ফাদার  দ্যতিয়েন : বাংলা গদ্যে  অনন্য ঝংকার

কৃষ্ণা সেন

ফাদার দ্যতিয়েন নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শুভ্রবসনে শরীরমোড়া একজন মানুষ, যাঁর জীবনবোধের একাংশকে আচ্ছন্ন করে রাখে গির্জার শান্ত সমাহিত পরিবেশ। আমরা, যাঁরা ভিক্তর হুগোর লেখা ল্যে মিজেরাব্ল পড়েছি অনুবাদে বা মূলে, সেখানে পেয়েছি শান্ত, সৌম, স্থিতধী একজন যাজকের ছবি। দ্যতিয়েন সাহেবকে সেরূপে ভেবে নিতে পারলেই কল্পনা অন্তত একটা ভিত্তিভূমি পেয়ে যায়। ল্যে মিজেরাব্ল বইটির নামোল্লেখের বিশেষ কারণ উপন্যাসটি যে-ভাষায় রচিত, সেই ফরাসিভাষী মানুষ হলেন ফাদার পল দ্যতিয়েন। তিনি বেলজিয়ামের ফরাসিভাষী মানুষ। এটুকু তাঁর অবস্থানগত পরিচয়ের দ্যোতক, কিন্তু সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যের অভিনব স্রষ্টা। অভিনব রচনা আঙ্গিকে বাংলা গদ্যে স্থাপনা করেছেন নতুন আভরণ।

বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে বিদেশির অবদানের সার্থক উত্তরাধিকারী তিনি। যে-গদ্য উইলিয়ম্ কেরির হাতে প্রাণ পেয়েছিল তাকেই অনন্য সৃজনশৈলিতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন দ্যতিয়েন সাহেব। বাংলা তাঁর আয়ত্ত করে নেওয়া ভাষা, কিন্তু এই অধিকার-পর্বের মাঝখানে রয়েছে দুই মহাদেশের ভিন্নতা, দুই সংস্কৃতির তফাৎ, দুই ধরনের জীবনবোধের উপলব্ধি। পাশ্চাত্য থেকে প্রতীচ্যে আগমন, ফরাসিয়ানা ভুলে বাঙালি-কৃষ্টির সঙ্গে পরিচয়, সংসার-বিলাস ত্যাগ করে সন্ন্যাস-জীবনে প্রবেশ – ফাদারের জীবনের অনেকগুলো বাঁকবদল। অথচ সব ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর লেখকসত্তা। বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলে তাঁর গতায়াত অনায়াস, স্বচ্ছন্দ।

বাংলায় তাঁর অভ্যাগমন ঘটেছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে। ভারতবর্ষ যখন উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীন জাতীয়তাবাদের পথে শুরু করেছে যাত্রা, সেই সময়েই এদেশে তাঁর আগমন সন্ন্যাসী হিসেবে। জেসুইট সন্ন্যাসীরূপে ধর্মীয় আনুষঙ্গিকতায় আগামীর উদযাপন – এই ছিল জীবনের উদ্দেশ্য। অন্যদিকে তাঁর মনের লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষা শিক্ষার গভীরে অবগাহন। বেলজিয়ামে অবস্থানকালে বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁর যে-পরিচয় ঘটেছিল, তার পরিসীমা ছিল ক্ষুদ্র। বাংলায় আসার পরই পেয়েছিলেন নিবিড়ভাবে বাংলা ভাষাকে জেনে নেওয়ার বিসত্মৃত প্রেক্ষাপট। ‘বাংলা ভাষায় আমার অনুপ্রবেশ শ্রীরামপুরে – কেরি-স্মৃতির ছায়াচ্ছন্ন শ্রীরামপুরে। সবেমাত্র এসেছি দেশ থেকে, কায়রোতে কেনা সোলার টুপিটা ফেলেছি ডাস্টবিনে, ইংরেজি ভাষা ভাল করে শেখার আগেই শিখতে বসেছি বাংলা।’ শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও বাঙালিয়ানার সঙ্গে এতই গভীর ভালোবাসা-বন্ধনী সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে, তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির আপনজন, নিকটজন।

