প্রস্থানের বিষাদ ও ফেরার আনন্দ

Prosthaner Bishad

জাহিদ মুস্তাফা

শিল্পীজীবনের প্রায় চল্লিশ বছর কেটেছে পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামে। করেছেন শিল্পের অধ্যাপনা, ক্রমাগত শিল্পচর্চায় দেশ-বিদেশের সৃজনজগতে নিজের অবস্থানটাও পোক্ত করেছেন, ঋদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের আঙিনা। এ মাটির সন্তান আর মৃত্তিকালগ্ন প্রকৃতির অফুরান সম্পদকে নিজের উৎসজ্ঞান করেছেন, অবলীলায় তুলে এনেছেন চিত্রপটে। ‘ফেরা’ নামে একটি সিরিজ এঁকে তিনি বাঙালির উৎসে প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি শ্যামলা একহারা লম্বা গড়নের পক্বকেশী একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী মনসুর উল করিম। চল্লিশ বছর আগে দেখা আমাদের চারুশিল্পের প্রাণপুরুষ শিল্পাচার্য জয়নুলের সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল প্রত্যক্ষ করে স্মৃতিতাড়িত হলাম। সম্প্রতি গ্যালারি কায়ায় হয়েছে তাঁর একক চিত্র-প্রদর্শনী।
ঢাকার উত্তরায় চারুশিল্পীদের একটি মাত্র মিলনক্ষেত্র, শিল্পিত সৃজন দর্শনের একমাত্র জানালা – গ্যালারি কায়া। বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের প্রথম প্রজন্মের শিল্পী প্রয়াত দেবদাস চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁর পুত্র শিল্পী গৌতম চক্রবর্তীর হাত ধরে এক দশক আগে কায়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল। যে-কোনো প্রদর্শনীকে ঘিরে জমজমাট হয়ে ওঠে এর প্রাঙ্গণ। ১০ এপ্রিল, শুক্রবার ছুটির দিনে সৃজন-জগতের চেনা মানুষগুলোর সরব উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠেছিল গ্যালারি কায়া। উপলক্ষ শিল্পী মনসুর উল করিমের ২২তম একক চিত্র-প্রদর্শনীর উদ্বোধন।
প্রদর্শনীর শিরোনাম ¬- ‘গন্তব্য ও প্রস্থান’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে শিক্ষকতার গাঁটছড়া সহসাই ছিন্ন হওয়ার বেদনার সঙ্গে শেকড়ে ফেরার আকুতি ফুটে উঠেছে এ-শিরোনামে। গ্যালারির দেয়ালে সাজানো চিত্রকর্মেও যেন এই ভিন্ন দুটি অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। একদিকে প্রস্থানের নীল ও ধূসর মনোবেদনার রং, অন্যদিকে গন্তব্যের বর্ণিল সম্ভাবনা।
কর্মস্থল চট্টগ্রাম থেকে প্রস্থান করে গন্তব্য তাঁর জন্মস্থান রাজবাড়ী। ১৯৫০ সালে ওখানেই জন্ম হয়েছিল বাবা-মায়ের আদরের সন্তান ঠান্ডুর – যাঁর পোশাকি নাম মনসুর উল করিম। যেখান থেকে জীবনের পাঠশালায় যাত্রা শুরু করেছিলেন দূর-শৈশবে, পরিণত বয়সে সেখানেই ফেরা। স্বপ্নবান এই শিল্পী নিজে ছবি অাঁকবেন, আবার সেখানে অন্যরাও যাতে ছবি অাঁকতে পারেন তার ব্যবস্থাও করেছেন। এই শিল্পপরিসরের নাম দিয়েছেন বুনন আর্ট স্পেস। একসঙ্গে বিশজন শিল্পী এখানে থেকে কাজ করতে পারবেন বলে জানালেন তিনি।
এ-প্রদর্শনীর জন্য দুটি সিরিজে ছবি এঁকেছেন শিল্পী। গ্যালারিতে চুয়াল্লিশটি চিত্রকর্মের মধ্যে পনেরোটির শিরোনাম – ‘বিদায়ী ভূমি’। অন্য ঊনত্রিশটি চিত্রের শিরোনাম – ‘গন্তব্য আমার মাটি’। এর সবই প্রায় সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ দু-তিন বছরের মধ্যে অাঁকা। মাধ্যম মূলত ক্যানভাসে তেলরং। আজকাল অবশ্য ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে কাজ বেশি হয়। তিনি তেলরঙেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
