প্রেম অথবা গোলাপের দীর্ঘশ্বাস

মানস সান্যাল

গোলাপ গাছটা আসলেই সুন্দর। অদ্ভুত সুন্দর। এত সুন্দর গোলাপগাছ পৃথিবীর কোথাও আছে ভাবতেই মেয়েটা পুলক অনুভব করে। সে কেবল ভাবতো গোলাপগাছ হলো গোলাপগাছ। তাতে গোলাপ ফুটবে। সামান্য গন্ধও বেরোবে। তবু সেই গোলাপগাছ মন কেমন করে দেবে না। বিস্মিত করবে না। এই গাছটা তেমন তেমন গোলাপগাছের মতো নয়। এমন আর কোথাও আগে সে দেখেনি। তাই হাত বাড়িয়ে গাছের পাতাগুলো ধরতে তার খুব ইচ্ছা করে এবং ইচ্ছা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে খেয়াল করে, তার একটা হাত গাছের পাতার কাছাকাছি চলে গেছে প্রায়। নম্র সবুজ পাতাগুলোর  কাছে তার হাত যেন প্রার্থনামগ্ন নারীর হাত হয়ে ওঠে। বিস্তীর্ণ বালির মধ্য থেকে উঠে আসা নারীর হাত। ক্যাকটাসের চুড়িপরা। মরুজ্যোৎস্নার আংটি; কিছু একটা যেন ঝিকমিক করে ওঠে তার ডান হাতের মধ্যমায়। অবিকল মরুজ্যোৎস্নার মতো আলো ঠিকরে বেরোতে থাকে; কিন্তু এমন তো হতে পারে না। সে খেয়াল করে, এটা তার মনের ভুল। চোখেরও ভুল। হ্যালুসিনেশন। খেয়াল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হাত টেনে নেয়। আশেপাশে ভালো করে তাকায়। সে জানে, বাগানের সবকিছু চোরা ক্যামেরার চোখে চলে যাচ্ছে। ক্যামেরার চোখ স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঢুকে সূক্ষ্ম তারের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে রেকর্ডরুমের তথ্যধারণীতে। বাগান কর্তৃপক্ষ অথবা কর্মচারীদের কেউ যদি দেখে, সে হাত দিয়ে একটি গোলাপ গাছের পাতা ধরেছে, তাহলে হয়তো বাগানে ঢোকার অনুমতি আর মিলবে না। খুব সন্তর্পণে সে পিছিয়ে যায়। চারপাশে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হতে চেষ্টা করে কেউ তাকে দেখছে কি না।

আশেপাশে কেউ নেই। কেবল নদী। পোষ-মানা নদী। যেন নদী নয়। পালিত জলাশয়। বাগানের কণ্ঠলগ্না হয়ে শুয়ে আছে। বাগানের পালিত জলভৃত্যের ভঙ্গিতে। বাগান জাগতে বললে জাগে। বাগান ঘুমাতে বললে ঘুমায়। বাগানের আদেশেই এতদূর চলে আসা। মেয়েটা জানে, যতটা বিনীত, নিরীহ এবং পোষ্য হয়ে শুয়ে আছে, নদীটা আসলে ততটা নিরীহ, বিনীত নয়। সে শুনেছে, নদীটা ঠিক এইখানে বাগানের পাশে ছিল না। ছিল দূরে। অনেক দূরে। সিন্ধ্যাবন-পাহাড়ে জন্ম নিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কাছাকাছি সমতলে। বাগান করার সময় প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়েছিল। প্রয়োজন হয়েছিল সলিল সৌন্দর্যের। তাই বাঁধ দিয়ে, অনেক পরিশ্রম, অর্থ ব্যয় করে নদীর গতিপথ বদলানো হয়। নিয়ে আসা হয় বাগানের পাশে এবং যতদূর বাগান বিস্তৃত ততদূর নদীটাও বাগানের পাশাপাশি বয়ে গিয়ে আচমকা মোচড় দিয়ে সরে গেছে নিজের কক্ষপথে। মেয়েটা জানে না, ঠিক কোথায় এ-নদী বাগানের পাশে এসেছে। মেয়েটা জানে না, ঠিক কোথায় এ-নদী আচমকা মোচড় দিয়ে বাগানের শেষবিন্দু ধরে সরে গেছে নিজ কক্ষপথে। সে জানে না, বাগানের কোথায় শুরু। বাগানের কোথায় শেষ। সে কেবল সুবাধ্য নদীর কথা জানে। জানে নদীর অভিমানের কথা। সে জানে নদীর  যে-অংশ বাগান-সংলগ্ন তাতে কোলাহল নেই, স্রোত নেই; মাছ নেই, উদ্ভিদ নেই। তবে সব আছে বাগান-বিচ্ছিন্ন অংশে।