ফাদার পল দ্যতিয়েনের জন্ম বেলজিয়ামের ছোট্ট শহর রশফরে। জন্মসাল ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ এবং তারিখ ৩০ ডিসেম্বর। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যের চারণভূমিতে তাঁর বেড়ে ওঠা। কিন্তু ধর্মপ্রাণ পরিবারের সাহচর্যে তিনি আর পাঁচজন গৃহী মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি, জীবনের সিদ্ধান্তে তিনি হয়ে ওঠেন খ্রিষ্টযাজক। পিতার বাসনা ছিল তাঁর পরিবারের অন্তত একজন যেন যাজকাভিষেকে অভিষিক্ত হন। পল দ্যতিয়েনই সেই পিতৃ-বাসনার মুক্তি ঘটিয়েছিলেন। ‘ভগবানের ডাকে সাড়া দিয়ে’ ঈশ্বরপ্রেমের মাহাত্ম্য বিতরণের উদ্দেশ্যে তাঁকে ছাড়তে হবে দেশ – বেছে নিতে হবে ভারতবর্ষ অথবা আফ্রিকা, যে-কোনো একটি। তিনি ভারতবর্ষের বাংলায় আসার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেন।

তার ঈশ্বরসাধনা, মানবপ্রেমের মধ্য দিয়ে জীবনদর্শন। বাংলায় এসে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সেই মানবপ্রেমেরই এক স্তর, দুই স্তর, বহু স্তর। আরো একটি বিষয়ের প্রতি তাঁর প্রেম ছাত্রাবস্থা থেকেই – ভাষাশিক্ষা। ফরাসি তাঁর মাতৃভাষা, প্রাথমিক বিদ্যাশিক্ষার পর আরো দুটি ধ্রম্নপদী ভাষা গ্রিক ও লাতিন শিখেছিলেন ছবছর। সংস্কৃত ও বাংলা ভাষাশিক্ষা পর্ব যখন শুরু হয়, তখন তিনি স্নাতক স্তরের ছাত্র। সহজ অনুমেয়, যৌবনের গ– অতিক্রম করার পূর্বেই বেশ কয়েকটি ধ্রম্নপদী ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল পোক্ত ধারণাবলয়। স্বদেশে থাকাকালীন তিনি সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বিখ্যাত ভারত দার্শনিক ফাদার পিয়ের জোহান্নকে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ছিটেফোঁটা পরিচয়ের যে-সুযোগ ঘটেছিল, তাও ফাদার জোহান্সের মুখনিঃসৃত কিছু গল্পের ভেতর দিয়ে। দ্যতিয়েন বুঝেছিলেন, শুধু শুকনো বইয়ের পাতা পড়ে বাংলা ভাষার রস ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। ভাষা গভীরভাবে জানতে হলে   কৃষ্টিও জানতে হবে সমান্তরতায়। সে-কারণে বাঙালি সমাজকে জানাও একান্ত প্রয়োজন।

বাংলায় পৌঁছে যথাযথ এবং প্রথাগতভাবে বাংলা ভাষাশিক্ষা শুরু করেন ফাদার পল দ্যতিয়েন। শ্রীরামপুর ক্যাথলিক মিশনের অধ্যক্ষ ফাদার দোঁতেনের কাছেই শুরু তাঁর শিক্ষাগ্রহণ। দোঁতেন সাহেব ছিলেন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার রসজ্ঞ প–ত। একসময় তিনি ‘অকেজো বুড়ো’ ছদ্মনামে বাংলা গদ্য লিখতেন পত্রিকার পাতায়। তাঁর ওপরেই ভার ন্যস্ত হয়েছিল বিদেশাগত সন্ন্যাসীদের বাংলা শেখানোর। এই শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তিনি যে বেশ কড়া মাস্টারমশাই ছিলেন তা ফাদার দ্যতিয়েনের লেখা থেকেই জানা যায়। ডায়েরির ছেঁড়া পাতায় ‘বুড়ো সাহেব’ শিরোনামাঙ্কিত হাস্যরসময় রচনাংশটি তাঁকে নিয়েই লেখা। সেই লেখা থেকে তুলে ধরা যাক নমুনা : ‘খাতায় কোনো ইংরেজি শব্দ লেখাই নিষিদ্ধ। একদিন অনন্যোপায় হয়ে ‘খুকি’ শব্দটির অর্থ লিখেছিলাম : ‘এ লিটল গার্ল’। বুড়ো সাহেব রেগে আগুন। নিজেও অতিষ্ঠ হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম : ‘তবে লিখব কী?’ তিনি বলেছিলেন : ‘খোকার উলটো।’ হায়, আমি যে খোকার অর্থও জানতাম না।’ ফাদার ফালেঁর প্রত্যক্ষ সাহচর্যও ফাদার দ্যতিয়েনের বাংলা শিক্ষাকে দান করেছিল অনেকখানি গভীরতা ও মসৃণতা। তাঁরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে শান্তিভবনে বাস করেছেন।

