বাবর আজমের উপন্যাস

মঈনুল আহসান সাবের

গুলির ঘটনাটা প্রথমেই থাকতে পারত। পরিবেশ একদম স্বাভাবিক থাকত, সাধারণত যা থাকে। এর মধ্যে হঠাৎ গুলি। গুলি হবে, একজন পড়ে যাবে, যাওয়ার আগে গুলির কারণ জানবেও না, তারপর কাহিনি বলি বা ঘটনা, এগোবে। এগোতে এগোতে কিংবা কখনো পেছতে পেছতে কোথায় কতদূর যাবে, এ-কথা পরের।

কাহিনি যে প্রায় গুছিয়ে এনেছিল বাবর আজম, এমনও নয়, বরং কাহিনি তখনো এলোমেলোই ছিল, এলোমেলো এই অর্থে – সে মনস্থির করতে পারছিল না, এই যে ভাবতে গেলে একটার পর একটা বিষয় মাথায় চলে আসছে, আসছে, আর তার মনে হচ্ছে – হ্যাঁ এটা নিয়ে লেখা যায়… হ্যাঁ, এটা নিয়েও লেখা যায়… এটা নিয়েও – এই নিয়ে আবেদ কিছুটা নাজেহাল ছিল, সে চাচ্ছিল – একটা কাহিনি গুছিয়ে নিয়ে – আচ্ছা, ঠিক গুছিয়ে নিয়েই নামতে হবে, এমনও না হয়তো, মোটামুটি স্থির হওয়া গেলেও চলবে, তার ভাবনায় এ-ব্যাপারটাই ছিল – এই মাথায় আসছে নানা কাহিনি, এর মধ্যে কোনটা বেছে নিলে, তার প্রথম উপন্যাস, যা সামনের ঈদসংখ্যায় ছাপা হবে, পাঠক নেবে।

সে জানে, বড় লেখক যারা, তারা পাঠক নেবে কি নেবে না – এ নিয়ে ভাবেন না। পাঠকের কথা না ভেবেই তারা লেখেন, বের হওয়ার পর হয়তো দেখা যায় পাঠক সেটা নিয়ে নিয়েছেন। সেটা লেখার গুণে হতে পারে কিংবা লেখকের নামের গুণে, যা-ই হোক। আবেদ জানে, তার অবস্থা সেরকম নয়। একটু বেশি বয়সেই লিখতে শুরু করেছে সে, নাম কিছুটা অবশ্য হয়েছে এ দুই-তিন বছরেই। সেজন্য, সেটুকু নামের কারণে সময় পত্রিকা তার কাছে উপন্যাস চেয়ে বসবে, এমন চিমত্মা তার ভেতর কখনো তৈরি হয়নি। অথচ আজ সকালে সময় পত্রিকা যখন সত্যি সত্যিই তার কাছে ঈদসংখ্যার জন্য উপন্যাস চেয়েছে, সে বিস্মিত বটেই, বলা বাহুল্য, তার ভেতরে আসলে এক ঘোর তৈরি হয়েছে, এই ঘোরের ফাঁকে ফাঁকে, ফলায় মধু-মাখানো তিরের মতো এক ভাবনা ফুঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়েছে – যাক, এই অল্প সময়েই ঈদসংখ্যায়, সময়ের ঈদসংখ্যায় লেখার সুযোগ… না, সুযোগ বলবে না সে, প্রস্তাব, প্রস্তাব বলবে, প্রস্তাব যখন পাওয়া গেছে, তখন বুঝতে হবে সে লেখেও ভালো, ঈদসংখ্যায় লেখার মতো নামও করেছে। এখন, ঈদসংখ্যা বের হওয়ার পর ফয়সাল আবেদকে আরো কতজন চিনবে। সময়ের সাহিত্য সম্পাদক অবশ্য তাকে বললেন, এটা একটা সুযোগ। বললেন, এটা যে একটা সুযোগ, বড় একটা সুযোগ, তা কি তুমি বুঝতে পারছ, আজম?

এটা তিনি বললেন আজমের চোখে চোখ রেখে। কথা শেষ করেও চোখ সরালেন না, তাকিয়ে থাকলেন আজমের দিকেই, মনে হলো তার কিছু একটা বলা দরকার – লেখাটা খুব ভালো হতে হবে, না? মানে লেখা ভালো না হলে আপনি তো ছাপতেই পারবেন না… এসব আমার মাথায় আছে। এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না, ইকবালভাই।

ইকবালভাই কবিতা ও কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন। ভারী ভারী লেখা। ভারী লেখার সবসময় কিছু নিন্দুক থাকে, তারা বলেন – এত ভারী যে তোলা যায় না – কবিতা সম্পর্কেও তারা বলেন, বলেন – ইকবালের কবিতা? তা, ওর কবিতায় ইক থাকে না, পরের অক্ষর দুটো শুধু থাকে। এসব কথা আবেদও একসময় বলত, যখন ইকবাল পরপর তার দুটো গল্প ছাপেনি, তখন, এখন এসব সে আর বলে না। বলে – ইকবালভাই, আপনার ওই কবিতাটি অনবদ্য হয়েছে।

বুঝেছ?

দুবার পড়েছি। দুবারই আলাদা মনে হয়েছে। আবারো পড়ব কিছু বিরতি দিয়ে। তখন হয়তো অন্য এক মাত্রায় উদ্ভাসিত হবে।

সাহিত্য, আবেদ, সাহিত্য হচ্ছে তা, যা বারবার তোমার কাছে নতুন রূপে ফিরে আসবে।

ওসব কথা থাক, এই যে আবেদ বলল – এসব নিয়ে যেন না ভাবে ইকবাল – শুনে ইকবালের মুখে হাসি দেখা দিলো, বড় হাসি নয়, ইকবালকে বড় হাসি হাসতে দেখেনি আবেদ, তার হাসি হালকা পরলের মতো, যেন কেউ পাউডারের পাফের বদলে হাসির পাফ হালকা করে বুলিয়ে দিয়েছে তার মুখে – আবেদ, কী ভাবব না আমি, তুমি কী ভাবতে বারণ করছ – জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

লেখা ভালো হবে, ইকবালভাই। আপনি নিশ্চিত থাকুন লেখা ভালো হবে।

আবেদ অনেকটা মরিয়ার মতো নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল – ইকবাল তাকে উপন্যাস লেখার কথা বলে নিশ্চিত ও সুস্থির থাকুক – যেন এই যে হঠাৎ তিনি বাবরকে উপন্যাস লিখতে বলেছেন, যেখানে কত কত লেখক সময়ের ঈদসংখ্যা বটেই, সাধারণ সংখ্যায় এটা-ওটা লেখার জন্য উদগ্রীব ও অস্থির হয়ে থাকে, সেখানে বাবরকে ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লিখতে বলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

তার কথায় ইকবাল কতটা নিশ্চিন্ত হলেন, বোঝার জন্য আবেদ মেকি সুস্থির চোখে ইকবালের দিকে তাকিয়ে থাকল।

ইকবাল বললেন – এটা একটা সুযোগ, আবেদ, এটা একটা সুযোগ।

জি জি, নিশ্চয় – বলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল আবেদ। যদিও পরক্ষণেই তার মনে হলো, ইকবাল যদি ‘সুযোগ’ না বলে, ‘এই যে আমাদের প্রস্তাব তোমার জন্য… ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লেখার জন্য’ – এভাবে বলতেন, তবে… তবে কী – সেটা নিয়ে আবেদ তখনই আর মাথা ঘামাল না, ইকবালের মতো সে-ও ভাবল – এটা একটা সুযোগ – তারপর সে নিজের মতো করেও ভাবল – সত্যিই, এটা একটা অবিশ্বাস্য সুযোগ, শুধু, ‘তাদের তরফ থেকে তাকে দেওয়া এটা একটা প্রস্তাব’ – এভাবে শুনলে ভালো লাগে, এই যা।

ইকবাল বললেন – আমি চাই এ-সুযোগটা তুমি পুরোপুরি কাজে লাগাও।

নিশ্চয়, ইকবালভাই। আমার চেষ্টায় কোনো ত্রম্নটি থাকবে না।

আমি জানি বাইরের অনেকেই আমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলে…।

কই…!

তুমিও বলতে।

না না, ইকবালভাই, কী যে বলেন!

আবেদ আড়চোখে ইকবালকে লক্ষ করল, তার মনে হলো হাসির এক পাফ, যদিও বেশ হালকা, এখনো আছে তার মুখে, দেখে সে স্বসিত্মবোধ করল ও বড় করে শ্বাস ফেলে বলল – এটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার আছে যে এটা একটা অনেক বড় সুযোগ।

মাথায় রেখো।… আরেকটা কথা…।

জি, ইকবালভাই।

একটা কথা মাথায় রাখো।… তোমাকে পিক করার কয়েকটি কারণ আছে, একটা বলি।… দেখো, ভালো, মোটামুটি ভালো লিখছে অনেকেই, দু-একজন তোমার চেয়ে নামি ও জনপ্রিয়… আমার এ-কথায় তোমার বিমর্ষ হওয়ার কোনো কারণ কিন্তু নেই…।

না না, বিমর্ষ হয়েছি কোথায় দেখলেন! আমি আপনার কথা মন দিয়ে শুনছি।

আমার কথায় বিমর্ষ হওয়ার কারণ নেই, কারণ আমি যাদের প্রশংসা করলাম, তুমি তাদের চেয়ে ভালো লেখো। তোমার
গল্প-বানানোর কৌশল আমার দারুণ লাগে। এই কৌশল এতদিন দেখেছি তোমার গল্পে, এবার দেখতে চাই আরো বড় পরিসরে গল্প তুমি কেমন বানাও। এ তুমি জানোই, সবই থাকবে উপন্যাসে, কিন্তু আড়ালে-আবডালে হলেও একটা কাহিনি থাকবেই।… ভুল বললাম?

একদম ঠিক।

সেই কাহিনিতে তোমার কল্পনাশক্তি কেমন কাজ করে, দেখব।

ফয়সাল আবেদ হাসল – দেখবেন।… ইকবালভাই…।

বলো।

আর কারণগুলো জানা যাবে?

আর কারণগুলো মানে!

ওই যে, বললেন না – আমাকে পিক করার কয়েকটি কারণ আছে…।

ওহ্ এই এসবই।… দাফতরিক ব্যাপারও আছে। তোমার আসলে আরো কিছু জানার দরকার নেই। তোমার কাছে কী চাই, সেটা বলেছি তোমাকে।

কাহিনি সে ভালোই বানায়, তার গল্প-বানানোর কৌশল ইকবালভাইয়ের দারুণ লাগে – এ-ব্যাপারটা আবেদের মাথায় ঢুকে গেল। হ্যাঁ, কথা এটাই, সব থাকবে উপন্যাসে, আড়ালে-আবডালে একটা কাহিনিও থাকবে, সেখানে কল্পনাশক্তি বা ইমাজিনেশনের ব্যবহার, যার ওপর নির্ভর করে কাহিনি এগিয়ে যাবে।

এখন, ইকবালের ওখান থেকে বের হওয়ার পর, বলা উচিত বের হওয়ার পর থেকেই আবেদ বুঝতে পারল – এই ভাবনাগুলো তাকে আচ্ছন্ন ও অস্থির করে রেখেছে। কখনো পেটের কাছে গুড়গুড় করছে, কখনো গলার কাছে বেরিয়ে না-যাওয়া ঢেকুরের মতো হয়ে আছে, কখনো মাথার ভেতর এক্কাদোক্কা খেলছে। তার মনে হলো, ইকবালভাইয়ের অতসব বলার দরকার ছিল না। সে সময় পত্রিকার ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লেখার গুরুত্ব বোঝে। সুতরাং, ‘আবেদ, তুমি এ-বছর আমাদের ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লিখছ’ – এই এটুকু বলাই যথেষ্ট ছিল। তার অস্বসিত্মটা শুরু হয়েছে তখন, ইকবালভাই যখন উপদেশমালাসহ মুরবিব সাজতে চেয়েছেন। তবে, এ-ও ঠিক বটে, ইকবালভাই যদি মুরবিব না-ও সাজতেন, এ-কথা সবসময়ই ঠিক যে একটা জুতসই গল্প তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

একটা গল্প খুঁজে বের করা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো তার গল্প খুঁজে বের করার প্রস্ত্ততি নেই। শুধু গল্প হলেও এক কথা ছিল, কিন্তু এ-হচ্ছে উপন্যাসের গল্প। সময় তার কাছে উপন্যাস চাইবে তার ধারণা ছিল না। এখন চেয়েছে, এখন এই সুযোগ হারানোর প্রশ্নই ওঠে না, এখন, সময় যদিও কম, এর মধ্যেই চারপাশসহ একটা কাহিনি তাকে সাজিয়ে নিতে হবে। কাহিনির ধারণা অবশ্য আছে কিছু, কিছু নোট আছে, কখনো উপন্যাস লিখলে এই কাহিনিগুলো লিখবে – এরকম নোট; এখন ওর মধ্যে কোনটি মানানসই হবে কিংবা কোনটিকে মানানসই করে তোলা যাবে। আপাতত, যতক্ষণ সে ওদিকে সময় দিতে পারছে না। এমন এলোমেলো উদ্ভ্রান্ত না থেকে – একটা উপন্যাসই লিখতে হবে, নাকি? – এরকম ভেবে তাকে বরং আজকের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া উচিত। সে-চেষ্টা চালাল আবেদ। কতটা সফল হলো, সে-নিজেও অবশ্য বুঝতে পারল না।

 

ক্লাবে এ-সময় লোক কম থাকে। শরাফত দুটো হুইস্কি শেষ করে তৃতীয়টা নিয়ে বসে আছে। ১৮ বছরের পুরনো গেস্ননলেভিট। এসব গেস্ননলেভিট, ডবল ব্র্যাক, সিঙ্গেল সল্ট, গোল্ড লেবেলে শরাফতের পোষায় না। পানসে পানসে লাগে। সে দেখেছে, কিছু মেয়ে আছে, সেক্স করতে গেলে কিছু না করে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে শুধু, সেরকম। তার হাতেখড়ি হয়েছিল ভ্যাট সিক্সটি নাইন। সে বেশ অনেক আগের কথা। তারপর কতজন এলো-গেল, ভ্যাটের কথা সে ভুলতে পারল না। এক বন্ধুকে সে খুব দুঃখ করে এ-কথা বলতে গেলে বন্ধু অবাক গলায় বলেছিল – ভ্যাট ভুলবা ক্যামনে, অর্থমন্ত্রী তো বাঁইচা আছে। শুনে শরাফত খুবই বিরক্ত হয়েছিল। বন্ধু যে ভ্যাটের কথা বলল, তা কে ভুলতে চায়! ওটা আছে বলেই না ফাঁকি মারার ব্যবস্থা আছে, আর, ফাঁকি মারা মানে ডবল লাভ। থাক এসব কথা, তার জীবনে যে-ভ্যাট এসেছিল, সে-ভ্যাটের কথা সে ভুলতে পারল না। কেমন একটা ধাক্কা দিত, ‘মদ খাচ্ছি, আমি তাহলে মদ খাচ্ছি’ অনুভূতিটা জাগত। কিন্তু এখনকার গোল্ড লেবেল, বস্নু লেবেল তো বাদই, মল্ট ফল্টেও কিছু নেই। খেয়েই যাও খেয়েই যাও – শুধু খেয়েই যাওয়া আরকি,  সেই মেয়েটির মতো, সেক্স করার সময় উলটে ফেলে ওপরে ওঠে বসার মতো যার আচরণ, একটুও সেরকম না। সমস্যা হচ্ছে, ক্লাবে এলে এসবই খেতে হয়। এ-এক প্রচ- বিরক্তিকর ব্যাপার। আরে বাপ, আমার টাকায় আমি মদ খাব, যেইটা ইচ্ছা সেইটা খাব – তুই কেন আড়চোখে তাকাইবি আর মজা নিবি! এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সে হয়েছে কয়েকবার। একবার মোটামুটি ঘনিষ্ঠ একজন বলেই ছিল তাকে – শরাফতভাই, দুই পেগ আমার নামে অর্ডার করলে একগা পরামর্শ দিই।

ব্যবসার জীবনে প্রথম প্রথম এরও পরামর্শ শরাফত নিয়েছে। এখন আর সে-সময় নেই। এখন তার বহু রাস্তায় হাঁটা হয়েছে, জানাবোঝা হয়েছে, কোন রাস্তায় কোন জুতো পরতে হবে, সে জেনেছে, এখন তাই পরামর্শের কথা শুনলে তার বিরক্ত লাগে, সে-পরামর্শ ব্যবসার জীবনেই হোক, ব্যবসার বাইরের জীবনের হোক, সে মনে মনে বলে – আরে নাদান, শরাফত নিব তোর পরামর্শ!

তবে সেদিন সে নিয়েছিল, কারণ লোকটা বন্ধুর মতো ও আন্তরিক, শরাফত বলেছিল – হ ভাই, বলেন, শুনি।

আগে আমার নামে দুইটা গ্রিন আইল্যান্ডের অর্ডার দেন।

এইটা কী?

হুইস্কি।

আর কত নাম যে শুনব।

শোনেন নাই, এমনই বেশি।… দেন।

আচ্ছা, দিলাম।… মাশুক, এই স্যারকে দুইটা গিরিন আইল্যান্ড…।

আপনিও দুইটা অর্ডার দেন। আপনার জন্য।

আমার তো চলতেছে।

রেগুলার হুইস্কি। আপনি সবসময় রেগুলার হুইস্কি খান কেন?

শরাফত ভেবে উত্তর দিয়েছিল – ভাই, এইটা হইতেছে টেস্টের ব্যাপার।

সমস্যা।… ভাই, আপনার টাকা আছে কেমন?

এইটা ভাই, কী প্রশ্ন?

বিরক্ত হইয়েন না। আপনার টাকা কাইড়া নেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। বলেন।

তা ধরেন, আল্লাহপাকের বিশেষ রহমত, হইছে কিছু।

আগেও কি এই রকম ছিল?

কী বলেন! কত পরিশ্রম কইরা এইখানে আসছি…।

তাইলে মনে রাখেন, শরাফতভাই, টাকার সঙ্গে সঙ্গে টেস্টও বদলায়। যদি টেস্ট না বদলায় লোকে বুঝবে ক্যামনে আপনার টাকা হইছে!

এইটা আপনে ঠিকই বলছেন অবশ্য…।

একটা উদাহরণ দিই। মদের উদাহরণ না, অন্য। এই ক্লাবেরই একজন, চিনায়ে দিলে আপনিও চিনবেন, চিনায়ে দিবও না হয় একদিন, তারে আমি চিনি বহুদিন, আগে একশ টাকা পাইলে পাড়ায় ছুটত, এখন তার টাকা হইছে, যে পঞ্চাশ হাজারের নিচে মারা দেয়, তাদের লাগায় না।

কথাটা মনে ধরল শরাফতের। আরো কিছুক্ষণ তারা আড্ডা দিলো। পরদিন থেকে সে পালাক্রমে হুইস্কি খাওয়া শুরু করল। এসব হুইস্কি নাকি মিল্কের মতো মোলায়েম। কথাটা মিথ্যা না। তাই খাকি কাপড়ের স্বাদের হুইস্কির জন্য তার চাহিদা রয়েই গেছে। এসব সিল্ক মসলিন সে খায় বিরক্তি নিয়ে। এই এখনো সে যেমন বিরক্ত। তবে এখন সে, ওসব মোলায়েম জিনিস খেতে হচ্ছে বলে বিরক্ত নয়। এখন তার মন খারাপ। আরো বড় সমস্যা, তার মন খারাপের কারণ তার অজানা। গত দেড়-দুদিন ধরে এমন হচ্ছে, মন কেমন ভার হয়ে থাকছে, সে কারণটা বুঝতে পারছে না। আজ অবেলায় ক্লাবে আসার কারণ, সে ঠিক করেছে – সে খাবে আর ভাববে,  আরো খাবে আরো ভাববে।

এখন, সে খেয়াল করে দেখল, এতক্ষণ ধরে সে শুধু খেয়েছেই, এতক্ষণ কিছুই ভাবা হয়নি। এখন তাহলে ভাবতে হয়। সে বেয়ারাকে ডেকে দুই পেগের অর্ডার দিলো। এই দুই পেগ শেষ হলে সে আরো দুই পেগ নিয়ে খেতে খেতে ভাববে।

দুপেগ আর ফোনকল প্রায় একসঙ্গে এলো। সে দেখল মেজবার ফোন। মেজবার সঙ্গে তার জরুরি আলাপ বেশ কিছুটা এগিয়ে অল্প কিছু ঝুলে আছে। সুতরাং মেজবার ফোন জরুরি ফোন। সম্ভবত তাদের আলাপের ঝুলে থাকা বাকি আলাপ নিয়ে কথা বলবে মেজবা। সে মেজবাকে পস্ন্যানটা ফুলপ্রম্নফ করতে বলেছে। এমন হতে পারে, সেটা যে দাঁড়িয়ে গেছে, সেটাই জানাবে। দাঁড়িয়ে গেছে – এরকম শুনলে তার মতো আনন্দিত আর কেউ হবে না। অবশ্য তার পস্ন্যান দাঁড়িয়ে গেলে অন্য কারো আনন্দিত হওয়ার প্রশ্নও আসে না। সে চোখ বন্ধ করে – দাঁড়িয়ে গেছে দাঁড়িয়ে গেছে – এরকম ভাবতে আরম্ভ করল। সে শরীরে পরিবর্তন টের পেল ও বিরক্ত হলো – আহা, এইটারে দাঁড়াইতে কে বলছে! তবে এতকিছুর পরও তার মেজবার ফোন ধরতে ইচ্ছা করল না। মেজবার ফোন বাজতে লাগল। পাশের টেবিল থেকে একজন একপলক তাকাল, মেজবার ফোন বাজতে লাগল। থামল আর বাজল, থামল আর বাজল। সে এক পর্যায়ে যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে মেজবার ফোন ধরল – কী কইবা?

আপনেরে বিরক্ত লাগে।

হ, সকালে বাথরুম হয় নাই।

মন খারাপ?

আটকায়ে থাকলে মন তো খারাপ হইবই।

ভালো কইরা দিব?

পারলে দাও।

সন্ধ্যাবেলা তাইলে আসি?

তুমি সন্ধ্যায় আসলে বিরক্তি দূর হইব?

পস্ন্যান দাঁড়ায়া গেছে। শক্ত পস্ন্যান বড়ভাই। দাঁড়াইছেও শক্তভাবে। ভাব এমন হইছে, যেন একসঙ্গে তিনখান ভায়াগ্রা খাইছে।

তোমার কয়টা লাগে?

কী?

