প্রদোষে প্রাকৃতজন : ধ্রম্নপদী ভাষ্যে দূরবর্তী জীবন

কথাসাহিত্য আবেগতাড়িত মুহূর্তের শিল্প নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিমূর্ত সংকেতনিচয়ের রেখাঙ্কন, এমনকি জীবন ও জগতের স্পর্শযোগ্য নয় এমন কোনো আদর্শ ও মূল্যনিরপেক্ষ শিল্পও উপন্যাস নয়। তাহলে উপন্যাস কী? বাসত্মবিকই কি এর কোনো আদর্শ গড়ন-সংগঠন আছে, যার মাধ্যমে উপন্যাসকে সংজ্ঞায়িত করা যায়? এমন কোনো রীতিনীতি, স্বভাব-বৈশিষ্ট্য কি উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে এর ব্যাকরণ নির্ধারণ সম্ভব? না, নাটকের মতো, কবিতার মতো, সংগীতের মতো এর কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই। আর এই ব্যাকরণহীনতার জন্যই উপন্যাসশিল্পের কোনো সূচনালগ্ন নেই; কোনো
দেশ-কাল-সময়ের গণ্ডেরনিরিখ নেই। তাহলে প্রতিটি উপন্যাস কি একেকটি সয়ম্ভূ বিষয়, একেকটি স্বতন্ত্র শিল্প? এর কি সাধারণ বৈশিষ্ট্যসূচক কোনো পরিচয় নেই, যাতে পাঠক বলবে – এটি উপন্যাস? নিশ্চয়ই আছে এবং সেই পরিচয়সূত্র হলো গল্প, আখ্যান ও জনসম্পৃক্ততা। এই ত্রিবেণীসঙ্গমের ভেতর দিয়ে রচিত হয় উপন্যাস। সুতরাং, উপন্যাসে নাটক থাকতে পারে, কবিতা থাকতে পারে, গান থাকতে পারে, এমনকি প্রবন্ধ থেকে শুরু করে ভ্রমণকাহিনিও থাকতে পারে; পারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের হাজারটা বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে। আত্মস্থ করার এই বিপুল ক্ষমতার জন্যই এই শিল্পটি ব্যাকরণহীন, বিধিবিধানের ঊর্ধ্বে।

এই যদি হয় উপন্যাস, তাহলে কেন উপন্যাসকে আমরা বিজ্ঞানের সবচেয়ে কাছাকাছি শিল্প হিসেবে গণ্য করি? এই জিজ্ঞাসার উত্তর একটিই, তা হলো, জীবন ও জগতের ন্যায়সূত্র ধারণে উপন্যাসের মতো মহত্ত্ব আর কোনো শিল্পের নেই। জীবন ও জগতের গভীরতর অধ্যায় ন্যায়-অন্যায়ের, আদর্শ-অনাদর্শের, সুন্দর-অসুন্দরের, উচিত- অনুচিতের যে অনন্য নিরপেক্ষতার পটভূমি লক্ষ করা যায়, উপন্যাস সে-জীবনের শিল্প। এই কনটেক্সট ধর্মের নয়, মতাদর্শের নয়, এমনকি আবেগেরও নয় – সমগ্র বিষয়টিই হলো জীবনের। উপন্যাসই একমাত্র শিল্প, যেখানে জীবন তার আপন স্বভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। এই যে আপন স্বভাব – এর জন্যই উপন্যাস বিধানসংবদ্ধ নয়। প্রতিটি উপন্যাসই একটি স্বতন্ত্র স্বভাবে গড়ে ওঠে, একটি স্বতন্ত্র জগৎ ও জীবন সেখানে তার সকল সৌষ্ঠব নিয়ে তৈরি হয় অথবা বলা যায় তৈরি হয় না – জন্মে, বেড়ে ওঠে, বিকশিত হয়, বিপুলতা লাভ করে এবং সেই জীবন ও জগতের ভেতর উচ্চার্য-অনুচ্চার্য বহুতর জীবন ও জগতের আর্কেটাইপ রচিত হয়। আমাদের উপন্যাসশিল্পের পূর্বাপর যে-ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, সেখানে উপন্যাসশিল্পের এই ন্যায়সূত্র কীভাবে কার্যকর হয়েছে, সে-বিশেস্নষণে না গিয়েও বলা যায়, জীবনের গূঢ়তর রহস্য ও সংঘাতময়তার ভেতর-গড়ন আমাদের উপন্যাসে কখনো তাৎপর্যময় হয়ে ওঠেনি। জীবনের মহাকাব্যিক বিসত্মার ও বিপুলতার সৌন্দর্য আমাদের উপন্যাসশিল্পে দৈবাৎ ধরা দিয়েছে। আর প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে একেকটি স্বতন্ত্র সত্তার বাচনিকতা থেকে শুরু করে আচরণ ও ব্যবহারবিধির মধ্যে একটি স্বতন্ত্র স্বর, তথা একটি স্বতন্ত্র জীবন ও জগৎ রচিত হয়, সে-স্বাতন্ত্র্যকে স্পষ্ট করে তোলে তার স্বর। আর এসবের প্রায় ব্যাখ্যাতীত এক অন্বয়ের ভেতর দিয়ে রচিত হয় উপন্যাসশিল্প। শওকত আলী এই উপন্যাসশিল্পের শিল্পী। অসাধারণ এক মমত্ববোধের আশ্রয়ে তিনি উন্মোচন করতে চেয়েছেন মানবজীবনের বিচিত্র সম্পর্কের রহস্যময়তা, রক্তাক্ত যন্ত্রণা, মুক্তির আয়ুধ।

