বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে কৈবর্ত-জীবনসংগ্রাম

হরিশংকর জলদাস

Kotha Sahittay
Kotha Sahittay

প্রবন্ধটির বিস্তার ঘটানোর আগে কৈবর্ত সম্প্রদায় বিষয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন –

কৈবর্ত অর্থ দাশ, ধীবর। যারা মৎস্য হিংসা

করে, তারা কৈবর্ত।

(বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খন্ড)

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসও তাঁর বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে প্রায় একই কথা বলেছেন। রাজশেখর বসু চলন্তিকায় বলছেন – ‘কৈবর্ত মানে হিন্দুজাতি বিশেষ। জেলে।’ কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন – ‘কৈবর্ত : যে জলে বাস করে, জলের সহিত বিশেষ সম্বন্ধযুক্ত হিন্দুজাতি বিশেষ।’ (ব্যবহারিক শব্দকোষ)

আবু ইসহাক সমকালীন বাংলাভাষার অভিধানে বলেছেন – ‘কৈবর্ত অর্থ জেলে, ধীবর, মেছো।’ বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানেও আবু ইসহাকের মন্তব্যের সমর্থন মেলে।

ভারতকোষে আছে – ‘কে বৃত্তির্যেষাং ইতি কৈবর্ত।’ ‘কে’ শব্দের অর্থ জল। জলে যাদের জীবিকা, তারা কৈবর্ত।

কৈবর্ত জাতির উৎপত্তি বিষয়ে ঋষি মনুর ভাষ্য এরকম – ‘নিষাদ নৌকর্মজীবী মার্গব নামক সন্তান উপাদন করে। এদের আর্যাবর্তবাসীগণ কৈবর্ত নামে অভিহিত করেন।’ (দশম অধ্যায়, ৩৪নং শ্লোক)

শ্রেণিবৈষম্যের কারণে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র। শূদ্ররা ছিল পেশাজীবী। তারাই ছিল আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর মূল স্তম্ভ। এই শ্রমজীবী মানুষরাই বর্ণবাদীদের দ্বারা শূদ্র নামে অভিহিত হয়েছে।

শূদ্র পীড়নকারীরা শূদ্রদের দুই ভাগে ভাগ করেছে। সৎশূদ্র আর অসৎশূদ্র। ১৭টি পেশাজীবী সম্প্রদায়কে অসৎশূদ্রের অন্তর্গত করেছে তারা। ‘কৈবর্ত’ এই সতেরোটি সম্প্রদায়ের একটি। বর্ণবিভাজনের জাঁতাকলে পড়ে কৈবর্ত সম্প্রদায় একেবারে দলিত প্রান্তজনে পরিণত হয়েছে।

জীবনধারণের তাগিদে মানুষকে কোনো না কোনো কাজ অবলম্বন করতে হয়। মানুষের আর্থ-সামাজিক ইতিহাস মানে শ্রমজীবী তথা পেশাজীবী মানুষের ইতিহাস। জীবনের জন্যই জীবিকা। আর এই জীবিকা হিসেবে মানুষ গ্রহণ করেছে নানারকম পেশা। এর প্রাসঙ্গিক উদাহরণ মৎস্য শিকার, মাছ-ব্যবসা।

ভারতবর্ষীয় সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, সেটা মোটা দাগে দুভাগে বিভক্ত। এক. সেবাগ্রাহী, দুই. সেবাদাস। অমানবিক বর্ণবিভাজনের কারণে উৎপাদনশীলতার মূল ভিত্তিতে শ্রমের জোগান দেওয়া সত্ত্বেও কৈবর্তরা সেবাদাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাঙালির প্রধান যে দুটো খাদ্য – মাছ আর ভাত, তাদের একটি সরবরাহ করে আসছে এই কৈবর্তরা। তারপরও তারা অবহেলিত, কখনো কখনো তীব্রভাবে নিন্দিতও। কিন্তু এই কৈবর্তরা অবহেলার নয়। তাদের একটা প্রাচীন ইতিবৃত্ত আছে। এই দলিত সমাজ থেকেই একদা উঠে এসেছিলেন শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। প্রজ্ঞা আর মনস্বিতার অধিকারী ছিলেন তিনি। ব্যাসের প্রথম কৃতিত্ব – বেদ বিভাগ করেছিলেন তিনি। ব্যাসদেবের শ্রেষ্ঠকীর্তি মহাভারত। কৈবর্ত-কন্যাজাত ব্যাসদেব অষ্টাদশ পুরাণ ছাড়াও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা রচনা করেছিলেন। একাদশ-দ্বাদশ শতকে বাংলাদেশে কৈবর্তদের বলা হতো ‘কেবট্ট’। কেবট্ট পপীপ-রচিত গঙ্গাস্তবের একটা পদ পাওয়া যায়। সদুক্তি কর্ণামৃত নামক কাব্যসংকলনে এটি সন্নিবেশিত।

কৈবর্ত-সমাজ একসময় উন্নত ছিল, সভ্য ছিল। বর্তমানের মতো সেসময়ও কৈবর্ত-সমাজে পণপ্রথা ছিল না, বিবাহবিচ্ছেদ ছিল না। বিধবাবিবাহ এই সমাজের একটা অনুমোদিত বিষয়। পাল আমলে দিব্যোক নামে এক কৈবর্ত-সামন্তরাজের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। দিব্যোকের পর রুদোক ও ভীম নামে আরো দুজন কৈবর্তরাজ বরেন্দ্রভূমি শাসন করেছিলেন।

এসব কিছুর পরও ভারতবর্ষীয় সমাজে কৈবর্তদের স্থান ছিল অত্যন্ত নিচুস্তরে। তাদের জীবনে হতাশা, জীবনাচরণে নানা সংকট আর ঘরের চৌকাঠ পেরোলেই অসম্মান। প্রথাদীর্ণ বর্ণবৈষম্যের দম-বন্ধ করা পরিবেশে আর দারিদ্রে্যর জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে কৈবর্ত-সম্প্রদায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তাদের স্থান ছিল না সমাজে, স্থান ছিল না সাহিত্য-সংস্কৃতিতে।

 

