বইপত্র

বাঁধনহারা : সাহসী অনুবাদকর্ম

হারুনুজ্জামান

 

Kazi Nazrul Islam

Badhon Hara

Unfettered

 

Translated by

The Reading Circle

 

Nymphea Publication

Dhaka, 2012

বি কাজী নজরুল ইসলামের বাঁধনহারা পত্রোপন্যাসে উলি�খিত পত্রগুলির মধ্যে তাঁর বন্ধু রবিয়লের মাকে (রকিয়া) উদ্দেশ করে লেখা একমাত্র চিঠিতে কেবল তারিখ ছিল না। আর বাকি সতেরোটি চিঠির তারিখ হচ্ছে – করাচি সেনানিবাস থেকে রবুর উদ্দেশে নূরুল হুদার চিঠিটি ২০ জানুয়ারি, করাচি সেনানিবাস থেকে মনুয়রের উদ্দেশে লেখা নূরুল হুদার চিঠি ২১ জানুয়ারি, সালার থেকে নূরুর উদ্দেশে রবিয়লের লেখা চিঠি ২৯ জানুয়ারি, বাঁকুড়া থেকে নূরুল হুদার উদ্দেশে মনুয়রের লেখা চিঠি ২৬ জানুয়ারি, সালার থেকে নূরুল হুদার উদ্দেশে রাবেয়ার লেখা চিঠি ৬ ফাল্গুন, শাহপুর থেকে সোফিয়ার উদ্দেশে লেখা মাহবুবার চিঠি ১০ ফাল্গুন, সালার থেকে মাহবুবার উদ্দেশে লেখা সোফিয়ার চিঠি ১২ ফাল্গুন, করাচি সেনানিবাস থেকে ভাবিসাহেবার উদ্দেশে লেখা নূরুল হুদার চিঠি ১৫ ফেব্রুয়ারি, বাঁকুড়া থেকে নূরুল হুদার উদ্দেশে মনুয়রের লেখা চিঠি ২ ফেব্রুয়ারি, করাচি সেনানিবাসের প্রিজন সেল থেকে মনুয়রের উদ্দেশে লেখা নূরুল হুদার চিঠি ১৭ ফেব্রুয়ারি, সালার থেকে ননদ মাহবুবার উদ্দেশে লেখা রাবেয়ার চিঠি ১২ ফাল্গুন, সালার থেকে আয়েশার উদ্দেশে লেখা রকিয়ার চিঠি ১৩ ফাল্গুন, শাহপুর থেকে বুবুসাহেবা অর্থাৎ রাবেয়ার উদ্দেশে লেখা আয়েশার চিঠি ১ চৈত্র, সালার থেকে সাহসিকার উদ্দেশে লেখা রাবেয়ার চিঠি ২৭ চৈত্র, বিডন স্ট্রিট, কলকাতা থেকে রাবেয়ার উদ্দেশে লেখা সাহসিকার চিঠি ১ বৈশাখ, শেঙান থেকে সাহসিকার উদ্দেশে লেখা মাহবুবার চিঠি ১ আষাঢ় এবং বাগদাদ থেকে সাহসিকার উদ্দেশে লেখা নূরুল হুদার চিঠির তারিখ ছিল ২৩ চৈত্র।

বাঁধনহারা পত্রোপন্যাসে যেসব চরিত্র স্থান পেয়েছে সেগুলো             হচ্ছে :

১. আয়েশা – মাহবুবার মা ও রকিয়ার ছোট বোন।

২. খুকি (আনারকলি) – রাবেয়া ও রবিয়ল দম্পতির কন্যা।

৩. মা (রকিয়া) – রাবেয়ার শাশুড়ি, সোফিয়া ও রবিয়লের মা।

৪. মাহবুবা – নূরুল হুদার প্রেমিকা, আয়েশার কন্যা।

৫. মনুয়র – রাবেয়ার ভাই, রবিয়লের শ্যালক, নূরুল হুদার বন্ধু।

৬. নূরুল হুদা - সৈনিক কবি, যার প্রথমে পোস্টিং হয়েছিল করাচি, পরে বদলিসূত্রে গিয়েছিলেন বাগদাদ।

৭. রবিয়ল – রাবেয়ার স্বামী, সোফিয়ার ভাই ও নূরুল হুদার বন্ধু।

৮. রাবেয়া – রবিয়লের স্ত্রী ও মনুয়রের বোন।

৯. সাহসিকা – রাবেয়ার ব্রাহ্ম শিক্ষিকার মেয়ে, রাবেয়ার বান্ধবী, একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী।

১০. সোফিয়া (সোফি) – রকিয়ার মেয়ে, রবিয়লের বোন, নূরুল হুদার প্রেমিকা।

এ-উপন্যাস মূলত আবেগ-উচ্ছ্বাসপূর্ণ। আবেগময় ভাষা এবং উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়েই কাহিনির সূচনা এবং পরিণতি। দ্বিতীয় চিঠিটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বৃষ্টিস্নাত সকালের প্রকৃতি তাকে আরো উচ্ছ্বসিত করেছে। সেইসঙ্গে প্রচুর হাস্যরস, আনন্দ, রাগরাগিণীর পরিচিতি এবং সংগীত এটির মূল বৈশিষ্ট্য।

 

তৃতীয়

তৃতীয় চিঠিতে আছে কৌতুক, খুকির কথা, বিবাহ-পরবর্তী পরাধীনতার কথা, যা কৌতুকছলে বলা, সর্বোপরি আছে বন্ধনহীন কবির আত্মদর্শন এবং মাহবুবার সঙ্গে তাঁর প্রেমের কথা, যা কখনোই বাস্তবে রূপ নেয়নি। এখানেই প্রথম কবির প্রতি সোফিয়ার নীরব ভালোবাসার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

 

চতুর্থ

নূরুকে লেখা মায়ের এ-চিঠিতে মাতৃহৃদয়ের ভালোবাসা, উৎকণ্ঠা এবং উপদেশই প্রাধান্য পেয়েছে।

 

পঞ্চম

নূরুল হুদাকে লেখা মনুয়রের এ-চিঠিতে দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের পরিচয় চিত্রিত, সেই সঙ্গে আছে কিছু স্মৃতিচারণ এবং মনুয়রের সম্ভাব্য বিবাহ প্রসঙ্গ।

 

ষষ্ঠ

বাঁধনহারা উপন্যাসের রাবেয়া চরিত্রটি ব্যতিক্রমধর্মী। উপন্যাস থেকেই জানা যায়, রাবেয়া কেবল শিক্ষিতই নয়, তার পাঠাভ্যাস আছে। স্বাভাবিকভাবেই তার চিন্তাধারা স্বচ্ছ এবং ব্যতিক্রমধর্মী। এ-চরিত্র তৎকালীন গোঁড়া মুসলিম সমাজের মধ্যে বসবাস করলেও স্বাধীন চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী।