বাংলা ভাষার প্রতি ফাদার দ্যতিয়েনের আবেগ অনবরুদ্ধ, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আকর্ষণ গভীর। শুধু প্রয়োজনই যদি হত তাঁর এ-ভাষাশিক্ষার মূল কারণ, তবে তা প্রয়োজনকে ছাপিয়ে হয়ে উঠতে পারত না অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক পরিম-লে দশ বছর অতিক্রান্ত করার পর তাঁর জেসুইট সন্ন্যাসীর পরিচয় কতকটা নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, তুলনায় অনেক বেশি মুক্ত হয়ে ওঠে তাঁর লেখকসত্তা বাঙালি সারস্বত সমাজে, বৌদ্ধিক জনমানসে। তাঁর গদ্যের সাবলীল প্রকাশ-ভঙ্গিমায় বিঘ্নিত হন দেশ পত্রিকার কিংবদন্তি সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। সাহেবের লেখা আদায় করে নেয় তাঁর উদারচিত্ত প্রশংসা। সেই প্রশংসা সত্যতা মান যাচাই হয়ে যায় দেশ পত্রিকার পাতায় ফাদার দ্যতিয়েনের লেখা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। তাঁর লেখার অর্গলমুক্ত গতিস্রোতে ছয়ের দশকের দেশ পত্রিকার পাঠককুলের মনেও জাগে প্রশ্ন – ফাদার দ্যতিয়েন কি কোনো বাঙালি লেখকের ছদ্মনাম? এই জিজ্ঞাসাচিহ্নই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর লেখার উচ্চমান নির্ধারকার এক যোগ্যতম মাপকাঠি। এমনই তাঁর সহজাত সৃজনকুশলতা। সাহিত্যক্ষেত্রে আগমনের প্রথম দিনটি থেকেই তিনি প্রথিতযশা, রচনানৈপুণ্যের কারণে।

সাহিত্যিক হিসেবে ফাদার দ্যতিয়েনের আবির্ভাব ডায়েরির ছেঁড়া পাতায়; দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ দুকিস্তিতে, ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। যদিও তাঁর প্রথম মুদ্রিত লেখা ‘লেখকের লেখনী’ শিরোনামাঙ্কিত। অস্বাক্ষরিত এ-লেখাটি মুদ্রিত হয় খ্রিষ্টান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মুখপত্র আমাদের জীবনে। পরে এই লেখাটি লালপেড়ে গল্পাবলিতে (২০১৫) সংকলিত হয়েছে। রোজনামচা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। ১৯৭৮ সালে তাঁর বেলজিয়ামে প্রত্যাবর্তনের কারণে কিছুটা সময় বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে আসে সাময়িক বিচ্ছেদ। আটপৌরে দিনপঞ্জি (২০১৩) রচনার মধ্য দিয়ে সেই খরা কাটিয়ে পুনরায় বাংলা-সাহিত্যভূমিকে করেছেন সুফলা। সাহিত্য-সৃষ্টির সফলতাস্বরূপ পেয়েছেন সহৃদয় পাঠকের আনন্দময় অনুভূতি এবং স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৩ সালে নরসিংহদাস পুরস্কার এবং ২০১০-এ রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেছেন।

ফাদার দ্যতিয়েনের প্রতিটি গ্রন্থের নামকরণই বুঝিয়ে দেয় এগুলো দিনলিপি বা দিনালেখ্য জাতীয় রচনা – ডায়েরির ছেঁড়া পাতা, রোজনামচা, আটপৌরে দিনপঞ্জি। কিন্তু সাল-তারিখের উল্লেখসহ  কালানুক্রমিকতা যেভাবে দিনলিপি বা ডায়েরির (diary) মধ্যে বজায় থাকে, দ্যতিয়েন সাহেবের রচনা এই বৈশিষ্ট্যমুক্ত। অর্থাৎ প্রথামাফিক ছকে বাঁধা ডায়েরির আঙ্গিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না তাঁর গদ্যসম্ভারকে। তাঁর গদ্য তাঁর অভিজ্ঞতারাজির মসিলিখিত রূপ। এই অভিজ্ঞতার রূপ প্রকাশে তিনি অনেক বেশি স্বাধীন। ডায়েরির রচয়িতা তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ, খোলামেলা। তাঁর উপলব্ধি থেকে মানসজগতের উন্মোচন সবটাতেই তিনি অকপট। ডায়েরিও যখন সুবিন্যস্ত চিন্তায়, সৃষ্টিশীল শৈলী সমন্বয়ে লিখিত হয়, তখন তা ব্যক্তিগত স্তর অতিক্রম করে উন্নীত হয় সাহিত্যের পর্যায়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি, স্মৃতির রেখা, তৃণাঙ্কুর প্রভৃতি ডায়েরিধর্মী রচনার কথা। ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্যগুলো মুখ্যত ডায়েরির ছেঁড়া পাতাআটপৌরে দিনপঞ্জির রচনাগুলোর সঙ্গে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে ডায়েরির মিল থাকলেও অধিক সাযুজ্য জার্নালের সঙ্গে। জার্নালে দৈনন্দিন ঘটনাস্রোতের তুলনায় লেখকের মননশীল স্বচিন্তনের প্রভাব পরিলক্ষেত হয় গভীরভাবে। দ্যতিয়েন সাহেবের লেখাগুলোর মধ্যে আছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক বিবরণ। তবে এই ধারাবাহিকতা সময়কেন্দ্রিক নয়। সঙ্গে তাঁর পা–ত্যসুলভ বিশ্লেষণী ক্ষমতা, ঋদ্ধ ভাবনা, নিবিষ্ট প্রেক্ষাশক্তি রচনাকে দান করেছে উচ্চমার্গীয় সাহিত্যের মর্যাদা।