দুই

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ক্ষমতার পালাবদল হলো। মুসলমান নবাবের হাত থেকে ক্ষমতা চলে এলো ইংরেজদের হাতে। ভূমিরাজস্বের নতুন ব্যবস্থা হলো। ফলে গ্রামসমাজ তীব্রভাবে আক্রান্ত হলো। অল্পদিনের মধ্যে ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণের রূপ জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঠিক এই সময়েই মুষ্টিমেয় বাঙালি তরুণ পাশ্চাত্যচিন্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়া শুরু করলেন। তাঁদের ভাবনায় পালাবদল হতে শুরু হলো। এলো উনিশ শতক। এই শতকের প্রথমার্ধ ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে চঞ্চল। উনিশ শতকের নবজিজ্ঞাসার সূচনায় ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচিত্র ঘটনাবলি সমকালীন বাংলা সাহিত্যে যে-ছাপ ফেলল, তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠল বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের উপন্যাস সাহিত্য।

বাংলা উপন্যাসের সূচনালগ্নে কাহিনির কেন্দ্রভাগে ছিল জমিদার, সামন্ত আর ধনীরা। এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কৈবর্তের মতো ব্রাত্যজনেরা উপন্যাসের কেন্দ্রভূমিতে প্রথমবারের মতো এসে দাঁড়ায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-৫৬) মাধ্যমে। তারাশঙ্করের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা ও নাগিনীকন্যার কাহিনীর আগেই মানিকের পদ্মানদীর মাঝিতে (১৯৩৬) প্রান্তিকায়িত জনগোষ্ঠীর উদ্বোধন হয়েছে।

সাহিত্যে প্রান্তবর্গীয়-জীবনের সন্ধান – আধুনিকতার এক বিশেষ লক্ষণ। দেশি-বিদেশি বহু সাহিত্যিকের অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে ওঠে দলিত-প্রান্তজনদের জীবন। এই প্রান্তবর্গীয়দের উল্লেখনীয় জনগোষ্ঠী হলো কৈবর্ত তথা জেলে।

জেলেদের নিয়ে পাশ্চাত্যের স্মরণীয় উপন্যাসগুলো হলো – আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ওল্ডম্যান অ্যান্ড দি সি (১৯৫২), ভিলিস লাৎসিসের সান অফ ফিশারম্যান (১৯৩৪), স্টিফেন গুয়ইনের ডাফার লক – অ্যা ফিশারম্যানস্  অ্যাডভেঞ্চার (১৯২৪), নরমান হিলের অ্যা ফিশারম্যানস্ রিফ্লেকশনস্ (১৯৪৪), অলিভার কাইটের অ্যা ফিশারম্যানস্ ডায়েরি (১৯৬৯) প্রভৃতি। এসব উপন্যাসে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কাহিনির চেয়ে বেশি গুরুত্ব  পেয়েছে মাছশিকারের খুঁটিনাটি বর্ণনা।

অন্যদিকে, বাংলাভাষায় এ-জাতীয় উপন্যাসগুলোর মূল উপজীব্য কৈবর্ত-সমাজজীবন। কৈবর্ত-জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামের পরিচয় এসব উপন্যাসে স্পষ্ট। বাংলা সাহিত্যে এ-বিষয়ে যে কয়েকটি স্মরণীয় উপন্যাস রচিত হয়েছে সেগুলো হলো – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), অমরেন্দ্র ঘোষের চরকাশেম (১৯৪৯), অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬), সমরেশ বসুর গঙ্গা (১৯৫৭), সত্যেন সেনের বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯), সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গহিন গাঙ (১৯৮০), শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমুদ্র বাসর (১৯৮৬), মহাশ্বেতা দেবীর কৈবর্ত খন্ড (১৯৯৪), ঘনশ্যাম চৌধুরীর অবগাহন (২০০০) ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গঙ্গা একটি নদীর নাম (২০০২)।

উল্লিখিত ১০টি উপন্যাসের প্রথমটির রচনাকাল ১৯৩৬ এবং শেষটির রচনাকাল ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ। ৬৬ বছরের কাল পরিধির মধ্যে রচিত এই উপন্যাসসমূহে ধীবর জীবন ও সমাজ নানা মাত্রিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

এই প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের কৈবর্ত-জীবনসংগ্রাম।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আলোচ্য উপন্যাস হবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, সত্যেন সেনের বিদ্রোহী কৈবর্ত, শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমুদ্র বাসর এবং বর্তমান সময়ে লিখিত আরো কয়েকজন ঔপন্যাসিকের জেলে-জীবনসংগ্রামভিত্তিক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

বাংলাদেশে কৈবর্তজীবননির্ভর উপন্যাসগুলোর রচয়িতা হিন্দু ও মুসলমান। হিন্দু রচয়িতার মধ্যে আবার দুটি শ্রেণি লক্ষণীয় – বৈশ্য ও শূদ্র। একটির রচয়িতা ‘সেন’, অন্য একটি শূদ্র। বাকিগুলোর মুসলমান। কৈবর্ত-সমাজের ওপর এই তিন শ্রেণির রচয়িতারা ত্রিমাত্রিক আলো ফেলে সেই সমাজের অন্তর্রহস্যকে উদ্ঘাটন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। এই আলোর নানা রং। কোনো রং মুগ্ধতার, কোনো রং অনুসন্ধিৎসার, কোনো রং সহানুভূতির, আবার কোনো রং বাস্তবতাঋদ্ধ নির্মোহতার। প্রায় সব ঔপন্যাসিক চেয়েছেন কৈবর্ত-জনগোষ্ঠীর মূল সমস্যাকে নির্দেশ করে এর প্রকৃত চেহারার উদ্ঘাটন ঘটাতে। স্বীকার্য যে, সবাই সমান দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি।

কোনো উপন্যাসে জেলেজীবনের সংগ্রামশীলতার কাহিনি বিবৃত, কোনোটিতে কৈবর্ত-কাহিনি মূলকাহিনির সহকাহিনি হিসেবে অঙ্কিত। কোনো উপন্যাসে কৈবর্ত-সমাজজীবন রাজনীতির টানাপড়েনে দীর্ণ, আবার কোনোটিতে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন উচ্চবর্গীয় নিষ্পেষণে জর্জরিত। কোনো উপন্যাসে কৈবর্ত-সমাজ শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, কোনোটিতে শোষিতের পর্যায়ে অবনমিত। এক-একটিতে কৈবর্ত-জীবনসংগ্রাম প্রসঙ্গ এসেছে এক-এক রকমভাবে।

 