ভায়াগ্রা।

লাগে না, বড়ভাই। ঠেকায় পড়লে এক-আধটা। বাপ-মায়ের দোয়া, তাছাড়া বয়সও এমন বেশি হয় নাই।

মেজবা তার চেয়ে কমপক্ষে বছরদশেকের বড় হবে। সে যদি বলে তার বয়স এমন বেশি হয়নি, তবে তার কী বলা উচিত! শরাফত আলতো করে, কিছুটা বেখেয়ালেই তার পুরুষাঙ্গের ওপর হাত রাখল। এখনো সার্ভিস ভালো দিচ্ছে, এই একটু আগেই শরাফতের মনে পড়ল, শক্তপোক্ত হয়ে যাচ্ছিল, তবে এ-ও ঠিক, মাঝেমধ্যেই আগড়াই-বাগড়াই করে, সুতরাং আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

সে মেজবাকে বলল – শুনো, ঠিক রাত এগারোটায় আসবা।

বড়ভাই, বয়স হইছে, রাত এগারোটার পর ঘুমায়ে পড়ি।

ঠিক এগোরোটায়। নাইলে পার্টি বদলামু।

ওপাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া গেল – ঠিক আছে বড়ভাই, এগারোটায়।… তবে বড়ভাই, আপনি ওই কথাটা না কইলেও পারতেন।

পার্টি বদলানোর কথা।

জি।

পার্টি তো অনেক। কতজনে বেকার বইসা আছে।

এইটা ঠিক না, বড়ভাই।

ঠিক না?

না। কেউ বেকার বইসা নাই। ধরেন, আপনি যদি না ডাকেন, আমরাও বেকার বইসা থাকব না; কিন্তু আপনি হইলেন বড়ভাই।

একটা ভালো খবর দিলা – কেউ বেকার বইসা নাই। তা, এই কথা গভমেন্ট ফলাও কইরা প্রচার করে না কেন!

জি, কইতে পারত, দেশে এত কর্মসংস্থান হইছে…।

কিন্তু সব জায়গায় ঠিক লোক বসে নাই। মনে কইরা দেখো মেজবা, গতবার সব মিলায়ে পঞ্চাশ-ষাট গেল। লাভ হইছিল?

বড়ভাই, এইটা আপনেও জানেন সবগুলোয় লাভ হয় না।

তাই বইলা পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকারে তুমি গুনবা না!

কেন গুনব না! ট্যাকা না! এইসব মাথায় রাখছি। শক্ত পরিকল্পনা নিছি। ছিদ্র নাই। ছিদ্র পাইলে আপনে বন্ধ কইরা দিয়েন।

ঠিক আছে।… রাত এগারোটা।

 

আসিফ আকবর প্রকাশ্যেই বলে – শরাফত একসময় তাদের এলাকায় চটপটি বিক্রি করত। সে নিজেও, শৈশবে, কয়েকবার শরাফতের বানানো চটপটি খেয়েছে। ভালো চটপটি বানাত না, ফুচকাও। সুতরাং শরাফত ওই লাইনে থেকে গেলেই ভালো করত।

প্রথম যেদিন এ-কথাটা সে বলল, আড্ডায়, আড্ডাটা বড় ছিল, অনেকেই হাসিতে ফেটে পড়ল। কেউ কেউ অবশ্য হাসলেও, আসিফ জানত, আজই খবরটা শরাফতকে পৌঁছে দেবে। এ নিয়ে তার কোনো দুর্ভাবনা ছিল না। সে নিজেই চাচ্ছিল কথাটা শরাফতের কানে পৌঁছাক। শরাফত জানুক আসিফ তাকে কী চোখে দেখে। জানুক ও, যখনই আসিফের এ-কথা তার মনে পড়বে, তখনই সে মেজাজ হারাক। তাই সে শরাফতকে শুধু চটপটিঅলা বলেই থেমে থাকে না, তার পোশাক কেমন ছিল, সে কী ভাষায় কথা বলত, কতদিন দাঁত মাজত না – এসবেরও বিস্তারিত বর্ণনা দিলো।

তার প্রতি বর্ণনায়ই শ্রোতাদের হাসি বড় হলো, কেউ কেউ টেবিল থাবড়াল, তবে কেউ কেউ মৃদু আপত্তি কিংবা অনীহাও জানাল – আহা, বাদ দাও না আসিফ।

কী বলো! বাদ দেবো কেন! আমি কি মিথ্যা বলি নাকি?

তাই বলে শরাফত চটপটি বিক্রি করত, এটা নিশ্চয় ঠিক না।

ওই হলো আরকি। যাহাই চটপটি তাহাই পটপটি। চটপটি না হোক, ওইরকম কিছু একটা আরকি। হয়তো চিনাবাদাম।

আচ্ছা করত বিক্রি। চিনাবাদাম, কুঁচো চিংড়ি, পালংশাক – যাই হোক; তোমার ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কী দরকার!

ওর শয়তানিগুলো দেখবেন না?

না দেখলেই হয়। তুমি ওকে হিসাবেই এনো না।

আমি আনি না। কক্ষনো আমি আনি না ভাই, ও নিজেই চলে আসে।

মিটমাট করে নাও। দরকার হলে আমরাও থাকি সেখানে।

কী মনে করেন, ও আপনাদের কথা শুনবে? হঠাৎ কিছু কাঁচা পয়সা চলে এসেছে হাতে। এখন, কী যেন বলে, সরাকে ধরা জ্ঞান করে। হ্যাঁ।

ধরাকে সরা জ্ঞান?

ওহ্, হ্যাঁ, ধরাকে সরা জ্ঞান।

করুক। আসুক হাতে কাঁচা পয়সা। সবাই তোমাদের মতো তিন পুরুষের বড়লোক হলে, নতুন ব্যবসায়ী কারো তো আসার সুযোগ থাকছে না।

না না, তা কেন। এটা তো আর আমাদের সম্পত্তি না, কিন্তু ওর ভাবটাও আপনাদের দেখতে হবে।

দেখো না। তুমি তোমার মতো থাকো, ও ওর মতো। বাকিটা আমরা দেখব।

কেউ কারোটা দেখে না, এটা আসিফ আকবরের ভালো করে জানা আছে। সবাই যে যারটা দেখে, অর্থাৎ নিজেরটা। সুতরাং এই এখন যারা শরাফত চটপটি বিক্রি করত শুনে হাসছে, তারা প্রয়োজন পড়লেই শরাফতের সঙ্গে ঘেঁষটাবে, আর, যারা তাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে, তারাও যে-কোনো সময় চলে আসতে পারে তার দিকে, কিংবা তাকে টেনে নিতে পারে তাদের দিকে। আসিফ অবশ্য একা কাজ করতে চায়। সিন্ডিকেটের ব্যাপারটা সে দেখছে অবশ্য অনেকদিন ধরে। মিলে গেল তো কয়েকজন একজোট হয়ে ব্যবসাটা ধরে বসল, সেখানে আর কাউকে ঢুকতে দিলো না। এটা আসিফের পছন্দ নয়। তার মনে হয়, কাজ একা করাই ভালো। তার বাবাকেও সে তা-ই করতে দেখেছে, একা করেছে। কাজ বড় হলে বা ঝামেলা থাকলে দু-একজন বা তিনজনকে নিয়েছে। কিন্তু সেটা সিন্ডিকেট করা ছিল না। অথচ এখন দল না-পাকালে যেন চলেই না। আর, দল পাকানোর ব্যাপার যখন থাকে, এই নতুন পয়সাঅলাদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন হয়ে যায়। এ-ব্যাপারটা আসিফের কাছে অসহ্য। পয়সা কামানো কঠিন, পয়সা কামানোর জন্য জানাশোনা লাগে, বুদ্ধি লাগে, পরিশ্রম লাগে – এসব সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে। বাবাকে সে এভাবেই দেখেছে, বাবার মুখে শুনেছে দাদার কথা – ওই একই তরিকা – পরিশ্রম করো, লেগে থাকো, মানুষকে ঠকানো বা তাদের মাথায় হাত বোলানোর ব্যাপারটা সবসময় মাথায় রেখো না। সে নিজেও শুরু করেছিল ওভাবেই। হ্যাঁ, পয়সা সহজে আসবে না, পয়সার জন্য শ্রম, সময় ও বুদ্ধি দিতে হবে। এভাবে চালিয়ে এসে একসময় সে দেখল, সে এভাবে চালাতে আর পারছে না। সে শ্রম দিচ্ছে, লাভ করছে – ঠিক আছে; অথচ ব্যবসায়ে নতুন-আসা কেউ যাওয়া-আসা করছে এদিক-ওদিক, তারা লাভ করছে তার তিন কি চারগুণ। এদের অদ্ভুত ক্ষমতা, যেখানে ব্যবসা নেই, যেখানে ব্যবসা থাকার কোনো যুক্তি নেই, সেখানেও তারা বিরাট ব্যবসা খুঁজে বের করছে, টাকা কমিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আরে, ব্যবসা কি ফটকাগিরি নাকি, ব্যবসা কি নয়ছয় – সে প্রথম প্রথম বলত। তারপর, ওসব বলা সে ছেড়ে না দিলেও – টিকে তো থাকতে হবে – এই ভাবনা থেকে ক্রমশ নতুন ব্যবসায়ীদের পথে হাঁটতে শুরু করে। ব্যাপারটা তার জন্য খুব একটা কঠিন নয়। তারা তিন পুরুষের ব্যবসায়ী পরিবার। সে নিজে অনেকদিন হলো এই ব্যবসার লাইনেই, তার কানেকশনও ভালো। এছাড়া তার বাবাকে এখনো অনেকেই চেনে, এমনকি কেউ কেউ তার দাদাকেও। সুতরাং তাদের এতদিনকার ব্যবসার ধরন থেকে তাকে কিছুটা সরে এসে নতুন জায়গা তৈরি করে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। তাদের স্থায়ী ব্যবসাগুলো থেকে যায়। পয়সা যদি আসবেই, দুদিক থেকেই আসুক। সে অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই টের পায়, এই নতুনদের সঙ্গে সে তেমন পারছে না। নতুনরা অনেক বেপরোয়া, প্রায় দাঙ্গাবাজ, আর, ব্যবসা-বানানোর কাজে তার চেয়ে অনেক বেশি পারঙ্গম। সে হতাশাবোধ করে যদিও, ঠিক করে – নেমেছে যখন, এই পথ থেকে সরে আসবে না। সে দেখবে-বুঝবে, বুঝবে-দেখবে। বোঝার ক্ষেত্রে তাকে অনেক সহায়তা করে দুজন। একজন তার বাবার বন্ধুর ছেলে। বাবার বন্ধুর ছেলে যখন, বয়সে বেশ কিছুটা ছোট হলেও, সখ্য হতে পারত তাদের। তা, যে-কারণেই হোক, দেখা হলে শুধু কুশলবিনিময় হবে – সম্পর্ক এভাবেই সীমিত হয়ে ছিল তাদের মধ্যে। সেটা থাকল না একসময়। উদ্যোগী, এক অর্থে বাবার বন্ধুর ছেলেই। এক পার্টিতে দেখা হলে সে ছেলে টুকটাক কথার ফাঁকে আচমকাই জিজ্ঞেস করল – ভাই, শুনি বেকায়দায় আছেন। কথা কি ঠিক? আসিফের ইচ্ছা করল, সে খুব কড়া একটা জবাব দেবে। সে কড়া জবাব দিলো না, সামান্য মাথা ঝাঁকাল। তাদের তখন কিছু কথা হলো, তারপর কথামতো সে একদিন ওই ছেলের অফিসে গেল। বেশ বড় অফিস, টিপটপ সাজানো-গোছানো। কিন্তু সে হিসাবে স্টাফ নেই। সে-ছেলে বলল – অফিস আসলে লাগে না, আসিফভাই। কিংবা নামকাওয়াসেত্ম একটা হলেই হয়। ব্যবসা হয় ফোনে, আড্ডায়, পার্টিতে, নেতা বা আমলাদের পছন্দের জায়গায়। তবে আমার সাজিয়ে রাখা অফিস পছন্দ। তাই এটার ব্যবস্থা।

সেখানে একটা সবক হলো আসিফের। তার বাবার বন্ধুর ছেলে অবশ্য এ-ও বলল – কেউ কাউকে ব্যবসা ধরিয়ে দেবে না, ভাই। শূন্য থেকে ব্যবসা বানাতে হবে নিজেকেই। যে পারে সে মরুভূমিতে বালু বিক্রি করতেও পারে। যা যা শুনল আসিফ, তার অনেক কিছুই তার জানা ছিল, সে শুধু অ্যাপস্নাই করতে পারে না এই যা। আরো কিছু সে শুনল, সেসব সম্পর্কে তার ধারণাই ছিল না। ওয়ান কোম্পানি ওয়ান ডিল একটা বা দুটো নিয়মিত কোম্পানি থাকতে পারে, বাকিগুলো জন্মাবে, মন্ত্রী, মন্ত্রীর ভাই বা ছেলে, নেতা, আমলা, প্রাক্তন আমলা, যাকে যাকে প্রয়োজন আর কি, কিছু কিছু শেয়ার দিয়ে ডিরেক্টর বানানো হবে, তারপর ব্যবসা হবে, তারপর কোম্পানি মারা যাবে।

আমি কি একজনকে পাঠাব আপনার কাছে? সে ছেলে জানতে চাইল।

আমার কাছে!… কেন?

এই যে বলছেন, জানেন হয়তো অনেক কিছু, কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী অ্যাপস্নাই করতে পারেন না, অর্থাৎ যখন যা দরকার, তা আপনার করা হয় না।

হুম।… কিন্তু কাকে পাঠাবে?

পাঠাব।

আসিফের বাবার বন্ধুর পাঠানো ছেলেটি, নাম রাহাত, ফোন করে দিনদশেক পরে এলো। বলল – ব্যস্ত ছিলাম, সেজন্য আগে আসতে পারিনি। সেজন্য কিছু মনে করবেন না। জিয়া সাহেবের কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

আসিফ বলল – না, আমি কিছু মনে করিনি। আপনি আপনার সুবিধামতোই আসবেন। কিন্তু এই জিয়া সাহেব কে?

রাহাতকে বিব্রত দেখাল – প্রথমেই একটা ভুল করে ফেললাম। আপনার আমার ওপর ভরসা জন্মাবে না।

কেন?… কী ভুল?

আমি ভেবেছি জিয়া সাহেবকে আপনি চেনেন। এই ভেবে নেওয়াটা ভুল। তা ছাড়া, তিনি আপনার পরিচিত হলেও আমি তার কাজ করছিলাম কিনা, এটা জানানোর দরকার নেই।

আসিফ সম্মতি জানাল – হ্যাঁ, দরকার নেই।… কিন্তু জিয়া সাহেবকে চিনছি না কেন!

জিয়া সাহেব শান্তনু সাহেবের পুরনো বন্ধু…।

বুঝলাম। কিন্তু এই শান্তনু সাহেবটাই-বা কে?

রাহাত সামান্য চমকাল কি চমকাল না, চমকালেও সেটা সামলে নিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকল আসিফের দিকে।

তার তাকানোর মধ্যে কিছু একটা আছে, আসিফ অস্বসিত্মবোধ করতে আরম্ভ করল, সামান্য মাথা ঝাঁকাল, সে-কী?

শান্তনু সাহেবকে চেনেন না!… আমি ঠিক জায়গায় এসেছি কিনা বোঝার চেষ্টা করছি।

আসিফ হেসে ফেলল – আপনি বাবুর কথা বলছেন!… আমি ওকে বাবু নামে চিনি। হঠাৎ শান্তনু শুনে অচেনা মনে হয়েছে।

শান্তনু বা বাবু সাহেব আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

কেন দেখা করতে বলেছে, সেটা কী বলেছে?

জি না, নির্দিষ্ট করে কিছু না। শুধু এটুকু – সুবিধা করতে পারছেন না।

বেশ বুঝলাম আমি সুবিধা করতে পারছি না, আপনি থাকলে কি আমি সুবিধা করতে পারব?

তার নিশ্চয়তা নেই।

তাহলে?

রাহাত চুপ করে থাকল।

ধরে নিলাম, আপনি বুদ্ধি দেন। আপনার বুদ্ধিতে কাজ হয়?

সবসময় হয় না।

মাঝে মাঝে হয়?

মাঝে মাঝে। তবে যে-কাজ আদতে পারা যাবে না, সে-কাজে না এগোনোর পরামর্শও আমি দিই। তাতে সময় ও পয়সা বেঁচে যায়।

হু-ম-ম। ধরেন…। ধরেন – বলে চুপ করে থাকল আসিফ।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রাহাত, তারপর বলল – জি?

ধরেন, কথার কথা, আমি একটা জমি দখল করতে চাই। এই শহরেই। এক অর্থে পড়ে থাকা জমি, হয়তো সিটি করপোরেশনের কোনো স্ট্রাকচার আছে সেখানে, তবে তেমন কিছু না, আমাকে বলুন দেখি এ-জমিটা আমি কীভাবে দখল করব।

 

আবেদের ছোটখাটো সাপস্নাইয়ের ব্যবসা আছে। ব্যবসাটা বেশ কিছুদিনের। তার ব্যবসার কথা কেউ জানে না। বাবরের মনে হয়, অন্য কোনো ব্যবসা হলে সে নিজেই জানিয়ে দিত। কিন্তু সাপস্নাইয়ের ব্যবসা একজন লেখকের সঙ্গে ঠিক যায় না বলেই তার মনে হয়, তাই সে বলে না।

শুরুটা ছিল এরকম – অনার্স শেষ হওয়ার পর তার আর্থিক অবস্থা তখন খুব করুণ। বাড়ি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, টাকা আর পাঠানো সম্ভব না। এটা আবেদের জানাই ছিল। সে দুটো টিউশনি করত, কিন্তু তার খরচ মিটত না, তাছাড়া সে বড় ঝামেলা ও অস্বসিত্মর কাজও। কিন্তু অনার্স পর্যন্ত সে টিউশনি ছাড়ার কথা ভাবেনি। তার বাড়ির অবস্থা খুব নড়বড়ে হলেও, বাবা কীভাবে কীভাবে ম্যানেজ করে কিছু টাকা পাঠাত, সে চালিয়ে নিত। কিন্তু অনার্স পরীক্ষার পর যখন বাড়ি থেকে টাকা আসবে না, টিউশনির টাকায় চলবে না, তার চাকরি খোঁজা শুরু। এমন নয় যে, সে বুঝতে পারেনি, কাজটা বুদ্ধিমানের হচ্ছে না। অনার্স পর্যন্ত সে পড়েছে বটে, পরীক্ষাও ভালো দিয়েছে, কথা হলো – রেজাল্ট বের না হওয়া পর্যন্ত সে এইচএসসি পাশ। কেন এইচএসসি পাশ একজনকে চাকরি দেবে! দিলেও দরজা খোলা ও বন্ধের চাকরি কেউ দিতে পারে, সেখানে যদিও বিশাল লাইন। তবে এভাবে চাকরি খুঁজতে খুঁজতেই তার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। বাবর নিজেকে বলল – মিরাকল স্টিল হ্যাপেনস। ঘটনাটা ঘটল সহজে, সাদামাটাভাবে। এক অফিসে গেছে সে, বন্ধুর ভাই সেখানে চাকরি করে। ঠিক চাকরির জন্যও যায়নি সে। গেছে চাকরি বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা নিতে। কারণ ততদিনে তার এটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে – এভাবে অফিসে ঘুরে ঘুরে চাকরি হয় না। হয়তো চলিস্নশ-পঞ্চাশ বছর আগে হতো। কিন্তু এখন নিজেদের অফিসে নিজেদের লোকের ছাড়া আর কারো চাকরি ওভাবে হয় না। চাকরির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, যোগ্যতা থাকলে অ্যাপিস্নকেশন জমা দিতে হয়। তারা তখন ডাকতেও পারে, পরীক্ষাও নিতে পারে, লিখিত ও মৌখিক।

বন্ধুর সম্পর্কের ভাই, বাবরের প্রথমেই তাকে পছন্দ হলো না, একরুমে অনেকজনের সঙ্গে বসা তার কোনো ক্ষমতা, চাকরি বা বুদ্ধি দেওয়ার, আছে বলেও মনে হলো না, তবু সে তার প্রয়োজন ও চাকরি খোঁজার অভিজ্ঞতার কথা বলল।

তুমি কি রাসেলের সিনিয়র? লোকটা জিজ্ঞেস করল।

জি না, রাসেল আর আমি একসঙ্গেই পড়ি।

অর্থাৎ অনার্স দিয়েছ, রেজাল্ট হয়নি?

জি।

তাহলে কেন এসেছ! রাসেল যখন বলল আমি ভাবলাম ওর সিনিয়র কোনো বন্ধু হবে। এখন দেখছি…।

আসলে একটু বুদ্ধি-পরামর্শ…।

এখানে বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়ার কিছু আছে বলে তোমার মনে হয়?

বাবর চুপ করে থাকল।

অনার্স ভালো রেজাল্টসহ পাশ করা হলেও এক কথা ছিল।

জি…।

যাও এখন, মাস্টার্স শেষ করে তারপর আসবে।

বাবর বসে থাকল।

তাকে কিছুটা সময় দিলো লোকটা, সময় ফুরোলে বলল – এভাবে বসে থাকলে সব বদলে যাবে? তোমাকে একটাই পরামর্শ দেওয়ার আছে, মাস্টার্স শেষ করে আসবে – সেটা বলেছি তোমাকে। বলিনি?

বাবর মনে মনে তার জানা সবচেয়ে কুৎসিত গালিগুলোর একটা দিলো, তারপর উঠল।

পাশের টেবিলের লোকটার দিকে সে বারদুয়েক তাকিয়েছিল। পাশের টেবিল দূরে নয়, অপরিচিত কারো সামনে দুঃখ, তদবির, পরামর্শ, যা-ই বলা হোক বলতে বাবরের লজ্জা লজ্জা লাগছিল। সে তাই বারদুয়েক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিল, লোকটা তাদের কথা শুনছে কি শুনছে না। বাবরের মনে হয়নি শুনছে। মধ্যবয়সী গাল তোবড়ানো লোক। সারা টেবিলে কাগজপত্র ছড়িয়ে একবার এ-কাগজ  আরেকবার ও-কাগজের দিকে তাকানো নিয়ে ব্যস্ত, মনে হচ্ছিল না তার অন্যকিছু খেয়াল করার সময় আছে। তা, বাবর যখন উঠল, কয়েক পা এগোল দরজার দিকে, লোকটা পেছন থেকে তাকে ডাকল – এই যে…।

বাবর ফিরল, লোকটাকে দেখল, লোকটা এবার হাত উঠিয়ে তাকে কাছে আসার ইঙ্গিত করল, ইঙ্গিতের মধ্যে তাচ্ছিল্য আছে, বাবরের কয়েক সেকেন্ড গেল – যাবে কি যাবে না – এই সিদ্ধান্ত নিতে। তবে লোকটা যখন বলল – ডাকতেছি। শুনতে অসুবিধা আছে? – তখন সে কোনো অসুবিধাবোধ করল না। সে এগিয়ে গেলে লোকটা তাকে বসার ইঙ্গিত করল। বসতে বসতে বাবর, সে যার কাছে এসেছিল, বন্ধুর সম্পর্কের ভাই, তার দিকে তাকিয়ে নিল। সে-লোক সরু চোখে তার সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে কিছু বিরক্তি, কিছু বিস্ময়।

নাম কী?… থাউক। নামে কী কাম।

জি, আমার নাম বাবর।

নামের আগে সম্রাট আছে?