মৌলিক সাহিত্যসৃজনের পাশাপাশি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ সম্পাদনার কাজেও তাঁর মনীষার দীপ্ত প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ দুটি : একটি হলো উইলিয়ম্ কেরির ইতিহাসমালা ও অপরটি হলো গদ্যপরম্পরাইতিহাসমালার সম্পাদনা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাংলা গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশের যুগের গ্রন্থ হিসেবে ইতিহাসমালার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ১৮১২ সালে মুদ্রিত হওয়া বইটির সম্পাদনার কাজ ছিল বেশ পরিশ্রম ও আয়াসসাধ্য। গদ্যপরম্পরা বাংলা গদ্যের সংকলন। ৪৮৫ জন সাহিত্যিকের গদ্যরচনার এক পৃষ্ঠা করে সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিষয়ে ফাদার দ্যতিয়েনের জ্ঞানের জগৎ যে বৃহৎ ছিল, এ-গ্রন্থই তা প্রমাণ করে।

দ্যতিয়েনের সম্পাদনায় উইলিয়ম্ কেরির ইতিহাসমালা প্রকাশিত হয় ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে। বইটি প্রথম মুদ্রিত হয় তার ১৬০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে। বইটি সে-সময়ে পাঠকমহলে প্রচারিত হওয়ার বিশেষ সুযোগই লাভ করেনি। কেননা ওই বছরেরই (১৮১২ খ্রিষ্টাব্দ) মার্চ মাসে অগ্নিকা–র দরুন বইয়ের পুরো স্টকই ভস্মীভূত হয়ে যায়। গোঁড়ামির কারণে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা ইচ্ছা করেই এই বইটি আগুনে নিক্ষিপ্ত করেছিলেন, এমন সম্ভাবনাও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ফাদার দ্যতিয়েনের কথায় কেরির সংকলিত এগারোটি গল্পে হিন্দু দেবতার উল্লেখ, পাশাপাশি বিনা দ্বিধায় আরবিনা, পূজা, ভগবান, দৈব, কর্মফল প্রভৃতি হিন্দুত্ববাদী শব্দের অধিগ্রহণ ওপরতলার খ্রিষ্টান মিশনারিদের অপছন্দের বিষয় ছিল। একজন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকের অহেতুক হিন্দুয়ানির প্রতি অধিক আকর্ষণ অপরাধেরই শামিল হয়ে উঠেছিল তাঁদের চোখে। সেই অপরাধের মাসুলই ইতিহাসমালা বিনষ্টের মধ্য দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছিল কেরি সাহেবকে। ইতিহাসমালার বিনাশকাণ্ডের সম্ভাবনার একটা দিক এভাবেই সাহিত্য-চিন্তকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন ফাদার পল দ্যতিয়েন।

ইতিহাসমালা বইটির ধ্বংসত্বপ্রাপ্তির কারণেই বাঙালির সাহিত্য মানসের কাছে এ-বইটির অস্তিত্ব ছিল অজ্ঞাত। দ্যতিয়েন সাহেবকেও নিরলস পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে উদ্ধার করতে হয়েছে এই সংকলন। অনুসন্ধানের ইতিহাস তাঁর রচনা থেকেই উদ্ধৃত করা গেল : ‘আসল কথা এই যে, কেরি সাহেবের রচনার এক নমুনা খুঁজতে গিয়ে ইতিহাসমালার সাংঘাতিকভাবে বল্মীকাক্রান্ত এক কপি চোখে পড়ল। পাঠ করতে শুরু করলাম। বেশ বেগ পেতে হয়েছে : একে তো অনেক দিনের বই, তাতে আবার ছাঁকনির মতো ফুটো-ভরা’ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে পাওয়া (মাত্র দুটি লাইব্রেরিতে এই বইয়ের কপি সংরক্ষিত ছিল – বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও ন্যাশনাল লাইব্রেরি।) উইপোকা দংশনে জীর্ণ ইতিহাসমালার সম্পাদনা কাজে তিনি যে উৎকর্ষের ছাপ রেখেছেন তা একজন যথার্থ সম্পাদকের কাজের নিদর্শন। আবেগহীন যুক্তিপরম্পরায় গ্রন্থের বিবরণ, ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে তিনি যে আলোচনা করেছেন, তা বহুস্তরীয়। একজন সাহেবের সংকলিত রচনা, সর্বোপরি বাংলা গদ্যের সৃষ্টিপর্বকালীন ভাষার দুরূহতা, ব্যাকরণের জটিলতায় গ্রন্থশরীর সহজবোধ্য, স্বচ্ছন্দ নয়। ব্যাকরণের আলোচনায় আলাদাভাবে বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয়, ক্রিয়াপদের ব্যবহার, বাক্যবিন্যাস নিয়ে তাঁর পা–ত্যলব্ধ আলোচনা গ্রন্থ সম্পাদনাকে করেছে উৎকৃষ্ট। এমনকি গল্পের কুশীলব, গল্পের উৎস বিষয়ের উপস্থাপন সম্পূর্ণ করেছে তাঁর আলোচনার বৃত্তকে। তাঁর নিখুঁত দৃষ্টিপথ এড়িয়ে যায়নি গ্রন্থের মুদ্রণপ্রমাদও।