নদীর পাশেই, বাগানের উঁচু অংশ যেখানে শুরু, সেখানে রোপিত এই উদ্দাম গোলাপ গাছ মেয়েটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। গাছের পাশেই একটা লোহার খুঁটি। খুঁটিতে লাগানো লোহার বোর্ডে লেখা – ‘রানি ক্লিওপেট্রার বাগানের একান্ত গোলাপ। রানি-প্রদত্ত নাম – আনাতোনিয়ান রোজ’। ক্লিওপেট্রা সম্পর্কে মেয়েটা জানে। অ্যানটোনিও সম্পর্কেও। সেই সুদূর মরুর বুক থেকে এত দূরে চলে আসা গোলাপ গাছের প্রতিটি পাতায় যেন ইতিহাস অাঁকা আছে রঙের ভাষায়। মেয়েটা ভাবে, রঙের ভাষা জানা থাকলে খুব ভালো হতো। নিমেষেই পড়ে ফেলা যেত এই গোলাপগাছের ভাষ্য। সেই বর্ণাঢ্য ইতিহাস হয়তো নিজেই বয়ে যাচ্ছে আনাতোনিয়ান গোলাপের বংশধারার মধ্য দিয়ে। সবুজ কান্ডের মধ্যে দিয়ে। গাছটায় ফুটে থাকা গোলাপগুলোর দিকে তার নজর পড়ল। গোলাপগুলোও সুন্দর। লাল টকটকে। এগারোটা গোলাপ ফুটেছে গাছে। সবগুলোই একরকম। টকটকে লাল। সবগুলোই একরকম? সে ভালো করে দেখে। না, সবগুলো একরকম নয়। ঠিক মাঝখানে ফুটে থাকা গোলাপটা অন্যগুলোর মতো টকটকে লাল নয়। একটু কালচে। শিরার রক্তের মতো। ঠিক লাল বলা যাবে না। লালের মধ্যে কালো। অথবা কালোর মধ্যে লাল। ধমণীর রক্তের মতো অত শুদ্ধ লাল নয়। যেন এই একটি গোলাপ কেবল বেদনায় জড়িত। কার বেদনা? রানী ক্লিওপেট্রার? অথবা অ্যানটোনিওর? সে বোঝে না। সে কেবল বোঝে জগতের সকল গোলাপ থেকে আলাদা, বিচ্ছিন্ন এ-গোলাপ কেবল বিষাদ ও বেদনার রসে নিজেকে টইটম্বুর করে ফুটে আছে। আসন্ন শীতের বাতাসে নড়ে উঠছে বাগানের সবকিছু। দুলে উঠছে মরুগোলাপের গাছও। অন্য গোলাপগুলোও হালকা হিমেল বাতাসে দুলতে শুরু করেছে। কেবল মাঝখানের অনিন্দ্য গোলাপটিই বাতাসের তীব্রতাকে রীতিমতো উপেক্ষা করে বিষাদগ্রস্ত রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বিষাদগ্রস্ত রাজার সব বেদনা যেন এ-ফুলের কালচে লাল কোরকগুলো মাতিয়ে বয়ে চলেছে। মেয়েটার মনে হয়, সে বহুকাল ধরে এ-গোলাপের সামনে হাত বাড়িয়ে আছে। কী এক অপার প্রার্থনায়! মনে হয়, এ-প্রার্থনা কোনোদিন শেষ হওয়ার নয়। সম্পন্ন হওয়ার নয়।

প্রাচীন রূপকথার মরু-অধ্যায় থেকে জন্মানো অমোঘ গোলাপের থাকতে থাকতেই সে শুনল ঘণ্টায় শব্দ হলো। ঢং ঢং। তার মানে সময় শেষ হয়ে আসছে। পরীক্ষাকেন্দ্রে যেমন সময় শেষ হওয়ার আগেই একবার ঘণ্টা বাজানো হয়, এ-বাগানেও সেরকম রীতি চালু আছে। আর মাত্র পনেরো মিনিট আছে। দুপুর ১টায় বাগানের গেট বন্ধ হয়ে যায়। তার আগেই বেরোতে হবে। অন্য কোনোদিন এতটা বিমুগ্ধ হয়নি সে। সময় শেষ হওয়ার আগেই বেরোতে পেরেছে। আজ তার বেরোতে ইচ্ছা করে না। তার ইচ্ছা করে আরেকটু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে। গোলাপগাছটার সামনে। মরুগোলাপের বিষাদগ্রস্ততায় আরেকটু সিক্ত করে নিতে নিজেকে। এক দুই তিন করে সময় এগিয়ে যেতে থাকে। সে চায় সময়কে উপেক্ষা করে গোলাপটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। কেননা, বারবার তার চোখে ভেসে উঠতে চায় একজন পুরুষের অবয়ব। খুব আবছা। অনেকটা পেনসিল স্কেচের মতো। কেবল রেখাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গোলাপের একেকটি পাপড়ি যেন পেনসিলের একেকটি দাগ। খুব মৌন এবং গোপন কলায় কারো অবয়ব ফুটিয়ে তোলার জন্য কোনো ছবির জাদুকর জুড়ে দিয়েছে এগুলোকে।

১টা বাজতে যখন আর মিনিটতিনেক বাকি আছে, ঠিক সে-সময় মেয়েটা উপলব্ধি করে এ-গোলাপের পাপড়ি, রেণুদন্ড এবং অন্য অংশগুলো একত্রিত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে অ্যানটোনিওর অবয়ব ফোটাতে চাইছে। ধীরে ধীরে তার কাছে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। হ্যাঁ, অ্যানটোনিওর এক ফুল-ভাস্কর্য এ-গোলাপ। এমনিতে ভাস্কর্য বানাতে কেউ কেউ সিমেন্ট, চুল, বালি বা কংক্রিট ইত্যাদি ব্যবহার করলেও এ-ফুল কেবল কোরক দিয়ে একজন মানুষের মুখ ফোটাতে চাইছে। ইতিহাসের বহু প্রাচীন অধ্যায় থেকে তুলে আনতে চেয়েছে অ্যানটোনিওর মুখ। সে নিজের কাছেই জিজ্ঞেস করে, কখনো অ্যানটোনিওর কোনো ছবি বা ভাস্কর্য সে দেখেছে কি না। দুয়েকটি গ্রন্থে দেখেছে। তবে ওইভাবে লক্ষ করেনি। তবে এই বর্ণাঢ্য গোলাপের সামনে দাঁড়িয়ে সে যেন দেখতে পায় কোনো ছবি বা ভাস্কর্য নয়, স্বয়ং অ্যানটোনিওর মুখই যেন এ-গোলাপটিকে উপলক্ষ করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে তার চোখের সামনে। এ কি সত্য? নাকি তার মনের ভুল? দেখার ভুল? সহসাই সে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না।