শওকত আলী মূলত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক। তবে তাঁর প্রথম উপন্যাস পিঙ্গল আকাশ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে এবং প্রথম গল্পগ্রন্থ উন্মূল বাসনা
প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। এরপর তাঁর প্রচুর গল্প-উপন্যাস সবই স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের সৃষ্টি। আর এই সুপ্রচুর কথাসাহিত্যের মধ্যে বিষয় ও ভাষা নির্বাচনের অনন্যতায় যে-উপন্যাসটি পাঠকসমাজে বিপুল খ্যাতি অর্জন করে, সেই প্রদোষে প্রাকৃতজন শীর্ষক উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। এই উপন্যাসে তিনি বিশ শতকের প্রায় শেষপ্রামেত্ম দাঁড়িয়ে সুদূর পেছনপানে তাকিয়ে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের শিল্পভাষ্য রচনা করেছেন। লক্ষ্মণ সেনের (আনুমানিক ১১৭৮-১২০৬ খ্রি.) ২৮ বছরের রাজত্বকালের শেষ বছরগুলোতে তিনি বার্ধক্যে এবং ক্ষমতা প্রয়োগে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। অনেক সময় শাসনকার্য পরিচালনা তাঁর জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল। এই দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের ভেতরে ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল ধরে এবং কিছু স্বাধীন শক্তির উত্থান ঘটে। এ ছাড়া শক্তিমান ও ক্ষমতাধরদের অরাজকতা দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এ-পরিস্থিতিতে তুরস্কের মুসলমান অভিযানকারী বখতিয়ার খলজি অনায়াসেই বাংলা দখল করে নেন। এই বিশৃঙ্খল পটভূমিতে গ্রামবাংলা কীভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিল, ক্ষমতাধরদের তা-ব ও লুটপাটে কীভাবে মানুষ গ্রামছাড়া হয়েছিল এবং এর মধ্যে কিছু নর-নারী বিচিত্র সম্পর্কের টানাপড়েনে কীভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল, সেসবের নানামাত্রিক বুনন-বিন্যাসে গড়ে উঠেছে প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি।

 

একটি বিস্ময়কর সংঘাতের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি শুরু। এই সংঘাত গুরুর সঙ্গে শিল্পের স্বরূপ নিয়ে শিষ্যের সংঘাত। গুরু বাসুদেব শিষ্য শ্যামাঙ্গকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ‘দেখো, কোনোভাবেই যেন তোমার ফলকে ব্রাত্য প্রসঙ্গ না থাকে – শাস্ত্রানুশাসন বিচ্যুত হয়ো না।’

গুরু বাসুদেব প–ত মানুষ। তার পা–ত্য যেমন মৃত্তিকাপট নির্মাণে, অন্যদিকে সনাতন ধর্মেও। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তিনি শিল্পের ভেতর দিয়ে তাঁর ঈশ্বরভাবনার সনাতন বিশ্বাসকে ফলিয়ে তুলতে চান। অন্যদিকে তরুণ শ্যামাঙ্গ শিল্পকে একান্ত শিল্প হিসেবেই দেখতে চায়। তার শিল্পের কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই, কোনো শ্রেণি-পেশা নেই। সুতরাং, সে গুরুর কাছে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, ‘কেন গুরুদেব, ব্রাত্য মুখচ্ছবিতে অপরাধ কী?’

