প্রসঙ্গ আধুনিকতা, আধুনিক কাব্য

উজ্জ্বল সিংহ

আধুনিকতার প্রসঙ্গ সবসময়ই আধুনিক, তা কখনই পুরনো হওয়ার নয়। যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে, শিল্পকলা-কাব্য-সাহিত্য ইত্যাদির অস্তিত্ব থাকবে, ততোদিন আধুনিকতাও থাকবে। সমকালে সকলই আধুনিক, বর্তমানে যা আধুনিকতা হিসেবে গণ্য, পঁচিশ-পঞ্চাশ-একশ বছর পর তা-ই হয়ে ওঠে অনাধুনিকতা। অতএব, সময়ের বিচারে আধুনিকতার বিচার করা উচিত নয়। সময়ের মতোই আধুনিকতা একটি কল্পিত বা পরাবাস্তব ধারণা, দুটোই সতত প্রবহমান। আর, প্রবহমান কোনো কিছুরই কাল বলে কিছু হতে পারে না। কালও তো প্রবহমান, সেজন্য কালপ্রবাহ বা কালস্রোত শব্দগুলো আমরা নিয়ত ব্যবহার করে থাকি। ফলে, প্রকৃত অর্থে, আধুনিকতা যে কী বস্ত্ত, কবে থেকে, কোন সময় থেকে আধুনিকতার শুরু, তা তত্ত্বগতভাবে উল্লেখ করা অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধের গোড়াতেই আসল কথাটি বলে দিয়েছেন, ‘পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে। এটা কালের কথা ততোটা নয় যতটা ভাবের কথা।’ তারপর তিনি মোটামুটি একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন বটে, ‘নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয়, তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ন। বাংলায় বলা যাক আধুনিক।’ কিন্তু পরের পঙ্ক্তিতেই তাঁর স্পষ্ট সিদ্ধান্ত – ‘এই আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’
সমকালে আধুনিকতার বিশেষ বিশেষ লক্ষণ থাকে, অর্থাৎ একেক কালে আধুনিকতার একেকরকম লক্ষণ। তবে, আধুনিকতার প্রথম ও অনিবার্য শর্তটি হলো স্ব-চেতনতা (self-consciousness)। তাকে যদি যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, নানা প্রসঙ্গের বিচারে তা করা যায়। যেমন, যদি ইতিহাসের ক্ষেত্রটি ধরি, সেক্ষেত্রে কালবিভাজনের তুলনামূলক বিচার করলে স্পষ্ট হবে, যে ইতিহাসের কাল, সময়ের মেয়াদের দৃষ্টিকোণে, ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। যুগপ্রবৃত্তিগুলোর দ্রুত পরিবর্তনগুলোকে দ্রুত অনুধাবন করা সম্ভব শুধু গভীর স্ব-চেতনতা দিয়েই। সময়কে যদি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে বিভক্ত করি, সেক্ষেত্রে আধুনিকতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় বর্তমানকেই।
রেমন্ড উইলিয়ামস তাঁর কালচার অ্যান্ড সোসাইটি গ্রন্থের রোমান্টিসিজম সম্পর্কিত অধ্যায়টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের দ্বিস্তরীয় মানসিকতার সমাধান সাহিত্যের দিক দিয়ে একটা জটিল প্রশ্ন উপস্থাপিত করে। একদিকে, ইংল্যান্ডের প্রায় সব রোমান্টিক কবি সমসাময়িক রাজনীতি ও সামাজিক নানা বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করতেন, অপরপক্ষে তাঁদের কবিতায় পাওয়া যায় কোমলতা, প্রাঞ্জলতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য। উইলিয়ামস এই যে বিরোধাভাসটির কথা উল্লেখ করেছেন, তার প্রধান কারণ হচ্ছে, রোমান্টিক ব্যক্তিমানুষের আপন কাল বা বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিপাত। বর্তমানের অব্যবস্থা ও অস্থিরতার প্রতি সে ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট, কিন্তু অতীতের মেদুরতা ও মুগ্ধতাবোধে সে আচ্ছন্ন থাকার দরুন বর্তমানের সঙ্গে সৃজনের স্তরটিতে সে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে অবতীর্ণ হতে পারছে না, বাস্তব জীবনে হয়তো সে সেই সংগ্রামের মুখোমুখি হচ্ছে। বিদ্রোহী তাকে বলতেই হবে, কিন্তু সে অতীত-ভারাক্রান্ত, এবং সেটা যে বাধ্য হয়ে হতে হচ্ছে তা নয়, এটি তার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা-আরোপিত।
