ফণীন্দ্র

মাদ্রাসার ভিটেয় উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে এক পা রেখে থমকে থেমে যায় ফজল। ভবনটি ছিল একতলা। এখন দোতলা ভবনে সবলসিংহপুর সিনিয়র মাদ্রাসার নামফলকটি শোভিত। সে যখন দেখেছে তখন ছিল জুনিয়র মাদ্রাসা; স্থাপিত ১৯২৬। একতলার রূপটি ছিল হালকা-পাতলা ছিমছাম। এখন ভার বেড়েছে উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে। একটু অচেনা মনে হয়। এখানে সে পড়েনি। গুরুত্বটা বেশি বাবা পড়েছেন বলে। তার ছোট চাচা বা একমাত্র কাকা ফণীন্দ্রও পড়েছেন এই মাদ্রাসায়। কাকার সঙ্গে সে বেড়াতে আসত। আকর্ষণ ছিল বোর্ডে লেখার চকখড়ি কুড়িয়ে পাওয়া আর খুব টানত নয়নতারার কেয়ারিগুলো। বেগুনি ফুলের লতানো চেহারা আর প্রতিটি কাণ্ডির মাথায় ফুলের শোভা। কয়েকবার চারা এনে ভিটেয় লাগিয়েছে, কিন্তু ছায়ার কারণে গাছ হয়নি। তাদের ভিটেটা ছিল খুব ছোট। করমচা আর তেঁতুলগাছের ঘনপাতার ছায়ায় গাছ কখনো দুপাতার বেশি মাথা তুলতে পারেনি।

তার মাদ্রাসায় আসার কথা প্রধান শিক্ষক জানতেন। তাই খবর পাওয়া মাত্র নেমে আসেন। মধ্যপঞ্চাশ ভদ্রলোক, ছোটখাটো-গোলগাল চেহারা। হাত ধরে ফজলকে সম্ভাষণ জানান। তারপর সবকিছু ঘুরিয়ে দেখানোর জন্যে লন পার হয়ে মূল ভবনের বারান্দায় ওঠেন।

এইটা আমাদের প্রথম শ্রেণি।

সামাদ সাহেব, আমি যখন দেশে ছিলাম তখনো এটা প্রথম শ্রেণি ছিল। তবে কিছুদিনের জন্যে প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে হাসপাতালের ডাক্তার পরিবার ছিলেন।

হ্যাঁ, তা আমি শুনেছি। আপনারা আগের অনেক কিছু জানেন।

সে পুরনো কথা। মাঝে হল ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়…

তা ঠিক।

এখনও আমরা এই মাদ্রাসাকে নিয়ে গর্ব করি আপনার বাবার মতো মানুষ এখানে পড়েছিলেন বলে। এই মাদ্রাসা কেন, এই গ্রামের শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি।

ঠিক বলেছেন… তারাশঙ্করের লাভপুর, শওকত ওসমানের সবলসিংহপুর…

আর আববাসউদ্দীনের বলরামপুর…

পাশ থেকে বলে ওঠেন একজন।

ও পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি আমাদের মতিনবাবু… ভূগোলের শিক্ষক।

বাড়ি নিশ্চয় কোচবিহার? – বলে ফজল।

ঠিক ধরেছেন। আপনি জানলেন কী করে?

বলেন মতিনবাবু।

ওই পরিবারের সঙ্গে আমার যে ঘনিষ্ঠ জানাশোনা।

তাই!

