তলু ব্যাপারি যখন ১টা গাই আর ২টা বকরির দড়ি হাতে হেঁটে যাচ্ছিল দ্রুত তখনও সব ঠিক-ঠাক ছিল। বৃষ্টি তো শুরু হলো তারও ১০ কী ১৫ মিনিটি পরে। আজমত আলী একবার ভেবেছিল তলু ব্যাপারির পিছু পিছু যাবে, কিন্তু পেরে ওঠে নি। কারণ ব্যাপারি হাঁটে দ্রুত; এখান থেকে ৮/১০ মাইল দূরে বায়রা হাট;সে-ই হাট থেকে গাই আর বকরি কিনে এনেছে; দ্রুত না-হাটলে কী এশার ওক্ত পার হতে-না-হতে পৌছুতে পারত? গাইটা দেখতে সুন্দর সিন্দুরে লাল; চাঁদির ওপর শাদা ছোপ, তাছাড়া তিন মাসের গাভিন। ব্যাপারি গাই পেয়ে মহাখুশি। বলে, বিক্রি করবে না, নিজেই পালবে। আজমত আলীও তাকে বলে দিয়েছে, -পালো। জোগালপাতি কইর‌্যা গোয়ালে রাখ। আল্লায় বরকত দিব। গাই পাললে লুকশান নাই। এই কথা বলার পর আজমত আলীর হাঁটার বেগ কমে, একটু হেঁটেই সে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিল। -চাচা দোয়া কইরেন বলে তলু ব্যাপারি খুচরা কথার প্যানপ্যানানি রেখে চলে যাবার পর আজমত আলী ভাবে, -নাহ! ব্যাপারি মানুষের সাথে হাঁটা মুস্কিল, এদের পা চলে বেশি। তাই সে আস্তে আস্তে হাঁটা আরম্ভ করে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে তাকে দাঁড় করিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলবে। কী যে যুগ পড়েছে, বুড়া মানুষের সাথে কেউ কথা বলতেই চায় না! কারো সাথে দুদণ্ড কথা বলতে চাইলে তারা নানান কাজের বাহানা দেখায়! অথচ তার মনে কত কথা! তাই মাঝে মধ্যে সে নিজেই নিজের সাথে কথা বলে।

-ও কাকু! আইয়েন চা খাই যান। রাস্তার ওপারে ঘণ্টি দোকান থেকে আছালত মোল্লার বড় ছেলে আব্দুর রব মোল্লার ডাক শুনে আজমত আলী সপ্রতিভ হলেও তার খেয়াল হয়, পকেটে টাকা নাই; চা-পান খাবে কেমন করে? বাকি খাবে, এ-কথা ভাবতেই তার মনে পড়ে বড় ছেলের বউ আছিমনের কথা। শ্বশুরের পয়সা  খরচ নিয়ে ২/৪ দিন পর পর আজমত আলীর বড় ছেলে জব্বারের কাছে এই আছিমন নাতিদীর্ঘ নালিশ পেশ করে। কিন্তু পানের নেশায় তার জিহ্বার আনাচে-কানাচে তোলপাড় শুরু হলে আছিমনের নালিশনামা উপেক্ষা করে সে রব মোল্লার দোকান অভিমুখে ধাবিত হয়।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে কত মানুষ তাকে ছেড়ে গেল, কত মানুষের সংস্পর্শ ত্যাগ করল সে নিজেও, কিন্তু ১ কাপ কড়া চা পান করার পর বাবা জর্দ্দা মেশানো পান খাওয়ার প্রতি যে দুর্নিবার টান সেটা গেল না। এই পানের জন্য আজমত আলীর ভোগান্তিও কম পোহাতে হয় না। মানুষ তো ভাবে আজমত আলীর টাকা পয়সার অভাব নাই, কারণ তার ছোট ছেলে ডিভির বদৌলতে আমেরিকা প্রবাসী, অপর ছেলে জব্বার সাভার নামা বাজারে ভূসি-কুড়ার দোকান করে; তাতে তার কী, ছেলেদের হাতের ফাঁক-ফোকর গড়িয়ে একটা কানাপাইও যদি তার হাতে পড়ত!

