বটতলার বই ও তার বিজ্ঞাপন

সোমব্রত সরকার

বাংলা ছাপাখানার অাঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে হুগলি-শ্রীরামপুর। এখানে তার বহাল তবিয়তে বাল্য-কৈশোর কাটলেও যৌবনের রং গিয়ে লেগেছে কলকাতাতেই। আর স্বভাবতই যৌবনের স্বাভাবিক ধর্ম মেনেই তার ভেতরেও যৌন কৌতূহলের চাগাড় দিয়েছে। যার কারণেই হয়তো-বা বাংলা ছাপা উনিশ শতকের শুরু থেকেই কলকাতায় ছাপাখানার ব্যাপ্তি নিয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, তার ওপর নেমেছে একেবারে চোখরাঙানি। বয়ঃসন্ধির শাসন। এতসব দুষ্টুমি, দামালপনার বাড়-বৃদ্ধি ঘটেছে তার জোড়া বটের ছত্রছায়ায়। শোভাবাজার রাজবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় সে একচ্ছত্র চাতাল পেয়ে ‘বান্ধা বটতলা’র কেবলই একটেরে আদরে-সোহাগে বড় হয়ে যে কেবল লোফার-লাফাঙ্গায় পরিণত হয়ে উঠেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তথাপি বটতলা তার ‘হাবিজাবি মুদ্রণে’র তকমা পেয়েও নানা প্রশাসনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বাধা পেরিয়েও উনিশের লোকশিক্ষা ও লোকচৈতন্যের সিংহাসনখানিও যথাযথভাবে দখল করে রেখেছে। এটা বোধহয় তার যৌবনের সহজাত জেদ ও জেহাদ। সেজন্যেই বটতলা তরতর করে এগোতে পেরেছে, তার প্রসার, বিস্তার এতখানি বাড়িয়েছে যে, কলকাতা-ঢাকার একটা যোগসূত্র গড়ে তুলতে পেরেছে নতুন এই সাহিত্যধারায়। যেখানে জীবন-ধারণের স্বাভাবিক টুকিটাকি শিষ্টাচার-পদ্ধতি, দেশি-বিলেতি আচার ব্যবহার শিক্ষা থেকে দিনানু-দৈনিকতা বাড়ি ও রাস্তা তৈরি শিক্ষা, ব্যবসায় শিক্ষা, চিকিৎসাবিদ্যা, যোষিদ্বিজ্ঞান-নারীদের অবশ্যজ্ঞাতব্য বিস্ময়সমূহ, গেরস্থালি, ব্যায়ামশিক্ষা, ঘড়ি-সারানো শিক্ষা, রাবার স্ট্যাপ প্রস্ত্ততপ্রণালি, ফটোগ্রাফি শিক্ষা, আতশবাজি তৈরি শিক্ষা, শুদ্ধভাবে নাম লেখার শিক্ষা, অদৃশ্যলিপি লিখন পদ্ধতি, শবদাহ পদ্ধতি, চাকরি পাওয়ার পদ্ধতি, প্ল্যানচেট শিক্ষা, অপঘাত-মৃত্যু নিবারণ পদ্ধতি, আইকিউ টেস্ট, জাল-জুয়াজুরি এবং ছাত্র-ঠকানো প্রশ্নোত্তর শিক্ষা, কলকাতা স্ট্রিট গাইডের মতো খুঁটিনাটি ব্যবহারিকও কোনোভাবেই বাদ পড়েনি। ব্যবহারিক ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা, ধাঁধা-ম্যাজিক-তাস-পাশা-দাবা খেলার বিনোদন, গুপ্তবিদ্যাও বাদ যায়নি, রয়েছে সামাজিক উৎসব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাভিচার, দুর্ঘটনা, চমকপ্রদ ঘটনা, রান্না, কৃষি, আমোদ, নাটক, নকশা, যাত্রা-কবি-পাঁচালি, আখ্যান, উপন্যাস ইত্যাদি বিষয়ক বই। তবু গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো গুপ্তকথা, রতিশাস্ত্র, কাহানি-কিস্সা, যৌনতা উদ্রেগকারী প্রহসন, বেশ্যাকাহিনি ও গাইডের মতো রগরগে সাহিত্যধারাই কেবল শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব নিয়ে বাজার গরম করেছে। যে-কারণে ধর্ম, ভেদাভেদ, জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠা বটতলা হয়তো এক্ষেত্রে কিছুটা ফায়দাবাজির হলেও অহরহ নাম কিনেছে নেক নজরের। তার ভেতরেও বিলো ক্লাসের এই হেটো সংস্কৃতি নাম পেয়েছে, ফায়দা তুলেছে অশ্লীলতার দুন্দুভি বাজিয়ে-টাজিয়ে। বটতলার প্রকাশকেরা ফায়দাবাজিটি বেশ ভালো রকমভাবে রপ্ত করে নিয়েছে বলেই বাজার পেয়েছে বই।