ভাবতে ভাবতেও যখন তার ভাবনা ফুরাতে চায় না কিন্তু বাগানের রুটিনে মহিলাদের জন্য ধার্য সময় ফুরিয়ে যায়, বাগানের একজন কর্মী তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাকে বোঝাতে চায় কিছু। মেয়েটা শোনে লোকটা কিছু বলছে তাকে। কী বলছে তা বুঝতে পারে না। হাত বাড়িয়ে যখন লোকটা তার কাছে কিছু চাইতে থাকে তখন সে বাড়িয়ে দেয় তার নিজের হাত। কিন্তু লোকটা হাত চায়নি। সে চেয়েছে বাগানে ঢোকার অনুমতিপত্র। বুঝতে পেরে মেয়েটা অনুমতিপত্রটা লোকটার হাতে ধরিয়ে দেয় এবং টের পায় অদ্ভুত বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সে বুঝতে পারে, এই অনিন্দ্যগোলাপের সামনে সে আর কোনোদিন দাঁড়াতে পারবে না। বিষণ্ণ মন এবং বিবশ শরীর নিয়ে সে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে বাগানের গেটে এসে দাঁড়ায়। একবার পেছন ফিরে দেখতে চেষ্টা করে সেই গোলাপটিকে দেখা যায় কিনা। এতদূর থেকে, এতগুলো গাছের শরীর ডিঙিয়ে যেতে পারে না তার চোখ। ফলে সে আস্তে আস্তে প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তার ভাবতে ইচ্ছা হয়, ওই গোলাপের কালচে রক্ত, শিরার রক্ত নিয়ে ফুটে থাকা মরুগোলাপের নির্যাস তার পথে ছড়িয়ে দিচ্ছে কেউ। ওই কাল্পনিক রক্তের ফোঁটা মাড়িয়ে মাড়িয়ে সে চলে যেতে থাকে আর বুকে, বুকের বাঁদিকে খুব জোরে চেপে তার করতল, যে করতল কিছুক্ষণ আগেও গোলাপের গায়ে লেগেছিল।

দুই

বাগানের গেট দুবার খোলে। একবার সকাল ৯টায়। অন্যবার দুপুর ২টায়। ছেলেটা জানে মাঝখানের এক ঘণ্টা সময় বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মধ্যাহ্নভোজনের জন্য পায়। তারা খায়-দায়। কেউ কেউ ঘুমায়ও। কারো খাওয়া-দাওয়া বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে তার ভালো লাগে না। ভালো না লাগলেও দেড়টার দিকেই সে বাগানের প্রধান ফটকের কাছে চলে আসে। প্রাচীন বটগাছের আদলে যে কংক্রিটের মূর্তিটা প্রধান ফটকের সঙ্গে বসানো, বিশালদেহী সেই কংক্রিটের গাছের শিকড়ে বসে থাকে, হাই তোলে। মাঝে মাঝে তন্দ্রাও এসে যায় তার। বাগানের কর্মীদের মতো মধ্যাহ্নভোজন-পরবর্তী ঘুমে তার নিজের শরীরও আচ্ছন্ন হয়ে আসে। কংক্রিটে হেলান দিয়ে রূপকথার রাখাল হয়ে সে ঘুমিয়েই পড়ে মাঝে মাঝে। বেলা ঠিক ২টায় ঘণ্টা বাজে। অর্থাৎ বাগানের গেট পুরুষদের জন্য খুলে দেওয়া হলো। বিকট কর্কশ ও যান্ত্রিক ঘণ্টা তার রাখালিয়া ঘুম ভাঙিয়ে দিলে, সে নিজের ভেতরে টের পেতে থাকে এক অদ্ভুত অচেনা মানুষের উপস্থিতি যে অচেনা মানুষটা কংক্রিটের শহরে নয়, বালিমগ্ন মরুর বুকে বেড়ে উঠেছে। উটের কুঁজে চড়ে, ক্যাকটাসের সাদা অন্তর্যাস পান করে বেড়ে উঠেছে। সে আসলে মরু-উটের রাখাল। তার বারবার মরুভূমির কথা মনে হয়। অথচ সে কখনো কোনো মরুভূমি দেখেনি। মরুভূমির কথা গ্রন্থে পড়েছে। মরুভূমিতে চিত্রায়িত মুভি দেখেছে, মিউজিক ভিডিও দেখেছে। কেবল আজ নয়। গতকাল রাতেও সে স্বপ্নে দেখেছে, এক মরুদেশীয় জাদুকর মহিলা তার মুখের নেকাব সামান্য উঁচিয়ে তাকে বলছেন, এটা খেয়ে নিন।

এটা কী, সে জানতে চেয়েছিল অথবা এটা কী জানার জন্য মহিলার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। তাকিয়েছিল মহিলার হাতে ধরা পানপাত্রের দিকেও। পিতলের পানপাত্র। রং দেখলেই বোঝা যায়। সূর্যের আলো লেগে ঝকঝক করছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে প্রতিবিম্বিত আলো। কিন্তু মহিলা কোনো উত্তর দিলেন না। হয়তো উত্তর দেওয়ার কোনো ইচ্ছা তার ভেতর ছিল না। সে আবার জানতে চেয়েছিল, কী আছে এই পানপাত্রের মধ্যে?

এবার মহিলা উত্তর দিলেন। সামান্য হেসে বললেন, এটা ক্যাকটাস। ঠিক ক্যাকটাস নয়। বালিক্যাকটাসের নির্যাস। এটা পান করলে আপনিও উটের রাখাল হতে পারবেন। পৃথিবীর সমস্ত উটের মালিক হয়ে যাবেন আপনি। মালিকানা স্বত্ব থাকবে না ঠিক। তবে ওরা আপনার কথা শুনবে, বুঝতে পারবে এবং মানবে। আপনি যখন কোনো মরূদ্যানের দিকে ওদের নিয়ে যেতে চাইবেন তারা আপনার ইচ্ছামতো ওদিকে চলে যাবে। আপনার মনের ইচ্ছাও ওরা বুঝতে পারবে। ফলে আপনাকে খুব একটা কথাও বলতে হবে না। ওরাই আপনাকে নিয়ে যাবে মরূদ্যানের ছায়ায়। নিজের গলদেশে জমিয়ে রাখা পানিও তারা বিনা বাধায় আপনার মুখে ঢেলে দিতে চাইবে। নেবেন কি না সেটা আপনার বিষয়। অতটা নির্দয় কি আপনি হতে পারবেন?

কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই মহিলা চলে গেলেন। স্বপ্নের প্রেক্ষাপটও বদলে গেল। বদলে গেলেও ওই স্বপ্নের রেশ গেল না।

মানুষের তো অনেক স্বপ্ন থাকে। স্কুলের টিচার মাঝে মাঝে স্টুডেন্টদের জিজ্ঞেস করে, বড় হয়ে তোমরা কে কী হতে চাও বলো? সবাই কমবেশি একই কথা বলে। উটের রাখাল হওয়ার কথা কি কেউ কখনো ভাবে? সে জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি কোনোদিন।

দুপুরে, বাগানের গেট খোলার অপেক্ষায় কংক্রিটের গাছের শিকড়ে বসে থাকতে থাকতে তার মনে হয়, কয়েকটি উট যেন বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। কখন খুলবে বাগানের প্রধান দরজা! সে ঘড়ি দ্যাখে। ১টা ৪৫। আরো পনেরো মিনিট বাকি আছে। উটগুলোর দিকে আবার তাকায়। নিশ্চয়ই পুরুষ উট। নাহলে বিকোলের সেশনে বাগানে আসত না। কেবল বিকেলের সেশনটাই পুরুষদের জন্য। সকালেরটা মহিলাদের। অপ্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ  শিশু-কিশোরদের জন্য এই বাগান কখনোই খোলা হয় না। এই নিয়ম মোটামুটি সবারই জানা। অন্তত যারা নিয়মিত বাগানে ঘাম ঝরাতে আসে। ছেলেটাও ঘাম ঝরাতে আসে। তবে ঠিক ঘামও নয়। মন ভোলাতেও। এই বাগানে পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে ফুল, ফল, গাছের চারা এনে লাগানো হয়েছে। প্রায় সব গাছই সাফল্যের সঙ্গে বেড়ে উঠছে। স্বাভাবিকভাবে। একেকটা গাছে, একেকটা গাছের ফুলে পৃথিবীর একেক জায়গার ইতিহাস যেন লেগে থাকে। ইতিহাসের গন্ধ এবং স্পর্শ লেগে থাকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলেই বুঝি সেসব প্রাকৃত ইতিহাস স্নায়ু বেয়ে শরীরে ঢুকে যাবে। সোজা মাথায়। এবং মজ্জায়। মেরু-ভালুকের লোম যেমন সাদা হয় তেমন সাদা তুষার গোলাপ যেমন এখানে আছে, মরুর ক্যাকটাসও আছে। এত বৈপরীত্য দেখতে ছেলেটার খুব ভালো লাগে। এত বৈচিত্র্য! সব সময়েই সে চেষ্টা করে এই বাগানে হাঁটার। বিশেষ একটা সময় ছাড়া। যখন বাগানের সব ফুল, ফল, পাতা ঝরতে আরম্ভ করে। এই বাগানের নাকি একটা নিয়ম আছে। সব ফুল, ফল, পাতা একসঙ্গে ফোটে এবং একই সঙ্গে ঝরে যায়। ফোটার সময়টায় বাগানে বেড়াতে সবচেয়ে ভালো লাগে। সবচেয়ে খারাপ লাগে ঝরার সময়টায়। গাছগুলো পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়া হয়ে যায়। বাগানে কেবল ডালপালা থাকে। পাতা থাকে না। ফুল, ফল তো বহু দূরের কথা। তখন ঘাম ঝরানোর জন্যও ছেলেটা এই বাগানে আসে না। সে তখন শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। ধূলি, বালি, গাড়ির ধোঁয়া, যান্ত্রিক হুইসেল, পিচের রাস্তায় টায়ারের ঘর্ষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে হাঁটে। শরীর থেকে টুপটুপ করে ঘাম ঝরতে থাকে। বছরের ওই সময়টায় সে আকুল হয়ে ওঠে। আবার কখন ফুল, ফল, পাতা গজানো শুরু হবে বাগানে সেই অপেক্ষায় থাকে। পাতা ঝরানোর দিন খুব কাছে এলো বলে। খুব তাড়াতাড়ি পাতা ঝরানোর সময় শুরু হতে যাচ্ছে। তারপর বেশ কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।

উৎকট শব্দের ঘণ্টা ছেলেটাকে সচকিত করে তোলে। খুলে দেওয়া গেট ধরে সে নীরবে ঢুকে পড়ে বাগানে। তার সামনে জনাকতেক লোক। ঘাম ঝরাতে এসেছে। ছেলেটার মনে হয়, লোক নয়, ওরা আসলে একপাল বধির উট। মরুদেশ থেকে বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে এনেছে ইতিহাস। বালিলাগা, রক্তের গন্ধলাগা ইতিহাস।

কল্পনার উটগুলো যেদিকে যায় ছেলেটিও সেদিকে যায়। যেতে যেতে, যেদিকটায় সে আগে কখনো যায়নি, নদীর কাছাকাছি, সেদিকে সে চলে গেল। এদিকটাও বাগানের অন্যান্য দিকের মতোই। শুধু নদী ছাড়া। নদীটা এই পাশ ধরে বয়ে গেছে। সে দেখল, উটগুলো আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। নদীর ওপর দিয়ে বয়ে আসা মৃদু বাতাস উটগুলোর বায়বীয় শরীর তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে কোথায় যেন। এবং তখনই তার চোখ পড়ল সেই অনিন্দ্যগোলাপগাছটার ওপর যেটার পাশে লোহার খুঁটিতে লাগানো লোহার বোর্ডে লেখা – রানী ক্লিওপেট্রার বাগানের একান্ত গোলাপ। রানি প্রদত্ত নাম – আনাতোনিয়ান রোজ।