রোমান্টিক এবং আধুনিক দৃষ্টিকোণের আরো একটি তফাৎ রয়েছে – সেটা ও-দুটির সামাজিক পরিবেশের কারণে ঘটেছে। রোমান্টিসিজমের বিকাশ ঘটেছিল উদারনীতিবাদের যুগে, তখনকার আধুনিকতার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্তর্গত হয়েই জন্ম হয়েছিল। উদারনীতিবাদের মতোই রোমান্টিকতাবাদেও ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর খুব জোর দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রে কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করার পরেও সামাজিক দায়িত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বাতন্ত্র্য ও দায়িত্ব এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য বা মূল্য (value)। ফলে রোমান্টিক বিদ্রোহী মূল্যহীনতার পরিস্থিতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়, কিন্তু আধুনিকতার স্বীকৃতি সৃজনমূলক মূল্যসমূহের বিস্তৃতি ও গতিতে বিশ্বাস করে। বর্তমানকালে এই যে রাষ্ট্রীয় সংবিধান তৈরি হয়, তা তৈরি হয় সৃজনমূলক মূল্যের ভিত্তিতেই।
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই বুদ্ধিগত বা বৌদ্ধিক, কিন্তু রোমান্টিসিজম আসলে বৌদ্ধিকতাবিরোধী। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এমনিতে সহজ-সরল জ্ঞানকেও বৌদ্ধিকস্তরে স্বীকৃতি দেয় আর রোমান্টিকতা ব্যক্তিগত জ্ঞানকেও ভাবাবেগের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। অতীতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা সুবিদিত, ফলে রোমান্টিকতা বুদ্ধি ও মেধাগত দৃষ্টিকোণের প্রয়োজন বোধ করে না। অপরপক্ষে অনাগত ভবিষ্যৎকে রূপায়িত করার বিষয়টি সফল হতে পারে একমাত্র সূক্ষ্মতম মেধা ও বুদ্ধিগ্রাহ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। যেমন, চিত্র-বিচিত্রিত পরীদের কাহিনির পরিবর্তে ছোটরা এখন কল্পবিজ্ঞান কমিক্স ইত্যাদি বেশি পছন্দ করে। আধুনিক যুগের সন্দিগ্ধ ও মেধাবী কিশোর-শিশুরা খাঁটি রোমান্টিককালীন গ্রিম-অ্যান্ডারসনদের রূপকথায় আসক্ত হতে পারে না। বর্তমান যুগ পরীদের রূপকথাকে আর গুরুত্ব দেয় না, কারণ পরীলোকের অবস্থা বা প্রকৃতি নৈতিকও নয়, অনৈতিকও নয়, বরং তা অনেকাংশে পূর্ব-স্থিতিকৃত নীতি দ্বারা চালিত। এ ধরনের মূল্যহীনতাকে কাব্য হিসেবে স্বীকার করাটা রোমান্টিক ও অ-বুদ্ধিগ্রাহ্য দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু মূল্যের সৃজন ও অন্বেষণ প্রধানত মেধাগ্রাহ্য বিষয়।
যে-কোনোরকম সৃজনমূলক নির্মাণ সম্ভব একমাত্র আধুনিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। আধুনিকতা বিনা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিও অসম্ভব। এবং রোমান্টিক ভাবধারাকে যথোপযুক্ত উপায়ে পরিহার না করলে সেই আধুনিকতার বিকাশ ঘটবে না। সমসময়ের প্রতি তীব্রতম সচেতনতাই হলো আধুনিকতার কেন্দ্রীয় উপাদান, মূল তত্ত্ব। তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতা ইতিহাসের প্রক্রিয়ার সাম্প্রতিকতম পর্যায়। সৃষ্টির বিকাশের মূলগত অবস্থাটি বিচার করে দেখলে তা সঞ্চরণ-ক্রমটি হবে। এরকম – পরিবর্তন > বিকাশ > আধুনিকতা। প্রারম্ভিক অবস্থায় পদার্থ এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হতে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে সেই নিরপেক্ষ পরিবর্তন গুণগত বা তাত্ত্বিক বিকাশের রূপে পরিণত হয়। অবশেষে আধুনিকতার অবস্থায় সেই পরিবর্তন আরো সচেতন হয়ে ওঠে। সেদিক দিয়ে, বর্তমান যুগের সেই স্ব-চেতনতাকে মানব-ব্যক্তিত্বের চরম পরিণতি বলা যেতে পারে।