আমেরিকা গেছে সুলতান, তা আমেরিকা যাক লন্ডন যাক আর দুবাই যাক বুড়া বাপটার কথা তো কোনোদিন মনে করে না! কোনোদিনও তো চিঠিপত্র কিংবা -হ্যালো বলে বাপের খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবে না? অথচ এই ছেলের জন্য সে কী কম করেছে? জোগালপাতি করে বড় করার কথা নাই-বা ধরলাম; কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সে কী কাণ্ডটাই না করল! ছি! ভাবতে গেলে আজো ঘেন্না করে। নিজের ছেলে বলে কী হবে, সে তো ভালো কাজ করেনাই। হেরমতুল্লার মেয়ের সঙ্গে পিরিত করে প্যাট বাধাইল;  তারপর সে-কথাটা অস্বীকারও করল কত সুন্দরভাবে! তা নিয়ে কত সালিশ, কত মামলা-মকদ্দমা; তখন যদি এই আজমত আলী জমি বিক্রি করে মামলার টাকা জোগাড় করে না-দিত তাহলে এখনো জেলের মধ্যেই পচতে হতো, আমরিকা আর যাওয়া হতো না। হেরমতুল্লার সেই মেয়ে পেটের সন্তানসহ মরল বিষ খেয়ে। এখনো মাঝে মধ্যে আজমত আলীর মনে হয়, সুলতান যদি হাফেজাকে বিয়ে করে ঘরে আনত তবে সে আজ নাতির মুখে দাদা ডাক শুনতে পেত। ওদিকে জব্বারের বউ একে তো বাঞ্জা তার উপর খোদাতালার প্রতি কোনো ভক্তি নাই। হায় রে! এ-জীবনে তার বুঝি দাদা ডাক শোনা হবে না!

চা-পান খাওয়ার পর টাকা নাই জেনেও বিল পরিশোধ করার ভঙ্গি করে আজমত আলী পকেট হাতড়ায়। পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে টাটকা একটা মিথ্যা কথা বানায়। বলে, -ট্যাকা মনে অয় পইড়্যা গেল, পাইতেছি ন্যা যে!

আব্দুর রব তাকে এই ঘোর বিপদের হাত থেকে খালাশ করে, -আইচ্ছ্যা, কাইল দিয়েন বলে আসল কথা পাড়ে, -চাচা! সুলতান ভাইর খবরাখবর কী?

নাফরমান ছেলের কথা শুনে আজমত আলীর চোখ জোড়া কেমন ছলছল করে ওঠে, -আর খবর! শোনো রব মোল্লা। জীবনের কাছে তুমি যা চাইবা, তা কোনোদিন পাইবা না। জীবন বড় জটিল। ভালো থাইকো। যাইগা!

 

রব মোল্লা কেটলিতে নতুন চায়ের পানি দিতে দিতে ধীর লয়ে হেঁটে যাওয়া আজমত আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। চাচার মাথায় আশ্বিনের শাদা মেঘের পুচ্ছের মতো ছাকরা ছাকরা চুল; পরনে ঘিয়ে রঙের ছেঁড়া-ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে প্লাস্টিকের কালো জুতা। শালার এই লোকটাকে দেখে কে বলবে তার ছেলে  আমরিকা থাকে? আব্দুর রব ভালো করে চেয়ে দেখে, আজমত আলীর ছাকরা ছাকরা শাদা চুল রাতের অন্ধকারকেও হার মানানোর জো করে ফেলেছে। আকাশে গুড়–ম গুড়–ম করছে মেঘ; এখনই বুঝি বৃষ্টি নেমে পড়বে অথচ লোকটা হাঁটছে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে! লোকটার শীর্ণ দেহ তো বাউকুড়ানির বাতাসেই পড়ে যেতে বাধ্য অথচ ঝড়-বৃষ্টির প্রতি তার কোনো ভ্রƒক্ষেপই নাই। লোকটার আজ কী হলো!