এই জিজ্ঞাসায় গুরুদেব বিস্মিত হন, তীক্ষন হয়ে ওঠে তাঁর দৃষ্টি। বলেন, ‘অপরাধের কথা তো বলিনি, বলেছি প্রয়োজনের কথা। মন্দিরগাত্রে যে-মৃত্তিকাপট থাকবে তাতে পবিত্র ভাবটি থাকা চাই। মেস্নচ্ছ ব্রাত্যের মন্দিরে প্রবেশ-অধিকার না থাকলে তাদের প্রসঙ্গ কেমন করে মন্দিরগাত্রের মৃত্তিকাপটে উৎকীর্ণ হতে পারে বলো?’

শিল্পভাবনার এই ফেনাটিক ধারণার সঙ্গে শ্যামাঙ্গ পরিচিত ছিল না। এমনকি, সে এও বুঝতে পারে না যে, মৃৎপট বা শিলাপট কী করে অপবিত্র হয় কিংবা ব্রাত্যজনের অপবিত্রতার সঙ্গে শিল্পের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না।

শ্যামাঙ্গের এই ভাবনায় বাসুদেব বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘মৃত্তিকা ও শিলা পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্বত্রই আছে, কিন্তু দেবতার পীঠস্থান সর্বত্র নেই। সকল মৃত্তিকা বা শিলা দেবতা হয় না। গুরুর এই ধার্মিকতায় শ্যামাঙ্গ বিভ্রান্ত হয়। বাসুদেবকে সে জানত শিল্পী হিসেবে। তাঁর শিল্প-প্রতিভায় ও পা–ত্যে শ্যামাঙ্গ মুগ্ধও ছিল; কিন্তু ধর্মের বাতাবরণে শিল্পের ব্যাখ্যা সে কিছুতেই মানতে পারে না। তার বুদ্ধি বিভ্রান্ত হচ্ছিল। কিন্তু তার হৃদয় অনড়। গুরুর কাছে তার অসংখ্য প্রশ্নের উদ্ভব ঘটছিল। কঠিনতর জিজ্ঞাসাগুলোর তীক্ষন ও দ্রম্নতগতির তীর গুরুর দিকে নিক্ষক্ষপের জন্য তার মনের ধনুক টানটান হয়ে উঠছিল। ‘গুরুদেব, তাহলে দেবতা কী? ভগবান কী? জগৎ কি দেবতাসম্ভূত নয়?’ গুরুদেব চমকে উঠেছিলেন। এমনতর কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্ত্ততি তাঁর ছিল না। তিনি দ্রম্নত এই জটিল পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে মুক্ত হতে চান। সুতরাং স্পষ্টভাবে শ্যামাঙ্গকে জানিয়ে দেন, ‘জটিল তর্ক ক’রো না শ্যামাঙ্গ, দেবতার পীঠস্থান ধর্মসিদ্ধ – তুমি শুধু এইটুকু মনে রাখবে যে, ধর্মই সত্য, পরম ব্রহ্মই সত্য – ব্রহ্মজ্ঞান যার আছে সেই ব্রাহ্মণের নির্দেশই পালনীয় – আর অন্য কিছু সত্য নয়, পালনীয় নয়।’

শ্যামাঙ্গ স্পষ্টভাবেই অনুধাবন করে, গুরুদেব তাকে পরিষ্কার আদেশ দিয়ে শেষ করতে চান। কিন্তু শ্যামাঙ্গ তো ইতোমধ্যে মৃত্তিকাপটে মানবীমূর্তি উৎকীর্ণ করেছে, তার কী হবে? গুরুদেব দেখতে চান, কী মানবীমূর্তি সে মৃৎশিল্পে ফলিয়ে তুলেছে। সুতরাং অনিবার্যভাবেই শ্যামাঙ্গকে তার মৃৎশিল্প প্রদর্শনে গুরুকে নিয়ে যেতে হয়।