বটতলাতে মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই যে সেখানে কেবল কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্যের ষড়রিপুরই শুধু বিস্তার হয়েছে তা তো নয়। বটতলা বরাবরই নজর দিয়েছে মানুষের ব্যবহারিক দিক-প্রতিদিকগুলোতেও। শিশুপাঠ্য বাংলা বানান ও ব্যাকরণ বই, নীতিশিক্ষা সে ছাপেনি ঠিকই উনিশের শিক্ষা-উপনিবেশটির প্রবল বিস্তারে। সেখানে সে সহজাত কারণেই আসলে মাথা গলায়নি। তৎকালীন বাঙালি দরিদ্র, অল্প-শিক্ষিত মানুষের জগৎকেই বটতলা শিরোধার্য করেছে। গ্রামের বৈষ্ণবী, পাঠশালা থেকে অক্ষরজ্ঞানপ্রাপ্ত মহিলা যেমন তার ক্রেতা হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা পেয়েছে, তেমনি কারিগরি শিক্ষানবিশ, শহরাঞ্চলের সরকারি কাজে কর্মপ্রার্থী ও নিত্যনতুন ব্যবসা এবং চাকরিতে নিযুক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মচারীদেরও চাহিদা ও প্রয়োজন মিটিয়েছে। ধনী দুলালদের  ইন্দ্রিয়-তাড়নার মুনাফা সে প্রবল অর্থে লুটেছে ঠিকই তবু সর্বজনীন, সাধারণের পাশে থাকার লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই হারিয়ে বসেনি। কেননা তার ঘরের লেখকদের পারঙ্গমতা নিয়ে সে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। তাঁদের সাধু বাংলায় অনুসৃত ব্যাকরণ ও বানানের বড়ো একটা রপ্তনবিশের ক্ষমতা নেই। চলতি কথোপকথনে ব্যবহৃত শব্দ, প্রবচন, উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখার অনায়াসদক্ষতার ঝুলি থেকে তাই বেরিয়েছে নানা রীতিভেদের ঝাঁঝালো পসরা। সঙের গানে, পাঁচালির ছন্দে, পয়ার, ত্রিপদী বা চৌপদীতে, নাটকের বুলিতে এক ফর্মা নামিয়ে দিয়ে বটতলা তার পরিসরের পসরা সাজিয়ে নিয়েছে বিনোদনের ক্ষেত্রটিতেও। সেখানে সে আবার জাতধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে ভালো রকম উদারতা দেখিয়েছি মুনাফাটি বেশ ভালোভাবে জেনে-বুঝে, যার কারণে এসব ক্ষেত্রেও সে জোরতোর বিজ্ঞাপন করেছে। ইন্দ্রিয় তাড়নের চাহিদা ও চাল অনুযায়ী বইয়ের অবতরণিকায় নজরকাড়া ভাষার ঢংটি সে ব্যবহারিক গৃহস্থালির ভেতরও বেশ বাজার ধরার সূক্ষ্ম চালে ঢুকিয়ে নিতে পেরেছে। আর এখানেই তার নতুন ভাব-ভাষায় বিজ্ঞাপন পরিবেশনের অভিনবতা। বটতলার বইয়ের বিজ্ঞাপন লেখক, মুদ্রক বা প্রকাশকের কাহিনির কায়া নির্মাণে বাজারচলিত নানা ঘটনা-তাৎক্ষণিকের অধর্মের ক্ষয়, পাপের পরিণতি মৃত্যুর নীতি-উপদেশের আখ্যানকথাতে