বন্ধুজন!!!

তাকে আমার চেনার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু একদিন দেখলাম, আমার কাছে তার বন্ধু হওয়ার ভার্চুয়াল অনুরোধ এসে বসে আছে। সে-সময়কার কথা, যখন ফেসবুক নামের অহেতুক ভোগাস্তিটা কেবল আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নিয়মিত রুটিনের বারোটা বাজিয়ে জাঁকিয়ে বসার আয়োজন করছে। নতুন নতুন সবকিছুই ভালো লাগে, অন্যরকম লাগে। এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করে। সেই উত্তেজনার প্রায় সময় আমাদের স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগের বেলায় খানিকটা শিথিলতা কাজ করে। আমরা বুঝে বা না বুঝে বোকার মতো আচরণ করে ফেলি।

যেমনটা ঘটল শরাফত ভাইয়ের ক্ষেত্রে। অফিসের সহকর্মী। জেলা অফিস থেকে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। পরিচয় হলো আরেক সহকর্মী সুমাইয়ার মাধ্যমে। তারা অফিসের এক গাড়িতে যাওয়া-আসা করে। মাঝে মাঝে অফিসশেষে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির সব সহযাত্রী মিলে এখানে-ওখানে, ভালো কোনো খাবারের দোকানে নেমে এটা-সেটা ভালোমন্দ খায়। সারাদিনের অফিসের ক্লাস্তি হালকা হাসি-ঠাট্টায় দূর করার চেষ্টায়।

সুমাইয়াদের এসব গল্প শুনতে আমার ভালো লাগে। খানিকটা লোভও হয় এরকম চমৎকার কিছু সময় কাটানোর। কিন্তু আমি ওই পথের যাত্রী নই বলে সংগত কারণে তা আর হয়ে ওঠে না। তারপরও একদিন শরাফত ভাই, তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরপর, একদিন আমাকে তাদের বৈকালিক আড্ডায় ভিড়িয়ে নিলেন এবং অফিসশেষে দলবেঁধে সবাই গিয়ে জেনেভা ক্যাম্পের বিখ্যাত চাপ খাওয়া হলো। ওই একদিনই।

শরাফত ভাইয়ের কথা চলে এলো আসলে ফেসবুক নামের আধুনিক বিড়ম্বনার কথা বলতে গিয়ে। একদিন আমরা সবাই মিলে মিলি আপার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি। সকাল ১১টা-সাড়ে ১১টা হবে। সকালের এরকম সময় প্রায় আমরা কাজের ফাঁক গলে কারো না কারো রুমে বসে কিছুক্ষণের জন্য গল্প-গুজব-কৌতুকে মেতে উঠি। আমি যতটা বলি, তার চেয়ে বেশি শুনি। একেকজনের একেক ভঙ্গিতে বলা নানা কিসিমের কথা শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে।

শুনতে শুনতে ফেসবুকের প্রসঙ্গটা এলো। সে-সময়কার কথা, যখন এই জুকারবার্গীয় জুজুটা মাত্র আমাদের ঘাড়ে সেঁটে বসছে সময়মতো মটকে দেওয়ার মতলবে। বই পড়ার মতো হৃদয়প্রসারী আনন্দলাভের অভ্যাস আর বন্ধু-স্বজনের নির্মল সাহচর্যের পরশ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে একটা প্রায় বোধ-বিবেকশূন্য জেনারেশন গড়ে তোলার অর্থহীন মিশন নিয়ে। প্রযুক্তির চূড়ান্ত নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে।

‘ফেসবুক আবার কী জিনিস রে ভাই?’ হঠাৎ শিঙাড়া খেতে খেতে শরাফত ভাইয়ের হাস্যকর প্রশ্ন। আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম এই দারুণ বিষয়ে এখনো তার জ্ঞানলাভ হয়নি জেনে। তারপর তার মুখের ভেতর আলু-আটার দলাটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম এবং আমার যা হয়, যথারীতি নীরবে গা গুলিয়ে উঠল।

খেতে খেতে আমি কথা বলতে পারি না, আর কথা বলার সময় মুখে কিছু পুরে দিই না। এতে আমার কথার গতি শস্নথ হয়ে পড়ে, পে­টের খাবার পে­টেই পড়ে থাকে। ভালো কি মন্দ অভ্যাস জানি না, বিষয়টা আমার সঙ্গে একেবারেই যায় না। কিন্তু শরাফত ভাই এসব টেবিল ম্যানারের ব্যাপারে একেবারে তোয়াক্কাহীন। শব্দ করে খাচ্ছেন, কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন, মুখভর্তি খাবার নিয়ে হো-হো করে হাসছেন, কথা বলতে বলতে বিকারহীন থুথু ছিটাচ্ছেন, আবার কখনো ডান হাতের তর্জনী গালে ঢুকিয়ে মাড়িতে লেপটে যাওয়া বিস্কুটের ল্যাদা গলিয়ে চটপট তা গিলে ফেলছেন! কী ভয়ংকর অসহনীয় অবস্থা আমার জন্য এসব দৃশ্য চোখের সামনে অবলোকন করা! কোনো উপায় না পেয়ে আমি চোখ নামিয়ে বা সরিয়ে ফেলি।

কিন্তু চোখ সরিয়ে ফেলতে পারলেও কান বন্ধ করতে পারলাম না যখন নাকি ফেসবুকের ব্যাপারে শরাফত ভাই তার চরম অজ্ঞানতার পরিচয় দিলেন। যেখানে বলতে গেলে জগতের প্রায় সব বিষয়ে, বিশেষ করে রসালো গল্পের রসদ সরবরাহে, তার জুড়ি মেলা ভার, সেখানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই অভিনব সৃষ্টির বিষয়ে তার কিছুই না-জানা আমাদের কাছে খুবই অবিশ্বাস্য ঠেকল। তাই কেউ কিছু বলার আগেই আমার সচরাচর বন্ধ থাকা মুখের কপাট খুলে গেল হুড়মুড় করে।

‘কী আশ্চর্য, শরাফত ভাই! আপনি এখনো ফেসবুকের নাম শোনেননি? কোথায় বাস করেন বলেন তো?’

‘কেন রে, ভাই, সবাইকে সবকিছু জানতে হবে এমন কোনো দিব্যি কোথাও দেওয়া আছে নাকি?’

