বনভূমির ভগ্ন ইমারতে চিত্রশিল্পী

মঈনুস সুলতান

পানে লেপটানো চুনের মতো সাদা-সাদা দাগওয়ালা একটি সবুজাভ পাথরে বাতাস-পোরা বালিশে ঠেক দিয়ে বসি। রোদ চড়ছে, তাই ফ্রোজেন কমলার কোয়াগুলো খেতে বেশ ভালো লাগে। আমার কাছেপিঠে কেবল পাতাহীন একটি গাছ। তার সরম্ন ডালে বসে একঝাঁক সুদর্শন সিডার ওয়াক্স উইং পাখি। আমি গুছিয়ে বসে পড়াতে তারা কাকলি স্টপ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শ্যানানডোয়া নদীর দিকে। আমার দৃষ্টিসীমায় নদীটির পরিষ্কার বাঁক। আমার সঙ্গে আছে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের এদিককার বনভূমির ল্যান্ডমার্কওয়ালা ফুটনোট দেওয়া একটি ডিটেইলড মানচিত্র, তাতে এ-বাঁককে ক্রিসেন্ট শেপ বা অর্ধচন্দ্রাকৃতি বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। আমি যে-মানচিত্রের নিশানানুযায়ী সঠিক পথে হাইক করছি তা বুঝতে পেরে কনফিডেন্স ফিরে আসে। হঠাৎ পাওয়া আত্মবিশ্বাস থেকে উদ্যম ফিরে পেলেও ঠিক সুস্থবোধ করি না। অজস্র গাছপালায় নিবিড় জঙ্গলে বারবার পথ হারানোর স্নায়বিক ধকল ছাড়া গেল, রাতে তীব্র জ্বরও এসেছিল। এখন তা ছেড়ে গেলেও গলা বারবার শুকিয়ে আসছে। ভোরবেলা মাত্র ঘণ্টাখানেক হাইক করেছি, কিন্তু দুর্বল লাগছে বলে বিরতি নিতে হলো। আমি ফ্রোজেন কমলার কোয়া চুষতে-চুষতে শ্যানানডোয়ার দিকে তাকাই। এখানে জলের স্বচ্ছতা সরল-সোজা মানুষের আত্মাকেও হার মানায়। আমি পাড়ের পাথরে ঠেক দিয়ে বসে রিভার-বেডে ছড়ানো পাথর ও তাদের পাশ ঘেঁষে ভেসে চলা মাছ, কচ্ছপ ও জলচর পাখিদের পরিষ্কার দেখতে পাই। নদীজলে প্রতিসরিত হচ্ছে তরতাজা সূর্যালোক। তাতে জলতলে সৃষ্টি হয়েছে জ্যামিতিক সব প্যাটার্ন। অনেকটা আলপনার মতো এ-প্যাটার্নগুলো সমবেতভাবে সৃষ্টি করেছে রম্নপালি জমিনে সোনালি নকশার একসেন্ট দেওয়া চলমান এক কার্পেট। ভাসমান এ-গালিচার দিকে চোখ রেখে কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেক প্রহর। এ-দৃশ্যকে ল্যাল্ডমার্কওয়ালা মানচিত্রের ফুটনোটে বর্ণনা করা হয়েছে ‘স্টানিং ভিউ’ ও ‘আনপ্যারালাল বিউটি’ বলে।

আমি সূর্যস্নাত শ্যানানডোয়ার পাড়ের গাছপালার প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে নদীর বৈশিষ্ট্যের কথা ভাবি। জলধারায় বয়ে-যাওয়া ছাড়াও একটি নদী শাখা-নদীতে বিভক্ত হয়ে সংযুক্ত হয় অন্য নদীর সঙ্গে অনায়াসে। তারপর সমুদ্রের বিষয়, তারাও বিচ্ছিন্ন নয়। আমি চাইলেই কিন্তু পাড় ধরে নেমে শ্যানানডোয়ার জল স্পর্শ করতে পারি। আর আমার ছোঁয়া এ-পানি হরেক রঙের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কোনো একদিন জোয়ারের তোড়ে ঢুকে পড়তে পারে মেঘনার মোহনায়। বদ্বীপের বিপুল জলমগ্ন বিসত্মার অতিক্রম করে, কালনীর কোনো দহে ঘুরপাক খেয়ে সুরমা গাঙ হয়ে জাফলংয়ের পাহাড়ি নদীর জলপ্রবাহের সঙ্গে তার মিশে-যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। নানা নদীর বিবিধ স্রোতের পরস্পরে সংযুক্ত হাওয়ার সঙ্গে হাইকিং ট্রেইলে ঘুরে বেড়ানোর কেমন যেন একটা মিল আছে। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে চলাচল করতে গিয়ে এখানেও নানাজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায়। কিছু-কিছু যোগাযোগ মনের জলপ্রবাহে বদ্বীপের মতো ভেসে থাকে। আমি গতকাল একজন মানুষের সঙ্গে সংযোগের কথা ভাবি।

গতকাল ঘণ্টা তিনেকের মতো আমি হাইক করেছি বেসামালভাবে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সঠিক ট্রেইল ধরে এগোচ্ছি কি না। আমার ভেতরে কাজ করেছিল গভীর বনে পথ হারিয়ে ঘুরপাক খাওয়ার আতঙ্ক। একসময় দিশেহারা হয়ে স্রেফ ট্রেইলের পাশে বসে থেকেছি অনেকক্ষণ। তারপর গতি পরিবর্তন করে এদিকে ঘণ্টাখানেক পথ চলতেই কপালজোরে পেয়ে যাই খুব সাদামাটা ছোট্ট কাঠের কুটিরের মতো একটি হাইকার্স শেল্টার। তার উঠানের পিকনিক টেবিলে রাখা লালরঙের হালকা ব্যাকপ্যাক। একটু আগে কেউ একজন এখানে বসে কফি তৈরি করেছে। বেঞ্চের ওপর রাখা কফি প্রস্ত্ততের ফ্রেঞ্চ প্রেস। চুলা থেকে উড়ছে ধোঁয়ার মৃদু রেখা। আমি পিকনিক বেঞ্চে বসে অনেকক্ষণ কফি তৈরি করনেওয়ালা মানুষটির অপেক্ষা করি। খুকখুক করে কাশতে-কাশতে তিনি অবশেষে কুটিরের পেছন থেকে প্রাকৃতিক কাজ সেরে দুটি ট্র্যাকিং স্টিকে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসেন।