হ্যাঁ। পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে।

আমরা কোচবিহারবাসী আববাসউদ্দীনের পরিবারকে নিয়ে গর্ব করি।

ফজলের কানের কাছে প্রয়াত শিল্পী আববাসউদ্দীনের কণ্ঠটা ধ্বনিত হয়ে ওঠে :

দিনার দিন দিন ফুরাল,

শুখনাতে তরণি –

বইসা রে দিন গুনি,

আমি বইসা রে দিন গুনি…

তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকায় আমেরিকান ইনফরমেশন কেন্দ্রে অনুষ্ঠান রেকর্ডে গানটা শুনেছিল ফজল। এখনো তার কানে কণ্ঠের অনুরণনটা লেগে আছে। মনে হয় এই তো সেদিন শুনলাম! অথচ মাঝে প্রায় অর্ধশতকের বেশি সময় অতিক্রান্ত।

আরো কত গান যে মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। বিশেষ করে গভীর রাতে কোনো উৎসব-বাড়ির মাইক্রোফোন থেকে যখন দূর থেকে ভেসে আসত :

প্রাণ কোকিলা রে,

আমায় এতো রাতে ক্যানে ডাক দিলি…

প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে নিচতলা প্রদর্শন সারা হলে তারা দোতলায় ওঠে। ভবনের পশ্চিম দিকের শাখায় অফিস কক্ষ। বড় টেবিল ঘিরে কাঠের চেয়ার। নতুন-পুরনো মেশানো।

ফজলের আগ্রহ সবদিকে। মাদ্রাসার কারিকুলাম, কারা পড়তে পারে বা না পারে। কী-কী পড়ানো হয়।

প্রধান শিক্ষক জানান, আজকাল সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যাপারটি উঠে গেছে। হিন্দু-সম্প্রদায়ের সন্তানও ভর্তি হতে পারে। তবে কারিকুলামে কোনো বদল হবে না। ইসলামিয়াত সবাইকেই পড়তে হয়। তিনি হাসতে-হাসতে আরো জানালেন যে, এই ধর্মীয় বিষয়েও হিন্দু-ছাত্ররা বরাবরই বেশি নম্বর পায়।

চমৎকৃত হয় ফজল। সে খুশি হয় যে, তারা মাদ্রাসা বলতে বাংলাদেশে বোঝায় শুধু গরিব মুসলিমরা পড়বে, এখানে তা নয়। মাদ্রাসা প্রায় ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র নিয়েছে। তার মনে পড়ে একসময় তা ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামপন্থী সরকার থাকায় এই উদারপন্থা সূচিত করেছে। বাংলাদেশেও মাদ্রাসায় এমনটা করলে হয় না? প্রধান সব ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সবাই জানল। তৈরি হল একজন আর একজনকে জানার! সম্প্রদায়গত সংস্কৃতির প্রতি জন্মাত শ্রদ্ধাবোধ! গরু আর শূকর ভক্ষণ নিয়ে হতো না হানাহানি! এক ধর্মে একটি প্রাণী ট্যাবু, অন্য ধর্মে নয়। জানাজানির ক্ষেত্রটা দিন-দিন পাকাপোক্ত হতো। একসময় ব্যাপারটা সবার কাছে হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়াত! তখন এক সম্প্রদায় আর এক সম্প্রদায় নিয়ে কৌতুক করলেও কেউ গায়ে মাখত না। বরং রসাস্বাদনের ক্ষেত্রটা অনেক বড় হয়ে যেত। আজকে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে নিজের ধর্ম নিয়েই রস করা যায় না, অন্য ধর্ম নিয়ে কিছু বলা তো দূরের ব্যাপার। ইদানীং কৌতুক করাটাই একটা গর্হিত কাজ। এমনকি রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে কার্টুন করলেও শিল্পীকে পেটানো হয়। না-হয় মাফ চাইতে হয় আদালতে গিয়ে। এমনি অসহিষ্ণু হয়েছে সমাজের মনোভাব। অথচ উন্নত দেশে এসব এত সাবলীল যে, সবাই উপভোগ করে। ক্ষিপ্ত হয় না। সভ্যতার মাপকাঠিতে আমরা যে কত তলানিতে, তা আর নতুন করে বলার নয়। অথচ ভিখিরির হাতেও মোবাইল।

এই সময় আপ্যায়নের উপাচার এসে যাওয়ায় আলোচনা লঘুছন্দ গ্রহণ করে।

মতিনবাবু বলেন, ফজল সাহেব, আপনি তো ছেলেবেলা এখানে কাটিয়ে গেছেন, মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলুন না, শুনি।