এদেশের মহিলারা যখন সহধর্মিণীর ঠিক মানে বুঝতে পারবেন, স্বামীর দোষকে উপেক্ষা না করে তার তীব্র প্রতিবাদ করে স্বামীকে সৎপথে আনতে চেষ্টা করবেন, তখনই ঠিক স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ হবে।১

এ-চিঠিতে আরো আছে নূরু-মাহবুবার ব্যর্থ প্রেমের পরিচয়।

 

চিঠি-৭

সোফিয়াকে লেখা মাহবুবার এ-চিঠিতে মামার বাড়িতে বসবাসকারী মাহবুবার আত্ম-অবমাননাকর পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। মাহবুবাও রাবেয়ার মতোই ব্যক্তিত্বসন্ধানী, নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

আমরা যে খালি রক্তমাংসের পিন্ড।… কোন কেতাবে নাকি লেখা আছে পুরুষদের পায়ের নিচে বেহেশত, আর সেসব কেতাব ও আইনকানুনের রচয়িতা পুরুষ।২

 

চিঠি-৮

মাহ্বুবাকে লেখা সোফিয়ার এ-চিঠিটি বন্ধুর কাছে লেখা একটি সাধারণ চিঠি। পারিবারিক কথার পাশাপাশি এসেছে নূরুর কথা। সোফিয়া এখানে তাকে চিত্রিত করেছে বন্ধনভীতু হিসেবে।

 

চিঠি-৯

ভাবিসাহেবাকে লেখা নূরুল হুদার এ-চিঠিতে মূলত কবির আত্মচরিত্র পরিস্ফুটনের প্রয়াস লক্ষণীয়। চিরদুর্বার বাঁধাবন্ধনহীন অভিমানী কবিকে এখানে পাওয়া যায়। তাঁর ক্রোধ, আক্রোশ এবং অভিযান সব স্রষ্টার বিরুদ্ধে। কোনো স্নেহের বন্ধনে ধরা দিতে তাঁর আপত্তি। এখানে একটি তথ্য পাওয়া যায়, আরব সাগর পাড়ি দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় তাঁর যুদ্ধযাত্রার প্রস্ত্ততি।

 

চিঠি-১০

নূরুকে লেখা মনুয়রের এ-চিঠি আবেগ এবং উচ্ছ্বাসে পূর্ণ। মনুয়রের জবানীতে নজরুল চরিত্র এবং মনস্তত্ত্ব চিত্রিত হয়েছে এখানে।

 

চিঠি-১১

এ-চিঠিটিতে নূরু তথা নজরুল ইসলাম তাঁর আত্মচরিত্র চিত্রণ করেছেন। মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধে যাওয়ার পরিবর্তে পদোন্নতিসহ সৈনিকদের ট্রেনিংয়ের জন্য নজরুল হুকুমপ্রাপ্ত হলে এক ক্যাপ্টেনকে কীভাবে ঘুষি মেরে জেলে গেলেন তারই বর্ণনা পাওয়া যায় আলোচ্য চিঠিটিতে।

 

চিঠি-১২

মাহবুবাকে লেখা রাবেয়ার এ-চিঠিতে নূরু-মাহবুবার প্রেম সম্পর্কিত তথ্য উপস্থিত। এ-চিঠিতেই ব্রাহ্মকন্যা সাহসিকার সঙ্গে পাঠকের প্রথম পরিচয় হয়। সাহসিকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেওয়ার সূত্রে ব্রাহ্মধর্মের উদার মানসিকতার প্রতি রাবেয়ার উক্তির মধ্য দিয়ে মানবতাবাদী নজরুলের শ্রদ্ধা লক্ষণীয়।

অন্য কোনো জাতির কোনো ধর্মের কোনো সমাজের নারীর৩ এমন পূর্ণ বিকাশ ত দেখিনি।

 

অথবা,

এই ছোঁয়াছুঁয়ির উপসর্গটা যদি কেউ হিন্দু সমাজ থেকে উঠিয়ে দিতে পারেন, তাহলেই হিন্দু-মুসলমানের একদিন মিল হয়ে যাবে।৪

 

চিঠি-১৩

আয়েশাকে লেখা রকিয়ার এ-চিঠিটি একটি সাধারণ পারিবারিক চিঠি।

 

চিঠি-১৪

এ-চিঠিতে পারিবারিক কথা এবং মান-অভিমানের সঙ্গে আছে মাহবুবার বিয়ে প্রসঙ্গ। ধনী কিন্তু বয়স্ক পাত্রের সঙ্গে মাহবুবার বিয়ের পাকা খবরই এ-চিঠির মূল বক্তব্য।

 

চিঠি-১৫

সাহসিকাকে লেখা রাবেয়ার এ-চিঠিতে নূরুর প্রতি সাহসিকার সমর্থনের অভিযোগ করেছে রাবেয়া। নূরু তথা লেখকের ঝোড়ো, দুরন্ত চরিত্রের প্রতি সাহসিকার স্নেহ ও সমর্থনই তাঁর বাঁধন না-মানা চরিত্রকে আরো উস্কে দিয়েছে, যুদ্ধযাত্রায় সমর্থন জানিয়েছে, এমন অভিযোগ রাবেয়ার।

নূরুর ব্যথার ধরণীতে যেই শৈবালের সর প’ড়ে আসছিল, অমনি তুই এসে একেবারে তার বেদন-ঘায়ে পরশ বুলিয়ে তাকে ক্ষিপ্ত করে তুললি।৫

 

চিঠি-১৬

রাবেয়ার লেখা সাহসিকার একটি দীর্ঘ চিঠি। এ-চিঠিটি মূলত সাহসিকার আত্মস্বীকৃতি, যেখানে ‘ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মিস সাহসিকা বোধ’ গ্র্যাজুয়েটের অতলান্তিক বেদনার পরিচয় পাওয়া যায়। এ নারী নানাবিধ চাপে আপন আত্মার সুকুমার দিনগুলো ভুলে অহল্যার মতোই পাষাণ হয়ে গেছে। আপন খোলস থেকে বের হওয়ার তার উপায় নেই।

আমার মুক্তি নেই – মুক্তি নেই। অহল্যারও মুক্তি হয়েছিল, আমার মুক্তি নেই… ঐ অহল্যা নারী যখন পাষাণ হয়েছিল, তার মাঝে যে আমিও ছিলাম।৬

এ-চিঠিতে সাহসিকার জবানবন্দিতে ধর্মসংক্রান্ত নজরুলের গভীর দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়।