তিন

অদ্বৈত মল্লবর্মণের অমর সৃষ্টি তিতাস একটি নদীর নাম।  মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে আরো তিনটি উপন্যাস লিখলেও তিতাস একটি নদীর নাম তাঁকে অমরত্ব দেয়। উল্লেখ্য, অদ্বৈতের চারটি গল্প আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, কোনো গল্পই জেলেজীবনকেন্দ্রিক নয়। তিতাস একটি নদীর নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে রচিত, কিন্তু এতে যুদ্ধ অনুপস্থিত। তবে যুদ্ধের চেয়েও মারাত্মক খাদ্যসংগ্রামে জর্জরিত কৈবর্ত-মানুষদের অখন্ডনীয় ভাগ্যের লিখন এতে বিম্বিত হয়েছে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতায় বন্দি, বঞ্চিত ও বিড়ম্বিত মালোসমাজের চিত্র এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মেঘনার শাখা তিতাসের তীরবর্তী ধীবর সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা, দুর্জ্ঞেয় প্রকৃতি ও মানব চরিত্রের অন্তর্নিহিত উপলব্ধি উদ্ঘাটিত হয়েছে এখানে।

তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের কাহিনি চার খন্ডে বিধৃত। প্রতি খন্ডে দুটি করে পর্ব। ধনুকের মতো বাঁকা তিতাসের তীর ঘেঁষে মালো সম্প্রদায় বাস করে। তাদের নিরীহ-নির্বিরোধ জীবনযাপন। অন্ত্যজ কৈবর্ত-সমাজের জীবনসংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের ইতিহাস ধারণ করে আছে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি। কৈবর্ত-সমাজের অবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও প্রতিরোধের কাহিনি নিঃশব্দ স্রোতের মতো উপন্যাসের পরতে-পরতে প্রবহমান।

মালো সম্প্রদায়ের অবহেলিত নরনারীরাই উপন্যাসের কুশীলব। কিশোর, বাসন্তী এবং অনন্ত এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র। কিন্তু সুবল, রামকেশব, কালোর মা, উদয়তারা, অনন্তের মা, মোহন, বনমালী কিংবা কাদির মিয়াও এই কাহিনির সমৃদ্ধি সাধন করেছে। উপন্যাসের শেষ দুটো পর্বে দেখা যায়, মালোদের জন্ম-জন্মান্তরের আশ্রয় তিতাস নদী শুকিয়ে আসে, তার বুকজুড়ে জেগে ওঠে চর। তিতাসপাড়ে নেমে আসে দুঃখের ছায়া। শোষিত জেলে ও কৃষাণের ক্ষয়িষ্ণু জীবনকাহিনি ঔপন্যাসিক বাস্তবনিষ্ঠভাবে উপন্যাসের পরিণতি পর্যন্ত বিস্তৃত করেছেন।

কৈবর্তদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হুমকির সম্মুখীন হয় – নদী ও বাজারকে ঘিরে এই জাতীয় ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক জীবনবেদ গ্রন্থন করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। পদ্মানদীর মাঝির মতো তিতাস একটি নদীর নামেও অধিকাংশ জেলের নিজের জাল নেই, নেই মূলধন। জমিদার মেজকর্তা অনন্ত তালুকদার, মুহুরি শীতল ঘোষ, আড়তদার লোকনাথ কিংবা মাগন সরকার, দোলগোবিন্দ – সবাইকে নিয়ে কৈবর্ত শোষণের চেনাজানা বৃত্ত। তবে পদ্মানদীর মাঝিতে ঔপন্যাসিকের অনবধানে অর্থনৈতিক সংগ্রাম ও সংঘর্ষের দিকটি উপেক্ষিত হলেও তিতাস একটি নদীর নামে অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে কৈবর্ত-সমাজের সংঘবদ্ধ হওয়ার চিত্র আছে। আনন্দবাজারে মাছ বিক্রির ওপর জমিদার আনন্দবাবুর লোক নতুন খাজনা আরোপ করে। এতে মোড়ল রামপ্রসাদ গর্জে ওঠে – ‘শুন বেপারী, বাবুকে সাফ কথা কইয়া দিও, মালোরা মাছ বেচতে কোনো সময় মাসুল দেয় নাই, দিবেও না।’

তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের প্রথম দিকে ধীবরদের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিপূর্ণতার কথা আছে। কিন্তু উপন্যাসের শেষ দিকে শুকনো তিতাসের বিপ্রতীপে কৈবর্তজীবনে নেমে এসেছে সামাজিক-অর্থনৈতিক পতন। তিতাসের জেলেরা জীবিকার প্রয়োজনে তিতাস ছাড়িয়ে মেঘনায় মাছ ধরতে গেছে, আবার ফিরেও এসেছে। সমুদ্রে যেতে হয়নি তাদের। এক্ষেত্রে অদ্বৈত মল্লবর্মণ অপূর্ব দক্ষতায় কৈবর্তদের জীবনযাত্রার বহির্ঘটনা চিত্রণের পাশাপাশি তাদের মুখের ভাষা, অন্তরের স্বপ্নময় চিন্তা, আবেগের স্পন্দন, গোষ্ঠীজীবনের সমস্ত প্রদোষান্ধকার, স্পষ্টতা-অস্পষ্টতা ও রহস্যঘন দীপ্তি উদ্ঘাটন করেছেন।

দারিদ্রে্য দীর্ণ, হতশ্রী এক কৈবর্ত-পরিবারে অদ্বৈতের জন্ম। ফলে কৈবর্তজীবনের গতিপ্রকৃতি, সংগ্রামশীলতা, অস্তিত্বের সংকটের কথা তাঁর ভালো করে জানা। কৈবর্ত-সম্প্রদায়ের নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা, মৎস্যজীবিতার ঐশ্বর্য-অঘটন, সামাজিকতা এবং এর পাশাপাশি কৃষিজীবীদের অবস্থান, তাদের ঔদার্য-কুটিলতা আর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে মালোদের  সংস্পর্শ-সংঘাত – এ সবকিছু অদ্বৈত বিশ্বস্তভাবে তাঁর উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। এখানে অদ্বৈত কৈবর্তজীবনের লবণাক্ত রূপের গাথা রচনা করেছেন।