দ্যতিয়েন সাহেবের বিচক্ষণতার কারণেই ইতিহাসমালা চিরকালের জন্য অপসৃত হয়ে যায়নি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে। ড. সুকুমার সেন এই গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। ফাদার দ্যতিয়েনকৃত ইতিহাসমালার সম্পাদনা একদিকে যেমন তাঁর বাংলা সাহিত্যের গভীরতার প্রতি বৌদ্ধিক প্রকাশ, অন্যদিকে পূর্বসূরির সাহিত্যকৃতির প্রতি সম্মাননা প্রদর্শন।

তাঁর সম্পাদিত গদ্যপরম্পরা গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ। গ্রন্থটির পরিকল্পনা-ভাবনা অভিনব। শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠ গল্প প্রভৃতি সংকলনের সঙ্গে আমরা অধিক পরিচিত। তবে একজন গদ্যকারের শ্রেষ্ঠ একপাতা গদ্যরচনার সংকলনের সঙ্গে বাংলা সাহিত্য পাঠকের বিশেষ আলাপ নেই। ৪৮৫ জন বাংলা গদ্যকারের রচনার ‘শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠা’ গ্রহণ করেই সম্পাদনা করেছেন গদ্যপরম্পরা। রচনার শ্রেষ্ঠত্ব নির্বাচনের দায়ভারটুকু সম্পাদকের। তবে সেই নির্বাচনের মধ্যে যে-কোনো প্রকার অসংলগ্নতা নেই, তা গ্রন্থপাঠেই প্রমাণিত। গ্রন্থমধ্যে গদ্যসজ্জার ক্ষেত্রে রক্ষিত হয়েছে ক্রমিক ধারাবিন্যাস। মানোয়েল দ্য আসসুম্প্সাঁও, উইলিয়ম্ কেরি, উইলিয়াম্ ইয়েট্স, ফেলিক্স কেরি প্রমুখ সাহেবের বাংলা গদ্যের নমুনাও সংযোজিত করেছেন সম্পাদক। এই গ্রন্থে সংকলিত গদ্যগুলো যে সময়পর্বকে নির্দেশ করেছে তা বাংলাগদ্যের উন্মেষপর্বের কাল থেকে বিশ শতকের সাতের দশক পর্যন্ত। সম্পাদকের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন রচনাসজ্জার পন্থা : ‘রচনাগুলি ক্রমবিন্যাস করা হয়েছে সর্বপ্রথম প্রকাশের তারিখের ভিত্তিতে। সেই তারিখটি জানা না থাকলে পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশের কালটিকেই গণ্য করা হয়েছে। সেটাও না জানতে পারলে সঙ্কলয়িতা আনুমানিক প্রকাশকাল অবলম্বন করেছে।’ পাঠককে অবহিত করার লক্ষ্যে রচনাগুলো সম্পর্কে উপস্থাপিত করেছেন বহুবিধ তথ্য – কতজন লেখিকা আছেন, ঠাকুরবাড়ির কতজনের লেখা সংকলিত হয়েছে, সাধু ও চলিত ভাষায় লেখা পৃষ্ঠা কতগুলো গৃহীত হয়েছে, কতগুলো নাটক ও রম্যরচনার পৃষ্ঠা গ্রহণ করা হয়েছে ইত্যাদি। তাঁর এই নিবিষ্ট তথ্য উপস্থাপনার পেছনে গবেষকের দায়িত্ব যেমন মিশে আছে, তেমনি অন্তর্লীন হয়ে আছে একজন পরিপাটি গ্রন্থ-সম্পাদকের যত্নশীল সম্পাদনার ছাপ।

