্রেনিয়ানরা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, নির্ধারিত স্থানগুলোতে তাদের লাগেজ, কোট, জুতো, পরনের কাপড় এবং আন্ডারওয়্যার জমা করতে হয়েছে। নির্ধারিত স্থানে মূল্যবান সামগ্রী জমা পড়েছে। সব ধরনের দ্রব্যের ভিন্ন ভিন্ন সত্মূপ।

নগ্ন হওয়ার পর তাদের ১৫০ মিটার দীর্ঘ, ৩০ মিটার প্রস্থ এবং ১৫ মিটার গভীর গিরিখাতের তলদেশে নিয়ে উপুড় করে শোয়ানো হয়েছে, তারপর গুলিবর্ষণ। তারপর আরেক দল নগ্ন ইহুদিকে নিয়ে শোয়ানো হয়েছে নিহতদের ওপর, এভাবে শবের সত্মূপ করা হয়েছে – মোট ৩৩ হাজার ৭৭১ জন। এই হত্যাযজ্ঞ থেকে হাতেগোনা যে-কজন বেঁচেছেন তাঁদের মধ্যে ২৯ জনকে শনাক্ত করা গেছে। কিয়েভ যতদিন জার্মানির দখলে ছিল, হত্যাকা- অব্যাহত রয়েছে। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সময় দাবি করা হয়েছে, বাবি ইয়ারে প্রাপ্ত লাশের সংখ্যা এক লাখ।

আনাতোলি কুজনেৎসভ দাবি করেছেন, বাবি ইয়ার শুধু ইহুদি কবর নয়, এটি আন্তর্জাতিক কবর – ইউক্রেনিয়ান, রাশান, জিপসি এবং বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ এখানে নিহত হয়েছে।

বাবি ইয়ারের নৃশংসতাকে প্রথম কবিতায় তুলে ধরেন ইহুদি-ইউক্রেনিয়ান কবি লুডমিলা টিটোভা, আরো মাইকোলা বাঝান, মোসে ফিশবিন, ইলিয়া এরেনবুর্গ, ওলগা আনস্টেল, লেভ ওজেরভ এবং আরো অনেকে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর ‘বাবি ইয়ার’ কবিতায় এবং ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সোভিয়েত সরকার বাবি ইয়ারের ঘটনা এবং নিজ দেশ ও নিজ দলীয় লোকদের যোগসাজশ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। এ নিয়ে মুখ খুলতে চায়নি সরকার। ১৯৬১ সালে এরই প্রতিবাদে ইয়েভতুশেঙ্কো লেখেন ‘বাবি ইয়ার’ :

বাবি ইয়ারের ওপর কোনো স্মৃতিসৌধ দাঁড়িয়ে নেই

…   …  …

 

এখানে আমি প্রাচীর মিসরের ভেতর দিয়ে ঠেলে এগোই

এখানে আমি ক্রসের ওপর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে নিঃশেষ হই

এবং এদিন পর্যন্ত আমি এদের আঁচড়ের ক্ষত বহন করি

…   …  …

 

রক্ত বয়ে যায় মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ে

বারের ভেতর উত্তেজনা ছড়ানো গণবক্তারা

ভদকা ও পেঁয়াজের দুর্গন্ধ ছড়ায়

একটি বুট আমাকে লাথি মেরে একপাশে ঠেলে দেয়,

অসহায়, আমি সেই হত্যাকারীর সাঙ্গাতদের সঙ্গে

তর্ক করি, তারা উপহাস করে এবং চেঁচায়

‘শালা ইহুদিকে পেটাও, রাশিয়াকে বাঁচাও।’

…   …  …

 

বাবি ইয়ার গিরিখাতে বুনোঘাসের মর্মর

বৃক্ষগুলোকে দেখায় অমঙ্গলের স্মারক

বিচারকের মতো।

এখানে সবকিছুর আর্তচিৎকার নীরবে

আর আমার মাথা খুলে

ধীরে ধীরে আমি অনুভব করি

বুড়িয়ে যাচ্ছি, ধূসর

আর আমি নিজে

হয়ে উঠি অতিকায় এক নিঃশব্দ আর্তচিৎকার

এখানে সমাহিত

হাজার হাজার মানুষের ওপর।

এখানে গুলিতে নিহত প্রতিটি বৃদ্ধ

আমি

এখানে গুলিতে নিহত প্রতিটি শিশু

আমি।

…   …  …

 

আমার রক্তে কোনো ইহুদি রক্ত মিশে নেই

তাদের খেয়ালি বোধে ইহুদি-বিদ্বেষী সবাই

ইহুদি মনে করে আমাকে ঘৃণা করবে

সে-কারণেই আমি একজন

সত্যিকারের রাশান।

 

ইয়েভতুশেঙ্কো থেকে উদ্ধৃতি

নীরবতা যখন সত্যকে প্রতিস্থাপন করে, সে-নীরবতা আসলে মিথ্যে।

* * *

কবিতাই একজন কবির আত্মজীবনী। আর যা কিছু সব ফুটনোট।

* * *

যদি কোনো মানুষ মারা যায়, তার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে তার প্রথম তুষার, প্রথম চুম্বন ও প্রথম লড়াই। মানুষ মরে না, বরং তাদের মধ্যে পৃথিবীগুলোর মৃত্যু হয়।

* * *

ঈর্ষা হচ্ছে নিজেকে অপমান করা।

* * *

অনুবাদ নারীর মতন। সুন্দর হলে বিশ্বাসী নয়, আর যদি বিশ্বাসী হয় তাহলে অবশ্যই সুন্দরী নয়।

* * *

সময় নিজস্ব একটি উপায়ে দেখিয়ে দেয় সবচেয়ে যারা একগুঁয়ে তারাই সবচেয়ে বুদ্ধিমান।

* * *

দুঃখ আসে, কষ্টের জীবন আসে – এসব গোলস্নায় যাক, যে-সুখের মূল্য জানে না, সে সুখী হবে না।

* * *

ডানপন্থী জারজগুলো কেন কাঁধে কাঁধে একাত্ম হয়। কিন্তু উদারপন্থীদের নিজেদের মধ্যে এত বিভেদ।

* * *

রাশিয়াতে সব স্বৈরাচারই বিশ্বাস করে কবিরাই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রম্ন।

* * *

খাঁচার ভেতরে যার ভ্রূণের জন্ম, সে তো খাঁচার জন্যই হাপিত্যেশ করবে।

* * *

কবিতা হচ্ছে একটি পাখি, যে সব সীমান্তকে উপেক্ষা করে।

* * *

ন্যায়বিচার হচ্ছে ট্রেনের মতো, যা সবসময়ই লেট।

* * *

আমি খেলাধুলা পছন্দ করি, কারণ আমি জীবনকে ভালোবাসি; জীবনের আনন্দের গোড়াতেই খেলাধুলা।

* * *

যখন অন্যের যন্ত্রণার অনুভূতি কেউ পেতে শুরু করে, তখন থেকেই মানবজীবন শুরু। r