প্রাগৈতিহাসিক জীবনের কথা

গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া

বিজ্ঞানকে সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করা একটি কঠিন কাজ। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় জগদীশচন্দ্র বসু ও আবদুল্লাহ আল-মুতী অবশ্যই অগ্রণী। এছাড়া আরো অনেক বিজ্ঞান-লেখক রয়েছেন, যাঁরা বাংলাভাষায় বিজ্ঞানকে সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন। বর্তমান গ্রন্থকার মুহাম্মদ ইব্রাহীম একজন স্বভাবজাত লেখক, যিনি বিজ্ঞানকে সহজবোধ্য করে পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় করার কাজে নিরলস রয়েছেন। তাঁর বিজ্ঞান সাময়িকী অথবা বিজ্ঞান ক্লাব কিশোর-তরুণদের বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আলোচ্য গ্রন্থটি পদার্থবিজ্ঞানী ইব্রাহীমের সর্বশেষ গ্রন্থ। মানুষের আদিম নিদর্শন ও বিবর্তন কীভাবে কালের ধারাবাহিকতায় ব্যাখ্যাত হয়েছে তা গ্রন্থটির সূচিপত্র দেখলেই ধারণা করা যায়। পঁয়ত্রিশ লাখ বছরের প্রাচীন উপাদান নিয়ে গ্রন্থে প্রথম লেখাটি লিখেছেন আর গ্রন্থের শেষ লেখাটি চারশো বছর আগের উপাদান নিয়ে লিখিত। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস একটি আকর্ষণীয় বিষয়, যা বহু বছর ধরে চর্চিত হচ্ছে। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একজন অনুসন্ধানী তরুণ সহজেই অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু যেসব তরুণের কাছে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নেই অথবা মানুষের ইতিহাস বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অনুপস্থিত তাদের কাছে এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে হাজার লাখ বছরের ইতিহাস-উপাদান সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাইবেলে বর্ণিত অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নিদর্শন বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য ও তুরস্কের প্রান্তরে উৎখননের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান লেখকও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কথা ভুলে যাননি। কার্বন ডেইটিং দ্বারা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইতিহাসকে প্রামাণ্য করে থাকে। যে-সময়ে নিয়মলব্ধভাবে ইতিহাস লেখা হয়নি, সে-সময়ের ইতিহাস মূলত প্রত্নতত্ত্ব ও স্থাপত্যিক নিদর্শনের মাধ্যমে শনাক্ত করা বা প্রামাণ্যকরণ করা হয়ে থাকে। লেখক ইব্রাহীম গ্রন্থের বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের কথা বলেছেন। ভূমিকায় মন্তব্য করেছেন – ‘প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সম্পর্কে পড়ার অভ্যাস থেকে, কোনো কোনো নিদর্শন নানা মিউজিয়ামে দেখে, বাকি অনেকগুলোর ফটো দেখে, প্রাগৈতিহাসিক মানুষের জীবন নিয়ে প্রায়শ ভেবেছি। পাওয়া তথ্যগুলো হয়তো সীমিত কিন্তু তার কিছু কিছু এতই ভিন্ন স্বাদের যে, সুদূর অতীতের এই মানুষগুলোর অন্যরকম জীবন মনের মধ্যে খুবই উঁকিঝুঁকি দিয়েছে।’

বর্তমান গ্রন্থে মুহাম্মদ ইব্রাহীম চৌত্রিশটি আখ্যান লিখেছেন। লেখাগুলোতে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ও প্রান্তের ঐতিহাসিক উপাদানগুলোকে উপজীব্য করে তিনি এগুলো রচনা করেছেন। নিবন্ধগুলোর শিরোনাম আকর্ষণীয় ও সহজভাবে দেওয়া হয়েছে। শিরোনামগুলো থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘ইথিওপিয়ার হাদারে লুসি : ৩৫ লক্ষ বছর আগে,’ ‘ফ্রান্সের লাশাপেলের বুড়ো : ষাট হাজার বছর আগে’, ‘প্যালেস্টাইনের মানাত গুহার তন্বী : পঞ্চান্ন হাজার বছর আগে’, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বার্নেট গুহার মাইয়ারা : তেরো হাজার বছর আগে’, ‘ইংল্যান্ডের স্টার ক্যারের অগ্নি : এগারো হাজার বছর আগে’, ‘ভারতের দমদমার আমদানি : এগারো হাজার বছর আগে’ ইত্যাদির কথা বলা যায়। পৃথিবীব্যাপী নানা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো লেখকের লেখায় উঠে এসেছে। পাঠকেরা যেসব অঞ্চলের নিদর্শন এই গ্রন্থে পাবেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে – কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউক্রেন, উত্তর জার্মানি, সিরিয়া, জর্দান, সাইপ্রাস, পাকিস্তান, চীন, নাইজার, জাপান, পাপুয়া নিউগিনি, মেক্সিকো, মিসর, ইরাক, চেক রিপাবলিক, বতসোয়ানা, অস্ট্রেলিয়া, ইস্টার আইল্যান্ডসহ উপরিউক্ত শিরোনামভুক্ত অঞ্চলসমূহ।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুহাম্মদ ইব্রাহীম সহজভাবে বিজ্ঞানকে উপস্থাপন করে থাকেন। তাঁর এই পারদর্শিতা গ্রন্থটির প্রত্যেক লেখাতেই রয়েছে। ইতিহাসকে যে সাহিত্যধর্মী বর্ণনার মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী করা যায়, তার উদাহরণ লেখক গ্রন্থটিতে সৃষ্টি করেছেন। প্রথম লেখাটিতে বর্ণনার মধ্যে রয়েছে – ‘ইথিওপিয়ার হাদার নামক জায়গায় সাভানা তৃণভূমি এটি। একসময় এখানেও ঘন বনভূমি ছিল; কিন্তু এখন ৩৫ লক্ষ বছর আগের দিনে একসঙ্গে ঘন হয়ে থাকা বেশি গাছ নেই বললেই চলে।… এ-কারণেই বনের ভাব ক্রমেই কমে গিয়ে সাভানা তৃণভূমির রূপটিই বহুদিন ধরে এখানে স্থিত হয়ে গিয়েছিল।’ একদম বিজ্ঞানের অনুবর্তী হয়েই লেখক ‘হাদারে লুসি’ নামের আখ্যানটি লিখেছেন। গল্পটি যে নিছক কল্পনার কোনো গল্প নয় তা লেখক বেশ কিছু নিদর্শনের আলোকচিত্র জুড়ে দিয়ে প্রমাণ করেছেন। লুসি প্রজাতির নরবানরদের ফসিলের নানা নিদর্শন এখানে দেখানো হয়েছে।