তাহলে রোমান্টিসিজম ভাবধারা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি কেন, আধুনিকতার চরমতম পর্যায়ে রোমান্টিক চেতনার তো থাকারই কথা নয়। রোমান্টিকতার পুনরাবির্ভাব তো নানারূপে নানাভাবে যুগে-যুগে লক্ষ করি আমরা। এর কারণ হলো, বহু অভিপ্রায়, বহু প্রতীতি সত্ত্বেও আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হই যে, মানব প্রগতি ঠিকপথে বিকশিত হয়নি। প্রচুর জাগতিক বিকাশ সত্ত্বেও মানবিক মূল্যবোধের ক্রম-অবনমন আমাদের নিয়ে যায় অতীতের দিকে, যে-অতীত মনে হয় গৌরবময় ছিল, বর্তমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। এ-দৃষ্টিভঙ্গিতে অতীতের ঠিকঠাক ব্যবহার প্রশ্নটি একটা বড়রকমের সমস্যা। বিশেষ করে ভারতের মতো কয়েক হাজার বছরের অতীতসম্পন্ন দেশের পক্ষে এ-সমস্যা আরো জটিল। এটি নিশ্চিত যে, যতদিন না অতীতকে কাজে-লাগানোর সমস্যার সমাধান ঘটছে ততদিন রাষ্ট্রের সৃজনমূলক প্রতিভার বিকাশও ঠিকঠাক ঘটবে না। অতীতকে ব্যবহার করার তাৎপর্য বা অভিপ্রায়টি হচ্ছে – অতীতের বোঝা বা ভারকে কীভাবে ও কতদূর পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে চলার ক্ষেত্রে সহায়ক বস্ত্ততে পরিণত করা যেতে পারে, সেটাই।
যখন একজন লেখক-সাহিত্যিক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন হিসেবে সৃজনকর্মে লিপ্ত হন, তাঁকে বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং সেসবের সমাধানও তাঁকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। রচনার উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ার মাঝখানে থাকে একধরনের টানাপড়েন। আধুনিক সৃজনমূলক শিল্পসাহিত্য আপন উদ্দেশ্য বা গন্তব্যকে আগে থেকে ঠিক করে নিতে চায় না। উদ্দেশ্য যদি আগেই জানা হয়ে যায়, সে-প্রক্রিয়ার আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। তাই আধুনিক শিল্পী-সাহিত্যিককে এ-সমস্যাটির মুখোমুখি হতে হবে খুব গভীরভাবে। উদ্দেশ্য বা গন্তব্য সম্পর্কে পূর্বনির্ধারিত ধারণাকে অস্বীকার করে তাকে প্রক্রিয়াটির প্রতি সচেতন থাকতে হবে। শিল্পিত সৃজনের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্ব-চেতনতার এটা একটি সন্ধিস্থল, তা সম্ভাব্য হলেও, তার জন্য লেখক-শিল্পীদের অনুসন্ধান এখনো চলছে।

চালু সভ্যতার ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে আধুনিকতার পর্ব অতএব একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে শুরু হয়েছে ধরে নিলে আলোচনার সুবিধা হয়। ঠিক যেভাবে সময় বা কালের ধারণাটি কল্পিত হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এবং ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডে আবদ্ধ করে নিয়েছি।
রেমন উইলিয়ামসের কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর মতে, ‘modern’ শব্দটি ইংরেজিতে প্রচলিত হয় ষোলো শতকের গোড়াতেই। কিন্তু আধুনিকতাবাদ (modernism) আঠারো শতকের জ্ঞানদীপ্তির (The enlightenment) যুগেই উদ্ভূত হয়। সমগ্র ইউরোপ তখন যুক্তিবাদ (rationality) অভিমুখী। চালু রাজনৈতিক-সামাজিক-ধর্মীয় ভাবনা-চিন্তাগুলো ক্রমশ পরিত্যক্ত হচ্ছে। আধুনিক ভাবধারাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নব্য একটা প্রগতির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দেখা গেল, উল্লিখিত প্রগতির ধারণাটি ভুল। তা আসলে পুঁজিবাদ-জাত একধনের সংকীর্ণ প্রগতি, তা colonialism-এর কাছে আত্মসমর্পণ করছে। এভাবে আধুনিকতাবাদ অন্যতর ভাবধারায় চর্চিত হতে শুরু করল।
