প্রথম অর্জুন

জলধি হালদার

এক
এই বাংলার সব পাখি ও নদীর মতো
আপনার সমূহ গা-ীব
আর অগাধ জলের তূণীর
চলে গেল বঙ্গোপসাগরে।

কে ডাকবে তাঁরে!
আমাদের লোক ও অলোককাহিনিতে এখন শূন্যতার প্রহর
অভিদ্রোহী গাছের শিকড়ে।

মনে করো সাবলীল, এসব বৈশাখে রচিত হয়
ধারালো বঁটির সামনে ছাই মাখানো মাছ
পরানের গহিন ভিতরে।

দুই
আমি নেপেন দারোগা থেকে আসছি
খিস্তি দিতে দিতে
আধো আধো চাঁদের আলোয়
গরুর গাড়িতে
একজন বিপ্লবীর মৃতদেহ
উজাড় গাঁয়ে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি

আগুনের লেলিহান বাচ্চারা তাকে জড়িয়ে ধরছে…

কবি চলে গেছে?
আনন্দময়ী মজুমদার

দুই তালুর মাঝখানে দুই নিমীলিত পদ্মকোরক
আর অঝোর জ্যোৎস্নাসফেন ঘুমু –
শিশু, টবে শিশু গাছের বাড়তে চাওয়া
নিতান্ত নিতান্ত সবুজ হতে চাওয়া হাড়
এই দগ্ধ সংসার
ফুলের গন্ধ এখানে আসি-আসি করে
ভ্রমর পলাতক

আমি তবু থেবড়ে এখানেই বসি বারবার
চড়–ইয়ের সময়হীনতায়
মণিবন্ধে ঘড়ি রাখি না তো আর

কাল যে ঘর খোলা ছিল, সেখানে চাবি পড়ে গেছে
কাল যে ঘর ছিল খোলা, সেই বাসা উঠে গেছে
কাল যে মাঠ ধু-ধু ছিল, সেখানে শেওলা ধরে গেছে
কাল যে পুকুর বন্ধুপ্রতিম, সেখানে পানকৌড়ি নেই

আমি তবু আমার কাছে আসি
ফাঁকা উদ্যানে এই দহনে বিচ্ছুরিত প্রাণ কবির প্রয়াণে
কবিতার ছায়াপথ খুঁজে

বসি – পড়ি নানান সংবাদ
শিরোনামে চলে যাওয়া তাঁর
খবরের কাগজ নিয়ে চা আর মুড়ির সোহাগে
একটু ফাঁক খুঁজি
যেন সুড়ঙ্গপথ জানা আছে এলিসের
দেখি সুখী পায়রা ডানা ঝাড়ে নাকি,
জানালায়
এইখানে আছি,
আছি, আমার সঙ্গেই,
ঘরজোড়া ছাড়া মৌমাছি – কবিতারা –
কবিতা যারা উস্কে দেয়, তারা।

এই ঘরের প্রান্ত জুড়ে
ক্লান্তি ঢালি শরীরের ঘট থেকে
কে-বা জানে কার পুণ্য হয়
কাঁটাতার হাহাকার বলির চিৎকার
মুছে যাবে নাকি, ঘুচে যাবে নাকি, ভয়?

কবি চলে গেছে,
কবিতার কেটলি থেকে
গরম চায়ের উস্কানি রেখে
সুঘ্রাণে দিয়ে গেছে অনেক অনেক ঘরছাড়া
মৌমাছির উদাসিনতা

মনে পড়ে, কদমের নিচে, বরইয়ের টকে
শৈশবের অলিন্দে – আর কৈশোরের ঝুলবারান্দায়
কবিতার কত মধুরতা –
বিদায়ী ঘরে যেয়ে চেয়ে নেবো নাকি সেই সব মদির, মদির
আলোকিত স্মৃতি?… কবি চলে গেছে?

আমি ভাবি,
সোনার মোহর যেই পথে, যে-পথে পুন্নিমা-চান
মধু ভরা মাছি
সে পথে, আমি কি তবু আমার হয়ে আছি?
আমার কাছেই কি সে-মাল্লার ঘর,
পরাণের গহীন ভিতর?

সে চলি যায় কেন্
জোবায়ের মিলন

সকালে এতো বৃষ্টি হলো কেন,
ঝাপুরঝুপুর ধারা বইলো কেন,
শ্রাবণের আকাশ কেন টুপটাপ করে
ঝরে গেল মা-হারা শিশুর মতো?
মেঘেরা কি পিঁপড়ার মতো জেনেছিল
শোকের পূর্বাভাস?
‘পরাণের গহীনের ভিতর’ ধাপুরধুপুর ভাঙন!
গঙ্গার স্রোত খেয়ে নিচ্ছে গাঁও-গেঁরাম
‘কার কাছে যাইয়া কমু, সে চলি যায় কেন্!’
‘নূরলদীন কার কাছে যাইয়া কবে –
সে চলি যায় কেন্!
কলিমুদ্দিন কার কাছে যাইয়া কবে –
সে চলি যায় কেন্!
জলেশ্বরী কার কাছে যাইয়া কবে –
সে চলি যায় কেন্!
কও’না কার কাছে যাইয়া কমু, সে চলি যায় কেন্!’

এখনো খুঁজে ফিরছি
মাজেদুল হক

চারিদিকে শুধু শোকের মাতম!
প্রকৃতির সমস্ত কোলাহল, আকাশ-বাতাস, পাখির কলকাকলি
ঋতুরাজ বসন্ত, চারিদিকের আনন্দ উৎসবের মুখরতা
এখন ঘোর অমানিশায় সয়লাব।
সব যেন নির্বাক, নিথর শান্ত, বোবা কান্নার আর্তনাদ…

হারানোর বেদনায় শুকিয়ে গেছে দুচোখের জল
নিরলস নীল কষ্টের স্রোত বয়ে যাচ্ছে শূন্যতার গভীর অতলে।
অদৃশ্য আঁধারও হৃদয়ের ভেতর
হামাগুড়ি দেয় প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণ…

এখনো ফেরারি হয়ে খুঁজে ফিরছি
যার হাতের ছোঁয়ায় ছিল অসম্ভব জাদু।
সেই চিরচেনা, সাহিত্যপ্রেমী, বহুরূপের কর্ণধার
অদ্ভুত আকর্ষিকতার আলোকিত মানুষটাকে।