মানুষটি খুবই বয়স্ক। ট্রেইলে এ-ধরনের বুড়ো মানুষের দেখা সচরাচর মেলে না। তাঁর লাঠি ধরা দুহাত অল্প-অল্প কাঁপে। তবে ফায়ার ফাইটারদের ট্র্যাকস্যুট পরা তাঁর দেহ এ-বয়সেও বেশ শক্তপোক্ত। তিনি বেঞ্চে আমার পাশে বসে – ওয়ান্ট সাম ফাইন ফ্রেঞ্চ রোস্ট কফি? বলে জবাবের অপেক্ষা না করে স্টাইরোফোমের কাপে আমার জন্য কফি ঢালেন। আমি চুমুক দিতে গেলে তিনি খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলেন, নট ফিলিং ওয়েল, রাইট? বলে আমার দিকে এগিয়ে দেন চকোলেটের প্রলেপ মাখানো একটি বিস্কিট। দিস ইজ গোনা পার্ক ইউ আপ, বলে আমার বিস্কিট খাওয়া ÿুধার্ত মুখের দিকে তাকালে আমি জিজ্ঞেস করি – আর ইউ এ ফায়ার-ফাইটার স্যার? তিনি জবাবে বলেন, আমাদের ছোট্ট শহরে ফায়ার সার্ভিসের লোকসংখ্যা খুব কম। আমার প্রশিক্ষণ আছে, তাই একসময় কোথাও আগুন লাগলে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতাম। অ্যান্ড ফর ইয়োর ইনফরমেশন, আমি ঠিক হাইকারও নই। আমি এবার জানতে চাই – তা এই বয়সে কষ্ট করে বনানীর গভীরে ট্রেইলে এসেছেন কেন স্যার? তিনি খুব নিরাবেগভাবে জবাব দেন – ইটস দ্য মেমোরি অব মাই সান। বস্নুরিজ মাউনটেনের পাদদেশে সে হাইক করতে খুব ভালোবাসত। আজ থেকে সাত বছর আগে এই শেল্টারের কাছাকাছি একটি রকওয়ালের কাছে সে নিজেকে হত্যা করে। দ্য স্যাড থিংগ ওয়াজ দ্যাট হি টুক হিজ অউন লাইফ উইথ মাই রিভলভার। পুরো ছয়দিন সে নিখোঁজ ছিল। রেসকিউ ডগ যখন দেহ খুঁজে বের করে তার শরীরে আর তেমন কিছু অবশিষ্ট ছিল না। শিয়াল, নেকড়ে ও শকুনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনেকটা খেয়ে নিয়েছে।

ভদ্রলোক মনে হয় কথা বলার কাউকে পান না, অথবা সুযোগ পেলে কথা বলতে ভালোবাসেন। তিনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে কেবলই নিজের কথা বলে যান। তিতকুটে স্বাদের কফি খেতে খেতে আমার ততক্ষণে জানা হয়ে যায় যে, স্ত্রী সতেরো বছর আগে তাঁর বিপত্নীক ভায়রাভাইয়ের সঙ্গে ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে কখনো ফরমালি ডিভোর্স হয়নি। এখন অবশ্য তার প্রয়োজনও নেই। তাঁকে ত্যাগ করে যাওয়ার আড়াই বছরের মাথায় তাঁর স্ত্রী ও ভায়রাভাই দুজনে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান।

আমার মাথা ধরে এসেছে, এতকিছু শুনতেও ইচ্ছা হচ্ছিল না। তাই, এক্সকিউজ মি বলতেই তিনি – ইউ আর অ্যা লিটিল সিক, আরন্ট ইউ? লেটস সি, বলে ব্যাকপ্যাক থেকে থার্মোমিটার বের করেন। তা জিবের নিচে রাখতেই আমার হাইফিভার ধরা পড়ে। তিনি ওষুধের তালাশে তাঁর ব্যাকপ্যাকে খোঁজাখুঁজি করতে করতে বলেন, ছেলেটাকে হাতেপিঠে করে আমিই মানুষ করেছিলাম। কলেজে বিজনেস অ্যাডমিনিসট্রেশনের ডিগ্রি শেষ করেছিল। আমার অটোমোবাইলের শোরম্নমের ব্যবসা। পস্ন্যান ছিল আমি রিটায়ার করলে সে-ই ওসব দেখাশোনা করবে। উত্তরাধিকারী বলতে আর তো কেউ নেই। ওষুধ পাওয়া গেলে তিনি আমাকে দুটি টাইনানল পিএম দিয়ে বলেন – দিস ইজ এ ভেরি গুড ট্যাবলেট। জ্বর, মাথাধরা এসব তো ছাড়বেই অ্যান্ড দিস ট্যাবলেট উইল পুট ইউ টু সিস্নপ অ্যাজওয়েল। আমি কফি দিয়ে টাইনানল গিলতে গেলে তিনি ‘ওয়েট অ্যা সেকেন্ড’ বলে হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দেন। দিস ইজ অ্যা ভেরি স্ট্রং মেডিসিন। খালি পেটে খেলে লিভারে এফেক্ট করবে। ডু ইউ হ্যাভ এনি ফুড উইথ ইউ? আমি জবাবে নিরম্নত্তর থাকলে তিনি ব্যাকপ্যাক থেকে একটি মাফেন বের করে আমার হাতে দেন। আমি তা খেয়ে কফির সঙ্গে ট্যাবলেট গিলে কুটিরের ভেতরে শুয়ে পড়ার জন্য গেলে তিনি কাঁপা হাতে লাঠি ভর দিয়ে দোরগোড়া পর্যমত্ম এসে বলেন – নাও আই অ্যাম শিওর ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট আই অ্যাম নট এ হাইকার, কিন্তু ছেলেটা এ ট্রেইল ভালোবাসত, তাই প্রতিবছর তার কথা ভেবে একবার করে এখানে হাইক করতে আসি। যেখানে তার মৃত্যু হয়েছিল, সেই রকওয়াল অব্দি যেতে লাগবে আরো ঘণ্টাখানেক। প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে এসেছি, আজকে আর যেতে পারব না। শরীরে কুলাচ্ছে না। কাল ভোরে কফি খেয়ে হাঁটতে শুরম্ন করলে সাড়ে আটটার আগে পৌঁছে যাব।

টাইনানল পিএম নেওয়ার পরও আমার ঘুম আসে না। আমার পাতানো বেডরোলের পাশেই বৃদ্ধ মানুষটি শুয়েছেন তাঁর সিস্নপিংব্যাগে। আমার ছটফটানি দেখে তিনি উঠে ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে ছোট্ট পাম্প দিয়ে ফুলিয়ে আমাকে একটি রাবারের বালিশ দিয়ে বলেন – আই লাইক টু স্পেন্ড এ নাইট হিয়ার, ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? আমার ছেলেটা এ-শেল্টারে তার আত্মহত্যার আগের রাতে শুয়ে ছিল। তার ঘুম হয়নি, তাই কাগজ কেটে কেটে দুমড়ে-মুচড়ে কিছু পশুপ্রাণীর আকৃতি সে তৈরি করেছিল। রেসকিউ টিমের লোকজন তাকে খুঁজতে এসে এগুলো এ-শেল্টার থেকে উদ্ধার করে। তার ইনসোমনিয়ার সমস্যা ছিল। আমি তার এ অভ্যাসের কথা জানতাম। তার মা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে তার ইনসোমনিয়া শুরম্ন হয়। সারারাত নিদ্রাহীনভাবে ছটফট করতে করতে সে কাগজ কেটে ছিঁড়ে হিংস্র প্রাণীর আকৃতি তৈরি করত। হাইকিং ট্রেইলে বালিশ ছাড়া ঘুমানোর ব্যাপার আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই তাঁর হাত থেকে বালিশ নিতে ইতসত্মত করলে তিনি বলেন, আমি সবসময় সঙ্গে এক্সট্রা পিলো ও বেডশিট এসব রাখি। তুমি এটা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারো। তিনি তাঁর ছেলে সম্পর্কে আরো কিছু বলতে চাইলে আমি অনেকদিন পর বালিশে মাথা রেখে বলি – পারডন মি স্যার, আই টু টায়ার্ড, আই নিড টু সিস্নপ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জবাব দেন – ও-কে, গুডনাইট নাও, সিস্নপ ওয়েল।

বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে। বৃদ্ধ মানুষটি ততক্ষণে শেল্টার ছেড়ে পথে নেমেছেন। আমারও ট্রেইল ভাঙতে হয়, তাই ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বাইরে আসি। পিকনিক টেবিলের ওপর স্টাইরোফোমের কাপে রাখা কালো কফি। পাশে স্বচ্ছ সেলোফোনে জড়ানো এক টুকরা চিজব্রেড ও ফ্রোজেন অরেঞ্জের প্যাকেট। নিচে একটি চিরকুটে লেখা – আমার ছেলে বলত, এ-ট্রেইলে পথ চলাতে ছড়ানো আছে ডিভাইন ম্যাজিক। তুমিও আজ প্রকৃতির অসাধারণ চার্ম অ্যাডমায়ার করতে করতে হাইকিংয়ের জাদু অনুভব করো। কফি একেবারে ঠান্ডা হয়নি, তাই আমি নিশ্চিত যে, তিনি বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। ইচ্ছা হয় ছুটে গিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ বলি। কিন্তু সিদ্ধামত্মহীনতার জন্য তা হয়ে ওঠে না। একটু পর উঁচু এলিভেশনকে টার্গেট করে আমি হাইকিং শুরম্ন করে টিলার ওপর দিয়ে বাঁক নিতে গেলে
নিচের লেয়ারে তাঁকে স্পষ্ট দেখি। দুটি ট্র্যাকিং স্টিকে ভর দিয়ে ঠিরঠিরিয়ে কাঁপা পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ মানুষটি। বাসনা হয় নিচে নেমে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে বলি – স্যার, আপনার ছেলে সম্পর্কে কাল রাতে আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন, এবার বলুন, বাকিটুকু শুনব।

না, আমি তাঁর কাছে ফিরে যাইনি। হোয়াই আই ডিড নট গো ব্যাক টু হিম? আমি শ্যানানডোয়ার কূলে তাঁর দেওয়া রাবারের পিলোতে হেলান দিয়ে বসে নিজেকে প্রশ্ন করি। অ্যান্ড দ্য আনসার ইজ… বিকজ আমি ফুটনোট দেওয়া ডিটেইলড মানচিত্রের পর একই বইতে ধারাবাহিকভাবে দেওয়া ডেসক্রিপশন ঘেঁটে কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য পেয়েছি। সে-অনুযায়ী একটি পোড়ো ম্যানোর হাউসের ভগ্ন ইমারতে আজ পৌঁছতে চাই। অর্থাৎ আমার মনে তৈরি হচ্ছে একটি নিজস্ব এজেন্ডা। একজন সমত্মানহীন মানুষকে সঙ্গ দেওয়ার চেয়ে নিজের এজেন্ডাকে বাসত্মবায়িত করা আমার কাছে অধিক আকর্ষণীয়। সুতরাং বলা চলে আমার আচরণে এক ধরনের সেলফিশ অ্যাটিচ্যুড বা স্বার্থপরতা আছে।

স্বার্থপরতার বিষয়টা ভাবতেই খুব অশামিত্ম লাগে। শ্যানানডোয়ার কূলে কূলে বইছে লিলুয়া বাতাস। বাতাসে বর্ণাঢ্য সব ঝরাপাতা জড়ো হয়ে কু-লী পাকিয়ে শূন্যে ওড়ে। দেখতে দেখতে কু-লী পাকানো পাতার কয়েকটি ফরমেশন বেশ উঁচুতে উঠে নদীর ক্রিসেন্ট বাঁক অতিক্রম করে উড়ে যেতে থাকে দিগমেত্মর দিকে। আমার ভেতরেও নানা ধরনের বিপরীতধর্মী ভাবনা তালগোল পাকিয়ে ঘূর্ণিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে থাকে। ওয়েল, ইন অ্যা হাইকিং ট্রেইল ইউ ডোন্ট রিয়েলি স্টপ। পথচলা বন্ধ করে বসে থাকলে তো চলে না, ইউ হ্যাভ টু কিপ গোয়িং। পথের রেখা ধরে তোমাকে যে কেবলই এগিয়ে যেতে হয়। আমি আরেক দফা আগে বাড়ার প্রস্ত্ততির জন্য নিজেকে সুস্থির করার উপায় খুঁজি।

ব্যাকপ্যাকে খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া যায় ইয়ো ইয়ো মা-র দুটি সিডি। ধ্রম্নপদী ধারার এই চেলো-বাদক আমার খুবই প্রিয়। আমি ওয়াকম্যানে তাঁর জার্মান ধ্রম্নপদী কম্পোজার বাখের চেলো সুইট নং ওয়ানের প্রিলিউড চড়াই। ইয়ো ইয়ো মা ব্যক্তি হিসেবে খুবই ইন্টারেস্টিং। চীনা পিতামাতার সমত্মান এ-বাদকের জন্ম হয় প্যারিসে। মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর পেরেন্টস স্থায়ীভাবে চলে আসেন নিউইয়র্কে। প্রিলিউড বেজে উঠতেই যে-বিষয়টি আমাকে আকর্ষণ করে তা হলো, তিনি যেন আমার শ্রম্নতির সংবেদনে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর বর্ণাঢ্য ইমাজিনেশন। চেলোর মোলায়েম আওয়াজে শ্যানানডোয়ার রিভারবেডে ফুটে-ওঠা সূর্যস্নাত আলপনার মতো আমার মননের তলদেশে অাঁকা হতে থাকে ঝংকারের সোনালি নকশা। চলমান ধ্বনিপ্রবাহ নৈঃশব্দ্যের দোরগোড়ার এসে পৌঁছায়। নিমেষে আবার সশব্দ ঝংকারে এ-বাদক দৃশ্যমান করে দিতে থাকেন অদৃশ্য সব দৃশ্যপট। যা আমি দেখতে পাচ্ছি না, যে-প্রতিবেশের অনুভব সম্পর্কে আমার নেই সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা, তার সন্ধানেই এই পদযাত্রা। চেলোর বাদন শুনতে শুনতেই আমি উঠে পড়ি। একপা-দুপা করে সামনে বাড়তেই মনে হয়, আমি এখনো বেঁচে আছি বলে শুনতে পাচ্ছি বাখের বৈদূর্যমণির মতো দ্যুতিময় ব্যঞ্জনা।

এবার নীচু এলিভেশনের দিকে যাচ্ছি বলে হাইকে তেমন একটা মেহনত হয় না। নীচের দিকে আসতে আসতে নেচার আবার শ্যামল হয়ে ওঠে। ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর তথ্যময় মানচিত্রে স্টোন ক্রিক বলে বর্ণিত জলময় ঝোরার পাশে এসে দাঁড়াই। পাথরের দেয়াল ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ নহর। ওপারে অজস্র পাতা ঝরে শুকাতে শুকাতে খয়েরি হয়ে গেলেও এপারের ছড়ানো পত্রালিতে বিবর্ণ হরিদ্রাভের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লালচে আভা। ঝোরার জলকে নিশানা করে ভাটির দিকে যেতেই চলে আসি জলাভূমির পাশে। ওখানে শুকনা জকড়ি-মকড়ি লাগা ধূসর রঙের প্যাঁচানো গাছে ঈগল জাতীয় ওসপ্রের বাসা। আমি তাকিয়ে আছি দেখে ওসপ্রে পাখি নীড় ছেড়ে উড়াল দিয়ে শূন্যে থির দাঁড়িয়ে পানিতে মাছের চলাচল লক্ষ করে। নির্জনতা কেটে কেটে আমি সামনে এগোই। মজা পুকুরের মতো এ জলাভূমির কিনারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রিড বলে পরিচিত এক ধরনের দীর্ঘ সবুজ ঘাস। তার পাশে পানিতে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব এঁকে ধ্যানমগ্ন পদক্ষেপে হাঁটে মসত্ম একটি বস্নু হিরণ পাখি। পতঙ্গের শব্দহীন এ-পরিবেশে প্রকৃতি তার নিজস্ব মেডিটেশনে এমন মগ্ন হয়ে আছে যে, মনে হয় কান পাতলে প্রশ্বাসে গাছের অমস্নজান ছড়িয়ে দেওয়ার মিহি আওয়াজও শোনা যাবে। তথ্যপুসিত্মকার বর্ণনা খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। সুতরাং বুঝতে পারি সামনেই কাঙ্ক্ষিত ম্যানর হাউসের ভগ্ন ইমারত। বনানীর এ-সত্মব্ধতাকে মিসমার করে দিয়ে বুটের সজোর পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া অসমীচীন মনে হয়। তাই, ঝরা পাতার ওপর আলতোভাবে পা ফেলে খুব ধীরে আগে বাড়ি।