‘না, তা নয়। তারপরও আজকাল এই নতুন হুজুগ নিয়ে সবাই খুব মজে আছে কিনা তাই। আর আপনি সেখানে কিছুই জানেন না শুনে খুবই অবাক হচ্ছি।’

আমরা প্রত্যেকে আমাদের যার যার অ্যাকাউন্ট নিয়ে কথা বললাম। কার কয়জন বন্ধু ইত্যাদি। আসক্তিটা দিনদিন কেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আর কাজের অনেকখানি সময় গিলে খাচ্ছে এসব সমাচার।

‘তাহলে দিন না ভাই আমাকেও একটু শিখিয়ে, কীভাবে এই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়।’ নাকি সুরে শরাফত ভাইয়ের আহ্লাদমাখা আবদার।

দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হলো। মিলি আপার কম্পিউটারে বসে অ্যাকাউন্ট খোলার সব ধাপ একে একে আমি শরাফত ভাইকে বুঝিয়ে দিলাম। তিনিও বাধ্য ছাত্রের মতো সবকিছু শুনলেন বলে মনে হলো এবং তার নিজের রুমে ফিরে অ্যাকাউন্ট খুলে আমাদের সবাইকে রিকোয়েস্ট পাঠাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর আমি বা আমরাও একটা গুরুদায়িত্ব ভালোভাবে শেষ করেছি ভেবে যে যার রুমের দিকে পা বাড়ালাম।

অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল সেদিন দুপুরের দিকে। সম্ভবত লাঞ্চের পরে। কেবল একবার ঢুঁ মেরেছি সেই মোহাবিষ্ট জগতের উন্মুক্ত  প্রান্তরে। মেসেজের ঘরে রেড অ্যালার্ট। বেশ উৎসুক হয়ে উঠলাম। কে আবার কী বার্তা পাঠাল কে জানে। নিজে থেকে কাউকে অনুরোধ পাঠাতে সংকোচ কাজ করে বটে। তবে কারো রিকোয়েস্ট পেলে ততোধিক আনন্দে মনটা ভরে ওঠে। ইনবক্স মেসেজের বেলাতেও একই কথা। তাই সময় নষ্ট না করে মেসেজের ঘরের লাল বিন্দুতে ক্লিক করে বসলাম আর চোখের সামনে ভেসে উঠল একজন অচেনা মানুষের আইডি – শুভ্র হাসান। এ নামের কাউকে চিনি বলে চটজলদি মনে করতে পারলাম না। মেসেজে চোখ বোলাতে গিয়ে মিলল আরো রহস্যের ছোঁয়া। ‘ভেবেছেন, আমি কিছুই জানি না। অথচ আপনাদের অনেক আগে থেকেই এই জগতে আমার ঘোরাঘুরি। আজ আপনাদের সবার সামনে বোকা বনে বসে থাকতে বেশ ভালোই মজা পাচ্ছিলাম। চিনতে পেরেছেন?’

জীবনে এ-ধরনের নিষ্ঠুর রসিকতার মুখোমুখি খুব কমই হয়েছি। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আমার এতটুকুও দেরি হয়নি। একবার ভাবলাম, এরকম তৃতীয় শ্রেণির ফাজলামির জন্য শরাফত ভাইকে দু-চারটা কথা শুনিয়ে দেব। অন্তত বেনামের আইডির জন্য হলেও তাকে কিছু বলা দরকার। আবার কী ভেবে নিজেকে সংবরণ করলাম। জীবনে বহুবার বহুরকম পরিস্থিতিতে এভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে গেছি, আজো যাচ্ছি। হয়তো ভবিষ্যতেও যেতে হবে ব্যক্তিচরিত্রের কারণে। তাতে কার কী লাভ হয়েছে জানি না, আমার কোনো লাভ হয়নি। কেবল ভেতরে ভেতরে ‘দেখিস, একদিন আমিও’ চিৎকারে ফুঁসেছি আর তুষের আগুনের মতো নিভে নিভে জ্বলেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার খুব মুখ খুলে কথা বলতে ইচ্ছা করে। আশপাশের ভ- বেশধারীদের জানাতে ইচ্ছা করে যে, সবার মুখোশের আড়ালের চেহারাটা আমি ঠিকই দেখতে পাই। খুব ভালো করে জানি যে, সামনাসামনি তারা যা বলে বা করে তা আসলে কতটা সাড়হীন বাগাড়ম্বর। আর এসব দুর্জ্ঞেয় জ্ঞানের কথা জানালেও তাদের আচরণের তেমন কোনো রকমফের হবে না বলেই চুপ করে থাকি।

দুই

সেই যে অচেনা যার কাছ থেকে বন্ধু হওয়ার অনুরোধ এসেছিল তার নামের লেজে বেশ বাহারি এক ঠাট লটকানো আছে। মানে চটকদার এক প্রাচীন পারিবারিক উপাধি। সেটা না হয় নাইবা বলি। তার শুভনাম শারমীন। বেশ একটা নজরকাড়া ছবি দিয়ে রেখেছে প্রোফাইল পিকচারে। পোশাকে পশ্চিমা প্রভাব। টাইট জিন্স, ফ্লোরাল মোটিফের টপস আর মাথায় স্ট্র হ্যাট। নায়িকার ভঙ্গিতে কোমরে হাত দিয়ে সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আছে। সাইড প্রোফাইলের ছবিতে দৃশ্যমান শারীরিক আবেদনের চূড়ান্ত প্রকাশ। এসব ভঙ্গিমার ছবি দেখলে আমার বেশ কৌতুক বোধ হয়। করুণামিশ্রিত এক ধরনের বিবমিষাও। আর অনেকদিন আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ অবধারিতভাবে।