থেকেও সাবেক রুচির বাইরে বেরোতে পেরেছে। এই রীতিতে গেরস্থালি গ্রন্থও বাদ পড়েনি। কেননা বটতলাতে লোক-ঠকানো গোত্রের মোড়ক থাকলেও ব্যবহারিক গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে সে সাধারণের প্রয়োজনীয়তার কথাই বড় বেশি মাথায় রেখেছে। কেননা বটতলার আসল ক্রেতাগোষ্ঠী তারাই। সেজন্য নবন্যাস পড়ার পাঠককে সে বিজ্ঞাপনে আকর্ষণের চাগাড় দিয়েও ধারক-বাহক ক্রেতাগোষ্ঠীর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দায়িত্বের সঙ্গেই সহায়ক হয়েছে। বটতলার এই দায়িত্ব-তৎপরতা-বিবেকটির দিকে আশ্চর্যজনকভাবে কেউ একবার ঘুরেও তাকাননি। সমকালেও বিদ্বজনেরা তাকে নিয়ে রাজনীতির ফায়দা তুলেছেন। বটতলার এটাও একটা অভিনন্দিত ফায়দাবাজি। সমকালীন প্রতিষ্ঠিতরাও যে দেগে-দেওয়া বটতলার শ্লীল-অশ্লীল আদিরসের ফায়দাটি নেননি তা তো নয়। বটতলার নবন্যাস, গুপ্তকথার বিষোদ্গার করেছেন তাঁরা। কবে-টরে বটতলাকেই সাঙ্গ করেছেন নিজেদেরই রচনায়। রামমোহনের মতো প্রগতিবাদী বটতলার ফায়দাটি নিয়েছেন একেবারে গ্রামগঞ্জের বাজারে বই ফেরিওয়ালার হাত ধরে নিজ বক্তব্যটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বঙ্কিমচন্দ্রও তো কম কিছু নখরাবাজি করেননি। কথায়-কথায় ‘অশ্লীলতাদোষে’ অভিযুক্ত বঙ্কিমী ব্যারাম টপকেই এই তিনি আবার আসমানীর রূপ খুলে বটতলার ঢঙে বিষবৃক্ষের দেবেন্দ্রর মুখে বসিয়ে দিয়েছিলেন আদিরসের গান, তারপর ব্যারামে বশীভূত হয়ে বইয়ের পরবর্তী সংস্করণ থেকে সেটিকে বাদ দিয়ে মান বাঁচিয়েছিলেন। মধু কবি, দীনবন্ধু বটতলার অবারিত অভিব্যক্তিতে মজেননি তা তো নয়। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা, জামাই বারিক, লীলাবতী – দুই নাটককারের দুই-দুই চার সৃষ্টিই এর নিদর্শন তোলে। কালীপ্রসন্ন, ভবানীচরণ ভাষার গুণে বটতলার গোত্রভুক্ত না হলেও এই দুজনকেও তো বটতলা পিছু ছাড়েনি। ভবানীচরণ তুখোড় বই-ব্যবসায়ী। তাই বটতলার মুনাফা তিনি বুঝবেনই। আর কালীপ্রসন্ন নিজে না গেলেও হুতোমি বয়ানে বটতলায় যে সহজলভ্য ছিলেন তার প্রমাণ উনিশ শতকের এই বিখ্যাত বইটির বিজ্ঞাপনেই তো রয়ে গেছে। ১৮৬২-র বিজ্ঞাপনী বক্তব্যে উঠে এসেছে সেই ‘বটতলার বেসাতি’র কথা। নামি নভেল বা আখ্যানকলা জায়গা পেয়েছে সেখানে বটতলার বইয়ের বিজ্ঞাপনেরই হরেদরে। বিরহের অশেষ দশা, স্ত্রীশিক্ষা, সর্পমন্ত্র সংগ্রহ, কুলটা কুলের কাঁটার পাশেই বহাল তবিয়তে জায়গা নিয়ে নিয়েছে হুতোম।