মুহূর্তের মধ্যে লোকটাকে পছন্দ হয়ে গেল বাবরের। সে হাসিমুখে দুপাশে মাথা নাড়াল – জি না, নাই।

হাইসেন না। হাসনের কিছু হয় নাই। আইছেন তো দুঃখের প্যাচাল পাড়তে।

জি। বাবর মাথা দোলাল।

দুঃখের প্যাচাল কেউ শুনে না, এই ধারণা নাই? বয়স হইছে তো।

বাবর চুপ করে থাকল।

মুখে তালা দিলেন ক্যা?… শুনেন, কিছু কথা কই। আপনে তালা পুরা খুইলা উত্তর দিবেন। তালার ফাঁকেফোকে কিছু আটকায়া রাখবেন না।

বাবর তাকিয়ে থাকল লোকটার দিকে।

আইছেন চাকরি খুঁজতে, সেইটা আপনার পাওনের উপায় নাই। আমি একখান কাজ দিতে পারি, সেইটা করনের যোগ্যতা আছে কিনা, একটু ভাবেন।

বাবর উদগ্রীব হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

সাপস্নাইয়ের কিছু কাজ দিতে পারি। শর্ত আছে, সেইটা পরে বলি। কাজ সহজ, আমি মালের অর্ডার দিব, কোথায় পাইবেন তাও বলব, রেট কত – সেইটাও বইলা দিব। আপনি মাল কিনবেন, সাপস্নাই দিবেন। পারবেন? কিছু কাগজপত্র অবশ্য জমা দিতে হইব। বানায়ে নিবেন। দুই নাম্বার কাগজ বানাইতে বেশি খরচ না।

বন্ধুর সম্পর্কের ভাই এ-সময় চেঁচিয়ে ওঠার মতো জিজ্ঞেস করল – এস্কান্দার সাহেব, আপনি এসব কী শুরু করেছেন!

আপনার সমস্যা?

ওই ছেলে এসেছে আমার কাছে। বুদ্ধি-পরামর্শ চেয়েছে। আমি বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছি।

আমিও বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেছি। একই ব্যাপার।

আপনি ওকে দুই নাম্বারি শেখাচ্ছেন?

আপনি ওকে এক নাম্বারি বা তিন নাম্বারি, কোনোটাই শেখাইতে পারলেন না।

তাই বলে দুই নাম্বারি শেখাবেন?

আমি তারে যে-নাম্বারি শেখাই, আপনার কী!… এই যে, এস্কান্দার আবেদের দিকে ফিরল – আপনি দুই-তিন-চার নাম্বারি শিখবেন?

জি, শিখব।

দেখছেন? এস্কান্দার ফিরল আবেদের বন্ধুর ভাইয়ের দিকে।

আমি কিন্তু নালিশ করব অথরিটির কাছে।

নালিশাবেন?

অবশ্যই।

করেন।… সকালে যে-বুয়া অফিস ঝাড় দেয়, আপনি যে তার সঙ্গে ইটিশ-পিটিশ করেছিলেন, এইটা কিন্তু সবাই জানে।

কী! আপনি…।

এইটা সবাই জানে। শুধু অথরিটি জানে না।

আপনি এইসব কী বলেন!

পিয়ন লোকমানের ফোনে ভিডিও আছে। সেও ঝাড়ুদার-বুয়ার পিছে ছিল। কিন্তু পয়সা খরচে রাজি ছিল না। আর আপনে ওই বুয়ারে খেইলা দিলেন পাঁচশো টাকা দিয়া!

আপনি এতসব নোংরা কথা বলেন!

ট্যাকা-পয়সা থাকলে কত লাভ, এইটা বলতেছি আরকি।… এইদিকে তাহলে আর কান দিয়েন না।… আবেদ – কী, সাপস্নাইয়ের ব্যবসা করবেন?

অবশ্যই করব।

শাবাশ।… অল্প কিছু পুঁজি লাগবে।

জোগাড় করে নেব।

এখন শর্তের কথা বলি। মন দিয়ে শুনবেন।

জি।

সহজ শর্ত। লাভ, আবার ভাইবেন না লাভ কত হইল, এইটা আমি বুঝব না; তা, লাভ ফিফটি ফিফটি। রাজি?

জি, রাজি।

ভাবলেন না তো। ভাইবা বলেন।

আমি ভেবেছি।

আপনার অবশ্য ভাবনের স্কোপ নাই। পিঠ দেয়ালে গিয়া ঠেকছে।

আবেদ সামান্য হাসল।

একটা কথা মনে রাইখেন। প্রথম প্রথম মনে হইব, এই ব্যবসা ভালো না। মনে হইব, দৌড়াদৌড়ি বেশি, লাভ কম। কিন্তু
একটু-একটু করে দেখবেন, যদি লাইগা থাকেন আরকি, দেখবেন সাপস্নাইয়ের ব্যবসা খারাপ না।

আবেদ সাপস্নাইয়ের ব্যবসা শুরু করল ও একসময় দেখল এই ব্যবসা খারাপ না। সে ধর্ম বিশ্বাস করে না, তবে তার মাঝে মাঝে মনে হয়, নিয়তি বলে কিছু একটা থাকলেও থাকতে পারে।

এখন তার ব্যবসা আগের তুলনায় বড়। বড় তার কাছে, সে জানে অনেকের কাছে এটা কোনো বিষয় নয়। একটু চেষ্টা চালালে, এ-ও সে জানে, ব্যবসা আরো বড় করা যায়। অনেকেই করছে, সে দেখেছে। একবার বুঝে গেলে কঠিন নয়। ব্যবসা বড় করা হচ্ছে একের সঙ্গে আরেকের জড়িয়ে থাকার ব্যাপারগুলো বুঝে নেওয়া। সে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যেতে পারে, সে একধরনের সাপস্নাই চালু রেখে আরো কিছু আইটেমের সংখ্যা বাড়াতে পারে। সে আপাতত সেরকম কিছু ভাবছে না। ব্যবসা বাড়ালে ছোটাছুটি বাড়বে, সে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়বে, সে অন্য কিছুর জন্য সময় বের করতে পারবে না। অন্য কিছু মানে সাহিত্য। সাহিত্য ও সাহিত্য। সে ব্যবসায়ী হতে চায় না। লেখক হতে চায় না। সে জানে, অনেকেই বলাবলি করে – তার কানে এসে পৌঁছায় – তার গল্প বানানোর দুর্দান্ত ক্ষমতা। অনেকেই বলে, এভাবেই লিখে যেতে পারলে বছরকয়েকের মধ্যেই দেশের সেরা লেখকদের একজন সে হতে পারবে। তা, সে কি নির্বোধ, যে লেখালেখিতে সময় কমিয়ে ব্যবসায় সময় বাড়াবে! তবে ব্যবসাটা সে ছেড়ে বা কমিয়ে ফুলটাইম লেখকও হয়ে যেতে চায় না। ভবিষ্যতে যদি সেরকম কিছু সে হতে পারে, হবে; আপাতত সম্ভব নয়, তার
হাড়ে-মাংসে জানা আছে। সে জানে, বেঁচে থাকা তো বটেই, গুছিয়ে সাহিত্য করার জন্যও টাকা দরকার। টাকা দরকার মানে গুছিয়ে জীবনযাপনের সামর্থ্য দরকার। সবাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন থেকে সাহিত্য করতে পারে না। সে জানে সেও পারবে না।

আজ তার সাপস্নাইয়ের কাজে এক অফিসে যাওয়ার কথা। সময় অফিস থেকে বেরিয়ে তার এরকম মনে হচ্ছিল – আরে, একটা জমজমাট উপন্যাসই তো লিখতে হবে, নাকি। এটা ছিল, বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি – মানসিক চাপ ঝেড়ে ফেলার একটা চেষ্টা। খুব একটা লাভ তাতে হয়নি। নানা গল্প এসে মাথার ভেতর লাটিমের মতো ঘুরছে। এ-অবস্থায় ব্যবসার কাজে যাওয়া উচিত?

যাওয়া উচিত, ফয়সাল আবেদ? সে নিজেকে জিজ্ঞেস করল।

তুমি নিজে কী মনে করো, শুনি।

আমার উত্তর দুরকম।

দু-রকমই বলো।

যাওয়া উচিত না।

আমিও সেরকম ভাবছি।

এখন দ্বিতীয়টা শোনো।

শুনছি।

যাওয়া উচিত।

আমারও এমনই ধারণা। সমস্যা।

সমস্যার কিছু নেই। এমন নয়, তুমি এখনই বাড়ি ফিরে লিখতে বসবে।

না না, তা নয়। এ সময় আমি লিখিও না।

এমন নয় তুমি এ-খবর এখন জনে জনে বলে বেড়াবে।

না না, কাকেই-বা বলব! ইকবালভাইয়ের নিষেধও আছে। বরং এই ভালো, সবাই নিজেরা দেখুক। দেখে…।

জ্বলুক।

হুম।

তাহলে ব্যবসার কাজে যাও, বাবর আজম।… রোজ থাকলে অবশ্য বলা যেত, তাই না?

রোজ?

রোজের কথা ভাবতে চায়নি আজম। তবে কিছু কিছু বিষয় থাকে, ঠিক ভাবনার মধ্যে পড়ে না, ওরা থাকে, থেকে যায়, মাঝে মাঝে পুকুরে ছোট মাছের মতো তিরতির করে চলে যায়। ধাক্কাটা অবশ্য বড়। আবেদ ফুটপাথের এক কোণে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। রোজের কথা কেন মনে হলো তার? কেন, যে মেয়েবন্ধুদের বলে বেড়িয়েছিল একসময় – কী ভেবেছে আবেদ, ভালো লেখেই বলে ওর প্রেমে পড়তে হবে। ও আমার প্রেমে পড়েছে, এটা ওর ব্যাপার। ওর এতসব পাগলামোর পরও বলব, ও ভালো লেখে, ওর লেখা আমার পছন্দ, কিন্তু ওর প্রেমে আমি পড়িনি। পড়বও না কোনোদিন ও নিশ্চিত থাকতে পারে – তার কথা কেন মনে হয় তার। এসব সময়ে আবেদ বিপর্যস্তবোধ করে। আজো করল। সে রোজের কথা ভাবতে চায় না, কিন্তু রোজ রঙিন ছোট মাছ, জলের ভেতর তিরতির করে।

হ্যাঁ, রোজ। রোজের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা হয়ে গেলে তুমি এতক্ষণে তার দিকেই ছুটতে। ছুটতে না?

কিন্তু সম্পর্ক আর হলো কোথায়!

সে অন্য কথা। ছুটতে – এ তো ঠিক।

আচ্ছা, বাদ দাও দেখি এসব।

বেশ। তুমি তাহলে কাজে যাও।

তার হাতে এখন যে-পরিমাণ টাকা আছে, লোন দিতে মুখিয়ে থাকা ব্যাংক থেকে কিছু নিয়ে ছোটমোটো একটা গাড়ি সে কিনতে পারে। কখনো সে গাড়ি কেনার কথা ভাবে, খুব ইচ্ছা হয় তার, ড্রাইভার চালাবে, সে গম্ভীর মুখে পেছনে বসে থাকবে, কিংবা নিজেই শিখে নেবে চালানো, এ আর তেমন কী ব্যাপার, নিজেই চালাবে, যতটা সম্ভব – হেলাফেলায়। এরকম ইচ্ছা মাঝেমাঝে প্রবল হয়ে উঠলেও সে নিজেকে সামাল দিয়েছে। সে বন্ধুদের চোখে বেকার মানুষ, লিখে কায়ক্লেশে বা তার চেয়ে কিছু ওপরে থাকা একজন মানুষ, সে হঠাৎ গাড়ি কিনলে বন্ধুরা হিংসা করবে, খেপবে, অভিমান করবে, কৌতূহলী হবে উঠবে, আর, এই কৌতূহল সবার কাছে তার সাপস্নাইয়ের ব্যবসার কথা ফাঁস করে দিতে পারে। সে ট্যাক্স-ফ্যাক্স দেয় না তেমন, ট্যাক্সের ঝামেলায় পড়তে পারে। এখন সব সাহিত্য-সম্পাদকই তাকে রেয়াত দেয়, কখনো কিছু চায়-টায় না, তখন মদের বোতল, টাকা-পয়সা,  অফেরতযোগ্য ধার, আরো অনেক কিছু চাইতে পারে। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হবে, সে যেসব অফিসে সাপস্নাই দেয়, সেসব অফিসে। ‘লাভ তাহলে ভালোই করতেছেন, আমাদের পার্সেন্টেজ বাড়ায়া দেন’ বলে তাকে বিপদে ফেলতে পারে। সুতরাং থাক, গাড়ি এখন থাক, আরো কয়েক বছর হোক। আপাতত সিএনজি-ট্যাক্সি আর রিকশাই ভরসা হিসেবে থাকুক।

ট্যাক্সি নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই মাথায় সময়ের উপন্যাস ঘুরতে শুরু করল। তার মনে হলো, যেতে যেতে সে কিছুটা সময় উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ভাবতে পারে। আচ্ছা, সে যদি প্রেমের উপন্যাস লেখে, কেমন হয়? প্রেমের গল্প-উপন্যাস শুনলেই এদেশের অনেকেই নাক সিঁটকায়। আজব এক দেশ! এমন একটা ভান, যেন প্রেম বলে কোনো ব্যাপার দিন-দুনিয়াতে নেই। কিংবা থাকলে থাকুক, লেখা যাবে না। লিখতে হবে গ্রাম নিয়ে, লিখতে হবে নির্যাতিত-বঞ্চিত মানুষ নিয়ে। তা, এসব কথা যারা বলে তাদের গ্রাম নিয়ে লেখা দুচারটে গল্প-উপন্যাস পড়েছে বাবর। সেই কবেকার গ্রাম! এখনকার গ্রাম কত বদলে গেছে, ধারণাই নেই তাদের। গ্রামের লোকদেরও তারা দেখায় সরল-সুবোধ হিসেবে। কোনো বদের হাড্ডি সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। থাকগে এসব, আবেদ জানে ওসব একসময় বাতিল হয়ে যাবে, যদি কেউ এখনকার গ্রাম নিয়ে লিখতে গিয়ে সুজলা-সুফলা, নিরীহ-সরল মানুষের জায়গা বলে ছেড়ে দেয়। তবে কথা ওটাই – থাকগে, যার লেখার সে লিখুক। লেখা হলো কি না, সেটাই দেখা হোক।

হ্যাঁ, প্রেমের উপন্যাস লেখা যেতে পারে। এখন কেউ আর হাত ধরে হাঁটাহাঁটির আর নরম নরম সংলাপের প্রেমের উপন্যাস লেখে না। যারা অমন লেখে, কেউ লেখে না – এরকম সে যতই বলুক, লেখে কেউ কেউ, নামকরারাও, তাদের নিয়ে হাসাহাসিই হয়। সে যদি লেখে প্রেমের উপন্যাস, সেখানে শ্রেণিই প্রাধান্য পাবে। সে যে দু-চারটে প্রেমের গল্প বা উপন্যাস লিখেছে – সেখানে শ্রেণিদ্বন্দ্বই প্রধান। শ্রেণি-অবস্থান নায়ক বা নায়িকার বা মূল চরিত্রের ভেতরে কীভাবে সুপ্ত থাকে ও একসময় তা কীভাবে টের পাওয়া যায় – তার লেখা এরকম। তা, এরকম একটা প্রেমের উপন্যাস সে লিখতেই পারে। আরো গভীর পর্যবেক্ষণ, আরো গভীর মনোযোগের সঙ্গে। লিখব? – সে গভীরভাবে ভাবতে নিল।

না, লিখো না। সে নিজেই বলল।

কী?

শুনেছ। লিখো না।

কেন! প্রেমের উপন্যাস লেখার পক্ষে আমার যুক্তি আছে।

থাকুক। এখন লিখতে বারণ করছি।

কেন!

রোজ চলে আসবে।

আবার রোজ!

হ্যাঁ, আবার রোজ।

আচ্ছা, রোজ যদি আসে, সমস্যা কী!

সামাল দিতে পারবে না। লেখা প্যাচপেচে হয়ে যাবে না।

খাবে না?

লোকে খামোকা জাউভাত খায়?

ওহ্।… ঠিক। ভুল বলোনি।

অন্যকিছু ভাবো।

এই যে আমরা সাপস্নাইয়ের ব্যবসা করি, এটা নিয়ে লেখা যেতে পারে?

কেন নয়!

খুব ইন্টারেস্টিং একটা জগৎ কিন্তু।

জানি। ভাবো।

আবেদ ভাবতে আরম্ভ করল।

 

মেজবা ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক রাত এগারোটায় এলো। তার সঙ্গে দুজন। তাদের কোমরে জিনিস আছে, শরাফত জানে। সঙ্গে লোক এনেছে বলে সে মেজবার ওপর বিরক্তবোধ করল – বডিগার্ড নিয়া আসছ?

বড়ভাই, দিনকাল খারাপ।

বুঝলাম খারাপ। তাই বইলা আমার এইখানে আসতেও বডিগার্ড।

এইখানে আসা আর বাড়ি ফিরনের কথা ভাইবেন, ভাইজান। রাস্তায় গাড়ি আইসা গাড়ির সামনে দাঁড়াইলে আমার কিছু করনের আছে?

এত শত্রম্ন বানাইছ ক্যামনে?

বাজারে কম্পিটিশন ভাইজান, খুবই কম্পিটিশন। আর কম্পিটিশন যত বাড়ব, শত্রম্নও দেখবেন তত বাড়ব। এই এখন ধরেন, আসিফ সাহেব আমার পেছনে লোক লাগাইছেন। টের পাই।

দুই আনার আসিফ তোমারে মারবে?

দরকার পড়লে তার লোক ট্রাই নিবে। তিনি তো জানেন আমি আপনার হইয়া কাজ করি।

তা, রাহাত না কার কথা বললা, সেও আসিফের হইয়া কাজ করে।

ধরেন, রাহাতের লগে আমার সম্পর্ক ভালো। দেখা হইলে আড্ডাও মারি। সে আমারে নিব না, আমিও তারে না। আমরা জানি আমরা আমাদের কাজ করতেছি।

তাইলে?

ধরেন, আসিফ সাহেবের মাথা গরম হইল। তিনি রাহাতরেও না জানাইয়া আমারে আর আপনারে হাপিস করণের কথা ভাবলেন। অচেনা লোক ভাড়া করলেন। সমস্যা এইখানে, সমস্যা রাহাতরে নিয়া না।

শুনো, আমিও চান্স পাইলে আসিফরে হাপিস কইরা দিব।

এই তো, এইটাই হইল ভুল।

আরে, সে ক্যামনে আমার পুটকির পিছে লাইগা আছে, এইটা জানো না?

লাইগা আপনেও আছেন। কিন্তু আপনারা জীবন-মরণ সমস্যা কইরা ফেলেন। ভুইলা যান এইটা হইল গেইম। এক গেইমে আবদুল জিতবে তো আরেক গেইমে জিতবে আবদুল দুই। আবার আরেক গেইমে আবদুল তিন।

ফিলোসফি মারাইও না।

ফিলোসফি কই পাইলেন! সহজ হিসাব। নিজেদের মইধ্যে খুন-জখমের দরকার নাই।… তয়, এইবার একটা লাশ দরকার।

মানে, তুমি কার কথা কও? আসিফ?… শুনো, তোমার লোকরে অন্যরুমে গিয়া বসতে বলো। অস্বসিত্ম লাগতেছে।

কিন্তু লাশ তো এরাই ফেলব।… অ্যাই যাও, তোমরা পাশের রুমে গিয়া বসো।

ছেলেদুটো উঠে গেলে মেজবা ফিরল শরাফতের দিকে – লাশ একটা দরকার।

তুমিই না বললা নিজেদের মইধ্যে খুন-জখমের কী দরকার!

আরে বড়ভাই, নিজেদের মইধ্যে লাশ পড়ব ক্যান? কিন্তু লাশ পড়ব।

পাবলিকের?

জি, পাবলিকের। পাবলিক ছাড়া আর কারে আপনি ফেলবেন!

তা-ও ঠিক। পাবলিকের প্রয়োজন এ-কারণেই। তাই না?

কেন বড়ভাই, এই রকম আপনি মনে করেন না?

শরাফত উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকল মেজবার দিকে। হাসল, একসময় বলল – পাবলিকরে যদি ঠিকমতো ব্যবহার না করি, তবে সেইটা অন্যায়।… নাও, এখন কী ঠিক করছ, সেইটা ভাইঙা বলো।

মেজবার পস্ন্যান গোছানো, ধাপে ধাপে ভাগ করা। সব কাজ শেষ করে ফল আনতে কিছু সময় লাগবে।

শরাফত জিজ্ঞেস করল – বেশি লম্বা কইরা ফেলাইছ না?

তা, লাম্বা একটু হইছে। মেজবা বলল। কিন্তু ছাঁটতে গিয়ে দেখলাম আগাছা নাই।

কিন্তু মেজবা। শরাফত সামান্য চিন্তিত। আসিফ বইসা থাকব না।

তিনি কি আপনার এই প্রজেক্ট সম্পর্কে জানেন?

সেইটা আমি সিওর যাই না। কিন্তু ধইরা নিতে হবে – সে-ও জানে, সেও আগ্রহী।

আমরা যদি কাজ শুরুর পর দুই-তিন স্টেপ পার হইয়া যাই, তিনি আর দৌড়াইয়াও আমাদের ধরতে পারবেন না।

যেইখানে-যেইখানে যোগাযোগ করার দরকার, করছ?

যেইগুলা এখন দরকার, করছি। কিছু আবার পরে দরকার।

অপারেশন কবে করবা?

এই ধরেন দুই-তিনদিনের মইধ্যে।

শরাফত মাথা ঝাঁকাল, সামান্য সময় চুপ করে থেকে বলল – মেজবা, একটা কথা মাথায় রাখবা – এই জমিটা আমার দরকার।

পাইবেন। দশ জায়গায় দিয়া-থুইয়া আগের ক্ষতি পোষায়া নিয়াও অনেক লাভ করবেন।… বড়ভাই, মেজবা হ্যায় না?

লাভের কথা ভাবতেছি না, মেজবা।

মেজবা তাকাল শরাফতের দিকে।

হারতে চাইতেছি না, এইটাই মূলকথা।

ইনশা আল্লাহ্, আমরা জিতব।

জিতব।… গোলাগুলির পার্টি ঠিক করছ।

তারা তৈয়ার আছে।

যাদের সঙ্গে আনছ, এরাই?