বৃষ্টি শুরু হলো জোরে। আজতম আলী তখন আর কী করবে, কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাঁটার পর সোমনাথ সাহার ভাঙা বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিল। এ বাড়িতে লোকজন থাকে না। জমিদার আমলের বাড়ি। বসবাসের অযোগ্য তাই পৌর কর্তৃপক্ষ -বসবাস নিষিদ্ধ সাইন বোর্ড ঝুলিয়েছে ছাদ বরাবর।

 

ততক্ষণে তার শাদা চুল আর মুখজড়ানো বাছাপাটের আঁশের মতো নরম দাড়ি ভিজে একাকার। তখনো বিদ্যুৎ যায় নি, বৃষ্টির ছাঁট লাগছে তার গায়ে, দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালে দেখতে পায় ভাঙা দেয়ালের ফাঁকে নিশ্চুপ শুয়ে আছে কালো একটা সাপ। ভাগ্য ভালো চোখে পড়েছিল, আর একটু হলে সাপের ছোবল খেতে হতো। সে ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে যায়। এরইমধ্যে লুঙ্গি ভেদ করে বৃষ্টির পানি তার কোচদাদ ছুঁয়েছে। সুতরাং এবার অন্তত ৫ মিনিট একটানা চুলকাওÑ তা না-হলে কোচদাদের জ্বালায় সে একেবারে পাগল হয়ে যাবে। একদিকে সাপের ভয় অন্যদিকে কোচদাদের ক্যাঁটক্যাঁট কামড়ে,Ñ সে পুরোপুরি অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু কোচদাদের জ্বালাপোড়া যতই থাক সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নাই। কারণ তার জানটা এখন হাতের মুঠোয়। একটু নড়াচড়া করলেই সাপে ছোবল মারবে। এমন সময় ধড়াম করে বিদ্যুৎ চলে গেলে আজমত আলী তুমুল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে।

 

প্রথমে দৌড়ায় তারপর কালাবুড়ির বাড়ির সামনে বিশাল আম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তার কোনো লাভই হয় না। কারণ যখন সে সোমনাথ সাহার ভাঙা বাড়িতে ঢোকে তখনো রিকশা-টিকশা ২/১টা ছিল, কিন্তু এখন তাও নাই। এ অবস্থায় সে বাড়ি যাবে কেমন করে!

 

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আজমত আলী দাদ চুলকায়। চুলকাতে চুলকাতে ভাবে, সুলতানের মা তো আবার সাঁঝবেলাতেই ঘুমিয়ে পড়বে। যখন সে গুটি গুটি পায়ে ঘরে প্রবেশ করবে, পাঞ্জাবি-টাঞ্জাবি খুলবে, তখন চট করে শেহেরজানের ঘুম ভেঙে যাবে। তখন একচোট গালি-গালাজ তাকে খেতেই হবে। তা না হয় খেল, কিন্তু আর একটা লুঙ্গি পাবে কোথায়? আজ কী তাহলে গামছা পরেই ঘুমাতে হবে? তার তো আবার শোয়া-টোয়া বদখৎ। এ নিয়ে শেহেরজান গালাগালি কম করে নাই; কিন্তু খাছলৎ যেমন মরলেও যায় না, তেমনি তার এই রোগটাও সারবার নয়।

দূর ছাই! সে এসব কী ভাবছে? সুলতানের মা আসবে কোত্থেকে? শেহেরজান? তো মারা গেছে আজ থেকে ২০/২২ বছর আগে। তার হাড়গোড়ও মাটির সাথে মিশে গেছে।

তা হঠাৎ মৃত স্ত্রীর কথা মনে পড়ায় আজমত আলী কোচদাদ চুলকাতে চুলকাতে নিকষ-কালো এই পানসে অন্ধকারের অলিগলি পথে স্মৃতিজীবী মানুষের মতো প্রায় ভুলে যেতে বসা অতীত জীবনের খুচরা স্মৃতি জোড়াতালি দিয়ে যতই দেখবার চেষ্টা করে শালার বৃষ্টির ছাঁট ততই তা ভেঙে দেয়।