লেখা হয়েছে :

হুতোম প্যাঁচা লিখিত পুস্তক সকল আবশ্যক হইলে দরজীপাড়া গুলু ওস্তাগরের লেনে বসু কোম্পানির ২২ নং ভবনে, পুরান সংগ্রহ যন্ত্রে শ্রীযুক্ত রাধানাথ বিদ্যারত্ন মানিকতলা শিবতলাস্থ শ্রীযুক্ত বাবু মধুসূদন মুখোপাধ্যায় তথা বাগমারীর গোপীনাথ চক্রবর্তীর নিকট ও ভাস্কর, পরিদর্শক ও প্রেসিডেন্সী যন্ত্রে অনুসন্ধান করিলে পাইবেন। এতদ্ভিন্ন শহরের প্রায় সমস্ত পুস্তকালয় ও বটতলার শ্রীযুক্ত বাবু রাধামাধব শীল প্রভৃতির দোকানেও বিক্রীত হইয়া থাকে।

প্রকাশক বা মুদ্রাকর ও লেখকের ঠিকানাতেই বই পাওয়াটা শুধু বটতলা কেন উনিশের দ্বিতীয়ার্ধের বইপুস্তকের রীতি। ব্যক্তিবিশেষের ঠিকানাতেও অবশ্য বটতলার বইয়ের প্রাপ্তিসংবাদজনিত বিজ্ঞাপনেরও কিছু দেখা মিলেছে। পথপুস্তিকার নামকরা প্রকাশক সেখ জমিরউদ্দীর বই প্রাপ্তিসংবাদের বিবরণে মলাটে লেখক-প্রকাশক নয়, এরকমই এক ব্যক্তিবিশেষের দেখা মিলেছে।

মলাটে লেখা রয়েছে : ‘গরানহাটার দক্ষিণাংশে শ্রীমতী পান্নাবিবির বাটীতে তত্ত্ব করিলে পাইবেন।’

১৮৮১ সালে প্রকাশিত হনুমানচরিত বইটিতেও প্রাপ্তিস্থান হিসেবে এরকমই এক ব্যক্তিবিশেষের নাম রয়েছে। আবার আরেক ধরনের বিজ্ঞাপনও বটতলার বইয়ের মলাটে দেখা মিলত। সেটা হলো, আনুকূল্য স্বীকৃতির বিজ্ঞাপন। বটতলা তার বইয়ের মলাটে এসবও ধারণ করেছে। ১৮৬৩-তে ছাপা হয়েছিল ক্ষীরোদগোপাল মিত্রের বাল্যবিবাহ উচিত নয় বইটি। নবন্যাসের নামি লেখক ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই বই ছাপার তদারকিতে। তাই ক্ষীরোদপ্রসাদ ঋণস্বরূপ তাঁর বইয়ের মলাটে ভোলানাথের আপনার মুখ আপনি দেখের ‘অতি সত্বর’ প্রকাশের এক বিজ্ঞাপন জুড়ে দেন। ঠিক একই কায়দায় রামতারণ সান্যালের বণিক দুহিতা নাটকের মলাটেও রীতিমতো তিন পাতাজুড়ে রয়েছে রাধানাথ মিত্রের বইয়ের বিজ্ঞাপন। সেখানে বইয়ের প্রশংসাসূচক অনুচ্ছেদটি তো যথারীতি আছেই। কোনোভাবেই বাদ যায়নি উৎসর্গপত্রটি পর্যন্ত। কেননা সেটি যে রামতারণের প্রতিই নিবেদিত। বটতলা এই রকম আনুকূল্যের ছোঁয়ালাগা স্বযাচক ঢাক-পেটানো বইয়ের বিজ্ঞাপন নির্দ্বিধায় ছেপেছে কখনো মলাটে, কখনোবা ভেতর পাতার অনুচ্ছেদে।

বটতলা যে ভালোরকম পয়সা করার জায়গা ছিল তার নজির বোঝা যায় যখন জাত-ব্যবসা ছেড়ে লোকজন এসে নেমে পড়ে এখানে বই-ব্যবসায়। তেমনি একজন হলেন বৈষ্ণবচরণ বসাক। দর্জিপাড়ায় তিনি বিরাট মাপের বইয়ের দোকান ফেঁদেফুদে বেশ সুনামের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই ব্যবসা চালাচ্ছিলেন। তাঁর ‘সমুন্নত – সাহিত্য-প্রকাশ কার্যালয়ে’র পুস্তক তালিকায় সেই বিজ্ঞাপনটিও জ্বলজ্বল করে। ধর্মগ্রন্থ, চিকিৎসা, ব্যাকরণ, বিনোদন, সাংসারিক-ব্যবহারিক হরেক মালের মজুদদার তিনি। তাই অনায়াসে তাঁর বিজ্ঞাপনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে তিনি ডাক দিতেই পারেন। এতে তাঁর হক রয়েছে।

গার্হস্থ্যকোষের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছেন :

শিক্ষিত, অশিক্ষিত, যুবক, বৃদ্ধ, ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, ছাত্র, আপামর সাধারণ ধার্মিক, সংসারী ও গৃহস্থ মাত্রেরই প্রতি পদবিক্ষেপে প্রয়োজনীয় সুখ-শান্তি, জ্ঞান ও বহুদর্শিতা প্রদায়ক দৈনিক সঙ্গী।