পদ্মানদীর মাঝির কুবের-গণেশের জালনৌকা ছিল না। ধনঞ্জয়ের মতো শোষকের জালনৌকা নিয়ে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে তাদের। তিতাসেও গগন-সুবলের নিজের জালনৌকা নেই। ফলে দারিদ্র্য আর শোষণের মুখোমুখি তাদেরও হতে হয়েছে। কৈবর্ত-সমাজের ভেতরই বোধাই-কালোবরণদের সঙ্গে সুবল-গগন-তিলক-গৌরাঙ্গদের শ্রেণিপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজবিকাশের ধারায় কৈবর্তরা একটা বিশেষস্তরে স্থিত, কিন্তু সেখানেও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের চিত্র স্পষ্ট।

‘জাউল্যার পোলা’ হয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ জেলেজীবনকে খুলেমেলে ধরছেন এ-উপন্যাসে। তিনি ভেতর থেকে জেলেজীবনকে, তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামকে অবলোকন করেছেন। ফলে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে নিম্নবর্গীয় কৈবর্ত-জনজীবনের সংগ্রামশীল নান্দনিক উপন্যাস।

 

চার

এবার সত্যেন সেনের (১৯০৭-৮১) বিদ্রোহী কৈবর্তের কথায় আসা যাক। তাঁর সাহিত্যজীবন স্বল্পকালীন। তাঁর বাষট্টি বছর বয়সে বিদ্রোহী কৈবর্ত বের হয়। বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসে বিধৃত সময় – পাল যুগ, স্থান – গৌড় ও বরেন্দ্রী, চরিত্র – পালরাজা ও শক্তিশালী অমাত্যরা, দলিত কৈবর্ত-সমাজ এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়, পটভূমি – পালরাজা মহীপালের সঙ্গে   কৈবর্ত-সামন্ত দিব্যোকের রাজনৈতিক সংঘাত। ফলশ্রুতি – মহীপালের পতন ও কৈবর্ত-সমাজ কর্তৃক গৌড় দখল। এ-ই হলো বিদ্রোহী কৈবর্তের সাদামাটা বিবরণ। কিন্তু এই উপন্যাসের ভেতরে অনুরণিত হচ্ছে শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব, অত্যাচারিত কৈবর্ত-সমাজের হাহাকার ধ্বনি। এই উপন্যাসের একদিকে প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে কৈবর্ত-জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তরঞ্জিত চিত্র। কৈবর্ত-সমাজের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কথাও বিদ্রোহী কৈবর্তে স্থান পেয়েছে। বঞ্চিত হতে হতে, লুণ্ঠিত হতে হতে কৈবর্তরা একসময় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। এবং সেই অস্ত্রের আঘাতে আঘাতে গৌড়ের আকাশছোঁয়া রাজপ্রাসাদ ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছে।

দ্বিতীয় মহীপালের সময় বরেন্দ্রীর ভূস্বামীরা বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কৈবর্ত-ভূস্বামী দিব্যোক। কৈবর্তদের দুটো ভাগ। হালিক ও জালিক কৈবর্ত। দিব্যোক হালিক কৈবর্ত। অদ্বৈত জালিকদের নিয়ে আর সত্যেন সেন হালিকদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। বিদ্রোহী কৈবর্তে উপস্থাপিত জেলেজীবন জল ও জলশস্যনির্ভর নয়। এই উপন্যাসের কৈবর্তজীবন দারিদ্র্যলাঞ্ছিত নয়, রাজপ্রতিনিধি দ্বারা নিষ্পেষিত। এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই হাল ফেলে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল কৈবর্তরা এবং জীবন-মরণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।

উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে পালরাজাদের সঙ্গে কৈবর্তদের অসন্তোষের সূচনা। কৈবর্তরা মনে করত, বরেন্দ্রী তাদের একান্ত নিজস্বভূমি। এই ভূমিতে ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধদের কখনো স্বাগত জানায়নি তারা। কৈবর্তদের প্রতি গৌড়ের রাজণ্যবর্গের মনোভাব ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। মহাপ্রতীহার কীর্তিবর্মা কৈবর্ত-সমাজ প্রসঙ্গে বলেন –

ছোটলোক (কৈবর্ত) গুলোকে সবসময় শাসনের উপর রাখতে হয়। কখনও প্রশ্রয় দিতে নাই। একটু প্রশ্রয় দিয়েছেন কি মাথায় উঠে বসবে।

বহিরাগতরা ছলে-কৌশলে কৈবর্তদের ভূমি অধিকার নিয়েছে। পদ্মনাভের কথায় চিত্রটি স্পষ্ট।

কৈবর্তরা এমনিতে শান্তিপ্রিয় নিরীহ সম্প্রদায়। ওরা মিথ্যে বলতে জানে না। কিন্তু সময়বিশেষে ওরা বাঘ আর সাপের মতোই দুর্দান্ত ও হিংস্র হয়ে ওঠে। গৌড়ের সম্রাটদের বিরুদ্ধে এরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম চালিয়েছে। এ-সংগ্রামের পশ্চাতে ছিল ওদের সংঘশক্তি। বরাহস্বামী, যে মনেপ্রাণে কৈবর্তদের ঘৃণা করে, তার মুখে এ-কথার সত্যতা মেলে। উপন্যাসের পঞ্চম অধ্যায়ে কৈবর্ত-চরিত্রধর্ম বাস্তবসম্মতভাবে অঙ্কন করেছেন সত্যেন সেন। এখানে বলা হয়েছে, পূর্বে চুরি বা ডাকাতি কাকে বলে কৈবর্তরা জানত না। চোর আর ডাকাত – এ দুটো শব্দ শিখেছে গৌড়ের লোকদের মুখ হতে। মহাভারতের কাল থেকে ‘দাশবংশে’র মেয়েদের রূপযৌবন ব্রাহ্মণ ও অন্য বর্ণহিন্দুদের জৈবিক ক্ষুধার সামগ্রী হয়েছে। এই অপমানের ইতিহাস লেখা আছে বিদ্রোহী কৈবর্তে। নারীর অপমান বুকে নিয়ে ভূমিহারা কৈবর্তরা একদিন জেগে উঠেছে। জেগে-ওঠা কৈবর্তরা রাজধানী গৌড় অধিকার করেছে। এই আক্রমণের নেতা দিব্যোক। সক্রিয় যোদ্ধা পরভু। দিব্যোক যতটুকু রাজা, তার অধিক মানবিক মানুষ। গৌড়জয়ের প্রথম দিনেই নিজ সৈন্যদের আদেশ দিয়েছে –

