বাংলার মাটি ও জলের নিসর্গ গাথা

Banglar-Mati-&-Joler-Nisorga-Gatha

জাহিদ মুস্তাফা

বাংলার মাটি বাংলার জল। কথাটা শুনেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে মেঘমেদুর আকাশের নিচে, খাল-নদীতীরে জলকাদামাটিমাখা সেণহশীলা গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর এ-বাক্যটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘দেশ’ পর্যায়ের গান থেকে উৎকীর্ণ। এটি কুইনিজ আর্ট গ্যালারির প্রদর্শনীর শিরোনাম।

এ নামেই গত মার্চে ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত হয়েছিল হার্দিক এক চিত্রকর্মশালার। তার সিপাহসালার গত শতকের আশির দশকের শুরুতে চারুকলায় আমার সহপাঠী-শিল্পী নাসিমা খানম কুইনি। তিনি নিজে আঁকেন, ছবি আঁকতে অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর সহযাত্রী হয়েছিলাম ২০১৪ সালের মধ্য ডিসেম্বরে গাজীপুরে নক্ষত্রবাড়িতে আয়োজিত আরেক কর্মশালায়। কুইনির সে-আয়োজনের নাম ছিল – উড়ন্তডানায় রংধনু। গত বছর ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে সে-প্রদর্শনীও হয়েছে সাফল্যের সঙ্গে। এরও আগে কুইনিজ আর্ট শিল্পী রণজিৎ দাসের পরিচালনায় রঙের ঐকতান নামে আরেকটি চিত্রকর্মশালা ও প্রদর্শনী করেছেন ঢাকা আর্ট সেন্টারে।

শিল্পীর ক্যানভাসে বাংলা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের নানাদিক তুলে ধরে মাতৃভূমির রূপমাধুরীকে সমঝদার দর্শকের সামনে তুলে ধরতে বাংলার মাটি বাংলার জল কর্মশালার আয়োজন। এতে অংশ নিয়েছেন নানাবয়সী উনিশজন শিল্পী। এই চিত্রকর্মশালায় ষোলোজন দুটি করে ছবি এঁকেছেন, তিনজন এঁকেছেন একটি করে। সব মিলিয়ে পঁয়ত্রিশটি চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর কাজগুলো যেন বাংলা প্রকৃতির রূপবৈচিত্রকে তুলে ধরেছে।

শিল্পী আবদুল মান্নানের আঁকা দুটি চিত্রকর্ম গ্রামবাংলার ঋতুবৈচিত্রের সৌন্দর্য-বৈভবকে প্রতিনিধিত্ব করে। ফসলপ্রাপ্তির কাল হেমন্ত আর আকাশ-নদীর একাকার হয়ে-ওঠা শরৎ সৌন্দর্যকে চিত্রপটে দক্ষতার সঙ্গে অনুবাদ করেছেন তিনি। নাসিম আহমেদ নাদভী তাঁর চিত্রপটে কালোবর্ণে গতিময়তায় কালবৈশাখিকে তুলে ধরেছেন। হাওয়ায় দোদুল্যমান চিরলঘাসের ফাঁক গলে দূরের নানা বর্ণে পুষ্ট রেখায়, রঙের আলিম্পনে
প্রকৃতির রূপ বিমূর্ত কায়দায় তুলে ধরেছেন শামিম সুব্রানা। নাসিমা খানম কুইনি জলমগ্ন নিসর্গ এঁকে তাঁর ছবির শিরোনাম দিয়েছেন বৃষ্টির ছায়া। এ ছবির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মিল লক্ষণীয়। সবুজবনের মাঝখানে প্রবহমান জলধারা যেন প্রকৃতিবান্ধব হয়ে চিত্রগঠনকেই সমৃদ্ধ করেছে। লায়লা শার্মিন প্রকৃতির রংবৈভবকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে দৃষ্টিনন্দন কাজ করেন। ‘ওম শামিত্ম’ শিরোনামে তিনি দুটি ছবি এঁকেছেন নমিত রঙের প্রশামিত্ম নিয়ে। এর একটিতে তিনি জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা চিত্রিত করেছেন।