খান স্যারের টিউশনিতে গ্রুপের সবাই নানারকম খুনসুটিতে ব্যস্ত। আমি অবশ্য সিরিয়াস মুখ করে স্যারের গমগমে কণ্ঠস্বরের লেকচার শুনতে সবটুকু মনোযোগ দিয়ে রেখেছি। উদারিং হাইটস নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে। পরের সপ্তাহে স্যার আমাদের উপন্যাসটির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত তাঁর সংগ্রহের সিনেমাটি দেখাবেন বলেছেন। তাই নিয়ে দারুণ উত্তেজনা। বিশেষ করে আমার মধ্যে। ইত্যবসরে ক্যাথরিনের ভূত আমাকে প্রায় পুরোটাই অবশ করে ফেলেছে। আর হিথক্লিফ স্বপ্নের নায়ক হিসেবে যখন-তখন চেতন-অবচেতনের দুয়ারে হানা দিয়ে যাচ্ছে। তার বন্য সৌন্দর্যের ভেতর কোনোভাবেই এড়ানো যায় না এমন এক ব্যাখ্যাতীত আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছি। এর আগে টমাস হারডির রিটার্ন অভ দ্য নেটিভ আর মেয়র অভ ক্যাস্টারব্রিজ উপন্যাসদুটি পড়ে ওই নায়কদ্বয়ের জন্য আমার এমন বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছিল। ভীষণভাবে। বয়সটাই ছিল অমন।

যাক সেসব কথা, যা মনে পড়লে কেবল মিসটেরিয়াস মেলাঙ্কলিতে মনটা সিক্ত হয়ে ওঠে। যা বলছিলাম – সিনেমার কথা উঠলে নায়ক-নায়িকার প্রসঙ্গ চলে আসবে, এ তো স্বাভাবিক। তাই আলোচনার সূত্রে একসময় খান স্যার তাঁর স্বভাবসুলভ টিপ্পনীর সুরে গ্রুপের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে কৌতুক করে বললেন, ‘কি, মাঝে মাঝে নিজেকে নায়িকা ভাবতে ইচ্ছে করে তো, নাকি?’

কথাটা বলার সময় স্যারের দৃষ্টি বিশেষ করে নিবদ্ধ হলো ঠিক তাঁর পাশেই বসা সুরঞ্জনার দিকে। বেচারি একে তো তার নাম নিয়ে সবসময় দৌড়ের ওপর আছে। তার ওপর আছে তার রঙিন সাজসজ্জার বলিহারি বাহার। এত সময় কীভাবে ম্যানেজ করে এ আমার কাছে এক ঘোরতর রহস্য। পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে যখন আমি চুল আঁচড়ানোর সময়টুকু পর্যন্ত বের করতে পারি না, সেখানে সুরঞ্জনা দিব্যি চোখে ঘন কাজল এঁকে, মোটা ঠোঁটে লিপস্টিকের পুরু প্রলেপ মেখে সময়মতো চলে এসেছে। সঙ্গে নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাকের প্রদর্শনী তো আছেই। একদিক থেকে দেখলে এটাকে তার বিশেষ গুণই বলা যেতে পারে। আমি সাজি না বা সাজতে পছন্দ করি না বলেই এর গুরুত্ব কোনো অংশে কমে যাবে, ব্যাপারটা তা নয়।

স্যারের কথা শুনে আর মিটিমিটি হাসি দেখে সুরঞ্জনাও সুন্দর একটা হাসি ছুড়ে দিলো। সঙ্গে গ্রুপের অন্য ছেলেমেয়েরাও। কেবল আমিই কেন জানি না বোকার মতো বলে বসলাম – ‘জি না, স্যার, আমার কখনো নায়িকা হতে ইচ্ছা করে না।’

কথাটা বলেই বুঝতে পারলাম কি মারাত্মক ভুলটাই না করে ফেলেছি। সর্বজনস্বীকৃত একটি ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত এক বক্তব্য দিয়ে বসে আছি, যাতে কেবল একধরনের নির্বুদ্ধিতা বা গোঁয়ার্তুমি প্রকাশ পায়। নিজেকে নির্বোধ ভাবতে ভালো না লাগলেও জেদি বা একগুঁয়ে ভাবার মধ্যে বেশ একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করতাম সে-সময়। আজ এতদিন বাদে বিবিধ নির্জলা অভিজ্ঞতার রসে-রক্তে সিক্ত-রিক্ত হয়ে অবশ্য সেই অনুভব থেকে বলতে গেলে অনেকটাই সরে এসেছি। এখন বাস্তবতাকে নিরেট বাস্তবতা বলেই মেনে নিতে চেষ্টা করি। পছন্দ হোক বা না হোক। নিজস্ব অনুভূতির মানদ– বিচারের পাশাপাশি এটাও এখন বিশ্বাস করি, ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যরে লও সহজে।’

তাই, যুগপৎ বিস্ময় এবং বিরক্তির সঙ্গে দেখতে পাই, জুকারবার্গ নামের তরুণ ছেলেটি কি অদ্ভুত মুন্শিয়ানায় মানবমনের অন্যতম চিরন্তন আকাঙক্ষাটিকে ফেসবুক নামক আশ্চর্য ভেলকিবাজির জাদুতে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সহজতম পথটি বাতলে দিয়েছে। নার্সিসাসের আত্মপ্রেমে বুঁদ থাকার গল্প সেও তো কম পুরনো নয়!

যাক গে। সুরঞ্জনাকে আমার সালাম ঠোকা উচিত, কারণ সে অন্তত একটি সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছে তার হাসির মধ্য দিয়ে। আমি তা করতে পারিনি। অর্থহীন প্রতিবাদ করতে গিয়ে অন্যদের সামনে তো বটেই, নিজের কাছেই নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তুলেছি। কারণ, আমার কথা শুনে স্যার একটু ভেংচি কেটেছিলেন, যার অর্থ, ‘ওরে বোকা মেয়ে, শুধু শুধু তর্ক করা কেন!’ খান স্যার অমনই ছিলেন। এরপর তিনি আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, স্বীকার করি আর না করি, আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই নিজেকে নায়ক বা নায়িকা মনে করার একরকমের সহজাত বাসনা সুপ্ত অবস্থায় আছে বা থাকে। কেউ তা প্রকাশ করে ফেলে, কেউ করে না বা করতে পারে না। সেও সহজাত লজ্জা বা দ্বিধার কারণে। তবে প্রকাশ না করলেও বিষয়টার অস্তিত্ব বা সত্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণের কোনো সুযোগ নেই। আমি চুপ করে স্যারের কথা শুনে গিয়েছিলাম। এখন তো চারপাশে তাকালেই দেখতে পাই এর অমোঘ অনস্বীকার্যতা।

 