কাঁচা মৃৎশিল্পগুলো তখন রৌদ্রে শুকাচ্ছিল। তার দায়িত্ব ছিল, রামায়ণ-কাহিনির চিত্রমালা মৃৎশিল্পে উৎকীর্ণ করা। সে গভীর ভালোবাসা আর মমত্বের সঙ্গে জানকীর বরমাল্য দান, রামের বনগমন, হনুমানের গন্ধমাদন বহন ইত্যাদি কাহিনি মৃৎফলকগুলোতে ফলিয়ে তোলে। এ ছাড়া প্রেমিকের কণ্ঠলগ্না ব্যাধ-তরুণীর প্রণয়দৃশ্য, শরব-যুবতীর প্রতীক্ষার দৃশ্য এবং মাতৃময়ী ধীবর রমণীর সমত্মানকে সত্মন্যদানের দৃশ্যগুলোকেও শ্যামাঙ্গ অসাধারণ এক মানবিকতায় প্রাণময় করে তোলে।

গুরু বাসুদেব মানবীয় লালিত্য ও প্রেমময়তায় জীবন্ত এসব মৃৎশিল্প দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। দেবমন্দিরের সঙ্গে প্রণয়দৃশ্যের সম্পর্ক তাঁর কাছে দুর্বোধ্য। এর প্রাসঙ্গিকতা নেই, কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ শুধুই দূরান্বয়, শুধুই ছলনা। বাসুদেব বলেন,

এ কেমন মুখাবয়ব, এ কেমন মুখভাব বলো? এ মানবিক লালিত্যে কী প্রয়োজন? কেন তোমার ফলকচিত্রে কেবল নমনীয় পেলব রেখা? কেন এই বৃত্তাকার ভঙ্গি? ঋজুতা
কোথায়, দৃঢ়তা কাঠিন্য কোথায়? ওষ্ঠ কেন এমন বিলোল হবে? এ হয়নি – সব ভুল হয়েছে তোমার। শ্রী রামচন্দ্রের কি এই মুখাবয়ব হয় কখনো? এ তো মানবিক আকৃতি, মানবিক ভাব, দেবতা কোথায়? জানকী আর যক্ষক্ষণী মূর্তিতে যে কোনো পার্থক্য নেই। এসবে কাজ হবে না – বিনষ্ট করো সব।

গুরু বাসুদেবের এই নিষ্ঠুর আচরণে কাতর আর্তনাদ করে ওঠে শ্যামাঙ্গ। তার অবচেতনে লালিত জীবনতৃষ্ণার এক প্রগাঢ় উন্মোচনের বেহাল দশায় সে অস্থির হয়ে ওঠে। সুতরাং, সর্বশক্তি দিয়ে সে গুরুকে বোঝাতে চায়, কী অসাধারণ এক প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সে শিল্পগুলো রচনা করেছে; বলে, ‘গুরুদেব, এসব মূর্তিতে যে আমার আবেগ স্পন্দিত হয়েছে, রক্তধারার ছন্দ যে এদের রেখায় রেখায় বিবৃত হয়ে রয়েছে। দেখুন আপনি, এই ব্যাধ তরুণ-তরুণীর মুখভাবে সঙ্গীত মর্মরিত হচ্ছে কি না?’ শ্যামাঙ্গের এই অসাধারণ শিল্পবোধপূর্ণ বিনয় বচনে বাসুদেব বিমুগ্ধ হন না। বরং অবিশ্বাস্যরকম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। নিষ্ঠুর এক সত্যের মুখোমুখি হয়ে তিনি যেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ওঠেন। বাসুদেব বলেন,

মূর্খ তুমি শ্যামাঙ্গ, একেবারেই মহামূর্খ। তোমার স্মরণে থাকা উচিত যে, এসব নির্মিত হচ্ছে তোমার পিতৃধনে নয়। এসব নির্মাণের বিপুল ব্যয়ভার বহন করছেন কায়স্থ কুলতিলক মহাসামন্ত সুধীমিত্র। সুতরাং তাঁর আদেশ-নির্দেশই তোমার মান্য করতে হবে। তুমি আদেশের দাস মাত্র – তাঁর আদেশ পালনের জন্যই তোমাকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, প্রতিমা নির্মাণশাস্ত্র ব্যাখ্যার জন্য নয়।

