ফরিদা জামানের মরমি জাল

মইনুদ্দীন খালেদ4

মাটি মানুষকে ডাকে। মাটির টানে মানুষ ফিরে ফিরে আসতে চায় তার আঁতুড় আবাসে – জন্মভূমে। আর মাটি-মায়ের টানে পৃথিবী অভিমুখী হয়ে আছি আমরা সবাই। মাধ্যাকর্ষণের অমোঘ সূত্রটিই কি স্বভূমির জন্য মানবহৃদয়ের যে দুর্নিবার আকর্ষণ তার জন্য দায়ী? আমরা সুজলা দেশের মানুষ। আমাদের হৃদয়ে দয়ালু-জলের আর্দ্রতা। জলকষ্টে আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে। জলধারা শুকিয়ে গেলে আমরাও মরে যাই। নদী মরে গেলে বিলাপ করি। এই জানুয়ারিতে দেশের প্রধান প্রদর্শনশালা বেঙ্গল গ্যালারি ফরিদা জামানের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীর নাম ‘নিরন্তর মাটির টানে’। শিল্পীর বিশেষ অভিনিবেশ জল ও জালের দিকে। জল ও জালের ধ্যানের মধ্যে উঠে এসেছে মাছ। মাছের আমিষাশী ডাকে সন্তর্পণে উপস্থিত হয়েছে বেড়াল। অপরদিকে অন্য আখ্যানও আছে। শাপলা-হাতে আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে আছে কিশোরী। এছাড়া পাখপাখালি, বিশেষ করে কাক, বক আর ফুল-লতাগুল্মও আশাতীত সজীবতায় রঙিন হয়ে পুষ্পিত হয়েছে শিল্পীর ক্যানভাসে।
ফরিদা জামানের চিত্রকলা বিষয়ে বিশ্লেষণ দেওয়ার শুরুতে শিল্পীর জীবনের দুয়েকটি ঘটনা মনে রাখা প্রয়োজন। তাঁর বাড়ি চাঁদপুর। এখান থেকে নদীমাতৃক বাংলা মাকে সবচেয়ে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিতের ঘরে জন্ম নিলে সাধারণত বেশিদিন গ্রামলগ্ন বা মফস্বলস্থ থাকা হয়ে ওঠে না। উচ্চশিক্ষার তাগিদ সেই ঘরের মানুষদের নগরে নিয়ে আসে। ফরিদা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও ভারতের বরোদায় চিত্রবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। সত্তরের দশকে এ দুটো ডিগ্রি নেওয়ার পর নব্বইয়ের দশকে বিশ্বভারতী থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। এখন সুদীর্ঘকাল ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শিক্ষকতা করছেন।
মানুষ যতো দূরে যায়, স্বদেশ ততো কাছে চলে আসে। মাতৃভূমি ততো আপন হয়ে ওঠে। এ বোধ হয়তো পৃথিবীর কোথাও ক্ষয়ে গেছে; কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তা রয়ে গেছে। বিদেশ-বিবাগী হলে সেই যাতনা বোঝা যায়। মানুষ যতো বড় হয়, ততো তার শৈশব বড় হয়ে দেখা দেয়। মানুষ শৈশবের স্মৃতির মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। অশীতিপর বৃদ্ধও মৃত্যুর সময় মাকে ডাকে। এই স্মৃতিকাতরতা আমাদের ও অন্যদের বলে ভিন্ন কিছু নয়; এটা বৈশ্বিক। মনস্তত্ত্বের বিজ্ঞানীরা আমাদের তা জানিয়েছেন। ফরিদা জামান শৈশবকে খুঁজছেন। কিন্তু তিনি তো আর শিশু নন, প্রৌঢ় প্রাজ্ঞ শিল্পী। তাঁর চাওয়াটা শিশুর মতো নেই, থাকতে পারে না। কিন্তু তিনি মানসিকভাবে গ্রামে থাকেন। নদী-খাল-বিলের মধ্যে নিষ্ঠাবান সতর্ক জেলের মতো জাল ফেলে চলেছেন। জাল-জল, মাছ, লতাপাতা তাঁর চিত্রের অনুষঙ্গ। তিনি নাগরিক হতে পারেননি। তিনি বুদ্ধিমার্গিতার পথ ধরে শিল্পের হিসাব মেলাতে চাননি। তিনি স্বদেশ বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন এবং এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই শিল্পীর জীবনের সালতামামি টানতে হলো।
সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকের শুরুতে ফরিদা জামানের দুটি প্রদর্শনী হয় ঢাকায়। আমাদের চোখ তখন ছবিকে আবিষ্কারের জন্য বিশেষ দ্যুতি লাভ করেছে। অপার বিস্ময়ে দেখলাম, জলের ফোঁটার বুনট আর তার ওপর ত্রিকোণ ডৌলে নেমে এসেছে জাল। হলুদ-বাদামি-কালচে রঙের িস্নগ্ধতায় বিষয় পরিস্ফুট। শিল্পরসিকরা বুঝলেন, ফরিদা জামান আশানুরূপ অভিনবত্বে শিল্পী জন্মলাভ করেছেন।
তারপর থেকে আজো জাল হাতে জলেই তাঁর বাস। অবশ্য মাঝে রোমান্টিক তাগিদটা বিশেষভাবে ঘনিয়ে উঠেছিল তাঁর কাজে। নীলজলে সাদা বক এঁকে সেই সৌন্দর্যতৃষ্ণা তিনি মিটিয়েছেন। কিন্তু সেই জালবিষয়ক ছবির মধ্যে যে-শিল্পরস পান করে আমরা নেশাগ্রস্ত হয়েছিলাম, তা তাঁর পরের কাজে তেমন নেশা জাগাতে পারেনি। আবডালে বসে অস্ফুট স্বরে কেউ কেউ তখন বিরূপ সমালোচনাও করেছেন। আমারও আড়ালে বসে তেমনই মনে হয়েছে।
কিন্তু নতুন বছরের পয়লা মাসে ফরিদা জামানের সাম্প্রতিককালে আঁকা প্রদর্শনী দেখে বহুকাল পর আবার বিস্মিত হলাম। তাঁর ধ্যানের মধ্যে যে জাল রয়ে গেছে এবং তা যে এমন শোভিত হয়ে শিল্পীমনের সৃজনশীলতার নানা পর্দাকেই মেলে দিয়েছে তা দেখে শিল্পপাঠের তৃপ্তি পেলাম। তবে জালের পাশাপাশি অন্য বিষয়ও গুরুতর ব্যঞ্জনায় প্রভাসিত হয়েছে। বিশেষ জল, মাটি আর জলের মধ্যে আলোর প্রতিক্রিয়া এসব মৌল উপাদান নিয়ে তিনি মূর্ত করতে চেয়েছেন দূরাগত গভীরতর অনুভবকে।
কিন্তু তিনি আখ্যান বা গল্প বলার ইচ্ছাটা বিসর্জন দিতে পারেন না। তাঁর ছবিতে মানুষ আছে। মানুষ থাকলেই গল্পটা অন্যরকম হয়ে যায় চিত্রকলায়। কোনো পুরুষ নেই তাঁর ছবিতে। তাই গল্পটা আরো অন্যরকম। গল্পের কিশোরীর অথবা কিশোরীপ্রতিম নিসর্গলীনা নারীর আবার নামও আছে। নাম তার সুফিয়া। সুফিয়া অবশ্য জলের পাশেই থাকে। শাপলা তোলে। পাখির ওড়াউড়িও দেখে। সুফিয়া আর জল একাকার হয়ে যায়। বর্ণের তারল্যের মধ্য থেকে সুফিয়া ও সুফিয়াকে ঘিরে যে-পাখি ও লতাগুল্ম তা আবিষ্কার করতে হয় দৃষ্টিকে পুরাতাত্ত্বিকের সরঞ্জাম বানিয়ে। আসলে বর্ণ ও রেখাই সত্য। এরই মধ্যে মানবী, নিসর্গ ও পাখি, লতাপাতার বিজড়িত উপস্থিতি। প্রায়শ লালে-হলুদে তপ্ত, কখনোবা সাদা-নীলের দ্যোতনায় কোনো বিষয়ের আংশিক প্রকাশ। মোদ্দাকথা বর্ণে সমর্পিত থেকে কখনো দুয়েকটা চড়া স্বর তুলে এনে সংগীতের স্বরূপটা চিনিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার। নারীর মনোলোক কি শিল্পী উজিয়ে দিতে চেয়েছেন এ-ধারার কাজে। নিজের ভেতরের কোনো এক কিশোরী-আমিকে খুঁজে পেয়েছেন কি ফরিদা জামান? তাঁর এই সুফিয়া কি তাঁরই জীবনের কোনো মুখপাত্র?