মেয়েদের আর বাচ্চাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না, কারো ঘরে আগুন দিতে পারবে না। যে এই নিষেধ মানবে না তার কঠিন শাস্তি হবে।

কৈবর্ত-জনগোষ্ঠীর ওপর নিবিড় আলো ফেলেছেন সত্যেন সেন বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসে। তাদের অন্তর্চিত্র ও বহির্চিত্র সমান দক্ষতায় অঙ্কন করেছেন ঔপন্যাসিক। কৈবর্তদের সুরাপ্রিয়তার কথা, সুরা যে তাদের চৈতন্য লুণ্ঠন করেছে,  তার কথা লিখতেও ভোলেননি কথাকার। উপন্যাসটি যেন কৈবর্ত-জনমানুষের রূপান্তরের ইতিহাস। নিরীহ, দরিদ্র, লাঞ্ছিত, সর্বহারা কৈবর্তদের শাসক-শ্রেণিতে রূপান্তরের ইতিহাস যেন বিদ্রোহী কৈবর্ত।

 

পাঁচ

বরিশাল জেলার দক্ষিণাংশ সমুদ্রঘেরা। দক্ষিণাঞ্চলে বাস করে সমুদ্রনির্ভর জনগোষ্ঠী। শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-৯৭) সমুদ্রতীরবর্তী জনজীবনের সুখ-বেদনাকে উপজীব্য করে সমুদ্র বাসর (১৯৮৬) উপন্যাসটি রচনা করেছেন। শ্রমজীবী মানুষের নিত্যদিনের জীবনাচরণকে এই উপন্যাসে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসটি মূলত মুসলিম সমাজকেন্দ্রিক। কিন্তু এতে কৈবর্ত-সমাজের চিত্রও নিটোলভাবে অঙ্কিত হয়েছে। উপন্যাসটির শুরুই হয়েছে কামদেবপুরের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ দিয়ে।

কৈবর্তদের জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে জলে। মৎস্য শিকারই তাদের প্রধানতম পেশা। জেলেপাড়ার সখানাথ, রতিকান্ত, দেবনাথ প্রভৃতি কৈবর্ত এক অন্ধকার রাতে মাছ ধরতে গিয়ে নতুন জাগা একটি চরের সন্ধান পায়। নতুন স্থলভূমির সন্ধান পেয়ে তারা উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। কারণ তাদের আবাসভূমি নিতান্ত সংকীর্ণ। জেলেপাড়ার জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু জায়গা নয়। ফলে বাসযোগ্য ভূমি জেলেদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। নতুন চরের সন্ধান পেয়ে তারা এজন্য খুশি হয়েছে যে, তারাও এই স্থলভূমির মালিকানা পাবে। তাদের অস্তিত্বে যে-সংকট চলছে, তা একদিন কাটিয়ে উঠতে পারবে। মৎস্য শিকার অসম্পূর্ণ রেখে সখানাথ মুজফ্ফর মিঞার কাছারিতে উপস্থিত হয়। উদ্দেশ্য – নতুন জাগা চরের কথা মুজফ্ফর মিঞাকে জানানো। এই চরে নিজের প্রতিষ্ঠা কায়েমের জন্য মুজফ্ফর সচেষ্ট হয়ে ওঠে।

তারপর নানা সংঘর্ষ-সংঘাত, রাগ-অনুরাগ, প্রাপ্তি-হতাশার মধ্য দিয়ে সমুদ্র বাসরের বিকাশ ও পরিসমাপ্তি ঘটে। গোটা উপন্যাসটি মুসলিম সমাজকেন্দ্রিক হলেও স্বল্প-পরিসরে কৈবর্তদের বাঁচা-বাড়ার লড়াইয়ের ইঙ্গিত আছে। এই প্রান্তিক মানুষের জীবন যে লোকবিশ্বাসের আবরণে ঢাকা, তার উদাহরণ আছে উপন্যাসে। – ‘জীবন দেয় কেডা? মা ধরিত্রী আর এই গাঙ।’ – কৈবত সমাজ-বিশ্বাসের কথা এই উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। তাছাড়া কৈবর্ত-সমাজের ‘কুমীরব্রতে’র কথা সমুদ্র বাসরে বর্ণিত হয়েছে। অন্যান্য প্রান্তিক সমাজের মানুষের মতো কৈবর্তরাও ভয়ংকর ও সর্বনাশা প্রকৃতির কাছে মাথানত করে। নিষ্ঠুর ও খল স্বভাবের দেবদেবীরাই কৈবর্তদের কাছে ভক্তি পেত বেশি। সময়ান্তরে দেবদেবীর পাশাপাশি মানবেতর প্রাণীরাও জেলেদের কাছে পূজ্য হয়ে ওঠে। ‘কুমীরব্রত’ উৎসবের মধ্যে উক্ত বক্তব্যের প্রমাণ মেলে।

শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমুদ্র বাসরে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা লিপিবদ্ধ। এই মানুষদের মধ্যে আছে মুসলিম আর কৈবর্ত। স্বল্পপরিসরে কৈবর্তজীবনকথা সমুদ্র বাসরে বিধৃত হলেও তা দ্যুতিময়।

 