বাসুদেব জাত শিল্পী। শিল্পের ন্যায়সূত্র তিনি জানেন। শিল্পের স্বভাব শিল্পের সৌন্দর্য। শিল্পীর স্বাধীনতার ব্যাপারেও তিনি সংবেদনশীল। একসময় শ্যামাঙ্গকে তিনি জানিয়ে দেন যে, বরেন্দ্রভূমির মৃৎশল্পীরা মৃৎফলকে জনজীবনের দৃশ্যাবলি জীবন্ত করে তুলেছে। শ্যামাঙ্গ স্পষ্টতই স্মরণ করতে পারে, সোমপুর মহাবিহারের অসাধারণ সব শিল্পকর্মের পরিচয় এই গুরুদেবই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। ‘যোগীভিক্ষু, মৃগয়া প্রত্যাগতা ব্যাধরমণী, শৃঙ্গারমগ্ন মানব-মানবী, ঢাল-তরবারি হসেত্ম বীরবটিকা পরিহিতা বীরাঙ্গনা’ এসব শিল্পকর্মের ঐশ্বর্য ও মাহাত্ম্য তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

যৌবনে তিনি দরিদ্র জীবনযাপন করতেন। রাজানুগ্রহ লাভের চেষ্টা কখনো করেননি তিনি। শিল্পকর্মে সমৃদ্ধ অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন বছরের পর বছর। প্রতিমা লক্ষ্মণশাস্ত্রে সুপ–ত। মৌর্য ও গুপ্তযুগের প্রতিমা নির্মাণকলা কীভাবে গৌড়ীয় রীতির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে, তার ব্যাকরণ তিনি জানেন। অসাধারণ এক নিষ্ঠা, সততা ও শ্রমের মাধ্যমে তিনি আয়ত্ত করেছেন ভারতবর্ষের শিল্পচর্চার ইতিহাস, রীতিনীতি ও স্বভাব-চরিত্র। এখন তিনি একেবারে ভিন্ন মানুষ, একেবারেই ভিন্ন তাঁর জীবনবোধ ও জীবনতৃষ্ণা। বাসুদেবের এই পিছু হটার তাৎপর্যময় কোনো ইঙ্গিত-ইশারা উপন্যাসে লক্ষ করা যায় না। একি নিজের কোনো গোপন পরাজয়ে নিজের প্রতিই অবচেতন সংক্ষুব্ধতা, রাজানুগ্রহ ও অর্থের কাছে দাসবৃত্তির যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ, নাকি শ্যামাঙ্গের কোনো অপরাধের প্রতিশোধ। সে যা-ই হোক না কেন, এই আয়োজন পৃথিবীর মহত্তর উপন্যাসশিল্পের কথাই মনে করিয়ে দেয়। যে-জীবনতৃষ্ণা ও জীবনাকাঙক্ষার দ্বন্দ্ব নিয়ে উপন্যাসের এই যাত্রারম্ভ, ঐতিহাসিক পটভূমিতেও এর তাৎপর্য বিস্ময়কর। কেননা, শিল্পচর্চার মাহেন্দ্রক্ষণ নিরবধি নয়। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক গড়ন-প্রকৃতির মধ্যেও শিল্প-সাহিত্যচর্চার মনোভূমি তৈরি হয়।