অভিজ্ঞতা কিন্তু কম নয়, যদিও আমি এই মাদ্রাসায় পড়িনি। আমি পড়েছি মামাবাড়িতে। ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম ‘ঝামটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়’, হাওড়ায়। ওটাও আমাদের মতো বানে-ডোবা অঞ্চল। ঢিবির ওপরে বিদ্যালয় ভবন। তখন ছিল টালি ছাওয়া। এখন পাকা হয়ে গেছে। সামনের পুরনো বটগাছটা আছে। আরো বিসত্মৃত হয়েছে। ফলে কিছু ডাল পড়েছে কাটা। পাশে উচ্চ বিদ্যালয়ও হয়েছে। দোতলা পাকা ভবন। জায়গাটার সামনে দিয়ে পাকা রাস্তাও হচ্ছে। বেশ জমাট বেঁধে গেছে জায়গাটা। পরিবেশটাই পালটে গেছে। ঝামটিয়ার সুবিধা কি জানেন, লোকসংখ্যা কম। সবলসিংহপুর জনবহুল গ্রাম, ফলে আমার চোখে কিছুটা ঘিঞ্জি লাগে।

আমরা রোজ দেখছি, তাই গা-সওয়া হয়ে গেছে। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন… অন্যরকম লাগতে পারে, বলেন প্রধান শিক্ষক।

তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। রোজ দেখলে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে না। আপনাদের মোরাম ঢাকা রাস্তাটা পাকা হয়ে গেলে সবলসিংহপুরের চেহারা কিন্তু পালটে যাবে। রাস্তার পাশের জায়গার দাম বেড়ে যাবে।

এখনি দাম বেড়ে গেছে, বলেন মতিনবাবু।

আপনাদের ফটিক ছেলেটি খুব স্মার্ট। একা যেভাবে ওষুধের দোকানটা সামলায় দেখার মতো।

ইয়াংম্যান। এই বয়সে খাটবে না তো খাটবে কবে? মজার কাহিনি যেমন আছে তেমনি এই মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে দুঃখের কাহিনিও আছে।

তখন ডাক্তার এইখানে অবস্থান করছেন। এক ছোটভাইয়ের হলো বিষফোড়া। পিঠে। বেশ বড় আকার নিয়েছে। লাল হয়ে ফুলে রয়েছে, কিন্তু ফোড়ার মুখ হচ্ছে না যে গলে যাবে। বেচারার দু-তিন বছর বয়স, খুব কষ্ট পাচ্ছে। শেষে ডাক্তার ভদ্রলোক শল্যচিকিৎসার রাস্তা ধরলেন। বাড়ির আমি বড় সন্তান। মা মহিলা মানুষ। আমি আর ছোট চাচা ওকে ওই মাদ্রাসায় নিয়ে এলাম। কোনোরকম অ্যানেসথেসিয়ার বালাই ছিল না। ফলে জোর করে হাত-পা চেপে ধরে উপুড় করে ডাক্তার ছুরি চালিয়ে পুঁজ বের করে ড্রেস করে দিলেন। আরো তিন-চার দিন নতুন করে ড্রেস করতে হতো। আর সেই আর্তচিৎকার। মোটামুটি এই ছিল ঘটনা। ফোড়া ভালো হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারকে আমরা ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ফজল বলে, এর চেয়ে কঠিন বেদনা কিন্তু ভবিষ্যতের গর্ভে আমাদের জন্যে জমা ছিল। ১৯৬৪ সাল, এই উপমহাদেশে আর একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। ওই বছর আমার এই ভাই আঠারো বছরের তরুণ, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল, সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়িতে কথাকাটাকাটি। ফল যে এমন হবে কেউ কল্পনা করেনি। ভাইটা আত্মহত্যা করে বসে। মা-বাবা, আমাদের সবার অবস্থা উন্মাদপ্রায়। বাবার বুকের এ-ক্ষত কখনো শুকোয়নি।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফজল।