তিন

মিস শারমীনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে বেশ খানিকটা অবাক হলাম। কারণ তিনি আমার পরিচিত কেউ ছিলেন না। সে-সময় দু-একজন কমন ফ্রেন্ড কেউ আমাদের বন্ধু তালিকায় ছিল কিনা আজ আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে, দ্রুতই তার অনুরোধ গ্রহণ করেছিলাম। কারণ ইতোমধ্যে তার ওয়াল থেকে ঘুরে এসে বেশকিছু প্রয়োজনীয় তথ্য ওয়াকিবহাল হয়েছি এবং জেনে ফেলেছি, চাকরিতে তিনি আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়র। যদিও তার ফেসবুক অ্যাক্টিভিটিতে একটু বেশি মাত্রার প্রগলভতা ফুটে উঠেছে, যা তার সিনিয়রিটির সঙ্গে বেমানান। সে যাক, সঙ্গে সঙ্গে আমার এ-ও বুঝতে বাকি থাকল না যে, তিনি একটি সাধারণ ভুল করে ফেলেছেন। এর আগেও আমার সঙ্গে আরো কয়েকজনের এমনটি ঘটেছে। একই নামঘটিত বিভ্রাস্তি। যদিও সে-অর্থে আমার ভালো নামটি ততটা বহুল প্রচলিত নয়।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মিস শারমীনকে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালাম ইনবক্সে। সম্ভাব্য বিভ্রাস্তি ব্যাখ্যা করে। সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও চাকরিতে যেহেতু তিনি আমার সিনিয়র, সে-কারণে মেসেজেও তার প্রতি প্রাপ্য সম্মান দেখাতে কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ করিনি। বলা দরকার, তার কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পেলাম না, যা আমি কিছুটা হলেও আশা করেছিলাম। প্রথমে সামান্য খারাপ লাগলেও তা ভুলে যেতে সময় লাগেনি। শুধু নিজেকে বললাম, তার জায়গায় আমি থাকলে সুন্দর একটা থ্যাংকস মেসেজ পাঠাতাম। এটাই ভার্চুয়াল ভদ্রতা, যার জন্য অতিরিক্ত প্রাইস পে করতে হয় না।

বোধ করি, ভুলটা বুঝতে পেরে মিস শারমীন খানিকটা বিব্রত হয়েছিলেন। তার পক্ষে ভুল করার যথেষ্ট কারণ এজন্য ছিল যে, সে-সময় পর্যন্ত আমার প্রোফাইলে সহজে চেনা যেতে পারে এমন পরিচায়ক কোনো ছবি ঝোলানো ছিল না। চেনাজানা গণ্ডির ভেতরেই ফেসবুকীয় চলাফেরা সীমাবদ্ধ ছিল বলে নিজেকে প্রকাশ করার তেমন কোনো আগ্রহ বা প্রয়োজন অনুভব করিনি। পরে অবশ্য মত পালটে ছবি দিয়েছি। মত বদলানোর পক্ষে ব্যাখ্যা ছিল এরকম যে, ফেসবুক শব্দটার মধ্যে ফেস একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কাজেই এটি যদি আমি ব্যবহারই করি, তাহলে ন্যূনতম বিবেচনা বজায় রেখে এর প্রাথমিক অলিখিত শর্তগুলো মেনে চলাই ভালো। তাতে অন্ততপক্ষে হিপোক্র্যাসি দোষে আক্রান্ত হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না। ‘ফেসবুকে আছি, আবার থাকার মতো নেই’ ব্যাপারটা আমার কাছে একধরনের হিপোক্র্যাসি বলেই মনে হয়। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, নাচতে নেমে ঘোমটা টানার কী অর্থ থাকতে পারে। তবে যুগ পালটেছে। সেদিন এক হলুদের অনুষ্ঠানে সবিস্ময়ে দেখলাম, ঘোমটার সমার্থক কিছু একটা মাথায় বেঁধেই ধুম-ধাড়াক্কা হিন্দি গানের সঙ্গে তরুণীদের বুক নাড়িয়ে, হৃৎকম্পন বাড়িয়ে তুমুল নাচানাচি। আমি মনে মনে বললাম, মাভৈ মাভৈ!

যাক। মিস শারমীন আমার মেসেজের জবাব না দিলেও আমাকে তার বন্ধু-তালিকা থেকে বাদও দিলেন না বা দিতে পারলেন না। যুক্তিসংগত কারণে। তবে তার সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো ধরনের যোগাযোগও হলো না। অনেকটা নীরব ঘাতকের মতো নীরব বন্ধু হয়ে থেকে পরস্পরের পোস্টগুলো দেখতে থাকলাম। যদিও এ-ব্যাপারে আমি তখনো খুব একটা অ্যাক্টিভ ছিলাম না। তবে তিনি ছিলেন বেশ নিয়মিত এবং নিত্যনতুন তার এবং পরিবারের সদস্যদের নানা ঢঙের ছবি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগেই বলেছি। ব্যস অতটুকুই।

অদূরভবিষ্যতে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার কোনোরকম আদান-প্রদানের ক্ষেত্র তৈরি হতে যাচ্ছে – এ নিয়ে ওই মুহূর্তে আমার মনে বিন্দুমাত্র ধারণার সুযোগ ছিল না। আমাদের কার পক্ষেই বা সম্ভব এমন পূর্বজাত ভাবনার অভিজ্ঞান লাভ! মানুষ হিসেবে এখানেই তো আমাদের নিদারুণ সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে দাঁড়িয়ে যত আস্ফালনের আহাম্মকি করি না কেন, আমরা কেউই বলতে পারি না, ঠিক নিমেষের তফাতে আমাদের জীবনের রঙ্গমঞ্চে কোন দৃশ্যের অবতারণা বা কোন চরিত্রের আগমন ঘটতে যাচ্ছে।

 