ক্লিওপেট্রার কথা কে না জানে। অ্যানটোনিওর ইতিহাসও অনেকের জানা। এ-গোলাপ যদি রানী ক্লিওপেট্রার বাগানের একান্ত গোলাপ হয়ে থাকে, তাহলে এর পূর্বপুরুষের গায়ে অবশ্যই রানির হাত লেগেছিল। অ্যানটোনিওর হাতও লেগে থাকতে পারে। ছেলেটা গোলাপ গাছের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে যায় এবং দেখে গাছের প্রতিটি পাতাই অনিন্দ্য। অদ্ভুত সুন্দর। তার চোখ পড়ে ফুটে থাকা এগারোটি গোলাপের দিকে। প্রায় সব গোলাপই একরকম। কেবল মাঝখানের গোলাপটা একটু অন্যরকম। বাকি গোলাপগুলোর মতো টকটকে লাল নয়। কালচে লাল। মনে হয় এতে সম্রাজ্ঞীর সমস্ত বিষাদ জড়ো হয়েছে প্রতিটি কোরকে। বিষাদের রং কি কালো? বিষাদের কি কোনো বর্ণ হয়? ছেলেটা এসব ভাবে আর তাকিয়ে থাকে মাঝখানের সেই গোলাপটার দিকে যেটা শিরার রক্তের মতো লাল। ঠিক লাল নয়। লালচে কালো।

যন্ত্রচালিত মানুষের মতো অনেকেই ছেলেটাকে অতিক্রম করে চলে যায়। মাঝে মাঝে কেউ কেউ বাঁকা চোখেও দেখে। কেননা, সাধারণত এই বাগানে কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রত্যেকেই ঘাম ঝরাতে আসে। ফুল, ফল, পাতা, বৃক্ষের সঙ্গ উপভোগ করতে নয়। তাছাড়া বাগানের কোনো ফুল, ফল, বৃক্ষ বা পাতা ছোঁয়াও রীতিবিরুদ্ধ। রীতি ভাঙলে বাগানে প্রবেশের অনুমতি হারাতে হয়। সাধারণত কেউ এমন করে না। কিন্তু কিছু পাগল তো থাকেই যারা বাগানে ঘাম ঝরাতে আসে না। ঘাম ঝরানোর ছদ্মবেশে তারা আসে প্রকৃতির সঙ্গ পেতে। এই ছেলেটিও হয়তো সেইসব পাগলের কেউ হবে ভেবে অন্যেরা আর তার সামনে দাঁড়ায় না। অতিক্রম করে চলে যায়। ছেলেটা অবশ্য এসব নিয়ে ভাবে না। তার ভাবনায় কেবল উড়তে থাকে মেরুপ্রদেশের ধূলি। বহুকাল আগে উড়ে যাওয়া মানুষের বেদনা ও গোপন ক্ষত-যন্ত্রণা। প্রাচীন সম্রাজ্ঞীর রাজ্য হারানোর বেদনা, প্রেমিক হারানোর বেদনা, এসব। আরো কত কি!

অনিন্দ্য সেই মধ্যগোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার হঠাৎ মনে হয়, এটা আসলে ফুল নয়। এটা একটা ভাস্কর্য। ফুল, ফুলের কোরক দিয়ে তৈরি। সে তার মনকে আরো নিমগ্ন করে তোলে। সব মনোযোগ ঢেলে দিতে চেষ্টা করে। কেন? তার মনে হয়, এটা আসলে একটা ভাস্কর্য কিন্তু কার ভাস্কর্য তা সহসাই সে ধরতে পারে না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে, থাকতে থাকতে একসময় সে বোঝে, এটা রানী ক্লিওপেট্রার মুখের ভাস্কর্য। হুবহু একই রকম মুখ। রানীর মুখ বহুবার বহু পত্রিকার পাতায় সে মুদ্রিত হতে দেখেছে। ওইভাবে কখনো মন দেয়নি। কিন্তু এই ফুলের ভাস্কর্যটিকে সে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না। উপেক্ষা তো দূরের কথা, চোখ সরাতেই সে ব্যর্থ হয়। এদিকে দুপুর পাশের নদীর ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায়। বিকেল যায়। সন্ধ্যাও যাব যাব করে। আচমকা তার খেয়াল হয়, নিজের অজান্তেই সে হাত বাড়িয়ে মধ্যগোলাপের একটি কোরক ছুঁয়ে দিয়েছে। কোরক নয়। সে ছুঁয়ে দিয়েছে রানির গন্ডদেশ। ধীরে ধীরে আঙুল বুলাতে শুরু করেছে। সচকিত হয়ে ওঠে সে। কেননা, সে জানে এটা বাগানের রীতিবিরুদ্ধ। এটা যদি বাগানের কারো চোখে পড়ে, কিংবা যদি কারো চোখে নাও পড়ে ক্যামেরায় ধরা পড়ে তাহলে সে এই বাগানে প্রবেশের অনুমতি হারাবে। অন্যেরা ঘাম ঝরানোর জন্য বাগানে আসে। ঘাম ঝরানোর জন্যই হয়তো এই বাগানের সৃষ্টি। সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মাঝে বাগানের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের উদ্ভিদ। এ হয়তো বাগান মালিকের খেয়াল মাত্র। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে এমন নিয়ম জারি হতো না। কেবল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের ছাড়াও শিশুদের প্রবেশাধিকার থাকত বাগানে। তা যখন নেই, তাই ছেলেটির মনে হয় এটা কোনো বাগান নয়। একরকম ব্যায়ামাগার। দেয়ালে পৃথিবীর সব বিখ্যাত ফুল, ফল, পাখি ও বৃক্ষের ছবি টানানো আছে মাত্র।  চেষ্টা করলেও ওইসব ধরা যাবে না। ছোঁয়া যাবে না। যেহেতু ধরা বা ছোঁয়া যাবে না তাই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। মাঝে মাঝে ছেলেটির ভ্রম নয়, এই বাগানে আশ্চর্য বিখ্যাত সব বাগান-উপাত্তের সম্মিলন কি আসল, নাকি তার নিজের কল্পনা মাত্র। সে আরেকবার হাত বাড়িয়ে ওই অনিন্দ্য গোলাপের আরেকটি  কারক নাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে টের পায় তার কাঁধেও একটি ভারী হাত এসে পড়ল। লোকটা বাগানের কর্মকর্তা। সারাটা সময় হয়তো নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে বসে গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যাবলি দেখে। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়। লোকটা নিরাপত্তা কর্মকর্তাও হতে পারে। লোকটা আসলে কী এটা জানার কোনো কৌতূহল নিজের মাঝে টের পায় না ছেলেটি। সে জানে, লোকটা কেন তার নিয়ন্ত্রিত কক্ষ ছেড়ে এখানে এসেছে। সে জানে, লোকটা এবার তাকে কী বলবে। কোন ভাষায় তার প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়ার সংবাদ জানাবে। সে আর সুযোগ দিলো না বাগানের কর্মকর্তাকে। আস্তেধীরে নদী ও অনিন্দ্যগোলাপ পেছনে রেখে সোজা হেঁটে সে বেরিয়ে গেল। কারো দিকে, কিছুর দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। যারা ঘাম ঝরাতে আসে তারাও বোধহয় এতটা নির্মোহভাবে বাগান ত্যাগ করে না। হয়তো সেও ততটা নির্মোহ বোধ করে না, কেননা, সে তখন বাগানের গেট ধরে দেখতে পায় লালচে আকাশজুড়ে একটা অনন্ত গোলাপ ফুটে উঠছে। আসলে গোলাপ নয়। ভাস্কর্য। রানী ক্লিওপেট্রার মুখের আদল। কোরক দিয়ে গড়া।