দর্শক হিসেবে গ্যালারি পরিসরে ছবি দেখতে দেখতে ক্রমশ শিল্পীজীবনের ভ্রমণের সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় ঘটে, আমরা দেখতে পাই তাঁর দুটি সত্তার টানাপড়েন। একদিকে পেশাদার শিল্পীজীবনের চার দশক ধরে নিজের জায়গা করে নেওয়ার সংগ্রাম, অন্যদিকে নিজের শেকড়ে ফেরার তাগিদ। এই দুটি দিকের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর অাঁকা এই সিরিজ দুটোয়।
মনসুর উল করিম চিত্রপটকে নিজের মতো করে তৈরি করে নেন নানা বর্ণের মিশ্রণে। এরপর কখনো রঙের ভেতর কাটাকাটি করেন আবার চিত্রপটের নানা পরিসরে তিনি ফুটিয়ে তোলেন মানুষের মুখের আভাস, পেশিবহুল বাহু ও কর্মিষ্ঠ হাতের মোচড়। যেন গাছের কাছের মাটি থেকে উঠে আসা কর্মিষ্ঠ হাত মনে করিয়ে দেয় আমাদের জন্ম ও বিলোপ এই মাটিতেই। এই উৎস খুঁজতে খুঁজতে শিল্পী মনসুর বাংলাদেশে প্রবর্তিত সবকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চারুকলা প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। এমনকি ভারতের স্বনামধন্য দিল্লি ত্রিবার্ষিক প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জয় করায় বাংলাদেশের সুনাম বেড়েছে।
চলমান প্রদর্শনীর দুটি সিরিজের দুটি চিত্র ও এগুলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলা যাক। ‘বিদায়ী ভূমি-২’ শিরোনামের চিত্রে যে-রঙের আবহ, তাতে নিশ্চিন্ত সুখী জীবনের আভাস মেলে। আবার এর জমির পরিসরের ভেতরেই পেয়ে যাই স্মৃতি-তাড়না, বিদায়ী ভূমির বোবাকান্না। দ্বিমাত্রিক পরিসরকে কুশলী-শিল্পী এমনভাবে ব্যবহার করেছেন, যাতে ত্রিমাত্রিক আভাস এসে গেছে। চিত্রপরিসরে অসংখ্য অাঁচড় আর দাগের প্রয়োগ যেন দীর্ঘ এক সময়ের কথা বলে ওঠে। এই শিরোনামের অন্যান্য চিত্রে সমুদ্রজলের নীল আর পাহাড়ের ত্রিকোণ আভাস পেয়ে যাই।
‘বিদায়ী ভূমি-১২’ সংখ্যক চিত্রের পট তিনটি সমান ভাগে বিভক্ত। স্মৃতির ধূসরতা ও বিষাদের নীলাভ আলোর ভেতর বিষণ্ণ তিনটি অবয়ব। মাঝের অবয়ব ঋজু ও দীর্ঘ আর তাঁর দৃষ্টি সুদূরে, দুটি হাত তাঁর নিজের বুকের ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। এটি তাঁর দৃঢ় সংকল্পের ইঙ্গিত বহন করে। তাঁর অবয়বের সামনে জানালার গ্রিলের মতো বাধা যেন নানা প্রিয়জনের পিছুটানকে তুলে ধরেছে। এর দুপাশে দুটি অবয়বে অনিচ্ছুক মনোভাব ফুটে উঠেছে বলে কি প্রতীয়মান হয় না?
‘গন্তব্য আমার মাটি’ সিরিজের ৯-সংখ্যক কাজে আমরা দেখতে পাই সুখী উজ্জ্বল রঙের আবহের ভেতরে নতুনের আবাহন। এখানেও রেখা আছে, আছে অঙ্কন, আছে বৃষ্টি, আছে জলের বুদ্বুদ। তবে এখানে মানব-অবয়বের ইঙ্গিত থাকলেও তেমন মূর্ত হয়নি। এখানে মানুষের জীবনসংগ্রামের চেয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও তার বর্ণনা প্রধান হয়ে উঠেছে। তবে কি স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে মনসুরের চিত্রপটেও পরিবর্তন আসছে! একজন সৃজনশিল্পীর কাজে এই পরিবর্তন বিচিত্র নয়। পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই সৃজন-ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ এগিয়ে যান তাঁর গন্তব্যে।
প্রদর্শনীটি চলে গত ২৪ এপ্রিল, ২০১৫ শুক্রবার পর্যন্ত।