চার

বদলির সুবাদে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার প্রথম রাতেই বেশ মাত্রার একটা ধাক্কা খেলাম। আবার সেই ফেসবুকীয় ফটো-ম্যাজিক। সে-রাতে যে-সহকর্মীর বাসায় ডিনারের দাওয়াত ছিল, সেখানেই এই জ্ঞান লাভ ঘটল যে, মিস শারমীন মাসপাঁচেক হলো সেখানে বদলি হয়ে এসেছেন এবং আসার পর থেকেই তার যতরকম ইত্যাদি। এই যতরকম ইত্যাদির স্বরূপ বুঝতে আমাকে আরো খানিকটা সময় ধৈর্যের সিঁড়ি পাড়ি দিতে হয়েছে। সহকর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম আমার মোবাইলে ফেসবুকের ছবিটার দিকে। সে জানালো, ছবিটা তার বাসাতেই তোলা একই রকম এক রাতের খাবারের আয়োজনে।

আরো যা জানলাম, সহকর্মীর বেশ খানিকটা নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বরে, ভদ্রমহিলা এক বা একাধিক শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন এবং সেখানে যোগ দেওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ সময়টাই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কাটিয়েছেন। ইনফ্যাক্ট, ওই সময়টাতেও তিনি হাসপাতালেই আছেন একটি জটিল অপারেশনের অপেক্ষায়। সম্ভবত দু-একদিন বাদেই তার অপারেশনের তারিখ। রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে আমার বিদ্যার দৌড় খুবই পীড়াদায়ক বলে আমি তার অসুখের জটিলতার ব্যাপারে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করলাম না। তবে সহকর্মীর কথার সুরে বুঝতে বাকি থাকল না যে, পাঁচ মাসেই মিস শারমীন একটি ট্রাবলসাম ক্যারেক্টার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। (যদিও হাতেগোনা দিন পার না হতেই আতঙ্কের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম যে, এই সহকর্মীও দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার আপাত গোবেচারা মুখোশের আড়ালের রূপ উন্মোচনের পর যে আঘাত পেয়েছিলাম, তার প্রভাব থেকে আজ কয়েক বছর বাদেও সবটুকু বেরিয়ে আসতে পারিনি। কারণ তার অগ্রহণযোগ্য আচরণের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার অভাব।) তো আরো বুঝলাম, জয়েন করতে না করতেই মিস শারমীনের এই হাসপাতাল-কাণ্ডে অফিসের বস মোটেই খুশি নন। একই সঙ্গে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কেউ শখ করে হাসপাতালের গণ্ডি মাড়ায় কিনা। অবশ্য সবকিছুই নিজেকে দিয়ে বিচার করা ঠিক নয়। যা হোক, ডিনার খেয়ে বেশ কিছু একটার সতর্ক আভাস পেয়ে অচেনা এক বাড়িতে এসে উঠলাম, যেখানে সামনের দু-তিন বছর আমাকে কাটাতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

দুদিন যেতে না যেতেই নতুন অফিসের পরিবেশ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেলাম এবং সেই ধারণা একদমই সুখকর কিছু নয় বলে প্রথম থেকেই অজানা এক শংকা বোধ করতে শুরু করলাম। চারপাশে থমথমে গুমোট এক দমবন্ধ পরিবেশ এবং এই কেউ দেখে ফেলল, শুনে ফেলল আর বসকে গিয়ে রিপোর্ট করল জাতীয় অশনিসংকেত।

তো, মিস শারমীনের অপারেশন বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে আরো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। বসের ব্যক্তিগত সহকারী থেকে অফিসের নিরাপত্তারক্ষী কাউকেই এ-ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহী পেলাম না। বরং সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। আশ্চর্য! অফিসের একজন কর্মকর্তার মেজর একটি অপারেশন হয়েছে। ন্যূনতম সৌজন্যবোধ বা মানবিকতাবোধ তো এক্ষেত্রে যথেষ্ট যে, তাকে দেখতে যাওয়া প্রয়োজন। যতই আধুনিকতার অস্বাভাবিকতায় আক্রান্ত হই না কেন, এখনো আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির চর্চা থেকে এ-রীতি বিলীন হয়ে যায়নি বলেই তো মনে হয়। যদিও অনেক ব্যাপারে বিকারহীনভাবে সামান্য মানবিকতার প্রকাশ থেকে আমরা কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছি কেবল নিজের ভাগটুকু পুরোপুরি আদায় করতে গিয়ে।

তাহলে কী? কোনো এক বা একাধিক কারণে কেউ যাবে না বলে আমিও যাব না? ভাবেসাবে মনে হচ্ছে, মিস শারমীনের ব্যাপারে এই অল্প সময়ে গড়ে ওঠা বসের নেতিবাচক মনোভাবকে গণনায় নিয়ে কেউ আর তাদের স্বাভাবিক মানবিক দায়িত্বটুকু পালন করতেও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছেন। আগে তো চাকরি বাঁচুক, তারপর মানবিকতা! আবারো আশ্চর্য!

যাক, সিদ্ধান্ত নিলাম, আগ-পাশ তেমন কিছু না ভেবেই। মিস শারমীনের সঙ্গে অফিসের কার কী হয়েছে এখন পর্যন্ত আমার জানার সুযোগ হয়নি। কেউ আমাকে পরিষ্কার করে তেমন কিছু বলেওনি। শুধু ‘কেয়ারলেস হুইস্পার’ জাতীয় হাশ-হাশ ফিসফাস। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আজতক আমার আনুষ্ঠানিক মোলাকাতই ঘটেনি। তিনি যে একই অফিসে জয়েন করেছেন তাও এখানে আসার আগে আমার জানা ছিল না। যদিও একটি পরোক্ষ যোগাযোগের মাধ্যম রয়ে গেছে সেই কবেকার ফেসবুক পরিচয়ের বদৌলতে। সেখানেও কোনো ধরনের সরাসরি ভাববিনিময়ের সুযোগ নেই, কারণ কেউই কাউকে চিনি না। আশ্চর্য! আবার নাকি বন্ধু!

যা হোক, সবকিছু বিবেচনায় এনে, একই ছাদের এবং বসের তলায় কাজ করার সাধারণ সূত্রটিকে কারণ হিসেবে গণ্য করে হাসপাতালে তাকে দেখতে যাওয়াই আমার জন্য সমীচীন বলে মনে হলো এবং আমি তাই করলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পথে তখন পর্যন্ত অপরিচিত শহরের রাস্তার এক কোণে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কয়েক স্বাদের ফলের জুস নিতেও ভুল করলাম না। মিস শারমীনের সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎপর্ব (ফেসবুক পরিচয়ের কয়েক বছর বাদে!) বেশ ভালোভাবেই উতরে গেল। অন্তত আমার তা-ই মনে হলো। কারণ, অপরপক্ষের মতামত জানার উপায় ছিল না। কারো সঙ্গে পরিচয়ের পরপরই তো আর তাকে জিজ্ঞাসা করা যায় না, ‘ভাই, আমাকে আপনার কেমন লাগল?’