তিন

পাতাঝরার দিনে বাগানের প্রতিটি গাছ শূন্য হয়ে যায়। প্রতিটি গাছই। কোনো গাছেই ফুল থাকে না। ফল তো দূরের কথা। পাতাও ঝরে যায়। তখন চূড়ান্ত শীতের মাঝে বাগান একলা দাঁড়িয়ে থাকে। নিঃসঙ্গ এবং রিক্ত। প্রত্নতত্ত্বের গূঢ় উৎসের মতো। অন্যান্যবারের পাতাঝরার সময়ের মতো এবারেরটারও শুরু হলো স্বাভাবিকভাবেই। সব ফুল, ফল, পাতা একসঙ্গে ঝরতে শুরু করল। তাই এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না। তারা ভাবল প্রতিবারই তো এমন হয়। এ নিয়ে ভাবার কী আছে। বাগানের বহু বছরের ঐতিহ্য অনুসারে এমনটা ঘটাই তো স্বাভাবিক। সবকিছু অনুমান মতো হবে। পূর্বধারণার বাইরে কিছুই হবে না। এমনকি কোন পাতাটি কখন পড়বে তাও যেন এই বাগানে নির্ধারিত হয়ে আছে।

অনুমানমতোই এলো বাগানের ঝরার পালা। প্রথমে শুকিয়ে যেতে লাগল প্রতিটি গাছের পাতা। ডাল। ফুলের কোরক। ঘাসগুলো বাদামি হতে শুরু করল। কুঁকড়ে যেতে লাগল। বাগানের প্রতিটি বস্ত্তই যেন একেকজন আশীর্বাদপুষ্ট টিথোনাস। অমর জীবনের প্রান্তরেখায় যৌবন হারিয়ে ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে। নিজের চামড়ার মধ্যে। আর এক বিষাদগ্রস্ত বিলাপ মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। ক্রন্দন জমিয়ে বুকের পাশ থেকে উঠে প্রতি ভোরে রক্তিম অশ্বদলের রথে চড়ে বসে অরোরা এবং একদিন বেদনা আর সইতে না পেরে প্রেমিককে বানিয়ে দেয় ঘাসফড়িং। এভাবেই ঝরার পালা হলো শুরু। অন্যান্যবারের মতোই দেখতে দেখতে একমাস চলে যেতে লাগল। এক মাসের মধ্যেই সাধারণত ঝরার পালা প্রায় শেষ হয়ে যায়। তারপর কিছুদিন মরা বাগানের খরা মাটি, খরা গাছ, খরা ডালপালা পড়ে থাকে। পাখি বসে না। পাখিরা হয়তো পাতা, ফুল, ফল, তাজা ঘাস, বর্ণ এবং গন্ধের সংশ্রব ছাড়া থাকতে শেখেনি। তাই এ-সময়টায় বাগান পাখিশূন্য হয়ে যায়। তবে এতে বাগানের উপযোগিতা একটুও কমে না। যারা ঘাম ঝরানোর জন্য শহরের কোথাও জায়গা পায় না, তারা এই শীতার্ত মরা বাগানেই আসে। বাগান জীবিত থাকলেও যা, বাগান মরে গেলেও তা। তারা তো বাগান দেখতে আসে না। আসে ক্লান্তি খুঁজে নিতে। আর ক্লান্তি জীবিত বাগান থেকে যেমন কুড়ানো যায়, মরা বাগান থেকেও কুড়ানো যায়। জীবিত বাগানে বরং ক্লান্তি কম জমে। কেননা, পাখির ডাক, ফুলের গন্ধমাতম, বাতাসে উড়ন্ত প্রজাপতি – এই সবকিছু কোনো না কোনোভাবে মনকে একাগ্র হওয়া থেকে বিরত রাখে। কেবলই ঘাম অর্জন থেকে মনকে বারবার সরিয়ে নিতে চায়। যত অাঁটসাঁটভাবেই বাঁধা হোক না কেন কিছুটা উন্মনা কি হয়ে যায় না সবাই জীবনের সংশ্রবে?