 

শেহেরজানের কথা কতদিন মনে পড়ে না তা সে হলফ করে বলতেও পারবে না। আজ হঠৎ এই ঘোরলাগা রাতে সুলতানের মা এল! আজমত আলী সবকিছু ডিঙিয়ে শেহেরজানের দিকে যাওয়ার পাঁয়তারা করে। তাকে এখন বেঁধে রাখে কে? ঘোরলাগা রাত তো পুরুষের জন্য কামনার রাত। আচ্ছা, তার বাসররাত কী ঘোরলাগা ছিল না? ছিল। ২/৩ দিন আগে থেকেই তার ক্ষেতের কাজ করা বারণ ছিল। সে ভেসে যাচ্ছিল পুলক বন্যায়। তখনো দাড়ি-মোছ পুরোপুরি ওঠে নি। তবু সকাল-বিকাল চাঁছে; বিয়ের আগের সপ্তায় স্বপন নাপিতের কাছে চুল কাটিয়েছিল দুইবার। স্বপন নাপিতের সে কি উৎসাহ, যেন বিয়েটা আজমতের না স্বপন নাপিতের!

 

তখন তারা থাকত সাভারের পশ্চিমে, খড়ার চর গ্রামে। বাপ-দাদার বসতভিটায়। নদী ভাঙনের কবলে বসতভিটা ভেসে যাওয়ায় পুরো পরিবারসমেত সাভার চলে আসে। আজকের সাভার তখন ছিল জংলাভূমি। রাত-বিরাতে শিয়ালরা দল বেধে হুক্কাহুয়া ডাকত। কারো কারো চোখে নাকি হরিণ-টরিণও পড়ত। অথবা হতে পারে এটা সবটাই গাল-গপ্প। যাই হোক, এই যে সবুজবাগ, কাজী মোকমাপাড়া, ঘোষপাড়া, ইমান্দিপুর, মজিদপুর এইসব পাড়া তো হলো তার চোখের সামনে। এই তো সেদিনের কথা। এখন যে ঝকমকা সাভার তখন এই সাভারের নাম-গন্ধও ছিল না। লিবারেশনের পরে এর চেহারা পাল্টাতে শুরু করল। ধান্ধাবাজরা চোখের পলকে বড়লোক হয়ে গেল।

চেষ্টা করলে সে-ও পারত। কিন্তু ওসব তার ধাত না। ধান্ধাবাজি জিনিসটা তার দুই চোখের বিষ। না-হলে সে-কি পারত না সদ্য রমরমা শহর ব্যাংক কলোনিতে ২/৪ বিঘা জমি বগলদাবা করতে? উকিল সাবকে বললেই ব্যবস্থা করে দিত। সে তো দেলোয়ার উকিলের জমিতেই ডেরা বানিয়ে প্রথম দিকে বসবাস শুরু করেছিল।

উকিল সাবের জমির দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। মানুষের পেছন পেছন ঘোরা তার কাছে একেবারে অসহনীয় কাজ। তার চেয়ে বরং এই ভালো উকিল সাব খুশি হয়ে তাকে ৩ ডিসিমাল নিষ্কণ্টক জমি দিয়েছে। তিনি দিলদার মানুষ; গরিব মানুষ বলে তার কেয়ারটেকার আজমত আলীকে অবহেলা করে নাই। উকিল সাহেবের বদৌলতেই সবুজবাগে এখন তার একতলা বাড়ি। আর এই বাড়ি করার টাকাও দিয়েছিল উকিল সাহেব নিজে। দেলোয়ার উকিলের প্রতি অতিমাত্রায় কৃতজ্ঞতাবোধ আজমত আলীর স্মৃতিচারণে কিছুটা বিঘ্ন ঘটালে শেহেরজানের ব্যাপারটা একেবারে চাপা পড়ে যায়। বরং শেহেরজানের স্মৃতির উদরের ওপর আস্তানা করে নেয় তার রঙিন জীবন যথা বাংলা মদ, জুয়া আর নারী। দেলোয়ারের বদান্যতায় সে উড়তে থাকে। ৩ ডিসিমাল জমি পাওয়ার পর সে কি আনন্দ! সে কি ফূর্তি! গেলাসের পর গেলাস বাংলা মদ পেটে চালান কর, নিশিরাতে দুই একটা মেয়ে মানুষ পটাও কিংবা জুয়ার আসরে নিজেকে পুরোপুরি স্থাপন করে ছেড়ে দাও জীবনের নাটাই এই করে করেই তো তখন তার দিন কাটত।