ক. মন্দিরে গিয়ে পূজা করা আর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়াটাই কি ধর্মের সার সত্য?৭

খ. প্রত্যেক ধর্মই সত্য – শাশ্বত সত্যের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত।… তার এ সত্যকে বুঝতে হলে তার অন্তর দেউলে প্রবেশ করতে হবে ভাই।৮

নূরুর প্রতি মাহবুবার ভালোবাসার একটি গভীর বিশে�ষণও বিদ্যমান এ-পত্রটিতে।

 

চিঠি-১৭

সাহসিকাকে লেখা মাহ্বুবার এ-চিঠিতে একদিকে মাহ্বুবার গভীর অন্তর্বেদনার পরিচয় বর্তমান, অন্যদিকে তৎকালীন মুসলিম পরিবারের ঠুনকো আভিজাত্যের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।

আমার স্বামী আমার রূপকে চেয়েছিলেন রূপার দরে যাচাই করতে।… এ সওদায় তিনি ঠকেননি। কিন্তু এ জন্য স্বামীকে খোঁচা দিয়ে লাভ নেই। এই-ত আমাদের বাংলার – অন্তত শরীফ মুসলমান মেয়েদের চিরকেলে একঘেয়ে কাহিনী।৯

 

চিঠি-১৮

সাহসিকাকে লেখা নূরুল হুদার এ-চিঠিটি সংক্ষিপ্ত এবং সংহত। লেখকের আবেগ এবং উচ্ছ্বাস অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত। এখানেই প্রথম লক্ষ করি, নূরু প্রথম বিস্ময়ের সঙ্গে সোফিয়ার ভালোবাসার কথা উপলব্ধি করেছে। দ্বিতীয়ত, এ-চিঠিতেই তার দেশে না ফেরার সঙ্কল্পের কথা জানিয়েছে সাহসিকাকে।

কাজী নজরুল ইসলাম-রচিত বাঁধনহারা পত্রোপন্যাস। উপন্যাস হলেও এখানে আবেগ এবং উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভাষার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়। উপন্যাসের মূল চরিত্র নূরু তথা লেখক স্বয়ং এবং তাঁর চরিত্রের বন্ধনহীন উদ্দামতা, চিরচঞ্চল খেয়ালিপনা চিত্রণের জন্যই অন্যান্য চরিত্রের আগমন। মনুয়র, মাহবুবা, রাবেয়া, সাহসিকা প্রমুখ চরিত্রের জবানীতে নূরু তথা লেখক-চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যই প্রাধান্য লাভ করেছে। অবশ্য কয়েকটি চিঠিতে তৎকালীন মুসলিম পরিবারের পর্দাপ্রথা,             আত্ম-অহমিকা, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত এবং ব্রাহ্ম সমাজের উদার দিকগুলোর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। রাবেয়া শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের নারীদের প্রতিনিধি, সে কিছুটা হলেও মাহবুবা এবং সোফিয়াকে আলোকিত করেছে।

অনুবাদ এমনিতেই একটি দুরূহ সাহিত্যকর্ম। শব্দানুবাদ বা বাক্যানুবাদ সহজ হলেও একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্মের ভাষা অত্যন্ত কঠিন। কারণ এক ভাষায় আবেগ, অনুভূতি এবং সৌকুমার্য অন্য ভাষায় সঞ্চারিত করা প্রায় অসম্ভব। প্রত্যেক ভাষাভাষীর কাছে স্ব-স্ব ভাষার শব্দ এবং এর প্রয়োগ পৃথক অনুভবের সঞ্চার করে,                 যে-অনুভবের কোনো ভাষান্তর হয় না। তবু সাহিত্যপিপাসু পাঠককে বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র ভান্ডারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে অনুবাদ বা ভাষান্তরের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য অনুবাদককে মূল বিষয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে অনুবাদ করতে হয়, আবার সাহিত্যধর্ম রক্ষার জন্য গ্রহণ-বর্জনও প্রয়োজন।

উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনলে বলতেই হয়, বাঁধনহারা উপন্যাসটির ভাষান্তর করা একটি কঠিন কাজ। কারণ উপন্যাসটি আবেগ এবং উচ্ছ্বাসে পূর্ণ। আর এই কঠিন কর্মটিই সাধন করেছেন অনুবাদকেরা। কিছু কিছু স্থানে অনুবাদ মূল বর্ণনার চাইতে সংহত, কোথা কোথাও বর্ণনীয় বিষয়টির মূল ভাবকে সুন্দরভাবে সঞ্চারিত করতে সমর্থ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে মনুয়রকে লেখা নূরুল হুদার চিঠির একটি অংশ উদ্ধৃত করছি। বর্ষণস্নাত করাচির সকালের রূপ বর্ণনা করছেন এভাবে –

এখন সে দিব্যি তার আসমানী রঙের ঢলঢলে চোখ দুটি, গোলাপী নীল আকাশের পানে তুলে দিয়ে গম্ভীর উদার চাউনীতে চেয়ে আছে। আর আর্দ্র ঋজু চুলগুলি বেয়ে এখনো দু-এক ফোঁটা করে জল ঝরে পড়ছে আর নবোদিত তরুণের রক্তরাগের ছোঁয়ায় সেগুলি সুন্দরীর গালে অশ্রুবিন্দুর ঝিলমিল করে উঠছে।১০

Now she is looking at the pink and blue sky with her solemn blue eyes. From her wet hair a few drops continue to drip sparkling in the light of the morning sun like the tears on a girls cheeks.১১

নিঃসন্দেহে একটি অনবদ্য অনুবাদ। প্রতিটি শব্দের অনুবাদ এখানে নেই কিন্তু স্নিগ্ধ নরম আলোয় বৃষ্টিস্নাত একটি সকালের বর্ণনা হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দিতে ব্যর্থ হয় না। ‘ঢলঢলে’ শব্দটির অনুবাদ এখানে নেই, প্রয়োজনও হয়নি। গভীর উদাস শব্দটির ভাষান্তর করা হয়েছে Solemn এবং এই একটি শব্দই যেন হৃদয়ে পবিত্র অনুভূতির ছোঁয়া এনে দেয়।

আবার এর ব্যতিক্রমও আছে। সোফিকে মাহবুবা লিখছে –

আমাদের এই তথাকথিত শরীফের ঘরে ঘরে শুধু ঝুড়ি ঝুড়ি থুবড়ো ধাড়ি মেয়ে! বর যে কোথা থেকে আসবে তার কিন্তু ঠিক ঠিকানা নেই!১২