নৈঃশব্দ্য এখানে এত গাঢ় হয়ে আছে যে, একটি রবিন পাখির চিউচিউ শব্দে রীতিমতো শিউরে উঠি। পাখিটি ঝরা পাতার ওপর নরম পা ফেলে আমার দিকে হেঁটে আসে। আমি কয়েক পা সামনে গেলে সে চিউচিউ করে আমার পেছন-পেছন ছুটে আসে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লে সে ঠোঁট ফাঁক করে কিছু যেন চায়। আমি
হাত-পা নাড়িয়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলেও সে ওড়ে না। রবিন পাখির এই অস্বাভাবিক আচরণে আমি ব্যাকপ্যাক নামিয়ে মাটিতে বসি। সে আমার খুব কাছাকাছি এসে আবার খাবার চাইলে আমি আধখাওয়া চিজব্রেডের এক টুকরা ভেঙে তাকে খেতে দিই। হাইকিং ট্রেইলে কোনো কোনো ব্যাকপ্যাকার পাখিদের সূর্যমুখী ফুলের বীজ ইত্যাদি খেতে দিলে তারা মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় অভ্যসত্ম হয়ে পড়ে। সে যাই হোক। তাকে একটু রম্নটির টুকরা খাইয়ে আমি উঠে পড়লে সে আবার আমাকে চিউচিউ করে ফলো করে। আমি তাকে তাড়াতে গেলেও সে ঠিক উড়তে পারে না। এবার আমি পাখিটিকে হাতের তালুতে নিয়ে পরীক্ষা করতেই দেখি তার ডানার নিচে বেগুনি হয়ে আসা কামড়ের ক্ষতচিহ্ন। ঠিক তখনই নজরে পড়ে তার একপায়ে বাঁধা পস্নাস্টিকের ব্যান্ড। আমি জানি যে, বার্ড ওয়াচাররা তাদের পর্যবেক্ষণের উপাত্ত সংগ্রহের জন্য পাখিদের পায়ে ব্যান্ড পরিয়ে থাকে। সাতপাঁচ ভেবে আমি ব্যাকপ্যাকের সঙ্গে বাঁধা ওয়াটার বটল ক্যারি করার জালের ব্যাগ বের করে রবিনটিকে তাতে পুরে উঠে দাঁড়াই। মাথার ওপর উড়ে এসে থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওসপ্রে ঈগলটি ধাতব গলায় ডেকে উঠলে নৈঃশব্দ্য ভেঙেচুরে আমার বুকের ভেতরে ধক্ করে ওঠে। আমি জালের ব্যাগে রবিন পাখিটিকে বুকের কাছে নিয়ে এসে আসেত্ম-আসেত্ম পা ফেলে সামনে এগোই। ওসপ্রে ঈগলটি ঝরাপাতার ওপর তার ডানার দীর্ঘ ছায়া ফেলে আমার ওপরে ওপরে ওড়ে।

ম্যানর হাউসের সীমানায় পা দিতেই কোথায় যেন একটি ঘোড়া চিঁহিহি করে ডেকে ওঠে। উঠানে এক সময় যেখানে কেয়ারি করা ফুলের বাগিচা ছিল সেখানে এখন কাঠের ফ্রেমে জৈবসারময় মাটি আটকে তাতে করা হয়েছে লেটুস, পেঁয়াজ পাতা, স্কোয়াস ইত্যাদি নানারকমের সবজির চাষ। দোতলায় ওঠার নোনা ধরা একটি সিঁড়ি ভিন্ন ম্যানর হাউসের আর তেমন কোনো স্ট্রাকচার চোখে পড়ে না। তথ্যপুসিত্মকার বর্ণনা থেকে আমি জেনেছি যে, আজ থেকে একশ তেষট্টি বছর আগে এখানে এক জায়গিরদারের পরিবারের বাস ছিল। এ-ভূস্বামীদের এদিকে ছিল একাধিক অ্যাপেল অরচার্ড, ওয়াইন প্রস্ত্ততের জন্য আঙুরের ক্ষেত, যব ও তামাকের বিসত্মীর্ণ মাঠ। তারপর কী কারণে যেন মানুষের বসতি বিলুপ হলে তাবৎ ক্ষেতখামার জনহীন হতে হতে গাছপালা ও বন্যপ্রাণীতে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে ওঠে। আমি – হ্যালো, অ্যানিবডি হোম হিয়ার, বলে হাঁক দিয়ে রবিন পাখি হাতে এক পা-দুপা করে সামনে এগোই। আমি অবগত যে, এই ভগ্ন ম্যানর হাউসে আজকাল একাকী বাস করছে সারাহ জেকব উইটমার নামে একজন চিত্রশিল্পী। আমি তথ্যপুসত্মকে তাঁর সম্পর্কে বেশ খানিকটা পড়েছি। আমিশ সম্প্রদায়ের এ-তরম্নণী সিরামিকের পেস্নটে পাখির ছবি এঁকে থাকে। আমি বিবর্ণ হওয়া ঝরাপাতা মাড়িয়ে আধভাঙা সিঁড়ির কাঠামোর কাছাকাছি আসতেই ওপারে আরেকটি কাঠের ফ্রেমের ভেজিটেবল প্যাচ দেখতে পাই। তাতে ফলছে টমেটো, রোজমেরি ও বেজল লিভস। আমিশ সম্প্রদায়ের লোকজনের মূল পেশা হচ্ছে চাষবাস। তারা কৃষিকাজে আধুনিকায়ন ঠিক পছন্দ করে না। সুতরাং জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন এক আমিশ তরম্নণীর স্বাবলম্বীভাবে শাকসবজির চাষবাসে আমি অবাক হই না একেবারেই।