যদিও শ্রেণিকরণের রাজনীতিটাও আবার তাঁর প্রকাশনার সঙ্গে ভীষণভাবেই লেগে।  বই বিক্রির সময় সর্বশ্রেণি সব স্তর স্বাগত ঠিকই। এটি একটি বিজ্ঞাপনী কৌশল। ফায়দাবাজি। অথচ প্রকাশনাটি অফবিট করবার কায়দাবাজিটিও পুস্তক তালিকার মধ্যেই যে সেঁটে রয়েছে।

লেখা রয়েছে :

রাজা, মহারাজা, জমিদার ও পন্ডিত মন্ডলীর সাহায্যকৃত ২৫ বৎসরের বৃহৎ পুস্তকালয়।

বইয়ের বাজারে গোত্রনির্ণয়, শ্রেণিকরণ বটতলায় অবশ্য গা-সওয়া একটা ব্যাপার। বটতলা হেটা হয়েছে। হেটা করছে। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় তার মধ্যে অনেক ঝড়ই বয়ে গেছে বলেই বোধহয় সমকালীনতাকে সে কখনো অস্বীকার করতে পারেনি। বরং উদারতা দেখিয়েছে। তবে এই উদারতার পেছনে ব্যবসায়িক একটা রাজনীতি ছিল। সে থাক। সেটি শুধু বটতলাতে কেন, সব ব্যবসাতেই একই নেচার। বটতলা তার অভূতপূর্ব ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করেছিল প্রধানত উনিশের প্রথমার্ধের শেষলগ্ন থেকেই। আর এই স্বর্ণযুগটা মোটামোটি বলবৎ ছিল চল্লিশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত। যদিও সুকুমার সেন মশায় এর সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলেন ১৮৪০ থেকে ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তবে এই কালপর্বে বটতলা অবশ্য তার খদ্দের ধরতে মনোনিবেশ করেছে গাঁয়ের কৃষক-কারিগরের দিকেও যেমন, তেমনি শহরে-মফস্বলে নিযুক্ত নতুন পেশাধারীদেরও যুক্ত করে নেওয়ার জন্য তৎপরতা দেখিয়েছে। তার বইয়ের বিজ্ঞাপনেই এই দুই শ্রেণির পাঠক ধরবার কলাকৌশলটি রয়েছে।

উনিশ শতক জুড়েই বটতলা জমি-সংক্রান্ত আইন, ফৌজদারি আইনসমূহ, উকিল-পুলিশের বৃত্তিভোগী মানুষদের জন্য সহজ ভাষার বই প্রকাশ করেছে। এসব বই সরাসরি পরীক্ষা পাসের সাহায্যার্থে প্রণীত বলে বিজ্ঞাপিত অনুচ্ছেদই জোড়া রয়েছে। ১৮৫১ সালে প্রকাশিত পুলিশ দর্পণ ও দারোগা গাইডে বলা হয়েছে, পুলিশ সংক্রান্ত আইন-কানুনের বিবরণী, দারোগাগিরি পরীক্ষা পাসের জন্য প্রার্থীদের তৈরি করার উদ্দেশ্যে রচিত। বটতলা এভাবেই সরাসরি বইয়ের কনটেন্টকে বিজ্ঞাপিত করেছে মলাটে বা ভেতরে আলাদা অনুচ্ছেদে। ১৮৫৩ সালে যদুনাথ মল্লিক রচিত মাল-সংক্রান্ত আইন উকিলদের পরীক্ষা পাশের সাহায্যার্থে রচিত বলেই বিজ্ঞাপিত হয়েছে। সরাসরি বিষয়ানুগ বয়ানে পাঠক টানার প্রয়াস বটতলার বইয়ের বিজ্ঞাপনের খোলাখুলি ব্যবসারই একটি বড় দিক। কেননা, এসব বইয়ে তো আর রিপু ঝলসানির বালাই নেই। তাই মোড়ক, চটক, ইন্দ্রিয় উদ্বেগকারী বার্তার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে তাই একেবারে সরাসরি প্রয়োজনীয় অ্যাপ্রোচ। রংঢঙের বালাই নেই। এই ধরনের বইয়ের বিজ্ঞাপনে বটতলা স্মার্ট, সময়ানুগ।