ভাষান্তরিত রূপ –

Alas, Fate! We are old maid already, could’nt find husbands yet!১৩

এখানে মাহবুবার উক্তিতে একদিকে যেমন তৎকালীন মুসলিম পরিবারের মেকি আভিজাত্যের কারণে অনূঢ়া কন্যাদের সংখ্যাধিক্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়ছে, অন্যদিকে সমাজের অসার, ফাঁপা একটি দিকও চিত্রিত হয়েছে। অনুবাদে এ-মূলসুরটি অনুপস্থিত।

প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আরো সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল। বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের ভাষান্তর না করে ইংরেজিতে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন, যেগুলো অর্থগত দিক থেকে কাছাকাছি, সেগুলো ব্যবহার করলে অনুবাদ আরো সমৃদ্ধ হতো।

উপসংহারে বলতে হয়, বাঁধনহারা উপন্যাসের অনুবাদ করে Reading Circle একটি ব্যক্রিমধর্মী কাজ করেছে, যা পরবর্তী অনুবাদকদের অনুপ্রাণিত করবে নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে নিয়াজ জামান-লিখিত ভূমিকাটি আগ্রহী পাঠকদের জন্য একটি বাড়তি পাওনা।

প্রচ্ছদ যথাযথ, বাঁধাই চমৎকার।

Standard Chartered Bank ভবিষ্যতে এ-ধরনের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে – এই প্রত্যাশা। উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানাই।

 

তথ্যসূত্র

১. বাঁধনহারা, পৃ ৫১০, নজরুল রচনাবলী-১ম খন্ড, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, প্রথম প্রকাশ ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৩।

২. ওই, পৃ ৫২৩।

৩. পূর্বোক্ত, পৃ ৫৬৩।

৪. ওই, পৃ ৫৬৪।

৫. ওই, পৃ ৫৭৯।

৬. ওই, পৃ ৫৮৪।

৭. ওই, পৃ ৫৯০।

৮. ওই, পৃ ৫৯০।

৯. ওই, পৃ ৬০১।

১০. পূর্বোক্ত, পৃ ৪৯৩-৯৪।

১১. Bandhon Hara (unfettered), Translated by Reading Circle, P 28.

১২. বাঁধনহারা, নজরুল রচনাবলী-১ম খন্ড, পূর্বোক্ত, পৃ ৫২৮।

১৩. Bandhon Hara (unfettered), পূর্বোক্ত, পৃ ৬৮। r

 

নারীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ

ও জীবন

সৈয়দ আজিজুল হক

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

হাসনা বানু

 

দারুচিনি প্রকাশনী

ঢাকা, ২০১৩

 

১৬০ টাকা

 

 

 

 

 

 

 

বেশ কয়েক বছর আগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে আয়োজিত হয়েছিল বিশ্ব নারী সম্মেলন (১৯৯৫)। ওই সম্মেলনে যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়, চুম্বকসদৃশ। ����গানটি ছিল এরকম – ‘নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন’। অতিশয় চিন্তা-উদ্রেককারী, গভীর তলশায়ী, তাৎপর্যপূর্ণ এ-����গানের অন্তরালে যেমন লুকিয়ে আছে নারীর যুগ-যুগের বঞ্চনার ইতিহাস, তেমনি আছে নিজের                         সম-অধিকারসহ সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রবলতর আগ্রহ।

এ-প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত সেই ‘নারী’ কবিতার পঙ্ক্তি দুটি স্মরণীয় : ‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি        চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ নজরুল ইসলাম শুধু মহৎ ও কল্যাণধর্মী সৃষ্টির প্রশ্নেই দুজনের সমান অবদানের কথা বলে শেষ করেননি, তিনি এর বিপরীত অন্ধকার পরিস্থিতির জন্যও সমান দায়ী করেছেন নর-নারী উভয়কে। বলেছেন : ‘বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’ কিন্তু নজরুল                    ইসলাম যে-মর্যাদা নারীকে দিয়েছেন, সে-মর্যাদা তো তৎকালীন সমাজে তার ছিল না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ছোট বই নারীর মূল্য পাঠ করলে আমরা উনিশ শতকের শেষার্ধে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে নারীর বঞ্চনা, পীড়ন ও যন্ত্রণার মর্ম এবং ব্যাপ্তি অনুধাবন করতে পারি।

সুতরাং বিশ শতকের শেষে এসে যখন এ-আহবানটি উচ্চারিত হলো – নারীর চোখে বিশ্ব দেখার – তখন আমাদের একটু নড়েচড়ে বসতে হলো। সত্যিই তো, আমরা এতকাল যে সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন সৃষ্টি করেছি, তার সবটাই তো পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসারিত। এর কোথাও তো নারীর দৃষ্টিকোণ বা চিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখি না। সুতরাং শুধু শারীরিক               বঞ্চনা-নিপীড়নই নারীর একমাত্র নিয়তি ছিল তা নয়; তার মনোজগৎ, চিন্তাজগৎ, তার সৃষ্টিশীলতা – এই সবকিছুকেই রাখা হয়েছিল স্তব্ধ বা নিষ্ক্রিয় করে।

অতএব এই একুশ শতকে যখন আমরা নারীর চোখে বিশ্ব দেখছি, তখন অনেক অনালোকিত বিষয়ই আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। আমাদের আলোচ্য লেখক হাসনা বানুর (জন্ম ১৯৩৮) প্রথম গ্রন্থ বের হয়েছে তাঁর পঁচাত্তর বছর বয়সে। বয়সের এমন একটি প্রান্তে এসে তিনি যে লিখতে আগ্রহী হলেন, প্রথমত সেটাই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। চাকরিজীবী এই নারীর সংগ্রামশীল জীবনের সঙ্গে যুক্ত ছিল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা মানুষের বৃহত্তর কল্যাণসাধনের ব্রত। আর এ দুয়ের মধ্য দিয়ে, তাঁর মানবহিতৈষী ও প্রগতিকামী দৃষ্টিকোণ থেকে, জীবনের বৈচিত্র্যময় যে-অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্চয় করেছেন, তারই নির্যাস এ-গ্রন্থ। সংকলিত সাতটি রচনার প্রথমটির শিরোনামেই আছে স্মৃতি। সুতরাং সেটি যে নিজ জীবনাভিজ্ঞতার সরাসরি বয়ান, তা স্পষ্টত বোঝা যায়। বাকি ছয়টি লেখার শিরোনাম ও বলার ভঙ্গিতে গল্পের ভাব স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট। কিন্তু ওইটুকুই; আসলে এসব লেখায়ও পরিবেশিত হয়েছে তাঁর জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতারই সারাৎসার। প্রতিটি রচনাই নারীর মর্মন্তুদ যন্ত্রণাভোগের আখ্যানে পরিণত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ-পরবর্তী যে-অভিজ্ঞতার বয়ান তিনি উপস্থাপন করেছেন, তাতে ভয়ংকর বাস্তবতা যেমন পরিস্ফুট হয়েছে, তেমনি নারীর দৃষ্টিকোণও রচনাটিকে দিয়েছে নতুন তাৎপর্য। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য সরবরাহে লেখিকার মায়ের সাহস ও আন্তরিকতার স্বরূপ উদ্ঘাটনের পাশাপাশি                         যুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিপন্ন রাজাকারদের আর্তনাদে কাতর মাতৃমনের ছবিও অাঁকা হয়েছে একই সমান্তরালে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে স্বাধীন দেশে তাদের প্রণয়িনীদের একান্ত আত্মনিবেদনজনিত দুঃখভোগ ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটের চিত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি তিনি বীরাঙ্গনা নারীদের যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ-পরবর্তী দুঃসহ দুর্দশার এক মর্মান্তিক আখ্যানও রচনা করেছেন।