কী যে কন, বড়ভাই। এরা আপনার লোক। যাদের ঠিক করছি, তারা অন্য। আপনি তাদের চিনেন না। আমিও চিনি না।

চিমত্মায় ফেললা। চিনো না… তারা পারবে?

পারবে। ওটাই তাদের কাজ।

হুম, আমারও কাজই দরকার। শুধু, আসিফের আছে কি নাই, এইটা জানি না, ধইরা নাও আছে – তারে আগাইতে দিও না।

মাথায় রাখছি।

আসিফ কী করতেছে, এইটা কিছু জানো?

মেজবা সামান্য হাসল – এইটা জানা সম্ভব?… সম্ভব না বইলাই কাজটা আমি আগে শুরু করতে চাই।

তাইলে শুরু করো। গুলির শব্দের অপেক্ষায় থাকলাম। তারপর শুরু হইব দৌড়।

মেজবারা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নিচে নামলে শরাফত দোতলার বারান্দায় নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল। রাস্তায় আলো আছে কিছু। মেজবাদের গাড়ি সে-আলোর বাইরে অন্ধকারে মিশে আছে। স্টার্ট নিলে গাড়ি নিয়নবাতির মতো জ্বলতে আরম্ভ করল, তারপর মেজবাদের নিয়ে একটানে বেরিয়ে গেল। শরাফত কোনো কারণ নেই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, ঘরে ফিরে এলো।

বাসায় সে একা। স্ত্রী দেশের বাইরে। ঘুরতে আর কেনাকাটা করতে গেছে। প্রায়ই যায়। তার যাওয়া নিয়ে শরাফতের কোনো আপত্তি নেই। থাকলে বরং সমস্যা, বকবক বেশি করে ও প্রায় সবই সে বোঝে। ছেলেটা পাশের দেশের এক বোর্ডিং স্কুলে। একা থাকতে শরাফতের খারাপ লাগে না। তার মাঝেমধ্যেই মনে হয় সে একলা মানুষই। কে কখন ছিল তার পাশে! কে কখন বলেছে, এই যে শরাফত, আসো, এইখানে দাঁড়াও। কে কখন তাকে বলেছে, এই যে শরাফত এইখানে বসো, এই সিট তোমার!

নিজের দাঁড়াবার কিংবা বসার জায়গা তাকেই করতে হয়েছে। এর জন্য কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে, সে ভোলেনি। কত রকম ব্যাপার তাকে বুঝতে হয়েছে। কখন কার নিতম্বের সঙ্গে সেঁটে থাকতে হবে, বুঝেছে। কখন কাকে নিজ নিতম্বের দিকে টেনে আনতে হবে, বুঝেছে। কখন নিজের অজান্তেই যেন নিজের নিতম্ব উন্মুক্ত করে রাখতে হবে, তা-ও বুঝেছে। এতসব বোঝার কোনো দাম নেই? ব্যাপারটা কোথায় আছে, আর, না থাকলে – কীভাবে সেটা বানানো যায় ও কাকে পাশে নিয়ে সেটা সম্পন্ন করতে হবে, এসব সবাই বোঝে না।

অথচ মাথামোটা আসিফের এসব না বুঝেই তার ওপর রাগ। সে নাকি দুদিন হলো বড়লোক। সে নাকি মিথ্যা ব্যবসা বানিয়ে টাকা কামায়। তার নাকি দুই নাম্বারি বুদ্ধিতে মাথা ভর্তি। আচ্ছা, সব সই। তা, সবাই কি হাজার দিনের বড়লোক? সবাইকে হাজার দিন আগে বড়লোক হতে হবে, তারপর কেউ বড়লোক হতে পারবে না? মিথ্যা ব্যবসা সে যদি বানিয়েই থাকে, বানিয়েছে। মিথ্যা ব্যবসা কি আর কেউ বানায় না বা বানাতে পারে না? নাকি নিষেধ আছে আর সবার জন্য। আর, দুই নাম্বার বুদ্ধি কি বুদ্ধি না? এক নাম্বার বুদ্ধি বুদ্ধি হতে পারলে দুই নাম্বার বুদ্ধির বুদ্ধি হতে অসুবিধা কোথায়! অসমর্থ্যের যে কতরকম আহাজারি!

শরাফতের সেলফোনের দিকে নজর যায়। তার খুব ইচ্ছা করে আসিফকে ফোন করার। ফোন করে সে বলবে – অ্যাই, আসিপপ্যা…।

আসিফের ফোনে যদি তার নাম্বার সেভ করা না থাকে, সে হয়তো তোতলাবে – কে, কে, আপনি কে বলছেন?

তবে তার নাম্বার আসিফের ফোনে আছে। সুতরাং সে অমন কিছু বলবে না। সে হয়তো এভাবে বলবে – শরাফত, তোর কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আসা করা যায় না।

সে উত্তর দেবে – হ, সব ভালো তোর। তুই তো হাজারী।

হাজারী! হাজারী মানে!

তোগো হাজার দিনের ব্যবস্থা।

তিন জেনারেশনের। এটা সবাই জানে।

আমি হচ্ছি দুইয়ারি।

এটা আবার কী?

দুই দিনের ব্যবসায়ী। ভাতরে কই অন্ন।

এটাও দেশের সবাই জানে।

তা, আসিপ, ট্যাকা কত আছে তোর?

টাকা আর মর্যাদা এক জিনিস না।

তাইলে ধুইয়া খা, ধুইয়া খা।

কী?

মর্যাদা। যেইটা নিয়া ফাল পাড়স।

তোর তো ফাল পাড়নের বালও নাই।

শোন, শোন তুই। ওই জমি তুই পাইবি না।

সরকার তোরে দলিল কইরা দিয়া দিছে?

সে যেইটাই হোক, ব্যবস্থা ফাইনাল?

গোলও কি হইয়া গেছে?

হুইশেল বাজলেই হইব। চায়া চায়া দেখবি।

এসব কথার কথা। এভাবে ভাবতে ভালো লাগে। শরাফত আসিফকে ফোন করল না। এমনিতেই করে না, এখন করার প্রশ্নই ওঠে না। বরং সে চায়, কোনোদিন এমন কোনো দরকার আসিফের পড়ুক, ফোন সে নিজেই করুক। মাফ চাক বা পরাজয় স্বীকার করে নিক, কিংবা অন্তত এটুকু বলুক – আচ্ছা, এবার না-হয় গেল, এর পরেরবার দেখে নেব।

বড় করে হাই তুলল শরাফত, বড় করে আড়মোড়া ভাঙল, বিছানায় বসে টিভি ছাড়ল। কতক্ষণ চ্যানেল বদলাল, এক চ্যানেলে এসে স্থির হলো, টিভির দিকে যদিও সে তাকিয়ে থাকল না। সে টের পেল কোনো কিছুতেই তার মন নেই। তার শুধু – মেজবা বলে গেল – ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে,  গোলাগুলি হবে, কারো না কারো লাশ পড়বে – যার লাশ পড়বে তার সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

 

এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে, রাহাত?

রাহাত পায়চারি থামাল। আসিফের দিকে ফিরল – কথাটা আপনি ঠিক বললেন না। আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই।

ছোটাছুটির কোনো লক্ষণও এখনো দেখছি না।

রাহাত হেসে ফেলল – আপনি কি সবসময় আমার সঙ্গে থাকেন?

কিন্তু সময় পার হয়ে যাচ্ছে।

আমি বসে নেই, আসিফভাই।

শরাফতও বসে নেই।

না। ওনারও বসে থাকার কারণ নেই।

তা হলে?

মেজবাকে কদিন হলো ব্যস্ত দেখছি।

তা হলে?

কিন্তু আমরা এগিয়ে।

কীভাবে?

আমি একটা পস্ন্যান গুছিয়ে ফেলেছি।

বলোনি কেন!

দুজন নেতাকে সঙ্গে রাখব। একজনের সঙ্গে কথা বলেছি…।

রাজি?

রাজি তো বটেই। আমি ভাবছিলাম দ্বিতীয়জনের সঙ্গে কথা বলে তারপর আপনাকে জানাব। আপনার পছন্দ হবে।

না না, তুমি এখনই জানাও।

দ্বিতীয়জনের সঙ্গে আজ বা কালই কথা হবে।

আহা রাহাত, তুমি পস্ন্যানটা বলো আমাকে।

প্রথমে একটা লাশ ফেলতে হবে।

লাশ! কার? শরাফতের?

কী বলেন, আসিফভাই! ওনার কেন হবে!

তা হলে?

যে-কোনো একজনের।

সে কে?

আসিফভাই, আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। যে-কেউ একজন হলেই হলো।

ওহ্, রাজনীতিতে যেমন লাশ লাগে…।

জি, সেরকম আজকাল ব্যবসায়ও লাগে।

তা, কারা করবে লাশ ফেলার কাজটা?

সেটা আসিফভাই, আপনার জানার দরকার নেই। ধরেন, আমিও জানি না। এসব যত কম জানা, তত ভালো। শুধু কাজটা হলেই হলো।

আবার ভ-ুল না পাকালেই হলো।

পাকাবে না। লাশ ফেলাই ওদের কাজ।

কিন্তু তুমি এখনো তোমার পস্ন্যান আমাকে জানাওনি।

জানাচ্ছি। রাহাত এসে আসিফের সামনে বসল। এটা যত না পস্ন্যান, তার চেয়ে বেশি গল্প।

গল্প! গল্প দিয়ে আমরা কী করব!

উহু, আসল গল্প কেন ভাবছেন। গল্পের মতো গোছানো।

বলো বরং। না শুনলে বুঝতে পারব না, গল্প না নাটক।

ধীর গলায়, থেমে থেমে, আসিফের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে করতে তার পস্ন্যানটা বলল। বলে আসিফের দিকে তাকিয়ে থাকল।

আসিফ কিছুটা সময় নিল। তার সামনে নোটবুক, কলম। সে কতক্ষণ কিছু লিখল, কিছু কাটল, কিছু আঁকিবুঁকি করল। তারপর চোখ তুলল – তোমার কী মনে হয়, রাহাত? এই গল্পে কাজ হবে?

সেটা আপনি বলবেন।

কিন্তু তোমার অভিজ্ঞতা বেশি।

অভিজ্ঞতার কথা বাদ দিন। আপনার বুদ্ধি কী বলে?

হবে। আসিফ হাসল। রাহাত মুখ খুলতে যাচ্ছিল, তার আগে আসিফ বলল – যদি তোমার গল্প শেষ পর্যন্ত লাইনে থাকে।

আমি না থাকার কারণ দেখছি না।

আমিও। তবে…।

তবে?

না, কিছু না।

কাজটা কবে করতে চাও?

দ্বিতীয় নেতা সম্মতি দিলেই। যদি আজ সম্মতি দেন, তবে পরশু, এরকম।

হুমম।… একটা পস্ন্যান, মানে একটা গল্প যখন তুমি তৈরি করেই ফেলেছ, তখন আর দেরি করার কোনো মানে নেই।

তাছাড়া শরাফতকে সময় দেওয়া চলবে না।

নিশ্চয়। ও, ও তো কিছু একটা করার কথা ভাবছে।… রাহাত…।

জি, আসিফভাই…।

লাশের ব্যবসা বা ব্যবসায় লাশ, যা-ই বলি, তাছাড়া ব্যাপারটা এই প্রথম ঘটতে যাচ্ছে না। কিন্তু আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। ইন্টারেস্টিং, না?

রাহাত কিছু না বলে আসিফের দিকে তাকিয়ে থাকল।

 

বাবরের কাজ যখন শেষ হলো, তখন সে ক্লান্ত। তার ইচ্ছা ছিল অন্তত দুটো অফিসে সে যাবে। কিন্তু একটা অফিসই তাকে জেরবার করে দিয়েছে। অফিসের দেওয়া নমুনার সঙ্গে তার সাপস্নাই মেলেনি – এই হলো অভিযোগ। এসব অভিযোগ এই ব্যবসায়ে নিয়মিত ব্যাপার। চাপে ফেলে দুটো পয়সা বেশি আদায়ের চেষ্টা আরকি। আগেও
বারদু-তিন বাবরকে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পার পেয়ে গেছে বাড়তি কিছু গচ্চা দিয়ে। এবারের পারচেজ অফিসারকে অবশ্য নাছোড়বান্দা মনে হলো, যেন বাবরকে এই অফিস থেকে উৎখাত করার দৃঢ়সংকল্প তার। পারচেজ অফিসারের সামনে ভিড় ছিল, বসার জায়গা পেতে সময় লাগল, জায়গা পেয়ে সে যখন বসল, পারচেজ অফিসার তার দিকে একবার তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিল, তার মুখে বিরক্তি, বাবর দেখতে পেল।

তারপর এক অস্বসিত্মকর অবস্থার শুরু। সে কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না, পারচেজ অফিসার মুখ তুলবে, এমনও বোঝা যাচ্ছে না। পারচেজ অফিসার বরং, বাবর যে বসে আছে সামনে সেটা সে জানেই না, এমন একটা ভাব নিয়ে অন্য এক টেবিলের সামনে বসে বেশ কয়েক মিনিট পার করে এলো। এসেও সেই আগের মতো চোখ নামানো। বাবরের ইচ্ছা করল, লোকটাকে কানে ধরে থাপড়াতে। এরকম ইচ্ছা হতেই সে হাসল ও বলল – শরীর কেমন, নাইমুলভাই।

নাইমুল চোখ তুলল, তাকে দেখল কতক্ষণ, তারপর মাথা দোলাল – ভালো।

তা, খবর-টবর দেন কিছু।

কী খবর দিব! নাইমুলকে খুবই বিস্মিত দেখাল।

আরে, নাইমুলভাই…।

খবর পান নাই?

কী! বাবর অধিক সতর্ক বোধ করল।

আপনার মাল তো রিজেক্ট।

আমার?

না, খয়রাতের বাপের।

কিন্তু নাইমুলভাই…।

স্পেসিমেন তো নিছিলেন, এমন তো না স্পেসিমেন আর সবাইরে দিছি, আপনারে দেই নাই।

না না, দেবেন না কেন! কিন্তু নাইমুলভাই…।

অফিস মাল রিজেক্ট করছে।

কতদিন আপনাদের সঙ্গে কাজ করি, নাইমুলভাই, কখনো এরকম হয়নি।

কখনো এই রকম হয় নাই বইলা কোনোবার হইব না, এমন কোনো কথা নাই।

জি, তা ঠিক, কিন্তু মাল আমি নিজে মিলাই…।

তাইলে আমি মিথ্যা বলতেছি?

না না, আপনি কেন মিথ্যা বলবেন!

তাইলে!

তাহলে কী, সে-উত্তর সহসা বাবরের মুখে জোগাল না। বেশ কিছুটা সময় নিল সে। তাতে অসুবিধা হলো না, নাইমুল তার দিকে তাকিয়ে নেই, সে টেবিলের কাগজপত্রের দিকে চোখ নামিয়ে রেখেছে।

নাইমুলভাই…। বাবর মৃদু গলায় বলল।

কতদিন ধরে আপনার সঙ্গে কাজ করছি…।

সেইজন্য দুই নাম্বার মাল গছায়া দিবেন… ?

না না, সেইটা কখনো না।

তাইলে?

আমাকে কী করতে হবে সেটা বলেন।

মাল ফেরত নিয়া যান।

অনেক টাকার মাল, নাইমুলভাই। বিশাল লস হয়ে যাবে।

তো? অফিস আপনার জন্য লস দিবে।

তা-ও বলি না। তবে বুদ্ধি-পরামর্শ আপনিই দেন।

এইটার আবার বুদ্ধি-পরামর্শ কী!

চলেন। বাবর একটু মরিয়া হয়েই উঠল। চলেন, নাইমুলভাই, বাইরে কোথাও বসে আলোচনা করি।

কোথায়?

লাঞ্চ করি চলেন। সময় হয়েই গেছে।

নাইমুল এবার গলা তুলল – বিরিয়ানি খাওয়াইবেন? আপনে আমারে বিরিয়ানি খাওয়াইলেই আপনার বাতিল মাল অফিস নিয়া নিবে? আমি ঘুষখোর?

রুমে অন্যান্য যারা ছিল, তাকাল তাদের দিকে। সে অবশ্য কিছু সময়ের জন্য। চোখ ফিরিয়ে নিল তখন তখনই, এই রুমে ঘুষ ব্যাপারটা প্রতি টেবিলের ব্যাপার, সুতরাং সে-বিষয়ক আলোচনা নিয়ে, যদি নিজের স্বার্থ না থাকে, সবার আগ্রহই কম। বাবর তবু লজ্জায় বেশ কিছুটা গুটিয়ে থাকল। যদিও তার বলার ইচ্ছা হচ্ছিল – নাইমুইল্যা, তুই যেন গত মাসে আমার কাছ থেইক্যা কত নেছস? মনে আছে?

বাবর এই প্রশ্নের ধার দিয়েও গেল না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে – সে নিজেকে বারবার বলল। তাই সে হাসিহাসি করল মুখ – নাইমুলভাই, আপনি ঘুষ খান আমি কখনো বলেছি? কেউ বলেছে?

তেল মারবেন না, বুঝলেন। নাইমুল বলল। আমারে তেল মারবেন না।

তেল মারতে মারতে আর কমিশন কিছু বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েই অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হলো। বাবর বুঝতে পারছিল, এটা শফিকদের কাজ। টেন্ডার নেগোসিয়েশনের সময় শফিকের সঙ্গে তার কিছুটা লেগেছিল। শফিক বলেছিল – ঠিক আছে, দেইখেন কিছু পারি কিনা।

সে এক পেস্নট ও নাইমুল দেড় পেস্নট বিরিয়ানি খাওয়ার পর রেসেত্মারাঁর সামনে থেকে বিদায় নেওয়ার সময় নাইমুল বলল – বিল সামনের সপ্তাহে।

বাবর হেসে মাথা কাত করল – অসুবিধা নেই নাইমুলভাই। তবে আপনি বড়ভাই, ভুল-ত্রম্নটি ধরিয়ে দিয়েন।

নাইমুল বলল – হুম।

ঝামেলা তখনকার মতো মিটে গেলে আবেদের ইচ্ছা করল সে সোজা বাড়ি ফিরবে। অনেক হয়েছে, আজ তার একটা আনন্দের দিন, আনন্দের দিনে এমন এক ঝামেলা, এখন বাইরে আরো কিছুটা সময় কাটালে, কে জানে, ঝামেলা এদিক-ওদিক থেকে আরো কিছু এসে জড়ো হতে পারে। বরং বাড়ি ফিরে, শুয়ে-বসে, দরকার হলে দাঁড়িয়ে, যেভাবে ইচ্ছা সে উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ভাবতে পারে।

এই ভাবনার মধ্যে অন্য এক ভাবনা চলে এলো। এ-সময় সে বাড়ি ফেরে না। প্রতি বিকেলে সে যায় কোনো না কোনো আড্ডায়। তার আড্ডার জায়গা চারটা। একেকদিন হয়তো একেকটায়, কিংবা কখনো পরপর একটায়ই। আড্ডা থেকে ফেরে নটার মধ্যে। তারপর গোসল, তারপর লিখতে বসা, তারপর রাতের খাবার, তারপর প্রয়োজন পড়লে আবার লিখতে বসা অথবা ঘুমানো। তা, এখন যদি সে আড্ডায় না যেয়ে বাড়ি ফেরে, তার ভালো লাগবে! সে গুছিয়ে উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ভাবতে পারবে? আরো একটা সমস্যা আছে, তার মনে পড়ল, কালই সে মাইকিং শুনেছে, নাকি আজ সকালে সে যা-ই হোক, মাইকিং হয়েছে, বাড়িঅলাও জানিয়েছেন – বৈদ্যুতিক লাইনে বড় ধরনের মেরামতের জন্য তাদের এলাকায় রাত ৮টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকবে না। সে এখন যদি বাড়ি ফেরে, পানি থাকলে গোসল যদি সারতেও পারে, তারপর বসে দরদর করে ঘামা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। এই আশঙ্কা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা উচিত হবে?

তাহলে ফয়সাল আবেদ? সে জিজ্ঞেস করল নিজেকে। কী করবে তুমি?

ভাবছি। বুঝতেই পারছ।

আমি একটা বুদ্ধি দিতে পারি তোমাকে। সাধারণ বুদ্ধি।

দাও। সাধারণ-অসাধারণ, যে-কোনো বুদ্ধিই কাজে লাগতে পারে।

বাড়ির পাশে একটা পার্ক আছে না?

এখনো কিছুটা আছে।

ওখানে যাও।

শোনো, ওটাকে পার্ক বলতে আমার আপত্তি।

আহা, যত আপত্তিই থাকুক, পার্কই বলো ওটাকে, নাকি?

তা বলি। সবাই বলে, আমিও বলি।

ওখানেই যাও। তোমার জায়গা নির্দিষ্ট আছে ওখানে। বাদাম কিনবে। বসে বসে বাদাম খাবে আর ভাববে।

আমি ভাবছিলাম মাহমুদের ওখানে যাব। বেশ কদিন দেখা হয় না…।

ফ্রি মদ?

আরে না না, বাসায় আছে না… !

বাসায় যেটা আছে, সেটা কম দামি। ওরটা ডিলাক্স। ওখানে গেলে তোমার মদের হিসাব থাকে না। টুক করে একসময় বলে দেবে।

কী? উপন্যাসের কথা?

আর কী! অবশ্য আজ তোমার সাপস্নাই-ব্যবসায় কী ঝামেলা হয়েছে, সেটাও বলতে পার। বন্ধুরা জেনে যাবে তোমার অমন একটা ব্যবসা আছে।

না না, ওসব কাউকে জানাতে চাই না।

তা হলে এদিকেই থাকো।

থাকলাম না হয়।… আমার মাথায় অবশ্য একটা ব্যাপার ঘুরছে।… আচ্ছা, এই যে আমি সাপস্নাই-ব্যবসায় আছি, এ নিয়ে, মানে এ-জগৎটা নিয়ে একটা উপন্যাস হতে পারে। এক বছরে কম দেখিনি।

তা হলে? লিখবে?

ভাবছি।… এই আজকের কথাই ধরো। এই নাইমুল খচ্চরটার কথাই ধরো। কীভাবে আমাকে আটকে দিতে চাইল, খেয়াল করেছ নিশ্চয়।

তোমার সঙ্গেই যখন ছিলাম, খেয়াল না করে কী উপায়!

এরকম আরো অনেক ব্যাপার আছে।

সেসব নিয়ে লিখবে?

সম্পূর্ণ অন্য একটা জগৎ না?

সব জগৎই অন্য একটা জগৎ।

তা বটে। তবে এ-জগৎ নিয়ে সম্ভবত লেখা হয়নি।

বুঝলাম। কিন্তু উপন্যাস লেখার মতো মালমশলা আছে তোমার কাছে?