আশরাফুল হাসান গাছের শেকড়কে মানবাকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে চিত্রপটে একধরনের রহস্যময় আবহ তৈরি করে থাকেন। এবার তিনি বাংলার গ্রাম আর পাহাড়ি প্রকৃতির সৌন্দর্যে মজে দৃষ্টিমুগ্ধকর ছবি এঁকেছেন। আজমীর হোসেন ও উত্তম কুমার রায় দুটি করে ভূ-দৃশ্য এঁকে প্রায় সাদাবর্ণের একটা পর্দা দেওয়ায় একধরনের কুয়াশাচ্ছন্ন রূপ সৃষ্টি করেছেন। ফাহমিদা খাতুন এঁকেছেন নদীমাতৃক বাংলার বাহন নৌকার ছবি। তবে চিত্রপটের চারপাশে ভারিবর্ণের পর্দা দিয়ে করায় ছবির স্বাভাবিকত্ব ব্যাহত হয়েছে। মেহেদি হাসান ও শাহনুর মামুন গ্রামীণ প্রকৃতি এঁকেছেন নিজেদের অংকন-ধরনে। সোহাগ পারভেজ পাহাড়ি প্রকৃতি ও নদীর দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছেন। শিল্পী রফিকুন নবীর অংকনরীতির প্রভাব আছে তাঁর কাজে। সৌরভ চৌধুরী লক্ষ্মীপেঁচার ছবি এঁকে প্রদর্শনীর বিষয়বৈচিত্র বাড়িয়েছেন। আবদুল্লাহ আল বশীর গ্রামবাংলার সবুজ প্রকৃতির নন্দিত দৃশ্য তুলে ধরেছেন ভালোবাসা দিয়ে। জলাশয়ের প্রামেত্ম তালগাছসহ দূরে দিগন্তরেখার হাতছানি দর্শককে মনে করিয়ে দেয় তার ফেলে আসা গ্রামের কথা। সিঁদুর-লালচে রঙে জাহাঙ্গীর আলম এঁকেছেন ত্রিভঙ্গে নৃত্যরতা এক শিল্পীর ছবি।

অংশগ্রহণকারী অন্য শিল্পীরা হলেন – আনিসুজ্জামান মামুন, ইশতিয়াক তালুকদার সানি, রেজা কে চৌধুরী ও সুলতান ইশতিয়াক। মামুন প্রায় ফটোগ্রাফিক বাস্তবতায় সমুদ্রতট ও সমুদ্রের জলযান সাম্পান এঁকেছেন। তবে দূরে সাম্পানের চলমানতা প্রতিফলিত না হওয়ায় চিত্রটির গুরুত্ব ব্যাহত হয়েছে। ইশতিয়াক সানি এঁকেছেন ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও এর তীরবর্তী স্থাপনার ছবি এবং লালচে রাজপথের নগর কেন্দ্র। রেজা চৌধুরী এঁকেছেন শৈশবস্মৃতি ও এক বয়োজ্যেষ্ঠ পাহাড়ি নারীর অবয়ব। আমাদের যাঁরা গ্রামে বড় হয়েছেন তাঁদের অনেকেরই গ্রামের জলাধারে নেমে শৈশবে শাপলা আহরণের অভিজ্ঞতা কমবেশি আছে। সেই স্মৃতির অনুরণন হলো এই চিত্রদর্শনে। সুলতান ইশতিয়াক পুরনো ঢাকা ও সোনারগাঁর পানাম নগরের ছবি এঁকেছেন। ওপর থেকে দেখা পুরনো ঢাকা আঁকায় ছবির গঠন অন্যরকম হয়েছে। কিন্তু পানাম নগরের স্থাপনার ছবির সঙ্গে যে মানুষজন এঁকেছেন শিল্পী, সেই ফিগারগুলোকে নিঃসাড় মনে হয়েছে।

ওয়ার্কশপ ও প্রদর্শনী আয়োজনের পাশাপাশি কুইনিজ আর্ট আরেকটি প্রশংসনীয় কাজ করে থাকে। সেটি হলো বরেণ্য শিল্পীদের সম্মাননা প্রদান। তাঁদের সম্মাননাপ্রাপ্ত দুজন শিল্পী হলেন – অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও অধ্যাপক আবুল বারক আলভী।

গ্যালারির চার দেয়ালের অভ্যন্তরে বাংলা প্রকৃতির বৈচিত্র্য দর্শনের সুযোগ তৈরির চমৎকার এ-আয়োজনের জন্য কুইনিজ আর্টকে অভিনন্দন। ছয়দিনব্যাপী এ প্রদর্শনী শেষ হয়েছে গত ২০ জুলাই, বুধবার।