শুধু গ্রন্থ-সম্পাদনা নয়, পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়েও তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার সারস্বত সমাজের বিশিষ্টজন। সম্পূর্ণ ভিনদেশি একটি ভাষা আয়ত্ত করার দশ বছরের মধ্যে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ তাঁর জীবনে ধৈর্যের সঙ্গে যুক্ত করে সাহসিকতা শব্দটিকেও। খ্রিষ্টীয় সমাজের মুখপত্র আমাদের জীবন পত্রিকার দায়িত্বভার তিনি গ্রহণ করেন ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই সংখ্যা থেকে। বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মুখপত্র হওয়ার দরুন পত্রিকায় ধর্মীয় আবহ সঞ্চারিত ছিল প্রগাঢ়ভাবে। সম্পাদক হিসেবে তিনি বুঝেছিলেন সম্পাদনার খোলনলচে বদলে নিতে না পারলে ধর্মীয় বাতাবরণ থেকে পত্রিকাকে মুক্ত করা যাবে না। তাঁর হাত ধরেই এই পত্রিকার দেহে সাহিত্যরসের সঞ্চার এবং এই পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়েই তাঁর সম্পাদক-সত্তার বিকাশ একইসঙ্গে সাহিত্যবোধের উন্মীলন।

আঙ্গিক বিন্যাসের প্রতি ঐকান্তিক মনোযোগ, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সৃষ্টিশীল ভাবুক-সত্তা – ত্রিগুণ সমন্বয়ের কারণে তিনি সার্থক সম্পাদক। বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পত্রিকা হওয়ায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে পারেননি, সে-প্রয়াস তাঁরও চেতনাগত ছিল না। তবে সাহিত্যঘেঁষা করে তোলার যে-প্রচেষ্টা, তাতে সাহিত্যরস উচ্চস্তরীয় তো হয়েই ছিল, পাশাপাশি ধর্মীয় কাহিনিগুলোও একঘেয়েমির জাল ছিন্ন করে হয়ে উঠেছিল সুখপাঠ্য। নিজের পরিশীলিত রুচি ও বোধের জায়গা থেকে তিনি পত্রিকায় সংযোজিত করেন পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখসহ সূচিপত্র, যা পূর্বপ্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে নজরে পড়ে না। পূর্বগামীদের মতো ধর্মীয় মনোভাব তাঁর চিন্তাধারাকে একপেশে করে দেয়নি বলেই তিনি পত্রিকার নাম আমাদের জীবন বদলে রেখেছিলেন জীবন। তাঁর নিজের কথায় : ‘ষোড়শ পৃষ্ঠার পারিবারিক ওই পত্রটি প্রতি মাসে বেরুত। ওর আদি আখ্যা ছিল ‘আমাদের জীবন’। গ্রাহকসংখ্যায় বৃদ্ধিসাধন – অভিলাষে আমি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে, ওর নামান্তর করেছিলাম : ‘জীবন’। (এখানে একটা বিষয় উল্লেখনীয়, ফাদার দ্যতিয়েন পত্রিকার নাম পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করলেও লাইব্রেরিতে পত্রিকাগুলো দেখার সময় নজরে আসে পত্রিকার প্রচ্ছদপটে মুদ্রিত রয়েছে ‘আমাদের জীবন’ নামটি। অবশ্য ‘আমাদের’ শব্দটি ‘জীবন’ শব্দের তুলনায় অনেকখানি ক্ষুদ্র হরফে লেখা, যেটা পূর্বে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে দেখা যায় না।)