এবার তিন ধরনের কাজে ফরিদা গহনচারী হতে পেরেছেন। এক. বেড়াল ও জাল; দুই. জলাভূমি আর তৃতীয়টি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় জালের বিবিধ বিস্তার। মাছের লোভে অস্বাভাবিক রকমের প্রলম্বিত হয়েছে বেড়ালের গলা। তার চোখের মণি দুপ্রান্তে স্থিত হয়ে চওড়া হয়ে খুঁজছে মাছ। কিন্তু সেই মাছ কি সে খেতে পারবে। তার সামনে ঝুলছে জাল। চারদিকে মাছের সুস্বাদু গন্ধ আর ঝুলে আছে নানা রকম জাল; – এর মধ্যে একটি বেড়াল কীভাবে! কোন এক বিধুর কাতরতা তাকে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে। কালচে জালের গায়ে হঠাৎ এক প্রস্থ নীল। এ পরিমার্জনাই বেড়াল ও জালবিষয়ক ছবিটিকে কোনো এক অবচেতনের ইশারার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। বেড়াল স্বাদ-আহ্লাদের দ্যোতনাস্বরূপ ওই নীল রং। আমার মনে হয়েছে, শিল্পের অভিযাত্রীয় রুক্ষ পথ পাড়ি দিতে দিতে হঠাৎ বর্ণনা খুঁজে পাওয়ার মতো একটি বিষয় যেন।
একসময় একটি কি দুটি জালের নিচের দিকে ত্রিকোণ প্রসারণের কম্পোজিশন তৈরি করে বেশ পারমিতার পরিচয় দিয়েছিলেন ফরিদা জামান। এখন অবশ্য জালের সঙ্গে জলের সম্পর্কটা অনেক বড় হয়ে এসেছে। জাল যেন জলে অদৃশ্য হয়ে যেতে চায়। জালের শরীরে যে কালো সুতার মোটা বাঁধুনিগুলো আছে তা শুধু জলের সঙ্গে সংগতি রেখেছে। বাকি সবই জলজ প্রতিক্রিয়া। জলের মধ্যে রং গুলিয়ে যেতে থাকলে যেমন গাঢ় ও হালকা স্তরবিন্যাস তৈরি হতে থাকে, তেমনি জলসচল একটা আবহের মধ্যে আজকের ফরিদাকে দেখা যাচ্ছে। একসময় মনে হয়, কোথাও জালই নেই। আছে শুধু জলেরই নানা ঘনীভূত ও তরল প্রকাশ আর এর সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে গেছে জাল।
এ-অনুভব থেকে আমার মনে একটা প্রত্যয় এসেছে : একসময় যে-ফরিদা জাল ও মাছের সম্পর্ক রেখেছিলেন তা আজ নিশ্চিহ্ন। জলের মধ্যে জালের কী রূপ তা-ও তাঁর আরাধ্য নয় আর বরং শিল্পী জালের নানারকম জালিকার ঈষৎ উপস্থিতিতে জলকেই বোঝাতে চেয়েছেন। এ-কথা চক্ষুষ্মান মাত্রই বুঝবেন যে, তাঁর ছবি নিবিড়তম জলকথন। জাল তার লক্ষ্য নয়, বুঝি বা উপলক্ষও নয়। আর তাঁর জলকাব্য পাঠ করতে গিয়ে দেখি সেখানে গল্প নেই আর। আছে শুধু জল ও আলোর সংলাপ। লাল-হলুদ-কালোর বর্ণজোটে হঠাৎ একটু বেগুনি ইশারা মরমি পর্দাটা দুলিয়ে দিয়ে যায়। একটা বাতাসতাড়িত অবস্থা তৈরি করছেন শিল্পী। সব শিল্পই মনের অবস্থা – কোনো একটা ক্ষণে মনের মুদ্রা। জলের ওপর আলো দিয়ে মনোগ্রাহী মুদ্রা তৈরি করেছেন ফরিদা। একটা অনুচ্চ মৃদু-মৃদু শাব্দিক অনুভব তাঁর কাজে যুক্ত রয়েছে।