বানানো যায়। ধরো, আজ আমি নাইমুলের কাছে সারেন্ডার করলাম। আমি যদি লড়তে চাইতাম, নাইমুল কিন্তু পারত না। ওকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হতো আমার সাপস্নাই ঠিক, মাল অ্যাজ পার  স্পেসিফিকেশন, স্ট্যান্ডার্ড…।

মাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী!… মাল! কত কি বোঝাতে যে এই শব্দ ব্যবহার হয়।

যেখানে-যেখানে মানান, সেখানে-সেখানেই ব্যবহার হয়।

আমার শুধু তেমন জিনিস দেখলে বলতে ইচ্ছা করে।

দেখো, রোজকে একজন মাল বলেছিল বলে সে-বন্ধুর সঙ্গে আর কথাই বলিনি।

বুঝলাম।… যা বলছিলে…।

বড় কোনো পার্টি হলে মামলা করত। মামলা করে জেতার অনেক উদাহরণ আছে।

হেরে যাওয়ার উদাহরণ নেই?

আছে নিশ্চয়।… আমি বলছি, আমি করলে জিততাম। কিন্তু আমি ছোট পার্টি। আমার এখনো আপস করে চলার সময়। হয়তো এভাবে চালিয়ে যেতে পারলে আমারও একসময় আর তোষামোদী করা লাগবে না। গরম থাকবে।

সেটা ভালো।… তবে এটা নিয়ে উপন্যাস হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। সাপস্নাইয়ের ব্যবসায় কিন্তু মেয়ে সাপস্নাই, গোলাগুলি, খুঁটির জোর, পলিটিক্যাল প্রেসার, ভাগবাটোয়ারা, এরকম অনেক কিছুই আছে।

তবু। মনে হচ্ছে, এটা একটা বড় উপন্যাসের অংশবিশেষ হতে পারে।

আমার মনে হচ্ছে উলটো। আমার মনে হচ্ছে পুরো উপন্যাস হতে পারে। ধরো, শুরুই হলো দুপক্ষের গোলাগুলি দিয়ে…নাটকীয়…।

গোলাগুলি দিয়ে শুরু করবে, না নেতাদের ভাগবাটোয়ারা দিয়ে?

গোলাগুলি দিয়ে। শুরুটা নাটকীয় করতে চাই।

আচ্ছা।… এটাই লিখবে?

ভাবছি।

ভাবো।

পার্কে যাব। গুছিয়ে ভাবব।

এটা আসলে নামেই পার্ক। এলাকাটা বেশ ঘিঞ্জি। ছাড়িয়ে আরো কিছুটা সামনে গেলে বড়লোকদের এলাকা। লোকজন শুনেছে, বড়লোকরা একটু একটু করে এদিকে জমি কিনছে। কিনতে কিনতে তারা নাকি একসময় পুরোটাই কিনে নেবে। তখন এখানে কোনো গরিব থাকবে না। লোকজন আরো শুনেছে, সরকারও এরকম চাচ্ছে – বড়লোকদের বিস্তার। কেউ কেউ এমনও বলেছে, সরকার চাইল কি চাইল না, তাতে কিছু এসে-যায় না। বড়লোকরা ইচ্ছা করলে, করতে পারে। তাছাড়া বড়লোক ও সরকার, এই দুইয়ের তফাৎই-বা কী! এ-বিষয়টা ফয়সাল আবেদ সহজভাবে দেখতে চায়। হ্যাঁ, এটা নিয়েও লেখা যায় বইকি – বড়লোকের দল এক এক করে সব গ্রাস করে নিচ্ছে। নিতে নিতে এক সময় তাদের একচ্ছত্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা সেই রাজত্বের নাম দিয়েছে বড়লোকদের দেশ। বড়লোকদের দেশ নামে একটা উপন্যাস হতে পারে। তবে ফয়সাল আবেদ এখনই সে-উপন্যাস লিখবে না। বড়লোকদের সম্পর্কে, তার ধারণা থাকলেও, অনেককিছু জানা বাকি। না জেনে, তৈরি না হয়ে লেখা উচিত হবে না। আপাতত, এই যে বড়লোকরা এদিকটা, এবং নিশ্চয় আরো অনেক দিক, কিনে নিচ্ছে, বাবর আজম এর মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছে না। কিনুক না তারা, সব কিনে নিক। তার পয়সা থাকলে সে কিনত না! আর, না কিনেই-বা বড়লোকরা কী করবে! তাদের সংখ্যা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তাদের জায়গা লাগবে না? তারা নিশ্চয় চেপেচুপে গায়ে গা লাগিয়ে থাকতে পারে না। একটু হাত-পা ছড়িয়ে, খেলিয়ে থাকতে তারা চাইতেই পারে। সে নিজেও, বাবর আর কি, ওই হাত-পা ছড়িয়ে থাকার দলেই। ওরকমই একজন সে হয়ে উঠতে চায়। এসব কথা আর কাউকে বলা যায় না, বাবর তাই, যখন বলার ইচ্ছা হয়, নিজেকেই বলে। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা, নির্দিষ্ট করে বললে – দুটো, লেখক হওয়া, বড়লোক হওয়া। লেখকদের গরিব হতে হয়, এমন কোনো তত্ত্বে সে বিশ্বাস করে না। তবে এটাও সে মনে রাখে, লেখকদের গরিব না হতে হলেও মাঝেমধ্যে গরিবদের নিয়ে লিখতে হয়।

এটা পার্ক আসলে নামেই। একসময় অবশ্য বাচ্চাদের খেলাধুলার কিছু ব্যবসা ছিল। সেসবের অধিকাংশই এখন লুপ্ত কিংবা ভাঙা শরীরে অবশিষ্ট। বোঝা যায় কিছু ফুলগাছও একসময় ছিল। তার কিছু মৃত অবস্থায় ও শরীরের কিছু অংশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বসার জন্য অবশ্য, ক্ষয়ে যাওয়া হলেও সিমেন্টের কিছু বেঞ্চ এখনো আছে। প্রায় বিঘা দেড়-দুইয়ের বাকি এলাকাজুড়ে রাস্তার ওপাশের দোকানের কাঠমিস্ত্রিরা কাজ করে, কোথাও রড-সিমেন্ট-ইট আর স্টিলের পাত উঁচু হয়ে থাকে, কেউ কেউ খুঁটিতে পলিথিন বেঁধে তার নিচে রাত টাকায়। এখানে আহ্লাদ করে আসার কিছু নেই। তবু বাবর আসে, এখানে একটা বসার জায়গা তার প্রায় নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, সেটা খালি থাকলে, অধিকাংশ দিন খালিই থাকে, বাবর সেখানে বসে থাকে। বাচ্চাদের ছোটাছুটি, কাঠমিস্ত্রিদের কাজ, বালু-ইট বা তক্তার সত্মূপ, উঠতি বয়সীদের তাস খেলা বা একটু চেপে বসে গাঁজা খাওয়া – এসব সে দেখে ও দেখেও না, তা, দেখুক বা না-দেখুক, বসে থাকতেই তার ভালো লাগে। সে দেখেছে, বরাবর, এই ভিড় এই হইহল্লা, এসবের মধ্যে সে বেশ গুছিয়ে চিমত্মা করতে পারে। সে চিমত্মা শুরু করে দিলো।

তো, কী ঠিক হলো, সাপস্নাই-ব্যবসার যে-জগৎ, সেটা নিয়ে উপন্যাস সে লিখবে?

বাবর তার নির্দিষ্ট জায়গাটা পেয়েছে। এখানে বসার জন্য, বসে গল্প করার জন্য, বসে সময় পার করার জন্য খুব কম লোকই আসে। ফলে জায়গা পেতে তার অসুবিধা হয় না। মাঝেমাঝে অবশ্য বেঞ্চজুড়ে কেউ ঘুমায়, তবে সেটা মাঝেমাঝে। আজ কেউ নেই। সে বসার আগে একটা আড়মোড়া ভাঙল। বসে হাত-পা টানটান করে দিয়ে আরেকবার। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকল। চোখ খুলে ভুরু কুঁচকে দূরে তাকিয়ে থাকল। সাপস্নাই-ব্যবসা নিয়ে উপন্যাস না?

লেখা যেতেই পারে, তার মনে হলো। ভেতরে একটা, এক ধরনের অনীহা অবশ্য আছে। কখনো মনে হচ্ছে, এটা একটা উপন্যাসের অংশবিশেষ হতে পারে, পুরো উপন্যাস না। আবার এরকমও কখনো মনে হচ্ছে, পুরো উপন্যাস না-হওয়ার কোনো কারণ নেই। তার কথাই ধরা যাক, ধরা যাক এই উপন্যাসের সে-ই নায়ক। ছোট থেকে শুরু করে উপন্যাসের নায়ক ক্রমশ বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠছে। উঠতে উঠতে একসময় সে, শুধু উপন্যাস কেন, বাস্তবেও তা হতে পারে, রাষ্ট্রের বড় বড় সাপস্নাইয়েও অংশ নিতে শুরু করেছে। এই যে রাষ্ট্রের বড় বড় সাপস্নাই, এইখানে এক হুলস্থূল অবস্থা। এখানে যে যা পারে, সাপস্নাই দিয়ে যাচ্ছে। যা আছে, তাও সাপস্নাই, যা নেই, দরকারও নেই, চাহিদা তৈরি করে তাও সাপস্নাই। এইভাবে তারা টাকা নিয়েই যাচ্ছে, নিয়েই যাচ্ছে, তারপর আবার সাপস্নাই পাচ্ছে। এভাবে, একসময় এমন হতে পারে, দেখা গেল সাপস্নাই দেওয়ার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, আবার সাপস্নাই বিল পরিশোধ করার মতো টাকাও নেই রাষ্ট্রের।… এভাবে হয় না?

কী বলো তুমি? হয় এভাবে? বাবর আজম নিজেকে জিজ্ঞেস করল।

এখন মনে হচ্ছে, হবে, সম্ভবত।

সম্ভবত বলছ।

ধরো, সম্ভবত বলছি না, বলছি – হবে।

প্রথমে উড়িয়েই দিচ্ছিলে…।

প্রথমে তুমি একা গুছিয়েও ভাবোনি।

গোছানো শেষ হয়নি।

তা হয়নি। কিন্তু তুমি একটা ধারণা তৈরি করে ফেলেছ।

কেমন হবে, যদি সত্যিই লিখতে পারি?

শেষের অংশটুকু পছন্দ হয়েছে। উপচেপড়া অপ্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত মাত্র, রাষ্ট্র নিঃস্ব…।

শেষটা অমনই হবে। এখন শুরুটা শুরু করা। ধরো, বড় একটা সাপস্নাই। আর সবাই সরে গেছে, কিন্তু বড় দুই টেন্ডারবাজ অস্ত্র হাতে মাঠে নেমেছে, টেন্ডার ভ-ুল করে দেবে…।

ভ-ুল করে দেবে কেন! যারা জিতবে তারা টেন্ডার পাবে…। পরেরবার আবার এবার যে পায়নি, সে পাবে। নেগোসিয়েশন না?

নেগোসিয়েশন সবসময় হয় না। ধরো ইগোর ব্যাপার। তাছাড়া, এ-উপন্যাসে দেখাতে হবে ভ-ুল হয়ে গেছে। তা, টেন্ডার ভ-ুলের জন্য একটা বড় ধরনের গ-গোল দরকার। ধরো, একটা লাশ পড়ে গেল কিংবা দুটো…।

টেন্ডার এখন অনলাইনে…।

আহা, অনলাইনে হলেই সবাই পায়, কেউ বাদ যায় না, বড় টেন্ডার, আন্তর্জাতিক, খেলা থাকে না?

বেশ বেশ। তা হলে লাশ পড়বে?

হ্যাঁ, লাশ পড়বে?

যে-কোনো একপক্ষের? না দুপক্ষের দুটো?

না না, নির্দিষ্ট করে দুপক্ষের কারো নয়। যে-কোনো একজনের।… যে কারো। একজনের।… যে কারো। ধরো, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে একজন, কিংবা অফিস থেকে বেরিয়ে পার্কে এসে বসেছে, মন ভালো বা খারাপ, এমন যে-কোনো একজন…।

বুঝলাম।

আরেকটা ব্যাপার…।

বাবরের কথা শেষ হওয়ার আগেই গুলির শব্দ হলো। গুলির শব্দ কিনা প্রথমেই বাবর সেটা বুঝতে পারল না। তবে বেশ জোরালো শব্দ। শীশকাটা। যেন প্রবল প্রতাপে ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে। বাবর আজম চমকে উঠে শব্দের উৎসের দিকে তাকাল। তাকে অবশ্য খুঁজে পেতে তাকাতে হলো না, হঠাৎ কয়েকজন লোক হুড়মুড় করে কোথাও ঢুকে পড়লে চোখ সেদিকে চলেই যায়। বাবর আজমেরও গেল। সে দেখল লোকগুলো গুলি ছুড়ছে, কাছেই, কাজেই তাদের অস্ত্রও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তারা গুলি ছুড়ছে, কিন্তু গুলি কার দিকে ছুড়ছে, তা বাবর বুঝতে পারল না। তার মনে হলো এই যারা গুলি ছুড়ছে, তাদের গুলি ছোড়াটা এলোপাতাড়ি। কিন্তু এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ার কী অর্থ! গুলি কি আর বিয়েবাড়ির পটকা ফোটানো বা আতশবাজি ওড়ানো। এমন হতেই হবে, এখানে ওদের শত্রম্ন আছে। কে ওদের শত্রম্ন সে, হয়তো এ-মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে বুঝতে পারছে না, পরে বুঝতে পারবে। কিছুদিন আগে বাড়িঅলার মুখে সে শুনেছিল এখানে ইয়াবা বিক্রি হয়, ইয়াবা লুকিয়েও রাখা হয় এখানে। সে এই পার্কে আসে জেনে বাড়িঅলা বলেছিল – ভাইডি, আপনে ওই মাঠে যান শুনলাম…।

তা যাই মাঝেমাঝে।

কেন যান! ওই মাঠে আছেটা কী?

কিছু করি না, বসে থাকি। কী আছে, মানে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে তেমন কিছু একটা আছে, আমি জানি না।

এইটা বললেন ভাবের কথা। শুনেন, ইয়াবা খান?

আমি খাই? ইয়াবা?

লেখক মানুষ, খাইতেও পারেন।

ইয়াবাবা!

কন না।

না ভাই, আমি ইয়াবা খাই না।

মদ তো খান…।

জি, তা খাই কখনো কখনো।… ঝামেলা করি না কিন্তু।

মদ খাইলে অসুবিধা নাই। আমিও খাই। কিন্তু ইয়াবা ধইরেন না।

না না, কী বলেন!

তাইলে! ওই মাঠে ইয়াবার কারবার হয়, জানেন না?

কী বলেন! একদিনও দেখলাম না… !

আপনার দেখনের কী দরকার!

তা দরকার নেই…।

হয়।… ওই মাঠে যাইয়েন না, ঝামেলা।

আজ দেখি বাড়িঅলার কথামতো সত্যিই ঝামেলা লেগেছে। এই যে অস্ত্রহাতে একদল এসে গুলি ছুড়ছে, তারা কি প্রতিপক্ষ খুঁজছে, আজ ফেলে দেবে? প্রতিপক্ষ এখানেই আছে।… আছে? বাবর আজম এদিক-ওদিক তাকাল। প্রতিপক্ষ এখানে থাকলে তাদেরও পালটা জবাব দেওয়ার কথা।… তারা কই? কোথাও তাকিয়ে তাদের দেখল না বাবর আজম। যারা এখানে আছে, গুলি ছোড়ার কাজে, একতরফ আছে। তারাই এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে, তারাই এলোপাতাড়ি দৌড়াচ্ছে। সে কী করবে, বাবর বোঝার চেষ্টা করল, সে-ও কি এদের মতো, এলোপাতাড়ি না হোক, কোনো একটা পথ ধরে দৌড়াতে শুরু করবে? কিন্তু ছুটলেই বেরিয়ে যাওয়া যাবে, এই নিশ্চয়তা কোথায়? ছোটার চেয়ে, খিচে, এই সিমেন্টের বেঞ্চের পেছনে লুকানো বোধহয় ভালো। ভাবতে সামান্য সময় নিল সে, হ্যাঁ, এটাই ভালো – বেঞ্চের পেছনে লুকানো, ভেবে – সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বেঞ্চের পেছনে যেতে নেবে, প্রচ- এক ধাক্কায় সে দুলে উঠল।

এমন জোরালো ধাক্কা, বাবর প্রবলভাবে টলে উঠল। সে টের পেল, দেখলও, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। শরীরসহ চারপাশ এলোমেলো লাগছে, হাঁটু বারবার ভেঙে ভেঙে আসছে, বাবরের চকিতে মনে হলো – তার সবসময়ই সোজা হয়ে থাকারই ইচ্ছা, বসে কিংবা দাঁড়িয়ে। তা হলে এমন ব্যাঁকা হয়ে যেতে হচ্ছে কেন! সে বেঞ্চের হেলান দেওয়ার জায়গাটুকু ধরে সোজা হয়ে থাকার চেষ্টা করল। পারল না। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মাটিতে। বেঞ্চের সঙ্গে তার মাথা ঠুকে গেল। সে টের পেল, গরম ভেজা এক স্রোতে তার শরীর ভেসে যাচ্ছে। তার গলা খুলতে কষ্ট হলো, সে সব শক্তি জড় করল – বাবর আজম, বাবর আজম…।

চেঁচিও না। কী বলবে তুমি, আমি জানি।

জানলে, এটাও জানো – কী হয়েছে আমার – বলো।

আহা, কেন বুঝতে পারছ না? তুমি গুলি খেয়েছ।

আরে, এটা তুমি কী বলছ – আমি গুলি খেয়েছি!

তুমি অস্বীকার করার চেষ্টা করলেই গুলিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না। গুলির মতো ব্যাপার মিথ্যা খুব কম হয়। তুমি গুলি খেয়েছ।

আমি কিন্তু টের পাচ্ছি না, সত্যি।

তুমি টের পেতে চাচ্ছ না।

জানি না।… আমার কেমন যেন লাগছে।

কথা বলো না।

আমার অনর্গল বলতে ইচ্ছা করছে।

আহা… !

গুলিটা কোথায় লেগেছে?

গলায়।

গলায়!… ভাগ্যিস আমি গায়ক না, লেখক। গায়ক হলে রেওয়াজ বেশকিছু দিন বাদ যেত।

চুপ। একদম। রক্ত বেরোচ্ছে।

একটা পাইপ লাগিয়ে দাও। এখানকার ফুলগাছগুলো মরে কী হয়েছে! কিছু রক্তপাত… বাবর…।

বলতে হবে না, তোমাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি।

হ্যাঁ, জলদি। আমার মনে হচ্ছে আমার কিছু হবে না। তবে হবে না বলে, এভাবে চিকিৎসাহীন পড়ে থাকাও ভালো দেখায় না।

আমি দেখছি কী করা যায়। টিকে থাকো।

দেখাদেখির কিছু নেই, শোনো, এখানে দেখাদেখির কিছু নেই। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও, তুমি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।

টিকে থাকো…।

বারবার এই একই কথা বলো না – টিকে থাকো, টিকে থাকো। লাগা রাহো মুন্নাভাইয়ের মতো শোনাচ্ছে।

আহা, দেখছি তো।

তার পর বাবর আজমের আর কিছু খেয়াল নেই। কিছুই তার আর খেয়াল নেই। সে বুঝতে পারল না, কতক্ষণ সে ওভাবে পড়ে থাকল, তারপর কেউ কি তাকে হাসপাতালে নিল, নিলে – কে নিল, কিছুই সে বুঝতে পারল না।

সে বুঝতে পারল না, তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কীভাবে নেওয়া হলো! রিকশায় সিএনজি ট্যাক্সিতে (যে ভাড়া এদের, আর পাওয়াই যে যায় না), ভ্যানে, নাকি পুলিশের গাড়িতে? নাকি লোকজন টানতে টানতে নিয়ে গেছে – অ্যাই, চল চল।

সে বুঝতে পারল না, হাসপাতাল-যাত্রায় কেউ কি তার সঙ্গী হলো।

সে বুঝতে পারল না, কোন হাসপাতালে তাকে নেওয়া হলো। কী নাম হাসপাতালের। হাসপাতাল কাছের না দূরের, ভালো না খারাপ।

সে বুঝতে পারল না, হাসপাতালে তাকে নেওয়া হলে, হাসপাতাল কি তাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল, না ফেলে রাখল?

সে বুঝতে পারল না, তার বন্ধু-স্বজনদের কাছে খবর কি পৌঁছে গেছে, নাকি তারা কিছুই জানে না?

সে বুঝতে পারল না, তার বাবা-মা দূর থেকে এই খবর পেলে কতটা ভেঙে পড়বে?

সে আরো বুঝতে পারল না, কেন তাকে গুলি করা হলো!

সে বুঝতে পারল না, এখন সেই উপন্যাসটা সে শেষ করবে কীভাবে?

এমনকি, সে কি এখন বেঁচে আছে না মরে গেছে, এই সহজ ব্যাপারটাও সে বুঝতে পারল না। সে খুবই বিরক্তবোধ করল। একসঙ্গে না-বোঝার এতকিছু জড়ো হওয়ার কোনো মানে হয়!

 

দুই

বাবরের যখন জ্ঞান ফিরল, কতক্ষণ পর ফিরল – সে বোঝার চেষ্টা করল, পারল না, কোথায় সে – এটাও বুঝতে পারল না। সে দেখল সে একটা বড় ঘরের মধ্যে। ধবধবে সাদা রঙের সেই ঘরের মধ্যে বড় বড় আলো জ্বলছে। চারদিক একদম চুপচাপ, সাইবেরিয়ায় ঝিরিঝিরি তুষারপাত হলেও এখান থেকে টের পাওয়া যাবে, এমন চুপচাপ। সে দেখল তার সারা গায়ে লাগানো অনেক যন্ত্রপাতি। সে যন্ত্রপাতি, যতদূর দেখা যায় – দেখা শেষ হলে, ওসবসহই উঠে বসতে চাইল। পারল না। আবার চেষ্টা করল, আবারো পারল না। সে বলল – ঠিক আছে ঠিক আছে, এই এখনই আমাকে উঠে বসতে হবে কেন! বেঁচে যে আছি, আবার, উঠে বসার চেষ্টাও করলাম দুবার – এই কি আপাতত যথেষ্ট নয়।

বেঁচে থাকার আনন্দ আরো কিছুটা বোঝার আগে ঘরের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল দুজন ডাক্তার, তিনজন নার্স। মাথাটা তাহলে ঠিক আছে, কাজ করছে – পাঁচজন যে এসেছে, এটা বুঝতে পারছি – সে খুশি খুশি বোধ করল।

ডাক্তার দুজন তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখল, যন্ত্রপাতি নেড়েচেড়ে দেখল, কিন্তু তারা এমনই ভাবলেশহীন, তারা তাকে কেমন দেখল সেটা বাবর বুঝতে পারল না। দেখা শেষ হলে ডাক্তার দুজন নার্সদের উদ্দেশ করে কিছু বলল, বাবর সেসবও বুঝল না। তবে তারা তার কাছ থেকে সরে যাওয়ার সময় সে-কথা বলার চেষ্টা করল – ডাক্তার সাহেব… স্যার…।

পাঁচজন প্রায় একই সময় তার দিকে ফিরল – কথা বলবেন না, কথা বলবেন  না।

কেন? বাবর খুব সরল গলায় জিজ্ঞেস করল।

আপনার গলায় গুলি লেগেছে। এ-সময় কথা বললে গলায় চাপ পড়বে।

ওহ্। আচ্ছা, তাহলে বলব না।… গলায় গুলির কথা শুনেছিলাম অবশ্য।

বিশ্রাম নিন। সিস্টাররা আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছে। আপনার বেডের পাশেই কলবেল আছে। এমার্জেন্সি মনে করলে বাজাবেন।

বাহ্, ভালো ব্যবস্থা!