বটতলা মানুষের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা নিয়ে তার অাঁতুড় সময় থেকেই ভেবেছে। এখানকার ছাপাখানা থেকে তাই হরেক চিকিৎসাবিদ্যার বই বেরিয়েছে। তবে সব বইয়ের বিজ্ঞাপনেই বিষয়বক্তব্য এক। তেমনি এক বই চিকিৎসার্ণব। ১৮৫৫ সালে ছাপা। প্রচুর বিক্রি হয়েছিল এ-বই। বিজ্ঞাপনে বলা ছিল, এ বইটি প্রণীত হয়েছে সেসব চিকিৎকের কথা ভেবে, যাঁরা তাঁদের রোগীদের কাছ থেকে মাত্র চার আনা পারিশ্রমিক পান। ১৮৫০-এ প্রকাশ পায় জলচিকিৎসা বইটি। সেখানে জ্বর, বাত, হাম, বসন্ত, পৈটিক পীড়ার নিরাময়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জলপ্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। এসব চিকিৎসাগ্রন্থের বিজ্ঞাপনে দুটি দিক রক্ষা করা হতো। এক. পাঠকদের স্বাবলম্বী করে তোলার প্রচেষ্টা। দুই. গরিবদের চিকিৎসায় নিযুক্ত ডাক্তারদের সুবিধা। মনে রাখতে হবে যে, ১৮৫১ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে বাংলাতে শিক্ষাদানের জন্য বিশেষ পাঠ্যশ্রেণি খোলা হয়। বটতলা তার ফায়দাবাজির স্বভাবগত গুণেই তখন এসব চিকিৎসাগ্রন্থ ছেপেছুপে মলাট-অনুচ্ছেদে আম-আদমির সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের সাহায্য করার ফিকিরে ঝোঁপ বুঝেই কোপ মারতে নেমে পড়ে। সময়ানুগ সুযোগও তাই বটতলার বইয়ের বিজ্ঞাপন বক্তব্যের এক বড় বিষয়।

বটতলার চিকিৎসাগ্রন্থের জের টেনেছে অবশ্য বেণীমাধব দে অ্যান্ড কোম্পানি। পাঁজিতে তারা হরবোসত আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছে। সানুবাদ ভাবপ্রকাশ, পথ্যাপথ্য ব্যবস্থা, আয়ুবের্বদ দর্পণ, মুলানুবাদ ভৈষজ্যরত্নাবলী, বিবিধ বিষ চিকিৎসাবলী – কিছুই সেখানে বাদ যায়নি। ভারতীয় ভেষজই উঠে এসেছে ‘পুস্তক-নামাবলী’র বিজ্ঞাপনী বক্তব্যে। বটতলার ব্যবহারিক গ্রন্থের অ্যাপ্রোচই সেখানে বলবৎ রয়েছে।

সানুবাদ ভাবপ্রকাশ গ্রন্থটির বিজ্ঞাপনী বয়ানে লেখা হয়েছে :

…মহাত্মা ‘ভাবমিশ্র’ প্রণীত আয়ুবের্বদের চূড়ান্ত গ্রন্থ। মূল ও অনুবাদ সম্বলিত। ইহাতে সমুদয় রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা, ঔষধের মাত্রাও প্রস্ত্তত করিবার প্রণালী, তৈল, ঘৃত, আসব, অরিস্ট, বটীকা প্রভৃতি প্রস্ত্ততের বিবরণ, ধাতুদ্রব্য শোধন, জারণ, মাড়ন প্রভৃতি আয়ুবের্বদোক্ত যাবতীয় চিকিৎসার বিষয় বিস্তারিত রূপে লিখিত আছে। বলা বাহুল্য, ইহার ন্যায় বৃহদাকারের আয়ুবের্বদীয় সংগ্রহ পুস্তক অদ্যাবধি প্রকাশিত হয় নাই। এমনকি এক ভাব প্রকাশ পাঠ করিলেই রীতিমত চিকিৎসা করিতে পারিবেন। মূল্য উৎকৃষ্ট কাগজের পাঁচ টাকা, মাশুল দুই আনা।