ভাঙা সিঁড়ি পেরিয়ে ভেজিটেবল প্যাচ বাঁয়ে রেখে আরো কিছু ঝোপঝাড় অতিক্রম করে সামনে যেতেই দেখি শুকনা ডাল পুঁতে বেড়া দিয়ে পালা হচ্ছে মুরগি। আমার পদশব্দে তারা কক্-কক্ করে উঠলে সাঁইসাঁই বাতাস কেটে সামনে ছুটে যায় পালক লাগানো একটি তীর। ক্রসবো জাতীয় যান্ত্রিক ধনুক অ্যাডজাস্ট করতে করতে সাদাটে রম্নপালি চুলের এক নারী ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলে – হাই হইকার, ওয়েলকাম টু ম্যানর হাউস। তীব্র রম্নপালি চুলের শর্টস-পরা এ-নারী তেমন একটা সুদর্শন নন। আমি তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে বিপরীত দিকে মাটিতে পোঁতা ডালের ওপর আটকানো ডিকয় বা উড়মত্ম হাঁসের মূর্তিটি নিরিখ করে বলি – সো, ইউ অলসো হান্ট ডাকস উইথ ইয়োর বো অ্যান্ড অ্যারো? পাখির ছবি অাঁকা ছাড়া মনে হয় হাঁস শিকারেও তোমার আগ্রহ আছে?  রম্নপালিচুলো নারী জবাব দেয় – নট রিয়েলি, আই অ্যাম নট আ হান্টার অ্যাটঅল। তীর-ধনুক দিয়ে পাখি হত্যা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, বলে কাঁধ ঝাঁকালে শোল্ডারে শুধু স্ট্রাপ দিয়ে আটকানো টপে তাকে সুসত্মনী দেখায়। সো, হোয়াই আর ইউ শুটিং দ্য ডিকয় ডাক? তা ঠিক বুঝতে পারছি না, শিকারি না হলে নকল হাঁসের দিকে তীর ছোড়া প্র্যাকটিস করছ কেন? আমি প্রশ্ন করলে মেয়েটি জবাব দেয় – সো, ইউ ওয়ান্ট অ্যান এক্সপেস্ননেশন? দ্য থিংগ ইজ আমি পেস্নটে একটি হাঁসের ছবি অাঁকছি, আমি তার চোখেমুখে তীরবিদ্ধ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তের আতঙ্কিত এক্সপ্রেশন ফোটাতে চাই। সুতরাং প্র্যাকটিস করে নিচ্ছি যাতে কোনো হাঁসের কানের খুব কাছাকাছি তীর ছুড়তে পারি। আই অ্যাম গোনা বি রিয়েলি কেয়ারফুল, তীরে যেন পাখি বিদ্ধ না হয়, শুধু শব্দে তার যে রিঅ্যাকশন হবে, তাতে যে এক্সপ্রেশন ফুটবে, আমি শুধু তা চাÿুষ করতে চাই। নো হান্টিং বার্ডস।

রবিনটি চিউচিউ করে উঠলে আমি জালের ব্যাগ থেকে বের করে তাকে পাখিটি দেখাই। ও ডিয়ার, মাই লিটিল রবিন, বলে রম্নপালিচুলো মেয়ে পাখিটি হাতে নিয়ে পায়ের পস্নাস্টিকের ব্যান্ড পরীক্ষা করে বলে – ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ইজ অ্যাকচুয়েলি মাই বার্ড। এদের মাকে ওসপ্রে নীড় থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেলে দুটি বাচ্চা এখানে এসে আমার কাছে চিউচিউ করে খাবার চায়। এই ভেজিটেবল প্যাচে এরা বড় হয়। ওড়া শিখলে পরে আমি ব্যান্ড পরিয়ে এদের জঙ্গলে ফ্রি করে দিই। টেল মি মি. রবিন, হোয়ার ইজ ইয়োর লিটিল ব্রাদার? ওহ ডিয়ার, বলে মেয়েটি আক্ষেপ করলে আমি রবিনটি যে উড়তে পারছে না তা তাকে জানাই। সে ডানার নিচ পরীক্ষা করে বলে – আই ডোন্ট নো… সম্ভবত কোনো বিষাক্ত কীটের কামড়ে পাখা সাময়িকভাবে প্যারালাইজড হয়ে আছে। সে রবিনটিকে ভেজিটেবল প্যাচের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে তার ওড়ার ব্যর্থ চেষ্টা লক্ষ করে বলে – ওহ্ ডিয়ার, আই হ্যাভ টু টেক ইউ টু এ ভেটেরিনারিয়ান। ঠিক তখনই সম্পূর্ণ সাদা রঙের একটি ঘোড়া ঝোপঝাড়ে পিঠ ঘষে বেরিয়ে এলে সে তার কেশরে হাত বুলিয়ে বলে, নট এ বিগ প্রবলেম। দিস ইজ আইজাক। এর পিঠে চড়লেই ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর বনজঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে বন্য পশুপাখি চিকিৎসার ভেটেরিনারিয়ান হাসপাতালে। ওখানে মি. রবিনের একটা ব্যবস্থা হবেই।

আগেই আমি আন্দাজ করেছিলাম, এখন সাদা রঙের ঘোড়া দেখতে পেয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকে না যে, এ-মেয়েকে আমি দুদিন আগে হাইক করতে করতে শ্যানানডোয়া নদী থেকে বেরিয়ে আসা ছড়ার জলাভূমিতে ঘোড়াকে পানি খাওয়াতে দেখেছি। বিষয়টি আমি উলেস্নখ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করি না।

তথ্যপুসত্মকে আমি পড়েছি যে, কোনো কোনো হাইকার তাঁর কাছ থেকে পাখির ছবিওয়ালা সিরামিকের পেস্নট কিনে নেয়। ছবি কেনার মতো যথেষ্ট রেসত্ম আমার নেই। তাই জানতে চাই – ডু ইউ মাইন্ড আমি যদি ছবি না কিনে শুধু তোমার অাঁকাজোখার স্টুডিও দেখতে চাই? সে সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে আহবান জানিয়ে বলে – কাম অন উইথ মি, ছবি তো আমি অাঁকছি কেউ না কেউ দেখবে বলে। এ সিজন খুব ডাল যাচ্ছে। এ-মৌসুমে মনে হয় তুমিই আমার প্রথম দর্শক। হাইকাররা এদিকে ট্রেইলে এখনো পা ফেলেনি। আর কজন হাইকারেরই বা পাখি অাঁকা বার্ডপেস্নটে জেনুইন আগ্রহ আছে। আমরা একটি সোলার প্যানেল বা সূর্যরশ্মি ধারণের বোর্ডের পাশে ঝোপে আড়াল করা সিঁড়ি দিয়ে ম্যানর হাউসের বেসমেন্টে নামি। নামতে-নামতে সারা বলে, সে চেষ্টা করেছিল সোলার পাওয়ার দিয়ে নিচে আলোর বন্দোবসত্ম করার। কিন্তু প্যানেলটি কাজ করছে না। আই ডোন্ট নো হাউ টু ফিক্স ইট। আমি বলি, শহরে নিয়ে যাও, ওখানে কোনো মেকানিক পেয়ে যাবে যে তোমার সোলার প্যানেলটি ঠিক করে দিতে পারবে। আমরা মাটির তলায় আধো অন্ধকার একটি প্রশসত্ম করিডরে এসে দাঁড়ালে সারা জানতে চায় – একটু কৌতূহল হচ্ছে, ম্যানর হাউসের ভাঙা দালানে আমার স্টুডিওর সন্ধান তুমি কীভাবে পেলে? আমি মি. গোল্ডস্টিনের দেওয়া মানচিত্র তথ্যপুসিত্মকার উলেস্নখ করে বলি, ওখানে তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড ও সাক্ষাৎকার আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। সে মৃদু হেসে বলে – সো ইউ নো আই অ্যাম অ্যান আমিশ, যদিও আমিশ সম্প্রদায় আমাকে তাদের গোত্র থেকে বহিষ্কার করেছে, তারপরও আমি আমিশই থেকে গেছি। চিতাবাঘ যেরকম তার গা থেকে কালো গোলাকার স্পট মুছতে পারে না, সেরকম আমিশরা বহিষ্কৃত হলেও আচার-আচরণে আমিশই থেকে যায়। আমি তার মমত্মব্য বুঝতে না পেরে – হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দিস? বললে সে নির্লিপ্তভাবে হেসে বলে, লিসেন, আমিশদের ভ্যালুজ হচ্ছে, সব কাজ নিজ হাতে করা। নিজের দক্ষতায় না কুলালে অন্যের মেধায় তৈরি করা জিনিস তারা সচরাচর ব্যবহার করে না। তোমাকে একটি উদাহরণ দিই। এ যুগেও আমিশরা মোটরকার বা কম্পিউটার ব্যবহার করে না। আমিশরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তাদের চার্চে যায় – এ-দৃশ্য তুমি নিশ্চয় টিভিতে দেখেছ? ঘোড়ার গাড়ি তাদের নিজের হাতে তৈরি। সুতরাং আমিও চেষ্টা করব সোলার প্যানেল সারাই করা শিখে নিতে। দেন আই উইল হ্যাভ এনাফ লাইট ইন দিস বেসমেন্ট।