ছয়

শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমুদ্র বাসর প্রকাশের ২২ বছর পরেও জেলেজীবন নিয়ে তেমন কোনো উপন্যাস প্রকাশিত হয়নি বাংলাদেশে। ২০০৮ সালে বর্তমান প্রবন্ধকারের লেখা উপন্যাস জলপুত্র প্রকাশিত হয়। অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যুর ৫৭ বছর পর আরেক জেলের হাত দিয়ে কৈবর্তজীবননির্ভর উপন্যাস রচিত হলো জলপুত্র। জলপুত্রের পর দহনকাল (২০০৯) নামে বর্তমান লেখকের আরেকটি উপন্যাস বের হলো। জলপুত্র আর দহনকালের স্বাতন্ত্র্য এজন্য যে, দুটো উপন্যাসই সম্পূর্ণভাবে জেলেজীবননির্ভর এবং সমুদ্রপাড়ের জেলেদের নিয়ে রচিত। বাংলাসাহিত্যে সমুদ্রপাড়ের জেলেদের নিয়ে এই প্রথম দুটো উপন্যাস রচিত হয়েছে। জলপুত্র জলের কাহিনি হলে দহনকাল জল ও স্থলের কাহিনি। বর্তমান লেখক জলপুত্র উপন্যাসে কৈবর্ত-সম্প্রদায়ের অপ্রাপ্তির বেদনা, প্রাপ্তির উল্লাস, শোষণের হাহাকার, অশিক্ষার অন্ধকার – সবই বিশ্বস্ততার সঙ্গে অঙ্কন করার চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাসটি ভুবনেশ্বরী নামের একজন জেলেনারীর সংগ্রামশীল জীবনের ইতিহাস যেমন, তেমনি গঙ্গাপদ নামের একজন জলপুত্রের অধিকার সচেতন হয়ে ওঠার কাহিনিও বটে। জলপুত্র উপন্যাসে কৈবর্ত-সমাজ তার সকলপ্রকার সংগতি-অসংগতি নিয়ে উপস্থিত। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে চরিত্রগুলোর সংলাপ হিসেবে ব্যবহার করে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন লেখক। ভুবনেশ্বরী এ-উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও তার পুত্র গঙ্গাপদ শেষ পর্যন্ত কৈবর্ত-জনজীবন কাহিনিটির নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাদনদার শুক্কুর মিয়া ও শশিভূষণের বিরুদ্ধে উত্তর পতেঙ্গার জেলেপুত্রদের সে সংঘবদ্ধ করতে পেরেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গঙ্গাপদকে খুন করে এই দাদনদাররা। প্রতিবাদের কাহিনি, কৈবর্ত-জীবনসংগ্রামের কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যায় না। ভুবনেশ্বরীর মতো অন্য জেলেরা অপেক্ষা করে বনমালী নামের আরেক গঙ্গাপদের জন্য।

জেলে সম্প্রদায়ের দিবারাত্রির কাব্য নির্মাণ করতে গিয়ে বর্তমান প্রবন্ধকার দহনকাল লিখেছেন। এটি সমুদ্রসংগ্রামী জেলেদের জীবনালেখ্য। উল্লেখ্য, নদীপাড়ের জেলেরাও এই উপন্যাসে অবহেলিত হয়নি। দহনকালের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত জেলেসম্প্রদায়। আর আছে তাদের প্রতিবাদ প্রতিশোধের কাহিনি। মহান ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এই উপন্যাসের একটি বড় অংশজুড়ে আছে।

হরিদাস নামের এক জেলেসন্তান অশীতি বাবা রাধানাথের প্রেরণায় আলোর পথে হাঁটছে। তার পরিবারকে ঘিরে সমাজের পিছুটান, স্বার্থপরদের লোলুপতা, সুবিধাবাদীদের ওপর-চালাকি আবর্তিত হচ্ছে। নিকুঞ্জ সর্দার আব্দুল খালেকের সঙ্গে মিলেমিশে রাধানাথ তথা গোটা জেলেসমাজকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। চন্দ্রকলা নামের বিধবা কৈবর্তনারীটি শেষ পর্যন্ত এসব অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল থেকে গেছে।

হরিদাস, রাধানাথ, খু-উ বুইজ্যা, রাধেশ্যাম, চন্দ্রকলা, পরিমল, রসমোহন, শিবশরণ – এরা যেন কৈবর্ত-সমাজের এক-একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। এদের নিয়েই দহনকালের কাহিনি-বয়ন। দহনকাল উপন্যাসে দয়ালহরি বঞ্চনার শিকার হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে আর রামহরি নিজের জীবন দিয়ে জালাল মেম্বারের নৌকা ডুবিয়ে বঞ্চনার প্রতিশোধ নেয়। হরবাঁশি গানের ভেতর দিয়ে জগৎ ও জীবনকে অনুধাবন করতে চায়। সমুদ্রসংগ্রামী এবং নদীলগ্ন জেলেদের সঙ্গ-নৈঃসঙ্গ্য, মৃত্যু-জন্ম একাকার হয়ে আছে দহনকাল উপন্যাসে।

দহনকালের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর পতেঙ্গার কৈবর্তরা একাত্তরের পাদদেশে এসে উপস্থিত হয়। নির্জীব, নির্বাক, নিথর উত্তর পতেঙ্গার জেলেপল্লিটি পাকসেনাদের অত্যাচার-বর্বরতায় জেগে ওঠে। মা-বোন-স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষা করার জন্য হরিদাস-রাধেশ্যাম-খু-উ বুইজ্যারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। এবং প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। কৈবর্তদের জীবনে শুরু হয় আরেক দহনকাল।