হঠাৎ ছাকরা ছাকরা শাদা চুল চুঁয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ঠোঁটের ডগায় সুড়সুড়ি দিলে বাংলা মদের স্বাদ উবে গিয়ে সেখানে মাখো মাখো শুরু করে শরীরের নোনতা স্বাদ এবং আজমত আলী খেয়াল করে সে এখন আর কালাবুড়ির বাড়ির সামনে নাই। তাহলে কোথায়? আশ-পাশে তাকিয়ে দেখে জায়গাটা তার অপরিচিত। এটা কীভাবে সম্ভব? সাভারের এমন কোনো জায়গা আছে যা তার অপরিচিত? তাহলে কী তার ঘোর লেগেছে? সে চোখ কচলায়, এদিক-ওদিক তাকায়; না জায়গাটা চেনা যাচ্ছে না। সে কোথায় কোথায় গিয়েছে বা দাঁড়িয়েছে সব মনে করার চেষ্টা করে। তলু ব্যাপারির সাথে দেখা হলো কাজী মোকমাপাড়ায়,না, ঠিক মোকমাপাড়া না, লোকজন মোকমাপাড়া বললেও জায়গাটার নাম আসলে ঘোষপাড়া; মোকমা পাড়া আর ঘোষপাড়ার দক্ষিণ সাইডে মাস্টারপাড়ার ছাপড়া মসজিদে নামায আদায় করে সে বাড়ি ফিরছিল; পথে দেখা তলু ব্যাপারির সাথে, তারপর আছালত মোল্লার বড় ছেলে আব্দুর রবের ঘণ্টি দোকানে চা-পান খাওয়ারও কয়েক মিনিট বাদে শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে সে উঠল গিয়ে সোমনাথ সাহার পরিত্যাক্ত বাড়ির বারান্দায়। নাকি? সবই তো ঠিকঠাক মনে আছে। তাহলে এই জায়গাটা অপরিচিত ঠেকছে কেন? আচ্ছা ধরলাম তার ঘোর লেগেছে। যদি তাই হয় তাহলে তো আগের ঘটনাগুলো মনে থাকবার কথা নয়!

 

চিন্তা-ভাবনা রেখে নাক বরাবর হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্তকেই পুরোপুরি গুরুত্ব  দিল আজমত আলী। কিন্তু হাঁটলে কী হবে, উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যাওয়ার তো কোনো মানে হয় না। ওদিকে বৃষ্টির কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই রাস্তার অবস্থা এমন হয়েছে যে, রিকশা-টিকশা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। ফ্যাসাদ আরো আছে, ৪ যুগেরও বেশি সময় ধরে সে থাকে সাভার অথচ চিনতে পারছে না নিজের এলাকা; এ-কথা সে অন্যের কাছে বলবে কেমন করে? তাই এবার নতুন একটা বুদ্ধি বের করলÑ বাড়ির নেম প্লেট কিংবা সাইনবোর্ড দেখবে। কিন্তু সে যে আবার বকলম! উকিল সাহেবের ১৭৪ বিঘা জমি পাহারা দেওয়ার সময় সে ফটকের কাছে পাতা বেঞ্চিতে বসে খবরের কাগজ পড়ত। খবরের কাগজের একটা সুবিধা হলো তাতে ফটো থাকে। কিন্তু এই ঘিঞ্জি এলাকার বাড়ির গেটে ফটো তো দূরে থাক, ছোট হরফে কীসব লেখা তা উদ্ধার করা তার পক্ষে খুবই কঠিন কাজ। ফলে পুনরায় উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বৃষ্টি পড়ছে সেই কখন থেকে। ক্রমে বেড়ে চলেছে রাত অথচ এখনো তার কোনো হিল্লে হলো না।