ঐতিহাসিক নিদর্শন অনুযায়ী রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে শিল্প-সাহিত্যচর্চার জোয়ার এসেছিল। তাঁর রাজসভায় অনেক প–ত ও শিল্পী-সাহিত্যিকের সমাবেশ ঘটেছিল। উমাপতি ধর ও শরণ ছিলেন তাঁর সভাকবি। তিনি নিজেও সাহিত্যচর্চা করতেন। তাঁর রচিত বেশকিছু সংস্কৃত কবিতা সদুক্তিকর্ণামৃত কাব্যসংকলনে স্থান পেয়েছে। পিতার শুরু করা গ্রন্থ অদ্ভুতসাগর তিনি সমাপ্ত করেছিলেন। গীতগোবিন্দ-রচয়িতা বিখ্যাত কবি জয়দেব, পবনদূত-রচয়িতা ধোয়ী এবং গোবর্ধন আচার্য তাঁর সভা অলংকৃত করতেন। বটু দাসের ছেলে লক্ষ্মণ সেনের বন্ধু শ্রীধরদাস সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ সদুক্তিকর্ণামৃত সংকলন করেন তাঁরই শাসনামলে। তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারক হলায়ুধ মিশ্র রচনা করেন ব্রাহ্মণসর্বস্ব দেরপাড়া প্রশসিত্ম-রচয়িতা উমাপতি ধর লক্ষ্মণ সেনের একজন মন্ত্রী ও অন্যতম সভাকবি ছিলেন। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের বিস্ময়কর সূচনালগ্ন যেন শিল্প-সাহিত্যচর্চার অসাধারণ সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, উপন্যাসটি আর এই পটভূমিতে পরিচর্যা পায়নি। তীব্র অভিমানে, ক্ষক্ষাভে, যন্ত্রণায় শ্যামাঙ্গের গুরুগৃহ ত্যাগের পর থেকে অসাধারণ একটি উপন্যাসশিল্পের আয়োজন বৃষ্টিবিঘ্নিত অনুষ্ঠানের মতো বিপুল বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়। গভীর মমত্ববোধ ও প্রগাঢ় জীবনাকাঙক্ষার অসাধারণ শিল্পশক্তি নিয়ে শওকত আলীর আবির্ভাব। সেই অসাধারণ শিল্পশক্তি নিয়ে তিনি বরেন্দ্রভূমির প্রাচীন জনপদের পরিচয়, সেই জনপদে শ্যামাঙ্গ-লীলাবতীর প্রণয়, রাজ-রাজড়াদের অত্যাচার ও লুটপাট, বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও নবাগত মুসলমানদের উত্থান ইত্যাদির বিবরণ তুলে ধরেছেন, তা শেষ পর্যন্ত প্রগাঢ় হয়ে ওঠেনি – প্রবল কোনো জীবনাকাঙক্ষার গাঢ়বদ্ধ সংগঠন হয়ে ওঠেনি। পুরো উপন্যাসে নারী-পুরুষের প্রণয়সম্পর্ক একদিকে আত্মিক সংযমের শুদ্ধতায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে কতগুলো রূপক, প্রতীক ও সংকেতময়তায় দেহগত সম্পর্ক জনজীবনের ভাবনানিচয়ের বিষয় হয়ে উঠেছে; বাসত্মব ভিত্তি রচিত হয়নি।

উপন্যাসের শেষে লক্ষ করা যায়, যবন-সেনাদের হাতে নিরীহ শ্যামাঙ্গ নিহত হয়। এই তার পরিণতি। আর লীলাবতী, বসন্তদাস, ছায়াবতী, মিত্রানন্দ, নিরঞ্জন এবং আরো অনেকের পরিণতি জানা যায় না। শিল্পের দায় নেই যে, সবারই পরিণতি স্পষ্ট করে দিতে হবে। তবু কেন যে লেখক উপন্যাসশেষে কৈফিয়ত দিলেন, তা বোধগম্য নয়। এদের পরিণতির বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সীমাবদ্ধ ক্ষমতাই লেখককে অধিক বিসত্মারে যেতে সাহসী করেনি। উপরন্তু ওইসব চরিত্রের পরিণতি ইতিহাসে মোটামুটি স্পষ্টভাবেই লিপিবদ্ধ।’ বিনয় মহার্ঘ্য; কিন্তু সর্বত্র নয়। একজন শিল্পীর ক্ষমতার পরিমাপক তিনি নিজে নন, সংবেদী পাঠক। আর চরিত্রগুলোর পরিণতি ইতিহাসে আছে কি নেই, তা পাঠকের জানা অপরিহার্য নয়। আর শ্যামাঙ্গ সম্পর্কে তিনি যে অসাধারণ তাৎপর্যময় নিবন্ধ লিখেছেন -শিল্প-ইতিহাস-ঐতিহ্যের ন্যায়সূত্র উন্মোচন করেছেন – তারও কোনো প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না।