পরের গল্পটি লিখিত হয়েছে ‘কেনিয়ার নারিকোটোমের বালক’ নিয়ে। পনেরো লাখ ত্রিশ হাজার বছর পূর্বের বিষয় এটি। এই গল্পেও রয়েছে কয়েকটি আলোকচিত্র, যা গল্পটিকে বিজ্ঞান ও ইতিহাসের চরিত্র প্রদান করেছে। একইভাবে লিখিত হয়েছে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বার্নেট গুহার মাইয়ারা’। তেরো হাজার বছর পূর্বের নিদর্শন নিয়ে লিখেছেন এটি। যাযাবর একটি পরিবারের গুরুজন হলো মাইয়ারা : আখ্যানটির শেষে প্রাসঙ্গিকভাবেই রয়েছে বার্নেট গুহা, ক্লোভিস বর্শাগ্র ইত্যাদির আলোকচিত্র। ‘উত্তর জার্মানীর আরেন্সবার্গের বর্শাবাজ’ নামের আখ্যানটিতে রয়েছে তেরো হাজার বছর আগের বিষয়বস্ত্ত। জার্মানির শীতক্লিষ্ট জনবিরল এই স্থানে শরৎকালে মাংস খাওয়ার জন্য শিকারি দলের বর্শাবাজদের মধ্যে একজন সেরা বর্শাবাজকে নিয়ে আখ্যানটি লিখিত। এখানকার পাথরের বর্শাগ্র ও নারীদের বিমূর্ত ছবি গল্পের শেষে যুক্ত রয়েছে।

বারো হাজার বছর আগের একটি যাযাবর গোষ্ঠী হলো সিরিয়ার আবু হোরাইরার যাযাবর। কৃষিকাজের জন্য তাদের ছুটতে হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। মূল্যবান শস্যবীজ সঙ্গে নিয়ে কীভাবে কৃষি-সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করেছিল তা এই আখ্যানে রয়েছে। আখ্যানের শেষে আবু হোরাইরা নামের স্থানে যে উৎখনন করা হয়েছিল তার ছবি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভালো একটি বাড়ির নকশা। ‘সিরিয়ার মুরাবেটের দাদীমা’ নামের আখ্যানটি এগারো হাজার বছর আগের নিদর্শন নিয়ে লিখিত হয়েছে মুরাবেট নামের স্থান থেকে পাওয়া নানা নিদর্শনের ছবি গল্পের শেষে দেওয়া হয়েছে। ‘ভারতের দমদমার আমদানী’ নামের আখ্যানটি এগারো হাজার বছর আগের। লেখক আখ্যানটি শুরু করেছেন এভাবে – ‘উত্তর ভারতের গঙ্গা উপত্যকাটি একেবারেই সমতল বিশাল এলাকা নদী পেরিয়ে।… এলাহাবাদ থেকে ৭০ কিলোমিটারের মতো।’ কীভাবে শিকারের জন্য হাতিয়ার তৈরির পাথর সংগ্রহ করা হতো তার বর্ণনা রয়েছে এ-আখ্যানে। দমদমায় কবরে থাকা কঙ্কাল ও পাথরের হাতিয়ারের ছবি আখ্যানটিকে প্রামাণ্য করেছে।

এভাবে প্রতিটি আখ্যান ইতিহাসের নিরিখে উপস্থাপন করেছেন লেখক। বিভিন্ন দেশের মিউজিয়ামে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে উপজীব্য করে মুহাম্মদ ইব্রাহীম আখ্যানগুলোকে সাজিয়েছেন। চার শতাধিক পৃষ্ঠার এ-আখ্যানগুলো যে-কোনো বয়সের পাঠকদের মোহাবিষ্ট করে রাখবে। আখ্যানে উপস্থাপিত প্রতিটি নিদর্শন মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। আলোকচিত্রগুলোর ব্যবহার যথাযথ হয়েছে। গ্রন্থের শেষে প্রত্নতত্ত্ব ও স্থাপত্যিক বিষয়ের ওপর লেখা গ্রন্থের একটি তালিকা যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক ছিল। ড. ইব্রাহীম বহু বছর ধরেই বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন। শেষে বলা যায় যে, বর্তমান গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয় হবে নিঃসন্দেহে। আকর্ষণীয় একটি গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য সর্বশেষে লেখক ও প্রকাশককে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। r