সমস্ত কক্ষ বিষণ্ণ।

একসময় নীরবতা ভাঙে ফজল। এবার আপনাদের একটা আনন্দের বার্তা দিই। আমার জীবনে এই মাদ্রাসায় প্রথম সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড পদার্পণ। আর শুধু অংশগ্রহণ নয়, কবিতা আবৃত্তি করে পুরস্কারপ্রাপ্তি।

কোন কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, মনে আছে? জানতে চান মতিনবাবু।

আছে। কবির নাম নিয়ে একটু দ্বিধা আছে। সম্ভবত নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। আমি কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করেছিলাম।

পিপীলিকা, পিপীলিকা,

দলবল ছাড়ি একা,

কোথা যাও, যাও ভাই বলি?

শীতের সঞ্চয় চাই,

খাদ্য খুঁজিতেছি তাই –

ছয় পায় পিলপিল চলি।

এতদিন পরও দেখি সবটা ঠিক-ঠিক মনে রেখেছেন। বলেন মতিনবাবু।

এটা যে হার্ডডিস্কে তোলা।

তা ঠিক। বলেন প্রধান শিক্ষক।

আরো মজার ব্যাপার ছিল। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমার ডাক পড়ল। প্রচুর তালি। পেলাম একটা ছ-পয়সা দামের হ্যান্ডেল। লম্বা নিব। কাঠের রং, পালিশ করা। খুশির আর অন্ত নেই। ভিনি ভিডি ভিসি, আর কি! এই হল আমার সবলসিংহপুর মাদ্রাসার স্মৃতি।

একটু থেমে ফজল আবার বলে, ও হ্যাঁ, আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি… মাদ্রাসা চলাকালীন সময় দাদির সঙ্গে ফুপু মানে পিসি আমিনার বাড়ি পুবপাড়ায় যেতাম… মাদ্রাসার সামনে এলেই একটি ছেলে জোরগলায় চিৎকার করে বলত, এই দোস্ত, চললে কোথায়? আমি খুব যে একটা চিনতাম তা নয়, তবে সে নিশ্চয় আমাকে চিনত। দাদির মুখে শুনেছিলাম ছেলেটির নাম ছিল আইয়ুব। ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ত। আমি কানে এখনো সেই ডাক শুনতে পাচ্ছি, এই দোস্ত, চললে কোথায়? তখন যেতাম ফুপুর বাড়ি। আর এখন?

প্রশ্নটা অজান্তেই দার্শনিক অনুষঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ফজল ভাবে, তাই তো, কে কোথায় চলেছে? সেই দাদি, সেই ফুপু, সেই কাকা ফণীন্দ্র, সেই আইয়ুব, এই মাদ্রাসার শ্রেষ্ঠ সন্তান, তার বাবা, কে কোথায় চলে গেল? সবারই গন্তব্য এক। সবকিছু প্রবেশ করছে কালের গহবরে। সে-ও চলছে তাদেরই পথ ধরে। এ-চলার শেষ কোথায়, কে জানে!

আপনার কাকা তো এই মাদ্রাসায় পড়েছেন? বলেন প্রধান শিক্ষক, আচ্ছা তার নাম ফণীন্দ্র হলো কী করে?

আমি যদ্দূর জেনেছি সে এক মজার ঘটনা। আমাদের বাড়িতে ফণীন্দ্র নামে এক চর্মকার নিয়মিত আসতেন। কাজ না থাকলেও বাবা কিছু সাহায্য করতেন। আমার কাকা যখন জন্মগ্রহণ করেন, বাবার ঠাকুরমা মানে দাদি কাকার নাম রাখতে চান ফণীন্দ্র। তিনি এই চর্মকার ভদ্রলোকের আচরণে এত প্রীত ছিলেন যে, পৌত্রের নাম রাখতে চান ফণীন্দ্র। বাড়ির সবাই মেনে নেয়। এদিকে বাবার মামা, তিনি কোরানে হাফেজ, তিনি বলেন যে, নিজ সম্প্রদায়ের নামে নাম রাখতে। এদিকে বাবা জেদ ধরেন যে, ওই নামই থাকবে। শেষে একটা সমঝোতা হয়, ভালো নাম হবে জিলানী মানে গোলাম জিলানী, আর ডাকনাম হোক ফণীন্দ্র। এই হচ্ছে ফণীন্দ্র নামের ইতিহাস। দেশে হিন্দু-মুসলিম বিরোধটা আগে সেভাবে ছিল না।