তবে যুক্তিবাদকেই যে আধুনিকতাবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলা যায়, সেটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন ম্যাক্স ভেবের (Max Weber) : কারণ, উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকেই আধুনিকতাবাদ হিসেবে মনে করা হতো। আর, আধুনিকতার সাধারণ লক্ষণ হলো নতুন-নতুন ভাবনা-চিন্তা, দর্শন, শৈলী, মনোভঙ্গি, দৃষ্টিকোণ ইত্যাদি বিষয়ে তীব্র আগ্রহ, কৌতূহল এবং তার যথাযথ উপস্থাপনা। অর্থাৎ আধুনিক অর্থে আমরা যে স্বাভাবিক ধারণা পোষণ করি, তা মোটেই ঠিক নয়। এতে নিহিত রয়েছে বহু পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি। যুক্তিবাদই যে প্রধান বিচার্য, তা তো উল্লিখিত হয়েছেই। একটি ভালো উদাহরণ, রবীন্দ্রোত্তর কালের কাব্যকে বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে আধুনিক হিসেবে গণ্য করা হয়, ঠিক আছে; কিন্তু, সে-বিচারে কি রবীন্দ্রনাথ অনাধুনিক? তা তো কখনই নয়। তিনি বরং বাংলা কাব্য-সাহিত্য-সংগীতের ক্ষেত্রে প্রবলভাবে আধুনিক। তাহলে, আধুনিক ‘বাংলা কাব্য’ বলতে কেন আমরা শুধু শুধু রবীন্দ্রোত্তর কালের কাব্যকেই বুঝব? তা কি রবীন্দ্রনাথ-কথিত সেই যে ‘বাঁকে’র উল্লেখ, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই? সে-বিচারে রবীন্দ্রকাব্য কেন ‘আধুনিক’ হবে না? যুক্তিবাদের প্রাসঙ্গিকতার এখানেই যথার্থতা।
কাব্যের ক্ষেত্রে আধুনিকতার সূচনাপর্বে চিহ্নিত করার সমস্যা আছে। আমরা যেভাবে নিজেদের আলোচনার সুবিধার জন্য আদি, মধ্য, আধুনিক যুগ চিহ্নিত করেছি, কিন্তু সমকালে চর্যাপদও আধুনিক, সূক্ষ্মবিচারে রামপ্রসাদ সেনও আধুনিক, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও আধুনিক, আর মধুসূদন দত্ত প্রকৃত অর্থে সর্বার্থেই আধুনিক। কিন্তু একটা শুধু সমাধানে আসতে গেলে অনেক রকম বোঝাপড়া করে নিতে হয়; জীবেন্দ্র সিংহরায় এ-ব্যাপারে যা বলেছেন, তা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, ‘তরুণ কবিসমাজের লিখিত যে কবিতাবলী পূর্ণমনস্ক এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকরণে যে কবিতাবলী নব্যতন্ত্রী তা-ই আধুনিক বাংলা কবিতা।’
আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখেছেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত; অন্তত মুক্তির প্রয়াসী, কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ অন্যত্র তাঁর বক্তব্য, ‘আধুনিকতার ধারণা স্বভাবতই গতিশীল, ধাবমান। সেকালের যৌবনমদমত্ত আধুনিকতা এ কালে লোলচর্ম, পলিত কেশ; এ-কালের ঝকঝকে আধুনিকতা পঁচিশ, পঞ্চাশ কি একশ বছর পরে বেজায় সেকেলে হয়ে যাবে।’
আবারো প্রশ্ন হচ্ছে, রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত রবীন্দ্রোত্তর কাব্যকেই যদি আধুনিক বলতে হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথ কি অনাধুনিক? তাঁর রচনাবলি তো আধুনিকের চূড়ান্ত! বিশেষ করে, বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কাব্যে যে-বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন – বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি, আশা আর নৈরাশ্য – এসব তো রবীন্দ্রকাব্যে অতি চমৎকার ও শিল্পিতভাবে গ্রথিত। প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতার ধারণাটি একমাত্রিক নয়। তা বহুমাত্রিক এবং অনেকটাই উপলব্ধির বিষয়। জীবনানন্দ দাশ বরং ব্যাখ্যায় অনেকটাই উদার, ‘মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে।’