১৯৭১-ই জন্ম কথাকার প্রশান্ত মৃধার। মৃত্যুর আগে মাটি, আপন সাকিন, ক্ষয় পুরাণ, নদীর তৃতীয় তীর – এসব উপন্যাস লিখে তিনি পাঠকপ্রিয়তা পান। কৈবর্তজীবন নিয়ে তাঁর জল ও জালের তরঙ্গ নামের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এটি কৈবর্ত-জননির্ভর নদীভিত্তিক উপন্যাস। বলেশ্বর নদীর পাড়ে কৈবর্ত-জনপদ। সেই কৈবর্তপল্লিতে অনেক জেলের বাস। গণেশ তাদের একজন। সে জাল-নৌকাহীন। দারিদ্রে্যর নোনাজলে ডুবসাঁতারের জীবন তাঁর। দৈবক্রমে দুই বিয়ে তাঁর। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাঁশরীকে দ্বিতীয় স্ত্রী করে আনে গণেশ। গণেশের প্রথম স্ত্রীর ঘরে দুই সন্তান – গোকূল আর গৌরী। প্রথাগতভাবে বিমাতা বাঁশরী সতীন-সন্তানদের  অবহেলা-অত্যাচার করে। পিতা গণেশ অসহায়। সন্তানদের প্রতি স্নেহ থাকলেও বউয়ের ভয়ে তা দেখাতে পারে না। এই সময় গণেশ নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়। পঙ্গু হয়ে বাড়ি ফেরে সে। বিমাতার মধ্যে পরিবর্তন আসে। তার ভেতরের ক্রোধ ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। সে সতীন-সন্তানদের কাছে টেনে নেয়। গোকূল সংসারের হাল ধরে। পিতার মতো মাছ ধরার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করল সে। পিতার মতো নিজেকে বলেশ্বর নদীর দুপাড়ের ঘেরাটোপে বন্দি রাখতে চায় না গোকূল। সে সমুদ্রসংগ্রামী হতে চায়। এ যেন গোকূলের ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে যাত্রার আকাঙ্ক্ষা। জল ও জালের তরঙ্গ পড়তে পড়তে সমরেশ বসুর গঙ্গা উপন্যাসের কথা মনে আসা স্বাভাবিক। গঙ্গা প্রকাশিত হওয়ার ৫৭ বছর পরে লেখা প্রশান্ত মৃধার জল ও জালের তরঙ্গ উপন্যাসটি। তারপরও আমাদের মনে হয় পুরনো কাহিনির আড়ালে প্রশান্ত মৃধার এ-উপন্যাসে কৈবর্ত-জীবনসংগ্রামের কথা নতুন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। গণেশের আর গোকূলের, গৌরীর আর বাঁশরীর ব্যক্তিকাহিনির সঙ্গে সঙ্গে গোটা জেলেপল্লির কৈবর্তদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কাহিনিও এ-উপন্যাসে বড় জায়গা নিয়ে আছে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী (১৯৬০) মূলত কবি। হঠাৎ হঠাৎ লেখেন উপন্যাস। ২০১৪-তে বেরিয়েছে নার্গিস, নজরুল-স্ত্রীকে নিয়ে লেখা। ২০১৫-তে বেরিয়েছে বাসন্তী তোমার পুরুষ কোথায়? – একজন কৈবর্তনারীর একক জীবনসংগ্রামের কাহিনি। কৈবর্তনারীটির নাম নিভারানী ওরফে নাজমা বেগম ওরফে বাসন্তী। বস্ত্রবালিকা ছিল সে। গার্মেন্টসে চাকরি করতে করতে নিজামউদ্দিনের প্রেমে পড়া। নাম পালটে, নিভারানী নাজমা বেগম হয়ে নিজামকে বিয়ে করে। সমাজে নিন্দার ঝড় ওঠে। ভ্রূক্ষেপ করে না নাজমা। মাছ ধরতে গিয়ে নিজাম জলদস্যুদের কবলে পড়ে। পঙ্গু হয়ে বাড়ি ফেরে। তারপরও প্রেমে ভাটা পড়ে না নাজমার। সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে কাপ-ডিশ ধুয়ে দিনে গার্মেন্টসে চাকরি করে জীবন চালাচ্ছিল নাজমা। এ-সময় মনোহরখালীর জেলেপাড়ায় ‘নিষ্ঠা’ নামের একটা এনজিও আসে। এর কর্ণধার হায়দার  সাহেব। হায়দার সাহেবের নজর পড়ে নিভা তথা নাজমার ওপর। বলে – ভেতরে আগুন আছে মেয়েটার। জেলেসংস্কৃতি নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতে চায় ‘নিষ্ঠা’ নামের এনজিওটি। বংশী জলদাস প্রতিবাদ করে। বলে, ‘পেডত ভাত থাইলে তোঁয়ারারে ন লাগিব। অাঁরার নাটক আরা গইয্যম। পেট খালি রাই নাটক অইব না বা-জি!’

কৈবর্ত-জীবনসংগ্রামের মূল সূত্রটি যেন বংশীর সংলাপে উচ্চকিত হয়ে ওঠে। জলদাসদের কাছে ‘অন্ন চিন্তা চমৎকারা।’ পেটে ভাত না থাকলে নাটক আর সংস্কৃতি দিয়ে কী হবে? তারপরও নাটক হয়, কৈবর্ত-বিধবার হাহাকার নিয়ে নাটক। ওই নাটকে নিভারানী মানে নাজমা বেগম বাসন্তী চরিত্রে অভিনয় করে। সেই থেকে তার পরিচয় বাসন্তী নামে। হায়দার আলী পনেরো হাজার টাকা বেতনের চাকরির টোপ ফেলে বাসন্তীর সামনে। বাসন্তী টোপ গেলে। নাটক মঞ্চায়নের কথা বলে হায়দার আলী বাসন্তীকে নিউইয়র্ক নিয়ে যেতে চায়। বাসন্তীর পিছুটান প্রবল – সে আমেরিকা গেলে তার স্বামী নিজামকে দেখবে কে?

হায়দার বলে, মাত্র বিশ-বাইশ দিনের ব্যাপার। এই সুযোগ বারবার আসে না। বাসন্তী রাজি হয়ে যায়। তারপর নিউইয়র্ক, তারপর হায়দারের ভোগের সামগ্রী হওয়া। ফিরে এলে এই কৈবর্তকন্যার জেলেপাড়ায় আর স্থান হলো না। বাহান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই হলো পতিতাপল্লিতে।

অসহায় কৈবর্তনারী, যে-মাটিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল, যে অল্পতে তুষ্ট ছিল, এক নিজামে তৃপ্ত ছিল, সেই নিভারানী জীবনযুদ্ধে হেরে গেল। হেরে গেল প্রলোভনের কাছে। হেরে গেল এনজিওর উর্দিপরা তথাকথিত ভদ্দরনোকদের রিরংসার কাছে। এক দুর্মর বেদনায় চুরমার হয়ে যাওয়া বাসন্তী নামের কৈবর্তনারীটির হাহাকার বাসন্তী, তোমার পুরুষ কোথায়? নামের উপন্যাসটিতে ধ্বনিত হয়েছে।

বাংলাদেশের আরেক তরুণ ঔপন্যাসিক মহি মুহাম্মদ (১৯৭৪)। এর মধ্যে তাঁর তিনটি উপন্যাস বেরিয়েছে। আড়াইপাতা (২০১২), ময়নাদ্বীপ (২০১৪) ও মেনকা (২০১৫)। চা-বাগানেই জন্ম তাঁর, বেড়ে ওঠাও ওখানে। বালকবেলা থেকে প্রান্তিক দলিত মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা তাঁর। তাঁর গল্প-উপন্যাসে প্রান্তজনরা বারবার ফিরে ফিরে আসে। চা-বাগানের কুলি-কামিন, মেছো, দেহোপজীবিনীদের নিয়েই তাঁর লেখালেখি। একদা চা-বাগানের মানুষজন থেকে মহি মুহাম্মদ দৃষ্টি ফেরালেন নদী-সমুদ্রপাড়ের জেলেদের দিকে। পদ্মানদীর মাঝির শেষাংশ থেকেই তাঁর ময়নাদ্বীপ উপন্যাসের সূচনা করেছেন তিনি। সাধারণত পদ্মানদীর মাঝির মতো ক্ল্যাসিক উপন্যাসগুলোর শেষাংশ নিয়ে অনেকে নতুন উপন্যাস লিখেছেন। এ-ধরনের উপন্যাসকে পরিণতিখন্ডও বলা যেতে পারে। পদ্মানদীর মাঝির পরিণতিখন্ড ময়নাদ্বীপ। মানিকের উপন্যাসটি শেষ হয় কপিলাকে নিয়ে কুবেরের ময়নাদ্বীপে অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে।