‘একাকিত্ব’ নামের দীর্ঘ রচনাটিতে এক সচ্ছল শিক্ষিকা সুখী নারীর জীবনও প্রবাসী পুত্রের ভিন্ন সংস্কৃতির আবহে লালিত জীবনাচারকে মেনে নিতে না-পারায় কষ্টে, নৈঃসঙ্গ্যবোধে পীড়িত হয়ে কেমন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তার অন্তরঙ্গ কাহিনি বিধৃত হয়েছে। পুত্রকে নিয়ে মায়ের স্বপ্নভঙ্গজনিত বিষাদই এই একাকিত্বের জনক আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য। মাতৃমনের শূন্যতাজনিত হাহাকার কাহিনির শেষ অংশকে করুণরসে সিক্ত করে তুলেছে।

‘ফরিদপুরের ফরিদা’ নামক আখ্যানে উপস্থাপিত হয়েছে এক অশিক্ষিত গৃহপরিচারিকার মাতৃত্ব-উৎসারিত দায়িত্ববোধ ও মমত্ববোধের উন্নত মহিমার পরিচয়। দারিদ্রে্যর বিরুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের পাশাপাশি পুরুষের কর্তৃত্বপ্রধান এই সমাজে সন্তান পালনের একক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে স্বামী-পরিত্যক্ত এই নারীকে। কিন্তু দরিদ্র মায়ের সন্তান রক্ষার সকল প্রচেষ্টাই নিষ্ঠুরভাবে ব্যর্থ হয়ে গেলে কাহিনিতে সৃষ্টি হয় এক গভীর শূন্যতা, অসহায়ত্ব ও অকহবত্য ব্যথাবোধ।

‘অন্তরালে’ নামের কাহিনিতে উচ্চবিত্ত পর্যায়ে নারীর অনৈতিক জীবনাচারের গোপন চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি ওইসব নারীর এ-পথে আসার পেছনে পুরুষের শোষণ ও অর্থ-লালসার ভূমিকাই যে মুখ্য, তাও উন্মোচন করা হয়েছে। নারীর ওইরূপ জীবনের বাইরের চাকচিক্যের অন্তরালে তাদের অন্তর্যন্ত্রণা ও অনুতাপের ইতিহাসটিও গোপন থাকেনি।

‘অনিশ্চিত যাত্রা’য় ধনী ও দরিদ্রের দুটি বিষয়ে ঘটনার মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে মূলত বিত্তহীনতার সংকট। লেখক দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিশীল। ঢাকার এক অভিজাত হোটেলে আয়োজিত একটি বিলাসী বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে অবস্থান করেই লেখক অবচেতনে চিত্রিত করেন ইতিপূর্বে গ্রামে-দেখা চরম দারিদ্র্যপিষ্ট,                অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দোলায় কম্পিত, কান্নাসিক্ত একটি বিয়ের  বাস্তব রূপ। কাহিনি উপস্থাপনকৌশলে পরিবেশিত হয়েছে কথাশিল্পের ব্যঞ্জনা।

‘ভালোবাসার কাঙাল’ গল্পে দাম্পত্য প্রেমবঞ্চিত এক নারীর পতিপীড়নজনিত মনস্তাত্ত্বিক সংকটের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। শ্বশুরের অর্থে শিক্ষাপ্রাপ্ত এক পুরুষের পরনারীতে আসক্তির অকৃতজ্ঞতায় গল্পটি বিশিষ্ট। এর মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়েছে আমাদের সামাজিক বাস্তবতার এক করুণ পরিণতির চিত্রও। অর্থাৎ আমাদের দেশের বিত্তবানদের কেউ কেউ নিজ                      কন্যাকে শিক্ষিত করার পরিবর্তে দরিদ্র জামাতাকে শিক্ষিত করার পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করে। এরই পরিণতিতে একসময় অশিক্ষিত স্ত্রী শিক্ষিত চাকরিজীবী স্বামীর যোগ্য বিবেচিত না-হয়ে শিকার হয় বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার। নিজ পিতার অর্থে শিক্ষিত হয়েছে যে-স্বামী, শেষ পর্যন্ত তারই ভালোবাসার কাঙাল হতে হয় সেই নারীকে। শেষ রচনা ‘বাঁধনে’ও স্বামীর অন্যাসক্তির চিত্র পরিবেশিত হলেও উপস্থাপিত হয়েছে নারীর ভিন্নতর রূপ। এখানে নারী আর ভালোবাসার কাঙাল নয়, বরং শিক্ষিত ও চাকরিজীবী হওয়ার  কারণে বিধৃত হয়েছে তার ব্যক্তিত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় এবং শেষ পর্যন্ত স্বামীকেই নতি-স্বীকার করতে                  হয়েছে, পরিত্যাগ করতে হয়েছে অন্যাসক্তির অনৈতিক বিলাসিতা। সন্তানের প্রতি বাৎসল্যসূত্রে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের সংসারবন্ধন।

পুরো গ্রন্থে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর মনস্তত্ত্ব উন্মোচনের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। বাস্তব জীবনকাহিনির কাঠামোয় গল্পরস সৃষ্টির প্রয়াসটিও অভিনন্দনযোগ্য। r

শিল্পের সৌন্দর্যে

অশিল্পিত জীবনের বয়ান

নাসরীন জাহান

জলের রমণী দেখে

মৃত্তিকার খোয়াব

 

 

পারভীন সুলতানা

 

 

বিশ্ব সাহিত্য ভবন

ঢাকা, ২০০৫

 

 

৮০ টাকা

 