এভাবে গো ধরে পড়ে থাকলে সামনে সমূহ বিপদ আন্দাজ করে আজমত আলী এবার তার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়।  না হয় সে ৪ যুগ = ৪৮ বছর যাবৎ বসবাস করছে সাভারে কিন্তু ঐ ধুয়া তুলে কোনো লাভ নাই; যদি ঐ ফুটানিতে কোনো কাজ হতো তাহলে এখনো তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হতো না। কই, এখন পর্যন্ত তো বাড়ির ঠিকানার কোনো হদিস পেল না! তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, কোনো রিকশা-টিকশা পেলে আর হাত ছাড়া করবে না। এর আগে রিকশা নাই নাই করেও দু-একটা যে একেবারে চোখে পড়েনাই তা কিন্তু নয়।

 

হঠাৎ হুড তোলা একটা রিকশার সন্ধান পেল আজমত আলী। অনেক বলে-কয়ে রিকশাঅলাকে রাজি করিয়ে সেই রিকশায় ওঠে।

চলন্ত রিকশায় বসে আয়েশ করে দাদ চুলকাতে চুলকাতে আজমত আলী ভাবে, তার পকেটে টাকা নাই। রিকশা ভাড়া দেবে কেমন করে? পরে নিজেই সমাধানও বের করে, বাড়ির সামনে রিকশাঅলাকে দাঁড় করিয়ে জব্বারের কাছ থেকে টাকা এনে দেবে। টাকা আনা অবশ্য কষ্টসাধ্য কাজ, কারণ জব্বার সব টাকা-পয়সা রাখে বউয়ের কাছে; তবু সে একটা রিস্ক নেওয়ার ফন্দি আঁটে। কীভাবে টাকা আনবে এটা ভাবতে ভাবতে ছেলের বউয়ের দজ্জাল চেহারাটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। টাকার দরকারে ঐ দজ্জাল বেটির দ্বারস্থ হতে হবে অথচ ৩ ডিসিমাল জমির ওপর ভাঙাচোরা একতলা বাড়িখানার মালিক এই আজমত আলী!

রিকশা এসে বাড়ির সামনে থামে। -খাড়াও বাপু ট্যাকা নি আসতেছি বলে আজমত আলী রিকশা থেকে নেমে নড়বড়ে ফটকের পকেটে কুঁজো হয়ে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। ভেতরে প্রবেশ করার পর বাড়ির চেহারা দেখে খেয়াল হয়, আরে এটা তো তার বাড়ি না! এটা রমজান হাজীর তিনতলা বাড়ি। পরে বাড়িটার দিকে আর একবার ভালোভাবে তাকিয়ে বুঝতে পারে এটা রমজান হজীর বাড়িরও নয়। তাহলে? সে কার বাড়ি এসে উঠেছে! সে দ্রুত ফটকের সামনে যায়। দেখে রিকশাটি নাই, রিকশাঅলাও নাই।

 

মুহূর্তের মধ্যে অদ্ভূত এক অন্ধকারের কুণ্ডলি এসে তার চোখে-মুখে পলকা হাওয়ার মতো নাড়া দিয়ে যায়। সে এখন সম্পূর্ণভাবে দিকহারা ও অসহায় মানুষ। কী করবে বা কী করা উচিত কোনোটাই ভেবে উঠতে পারছে না।