হোসেন মিয়ার স্বপ্নবুননের ময়নাদ্বীপকে নিয়ে মহি মুহাম্মদ জেলেজীবনের নতুন পাঁচালি লিখেছেন। কুবের ছিল নদীনির্ভর কৈবর্ত। জল-জাল-মালা-সন্তানাদি নিয়ে ছিল কুবেরের দিনাতিপাত। কিন্তু ময়নাদ্বীপের কুবেরের অবস্থা যেন জলবিচ্ছিন্ন মাছের মতো। হোসেন মিয়া তাকে ময়নাদ্বীপে নিয়ে গিয়ে মৎস্য শিকারের সঙ্গে যুক্ত করেনি। চাষিতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছে। তাই হোসেন মিয়া কুবেরকে মাঠলগ্ন করেছে। হোসেনের কৌশলে কুবের জালিক কৈবর্ত থেকে হালিক কৈবর্তে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানেই ময়নাদ্বীপের স্বাতন্ত্র্য। মৎস্য শিকারবিযুক্ত হওয়ার কারণে কুবেরের যে অন্তর্দাহ, তারই বিশ্বস্ত রূপায়ণ লক্ষ করা যায় ময়নাদ্বীপে। মালাবিহীন সন্তানবিচ্ছিন্ন কুবেরের ব্যক্তিগত লড়াইয়ের কাহিনি মহি মুহাম্মদের ময়নাদ্বীপ উপন্যাসটি। একটা ক্ল্যাসিক উপন্যাসের অনুবর্তনমূলক কাহিনি হওয়া সত্ত্বেও ময়নাদ্বীপ কৈবর্ত-জীবনসংগ্রামের উল্লেখনীয় গ্রন্থ।

কথাসাহিত্য মানে শুধু উপন্যাস নয়, ছোটগল্পও। বাংলাদেশে কৈবর্তজীবন নিয়ে তেমন করে ছোটগল্প লেখা হয়নি। শওকত আলীর দু-একটা গল্পে, আল মাহমুদের ‘কালো নৌকা’ নামের গল্পে, মহি মুহাম্মদের ‘বীজ’ নামের গল্পে কৈবর্তজীবনের  দু-একটা অনুষঙ্গ উদ্ভাসিত হয়েছে। আল মাহমুদের ‘কালো নৌকা’ ক্ল্যাসিক পর্যায়ের ছোটগল্প। তাছাড়া বর্তমান প্রবন্ধকারের জলদাসীর গল্প নামে একটি গল্পগ্রন্থ এবং ‘আহব ইদানীং’ নামের অন্য একটি গল্প আছে। জলদাসীর গল্পে দশজন জেলেনারীর জীবনকাহিনি বিধৃত হয়েছে। নানা দিক থেকে আলো ফেলে দশজন কৈবর্তনারীর টিকে থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে এসব গল্পে। একজন পঙ্গু কৈবর্ত-মুক্তিযোদ্ধার বেদনার্ত কাহিনি ‘আহব ইদানীং’। স্বাধীনতাবিরোধীদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে কী নিবিড় কষ্ট নেমে আসে, তারই বিবরণ আছে এই গল্পে।

 

সাত

এ-কথা স্বীকার্য, কৈবর্তজীবন নিয়ে, তাদের বেদনা উল্লাস আর অতীত-বর্তমান নিয়ে যেরকম বিপুলভাবে গল্প-উপন্যাস লিখিত হওয়ার কথা, সে-রকম করে লেখা হচ্ছে না বাংলাদেশে। যদিও দু-চারটা উপন্যাস লেখা হচ্ছে, তাতেও তথাকথিত সমালোচকদের প্রশ্নের খোঁচায় রক্তাক্ত হতে হয়। পদ্মানদীর মাঝি বা তিতাস একটি নদীর নাম বা গঙ্গার পরে জেলেদের নিয়ে আর কোনো উপন্যাস লেখার দরকার আছে কিনা? এরকম প্রশ্ন বারবার উত্থাপিত হচ্ছে। আমার মনে হয়, এরকম প্রশ্ন অবান্তর। একটা বিষয় নিয়ে একাধিক, দশাধিক উপন্যাস লেখা কি অপরাধের? তাতে কি উপন্যাস বা উপজীব্য বিষয়বৈচিত্র্য হারায়? তাতো নয়। একজন মানুষের জীবনে কত বৈচিত্র্য, একটা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে কত স্তর-উপস্তর? কত রাজনীতি, সমাজনীতি, কত অর্থনীতি, কত ধর্মনীতি!

জেলেদের নিয়ে আজ পর্যন্ত যত উপন্যাস লেখা হয়েছে, তাতে তেমন করে রাজনীতি উপস্থাপিত হয়নি। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গহিন গাঙ আর ঘনশ্যাম চৌধুরীর অবগাহন উপন্যাসের কথা স্মরণে রেখেও এ-কথা বলা যায়। কৈবর্তরা ধীরে ধীরে শিক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষিতজনের মধ্যে অধিকার সচেতনতা ও যুক্তিবাদিতা বাড়ে। কৈবর্তরা এখনো পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়। অশিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার, বর্ণবাদীদের সঙ্গে বর্ণহীনদের যে দ্বন্দ্ব, দলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কৈবর্তদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম – এসবকে অবলম্বন করে এখনো উপন্যাস লেখা হয়নি বাংলাদেশে। তবে আশার কথা এই যে, কৈবর্ত-জীবনসংগ্রামকে কেন্দ্র করে কথাসাহিত্য রচনা একেবারে থেমে থাকেনি। দু-চারজন দরদি লেখক এখনো কৈবর্ত-জনগোষ্ঠী নিয়ে উপন্যাস-গল্প লিখে যাচ্ছেন। আশা করি, ভাটার নদীতে একদিন জোয়ার আসবে, কৈবর্তজীবন রূপায়ণের সমুদ্রস্রোতে বেগের প্রাবল্য বাড়বে।