সুস্থ হয়ে যাবেন। তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার মনের জোর অনেক।

জি, আমি জানি। অনেকে বলেও।

দারুণ একটা ফাইট ব্যাক দিলেন। না হলে আপনাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন ছিল।

বাবর হাসল – আচ্ছা, আমি কবে বাড়ি ফিরতে পারব?

সেটা একটু সময় লাগবে। এতবড় একটা আঘাত…।

আমি তো ভেবেছিলাম আমি মারাই গেছি। এই যে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, বুঝতে পারছি আমি মরিনি।

দুজন ডাক্তার আর তিনজন নার্সের মুখেও হাসি দেখা গেল – মরবেন কেন! মরা কি অত সহজ…!

না না, এটা ঠিক না। মরে যাওয়া খুবই সহজ। রাস্তাঘাটে দুমদাম মানুষ মারা যাচ্ছে।

সে অন্য কথা। আমাদের হাতে সময়মতো এসে পড়লে…।

বেঁচে যায়?

মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের কাজ…।

তা হলে যে পত্রিকায় দেখি ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায়…।

সে আধ-একটু।… ওসব কথা এখন থাক। আপনাকে নিয়ে আসলে যমে-মানুষে টানাটানি গেছে। মানুষ জিতেছে।

জি। মানুষের এমন জয়ের গল্প অনেক আছে।

হু-ম-ম। অনেক কথা হয়ে গেছে। এখন বিশ্রাম। আমরা আরেকজন পেশেন্টকে একটু দেখে নেই।

ডাক্তার-নার্সরা পা বাড়াল। সেদিকে তাকিয়ে থেকে বাবর দেখল কিছু দূরে আরেকটা বেড আছে। কী আশ্চর্য, এটা সে খেয়ালই করেনি। সে বিরক্ত হলো, ধরিয়ে না দিলে এভাবে কত কী চোখের আড়ালে থেকে যায়। এখন, কিছু দূরেই আরেকজন আছে জানার পর, তার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে সময় পার করা যাবে। অচেনা মানুষের সঙ্গে সাধারণত কথা বলতে তার ভালো লাগে না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, এখন বোধহয় কথা বলে সময় পার করতে খারাপ লাগবে না। সে তখনই এমার্জেন্সি কলবেলে চাপ দিলো। দুজন নার্স ফিরে তাকিয়ে প্রায় ছুটে এলো তার দিকে – কী হয়েছে! অসুবিধা বোধ করছেন? কোথায়?

আরো একজন পেশেন্ট আছেন দেখছি!

বাহ্, পেশেন্ট থাকবেন না! দেশে পেশেন্টের অভাব!

আগে খেয়াল করিনি কিনা…।

আপনারা একসঙ্গেই এসেছেন।

আচ্ছা!

ওই একই জায়গা থেকে।

বাবর বেশ উৎসাহবোধ করল – মানে ওই পার্ক থেকে?

ওটা পার্ক কিনা, তা তো বলতে পারব না, তবে ওখানেই আপনারা গুলি খেয়েছেন।

কী আশ্চর্য, আরেকজনও গুলি খেয়েছেন! কোথায়?

বললাম না – ওখানেই।

না না, কোন জায়গায় গুলি খেয়েছেন? আমি যেমন গলায়…।

তিনি হার্টে। হার্ট মাত্র ২৫ পার্সেন্ট কাজ করছে।

আহা রে।… বাঁচবেন!

আমরা কখনো আশা ছাড়ি না।… কিন্তু আর কথা নয়। আপনার বিশ্রাম দরকার।

বিশ্রাম নিচ্ছিই। ওনার নামটা জানা যাবে?

কেন! একজন একটু বিরক্তই হলো। নাম-টাম এসব কী দরকার!

মানে আমি চিনি কিনা…।

সেটা পড়ে খোঁজ নিয়েন। এখন চুপ। স্যাররা রাগ করবেন না হলে।

বাবর চুপ করে গেল। এখন, সে ভেবে দেখল, দরকার নেই এত কথার, তবে অনেক কথার দরকার আছে। এই এরা চলে যাক – তারপর ওই যে আরেকজন, গুলি খেয়েছে তার মতো, একই জায়গায় একই সময়ে, হার্টে, হার্টে গুলি খাওয়া যা-তা ব্যাপার না, সে জানে – তারপর সে অনেক অনেক গল্প করবে ওই লোকের সঙ্গে।

সে অবশ্য কান খাড়া করে রাখল, ডাক্তারা কী বলছে ওই লোকের সঙ্গে, তা শোনার জন্য। দূরত্ব খুব একটা বেশি না, তারা কথা যে বলছে, এটাও বোঝা গেল, কিন্তু কিছুই তার কানে এসে পৌঁছাল না। সে বিরক্তবোধ করল। সে গুলি খেয়েছে গলায়, তাহলে কানে কেন শুনছে না!

ডাক্তার দুজন, নার্স তিনজন চলে গেল একসময়। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাঁ-পাশ ফিরল। বাঁ-পাশ ফিরে সে অস্বসিত্মবোধ করল। সে আগেও এদিকে তাকিয়ে ছিল। ওই দুজন ডাক্তার, তিনজন নার্স আসার আগে, এই কাছেই যে আরেকজন আছে, এটা তখন তার চোখে পড়েনি। গুলি খেয়েছি গলায়, সে বিরক্ত গলায় বিড়বিড় করে বলল, আমার চোখ কী দোষ করল!

সে আরো কিছুটা সময় নিল। তারপর ডাকল – অ্যাই…।

কোনো উত্তর এলো না।

তখন সে গলা আরেকটু চড়াল – এই যে…।

লোকটি তার দিকে মুখ ফেরাল। বাবর দেখল, একে ‘লোক’ বলা উচিত হবে না, এ-ছেলে বলা উচিত, ছেলে মানে তরুণ, এই, তার বয়সী, কিংবা হিসাব-টিসাব করলে তার চেয়ে কিন্তু ছোটই হবে। বাবর একটু হাসি ফোটাবার চেষ্টা করল – আপনি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন?

শুনতে না পারলে ঘেটি এমনিই ঘুরাইছি?

বাবর কিছুটা দমে গেল। এই ছেলের সঙ্গে জমবে বলে মনে হচ্ছে না – প্রথমেই এমন ত্যাড়া উত্তর! বাবর ত্যাড়া চোখে একবার তাকাল। দেখল ছেলেটা ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেন ছেলেটা প্রথমেই এমন মেজাজ নিয়ে কথা বলল, এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বাবরের মনে হলো – অনেকের মনে অনেক ক্ষোভ থাকে। ক্ষোভ থাকলে অনেকেই এমন তেতো উত্তর দিতে পারে। তা সে কি ছেলেটার সঙ্গে, উত্তর যেমনই আসুক, ও যে-ভঙ্গিতেই কথা বলুক, সে কথা চালিয়ে যাবে? এমন হতেও পারে, ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে সে নতুন কোনো গল্প বা উপন্যাসের উপাদান পেয়ে গেল।

তবে তখনই সে মুখ খুলল না। বেশ কিছুটা সময় নিল সে, তারপর এমনভাবে মুখ খুলল যেন সে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না – নাম কী আপনার?

উত্তর তখনই এলো – আমার নাম দিয়া আপনার কী কাম?

এমন উত্তর বাবর আশাই করেনি, তবে সে যতটা মর্মাহত ততটাই কৌতূহলী – নাহ্, কাম আবার কীসের! এই একই ঘরে আছি তো…।

এই একই দুনিয়ায় সবাই আছি, সবাই সবার নাম জানি?

আহা, পৃথিবী আর একটা ঘর, এক হলো!

হইল না। একই রকম।

না। তফাৎ আছে।

নাই।… আচ্ছা শুনেন। মানুষ একই ঘরে দিনের পর দিন থাকে। নাম জানে কিন্তু কেউ কাউরে চিনে না। তো, চিনেই না যখন, নাম দিয়া কী করব! ফালাইব?

ঠিক কথা। তবে নাম শোনার মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে, একটু একটু করে চেনাজানার চেষ্টা…।

কী লাভ!

কী ক্ষতি?

যেইখানে লাভ নাই, সেইখানেই ক্ষতি।

এত কথা প্যাঁচান। নাম বললে ক্ষতি নেই।

কী অত্যাচার!

বলেন।

তালা বাবুল।

তালা বাবুল মানে।

তালা বাবুল মানে তালা বাবুল।

বাবর হাসি চাপল – বুঝেছি।

কী বুঝেছেন, অ্যাঁ? আমি মাস্তান, এইটা বুঝছেন?

ওই, হলো আর কি। ব্যাপার না – তালা বাবুল। শুনতে কিন্তু ভালো লাগে।

ঠিক বলছেন। পরথমে নাম ছিল – তালা-চাবি বাবুল। পরে ভাইবা দেখলাম, এত বড় নামে সময় লাগে। বন্ধুদের কইলাম – অই চাবি বাদ দে। শুধু তালা রাখলাম।

মানে তালা বন্ধ হয়ে গেল।

কী!

চাবি আর থাকল না। শুধু তালা।

শুধু তালা। গেইটলক।

নামটা এমন হলো কেন! তালা-চাবি বাবুল বা তালা বাবুল। নাম যে আসলে বাবুল…।

বাপে তালা-চাবির কাজ করত।

তার সঙ্গে আপনার নামের কী সম্পর্ক?

আমিও বাপের লগে কিছুদিন তালা-চাবির কাজ করছি।

ওহ্।

লাইনে আসার পর আমার নাম হইল তালা-চাবি বাবুল।… তারপরে তালা বাবুল।

তালা-চাবির কাজটা খারাপ ছিল? আয়-ইনকাম কম, ভালো লাগে না – এইরকম?

তালা বাবুল উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকল।

নাকি কাজটা শিখতে পারনি?

আমি?… সব তালা খুলতে পারি। সব। কী ভাবছেন।

চাবি বানিয়ে নিতে?

সব তালার চাবি লাগে না। সেইগুলার ভিন্ন সিস্টেম।

এক অর্থে সেগুলোও চাবি। তাই না?

তালা বাবুল একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল – হইতে পারে। তালার লগে চাবিই যায়।

তোমার নামটা কিন্তু ভালো লেগেছে – তালা বাবুল।

একবার বলছেন।… এই নামে প্রেস্টিজ কম।

কেন কেন!

মনে হয় – শুধুই তালা, চাবি নাই। মনে হয় তালা একবার দিলে আর খুলনের ব্যবস্থা নাই। তালা-চাবিতে এই পবলেম ছিল না। এইটায় লুলা লুলা মনে হয়।

লুলা?

হ। পুরা না।

এটা আমি আমার উপন্যাসে ব্যবহার করব।

কী!

কিছু না। তা বাবুল, তুমি গুলি খেলে কীভাবে?

কীভাবে?… আচ্ছা, এই গুলান কুনো ব্যাপার!

কোনগুলো?

এই যে গুলি খাওয়া।

ব্যাপার না!

ক্যান, আপনি খান নাই?

বাবর থতমত খেয়ে গেল – তা একটু খেয়েছি।

একটু কেন, পুরাই খাইছেন।

আচ্ছা, পুরোই।

তাইলে? আপনে গুলি খাইছেন, আমিও খাইছি। আমরা দুইজনায়ই গুলি খাইছি – ব্যাপার হইছে এই এইটুকান।

কিন্তু আমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি।

কী বুঝবেন?

কেন গুলি খেলাম।

আরে, এইটার মধ্যে বুঝনের কী আছে!… আমার এই আন্দাজ ছিলই।

আন্দাজ! কিসের আন্দাজ?

একদিন না একদিন – খামু।

কিন্তু আমার ধারণায় ছিল না।

এইটা যার যার তার তার আন্দাজ।… আবার আপনার আন্দাজ যে ভুল, এইটাও ঠিক।

কেন! ভুল হতে যাবে কেন!

থাকবেন – কিন্তু কখনো গুলি খাইবেন না – এইটা হাউসের কথা।

আমার কথাটাই স্বাভাবিক, বুঝেছ।… তোমাকে তুমি করে বলছি, তুমি ছোট আমার।

তুমি, তুই – যা ইচ্ছা, অসুবিধা নাই। আপনার যেইটায় আরাম।

শোনো, আমার কথাটাই স্বাভাবিক। বুঝেছ?

জি না, কথা ঠিক আমার। প্রমাণ পান নাই?

বাদ দাও, বাবুল। এই তর্ক শেষ হবে না।

বাদ।

তার চেয়ে আপনি বরং…।

আবার আপনে ক্যান! তুমি কইরাই বলেন। বয়সে বড়, নিজেই কইলেন। ইজ্জতেও যে বড়, এইটা আপনার চেহারা দেইখা বুঝতেছি।

আমার কাছে কিন্তু সব মানুষের ইজ্জত সমান।… যাকগে, তুমি বরং ওই ঘটনাটা আমাকে একটু ভেঙে বলো।

গুলি খাওনের?

হুম।

ধুর, ইচ্ছা করতেছে না। আর গুলি তো খাইয়াই গেছি।

আহা, বলোই না। আমার শুধু মনে আছে আমি পার্কে বসে ভাবছিলাম…।

তারপর আপনে একজন হইয়া গেলেন।

একজন?

একজনরেই দরকার ছিল।

তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

গোলাগুলিটা কীসের জন্য ছিল, এইটা বুঝলেই আমার কথা বুঝবেন।

গোলাগুলিটা কীসের জন্য ছিল?

যে-কুনো একজনরে ফেলানোর জন্য।

সেইটা ক্যামনে বলব! আমাদের কাম তো ফেলানো। কেন ফেলানো – এইটা না।

কী আশ্চর্য!

তাজ্জবের কথা কন। এর মধ্যে আশ্চর্যের কী দেখলেন!

তোমাদের ইচ্ছা হবে আর একজনকে তোমরা…।

যে-কুনো একজনকে…।

সেটা আরো খারাপ। তোমাদের ইচ্ছা হবে, আর যে-কোনো একজনকে…।

এইটা তো আমাদের ইচ্ছা না। কাম। রুজি। এইটা আমাদের রুজি।

তা হলে ইচ্ছাটা কার!

আজাইর‌্যা প্যাঁচাল পাড়েন। ইচ্ছা কার – এইটা আমি ক্যামনে বলব!

বুঝেছি।

কী?

কারো না কারো ইচ্ছা।

বুঝছেন। কারো না কারো। কিন্তু কার – এইটা জানার উপায় নাই।

আছে।

ক্যামনে?

খুঁজে বের করব।

আপনে!

হ্যাঁ।

আচ্ছা, কইরেন।

আমার জেদ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। আচ্ছা।

আমার সঙ্গে থাকবে তুমি?

কই?

যারা আছে পেছনে, সেটা খুঁজে বের করতে।

তালা বাবুল কোনো উত্তর দিলো না।

কী হলো! কিছু একটা বলো।

এবারো কোনো উত্তর এলো না।

দেখো, শুধু আমি না, গুলি তুমিও খেয়েছ।… আচ্ছা, তুমি গুলি খেলে কীভাবে?

ভাবছিলাম পার্টি আমরা একটাই। কিন্তু আমগো পেছনে সেকেন্ড পার্টি আছে, তারাও আইসা পড়ব, এইটা আমাদের আন্দাজে ছিল না।

সেকেন্ড পার্টি! সেকেন্ড পার্টি কেন এসেছিল?

সেইটা তারা কইছে আমাদের!… ধইরা নেন, ফালাইতেই আসছিল।

হতে পারে। তোমরা যেমন এসেছিলে, ওরাও তেমনি।

হইতে পারে। তো আমি গুলি খাইলাম মন্নাফের।

এই মন্নাফটা কে?

আমরা এক মহল্লায় থাকি। দোসিত্ম আছে। কাল সন্ধ্যায়ও চা-পুরি খাইলাম একলগে। অপারেশন যে ওরও আছে, এইটা আমি জানতাম না।

কেন! এসব তোমরা বন্ধুদের সঙ্গেও আলোচনা করো না?

নাহ্। সে তো পুলিশের লোকও হইতে পারে…। আসলে নিয়মই হইতেছে এইসব সিক্রেট রাখা। কই, মন্নাফও তো আমারে কিছু কয় নাই।

কিন্তু তোমরা একদলে না থেকে দুই দলে কেন গেলে!

এইসব কী কন! এইসব কি আমাদের! আমগো সঙ্গে পার্টি চুক্তি করে। অপারেশনে যাওয়ার আগে পার্টি যন্ত্রও দেয়, আমরা গিয়া ফুটাই। তারপর যন্ত্র ফেরত দিয়া বাড়ি ফিরি।

ইন্টারেস্টিং! তোমাদের নিয়ে দেখছি উপন্যাস লেখা যাবে।

কী ল্যাখা যাবে!

উপন্যাস।

উপন্যাস।… কাহিনি?

হু-ম-ম, ঠিক। কাহিনি।

তালা বাবুল একটু হাসল, বাবর বুঝতে পারল না, বাবুল বলল – লেইখেন। কত কাহিনি! তবে আপনেরে ওপরে উঠতে হবে।

ওপরে।

যত ওপরে উঠবেন, কাহিনি তত বেশি। নিচে কাহিনি কম। কাহিনির রকমও এক।

উঠলাম। ধরে নাও, উঠলাম। তুমি থাকবে আমার সঙ্গে?

আপনার লগে? এইখানে আমার কী কাম!

একজন সঙ্গী দরকার না? তাছাড়া কত রাস্তা তুমি চেনো, আমি চিনি না।

আমিও চিনি না। আমার কাম যাওয়া-আসা।

শোনো, ভাবো।

এইখানে ভাবনের কী আছে!

কে এসব ঘটাল, তোমার জানতে ইচ্ছা করে না?

তালা বাবুল হাই তুলল – ঘুম পাইতেছে।

বাবর ব্যস্ত হয়ে পড়ল – হ্যাঁ হ্যাঁ, ঘুমানো দরকার। তোমার রেস্ট দরকার। ডাক্তার বললেন, তোমার হার্টের অবস্থা ভালো না।

বাবুল অবাক গলায় বলল – ডাক্তার আমার হার্ট পাইল কই!

আহা, ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলেছেন।

তাগো পরীক্ষার খ্যাতা পুড়ি।

শোনো, তুমি তো আর ডাক্তার না।

তাগো বাপ। যার হার্ট নাই, তারও হার্ট খুঁইজা বাইর করছে…।

রেগে আছ, বোঝা যাচ্ছে।

ঘুমাই।… আম্মার কথা খুব মনে পড়তেছে।

খবর পেয়েছেন? খুব বোধহয় কান্নাকাটি করছেন।

আমার জন্মের দুইদিন পর আম্মা মারা যান। তার কান্নাকাটি করার কোনো সুযোগ নাই।

বাবরের মনে হলো, তালা বাবুল সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল। তারও অনেক ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে, বাবরের এমনও মনে হলো – তারও ঘুমিয়ে পড়া উচিত। সে চেষ্টা করল ঘুমানোর, চোখ বন্ধ করে রাখল, স্থির থাকতে চাইল, কিন্তু তার ঘুম এলো না। বরং সে দেখল, চোখ বন্ধ করলে কয়েকটি স্থির দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে থাকছে। সে পার্কের বেঞ্চে বসে আছে, সে তার উপন্যাসের কথা ভাবছে, হঠাৎ গুলির শব্দ, সে চোখ বন্ধ করে দৌড় দেবে, না বেঞ্চের পেছনে লুকাবে – ভাবছে, হঠাৎ গুলির শব্দ, হঠাৎ শরীর মাটি থেকে তুলে ফেলার মতো ঝাঁকুনি…। এসব দৃশ্য ঘটনার সময় চলমান ছিল, এখন খ- খ- স্থির। স্থির, তবে চেপে বসাও। বাবর কয়েকবার চোখ বন্ধ করে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে সেটা বন্ধ করে দিলো। কারণ সে দেখল, চোখ বন্ধ রাখতে গেলে ওই দৃশ্যগুলো বাড়তি ওজন নিয়ে ফিরে চেপে বসে। ঘুমানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে সে অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করল। এই যেমন, তার গুলি খাওয়ার কথা কি সবাই জেনে গেছে? তার বাড়িঅলা, বিভিন্ন পর্যায়ে তার বন্ধুরা, ইকবালভাই, রোজ… জেনে গেছে? পত্রিকায় এ-ঘটনাটা অবশ্যই আসা উচিত, তার মনে হলো। সে লেখক হিসেবে ফেলনা নয়, তাকে সবচেয়ে প্রতিশ্রম্নতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তার গুলি খাওয়ার ঘটনাটাও ব্যতিক্রম। সুতরাং পত্রিকায় এই ঘটনা অবশ্যই এসেছে।… আচ্ছা, এসেছে যখন, কেউ কি তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি? একটা সমস্যার সমাধান সে করতে পারছে না – ঘটনাটা কবের। যদি আজ বিকালের ঘটনা হয়, আর, এখন মাঝরাত, তবে পত্রিকায় আসার সুযোগ নেই। হয়তো তার পরিচিতজনদের কাছেও খবরটা পৌঁছায়নি। পৌঁছালেও দু-তিনজনের কাছে। আবার, এমনও হতে পারে, ঘটনাটা দু-তিনদিন আগের। এই দুতিনদিন সে ও তালা বাবুল, তালা বাবুলের কথা নিশ্চিত করে বলতে পারবে না, অজ্ঞান অবস্থায় ছিল। এমন হলে পত্রিকায় এসেছে খবর, ফলোআপও এসেছে, তা হলে অনেকেই নিশ্চয় এসেছে তাদের সঙ্গে দেখা করতে। এসেছে, হয়তো দরজার কাছ থেকে একপলক দেখে চলে গেছে, কিংবা ডাক্তাররা তাদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সে সুযোগটুকুও কাউকে দেননি। আচ্ছা, ঘটনাটা আজ বিকালের হলে বিকালের ঘটনাই মনে হচ্ছে তার, সবকিছু এমন স্পষ্ট, টিভি চ্যানেলগুলো, ওরা সার্চলাইট ফেলে খবর খুঁজে বেড়ায়, দৌড়াদৌড়ি করে হাসপাতাল অস্থির করে ফেলত।… আর, পুলিশ, পুলিশ কি একবারও আসেনি।

যাই হোক, বাবর আজমের নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছে। তালা বাবুল, যদিও তার সঙ্গে অনেকক্ষণই কথা বলল, তার অবস্থা সে বলতে পারবে না। তার মনে হচ্ছে তালা বাবুলও সুস্থ, কিন্তু সে ডাক্তার না। তার মনে না হলে ডাক্তাররা তালার অবস্থা আশঙ্কাজনকই বলে গেছেন। তার ব্যাপারে তেমন কিছু বলেননি, কথা কম বলতে বলেছেন অবশ্য, তা, কথা সে বেশিই-বা বলে কখন। কাল যখন, কাল নিশ্চয় আসবে অনেকে, সে তাদের সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলবে। তারা নিশ্চয় বলবে অনেক, নানাজন নানারকম, এরকম ভেবে বাবর আজমের বেশ আনন্দ হলো, চারপাশে পরিচিত মুখের ভিড় – মজাই আলাদা।

এসবের মাঝেও, তালা বাবুলের অবস্থা ভালো নয় – এটা তাকে ভাবাচ্ছে। সে চায় তালা বাবুল সুস্থ হয়ে উঠুক। বাবুলকে তার দরকার। সে এর মধ্যে ঠিক করে ফেলেছে সাপস্নাই-ব্যবসা নিয়ে উপন্যাস সে লিখবে না। সে উপন্যাস লিখবে তার এই আচমকা, আপাত-অহেতুক ঘটনা নিয়ে। সেখানে তালা বাবুলও থাকবে। প্রধান চরিত্র অবশ্যই সে, বাবুল হবে দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র। যা যা ঘটেছে, তারপর তালা বাবুল যা বলেছে ও আরো যা বলবে, তা-ই লিখবে সে। পার্কে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ গুলি খেল সে। গুলি খেল তালা বাবুলও। তারা দুজন ভর্তি হলো একই হাসপাতালে। পাশাপাশিই বেড তাদের। এসব মিল আছে তাদের। অমিলের মধ্যে হলো, তালা বাবুল গভীরভাবে ভাবতে চায় না, তেমন ইচ্ছাও তার নেই, আর, সে চায় পেছনের কথা জানতে। নেপথ্যের কথা খুব যে বেশি জানে বাবুল, তার কথা শুনে তেমন কখনো মনে হয়নি, তবে যেটুকু বলেছে। নিশ্চয় তার চেয়ে বেশি জানে সে। সে-কথাই বাবর তার কাছ থেকে একটু একটু করে শুনবে, আবিষ্কার করবে নেপথ্যের ঘটনা বা গল্প, দেখবে – কারা আছে গুলির পেছনে, কেনই-বা আছে। এই নিয়ে তৈরি হবে তার উপন্যাস। এই নিয়ে হবে তার উপন্যাস। হবে না? এটা একটা ভালো উপন্যাস হবে না? সে জিজ্ঞেস করল নিজেকে – বাবর আজম, তোমার নিজের কী ধারণা? উপন্যাসটা কেমন হবে?