প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শক্তি ও দৌর্বল্যের বিষয় হলো এর ভাষা। কবিভাষা বা ডিকশন বলে একটি ভাষা আছে, কবিতায় যার অধিষ্ঠান। প্রথাগত শব্দ কতটা তাৎপর্যময়, কতটা অফুরন্ত ব্যাখ্যার আধার হয়ে উঠতে পারে, তার পরিচয় আছে সফল কবিতায়। শওকত আলী কথাসাহিত্যিক। কিন্তু কবি না হয়ে কি কেউ কথাসাহিত্যিক হতে পারেন – কোনো শিল্পী হতে পারেন? পারেন না। এই চিরায়ত সত্যের পরিচয় আছে প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের প্রতিটি পদে, পদবন্ধনে। সাধু ভাষার শব্দভা-ারকে বিস্ময়কর নৈপুণ্যে তিনি ব্যবহার করেছেন চলিত ভাষার গড়ন-সৌষ্ঠবে। সম্ভবত ষোড়শ শতকের ভাষিক জগতের ধ্রম্নপদী আবহের স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এই অসাধারণ ভাষাপ্রপঞ্চ বেছে নিয়েছেন। কমলকুমার মজুমদারের ভাষাব্যবহারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, বাক্যগড়নের রীতির সঙ্গে পরিচয় আছে। সেখানে কাঠিন্য নির্ধারণই যেন কর্তব্য। কিন্তু সে অন্য অভিধা। শওকত আলী ভাষার মধ্যে পুরে দিতে চেয়েছেন জীবনের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধের আলো, আনন্দ আর অফুরন্ত প্রবাহ। বাক্যের গড়নসৌষ্ঠবের মধ্যেও তাঁর এই অফুরন্ত শক্তির পরিচয় মেলে। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শ্যামাঙ্গ সম্মুখে যে-প্রহেলিকা দেখতে পায়, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে শওকত আলী লিখেছেন,

সে বড় বিচিত্র অবস্থা। এখন স্মরণ হলে কৌতুক বোধহয়। অবশ্য তখনো তার কৌতুক বোধ হচ্ছিল। কৌতুক বোধ হওয়ারই কথা। কারণ প্রথমে তুমি দেখলে বংশবীথিকার বিনত শাখায় একটি বনকপোত। পরক্ষণে সেই ক্ষুদ্রাকার পাখিটি হয়ে গেল একটি ঊর্ধ্বলম্ফী মর্কট – মুহূর্তেক পরে সেই মর্কটও আর থাকল না, নিমেষে হয়ে গেল একটি বিশুদ্ধ বৃক্ষশাখা। চক্ষু কচালিত করলে অতঃপর তুমি আর কিছুই দেখলে না। বংশবীথিকা না, বনকপোত না, মর্কট না, বিশুদ্ধ শাখাও না।

এই রচনার মধ্যে প্রায় প্রতিটি শব্দই তৎসম; কিন্তু কোথাও দুর্বোধ্যতার লেশমাত্র নেই। অধিকন্তু এমন একটি সহজতা বিরাজমান, যা পাঠকের বোধের জগৎকে তৃপ্ত করে।

এই সহজ সৌন্দর্যকে গতি দান করেছে এর ছন্দ। অমত্মঃসলিলা ফল্গুধারার মতো তাঁর গদ্যের ভেতর-গড়নের মধ্যে প্রবাহিত ছন্দ পাঠককে টানে, পাঠ শুরুর পর আর থামতে দেয় না, একটি আনন্দিত বিহারের মতো পাঠককে মুগ্ধ করে নিয়ে চলে। একটি উদাহরণ দিই :

শুকদেবের গৃহ নীরব। বেলা দ্বিপ্রহর, কিন্তু জনমানব কোথাও আছে বলে মনে হলো না। সে [শ্যামাঙ্গ] ক্ষণেক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে। তাতে বিচিত্র একটি ভাব তার উপলব্ধি হয়। মনে হয়, নীরব পলস্নীটিতে বিষাদ এবং হতাশা পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। তার কাছে পরিবেশটি অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্য লাগে। সে একটি রাখাল বালককে ডাকল। বালকটি সংবাদ দিতেই শুকদেব বাইরে এলেন। ক্ষণেক পর দীনদাসকেও দেখা গেল। যোগীটিকে দেখে দীনদাস বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হলো। বললেন, যোগী মহাশয় কি এই গ্রামেই অবস্থান করবেন।