উনিশের শেষার্ধের (১৮৯৫-৯৬) এই বিজ্ঞাপন দেখে এটা স্পষ্ট, বটতলার সস্তা ছাপা, ঢিলঢিলে বাঁধাইয়ের বাইরে দাঁড়াতে চাইছে বটতলার ব্যবহারিক। বইয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিদ্যাকৌলীন্য। তাই গ্রথিত সংগ্রহের বিশদ ব্যবহারকারী ক্রেতাকে জানাতে বাধ্য থাকছেন গ্রন্থ-প্রকাশক, কেননা উনিশের এই পর্বে বইয়ের বাজারে চাহিদার গোত্রভাগ ঘটে গেছে ভীষণভাবে। কোন বিষয়ের বই কীভাবে কী ভাষায় কতখানি ডিটেলে এবং কী চেহারায়, কোন কাগজে, কীরকম বাঁধাইয়ে, কোন নির্দিষ্ট মূল্যে ছাপলে লোকে কিনতে পারে, তা নিয়েও মাথা ঘামাতে হচ্ছে প্রকাশককে। ব্যবহারিক গ্রন্থের ক্ষেত্রে এই নির্ধারণ আরো মারাত্মক। কেননা, সেখানে বই যতখানি পাঠ্য বিষয় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ তার থেকেও বেশি ভূমিকা তার রোজকার জীবনপথের সহায়িকার। বটতলার সহায়িকাগুলো একেবারে আম দরবারের কথা ভেবে সহজলভ্য করেই রাখা হতো। তবে বটতলা অতিক্রান্ত পর্বে বটতলাতেই  হাত-পাকানো নামি প্রকাশক ছাপছেন সেই রোজকার ব্যবহারিক। তাই তিন কৌলীন্যই যোগ হয়েছে সেখানে – অর্থকৌলীন্য, বিদ্যাকৌলীন্য, গ্রন্থকৌলীন্য। বিজ্ঞাপনটিতে সেই নজিরই রয়েছে। উৎকৃষ্ট ছাপায় গ্রন্থকৌলীন্য, মূলানুগ অনুবাদে ও মূল সংযোজনে বিদ্যাকৌলীন্য এবং চড়া দামে নামজাদা প্রকাশনার ব্যান্ড অর্থকৌলীন্যের ধারাটি এখানে বলবৎ রয়েছে। উনিশের শেষদিকে বটতলাজাত ব্যবহারিক এভাবেও কৌলীন্যের ছোঁয়া পেতে চাইছে। এ লেবেলের বাইরে বেরোতে গিয়ে তাই ভাবতে হচ্ছে প্রকাশককে রীতিমতো এখন বিজ্ঞাপনের ভাষা নিয়ে। কেননঋ, ব্যবহারিক গ্রন্থের মূল কথাটি হলো গিয়ে স্বকার্যসাধন-নিমিত্ত হকচকিয়ে ক্রয়। আজকের বইবাজারেও ঘটনাটি নিদেনপক্ষে সর্বাংশে সত্য। যে-জন্য বাংলা বইয়ের মার্জিত পর্বে বটতলার প্রকাশকও ঐতিহ্যবাহী উদাহরণে আধুনিক মডেলটিই সামনে রাখতে এতখানি তৎপর হচ্ছেন।

উনিশের দ্বিতীয়ার্ধেই বাঙালি জড়িয়ে গিয়েছে যান্ত্রিক গতিবেগের সঙ্গে। বঙ্গজীবনে এসে গেছে রেল। যাকে নিয়ে প্রথম প্রথম ভয় সংস্কারের বাধা আস্তে-আস্তে কাটিয়ে উঠেছে বাঙালি। নতুন এই যোগাযোগে ভালো-মন্দের বারোমাস্যা রচনাতেও পিছপা ছিল না ব্যবহারিক বটতলা। রেল-প্রহসনে তাই রেলযাত্রীর প্রথম চড়ার অভিজ্ঞতাজনিত ভীতি, পরবর্তীকালে ভাড়াবৃদ্ধি, দুর্ভোগ ইত্যাদি নিয়ে ভাবেনি বটতলা। সে ভেবেছে তার ইন্দ্রিয় জাগার দিকটি নিয়ে। প্রহসনে উঠে এসেছে বাড়ির পুরুষ দ্রুতযানে ঘন ঘন চাকরিস্থল থেকে চলে আসছে বলেই মেয়েরা সব ‘বছর-বিওনি’ হয়ে পড়েছে। তবে ইন্দ্রিয়জ্বালার দুর্নাম নিয়েও সে ব্যবহারিক ছাপায় অবশ্য মনটন দিয়েছে। তারই নিদর্শন রয়েছে তাঁর নির্ধারিত মাপ আঠারো পাতার চেনা পুস্তিকায়। বইটির নামপত্রেই রয়েছে ব্যবহারিক ঘোষণা।

লেখা হয়েছে :