আমরা একটি হলকক্ষে আসি। ওপরের ঘুলঘুলি দিয়ে এখানে বেশ কিছু আলো আসছে। দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো পায়া-ভাঙা কাঠ শুকিয়ে ফোপরা হয়ে আসা একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো। তার উইপোকায় কাটা ক্ষয়িষ্ণু কাঠামোর নিচে তিনটি পাথরের ঠেক দেওয়া। তার ওপরে সারা জেকবের পরিবারের বাঁধানো ছবি। তাতে চেয়ারে হ্যাটপরা দাড়িওয়ালা পিতার পাশে ঘোমটার মতো করে বনেট পরা তার মা। সামনে সিঁড়িতে বসে পাঁচ-ছয়টি ছোট্ট ছেলেমেয়ে। বনেট পরা মেয়ে-শিশুদের ছবি থেকে আমি সারাকে চিনে নিতে চাই। সঙ্গে-সঙ্গে সাক্ষাৎকার পড়ে তাঁর জীবন সম্পর্কে যা জেনেছি তাও মনে উঁকি দিয়ে যায়। কিশোরী সারার আমিশ সম্প্রদায়ের বাইরে একটি বয়ফ্রেন্ড জুটলে তার রক্ষণশীল পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। আমিশরা এ-যুগেও তাদের সম্প্রদায়ের ভেতর ছেলেমেয়েদের বিয়ের বন্দোবসত্ম করে থাকে। পাত্রপাত্রীরা বছরে দু-একবার সামাজিক অনুষ্ঠানে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। তখন একটি ছেলে তার ঘোড়াগাড়িতে একটি সোমত্ত মেয়েকে চড়ার জন্য দাওয়াত দিতে পারে। এভাবে তাদের অমত্মরঙ্গতার সূত্রপাত হয়। পরে ঘনিষ্ঠ হলে খুব রক্ষণশীল কেতায় ধর্মীয়ভাবে তাদের বিবাহ হয়। সারার বয়ফ্রেন্ড ভিন্ন-ধর্মাবলম্বী জুইশ হলে, এবং সে সারার জন্য ধর্ম বদলাতে রাজি হলেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয় না। আমিশ সম্প্রদায় বিবাহপূর্ব যৌনতার ঘোরতর পরিপন্থী। একপর্যায়ে সারা প্রেগন্যান্ট হয়ে পরবর্তীকালে স্বাস্থ্যগত কারণে অ্যাবরশন করালে আমিশ সম্প্রদায় তাঁকে ভ্রূণহত্যার অভিযোগে এক্সকমিউনিকেট বা সমাজ থেকে বহিষ্কার করে।

আমি পারিবারিক ছবিতে বনেট পরা ছোট্ট সারাকে চিনতে পেরে আঙুল দিয়ে দেখালে সে খুব নির্লিপ্তভাবে মমত্মব্য করে – পরিবার আমাকে অস্বীকার করলেও আমি এখনো মনের দিক থেকে তাদেরই একজন থেকে গেছি। তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারো যে, ঘর ছাড়ার পর আমেরিকার অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে আমিও হালফিল অনেক বদলে গেছি, আমি আর আমিশ মেয়েদের মতো মাথায় বনেট পরি না। হাঁটুর নিচ অবধি ঝুলের লম্বা স্কার্ট ও ফ্রিলদেয়া ঢাকাঢুকা গাউনের পরিবর্তে কাজের সুবিধার জন্য শর্টস ও টি-শার্ট পরি; তারপরও আমার ভেতরের আমিশ আইডেনটিটি কিন্তু আগেকার মতোই অবিকৃত থেকে গেছে। দেয়ার ইজ সামথিং অ্যাবাউট ইয়োর কৌর আইডেনটিটি, পরিবারের সঙ্গে যতই বিরোধ হোক, বা জন্মস্থান থেকে যতদূরেই যাও না কেন, অ্যাজ অ্যা পারসন ইয়োর বেসিক আইডেনটিটি রিমেইনস দ্য সেইম। তোমার আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক সবকিছু পালটে গেলেও, তোমার মূল পরিচিতি কিন্তু আগেরটাই থেকে যায়।

হঠাৎ করে আত্মসচেতন হয়ে সারা দ্রম্নত আলোচনার টপিক পালটে বলে, এককালের এ ম্যানর হাউসের সবকিছু ভেঙেচুরে গেলেও এর বেসমেন্টটি নির্জনে বসবাসের জন্য বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। আমি লিজ নিয়ে সবকিছু সাফসুতরো করার সময় এ পিয়ানোটি পাই। আর বাঁদিকের যে-ছবিটি দেখছ তাও ডাই করে রাখা। উইপোকায় কাটা বইপত্র ও ফ্যামিলি অ্যালবামের মধ্যে পেয়েছি। তুমি চাইলে ম্যানর হাউসের মূল দালানের এ-ফটোগ্রাফের একটি কপি তোমার ক্যামেরা দিয়ে করে নিতে পারো। তবে আমি চাই না কোনো হাইকার আমার অাঁকা বার্ডপেস্নটের ছবি তুলুক। ইজ দ্যাট্ ওকে উইথ ইউ? আমি রাজি হয়ে ফ্লাশ ঝলকিয়ে ম্যানর হাউসের মূল ভবনের একটি প্রতিলিপি করে নিই।