কিন্তু দেশভাগ তো আর রোধ করা গেল না! বলেন মতিন সাহেব।

ইতিহাস ভাল-মন্দ, উত্থান-পতন এসব নিয়েই চলে, বলেন ফজল। ইতিহাস সব সময় সোজা রাস্তায় চলে না। জটিল তার গতি। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব নিরন্তর লেগে আছে। অসুররাও অনেকবার স্বর্গ দখল করেছে। নারায়ণ এবং মহাদেবও তা রোধ করতে পারেননি। মহামায়াও তাদের সহায়তা দেননি। কালের গতি বড় বিচিত্র। কখন কার সুদিন কখন কার দুর্দিন, বলা কঠিন।

আলোচনা বেশ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে দেখে প্রধান শিক্ষক আবহাওয়া হালকা করার জন্যে বলেন, ফজল সাহেব, ছাত্রদের সঙ্গে একটু মিট করবেন নাকি?

আজ থাক। আপনি আগে থেকে বলে রাখবেন, আর একদিন হবে!

আছেন তো কয়েকদিন? জানতে চান মতিনবাবু।

আছি। সহজে যেতে ইচ্ছা করে না। পুরনো সব স্মৃতি হুড়মুড় করে সামনে জড়ো হয়।

তারা কামরা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

একতলার লন ভেঙে ভিটের সিঁড়িতে পা রেখে চমকে ওঠে ফজল। দেখে মাঝবয়সী একটা লোক উঠে আসছে। কাঁধে একটা কাপড়ের ঝুলি। বেশ পুরনো। ব্যাকব্রাশ করা চুল। বড় গোঁফ। দু-একটায় পাক ধরেছে। লোকটি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগেই ফজল রাস্তা ঘিরে দাঁড়ায়।

তুমি ফণীন্দ্রর ছেলে না? সোজাসাপটা প্রশ্ন।

লোকটি বিস্ময় নিয়ে ফজলকে দেখে। একে সে আগে কখনো দেখেনি।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কী নাম তোমার?

মণীন্দ্র। আপনি আমার বাবার নাম জানলেন কী করে?

আরে তোমার বাবা তো আমাদের মেহেদি মহল্লার বাড়িতে দেশভাগের আগে প্রায় সপ্তায় আসতেন। আর আমার বাবার ঠাকুরমা মানে দাদি নিজ হাতে তোমার বাবাকে খাবার বেড়ে দিতেন। আর বাড়িতে বাবা যদি থাকতেন সব বাড়ি থেকে নিজে ডেকে-ডেকে স্যান্ডেল বা জুতো সারাতে বলতেন। সেলাইয়ের কাজ না থাকলে জুতো পালিশ করাতেন। অন্যদের পয়সাও দিয়ে দিতেন।

হ্যাঁ, আমি বাবার মুখে আপনার বাবার কথা শুনেছি। তিনি বাবাকে খুব ভালবাসতেন। বলতে-বলতে মণীন্দ্রর চোখ-দুটো ঝাপসা হয়ে এলো।

ফজল পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে মণীন্দ্রর সামনে ধরে।

না বাবু, এসব কেন! সংকোচের সঙ্গে বলে মণীন্দ্র।

শোন মণীন্দ্র, আজ যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতেন, আর তোমার জায়গায় তোমার বাবা থাকতেন, তা হলে তিনি কী করতেন?

মণীন্দ্র ফজলের মুখের দিকে চেয়ে টাকাটা গ্রহণ করে। r