যাঁহারা কলের গাড়ি আরোহণ করিয়া গমন করেন, তাঁহাদের তৎসংক্রান্ত বিঘ্ন নিবারণের উপায় প্রদর্শন।

১৮৫৫-তে বের হওয়া অক্ষয়কুমার দত্তের এই ‘বাষ্পীয় রথারোহী দিগের প্রতি উপদেশ’ পুস্তিকাটিতে যাত্রীভাড়া, যাত্রীসাধারণের শ্রেণিবিন্যাস, যাত্রীদুর্ভোগ, রেলযাত্রায় দুর্ঘটনার বিবরণ ইত্যাদির আলোকপাতে সচেতন যাত্রীগাইড হয়ে উঠেছে। বটতলার এই সচেতনতা বরাবরই ছিল।

মেয়ে-পুরুষদের ভেদের রাজনীতি বটতলা করেছে অবশ্য তার মুনাফার দিকেই তাকিয়ে। বটতলার শিক্ষামূলক, স্বাস্থ্য, জনচেতনা বাড়ানোর পুস্তিকাগুলোর পাশে তাই জায়গা নিয়েছে মেয়েমহল। কেবলমাত্র আকর্ষণের রাজনীতি। বটতলা রীতিমতো এর ফায়দা নিয়েছে। মেয়েদের জন্যই ছেপেছে রাশি রাশি বই। তেমনি এক  বই বসন্তকুমারী দাসীর যোষিদ্বিজ্ঞান-নারীকূলের অবশ্যজ্ঞাতব্য বিষয়সমূহ। বইয়ের প্রথমেই লেখিকার কলমে সেই ‘অবশ্যজ্ঞাতব্য’-এর বিজ্ঞাপনটি রয়েছে।

লেখা হয়েছে :

মচকানিতে চুন হলুদ, পুড়লে দেবে ছাগল দুধ

কাটলে চিতের পাতা চুর, পচলে কেটে করবে দূর।

প্রাচীন এসব মেয়েলি চিকিৎসার পাশাপাশি বটতলা অবশ্য তার মুনাফায় উনিশ শতকের বাঙালি মেয়েদের নৈতিক আচার-আচরণের দিকটি নিয়েও ভেবেছে। তা নিয়েও ছাপা হয়েছে বই। তখন অবশ্য বটতলার পোয়াতি পর্ব চলছে। ১৮৩৪। বের হয়েছে নীলরতন হালদারের দম্পতি-শিক্ষা পুস্তিকাটি। লেখক বিজ্ঞাপন করেছেন এসব উপদেশ প্রাচীন শাস্ত্রসম্মত বলেই। অর্থাৎ ঐতিহ্যের থেকে সরেনি বটতলা। সংস্কারের মধ্যেও থেকেছে সে। তার কৈশোরপর্বেই বেরিয়েছে পতিব্রতোপাখ্যানের মতো মেয়েদের ব্যবহারিক। ১৮৫৪-তে অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের এই বইয়ের এতখানি চাহিদা ছিল যে, দ্বিতীয় সংস্করণ পর্যন্ত হয়েছে। বিজ্ঞাপনে বা লেখকনামায় দাবি ছিল সেই শাস্ত্রমান্যতার। আর অভিনব যেটা বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, রংপুরের জমিদার কালী চৌধুরী এই বইটির প্রশংসাস্বরূপ লেখককে পুরস্কার দান করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলা বইয়ের ঝকঝকে যৌবনে পুরস্কারপ্রাপ্তির কার্যকারণ সম্পর্কটি তখন থেকেই বিজ্ঞাপন ও বিক্রির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত ছিল। বটতলার বিজ্ঞাপনের এই ট্রেন্ড আজো নষ্ট হয়নি বিজ্ঞাপনের নানা নবকৌশলের ছায়ায়। আর এখানেই তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাজার ধরার ফায়দাবাজিটি লেগে। এটাই বটতলার অনন্য বৈশিষ্ট্য।

গ্রন্থঋণ :

বটতলার ছাপা ও ছবি – সুকুমার সেন
বটতলা – শ্রীপান্থ
বাংলা পথ-সাহিত্য : পথপুস্তিকা – জয়ন্ত গোস্বামী
উনিশ শতকে ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা – মুনতাসীর মামুন
দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন – চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত
উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান – সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা বই ও তার প্রচ্ছদ-বৃত্তান্ত  – সোমব্রত সরকার