কেবল বিস্ময়ের সঙ্গে (কোনো শারীরিক অভিব্যক্তি বা ভাষায় প্রকাশ করা, যা ভদ্রতাজনিত আচরণ বলে বিবেচিত হবে না বলে আমার ইন্স্টিঙ্কট আমাকে জানিয়ে দিলো) আবিষ্কার করলাম, একটি দীর্ঘ জটিল অপারেশনের দুদিন পরই ভদ্রমহিলা কেবিনের বিছানায় সটান উঠে বসে টানা দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় একনাগাড়ে কথা বলে গেলেন! কোনো ভিসিবল সাইন অব ক্লাস্তি ছাড়াই। বেচারা স্বামী প্রায় পুরোটা সময় হাসিমুখে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অপলক। মাঝে দুয়েকবার তাকে কম কথা বলার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছেন। আমার কথা বলা বাহুল্য। শুধুই নীরব শ্রোতা হয়ে থাকলাম – বারকয়েক ‘ও আচ্ছা’ আর তার কথায় মাথা নেড়ে যাওয়া ছাড়া। আসলে আমার কিইবা বলার ছিল। তাই আমার অবস্থানের গোটা সময়টা মিস শারমীনই যা বলার বলে গেলেন – তার অসুখের ইতিহাস ও বিস্তারিত আদ্যোপান্তসহ তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দেওয়া পর্যন্ত! নিজের রোগ সম্পর্কে তার জ্ঞানের বহর দেখে অবাক না হয়ে পারিনি – তার একটানা কথা বলার বিষয়টি ছাড়াও। মনে হলো, গুগলের কল্যাণে অসুখের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এত নিখুঁতভাবে তার নখদর্পণে যে সম্ভব হলে নিজের অপারেশনটি তিনি নিজেই করে ফেলতেন! হাসপাতাল থেকে প্রসন্ন মনে বের হয়ে এলেও দুয়ে দুয়ে চার মেলাবার আপ্রাণ চেষ্টায় সতর্ক হয়ে গেলাম।

 

পাঁচ

তারপর সময়ের চাকা ঘুরে এমন একটা জায়গায় মিস শারমীন ও আমাকে নিয়ে দাঁড় করাল, যেখানে তার সঙ্গে আমার চোখে পড়ার মতো এক ধরনের আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে গেল। একই দিকে বাসা হওয়ায় অফিস ছুটির পর মাঝে মাঝে আমরা একসঙ্গে ফিরতে শুরু করলাম। কখনো কখনো কোনো দোকান থেকে কিছু কিনে নেওয়া অথবা কোনো কফিশপে বসে কফি-চকোলেট খাওয়া – এরকম ছোট ছোট পারস্পরিক সম্পর্ক ঘন করার পর্যায়গুলো আমরা দুজনেই বেশ উপভোগ করতে থাকলাম। স্পষ্টতই মিস শারমীনের ব্যাপারে অফিসের সামগ্রিক ধারণা দিন দিন আরো বেশি বৈরী হয়ে ওঠা সত্ত্বেও। আর আমাদের ক্রমশ গড়ে উঠতে থাকা দৃশ্যমান সুসম্পর্কের বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করলে আমি কিছু না বললেও (কখনো কেবল স্মিত হাসিতে জবাব দিলেও) মিস শারমীন তার স্বভাবসুলভ জোর গলায় বলে উঠতেন, ‘আরে, আমরা তো আগে থেকেই বন্ধু ছিলাম। এখন একসঙ্গে কাজ করতে এসে এই বন্ধুত্বব আরো নিবিড় হয়েছে মাত্র।’

কয়েক বছরের বয়সের ব্যবধান থাকলেও আমাদের ভেতরে আপাতদৃষ্টিতে বেশ ভালো একটি বড়-ছোট বোন অথবা বান্ধবীসুলভ সম্পর্ক দানা বেঁধে উঠল বলে অন্ততপক্ষে আমার মনে একটা গভীর বিশ্বাস তৈরি হলো। বলা যায়, মিস শারমীনের কথায় এবং কাজে আমার ভেতরে এক ধরনের মুগ্ধতা কাজ করতে শুরু করল। অফিসের আর অন্য সবার সঙ্গে কেন তার রসায়নে মিলল না এটা নিয়ে আমি আর খুব বেশি মাথা ঘামাতে চাইলাম না। বিশেষ করে আরেক সহকর্মী যখন দুদিন যেতে না যেতেই কোনো কারণ ছাড়াই অনেকটা পায়ে পা লাগিয়ে আমার সঙ্গে শত্রম্নতা বাধাতে চাইল। আর বসের ব্যাপারে তো বেশি কিছু বলার নেই; বস তো বসই – তার সাত খুন মাফ। কাজেই আমার পক্ষে এরকম একটা ধারণা করা সংগত ছিল যে, মিস শারমীনের সঙ্গে অফিসের কারো কারো স্বার্থের সংঘাতজনিত কারণে সম্পর্কের এদিক-সেদিক হলেও আমার সঙ্গে সেরকম হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই তার কাছ থেকে শুধু শুধু গা বাঁচিয়ে চলা কেন। বরং মেলামেশাতে যতটুকু দেখলাম, তাকে আমার যথেষ্ট কেয়ারিং এবং ফ্রেন্ডলি মনে হয়েছে। এটা ব্যক্তিবিশেষের সমস্যা। কিন্তু আমার জন্য মিস শারমীনের পক্ষ থেকে আরো বিস্ময়, আরো চমকের তখনো অনেকটাই বাকি ছিল।