প্রথাগতভাবে তৎসম শব্দের বাক্য দীর্ঘ  এবং জটিলতার সৃষ্টি হয়। বক্তব্যকে মুখ্য ভাবার ফলেই এ-ঘটনা ঘটে। কিন্তু ওপরে যে-খ-চিত্রটি উলেস্নখ করা হয়েছে, তার ভাষা সম্পূর্ণই ভিন্ন। এখানে বাক্য ছোট ছোট এবং সে-বাক্যের প্রতিটি শব্দই সুনির্বাচিত। বাক্যের গড়ন, অন্তর্বয়ন ও বক্তব্যের ধারাক্রম সহজ-সাবলীল ও অনিবার্য। ফলে কাব্যভাষার মাধুর্য ও আনন্দ সহজেই উপভোগ করা যায়।

শওকত আলী ভাষার ব্যবহারে বিষয়ভিন্নতার তাৎপর্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। ফলে প্রণয়ের ভাষা আর অত্যাচারী রাজকর্মচারীদের ভাষণ ভিন্ন না হয়ে পারেনি। প্রণয়ের ভাষাকে তিনি বিচিত্র রাগ-অনুরাগের ব্যবহারে প্রণয়কাতর ও কামনাস্নিগ্ধ করে তুলেছেন। সেই ভাষার একদিকে আছে অসাধারণ সংযম ও পরিমিতিবোধ এবং অন্যদিকে আছে রোমান্টিকতা, কামনায় আরক্ত মানব-মানবীর দেহ-মনের উষ্ণতার উত্তাপ। মানব-মানবীর আত্মমর্যাদার বিষয়ে শওকত আলীর সংবেদনা শ্রদ্ধার্হ্য। ভালোবাসার পাত্রপাত্রী নিজেদের নিঃশর্ত সমর্পণের সময়েও সহজাত মর্যাদাবোধে সমুজ্জ্বল। শওকত আলী তাঁর অসাধারণ ভাষাশক্তির সৌন্দর্যে সেই মর্যাদাকর সম্পর্কের জগৎ নির্মাণ করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের পা–ত্যের মতোই তাঁর শব্দভা-ারের জগৎ। এই বিপুল ঐশ্বর্যকে তিনি বিস্ময়কর মমত্ববোধ আর প্রগাঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। প্রাচীন বাংলার বিচিত্র জনপদ, নদ-নদী, গ্রাম, শহর তাঁর এই অসাধারণ সৃজনশীলতায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে। এক্ষক্ষত্রে ভাষার শক্তি, সামর্থ্য ও উৎপাদনশীলতাকে তিনি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন।

শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে ভাষা ব্যবহারের এই বৈচিত্র্যময় সাফল্যের একটি উলটো পিঠ আছে, যেখানে চরিত্রগুলোর নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। সব চরিত্রই কথা বলে লেখকের ভাষায়। ফলে একটি চরিত্রের হয়ে-ওঠা কথাসাহিত্যের এই মূলগত প্রত্যয় রক্ষিত হয়নি।

এখন বলা হয়, পৃথিবীতে যতজন মানুষ কথা বলে, ভাষার সংখ্যাও ঠিক তত। এই সংজ্ঞার অর্থ কী? এর ভেতর দিয়ে মানবীয় ভাষার কোন তাৎপর্যের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে? আসলে এ হচ্ছে স্বাতন্ত্র্যের চিহ্নবিশেষ। প্রতিটি মানুষই আলাদা – যেমন দেহ ও মনোগড়নে, তেমনি ভাষার ব্যবহারে। ব্যক্তির জীবনবোধ, বিশ্বাস, চিমত্মাচেতনায় – এককথায় ব্যক্তিমানুষটির স্বাতন্ত্র্যের প্রায় সমগ্র স্বরূপ চিহ্নিত হয় তাঁর ভাষা-ব্যবহারের মধ্যে। কথাসাহিত্যে এই স্বতন্ত্র স্বরের মূল্য অপরিসীম। একটি উপন্যাসে যে-লোকসমাবেশ ঘটে, সেখানে যদি বহুস্বরতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে মানবীয় স্বভাবের সাধারণ শর্তই অপূরণীয় থাকে। প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে এই বহুস্বরতা না থাকায় কোনো চরিত্রই যথাযথ স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেনি। তারপরও এই ভাষা লেখকের অসাধারণ এক আবিষ্কার – এ-কথা অনস্বীকার্য।