আমরা আরেকটি হলঘরে আসি। উইপোকায় আধখাওয়া বিলিয়ার্ড টেবিলের দিকে তাকিয়ে মনে হয় বড়সড় এ-কামরাটি একসময় ম্যানর হাউসের রিক্রিয়েশন রম্নম ছিল। বিচিত্র ভঙ্গির পাখির ছবি অাঁকা সিরামিকের পেস্নটগুলো টেবিলের সবুজ পাটাতনে স্ট্যান্ডে ডিসপেস্ন করা। এ-কামরার ছাদের কাছের জানালা দিয়ে স্কাইলাইটের মতো আলো এসে সরাসরি পড়ছে বার্ডপেস্নটগুলোর ওপর। আমি পাখির এক্সপ্রেশনে যা মূর্ত হয়েছে ডানার নানাবিধ আলোড়নের ভেতর দিয়ে তা খুঁটিয়ে দেখতে গেলে সারা বলে, আমি বেসমেন্ট লিজ নিলে পাশের স্টোররম্নমে শতাধিক চিনের চিত্রিত সিরামিকের পেস্নট পেয়ে যাই। বিত্তশালী এ-পরিবার শৌখিন এ-পেস্নটগুলো সম্ভবত ব্যবহার করত পালা-পরবের ভোজ-উৎসবে। আমি এগুলোতে পাখিদের উড্ডয়নের নানা ভঙ্গি অাঁকছি। একটি পেস্নটে চিনা শিল্পীদের অাঁকা পাখির ছবি ছিল। সেগুলো স্টাডি করে আমি কিছু আইডিয়া পেয়ে যাই। ম্যানরদের আমলে চুয়িং টোব্যাকো খেয়ে পিক ফেলার একটি স্পিটন বা উগলদানির ওপর ডিসপেস্ন করা চিনা শিল্পীর আঁকা সিরামিকের পেস্নটে পাখির চিত্রের দিকে ইশারা করে সারা বলে, এ-ছবিটি আমার অাঁকা নয়, তুমি চাইলে তোমার ক্যামেরায় এর প্রতিলিপি করে নিতে পারো।

আমি ক্যামেরায় ক্লিক করে চিনা বার্ডপেস্নটের ছবি তুলে নিলে সারা তাঁর অসাধারণ রম্নপালি রঙের চুল হেয়ার টাই দিয়ে জড়াতে জড়াতে বলে, তথ্যপুসত্মকে আমার বার্ডপেস্নট সম্পর্কে তুমি যা পড়োনি সে-সম্পর্কে জানতে তোমার ইন্টারেস্ট আছে কি? আমি তার মৃদু রহস্যময় হাসির দিকে নজর করে – ওহ্ ইয়েস, বললে সে একটি বার্ডপেস্নট তুলে তাঁর পেছন দিকে লেখা বিবরণ দেখায়। তাতে কখন সে একটি পাখিকে কী পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং অাঁকতে কতদিন লেগেছে, তখন তাঁর মানসিক অবস্থা কী রকম ছিল ইত্যাদির বর্ণনা দেওয়া আছে। হাসিতে রহস্যময়তা আরো গাঢ় করে সে বলে, আমি চাই কোনো ক্রেতা হাইকার যখন এ-বার্ডপেস্নট কিনবে, সে-অাঁকার পেছনে যে মেহনতের ব্যাপার আছে, আর তাতে ফুটেছে যে উড্ডয়নের রূপরঙিন মুহূর্ত তা যেন প্রথমে অ্যাপ্রিসিয়েট করে। তারপর চলার পথে কোনো ধূসর রকের সামনে দাঁড়িয়ে স্মরণ করে তার জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনা। যে ব্যক্তিগত ঘটনার ফলে তার মনে জমে আছে ক্লেদ, ক্ষোভ ও ব্যাপক ক্রোধ। সমসত্ম কিছু যেন সে ইন ডিটেইলস ভেবে রকের ওপর আছাড় মেরে সিরামিকের বার্ডপেস্নটটি ভেঙে ফেলে।

বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে অর্ধভগ্ন সিঁড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বিদায় নেওয়ার সময় আমি জানতে চাই – তোমাদের আমিশদের মধ্যে বার্টারের প্রচলন আছে কি? আছে মানে, আমিশরা তো সবকিছু নিজেরা তৈরি করতে পারে না। এক বসত্মা গমের পরিবর্তে সাবান, লবণ, ওষুধপথ্য এসব তো বার্টারের মাধ্যমে তারা হামেশা বিনিময় করে থাকে। আমি এবার আমার সঙ্গে তার বার্টারের আগ্রহ আছে কি না জানতে চাইলে সে বলে, আর ইউ ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট ওয়ান অব মাই বার্ডপেস্নটস? বিনিময়ে তুমি কি অফার করতে চাও? আমি জবাব দেওয়ার আগেই চিউচিউ করে রবিন পাখিটি বেরিয়ে আসে। ওহ্ ডিয়ার মি. রবিন, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ ওয়ান্ট সাম ফুড, বলে সারা মাটি থেকে শুকনা এক ডালের ভাঙা টুকরা কুড়িয়ে নিয়ে ভেজিটেবল প্যাচ থেকে তা দিয়ে খুঁড়ে বের করে কেঁচো। রবিন ঠুকরে তা তার ঠোঁটে তুলে নিলে আবার কথা বলার অবকাশ আসে। আমি বলি – না, বার্ডপেস্নট আমি চাচ্ছি না। নট রিয়েলি ইন্টারেস্টেড। সে এবার প্রশ্ন করে – সো হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট রিয়েলি? আমি আজকের খাবারের সংকুলান হয়নি এ-বিষয়টি ভেবে বলি – লুকিং ফর সাম বেসিক ফুড। জঙ্গলে হাইকিং করছি তো বেশ কয়েকদিন ধরে। খাবারের সাপস্নাই ফুরিয়ে এসেছে।

সে বাগান থেকে কিছু লেটুস, পেঁয়াজপাতা, টমেটো ইত্যাদি তুলে নিয়ে বেসমেন্টে গিয়ে ধুয়ে তা পলিথিনের ব্যাগে ভরে দেয়। আমি প্যাকেট তুলতে গেলে দেখি লেটুসপাতার সবুজ মোড়কে একটি সাদা সিদ্ধ ডিম। এ খাবারের বিনিময়ে বার্টার হিসেবে কী দিতে পারি? হোয়াট কুড আই অফার ইউ ইন এক্সচেঞ্জ? বলে আমি ব্যাকপ্যাক খুলতে গেলে সে হেসে বলে – ডোন্ট ওয়রি, ÿুধার্ত অতিথির সঙ্গে সামান্য খাবার নিয়ে বার্টার করা ঠিক আমিশ ট্র্যাডিশন না।