ধীরে ধীরে মিস শারমীনের মধ্যে আমি বেশ কিছু ভালো শিক্ষণীয় গুণ বা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করতে থাকলাম। বাংলায় সুন্দর গুছিয়ে কথা বলাসহ নির্ভুল ইংরেজি বলেন, চমৎকার রিপোর্ট লিখতে পারেন, নিজের বিষয় ও কাজ সম্পর্কে ধারণা ও জ্ঞান সুস্পষ্ট ইত্যাদি। তবে চাঁদেরও কলংক থাকে বলে যে-কথা আমরা জানি এবং মানি, একবারে না হলেও মিস শারমীনের ব্যাপারে কিছু অস্বস্তিকর বিষয় আমি টের পেতে শুরু করলাম আমাদের সম্পর্ক যখন ঘনিষ্ঠতার তুমুল পর্যায়ে। যখন সবটা না হলেও আমরা আমাদের পরস্পরের পারিবারিক অনেক খবর জানি এবং নিজেদের ভেতরকার অনেক কথা নির্দ্বিধায় একে অন্যের কাছে বলে ফেলতে পারি।

যদিও প্রথম দিকে আমার বুঝতে খানিকটা দেরি হয়েছিল, অফিসে যোগ দেওয়ার পরপরই কেন তার সঙ্গে প্রায় প্রত্যেকের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। (আমি একসময় অনেক কিছুই দেরিতে বুঝতাম; জীবনের নানা মাত্রার অভিজ্ঞতার পাথরে ঘষা খেতে খেতে এখন অবশ্য এই বোঝাপড়ার শিলনোড়া বেশ ধারালো হয়েছে। এখন কারো মুখ থেকে দুয়েকটা শব্দ বের না হতেই তার মর্ম ধরে ফেলতে পারি। তাতে অবশ্য অন্য সমস্যা তৈরি হয়েছে আমার জন্য।) তবে খুব অল্প সময়ের ভেতরই মূল কারণটা ধরে ফেলতে পারলাম। আর সেটি ছিল নিজের ব্যাপারে মিস শারমীনের মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, যা অনেক সময় তাকে নির্লজ্জভাবে আত্মপ্রশংসায় ডুবিয়ে রাখত এবং তিনি যা জানেন বা বোঝেন এর বাইরে আর কিছুই থাকতে পারে না বলে তার কঠিন, অনড় অবস্থান। ফলাফল, প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে (সবাই তো আমার মতো চুপচাপ সরে আসার মানসিকতা ধারণ করে না) অনিবার্য সংঘাত, সংঘর্ষ, টানাপড়েন এবং সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই অবনতি।

কিন্তু একটা বিষয় কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকতে চাইছিল না যে, কীভাবে একজন মানুষের সঙ্গে একটা গোটা অফিসের প্রায় সবার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরকম খটমট লাগতে পারে। তাও আবার নতুন একটি জায়গায় আসবার পরপরই, যখন সেখানে সবার সহযোগিতায় সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সেটল করাটাই প্রাধান্য পাওয়া যুক্তিসংগত ছিল। আমি যখন হাসপাতালে মিস শারমীনকে দেখে অফিসে ফিরে এলাম, বসের ব্যক্তিগত সহকারী, একটা জাত ক্রিমিনাল, আমার রুমে এসে একেবারে গলে পড়ল (এটা ছিল তার স্বভাবজাত তৈলমর্দনের এবং বসের কানে লাগাবার আগে আমাকে বাজিয়ে দেখবার প্রথম কৌশল)। তার বিরাট তৈলাক্ত বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এটাই যে, যেহেতু সে মুহূর্তে বস কর্মস্থলের বাইরে ছিলেন, অফিসের সেকেন্ডম্যান হিসেবে মিস শারমীনকে দেখতে যাওয়ার মাধ্যমে আমি আসলে পুরো অফিসকেই প্রতিনিধিত্ব করেছি। বসের সম্মান রক্ষা হয়েছে। আমি খুবই ভালো কাজ করেছি ইত্যাদি। তার কথায় বাটারের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, সেরকম কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। কেবল মাথা নেড়েছি। তাতে সে কোনোকিছু বুঝতে পেরেছে কিনা জানি না। কেবল বিরক্তিটা প্রকাশ করতে না পেরে মনে-মনে রাগত স্বরে বলেছি, ‘ব্যাটা বদমাশ, এখন মুখ দিয়ে প্রশংসার ফেনা বের হচ্ছে, তোদের কেউ তাহলে গেলি না কেন? বস কী ভেবে বসে সে কারণে? যত্তসব ন্যাকামি!’

অফিসের কেউ কেন মিস শারমীনকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার মতো ব্যাপারটি খুব সযত্নে এড়িয়ে গেল তা বুঝতে আমার আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এর ফাঁকে তার সঙ্গে আমার মাখামাখির খবর বেশ খানিকটা রংচং মাখিয়ে বসের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে বলে টের পেলাম এবং অতীন্দ্রিয় বার্তা পেলাম যে, এবার আমাকে একটু সতর্ক হতে হবে। অফিসের সেই সহকর্মী যার বাসায় এখানে আসার প্রথম রাতে ডিনার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল এই সময়ের মধ্যে আমাদের সুসম্পর্কের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়ে বসের কান ভারী করে তুলেছে। সমস্যাটা এরকম যে, অফিসের দু-একজনের কাছে বস সহজে তার কান ভারী করে তোলার ইজারাটা দিয়ে রেখেছেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী ছাড়া এই সহকর্মী আরেকজন।

যা হোক, আত্মরক্ষার্থে সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন অনুভব করলাম এ-কারণে যে, অফিসের যে অস্বাভাবিক পরিবেশের আভাস আসতে না আসতেই টের পেয়েছিলাম তার অন্যতম নির্দেশক ছিল, এখানে টিকে থাকতে হলে বসের পছন্দের বাইরে কিছুই করা যাবে না। কার সঙ্গে ঘুরব-ফিরব, কার বাসার আড্ডায় যাব এতদ্বিধ ব্যক্তিগত-সামাজিক ওঠাবসা বসের ভালো লাগা না-লাগার নিক্তি বুঝে নির্ধারণ করে নিতে হবে। আরো একটা বিষয় বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হলো যে, আত্মকেন্দ্রিক বস তার আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে একেবারেই আপসকামী নন। কাজেই তাকে যতটা সম্ভব সমঝে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পছন্দ করি বা না করি, বসকে সমঝে চলতে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেবল কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়িটাই মেনে নিতে কষ্ট হয়। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তার নিজ নিজ পছন্দ-রুচিমাফিক চলার স্বাধীনতাটুকু থাকা দরকার। চাকরি করতে এসেছি বলেই বসের যা-ইচ্ছা খেয়ালখুশির কাছে নিজের আত্মসম্মানবোধটুকুও বিসর্জন দিতে হবে – স্যরি, এ আমার পক্ষে হজম করা সম্ভব নয়। তবে যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে আমি অনেকটা চেপে যাওয়া টাইপের মানুষ, তাই বেশিরভাগ সময় কোনো অন্যায় বা অন্যায্য কিছুর প্রতিবাদ-টতিবাদ করার তাগিদ ভেতর থেকে খুব একটা পাই না।