পাতাঝরার সময়ে কর্মীরা কেউ বাগানের মাঠে থাকে না। দূরনিরীক্ষণঘরের মধ্যে আরাম করে বসে থাকে। গল্পগুজব করে। শুকনো খাবার খায়। গানও গাইতে শোনা যায় কাউকে কাউকে। মাঝে মাঝে সরেজমিন দেখতে যায় ঝরার পালা কতটা বাকি আছে। বাগানের কোন অংশে ঝরার কাজ বেশি বেগে চলছে, কোন অংশে কম বেগে, এসবই তাদের জানাতে হয়। বিদ্যুৎ-চিঠির মাধ্যমে জানাতে হয় বাগানের মালিককে। মাঝে মাঝে সরেজমিন প্রতিবেদনও পাঠাতে হয়।

সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়েই বাগানের বড়কর্তার চোখে পড়ল বিষয়টা। সমস্ত বাগানে ঝরার পালা শেষ হয়ে গেছে প্রায়। আনাতোনিয়ান রোজের গাছটাও পত্রশূন্য হয়ে গেছে। কেবল মধ্যগোলাপটি ছাড়া বাকি দশটা গোলাপও প্রায় ঝরে গেছে। শুধু ঝরেই যায়নি, ততদিনে মাটির সঙ্গেও মিশে গেছে। কিন্তু মধ্যগোলাপটি ঝরেনি। ঝরা তো দূরের কথা। আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। এতটা প্রাণবন্ত যেন এক মাস আগেও ছিল না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে বড়কর্তার খুব কষ্ট হলো কেননা চোখ বিশ্বাস করলেও মন বিশ্বাস করতে চাইল না। চোখ বন্ধ করে সে স্মরণ করতে চেষ্টা করল আগে কখনো বাগানে এমন ঘটনা ঘটেছিল কি না। সুদূর অতীতে? না, তাকে হতাশ হতে হলো। এমন ঘটনা বাগানে কখনোই ঘটেনি। এই অবস্থায় সে কী করবে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। একবার ভাবল, বাগানের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে নেবে। তারপর মালিককে জানাবে। পরক্ষণেই  চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলো। সে সোজা ফিরে গেল নিজের কামরায়। বিদ্যুৎ চিঠি লেখার সরঞ্জাম নিয়ে লিখতে থাকল চিঠি। সমস্ত বিবরণ দিয়ে। একটি সামান্য গোলাপের কাছে কীভাবে বাগানের এত বছরের ঐতিহ্য হেরে যেতে বসেছে; জানতেও চাইল এ-অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে। বড়কর্তা আসলে বিষয়টা অধস্তনদের কাছে গোপন করতে চেয়েছিল, কেননা বাগানের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে বাগানের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী জড়িত কিনা এ-কথাও তো বলা যায় না। বাগানের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী হয়তো এমন কোনো উদ্দীপক গোলাপটিতে ঢেলে দিতে পারে যার বলে ফুলটি এতটা উদ্ধত হয়ে উঠতে পারে। কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। কাউকেই না।

কিন্তু বিষয়টি গোপন থাকল না। বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে ঘাম ঝরাতে আসা অসংখ্য নারী-পুরুষও জেনে গেল। যদিও তারা ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা দিলো না। একটি উদ্ধত গোলাপের ফুটে থাকার দৃশ্যের মাঝে তারা এমন কিছু খুঁজে পেল না যাতে অনেকক্ষণ গোলাপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। তবে বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টের পেল। রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পেতে লাগল। তারা বুঝে গেল গোলাপের বেহায়ার মতো ফুটে থাকা আসলে বিশাল ষড়যন্ত্রের একটা অংশ মাত্র। তারা আরো কিছু অসঙ্গতি পেল। যেমন পাখিদের আচরণ। প্রতিবার পাতাঝরার দিনে পাখিগুলো বাগান ত্যাগ করে দূরে কোথাও চলে যায়। পাতা গজানোর দিনে আবার ফিরে আসে। পাখিগুলো এবার কোথাও যায়নি। বাগানেই থেকে গেছে। প্রতিটি বৃক্ষশূন্য ডালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও না হয় একটা কথা ছিল। ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলা যেত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নয়, পাখিগুলো জড়ো হয়েছে গোলাপটিকে কেন্দ্র করে। আশেপাশের গাছগুলোর ডালে ডালে বসে থাকে। সন্ধ্যার দিকে গোলাপটিকে ঘিরে অসহ্য কিচিরমিচির জুড়ে দেয়। যেন নেতার কাছে শিক্ষা নিচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। আরো আছে। নদীটার আচরণও বদলে গেছে। আগে বাগানসংলগ্ন নদীতে তেমন ঢেউ ছিল না বললেই চলে। স্রোত তো ছিলই না। এখন স্রোত এবং ঢেউ যুগপৎ খেলতে শুরু করেছে। কয়েকটি মাছের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এগুলো বাগানের লোকেদের চোখ এড়ালো না। বড়কর্তারও নয়। বিশদ ব্যাখ্যা করে তারা আবার চিঠি লিখল এবং উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল। বাগানের এক কর্মী একদিন বড়কর্তার কক্ষে গিয়ে বলল, স্যার, বেহায়া গোলাপটাকে ছিঁড়ে ফেললেই তো সব ঝামেলা চুকে যায়। আপনি না ছিঁড়তে চাইলে আমাকে দায়িত্ব দিন। মিনিটখানেকের জন্য ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা বন্ধ করে রেখে দেবেন। আমি আস্তে করে ছিঁড়ে ফেলব। ফেলে দেব নদীতে। নদীতে ইদানীং ঢেউ এবং স্রোত দেখা দিয়েছে। ভেসে ভেসে কোথায় চলে যাবে, কেউ টেরও পাবে না। সন্ধান তো পাবেই না। বড়কর্তা বিষয়টি ভেবে দেখলেন। আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধিটা খারাপ না, কিন্তু বাগানের সার্ভিস রুলে এটা নিষিদ্ধ। সেখানে স্পষ্টই লেখা আছে, বাগানের কোনো অনুষঙ্গকেই অস্বাভাবিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মৃত্যু অবশ্যই কোনো অস্বাভাবিক পরিণতি নয়, কিন্তু হত্যা অস্বাভাবিক। কোনোমতে যদি এটা ফাঁস হয়ে যায় তাহলে আর চাকরি থাকবে না এবং আজ হোক বা কাল হোক ফাঁস হবেই। তখন পরিণতি হবে আরো ভয়াবহ। তাই বড়কর্তা সেই দুর্বুদ্ধি কর্মীকে ডেকে খুব করে শাসিয়ে দিলেন। এমন নীতিবিরুদ্ধ বুদ্ধির চর্চার জন্য এক সপ্তাহের বেতনও কেটে নিলেন তার আর অপেক্ষা করতে লাগলেন মালিকের চিঠির। নিশ্চয়ই তিনি কোনো উপায় বের করে ফেলবেন – এই বিশ্বাস বড়কর্তার আছে। তবে সহসাই কোনো জবাব এলো না। দিন যেতে লাগল। মাসও পার হয়ে গেল।