দ্যতিয়েন সাহেব যখন নিজের সম্পাদিত পত্রিকায় লিখছেন, পাশাপাশি লিখছেন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। সে-কারণেই বেশ কিছু কাহিনি দুই পত্রিকাতেই প্রকাশিত, ভিন্নতা শুধু শিরোনামে বা চরিত্রদের নামকরণে। ডায়েরির ছেঁড়া পাতার একাদশতম অধ্যায়ে ‘কুশালের কাহিনি’ যেটা পাঠকদের শোনান, সেই একই কাহিনি ‘কৈশোর’ নামে প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার পাতায়। টুটুর কাহিনিও প্রকাশিত হয়েছে উভয় পত্রিকাতেই। দেশ পত্রিকার ‘বাবুল সরকারে’ বর্ণিত গল্পের সঙ্গে কোনো তফাৎ নেই জীবনে (আমাদের জীবন) প্রকাশিত ‘পদার্পণ’ গল্পের। আরো অনেক রচনা রয়েছে, যেগুলো তিনি দেশ পত্রিকায় লিখেছেন স্বনামে, আর ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মুখপত্রে লিখেছেন ছদ্মনামে। উৎপল দত্ত রায়, কমল বসু, ইন্দ্রনাথ দত্ত, ফাদার দে, ফাদার যতীন পাল, প্রভাতী দে – একাধিক ছদ্মনাম ফাদার দ্যতিয়েনের।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই সংখ্যা থেকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর সংখ্যা পর্যন্ত একটানা সম্পাদক তিনি। এরপর কিছু বিক্ষিপ্ত উপস্থিতি – কখনো যুগ্ম-সম্পাদক, কখনো সম্পাদকম-লীতে। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে আলাপ নামক এক পত্রিকার প্রথম সংকলন প্রকাশ করেন তিনি। বিভিন্ন স্কুলের উৎসাহী ছাত্রছাত্রীদের রচনা নিয়েই এ-সংকলন। প্রকাশের পেছনে অনুরোধ ছিল ডাফ স্কুলের দিদিমণিদের আর তিনি উৎসাহ পেয়েছিলেন দুজন মহান ব্যক্তিত্বের – অন্নদাশঙ্কর রায় ও সত্যজিৎ রায়। পত্রিকাটি সম্পর্কে লেখকের নিজেরই একটি বক্তব্য : ‘প্রথম সংকলনটিতে ছত্রিশটি বিদ্যালয়ের নববই জন ছাত্রছাত্রীদের রচনা স্থান পায়। সাত হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল, বিক্রিও অনুরূপ।’এ-পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে ফাদার দ্যতিয়েন অনেক বেশি স্বাধীন ছিলেন এবং এ-পত্রিকা ছিল সর্বতোভাবেই সাহিত্যবোধ সমন্বিত এক পত্রিকা। সম্পাদকসত্তার পাশাপাশি তাঁর অনুবাদকসত্তাও উজ্জ্বল। ফরাসি সাহিত্যের বিখ্যাত কিশোর-গ্রন্থ আঁতোয়ান্ দ্য স্যাঁতেকসুপেরির লেখা ল্য প্যতি প্রাঁস বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর সম্পাদনাকালে জীবন (আমাদের জীবন) পত্রিকায় এই অনুবাদ ‘ছোট রাজকুমার’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে নভেম্বর সংখ্যা পর্যন্ত। এই অনুবাদ ভাবানুবাদ। মির্চা এলিয়াদের লেখা লা নুই বেঙ্গলি বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলার রাত নামে। অনুবাদেও তাঁর শব্দ নির্বাচন ঝরঝরে, আড়ষ্টতামুক্ত; বাক্যবিন্যাস নির্ভার, স্বচ্ছন্দ, হৃদয়গ্রাহী। সম্পাদনা, অনুবাদকর্ম – এ সবই যেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর বহুমুখী আবর্তন।

ফাদার পল দ্যতিয়েন মুখ্যত গদ্যকার। তাঁর গদ্যের বিনুনির ফাঁকে-ফাঁকে অন্তর্লীন হয়ে আছে ছন্দ, যাকে তিনি নিজেই অভিহিত করেছেন ‘গদ্যছন্দ’ নামে। আসলে তাঁর লিখনশৈলীর ধারায় যথোপযুক্ত শব্দের যথাযথ প্রতিস্থাপন হয়ে উঠেছে রচনার ঠাস বুননের কারণ। ক্রমশ ছন্দোময় গতিতে অগ্রগতি ঘটেছে গদ্যের। তাতেই ছন্দোসুলভ এক গতিময়তা এসেছে গদ্যশরীরে। প্রাত্যহিক জীবনের ছবি অক্ষরে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন গদ্যের বাক্-প্রতিমা। প্রথম যখন তিনি বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিকল্পে কলম তুলে নিয়েছিলেন, তখন তাঁর ভাষার প্রাঞ্জলতায় পাঠককুলের অনুভূতি হয়েছিল, তিনি কোনো বাঙালি লেখক। অনেকের মনেই এ-ধারণা জন্ম নিয়েছিল, হয়তো পরশুরাম বা সৈয়দ মুজতবা আলী নতুন কোনো ছন্দনামের আড়ালে কলম চালাচ্ছেন। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’ পাঠ করে সমালোচককুল তাঁর রচনাশৈলী সম্পর্কে যে মতামত জ্ঞাপন করেছিলেন তা নিজেই উদ্ধৃত করেছেন : ‘আমার স্টাইল নাকি দু’আনা ফরাসি, দু’আনা বাংলা আর পঁচাত্তর নয়া পয়সা (পৈসে) সম্পূর্ণ নিজস্ব।’

