বাঙালির আভিজাত্য আর একটু ম্লান হলো

গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। অশোক মিত্র তখন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। ন্যায়সংগত কারণেই সরকারি গাড়ি পান সরকারি কাজে যাতায়াতের সূত্রে। তাঁর গাড়ির যিনি চালক তিনিও সরকারি কর্মী। একদিন অশোকবাবুকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় সেই চালক ভদ্রলোক দেখেন অশোকবাবুর স্ত্রী সামনে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করে ম্যাডামের গন্তব্যও একই দিকে জেনে স্বাভাবিকভাবেই তিনি গাড়ির দরজা খুলে তাঁকে উঠে আসতে বলেন। একটু ইতস্তত করে ভদ্রমহিলা উঠে বসেন গাড়িতে। গাড়িতে দম্পতির মধ্যে কোনো কথাবিনিময় হয়নি। তিনি নেমে যাওয়ার পর অশোকবাবু সরকারি নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে চালক ভদ্রলোককে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করেন এবং কর্তৃপক্ষের কাছে তার নামে অভিযোগ জানান। যা হোক, ক্ষমা চেয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটার সেখানেই ইতি হয়। যদিও এই কাহিনি আমি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুনেছি, তথাপি যেহেতু লিখিত নথি নেই এবং সম্পর্কিত তিন ব্যক্তির কাছ থেকে আমি শুনিনি, তাই এই ‘ঘটনা’ না হয় গল্প হিসেবেই থাক। বলার কথা শুধু এই যে, আজ এই ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে আজকের সাধারণ মানুষেরা তো দূর অস্ত, রাজনীতির মানুষরাও এ-ঘটনাকে বাড়াবাড়ি বলবেন। বোকামি মনে করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করবেন। এমনকি, হয়তো প্রকাশ্যেও বলবেন। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাটা মূল্যবোধের। এবং যার অভাব আজ সর্বস্তরে। এবার আসি দ্বিতীয় ঘটনাতে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির জীবনানন্দ সভাঘরে একটি সাহিত্য পত্রিকার অনুষ্ঠানে আমাদের মতো অর্বাচীন শ্রোতাদের অশোক মিত্র, একটু মজার ছলেই, একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, সে-সময় বাংলা ভাষার সব থেকে বয়স্ক এবং সৃষ্টিশীল কবির নাম কি। দু-একটি ভুল উত্তর শুনে তিনি নিজেই জানিয়ে দেন নামটি – বিল্ব বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়তো কাকতালীয় যে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কর্তৃপক্ষ পরবর্তী লিটল ম্যাগাজিন মেলার সময় কবি বিল্ব বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্মান জ্ঞাপন করেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। এই ঘটনার অব্যবহিত পরে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন।

দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত, কোনোরকম যোগসূত্রহীন ঘটনা। মিল শুধু এক জায়গায় – দুটিরই কেন্দ্রে একই ব্যক্তি, অশোক মিত্র। কতগুলি এরকম অশোক মিত্র আছেন? অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনীতির শিক্ষক, কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেষ্টা, রাজ্যের মন্ত্রী; সংবাদপত্রের কলাম লেখক, রবীন্দ্রনাথ-বিশেষজ্ঞ, সাহিত্য-সমালোচক, বাংলা কবিতার সুদীক্ষিত পাঠক এবং লিখনে বাংলা ও ইংরেজি – দুভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। এর যে-কোনো একটা হলেই যখন ‘বিদ্বজ্জন’ হিসেবে এই বাংলায় সম্মান জোটে, তখনো তিনি আপন গরিমায় বাজার প্রতিমার পুজোয় ভেসে যাননি।

বিদ্বজ্জন বা বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গটা যখন উঠেই পড়ল, তখন ওই পাড়াটা একবার ঘুরে আসা যাক। পশ্চিমবঙ্গে গত বছর-পনেরোমতো বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিম-লে ভেসে উঠতে দেখা যাচ্ছে। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে ‘বিবমিষার অপরাধ নেই’ শীর্ষক লেখায় তিনি বলছেন, ‘তবে ন্যায়ধর্মের সঙ্গে স্তাবকতাবৃত্তির বরাবরই আড়াআড়ি সম্পর্ক। বিদূষকদের মধ্যে সাধারণত একটি প্রকৃতিগত বিভেদ থাকে। একদল বিদূষক বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে স্তাবকতায় লিপ্ত হন, কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিদের যথাযথ খোশামোদ করলে আখেরে এখানে-সেখানে কিছু সুবিধা হতে পারে, তাঁদের মনের কোণে সর্বদা এই চিন্তা জাগরূক থাকে। অন্য সম্প্রদায়ের বিদূষকরা স্বার্থের ব্যাপারটা ঠিক সবসময় মাথায় রাখেন না, তাঁরা নিছক স্তাবকতার জন্যই স্তাবকতা করে থাকেন, যে-কোনো রাজপুরুষের পদযুগল দেখলেই তাঁরা মন্ত্রবৎ ষাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণিপাত করেন, সব ঋতুতে সব ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই করেন।’ অশোক মিত্রের এই বক্তব্যের তাত্ত্বিক ভূমিকা কিন্তু আছে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে। আমাদের মনে পড়বে কমিউনিস্ট পার্টির ‘ম্যানিফেস্টো’ থেকে এই কথাগুলি,