বৃষ্টি ততক্ষণে কিছুটা কমতি ধরেছে।

তবে বৃষ্টি কমলেও তার চোখের ঝাপসাভাব কাটে নি। অন্যের বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করা থেকে শুরু করে সকল ভুলগুলো তাকে একেবারে ম্রিয়মাণ করে ফেলেছে। তাই আপন ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এলোপাতাড়ি হাঁটতে হাঁটতে সে একটা বট বৃক্ষের সন্ধান পায়। শ্মশানের বট বৃক্ষ। জায়গাটা চিনতে তার বেগ পেতে হয় না। -পোড়াবাড়ির দক্ষিণ সাইডে সাভারের একমাত্র শ্মশান। সে আশ্বস্ত হয়, কেননা শ্মশানের পূর্ব-দক্ষিণ সাইডে সবুজবাগ আর সবুজবাগের ১৭ নম্বর বাড়িটাই তার।

ঠিক আছে। আর কোনো রিকশা নয়। এখন তার চোখ বেঁধে দিলেও সে নিজের বাড়ি যেতে পারবে।

রাত এখন বারটা না-একটা কে জানে! খুব ধকল গেছে এতটা সময়; যাকগে, আর কোনো চিন্তা নাই। এই ভাবনা শেষ হতে না-হতে নতুন একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, খোদাতালা কী তার বান্দারে দিয়ে কোনো পরীক্ষা করিয়ে নিল? আগে-পরে যাই হোক, আট-দশ বছর হলো সে নামায-রোজা ঠিক-ঠাক আদায় করে, দিন দিন মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্জ করার বাসনাটাও বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে; তাহলে সে এমন অবস্থার মধ্যে পড়ল কেন?

নিজের কৃতকর্ম সম্বন্ধে গভীর চিন্তা করতে করতে আজমত আলী যখন বাড়ির পথে রওয়ানা দেবে ঠিক তখন, শ্মশানের বট বৃক্ষের নিচ থেকে ভেসে আসা শিশুর ক্রন্দন ধ্বনি তাকে বিচলিত কওে তোলে। হঠাৎ সে কেঁপে ওঠে। কান্নার উৎসের দিকে ফিরে যাবে কী যাবে না ভাবতে থাকে। এরই মধ্যে সে টের পায় তার পা চলছে না। ক্রমাগত শিশুর কান্নাধ্বনি বৃষ্টিভেজা রাতকে আরো আর্দ্র করে তোলে।

অচেনা একটা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরে। শ্মশান থেকে কান্নাধ্বনি; এ তো মৃত্যুর ডাক! আজ কী তার মৃত্যু হচ্ছে? সে আর ভাবতে পারে না। গলা শুকিয়ে আসে। কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।

 

উপায়ান্ত না-দেখে সে কান্নার উৎসের কাছে যায়। দেখে বটবৃক্ষের নিচে অন্ধকারের কুণ্ডলির মধ্যে একখণ্ড ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো সদ্যপ্রসূত ফুটফুটে সুন্দর একটি শিশু। কী হয় মুহূর্তের মধ্যে তার ভয়ের মাত্রা কমে আসে। শিশুটির অস্পষ্ট ধ্বনি তার করোটিতে কম্পন শুরু করলে সে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। জারজ সন্তানের গল্প সে অনেক শুনেছে, কখনো দেখে নি। এই বাচ্চাটি কি তবে তাই? নিষ্পাপ শিশুটির কান্নাধ্বনি জড়ানো আর্তনাদ কী তার নাফরমান বাবা-মার প্রতি?

আজমত আলী শিশুটির শোকার্দ্র কান্নার কাছে বিগলিত হয়ে পড়ে। তলু ব্যাপারির সাথে দেখা হওয়ার পর নিজের সবকিছু ভুলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও মুখ থুবড়ে পড়ে এই শিশুটির কান্নার কাছে।

শিশুটিকে সে কোলে তুলে নেয়। মমতার স্পর্শে শিশুটির কান্না থামলে আজমত আলীর মনে হয় এটা হাফেজারই সন্তান। হাফেজার ছেলে তো তাকে দাদা বলেই ডাকবে, কিন্তু এই মাসুম বাচ্চাটি বড় হয়ে তার নাফরমান বাপ সুলতানকে বাপ বলে স্বীকৃতি দেবে তো?