ভালো।

এত ছোট করে বললে।

বেশ ভালো। আগে যেটা নিয়ে ভাবছিলে সেটার চেয়ে ভালো হবে কিনা, বলতে পারছি না।… কারণ আছে।

কিন্তু এটার বিষয় আমার কাছে অনেক ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

সেটা ঠিক আছে। সে-বিষয়ে আমি একমত।

তা হলে?… আমি এটা লিখতে পারব না গুছিয়ে? মানে নতুন বিষয়… ?

তোমার হাতে সময় কম, বাবর।

কথা ঠিক।… আবার আমার হাতে সময় কমও না। লেখা জমা দেওয়ার জন্য মিনিমাম দেড়-দুমাস সময় আছে আমার হাতে।

ওই দুমাস তো লিখতেই যাবে।

তা যাবে।

তা হলে খুঁজবে কখন?

হু-ম-ম…।

কাঠামো দাঁড় করাবে কখন? তোমার অনেক তথ্য দরকার, না? সেসব জোগাড় করার আর বোঝার সময় আছে তোমার হাতে?

কাজটা অবশ্যই কঠিন…।

কঠিন না, অসম্ভব।

আচ্ছা, সময়ের কথা বাদ দাও। লিখতে পারলে এটা কেমন হবে?

নতুন ধরনের।

আহা, আরেকটু প্রশংসা করো না যে এমন একটা বিষয় আমার মাথায় খেলেছে। ব্যাপারটা হবে এরকম – ঘটনাচক্রে একইসঙ্গে গুলি খেয়েছে যে দুজন, সে-দুজন এক হয়ে বেরিয়ে পড়েছে ঘটনার জট খুলতে…।

এই ভাবনাটা আমার পছন্দ হয়েছে। যেন পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে লেখক এসেছে। একটার পর একটা পরত খুলছে…।

তবে কাজটা সত্যিই কঠিন।

এ-কথাটাই আমি বলেছি। বলেছি – অসম্ভব।… একটা কথা কি ভেবেছ?

কতদূর যেতে পারব?

হ্যাঁ, কতদূর? তালা বাবুল তোমাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারবে? সে ভাড়াটে মাত্র। তাকে যেটুকু করতে বলা হয়, সেটুকুই সে করে। তার কাছে বাড়তি তথ্য থাকে না।… নেইও। এটা তুমি নিজেই দেখেছ।

এসব ভেবেছি আমি। আমার কাছে এই কথাও ঠিক – ক্লু থাকেই। ধরো, তালা বাবুলকে কেউ ভাড়া করেছে। যে তালা বাবুলকে ভাড়া করেছে, তাকেও নিশ্চয় কেউ ভাড়া করেছে। আবার তাকেও কেউ না কেউ করেছে।

প্রতিনিয়ত আমাদের কেউ না কেউ তো করছেই।

বাজে কথা বাদ দাও। প্রসঙ্গে আসো। আমি তালা বাবুলকে ধরে উৎসের দিকে যেতে চাই।

চেষ্টা করে দেখতে পার।

দেখব।

পথের মাঝখানে হাপিস হয়ে গেলে?

বাবর চুপ করে গেল। সে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর কিছুটা ব্যাকুল, কিছুটা অস্থির গলায় বলল – কিন্তু এ-উপন্যাস আমি লিখব।

দাঁড়াও।

কেন!

রোজ এসেছে।

কে?

রোজ। তোমার রোজ।

হেসো না। রোজ আমার না কার – এটা হাসির কিছু না। কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে?

আমার মন বলছে।

বাবর আজম নিজের অনুমানশক্তি দেখে অবাক হয়ে গেল। রোজ সত্যিই এসেছে। দরজায় আওয়াজ হলে বাবর ফিরে তাকাল। প্রথমে একজন নার্স – আপনার গেস্ট, কিন্তু মনে রাখবেন, কথা বেশি বলা একেবারেই নিষেধ – তারপর রোজকে দেখা গেল দরজায়। রোজের চেহারায়, দূর থেকেও বাবর টের পেল, উদ্ভ্রান্ত ভাব। সে নীল রঙের একটা সালোয়ার-কামিজ পরেছে। গলার কাছে কাজ করা। বাবর রোজকে কখনো নীল পরতে দেখেনি। নীল পরলে তাকে কেমন দেখাবে, রোজকে নিয়ে বহুকিছু ভাবলেও এটা ভাবেনি। এখন নীল রঙে রোজকে দেখে তার মনে হলো, এই রং তৈরিই হয়েছে রোজের জন্য। আগে যারা নীল পরেছে, কিংবা ভবিষ্যতে যারা পরবে, তাদের দেখে কেউ বুঝবে না – নীল আসলে কী! তবে রোজের চেহারায় উদ্ভ্রান্ত ভাব। তাকে একই সঙ্গে অস্থির ও বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। সে যখন মৃদু পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল, বাবরের মনে হলো রোজের গালে কান্নার দাগ শুকিয়ে আছে। এই শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ রোজের সৌন্দর্য যেন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাবর টের পেল, সে প্রবল আনন্দ অনুভব করছে। এই যে রোজের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে শুকনো কান্নার দাগ, বাবর মুগ্ধ হলেও, সে আনন্দিত হলো এই কারণে যে, রোজ তার জন্য কেঁদেছে।

বাবর দেখল রোজ তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। তারও রোজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার ইচ্ছা করল। সে লজ্জাবোধ করলেও তাকিয়ে থাকল, হঠাৎ তার একটু অভিমানও হলো – রোজ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সরাসরি না হোক, সে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে আগ্রহী নয় – বাবরের মনে হলো, যদিও রোজ শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ নিয়ে ছুটে এসেছে, তবু একটু অভিমান তার হতেই পারে। অভিমানে সে মুখ ফেরাল।

রোজ মৃদু গলায় তাকে ডাকল – বাবর…।

বাবর ঠিক করল এই একবারেই সে রোজের ডাকে সাড়া দেবে না।

রোজ আবার ডাকল – বাবর…।

সেই ডাকের মধ্যে কী ছিল, সেই ডাক যেন বহুদূর থেকে সম্মোহনের শক্তি নিয়ে ভেসে এলো, বাবর যেন এলোমেলো হয়ে গেল। সে চোখ ফেরাল, বলল – বলো, রোজ।

রোজ বলল – বাবর…।

বলো…।

বাবর…।

থাক, বোলো না, আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি।

সে আর রোজ পরস্পরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল।

এভাবে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। একসময় রোজ হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল, রোজের হাত উষ্ণ ও কোমল, বাবর রোজের হাতের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকল। রোজ বলল – বাবর…।

বাবর হাসল – বলো এবার।

রোজ দুচোখের কোণ মুছে নিল – তুমি একসময় উষ্ণ ছিলে। কী প্রাণময়। আমি কোনোদিন তোমাকে স্পর্শ করিনি, কিন্তু আমি তোমার উষ্ণতা টের পেতাম।

আর এখন বুঝি আমি শীতল! বোকা মেয়ে! আমি এখনো তেমনই উষ্ণ আছি, তেমনই প্রাণময়।

একটুকরো ম্লান হাসি রোজের মুখে ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল।

রোজ…।

বলো, বাবর।

তুমি এসেছ, আমি কী যে খুশি হয়েছি!

তোমার এমন একটা ব্যাপার, বাবর… আমি, আমি আসব না!

বাবরের চোখ ভিজে গেল। তার ইচ্ছা করছে রোজের হাত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরার, সে জোর পাচ্ছে না, তার মনে হচ্ছে – রোজ কি পারে না তার হাত আঁকড়ে ধরতে!

রোজ। সে বলল।

বলো।

রোজ…।

বলো। বাবর।

কিছু বলব না।

তা হলে!

তোমার নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছা করছে শুধু।

ডাকো, বাবর। তোমার যত ইচ্ছা ডাকো।

তুমি কি প্রতিবার আমার ডাক শুনবে?

শুধু আজ কেন, আমি জানি, দশ বছর পরে হোক, কিংবা পনেরো বছর কিংবা আরো পরে – তোমার ডাক আমি শুনতে পাব।

এতদিন… এতদিন। বাবরের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। এতদিন এই কথাগুলো তুমি কেন বলোনি!

রোজ হাঁপিয়ে ওঠার মতো শ্বাস ফেলল। কিছু বলল না।

বলো, বলো কেন বলোনি।

কী বলব! রোজ মৃদু গলায় বলল। আমি হয়তো নিজেই বুঝতে পারিনি।

এখন পারছ?

তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি, বাবর।

শুনি।

আমি এখন বুঝতে পারছি, আমি তোমাকে ভালোবাসতাম।

ভালোবাসতে!… এখন… ?

ভালোবাসতাম, বাবর। নিজেকে কী বলে সান্তবনা দেবো, বুঝতে পারছি না।

এখন, এখন ভালোবাসো না!

বাবর, আমি এখন যাব।

বলে যাও।

আর কিছু যে বলার নেই।… যাই, বাবর।

যাবে? না বলেই!

যা বলার ছিল বলেছি আমি।… যাই?

আবার আসবে না?

রোজ তার হাতের ওপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল। বাবরের দিকে তাকিয়েই পেছনদিকে কয়েক পা সরে গেল। চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রম্নত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মেয়েদের আসলেই বোঝা কঠিন, বাবরের মনে হলো। কী হলো রোজের হঠাৎ করে! ভালোবাসার কথা বলে হঠাৎ দ্বিধায় পড়ে গেল। কিন্তু অতীতের কথা বলল কেন সে – ভালোবাসতাম – এখন কি সে আর ভালোবাসে না? নাকি ব্যাপারটা এরকম – যখন প্রত্যাখ্যান করেছিল, তখন সেটা ভান ছিল কোনো কারণে, আদতে তখন থেকেই সে ভালোবাসে – ব্যাপারটা এরকম?

বাবর মনে করতে পারল না, রোজ ফিরে আসবে কিংবা সে বুঝবে তার ভালোবাসা – এমন কোনো ধারণা তার কখনো ছিল কিনা। সে মনে করতে পারল না, তবে আশা ছিল তার, আশা ছিল – রোজ একদিন বুঝবে ও তার কাছেই ফিরবে।

রোজ কি ফিরল?

কাল সে আসবে আবার?

কাল না হোক, পরশু।

কিংবা আরো কয়েকটা দিন পরে?

বাবর কলবেল বাজিয়ে নার্সকে ডাকল। নার্স যেন দরজার পাশেই ছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে ঢুকে পড়ল।

সিস্টার, আমাকে একটু দেখে দেবেন?

খারাপ লাগছে?

বুঝতে পারছি না।

আমি কি আর সেভাবে বুঝব। এসব স্যারদের কাজ।

তবু…।

নার্স এগিয়ে এসে তার পালস দেখল, প্রেসার দেখল, চোখ দেখল, জিভ দেখল। বলল – সবকিছুই নরমাল মনে হচ্ছে।

আমার আসলে মন ভালো হয়ে গেছে।

ভালো খবর। যে-পেশেন্টের মন ভালো থাকে সে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে।

রোজ কি চলে গেছে?

রোজ কে?

এই যে একটু আগেই একটা মেয়ে এসেছিল না আমার কাছে…।

ওহ্, তিনি। হ্যাঁ, চলে গেছেন। বারবার চোখ মুছছিলেন…।

কেন চোখ মুছছিলেন, জানেন?

না। অনুমান অবশ্য করা যায়… আপনার এই অবস্থা…।

ঠিক। তবে আরো একটা কারণ আছে। আপনাকে আরেকদিন বলব।

আচ্ছা। নার্স ফিরল। দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল – বাইরে কিন্তু আপনার অনেক গেস্ট।

কারা?

আহা, আমি কি তাদের চিনি! কিন্তু ডাক্তার-পুলিশ দুপক্ষেরই গেস্টের ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। শুধু আপনার ওই রোজ কীভাবে কীভাবে যেন…।

ওর কথা আলাদা। আর কারো সঙ্গে আমার এখন দেখা করতে ইচ্ছা করছে না। আমি ক্লান্ত, খুবই ক্লান্ত।

 

তিন

শরাফত খুবই বিচলিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে। তার অস্বসিত্ম তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে। মেজবা বসে আছে সোফায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে-ও খুব একটা স্বসিত্মতে নেই। শরাফত পায়চারি করছে ও মাঝেমাঝেই মেজবার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। এরকম এক ফিরে তাকানোর সময় সে হঠাৎই পায়চারি থামিয়ে মেজবার সামনে এসে দাঁড়াল – কও।

শরাফতের ‘কও’ শুনে মেজবার অস্বসিত্ম বেড়ে গেল।

শরাফত বলল – চুপ কইরা থাইকো না, কও।

আসিফ সাবেও পার্টি পাঠাইব, এইটা ভাবি নাই।

ক্যান!

মেজবা শরাফতের দিকে তাকাল একবার, চোখ নামিয়ে নিল।

কী ভাবছিলা? একা একা ফুটবল খেলবা? এইদিকে গোল দিলেও তোমার, ওইদিকে গোল দিলেও তোমার?

শরাফতভাই…।

কও। কইয়া ফ্যালাও।

শরাফতভাই, আপনেও কিন্তু আন্দাজ করতে পারেন নাই।

শরাফত কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকল মেজবার দিকে, ঠান্ডা, স্থির গলায় বলল – শুনো দুইখান কথা কই। একখান হইল, ভাই ডাকবা না, ভাইয়ের গুষ্টি কিলাই আমি। দুইখান অর্থাৎ পরেরখান, হইল – আমারেই যদি রাখতে হয়, তোমারে রাখছি ক্যান!

আপনেও কিন্তু কিছুই জানতেন না।

মেজবা… আরে মেজবা, তুমি কথা বাড়াইতেছ ক্যান! মিজাজ ঠান্ডা করছি মাত্র।

শুনেন।… শরাফতভাই, সবকিছু এখনো আমাদের হাতেই।

একটার জায়গায় দুইটা পড়ছে, তাও?

যাহা একটা তাহা দুইটা, যাহা দুইটা তাহা একটা – পাবলিক।

পাবলিকের চিল্লানি জীবনে শুনো নাই, মেজবা?

পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, যতগুলা পারছি, হাত করছি।

ফেসবুক, না কী একটা আছে না, সেইটার মালিকরে হাত করবা?

না।… মালিকের নিজেরই অনেক টাকা। শুনেন, মিডিয়া বন্ধ হইলে ফেসবুকও বন্ধ। একটাই সমস্যা, যা ইচ্ছা লেখে।

শরাফত একটু ভাবল – না, এইটা সমস্যা না, সুবিধা। ওইরকম শুরু হইলে তুমিও যা ইচ্ছা তা-ই লেখবা।

জি। মেজবা মাথা নাড়ল। তবে মিডিয়া সামাল দিতে পারলে…।

সেই চেষ্টা তো আসিফও করব। করব না?

কথাবার্তা শুইনা মনে হইল আসিফ সাব, মানে রাহাত আগে যোগাযোগ করে নাই। আমি তো পনেরো দিন আগেই এদের হাত করছি।

দেখবা, তোমার রাহাতও এই কাম করছে। আর, সাংবাদিকগো বিশ্বাস করবা না। দুইদিকের পয়সা খাইতেছে কিনা – এইটা আগে বুইঝা নিবা।

দেখেন ভাই, পত্রিকায় দুই রকম লেখালেখি হইছে, এইটা কিন্তু ভালো।

শরাফত মেজবার সামনে থেকে সরে গেল। সরে সে দূরে গিয়ে বসল। মেজবার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল অনেকটা সময়। তারপর গলা তুলল – এইটার মধ্যে ভালো দিক কী, সেইটা বুঝাও আমারে।

এইটা সহজ, শরাফতভাই। এইটা ধরেন, জটিলতা বাড়বে।

জটিলতা বাড়লে ভালো দেখতেছ? কী কও এইসব!

ভাবেন, শরাফতভাই। ঠান্ডা মাথায় ভাবেন। যতই জটিলতা, ততই ফাঁক দিয়া বাইর হইয়া যাওনের সুযোগ।

শরাফত কিছুক্ষণ মেজবার দিকে তাকিয়ে থাকল – বুঝলাম। কিন্তু তুমি এইটার মধ্যে ফাঁকটা কোথায় দেখতেছ?

চলেন, কাল সামাদভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি।

তুমি হারিস, মোল্লা – এদের ভাগে রাখো নাই?

তারা তো আছেই।

তাইলে আবার সামাদ ক্যান! হারিসে সামলাইতে পারব না?

সামাদের লাইন কই কই, সে কদ্দুর পৌঁছাইতে পারে – এইটা আপনি জানেন।

জানি।… মানিও। কিন্তু সামাদ হইতেছে জলহসত্মী। তার পেটে অনেক জায়গা।

আপনি নিজেই বুঝেন, শরাফতভাই। কিছুদিন পর ওই জমির দাম হইব একশ কোটি। তা, আপনি বিশ-পঁচিশ কোটি আলাদা রাখবেন না?

রাখলাম।… কিন্তু সামাদরে পাওয়া কঠিন।

ব্যবস্থা করব?

করো।… থানার খবর কী?

থানা ঠিক আছে।

ওপর থেইকা চাপ আসলে ঠিক থাকব?

সময় দিব। টাইম কিল করব।… আর, চাপ যেন না আসে সেই চেষ্টা আমরা নিতেছি।

হু-ম-ম।… নিউজ কেমন হইব, ঠিকমতো ব্রিফ করছ?

একদম।… দুইটা ঝামেলা অবশ্য আছে এইখানে।

আবার ঝামেলা! তুমি কি ঝামেলা সব জড়ো কইরা নিয়া আসছ!… কও।

এক, সব পত্রিকা সব চ্যানেল সব সাংবাদিক পয়সা খায় না।

কী খায়? মদ? মেয়ে? উপহার খায়, উপহার? গিফট, গিফট?

ধরেন, কিছুই খায় না।

খুবই ভালো। সৎমানুষ। যারা খায়, তাগো বেশি কইরা খাওয়াও।

জি।… দুই নাম্বার হইল, তারা সিন্ডিকেট কইরা রিপোর্ট না করলেই সমস্যা নাই।

সেইটা কী?

সবাই মিলে বসে ঠিক করল রিপোর্ট কীরকম হইব।

অ!… নজর রাখছ?

ভাববেন না। লোক লাগায়া রাখছি।… সমস্যা আরেকটা আছে।

আহা রে, সমস্যা দেখি শ্যাষ হয় না।… এইবার কী?

পড়ার ছিল একটা, পড়ছে দুইটা।

এইখানে একটা দুইটার কী তফাত, মেজবা? তুমিই না বললা পাবলিক একটা পড়লেও যা, দুইটা পড়লেও তা-ই!

তখন আপনে মেজাজে ছিলেন, তাই বলি নাই। ধরেন, এমনিতে একটা-দুইটা বা তিনটায়ও কোনো সমস্যা নাই।… কিন্তু যে দুইজন পড়ছে, তার একজন হইল লেখক। খুব নামকরা কেউ না। কিন্তু সে লেখক।

কী কও! লেখক পড়ছে, সমস্যা কী! সাংবাদিক হইলে ভাবতাম।

না, শরাফতভাই, আপনার ধারণা নাই।

লেখক পড়ছে বইলা সমস্যা?

যে-কথা আপনে বলছিলেন। ফেসবুক। ফেসবুকে হইচই আরম্ভ হইল বইলা।

শুনছি। তুমিও বললা – কিছু হইলেই লাফাইতে শুরু করে।

করুক। আপনি আমারেও লেখাইতে বললেন না। প্রয়োজন পড়লে লেখাব। প্রয়োজন পড়লে দুই-তিনটা সেলেবরে হাত কইরা ফেলব।

কী রেব?