কটা সময় ছিল, যখন মৌলিক সাহিত্য সাময়িকীতে সহসা কোনো নারী-লেখকের লেখা ছাপা হতো না। নারীদের জন্য আলাদা মহিলা পাতা বরাদ্দ থাকত, তাদের রচিত সাহিত্য ছাপার জন্য। আরো গুটিকয় নারী-লেখকের মতো আমিও বলা যায় পাহাড় কেটে কেটে এগিয়ে যা ছেপেছি, যেখানে ভেদ নেই, তেমন সাহিত্য পাতাতেই। তখন পারভীন সুলতানার মধ্যেও আমি এই পাহাড় কেটে এগিয়ে অনির্বচনীয় লেখা প্রকাশ করার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হতাম। তাঁর শব্দের কারুকাজ, উপস্থাপনের স্বকীয়তা, মানুষের মন নিয়ে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান আমাকে বিমুগ্ধ করত। এখনো করে। তবে অনেক লেখকের মতোই আচমকা নিজেকে আড়াল করে ফেলায় কয়েক বছর তাঁর লেখা না দেখে হতাশ হয়েছি। এরপরে আচমকা ঝড়ের মতো তিনি অপূর্ব লেখার ভান্ডার নিয়ে এসে পত্রিকার পর পত্রিকায় নিজেকে মুখরিত করতে চাইলেও কী এক অজানা কারণে, তার আপসহীন একাকী চর্চা করে যাওয়ার প্রবণতার কারণেই নাকি, তার চাইতে অনেক দুর্বল লেখককে নিয়ে লেখকদের মুখর হতে শুনেছি, ‘তাঁকে নিয়ে নয়।’

গল্প-উপন্যাস বেরিয়েছে ইতোমধ্যে বেশ কটি। নানাভাবে বিলোড়িত করা তাঁর গল্পের বই জলের রমণী দেখে মৃত্তিকার খোয়াবের গল্পগুলো সম্পর্কে কিছু লেখার জোর তাগিদ অনুভব করছি। প্রথমেই শিরোনামগল্পে আসি। বেদে রমণী শুক্কুরজানের জীবন আজীবন জলের সঙ্গে বাঁধা। তার বুড়ো স্বামীকে নিয়ে এই জীবনে অভ্যস্ত তারও যখন বয়স বাড়তে থাকে, তার বোধ কোষের বিবর্তন শুরু হয়। এই গল্পের অত্যাশ্চর্য বর্ণনায় সাপের উপস্থিতি, সাপখেলা এসবের আড়ম্বর নেই। তারপরও নিদারুণ দক্ষতায় এসেছে জলের জীবনের রূপ। শুক্কুরজান এমনিতে কোনোদিন ডাঙ্গায় বাঁচার স্বপ্ন দেখেনি। কিন্তু আজব মানুষের বার্ধক্য। বার্ধক্যে সে ক্ষণে ক্ষণে মাটির জন্য আকুল হলেও তা উবে গেছে। কিন্তু এক স্বপ্নে যখন জলে ভাসা বেদেনিকে ফেরেশতা প্রশ্ন করে, তোমার মাটি কই – কী কইরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি? তখন অপেক্ষারত ফেরেশতাদের স্বপ্নে রেখে পারভীনের ভাষায়, ‘শত বছরের গজার মাছের মতো তড়পে একবার ডাঙ্গার মানুষ হতে চায়।’

‘শানে বান্ধা ঘাট’ গল্পটিই শুরু হয় নাম-পরিচয়হীন এক যুবকের রাত্রি-অভিযানের নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে পূর্বপুরুষের ভিটের দিকে              যাত্রা-বর্ণনা দিয়ে। না, শেকড়ের টানে নয়, আত্মীয়স্বজন পৃথিবী সবকিছুর প্রতি নৈর্ব্যক্তিক এই যুবক যায় তার ভিটের দিঘিতে ডুবে থাকা কথিত সিন্দুকের লোভে। পারভীনের বর্ণনায় ‘সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখে, ধবল জ্যোৎস্নায় সাগরদিঘির শান-বাঁধানো ঘাটে বসে আছে এক যুবক। চান্দের আলোঝরা স্ফটিকের মতো পানির নহর বইছে। দিঘির চারপাশ ঘিরে মালার মতো ফুটে আছে লাল পদ্ম। শত শত তারা টলটলে জলে প্রতিবিম্ব দেখে আলোকমালা জ্বেলেছে। যুবক জলে হাত বাড়াতেই শুরু হয়ে গেলো বুজরুকি – তোলপাড় শুরু হলো নিস্তরঙ্গ বুকে। আকাশের উজ্জ্বলতাকে ���ন করে দিয়ে ভাসতে শুরু করলো সোনার কারুকাজ খচিত সিন্দুক।’ পূর্বপুরুষ জমিদার, তারও পূর্বপুরুষদের রক্ত যুবকের দেহে। লম্পট হিংস্র বর্বর পূর্বপুরুষদের তীব্র ঘেন্না করলে নিজের মধ্যে তার প্রবহমানতার ঝলক, সেই যুবকই পূর্ণিমারাতে সিন্দুকের লোভে গিয়ে সেই দিঘির পাশে বসে অন্য মানুষ হয়ে যায়। নস্টালজিক এক বোধে তার অাঁধার সত্তাটা সিন্দুকের কথা ভুলে কেবল প্রকৃতি-দিঘির জল ছুঁতে উন্মুখ হয়ে ওঠে।

‘নামপরিচয়হীন’ গল্পটি অদ্ভুত ছায়াছন্ন পাহাড়ি এলাকায় কোনো এককালে ছিটকে পড়া এক হিজড়ার অনুভব নিয়ে রচিত। ছবিসহ পত্রিকায় ছেপেছিল দাদারা, কেউ নিতে আসেনি। এ-গল্পে এক হিজড়ার মনোপীড়নের সঙ্গে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে আদিবাসী সমাজের চিত্র। হিন্দু আর খ্রিষ্টানবেশিত অঞ্চলে ভেতরে তাকে তড়পায় মা-কে আম্মা, জলকে পানি ডাকার তৃষ্ণা। সময়ের বিবর্তনে দিকভ্রান্ত মানুষটি গির্জায় নতজানু হয় একসময় মথুরা নগরীতে যোগিনী হওয়ার স্বপ্নে। পারভীন পরক্ষণেই লেখেন, ‘নিজের অধরা যৌবন নিয়ে শরীর কাঙ্ক্ষায় নির্দয় মাটিতে আছড়ে পড়ে।’ ‘একজন কুমারী জননীর গল্পে’ কালো            কিশোরী ফর্সা সন্তানের লোভ একসময় গ্রামের অসহ্য পীড়ন তাঁকে অদ্ভুত জেদে অটল রাখে। তার গর্ভের ভ্রূণটির পিতা ভন্ড পীরের কথা তার মুখ দিয়ে বের করায় না। যদিও পারভীন বিষয়টি শৈল্পিকভাবে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন।