যাক, বসের ব্যাপারে সতর্ক হলাম বটে, তবে সমস্যা বাধল যার সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে মূলত এই সতর্কতার আবরণে নিজেকে ঢেকে নেওয়ার বাড়তি পদক্ষেপ আমাকে নিতে হলো তাকে নিয়ে। মিস শারমীনের সঙ্গে সবকিছু ভালোই চলছিল সেদিন পর্যন্ত, যেদিন সন্ধ্যায় অফিসের কনফারেন্স রুমে একটি জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত অনুশীলনপর্ব শুরু হলো। বেশ একটা আমোদ-আড্ডার মুডে সেখানে অফিসের সবাই এক হয়েছিলাম। সঙ্গে বাইরের আমাদের কারো কারো প্রতিবেশীরাও এসেছিলেন, যারা খানিকটা গান-বাজনা করেন, কবিতা পড়েন এ-রকম সংস্কৃতিমনা। তবে এই সংস্কৃতিমনা শব্দটা নিয়ে আমার মনে এক ধরনের সন্দেহ কাজ করে। সন্দেহ যে এত দ্রুত সত্যে পরিণত হবে সেটা অবশ্য একেবারেই আমার ধারণার বাইরে ছিল।

গান-টান গাইতে পারি না বলা সত্ত্বেও সবার জোরাজুরিতে আমাকে শেষ পর্যন্ত একটি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে শোনাতে হলো এবং বসসহ উপস্থিত সবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারলাম সেটি সবার পছন্দ হয়েছে। অনুষ্ঠানের জন্য গানটি চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হলো। আমি একটু অপ্রস্ত্তত হয়ে পড়লাম। মিস শারমীনের কাছ থেকেই বেশি উৎসাহ পাব বলে আশা করলেও বাস্তবে ঘটল ঠিক তার উলটো। অনুষ্ঠানের আরো আইটেমের জন্য সবার অনুরোধে তিনিও একটি দেশের গান গাইলেন এবং যে-কোনো কারণেই হোক তা শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে শ্রুতিমধুর মনে হয়েছে বলে তেমন প্রকাশ্য কোনো ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। এই ইঙ্গিত না পাওয়ার ব্যাপারে আমার আদৌ কোনো সন্দেহজনক ভূমিকা আছে কিনা আমি তা বুঝতে না পারলেও মিস শারমীনকে এরপর থেকে দেখলাম আমার কাছ থেকে একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে। মহামুশকিল! তবে যেহেতু তিনি নিজের ব্যাপারে সবসময় ওভার কনফিডেন্ট, তাই তিনি সবাইকে হাসিমুখে অভয় দিলেন এই বলে যে, মূল অনুষ্ঠানের দিন আরো সুন্দর গাইবেন। সামনের দুদিন বাসায় ভালো করে টানা রেওয়াজ করে ফেলবেন।

ভালো করে রেওয়াজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সেদিনই আমাকে সাবধান করে দিলো যে, কোথাও একটা সুর বোধহয় কেটে গেল! ভালো হতো যদি আমার গলায় ওই গানটা সবার কথামতো  অত চমৎকারভাবে ফুটে না উঠত। যদি  আরেকটু বেসুরো শোনাত, যদি আমার তাল-লয়-ছন্দের জ্ঞানটা আরেকটু কম হতো, তাহলেই বোধহয় ভালো হতো। অন্তত এতদিন ধরে দেখে আসা মিস শারমীনের হাসিখুশি মুখটা ঈর্ষার অমন অমানিশায় ঢেকে যাওয়ার অস্বাভাবিক দৃশ্যটা আমাকে দেখতে হতো না! সেদিন রিহার্সালের পরও আমরা একসঙ্গে বাড়ির পথে ফিরলাম বটে, কিন্তু তার কথায় সেই বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তরিকতার টানটা আর পেলাম না, যা সেদিন রিহার্সালের আগে দোতলা থেকে একত্রে নিচে নামার সময়ও পুরো মাত্রায় ছিল।

অফিসের অনুষ্ঠানের জন্য একসঙ্গে গান গাইতে গিয়ে কী বিপত্তিটাই না বাধল! কোথাও যেন একটা অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন ঘটে গেল। বসের ব্যাপারে সতর্ক হলাম ঠিকই, কিন্তু মিস শারমীন আচমকা এ কোন চেহারা আমাকে দেখালেন যে, তার কাছ থেকে সতর্ক হওয়ার কোনো সুযোগই পেলাম না। এতদিনের মধুর সম্পর্ক একটি ছোট্ট হালকা বিষয়ের কারণে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে! আমার মাথায় কিছুই কাজ করছিল না। ফেরার পথে তেমন কোনো কথাও হলো না দুজনের মধ্যে। বাসার কাছে এসে তিনি যখন গলিতে ঢুকলেন, অন্যদিনের মতো হাসিমুখে ‘কাল আবার দেখা হচ্ছে’ বলার ভদ্রতাটুকুও দেখালেন না। সব বুঝে কষ্ট পেলাম, আর অবাক হওয়ার ধকলটা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হলো। ফেব্রম্নয়ারির সেদিনের ঠান্ডা ঠান্ডা সন্ধ্যাটা তখন ঘন হয়ে এসেছে। আমি সেই অন্ধকারে ভারী পা, ততোধিক ভারী মন, নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে একবার সুবিশাল আকাশটার দিকে চাইলাম আর লম্বা সময় ধরে জমে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস এতোক্ষণ পর বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পেয়ে আমাকে চমকে দিয়ে যেন বলে উঠল ‘হায়, বন্ধুজন!!!’ r