অবশেষে প্রত্যাশিত চিঠি যখন এলো, বাগানের সবাই আরো অবাক হয়ে গেল। মালিকের নির্দেশ হলো – নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবাইকে বাগানে ঢোকার অনুমতি দেওয়া। সবাই ঢুকতে পারবে। একসঙ্গেই ঢুকতে পারবে। বাচ্চারা খেলতে পারবে। ইচ্ছামতো ছিঁড়তে পারবে ফুল। পাতা। ঘাসফড়িং। এমনকি যারা বাগানের ফুল অথবা ফলে হাত দেওয়ার অপরাধে দন্ডিত হয়েছিল তারাও আবার বাগানে ঢোকার অনুমতি পাবে।

অবিলম্বে এই নিয়ম কার্যকর হলো। সবাই দলে দলে বাগানে আসতে লাগল। ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে বাগানে ঘুরতে শুরু করে দিলো। কিন্তু এতকিছুর পরও সেই গোলাপের কোনো পরিবর্তন হলো না। সেই গোলাপ তার নিজস্ব মহিমায় ম্লান করে দিতে লাগল চারপাশ। প্রাচীন ঐতিহ্যকেও। এবং এভাবেই চলতে লাগল মাসের পর মাস যতদিন পর্যন্ত না এক প্রাকৃত সন্ধ্যায় খুব কাছাকাছি সময়ে বাগানে প্রবেশ করল সেই বহিষ্কৃত মেয়ে এবং ছেলেটি। প্রায় একই সঙ্গে তারা এলো বাগানে। দুজনেই এলো ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো। এক মনে মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তারা সোজা চলে গেল গোলাপগাছের দিকে। দুইজন দুই দিকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল একমাত্র গোলাপটির রূপ। বিরাট বিষাদের প্রস্তাবনা পাঠ করে নিতে থাকল যেন। আগের বারের মতোই ছেলেটির মনে হলো, এই গোলাপের আদলে আসলে লুকিয়ে আছে রানী ক্লিওপেট্রার মুখের আদল। অ্যাসপাইন বিষের প্রতিক্রিয়ায় কালচে হয়ে যাওয়া তার চোখ আর ঠোঁটের মহিমাও যেন লেগে আছে প্রতিটি কোরকে। আসন্ন সন্ধ্যার প্রেক্ষাপটে অকস্মাৎ সামনে তাকিয়ে সে বিস্মিত হয়ে গেল। তার মনে হলো, রানী ক্লিওপেট্রাই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হুবহু একরকম চেহারা। মুখের অভিব্যক্তিতে সেই অনিন্দ্যবিষাদ। অন্যদিকে মেয়েটিও দেখল, গোলাপের অবয়বে লুকিয়ে থাকা অ্যানটোনিওর মুখের আদল আস্তে আস্তে নড়তে আরম্ভ করেছে এবং নড়তে নড়তে ধীরে ধীরে গোলাপগাছের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা ছেলেটির মুখে গিয়ে স্থির হলো। তারা একই সঙ্গে বাড়িয়ে দিলো তাদের হাত। একে অপরের দিকে নয়। উভয়েই গোলাপটির দিকে। তাদের হাত একই সঙ্গে স্পর্শ করল গোলাপটিকে এবং সন্ধ্যার ঘড়িতে ব্যাপক ঘণ্টায় শব্দ হলো ঢং ঢং। ছেলেটা বা মেয়েটা তবু নড়ল না। দাঁড়িয়েই থাকল।

বাগানের তথ্যধারণ কক্ষে সমবেত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেখল সেই অনিন্দ্যগোলাপ ধীরে ধীরে ঝরে যেতে শুরু করেছে। সব কোরক আস্তে আস্তে কুঁকড়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। পোড়া কাগজের ছাইয়ের মতো আস্তে আস্তে খসে পড়তে লাগল সব অংশ। এত মাস যে-গোলাপটিকে কেন্দ্র করে তাদের রাগ, ক্রোধ, ভয় এবং উত্তেজনা বেড়ে উঠছিল সেই দুরন্ত গোলাপের করুণ পরিণতি দেখে তারা কিছুটা আহতই হলো। তারা একবারের জন্যেও মেয়েটির বা ছেলেটির মুখের দিকে তাকাল না।

সম্মোহিত হয়ে তারা দেখতে লাগল গোলাপটির অন্তিম মুহূর্ত। যদিও বাতাসের শব্দে আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না যন্ত্রে, তারা যেন স্পষ্ট শুনতে পেল গোলাপের প্রতিটি কোরকের দীর্ঘশ্বাস। তাদের মনে হলো, এই দীর্ঘশ্বাসগুলো একসঙ্গে জড়ো হয়ে তাইফুন বা তুফান হয়ে যাবে। উড়িয়ে নিয়ে যাবে বাগানের পাশে এতকাল ধরে বইতে থাকা পোষ-মানা নদীটিকেও।