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল থেকে মাসিক সাহিত্য পত্রিকা কল্লোল প্রকাশিত হতে থাকে। অনেক সমালোচকের মতে, এ-পত্রিকাটির মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা ঘটেছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বাংলা যথাযথভাবে, অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে, আধুনিকতার সূত্রপাত নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। রামপ্রসাদ সেন তো প্রায় দুশো বছর আগেকার কবি। শ্যামাবিষয়ক গীত রচনা করেও তিনি মধ্যযুগীয় সাধক-কবিদের মতো সাধনালোকের অধিবাসী ছিলেন না। তাঁকে তো অনাধুনিক বলতে দ্বিধা হয়। সমালোচকের মতে, ‘ঐতিহাসিক নৈকট্যই নয়, মানসিক সার্ধম্য ও আত্মীয়তার জোরেই রামপ্রসাদ আধুনিককালের কবি।’ আবার এটিও অনস্বীকার্য যে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের (১৮১২-৫৯) ভূমিকা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনায় অত্যন্ত মূলবান। আর, তর্কাতীকভাবে তত্ত্বগত দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলা কাব্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
পাশ্চাত্যে চিন্তাধারায়, সাধারণভাবে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে – বিষয়ে, প্রকরণে, ধারণায়, শৈলীর দিক দিয়ে একটা স্বতন্ত্র্য ও রূপারোপকে ‘আধুনিকতা হিসেবে গণ্য করা হয়; এবং বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কালকেই তার সূচনাপর্ব হিসেবে বিচার করা হয়। সেদিক দিয়ে যারা, যেসব প্রতিষ্ঠিত সত্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, নৈতিকতা এবং মানবীয় অহংকে উপলব্ধি করা পারস্পরিক বা চিরাচরিত পন্থা ও রীতির অনুসারী, সেসব সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন, তাঁরাই আধুনিকতার অগ্রদূত – ফ্রিডরিক নিটসে, কার্ল মার্কস, সিগমন্ট ফ্রয়েড, জেমস জি ফ্রেজা প্রমুখ। বহু ঐতিহাসিক আবার আধুনিকতার বিদ্রোহের বিষয়টি আরো বহু পূর্বে ১৮৯০-এর দশকে সূচিত হয়েছিল বলে মনে করেন; কিন্তু অধিকাংশই মত প্রকাশ করেন যে, অভূতপূর্ব চর্চাক্ষেত্র ও নানাবিধ পরিবর্তনের দ্রুততার দিক দিয়ে আধুনিকতার আবির্ভাব পূর্বোল্লিখিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯২২ সালটি তো এ-বিচারে চিহ্নিত হয়ে থাকবে নানা সৃজনশীল নব্য উপস্থাপনায় – জয়েসের ইউলিসিস, এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড, ভার্জিনিয়া উলফের জ্যাকবস রুম – এ জাতীয় বহু চিরস্মরণীয় সাহিত্যকৃতির কারণে।
তাই আধুনিকতাকে সাহিত্যের একটা আন্দোলন হিসেবে ধরলে সময়কালটি মোটামুটিভাবে ধরা যেতে পারে, ফ্রান্সে ১৮৭৫ নাগাদ এবং গ্রেটব্রিটেনে ১৮৯০ থেকে আর জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে। আর, আধুনিকতাকে একক কোনো বস্ত্ত হিসেবে বিচার করা যায় না, বহু গোষ্ঠী ও ঘরানা, শিল্পকলা-সংগীতের নানা নব্য তত্ত্ব, বিশেষ করে ইউরোপে এসবকিছু সম্মিলিত ফলাফলকে গণ্য করে তবেই বিচার করতে হবে – প্রতীকবাদ (Symbolism), উত্তর-প্রতীচ্ছায়াবাদ (Post-Impressionism), অবক্ষয় (Decadence), বন্যতাবাদ (Fauvism), কিউবিজম, অভিব্যক্তিবাদ, (Expressionism), চিত্রকল্পবাদ (Imagism), ভর্টিসিজম (Vorticism – ভবিষ্যবাদ থেকে উদ্ভূত এই আন্দোলনটি কিউবিজম ও অভিব্যক্তিবাদের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল। আধুনিক জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য হিসেবে যান্ত্রিকতার জটিলতার ওপর জোর দেওয়া হয় এই তত্ত্বে), ভবিষ্যবাদ, দাদাবাদ, অধি বা পরাবাস্তববাদ ইত্যাদি নানাবিধ তাত্ত্বিক সাহিত্য-শিল্প-কাব্য আন্দোলনগুলোকে আত্মস্থ না করলে বিচারটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
সবচেয়ে বড় কথা ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বা ছোট পত্রিকার উদ্ভব ও বিকাশও এই আধুনিকতারই অবদান। সে এক অন্য প্রসঙ্গ।