কখনো মনে হয়, চোখকে কানের কাছে না নিয়ে এলে তাঁর ছবির অন্তর্লীন সংগীত অশ্রুত থেকে যাবে। ফরিদা জামানের কাজে যে-পালাবদল ঘটেছে, তা বোঝা যায় তাঁর আলো, জল, হাওয়া, মাটি এসব মৌল উপাদানের আকর্ষণে। তাঁর কাজ জাগতিক প্রাত্যহিকতার অভিজ্ঞতা ছেড়ে অতিজাগতিক মায়ালোকে, অবচেতনলোকে ও মরমিভুবনের দিকে অগ্রসরমান। তবে তিনি ছবি নির্বাচনে সুবিচার করেননি। অনেক ধরনের কাজ এভাবে উপস্থাপিত করা সংগত হয়নি। তিনি যদি জাল ও জলাভূমিতে সীমায়িত থাকতেন। কিংবা সুফিয়া ও পাখপাখালি বিষয়ক ছবির আলাদা প্রদর্শনী করতেন তাহলে তাঁর শেষ সৃজনশীলতা আমরা আরো স্পষ্ট ও ডাগরভাবে বুঝতে পারতাম।
ফরিদা জামান রং দিয়ে মাটির ধর্ম বুঝতে চেয়েছেন। এই মাটিও জলসিক্ত। জলবান্ধব উর্বর মাটিতে পা পড়লে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় কৃষক। এদেশ মূলত জলাভূমির দেশ। এখানে যতোরকম কাদা দেখা যায় ততোরকম কাদার ঐশ্বর্য খুব কম দেশেই আছে। বৃষ্টিমুখর ব-দ্বীপীয় দেশে মাটিতেই প্রভূত নাটক। রং হাতে নিলে বা তুলির মুখে লাগালেও মাটি-স্পর্শের মতো অনুভব হয়। আপাতদৃষ্টে মাটি কালচে-ধূসর : কিন্তু গভীরতর নিরীক্ষায় মাটি বহুবর্ণা। কৃষক যেমন চাষের জন্য জমিন তৈরি করেন, শিল্পী ফরিদা তেমনি শিল্পচাষের জন্য রং দিয়ে জলকাদাময় ডোবাভূমির মানচিত্র ধরতে চেয়েছেন। শুধু দুহাতে বা দুপা দিয়ে নয়, সমস্ত দেহে কাদা মেখে তবে ফসল ফলাতে হয় কৃষির শ্রমশিল্পীদের। মাটির সঙ্গে মাখামাখি করে যে মৃত্তিকার চরিত্র বোঝা তা আমাদের পূর্বপুরুষেরা এবং আজো কৃষকেরা করে চলেছেন। আমাদের জীবনজুড়ে জল আর মাটি। মাটির মধ্যে অনেক বৃত্তান্ত। পুরাতাত্ত্বিকের মতো খুঁড়ে না দেখেও শুধু উপরিতলেও কতরকম রেখা – আঁকিবুকি, উত্তল-অবতল দেখা যায়। জলমগ্ন মাটিতে কত রকম কীটপতঙ্গের চলাচল, তাদের দেহরেখা, লতাগুল্মের উম্মিলন এবং সেই সঙ্গে অজস্র অচেনা বীজের উদ্গিরণ – সবমিলিয়ে জলের উপরিতল ও অগভীর জলতলে বিরাজমান অনুষঙ্গ নিয়ে কম্পোজিশন রচনায় উৎসাহ পেয়েছে শিল্পীর মন। কখনো সেই জলে প্রতিফলিত হয়েছে শুধু আলো নয় – ডানামেলা বকও। নীল জলে বকের ছায়া সাদা। বকের চোখ মাছের সুস্বাদু ঘ্রাণের টানে জলের দিকে ধাবমান, যেমন জালের পাশে বিজড়িত হয়েছে বেড়ালের আমিষাশী স্বপ্ন। ফরিদা জামান অবচেতনলোক নাড়াচাড়ায় একটা সিদ্ধিতে পৌঁছেছেন। বলা যায়, অবচেতনের টানটা তাকে ডোবাচ্ছে। এভাবে ডুবেই শিল্পের নতুন মুদ্রা নিয়ে দক্ষ ডুবুরির মতো নতুন করে ভেসে উঠতে চান তিনি। একান্ত জাগতিকতায়ও আমি অতীন্দ্রিয়ের আভাস দেখতে পাচ্ছি। মাঠে চড়ছে একজোড়া ছাগল। বৈজ্ঞানিক পরিপ্রেক্ষিত নেই। দ্বিমাত্রিকতায় স্পষ্টত প্রতীয়মান কালো-ধূসর পটভূমিতে একজোড়া ছাগল হয়তো জলের তৃষ্ণায় বা ঘাসের স্বাদে মগ্ন। ছাগল দুটি সাদা, আবছা রেখায় আঁকা ড্রইংমাত্র। সাদা ছাগলজোড়া রহস্যময় মনে হয়, হঠাৎ মনে হয় ছাগল কামধেনুর মতো কোনো অতিজাগতিকতার সংকেত দিচ্ছে।