মি. রবিনকে হাতে নিয়ে সারা হেঁটে হেঁটে ম্যানর হাউসের বাইরে ট্রেইলহেড অব্দি আসে। হোয়াট ইজ ইয়োর নেক্সট প্রজেক্ট? আগামী দিনগুলোতে তোমার কী করার পরিকল্পনা আছে সারা? আমি জানতে চাইলে সে জবাব দেয় – ওয়েল, ওয়েল, কাল আমার হোয়াইট হর্স আইজাকে মি. রবিনকে চড়িয়ে নিয়ে শহরের দিকে ছুটব। ভেটেরিনারিয়ান হাসপাতালে রবিনের ব্যবস্থা হলেই একটু সামনে গিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুঁ মেরে দেখব সোলার পাওয়ারের প্যানেল মেরামত করার কোনো ম্যানুয়েল জাতীয় বইপুসত্মক পাওয়া যায় কিনা। অটামের এ-মৌসুমে হাইকাররা এদিকে আসবে, তখন যদি  কয়েকটা বার্ডপেস্নট বিক্রি হয়, ভাবছি ফার্ম থেকে একটা গরম্ন কিনে নিয়ে আসব। সোলার পাওয়ারে একটি রেফ্রিজারেটর চালাতে পারলে গরম্নর দুধে পনির করা যাবে। তাতে আমার স্টুডিও খাবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। একজন আমিশ গার্লের জীবনযাপন তো এরকমই হওয়ার কথা। হোয়াট এল্স ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো?  ধরা যাক বেসমেন্টে পাওয়া সব চিনা সিরামিকের পেস্নটে তোমার ছবি অাঁকা হয়ে গেলে তখন পেস্নট কোথায় পাবে? আমি প্রশ্ন করলে রেসপন্সে সে বলে – আই হ্যাভ অ্যান আইডিয়া ইন মাই মাইন্ড। কিন্তু জানি না কীভাবে তার বাসত্মবায়ন করব? আমি চুলিস্ন তৈরি করে শ্যানানডোয়ার চর থেকে কাদামাটি বালি নিয়ে এসে তাতে পেস্নট বানিয়ে পোড়াব। আমি এমন একটি পেস্নট বানানোর প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে চাই যা আছাড় মারলেও সম্পূর্ণটা ভাঙবে না। চারদিকের মোটিফ, পেস্নটের কিনারে অাঁকা নিসর্গের চালচিত্রের রূপরেখা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, তবে মধ্যখানে পাখির উড়াল দেওয়ার আবহ অভঙ্গুরই থেকে যাবে। আর যে হাইকার বার্ডপেস্নটটি আছড়াবে তার চোখের সামনে পাখির প্রতিকৃতি লাফিয়ে উঠবে। এতে সৃষ্টি হবে উড্ডয়নের বিশেষ এক অনুকৃতি, তাতে মনে হবে খেচরটিকে যেন মুক্ত করা হলো সিরামিকের পিঞ্জিরা থেকে। আমার পেস্নট ভেঙে যেন একজন হাইকার বা ক্রেতা তার অতীতের নেগেটিভ কোনো এক্সিপিরিয়েন্সকে ভেঙেচুরে তার ভেতর থেকে গতিময় কিছুকে ভবিষ্যতের দিকে ওড়াতে পারে। কথা বলতে বলতে তার নীলাভ চোখে ইমাজিনেশনের দ্যুতি খেলে যায়। আমি যেন তাতে কোনো এক পরিযায়ী পাখির দিগমেত্মর দিকে উড়ে যাওয়ার প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। এবার সে জানতে চায় আমার গমত্মব্য। আমি ভিয়েতনাম যুদ্ধের এক সাবেক সৈনিকের ডেরায় পৌঁছতে চাচ্ছি বললে সে একটি ট্রেইলের পাশে ছড়ানো রক ফরমেশনের লাগোয়া বনানীর বর্ণনা দিয়ে বলে, ওখানে পৌঁছতে পারলে সন্ধ্যাবেলা খেয়াল করে দেখো তো জোনাকি জ্বলছে কি না? তা জোনাকির জ্বলানেভা নিয়ে তোমার আগ্রহ কেন? প্রশ্ন করলে সে জবাব দেয় – দিস পারটিকুলার ফরেস্ট হ্যাজ আ টোটালি ডিফরেন্ট ইকো সাব সিস্টেম। হাইকারদের কাছ থেকে শুনেছি কেবল এই ছোট্ট বনানীতে এ-সিজনে জোনাকি দেখা যায়। আর এক ধরনের নিশাচর পাখি উড়ে-উড়ে আলোময় পোকাগুলো ধরে ধরে খায়। যদি তুমি জোনাকির সন্ধান পাও, ফেরার পথে ম্যানোর হাউসে থেমে আমাকে জানিয়ে যেয়ো। তাহলে আমি ওখানে তাঁবু খাটিয়ে এক রাত থেকে জোনাকি ও নিশাচর পাখির বিষয়টি স্কেচ করে আনতে পারব। আর ততদিনে হয়তো একটি পেস্নটে মি. রবিনের কেঁচো খাওয়ার বিষয়টি অাঁকা হয়ে যেতে পারে।

অবশেষে গুডবাই বলে একা ট্রেইল ধরে খানিক হেঁটে বুঝতে পারি ÿুধা পেয়েছে। এখনো জলাশয় অতিক্রম করিনি। তার কিনার ঘেঁষে একটি পাথরে বসে সবজির সালাদ ও সিদ্ধ ডিমের কথা ভাবি। না, এগুলো এখনই খেয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ব্যাককান্ট্রি ক্যাম্পিংয়ের সাইট খুঁজতে আমাকে যেতে হবে অনেক দূর। সন্ধ্যার দিকে খাওয়ার জন্য হাতে কিছু খাবার মজুদ রাখা ভালো। সাতপাঁচ ভেবে হার্সির চকোলেট বার বের করে খেতে-খেতে আবার ম্যানর হাউসের ভগ্ন ইমারতের দিকে ফিরে তাকাই। সারার চুলের অসাধারণ রম্নপালি আভা কিংবা তার সত্মনযুগলের বন্য দোদুল্যমানতা দৃষ্টিতে শোভা ছড়ালেও তার শরীর ছড়িয়ে অন্য একটা কিছু আমাকে স্পষ্ট আকর্ষণ করেছে। বোধকরি অজানা কোনো হাইকারকে সঙ্গ দেওয়ার বিষয়ে তার সহজিয়া আচরণ আমার মনে রেখাপাত করেছে। তার সঙ্গে আমার জীবনযাপনের আশ্চর্য কিছু মিল ও তীব্র সব অমিল নিয়ে আমি ভাবি। তার মতো ভিন্ন ধর্ম ও গাত্রবর্ণের নারীকে ভালোবাসা নিয়ে পরিবারের সঙ্গে আমারও দ্বন্দ্ব হয়েছে। তিনি এ-সমস্যা প্রকাশ্যে সাক্ষাৎকারে বলতে পেরেছেন। আমি কিন্তু এ-নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারব না। কারণ আমাদের মূল্যবোধ ভিন্ন। অনেক দিন হয় আমিও পরিবারের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। আমার পোশাক-আশাক, চালচলন ও বাচনভঙ্গিতে আসছে পরিবর্তন। অনেকদিন হয় আমি মাতৃভাষা বলি না। ভিনদেশে পথ চলতে গিয়ে বিবর্তিত হচ্ছে আমারও ধ্যানধারণা এবং
সাংস্কৃতিক বিশ্বাস। যত দিন যাবে আমি আরো বদলাব। আমার আদি মূল্যবোধের অবক্ষয় হবে। নতুন সব দৃশ্যপট ও হরেকরকমের মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় আমার ভেতরেও তৈরি হবে মিশ্র এক মূল্যবোধ। মনে হয় এ-প্রক্রিয়া আমার অবচেতনে ইতোমধ্যে শুরম্ন হয়ে গেছে। অনেক দূর যেতে যেতে, রকমারি সব জনপদ অতিক্রম করতে-করতে আমিও শিখে নেব বিবিধ ভাষা। তারপরও মনে হয় আমার কৌর আইডেনটিটি, মূল পরিচয় থেকে যাবে আগের মতোই সাদামাটা সহজিয়া এক বাঙালি। ভাবতে ভাবতে পানিতে ভাসা আমার কুঁজো দেহের পিঠে বাঁধা মসত্ম ব্যাকপ্যাকের প্রতিফলনের দিকে তাকাই। কয়েকটি সবুজে লালচে হরিদ্রাভ রঙের পাতা জলে ভাসছে। তার একটির ওপর বসে ছোট্ট একটি সবুজ ব্যাঙ। আমি তার দিকে তাকালে পাতা ছেড়ে ব্যাঙটি লাফ দিয়ে জলে নামে। তাতে পানিতে সৃষ্ট হয় গর্তময় এক বৃত্ত। মৃদু কম্পনে আমার প্রতিফলিত ভাবনার মতো বৃত্তের পরিসর বড় হতে থাকে।