‘কবিচন্দ্রপুর থেকে ধানমন্ডি অতঃপর মারফত আলী’ বর্ণিত হয়েছে গ্রাম্য কৃষকদের ধনী চিত্রশিল্পী সন্তানের বাড়িতে অসহ্য মিথ্যার মধ্যে নিজেকে নিরন্তর ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার মধ্যে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি পাওয়া এই শিল্পীর পিতার সাক্ষাৎকার নিতে এলে তাকে যেভাবে পূর্বপুরুষদের ধনাঢ্য জীবনের কথা, শুদ্ধ কথা অন্তত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে শেখানো হয়, মারফত আলীর বেদনা, এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া আমাদের হৃদয় স্পর্শ করলেও চিত্রকরের চরিত্র অনেকটাই আরোপিত মনে হয়েছে। আর এদেশের কোনো চিত্রকরের সাক্ষাৎকার নিতে এসে যাঁরা সাক্ষাৎকার নিতে আসেন, তাঁরা অভ্যস্তই থাকেন শিল্পীর বাবা যে-কোনো অবস্থার মানুষই হতে পারেন। আর চিত্রকর-শিল্পীরা তো তাদের বাপ-দাদাদের দৈন্যের কাহিনিই বেশি বলে যদ্দুর জানি।                এ-গল্পের কিছু বর্ণনা, ‘যার শৈশব কৈশোর কেটেছে জামবুড়ার ফুটবল খেলে, বাজানের জন্য আউশ ধানের ভাত বয়ে নিয়ে, সাল ডুরাকাটা তহবন্দ পিন্দে শেখবাড়ির বিরাট আঙিনায় ষাঁড়ের লড়াই দেখে…’ – মারফত আলীর স্মৃতি আমাদের নস্টালজিক করে তোলে।

‘মিঃ বুশ ও একজন ভিখিরির গল্পে’ লেখক ওভারব্রিজে ভিক্ষেরত খন্ডবিখন্ড মানুষদের পেট বাঁচানোর তাগিদে বাঁচার চাতুর্যকে নির্লিপ্ত চোখে নিরীক্ষণ করেছেন। শুরুটাই এমন – ‘মিঃ বুশ যখন একবিংশ শতকের ভিয়েতনাম বানানোর পরিকল্পনায় হোয়াইট হাউজের লৌহকঠিন নিরাপত্তায় থেকেও বেয়াদব দুশ্চিন্তায় অস্থির, তখন ইজ্জত আলীর চিন্তা নিজের নুলো হাত আর পা নিয়েই ব্যস্ত। ফার্মগেটের ওভারব্রিজে সে ক্রাচে ভর দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আসে।’ এরপরই এসে দাঁড়ায় ইজ্জত আলীর অস্তিত্ব সংকটের ভয়। কেননা, ওভারব্রিজে উঠেই সে দেখে, ‘কলিজা বরাবর বিশাল ঘাওয়ালা  এক ভিখিরি’ যাকে ইজ্জত আলী ‘ব্যবসায়ী’ অভিহিত করে… সে পড়ে আছে এবং তার ওপর মাছি ভনভন করছে। শুরু হয় তার চাইতে করুণাপ্রার্থীর সঙ্গে তার নিজেকে ব্যান্ডেজে বেঁধে মুরগির রক্ত দিয়ে আরো করুণ করে ওই ভিখিরির          সমান্তরালে যাওয়ার নিষ্ফল প্রতিযোগিতা।

কিন্তু দিনের পর দিন ওই ভিখিরি আরো বীভৎস, আরো করুণ কাতর হয়ে তড়পাতে থাকলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেতে থাকা ইজ্জত আলী বুশবিরোধীদের মিছিল দেখে…, আচমকা নিজের নুলো কিন্তু ক্ষুদ্র দেহটাকে দেখে এক অদ্ভুত ‘ইজ্জত’বোধের আনন্দে একই সঙ্গে সে ঘাওয়ালা আর বুশকে করুণা করার তৃপ্তি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। পারভীনের প্রত্যেকটা গল্পের বিষয় আলাদা। কোনো কাহিনি, নাটকীয় চমকের আড়ম্বর নেই। তবে সাবলীলভাবে এগিয়ে যাওয়া একটি গল্পের নাটকীয়তা ভীষণ নাড়াদায়ক। এক নারী পেইন্টার এক মেয়ে বান্ধবীর সঙ্গে তার গ্রামে কী গ্রাম পাহাড় নদীর সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হয় কাজল খাতুনের সঙ্গে, যেখানে অবৈধ সন্তানের জননী গ্রামে কাউকে না বলা কাহিনি পেইন্টারের কাছে বয়ান করে। পারভীনের ভাষায়, ‘কারণ কেবলই শারীরিক কামনা চরিতার্থে স্খলিত বীর্যে জননী হতে অনিচ্ছুক এই যুবতীভৃত্যা গর্ভধারণের ফাঁদে আটকে যায়।’ স্বভাবতই গৃহচ্যুত হয় সে। রজ্জব আলী মুরগির মতো ঘুরে ঘুরে এটা-ওটা খেয়ে বাঁচে। সময়ের গর্ভে একসময় এসব স্মৃতি ভুলে দাম্পত্যে সুখী পেইন্টার ধনী শিক্ষিত স্বামীর সঙ্গে সেই গ্রামে গেলে কাজল খাতুন আচমকা ‘রজ্জবের পিতা’ বলে পেইন্টারের স্বামীর দিকে আঙুল তুললে নিপুণতায় শেষটাকে চরমে না নিয়ে লেখক শেষ লাইনে লেখেন, ‘আমার বুক চিরে একটা অসুখী দীর্ঘশ্বাস বিরান হাওরের কঠিন শূন্যতায় লাফিয়ে পড়ে।’

সব গল্প নিয়ে না লেখার সীমাবদ্ধতা নিয়েই বলবো, গভীর বিষয় নিয়েই হয়তো চারপাশে ভাষার আড়ম্বরের ধার না ধেরে অনেকে ভালো গল্প লেখেন। তবে পারভীন সুলতানার একবারে শেকড় ধরে টান দেওয়া রূপক পরিপূরক অলংকারময় ভাষার গল্প পাঠ করে আমি অত্যন্ত ভালো কিছু গল্প পড়লাম… নিঃসন্দেহে এই কথা বলব। r

পাখির জীবন,

তবু মায়া রয়ে যায়

চঞ্চল শাহরিয়ার

সাতচলি�শের বঙ্গভঙ্গ, উদ্বাস্ত্ত সময় এবং আমাদের মিনা পরিবার

 

লেখক সৈয়দ মনোয়ার আলী

 