তাঁর সৃষ্টিকাল বাংলা গদ্যসাহিত্যের এক অত্যুজ্জ্বল পর্ব। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখনীর মুখে। বাংলা তাঁর হৃদয়ানুভূতির ভাষা, তাই অন্তর-উপলব্ধির প্রকাশে তিনি বাধাহীন। স্বসৃষ্ট গদ্যের ঝংকার তাঁর নিজের কানেই মধুর শোনায়, স্মরণে রাখেন বুদ্ধদেব বসুর উক্তি : ‘Trust your ear’। এই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিস্থাপনেই বাংলা গদ্যসাহিত্যকে, দিনালেখ্যধর্মী রচনা আঙ্গিককে, রম্যরচনাকে নতুনতর মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর রচনার প্রতি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য সার্থক ও যথাযথ : ‘What I admire very much is your command over all styles of Bengali, including mussal-mani Bengali.’

ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্য আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে বিস্ময়ে। ভাবতে অবাক লাগে এমন মাধুর্যময় গদ্যের সৃজক জন্মসূত্রে অ-বাঙালি, অ-ভারতীয়, পাশ্চাত্যের অধিবাসী। বাংলা ভাষার ওপর তাঁর অনায়াস দখল, অনুপম শব্দের ভাণ্ডার তাঁর করতলগত। স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বাক্যের ব্যবহার তাঁর উচ্চস্তরীয় বোধ ও পা–ত্য তুলে ধরে। তাঁর সৃষ্ট গদ্য তাঁর নিবিড় সাহিত্য তপশ্চর্যার ফসল। জীবন রসবোধের মাত্রা অনেকখানি উচ্চস্তরীয় হলে তবেই তা ধরা পড়ে কালির আঁচড়ে। দ্যতিয়েন সাহেবের লেখায় পাঠকের নিবিষ্টচিত্ত হওয়ার মূল কারণই হলো বুদ্ধি ও বোধের পরশলাগা রসপ্রিয়তা। বলার সামান্য বিষয়েরই অন্তরালে ফল্গুধারার মতো প্রবহমান বলার ভঙ্গিমা ও শব্দ নির্বাচনের কৌশলগত প্রয়াস। প্রেমেন্দ্র মিত্রর রচনাতেও অনুপম সৌন্দর্যের মূলে রয়ে যায় শব্দ ও বাক্যসজ্জার মাধুর্য। উপস্থাপনরীতির অনন্যতার কারণেই তাঁর গল্প হিলেস্নাল তোলে সুধী পাঠকের হৃদয়ে। দিনালেখ্যের রচয়িতা ফাদার দ্যতিয়েনও তাঁর মরমি গদ্যের সরস প্রকাশে তুলে ধরেন পরম রমণীয়তা। প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর রম্যরচনা হয়ে ওঠে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জীবনরসবোধের যুগলবন্দি।

বাঙালির সঙ্গে তাঁর মানসবন্ধন স্থাপিত হয়েছে সাহিত্য-সৃষ্টির ভেতর দিয়ে। বাংলা ভাষাকে আপন করে নেওয়া ছিল তাঁর অভিলষিত বিষয়। যে মুন্শিয়ানায় তিনি বাংলা সাহিত্যের অভিনব শৈলী সৃষ্টিকারী সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন, সেখানে অধ্যবসায়ের সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত হয়ে যায় অন্তরের ইচ্ছা। হৃদয়-নিঃসৃত ভালোবাসা না থাকলে সৃষ্টিতে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় না প্রাণ। বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কারণেই তিনি বাংলা ভাষাকে বরণ করে নেন অন্তরের ভাষারূপে। সেই ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখকসত্তায়। তিনি হয়ে উঠেছেন সাহিত্যিক, ‘বাঙালি’ সাহিত্যিক।

 

উল্লেখপঞ্জি

১.   ফাদার দ্যতিয়েন, ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’, গদ্যসংগ্রহ, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১২, পৃ ২৯৩।

২.   তদেব, পৃ ২৯৬-৯৭।

৩. ফাদার দ্যতিয়েন, গদ্যসংগ্রহ, পৃ ৬২৭।

৪.   ফাদার দ্যতিয়েন (সম্পা.), গদ্যপরম্পরা, ভূমিকা, কলকাতা, গাঙচিল, ২০১০।

৫.   ফাদার দ্যতিয়েন, আটপৌরে দিনপঞ্জি, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৩, পৃ ৭৪।

৬. তদেব, পৃ ৯।

৭.   ফাদার দ্যতিয়েন, ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’, গদ্যসংগ্রহ, পৃ ৮।

৮. চিন্ময় গুহ, আয়না ভাঙতে ভাঙতে, কলকাতা, গাঙচিল, ২০১১, পৃ ৩৮।

৯. ফাদার দ্যতিয়েন, গদ্যসংগ্রহ, পৃ ৬৩২। 