‘ÔThe bourgeoisie has stripped of its halo every occupation hitherto honoured and looked up to with reverent awe. It has converted the physician, the lawyer, the priest, the poet, the man of science, into its paid wage labourers.’ আসলে অশোক মিত্রের কথাকে তাঁর যাপন থেকে, তাঁর যাপনকে তাঁর বিশ্বাস থেকে, তাঁর বিশ্বাসকে তাঁর রাজনীতি থেকে আলাদা করা যায় না। সেই কারণেই মন্ত্রী হিসেবে তাঁর বিশ্বাসমতে ‘ঠিক’ সিদ্ধান্তে মুখ্যমন্ত্রী ও দল ভিন্নমত পোষণ করলে, আপস না করে তিনি দল ও মন্ত্রিত্ব – দুই-ই ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে লেখা ‘প্রসঙ্গ ধূর্জটিপ্রসাদ’ নিবন্ধে তাঁর এই কথাগুলোর উদ্ধৃতি দিতে লোভ সংবরণ করতে পারছি না, ‘… এখন সাধারণভাবে বাংলা সাহিত্যের মান, সেই সঙ্গে সাহিত্য-উপলব্ধির মান, ভয়ে ভয়ে হলেও বলতে হয়, ভয়ংকররকম নিম্নগামী। সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের ভেতর তফাৎ সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়েছে এবং সেটা মুছে দিয়েছেন যাঁরা বাংলা সাহিত্যকে গত কুড়ি বছরে একেবারে বাজারি ব্যবসায় রূপান্তরিত করেছেন।’ নিজের বিশ্বাসে স্থিত থাকলে, নিজের ধীশক্তির এবং কলমের ওপর আস্থা রাখলে, প্রতিষ্ঠান মাথা নোয়ায়। অশোক মিত্র সমকালীন ইতিহাসে তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ-কাণ্ডের পরবর্তী অধ্যায়ে তাঁর লেখা ‘সহিষ্ণুতার দ্বন্দ্বসমাস’ নিবন্ধে আমরা এক অনন্য সত্যান্বেষী অশোক মিত্রকে পাই। পিলু মোদির সঙ্গে নিজের সম্পর্কের প্রেক্ষিত তিনি এভাবে বর্ণনা করছেন, ‘কট্টর বামপন্থী আমি, অন্যদিকে পুঁজিপতি টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পিলু বরাবর মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থার তথা বৈদেশিক নীতির অন্ধ অনুরাগী-সমর্থক। তাহলেও ব্যক্তিগত স্তরে আমাদের মধ্যে সৌজন্য সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা হয়নি। শিষ্টতাসহকারে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করেছি।’ বীরেন শাহ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু এই নিবন্ধে তিনি আত্মসমীক্ষা করেছেন – ‘সহনশীলতার ঋতু যে অতিক্রান্ত এই উপলব্ধি যতদিন আমরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবো, ততবেশি দ্রুততার সঙ্গে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনব।’ তিনি সাবধান করেছিলেন। আমরা অনুধাবন করতে পারিনি – সে তাঁর দোষ নয়।

যে-কোনো মানুষ বা শিল্পকর্মকে ইতিহাস থেকে বিচ্যুত করে বিচার চলে না। বিচার চলে না কোনো শিল্পী-কবি-অন্য সমস্ত রকমের স্রষ্টাদের তাঁদের শ্রেণিগত অবস্থানকে বিস্মৃত হয়ে। ব্যক্তিগতকে ছাপিয়ে যেতে হয় নৈর্ব্যক্তিকে উন্নীত হওয়ার জন্য। জীবনানন্দের শতবর্ষের পর তাঁকে নিয়ে এক নিবন্ধে (শতবার্ষিকী সমারোহের পর) তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছেন, ‘যে-কথা বহুবার বহু প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করেছি, জীবনানন্দ আমার প্রিয়তম কবি, আমার চেতনা-ধমনী অধিকার করে তাঁর প্রব্রজ্যা। কিন্তু তাহলেও বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক মূল্যায়নে আমার যথাযথ বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ থেকে কেন নিবৃত্ত থাকবো?’ এই হলেন অশোক মিত্র! ব্যক্তিগতকে ছাপিয়ে ওঠে তাঁর যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত। তা তাঁর নিজের কাছেই তিক্ত লাগতে পারে। তবু তিনি নিজের যুক্তি ও বিশ্বাসে অটল থাকবেন।

আমরা তাঁর যুক্তির প্রতিযুক্তি দিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতে পারি; কিন্তু পারি না তাঁর সততাকে প্রশ্ন করতে। মুখের ওপরে চাপা দেওয়া মুখোশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমরা তাঁর লেখায় পেয়ে যেতাম চেতনার শুশ্রƒষা। মেধায়, মননে, লিখনে এবং সাংস্কৃতিক আভিজাত্যে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত ‘রেনেসাঁসম্যান’।

তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন কি না তা বিচার করার যোগ্যতা এই প্রতিবেদকের নেই। কিন্তু এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত শিক্ষিত ভদ্রলোক বাঙালির শেষ কয়েকজন প্রতিনিধির তিনি ছিলেন একজন। তাঁর প্রয়াণে বাঙালি-আভিজাত্য আর একটু ম্লান হলো।