সাহিত্য প্রকাশ

ঢাকা, ২০১৩

 

৩০০ টাকা

 

জী

বন নাটক নয়। নয় গল্প-উপন্যাস বা সিনেমার রঙিন ভুবন। তবু এ-জীবনের কিছু টুকরো স্মৃতি, কিছু ক্ষোভ, কিছু কষ্টবোধ, কিছু শোক-তাপ-অনুভূতি, বঞ্চিত আর বঞ্চনার উজ্জ্বল বাস্তবতা আমাদেরকে বিস্মিত করে। জীবনে বেঁচে থাকা আর টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম, ছিন্নমূল মানুষের বহুমুখী ভাবনা আমাদের কঠিন সময়ের সাক্ষী। এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে আমাদের সাহিত্যে লেখা হয়েছে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস। ইতিহাস এ সময়ের সাক্ষী। সাক্ষী উনিশশো সাতচলি�শের বঙ্গভঙ্গ আর উদ্বাস্ত্ত সময়ের।

ইতিহাস প্রিয় বিষয় বলেই সৈয়দ মনোয়ার আলীর লেখা গবেষণাগ্রন্থ সাতচলি�শের বঙ্গভঙ্গ, উদ্বাস্ত্ত সময় এবং আমাদের মিনা পরিবার আমাকে আকর্ষণ করেছে। আকর্ষণ করেছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মাতৃভূমি থেকে উৎখাত হয়ে অসংখ্য পরিবার পাড়ি দিয়েছিল অজানা-অচেনা ভূখন্ডের দিকে। সীমান্তের এ-প্রান্ত থেকে        ও-প্রান্ত, ও-ধার থেকে এ-ধার। উদ্বাস্ত্ত পরিবারের বাকি জীবনে বহন করা দুঃখস্মৃতি। সেই স্মৃতি আরো একবার উসকে দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।

দেশভাগের পটভূমিকায় দেশভাগের ষাট বছরেরও বেশি সময় পর উদ্বাস্ত্ত এক বালক পরিণত বয়সে ধীরে ধীরে গেঁথে তুলেছেন দেশভাগ ও দেশান্তরী হওয়ার গল্প। এই গল্প, এই কাহিনি লক্ষ উদ্বাস্ত্ত মানুষের। তাঁদের বেদনা ও জীবনসংগ্রাম বোঝার অবলম্বন।

বইটিতে বর্ণিত হয়েছে মিনা পরিবারে মীর এবং সৈয়দ পদবি প্রসঙ্গ। লেখকের মাতৃভূমি ভারতের বসিরহাটের জীবন, সে-কালের ধর্ম-সংস্কৃতি, কলকাতার ভয়াবহ রাজনৈতিক দাঙ্গা, ছিন্নমূল মানুষের কাফেলার কথা। চোদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, নতুন দেশ, নতুন ভিটেতে খুঁটি গাড়া কম কথা নয়। হিন্দু-মুসলমানের চিরকালীন বৈষম্য, সৈয়দ পরিবারের সন্তান হওয়ার বিড়ম্বনা, কথায় কথায় ‘রিফুজি’ গালি শোনা আর নিরন্তর আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটানোর করুণ কাহিনি লেখক মনোয়ার আলী যথেষ্ট দরদ দিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন তাঁর পবিরারের উলে�খযোগ্য সব ঘটনা। বারবার বাসা-বদল, অভাব, মায়ের করুণমুখ, নিজের ছন্নছাড়া জীবন, এ যেন উদ্বাস্ত্ত বাঙালির হৃদয়ের কথা।

আনন্দ-বেদনার বর্ণনা আমরা বালক মনোয়ারের মুখেও শুনেছি। স্মৃতি হাতড়ে লেখা এসব কাহিনি আমাদেরকে যেমন ব্যথিত করেছে, তেমনি বালক বেলার কিছু সুখস্মৃতি মন ভালো লাগায় ভরিয়ে দিয়েছে।

বালকবেলার কথা লিখতে গিয়ে সৈয়দ মনোয়ার আলী লিখছেন, পশ্চিমবঙ্গের সব গ্রাম আর দশটা গ্রামের মতোই। তবু নানিবাড়ির গ্রাম উনাকে দারুণ টানতো। খুবই ভালো লাগতো নানিবাড়ি। কারণ নানি কখনো মা-আববার মতো বকাঝকা করতেন না। শাসন করতেন না। ‘পড়াশুনা কর পড়াশুনা কর’ বল বাড়ি মাথায় করতেন না। বালক মনোয়ার নানাবাড়িতে ভরদুপুর বেলা না ঘুমিয়ে ফড়িং ধরার জন্য  ছোটাছুটি করে ঘর্মাক্ত হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পেরেছেন। আহ্! কী আনন্দ। কী স্বাধীনতা।

এ তো দুরন্ত বালকের স্বপ্নমাখা দিন। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনায়াসে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। মনোয়ার সাহেব তাই পার করেছেন ভারতের বসিরহাটের জীবন ছেড়ে এ-বঙ্গের খুলনার নানা রঙের দিন। লিখেছেন খুলনার সেনহাটির গল্প – যাযাবর জীবন, খুলনার নতুন ঠিকানা, দেশি বনাম উদ্বাস্ত্তর দ্বন্দ্ব, বিহারি আর মহান মুক্তিযুদ্ধের বৈরী সময়ের কথা।

বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে লেখা এ-বইটি পড়তে পাঠক একটুও ক্লান্ত হবেন না। এবং ইতিহাসের মুখোমুখি হয়ে, জীবনের চরম সত্যকে জানতে পেরে উপকৃত হবেন। পুনর্বার। কবি মন এবং রাজনৈতিক- সচেতন হওয়ার কারণে সৈয়দ মনোয়ার আলী পৃথক পৃথকভাবে পর্ব সাজিয়েছেন আকর্ষণীয়ভাবে। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের স্পর্শ পাওয়া এ-বইটি তাই নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক সৈয়দ মনোয়ার আলীর লেখালেখির অনুশীলন দীর্ঘদিনের, তবে এটিই প্রথম প্রকাশিত বই। জাতিগত বিভেদ, এক শ্রেণির মানুষের স্বার্থপরতা, রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার ইতিহাস তাই নিবিড়ভাবে বইটিতে বর্ণিত হয়েছে।

বইটির প্রচ্ছদ, ছাপা ও বাঁধাই মজবুত আর দৃষ্টিনন্দন। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ স্বাধীনতার বেদিমূলে উৎসর্গিত লাখ লাখ শহীদ, সম্ভ্রমহারা নারী ও ছিন্নমূল মানুষের স্মরণে উৎসর্গিত বইটির ব্যাপক প্রচার আশা করি। r