সেলেব। ফেসবুকে সেলিব্রিটিরে ছোট কইরা সেলেব ডাকে। তো, তাগো আবার নানা তরিকা। এই ঘটনা কোনদিকে যায়, সেইটা দেইখা সেলেব কিনার চেষ্টা নিব। তারা নানা কথা লেইখা ঘটনা অন্যদিকে ঘুরায়া দিব।

শুনো, লেখক যখন – এইটাও বলাইতে পার। বলল – ওই মাঠে পতিতাগো আড্ডা ছিল। লেখক ওই মাঠ থেইকা পতিতা ভাড়া নিত। একদিন এক মাস্তানের বান্ধা পতিতা নিয়া জোরাজুরি করলে মাস্তান তারে গুলি করে…।

এইটা ভালো বুদ্ধি। লেখক আর পতিতা ভালো যায়। তবে ডিসিশন এখনই না, হইচই আরম্ভ হইলে পরিস্থিতি বুইঝা ডিসিশন নিব।

আচ্ছা, অন্য যেইটা পড়ছে, সেইটা তো মাস্তান, না?

হালকা মাস্তান। ওরে নিয়া ঝামেলা নাই।… এখন চলেন, সামাদভাইয়ের বাড়ি যাই।

এখন? রাত হইছে। বারোটাও পার হইছে সেই কখন…!

এইটাই সময়, ভাই। সামাদভাই ভোরবেলা পর্যন্ত এইসব কাজ করেন। তারপর দুপুর পর্যন্ত ঘুমান।

এখন ফ্রি পাব?

ব্যবস্থা করব। চলেন।

 

রইসুদ্দিনের শরীরটা বিশাল, যেমন সামনে তেমন দুপাশে। তার ভুঁড়ি দেখে মনে হতে পারে ওটা দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল। এই ভুঁড়ির জন্য তাকে অবশ্য কোনো পরিশ্রম করতে হয়নি, ওটা হয়েছে। রইসুদ্দিনের কাজ হচ্ছে ওটা টিকিয়ে রাখা। সে দিনের মধ্যে অন্তত দশ-বারোবার বলে, আমি বাঁচব না, আমি বেশিদিন বাঁচব না। সিক্স প্যাকের এই যুগে এমন শরীর নিয়া কেউ বাঁচে! তবে ভাই, যতদিন বাঁচি, হেসেখেলে…!

এখন রইসুদ্দিন হাসছে, তার হাসির দমকে শরীরসহ চারপাশ কাঁপছে। তার সামনে মঞ্জুর ইকবাল বসে আছে। সাংবাদিক। তবে যত-না সাংবাদিক তার চেয়ে অনেক বড় সাংবাদিক নেতা সে। সাংবাদিক মঞ্জুর ইকবালের মুখে বিরক্তি।

রইসুদ্দিন হাসতে হাসতে তাকে জিজ্ঞেস করল – কী, খেপছ, খেপছ আমার ওপরে?

মঞ্জুর ইকবাল জবাব না দিয়ে মুখ থেকে বিরক্তির ভাবটা সরানোর চেষ্টা করল।

রইসুদ্দিন সেটা সহজেই ধরতে পারল – এই তো, লাইনে আসতেছ…।

মঞ্জুর ইকবাল হাসল – রইসভাই, আপনি না… !

মিছা কথা কী কইছি কও? দালালি করো না?

আচ্ছা রইসভাই…।

এগো কাছ থেইকা কত নিছ, সেইটা আগে কও, তারপর কথা শুরু করি।… এই যে ভাই, রইসুদ্দিন সামনের দিকে হাত তুললেন। মঞ্জুরে আপনার সঙ্গে কততে চুক্তি করছে? ঢাকা শহরে এর কিন্তু চারটা ডিলাক্স ফ্ল্যাট, আরেকটা কিননের ধান্ধা করতেছে, এরে কম দিবেন না।

একটু দূরে সোফায় আসিফ আর রাহাত বসা। অন্য সময় হলে রইসুদ্দিনের রসিকতা তারা নিশ্চয় উপভোগ করত। এখন পারছে না, এখন তাদের সময় কম, এখন তাদের জরুরি কথা সেরে ফেলা দরকার।

তবু, একটু হাসার চেষ্টা করল রাহাত, বলল – স্যার, মঞ্জুভাই আপনেরে কী যে শ্রদ্ধা করে…!

কে? রইসুদ্দিন জিজ্ঞেস করল। ইকবাল? ইক… বাল?… তারে শ্রদ্ধা আমিও করি।

রইসভাই, আপনি জানেন আপনাকে আমি কতটা ভালোবাসি? মঞ্জুর ইকবালকে এবার অভিমানী দেখাল।

আরে, ভালোবাস বইলাই তো এত রাইতে রাজি হইলাম।… মদ খাইবা?

আসিফ বলল – ভাই, আগে কাজের কথা হোক।

কাজের কথা! রইসুদ্দিন আসিফের দিকে তাকাল।

জি… আপনি…।

মঞ্জু টেলিফোনে বলছে কিন্তু…।

জি…।

তা আমার আগে কোন চোদনার কাছে গেছিলেন?

জি… ?

কী বলছি, সেইটা তো শুনছেন। তারে দিয়া হইতেছে না?

স্যার। রাহাত বলল। আপনি হচ্ছেন খাসলোক।

অ। তা, এইটা আগে মনে পড়ে নাই?

আসিফ ও রাহাত দুজনই বিব্রতবোধ করল, আর, মঞ্জুর ইকবাল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালাল – আসলে হয়েছে কী, রইসভাই…।

কী হইছে, সেইটা অনুমান করি। বলব?… আগে কাজটা ছোট ছিল এখন দুইটা লাশ পড়ার পর বড় হইয়া গেছে, না?

আসিফ ধাক্কাটা সামলে নিল – জি।

রইসুদ্দিন আসিফকে দেখল কতক্ষণ। চোখ সরিয়ে নিয়ে রাহাতের দিকে তাকাল – তিনি গুছায়ে বলতে পারবেন না। তুমি বলো।… আর, প্রথম থেইকা বলো, বাদ দিবা না। বাদ দিলে অসুবিধা হয়।

আসিফ তখনই মুখ খুলল – না না, বাদ দেবে কেন! সব বলবে।… রইসভাই, আমরা অনেক আশা করে আপনার কাছে এসেছি…।

কিন্তু পরে আসছেন। আগে আসেন নাই।

কাজ বড় ছিল না, আপনি তো বুঝলেনই, তাই ভেবেছিলাম ছোট কাজে আপনাকে বিরক্ত করা।

তারপর, যা বললাম – সেইরকম বড় হইয়া গেল কাজ?

তেমন বড় কথা।… আসল কথা হলো, আমরা সরে আসতে চাই না।

সরে আসতে হইব কিনা, এখনই সেটা বলা যায় না।

কী বলেন! আপনি থাকতে সরার প্রশ্ন ওঠে না…।

ক্যান, আমি কি ম্যাজিক নাকি? ডায়নামোর মতো রাস্তায় রাস্তায় ম্যাজিক দ্যাখায়া বেড়াই?… মঞ্জু, তোমার ওই ঘটনাটা মনে নাই, ওই যে চিনি সিন্ডিকেটের? তোমার পত্রিকায় রিপোর্ট করাইছিলা না?

সেই রিপোর্ট কাজে লাগে নাই। আরো অনেকে রিপোর্ট করছিল, সেইগুলাও কাজে লাগে নাই। আবার আপনিও হাত গুটায়া নিছিলেন।

তোমারে তো বলছিলাম পুরাটা। ভুইলা গেছ?

না, ভুলি নাই। আবার, পুরাটা মনেও পড়তেছে না।

ওই যে, সেইবার – রমজানের সময় চিনির দাম কত রাখব, সিন্ডিকেট ঠিক কইরা ফেলাইছে। মন্ত্রী তাদের ডাইকা বলল – ভাই, চিনির দাম এত-র ওপরে উঠায়েন না। তা তারা তো ঠিক করছেই, এখন মন্ত্রীর কথা নতুন কইরা শুনব ক্যান! মন্ত্রীও বোধহয় এক পর্যায়ে একটু ভাব নিয়া কথা বলছিল। সিন্ডিকেট তারে বইলা আসল – চিনির দাম কত পড়ব, সেইটা তারাই ঠিক করব।

হুম, রইসভাই, এইটা মনে আছে, মানে, মনে পড়তেছে আর কি…।

মন্ত্রী তখন কী করল, মনে আছে? সে আরেকখান সিন্ডিকেট বানাইতে চাইল। এরে-ওরে ডাইকা আইনা অভয় দিয়া কইল – তারাও যেন চিনি আনে, মার্কেট শেয়ার নেয়, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। কিন্তু লাভ হয় নাই। নতুন সিন্ডিকেট যেই মাঠে নামছে, তিনদিনের মইধ্যে তাদের দুইজন গুলি খাইল, একজনের মেয়ে আরেকজনের ছেলেরা উঠায়া নিয়া গেল, কেউ সুরাহা করতে পারল না। নতুন সিন্ডিকেটের লোকজন তখন আমার কাছে আসছিল, জেদ নাকি চাপছিল তাদের।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনেও কিছু করতে পারেন নাই, রইসভাই।

আসলে ওই কাজ আমি নিতেই চাই নাই। তবু তাদের জেদাজেদিতে জায়গামতো বলছিলাম। লাভ হয় নাই – ধমক খাইয়া ফিইরা আসছি, ওই মন্ত্রীরও মন্ত্রিত্ব থাকে নাই। সুতরাং এরা যেমন ভাবতেছে, ঘটনা সেই রকম না। আমিও ইচ্ছা করলেই সব পারি না।

রইসভাই, এইটা পারবেন। চিনি-কাজের তুলনায় এইটা নস্যি।

এখনই কিছু বলতেছি না।

মঞ্জুর মাথা নাড়ল – চিনি তেল পেঁয়াজ স্বর্ণ মাদক – যেই সিন্ডিকেটের কথাই বলেন। তাদের যে-কোনো মেম্বারের কাছে এরা হচ্ছে চুনোপুঁটি। এইটা আপনি পারবেন।

বিস্তারিত শুনি আগে… কই, রাহাত… পুরাটা…।

 

বাবরের ঘুম ভাঙল। তার নিদ্রা-পরবর্তী আচ্ছন্নভাব কাটতে সময় লাগল। তার মনে হলো, একঘুমে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। একঘুমে কখনো সে এতটা সময় পার করেনি। কব্জির দিকে তাকাল সে একবার। ঘড়ি নেই, তার মনে পড়ল, ঘড়ি থাকার কথাও না। সে ঘরের চারপাশে তাকাল, না, কোনো দেয়ালে কোনো ঘড়ি নেই। সে বিরক্তবোধ করল। মানুষের সময় জানার অধিকার আছে, নাকি? দেয়ালে ঘড়ি ও ক্যালেন্ডার দুটোই থাকা উচিত। সে গলার কাছে হাত দিয়ে দেখল। গলায় এখন ব্যান্ডেজ জড়ানো। ঘরে আয়নাও নেই নিশ্চয়, থাকলে নিজেকে সে একবার দেখতে পেত। বাংলা সিনেমায় এরকম প্রায় দেখা যায়। গুলি করল বুকে, নায়ক গুলি খেয়ে ‘ভাবিস না তুই পার পেয়ে যাবি’ বলে বুক ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, পরের দৃশ্যে দেখা গেল নায়ক মাথায় লাল ছোপঅলা ব্যান্ডেজ বেঁধে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তার বেলায় অমন কিছু হয়নি, ব্যান্ডেজ তার গলায়ই। বাবরের মনে হলো, তার আঘাতটা আসলে তেমন গুরুতরই নয়। হয়তো গলার চামড়ার কিছুটা উঠিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। না হলে খবর ছিল, বিশেষ করে যদি গলার মাঝ বরাবর গুলি লাগত। এতক্ষণে যমে-মানুষে টানাটানি চলত কিংবা সে থাকত কবরে। হয়তো এতক্ষণে কুলখানির ব্যবস্থা-ট্যবস্থা হতো। নাকি চলিস্নশার? ঘড়ি-ক্যালেন্ডার না থাকলে এই হয় সমস্যা।

ভাবতে ভাবতে বাবর বিছানায় উঠে বসল। উঠে বসে সে নিজেই অবাক – আরে দেখেছ, দেখেছ বাবর আজম, ভেবেছিলাম পারব না।

আগে একবার চেষ্টাই করোনি।

তাও ঠিক। করলে হয়তো আগেই পারতাম।

তবে উঠে বসেছ, ভালো খবর, এভাবেই থাকো। আনন্দে নাচানাচি শুরু করে দিও না। নাচ অবশ্য তুমি পারোও না। ওই যে একবার…।

থাক থাক, মনে করিয়ে দিও না। সবাই নাচছে দেখে আমারও শখ হলো, ছিলাম মদ-খাওয়া, গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লাম আরেকজনের গায়ে, সেখান থেকে ফ্লোরে।… আচ্ছা, রিলিজ কবে পাব, জেনেছ কিছু?

আমি কী করে জানব! ডাক্তার কি আমাকে বলবে! বললে বলবে তোমাকে।

জিজ্ঞেস করতে হবে…।

বলতে বলতে বাবর চারপাশে তাকাল। তালা বাবুলকে চোখে পড়ে গেল তার। বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবর বড়ই অবাক হলো। এর আগেরবার ঘড়ি আর ক্যালেন্ডারের খোঁজে চারপাশে তাকাল, তালা বাবুলকে তার চোখে পড়েনি। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে – সে আছে। বাবর জিজ্ঞেস করল – বাবুল, তুমি এখানেই ছিলে?

আর কই যাব! আপাতত এইটাই ঘর।

পা দোলাচ্ছ যে!

গরিব বইলা কিছু আনন্দও করতে পারব না!

আরে, না না, তা কেন! আনন্দ করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু আমি বলেছি অন্য কারণে।

এত কারণ দিয়া কী করমু?

শোনো, তোমার হার্টের অবস্থা ভালো না…।

আবার এক কথা বলতেছেন!

পা এভাবে দোলালে তোমার হার্টের ওপর চাপ পড়তে পারে।

স্যার, আমি বলছি আপনারে, আমার হার্ট নাই। তাছাড়া আমি জীবিতও না।

জীবিত না!

জি স্যার, আমি জীবিত না।

তুমি কী বলো এইসব! তোমাকে কে বলেছে এ-কথা।

কারো কওনের কী দরকার! এইটা যার যার বুঝ। যখন মন্নাফের গুলি খাইলাম, তখনই বুঝলাম – আমি নাই।

বাবুল, তুমি আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছ।

এইটারে ধাঁধা ভাবলে ধাঁধা, না ভাবলে না। জীবিত ও মৃতের মইধ্যে থাকা ও না থাকা আছে, কিন্তু ধাঁধা নাই।

কিন্তু… কিন্তু তুমি যদি মৃতই হয়ে থাকো… আমি, আমি কী?

স্যার, আমি সেইটার কী বলব!

মানে, আমি জীবিত, না মৃত?

আহা, এইটা আমি ক্যামনে জানব!

জানবে। পারবে আর কি। তোমার কী মনে হচ্ছে – জীবিত না মৃত – সেইটা বলো।

স্যার, গরিবের মনে হওয়ায় বড়লোকের জীবিত-মৃত বোঝা যায় না। আমিও বুঝতেছি না।

আশ্চর্য!… আচ্ছা, তুমি আমাকে বড়লোক বলছ কেন! এমন অদ্ভুত কথা কোথায় পেলে!

ওই যে, ঘুমাইতেছিলেন না মটকা মাইরা পইড়া ছিলেন, কে জানে, সেই সময় কত লোক যে আপনেরে দেখতে আসল। দেইখা আমি টাসকি খাইছি, আর, তখনই বুঝছি – আপনি বহুত ওপরের লোক।

ভুল করছ। আমি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করি, অনেকেই তাই নাম জানে আমার, কেউ কেউ আমার লেখা পছন্দ করে, তাই তারা দেখতে এসেছিল। এমনিতে আমি সাধারণ মানুষ। এই যে তুমি আমাকে স্যার স্যার বলছ… আমাকে স্যার বলার কিন্তু কোনো কারণ নেই।

জি না, স্যার, আপনে যা-ই বলেন না কেন, আমি স্যারই ডাকব।

সমস্যা। আমি কিন্তু তোমাকে বন্ধুই ভাবছি।

ক্যান! আমি তো পত্রিকায় লেখি না…।

আহা, শুধু পত্রিকায় যে লিখবে, সেই-ই বন্ধু হবে! বাইরের কেউ হতে পারে না?

মাস্তান হইতে পারে? আমি কিন্তু মাস্তান হিসেবেও খুব একটা নাম করি নাই।

না করো… তুমি মাস্তান, এটা ঠিক। তবে আমি নিছকই মাস্তান হিসেবে দেখি না। আমি মনে করি তোমার মাস্তান হওয়ার পেছনে যে কারণ, সেটা আমাদের বুঝতে হবে।

থাক। এসব শুনতে বা এসব নিয়া কথা বলতে ইচ্ছা করে না।

আচ্ছা, থাক।… বাবুল আমাকে যারা দেখতে এসেছিল, তাদের মধ্যে মেয়ে ছিল একটা? খুব সুন্দর?

মেয়ে তো কয়জনই ছিল, এখন আপনে কার কথা বলতেছেন…।

খুব সুন্দর…।

স্যার, আমার সব মেয়েরেই সুন্দর লাগে…।

কী যে বলো না! সব মেয়ে সুন্দর হয় কী করে! আমি যার কথা বলছি, সে খুব সুন্দর। একটু বিষণ্ণ একটা মায়া…।

স্যার, বলতে পারব না। জটিল মনে হইতেছে।

থাক, বলতে হবে না। তা, যারা দেখতে এলো আমাকে তারা কী করল?

কানল। কেউ জোরে জোরে কানল, কেউ চোখ মুইছা মুইছা কানল। কেউ আপনার মাথায় হাত বুলায়া দিলো, কেউ আপনার দিকে চুপ কইরা চাইয়া রইল। সে অনেক ব্যাপার।

বড়ই মিস হয়ে গেল।

কী?

এই যে আমাকে ঘিরে এতকিছু হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আমি তো ভাবছিলাম আপনে মটকা মাইরা পইড়া আছেন, মজা নিতেছেন, দেখতেছেন কে আপনার লগে কী করে।

সেটাই দেখা হলো না হে। কে আমাকে কতটা ভালোবাসে, এটা দেখার খুব ইচ্ছা ছিল।

কপালে নাই। আর দেইখাই-বা কী লাভ!

লাভই তো। ক্ষতির কী!

ক্ষতি। এই যে আমার বাপ আসল…।

তোমার বাবা এসেছিল?

আইসাই হাউমাউ কইরা কান্দন। আমি সেই কান্দন দেইখা তাজ্জব হইয়া গেলাম। তার লগে আমার ছিল না যোগাযোগ। বাড়ি আর কয়দিন ফিরতাম। ফিরলেও কতা হইত না। শুনতাম বাপে মুদিদোকানে আর এইখানে-ওইখানে বইসা আমারে গালিগালাজ করে। আমিও করতাম।

তুমি কেন করতে!

করতাম আর কি।

আচ্ছা, তারপর?

তো দেখেন, বাপের কান্দন দেইখা আমারও কান্দন চইলা আসল। ইচ্ছা হইল তারে দুইটা ভালো কতা কই, একটু হাত ধরি…।

তালা বাবুল বলতে বলতে চোখ মুছে নিল। তাই দেখে বাবরেরও খুব মন খারাপ হলো। তারা বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলল না। শেষে তালা বাবুলই আবার মুখ খুলল – মন্নাফেও আসছিল।

মন্নাফ! মন্নাফ কে?

তার কথা কইছি আপনেরে। যার গুলিতে আমি পড়লাম।

ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছ। তা ও-ও দেখতে এলো!

অবাক হইতেছেন ক্যান! সে আমার বন্ধু না!

ওর গুলিতেই তুমি পড়লে কিনা।

তো! কইছি না আপনেরে ওইটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। সে কি আমারে ইচ্ছা কইরা মারছে!

তুমি যখন বলছ, তখন নিশ্চয় মারেনি।… ও কী করল?

কানল।

অল্প, না বেশি?

অনেকক্ষণ কানল। আমার হাত ধইরা কইল – দোস্ত, তুই তো জানস, এইটা ঘইটা গেছে গা। আমি কইলাম, জানি। সে কইল, মনে দুঃখ রাখিস না। আমি কইলাম, মন্নাফ, আমি মনে দুঃখ রাখি নাই।… সে দাঁড়ায়া থাকল আমার পাশে। আমি কইলাম – যা গিয়া। সে কইল – থাকি। সে থাকল।

তারপর?

এই তো। একসময় সে কইল – যাই গিয়া বাবুল। আমি কইলাম – যা গিয়া।

তারপর চলে গেল?

তো খাড়ায়া খাড়ায়া কী করব!

তা-ও ঠিক।… এই দুজনই। আর কেউ আসেনি?

আমি তো আপনার মতন ফিমাস না।… আসছিল।

তারা কারা?

তারাও বন্ধু। লাইনের বন্ধু।… কেউ কেউ মহল্লার। টুকটাক ব্যবসা করে।

তারা কী বলল?

তারা ভেতরে আসে নাই। বাইরে ঘোরাঘুরি করতেছিল।

ওমা, কেন!

আপনে দেখি খুবই কম বুঝেন।… পুলিশ পুলিশ…।

কোথায়?

এইখানে, বাইরে। আমার বন্ধুরা যে আইব, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে!

পুলিশ ধরবে কেন! তুমি মাস্তান তাই তোমার বন্ধুরাও মাস্তান, এজন্য।

তারা তো মাস্তানই। মামলা আছে। মাঝেমাঝে গোলমাল হইলে পুলিশ খোঁজে। কাউরে ধরেও, যদিও সে হয়তো জড়িত না। তাছাড়া কাম দেখাইবার জন্যও ধরে। আর এখন দুইটা পড়ছে, পুলিশের কাম দেখাইবার আর ট্যাকা খাওনের টাইম শুরু হইছে। আমার বন্ধুরা কাছে আসব কোন সাহসে!… একবার তো আমিও ধরা পড়ছিলাম।

কী করেছিলে?

কিছুই না।

কিছুই করোনি বলে ধরল!

জি।… হইছে কি, ওই যে বড়লোকগো এলাকা, রাতে খুন হইল একজন। কেলাব থেইকা মদ খাইয়া ফিরতেছিল, লগে একটা মাগি ছিল। তা, গাড়ি যখন বাড়ির কাছাকাছি আইছে, দুইটা মোটরসাইকেল আইসা গাড়ি থামাইল। ড্রাইভাররে কিছু কইল না, মাগিরেও না, কিন্তু যারে খাওনের তারে খাইয়া চইলা গেল।

তোমাদের দলের কাজ?

আমগো গুরুপ এইটা জানতও না।

তাহলে কাদের কাজ?

ক্যামনে কই! গুরুপ কি কম? সব গুরুপ কি সব গুরুপরে চিনে!… গল্প কিন্তু এইটা না।

হ্যাঁ, তুমি গল্পটা বলো।

দেখেন কে তারে মারছে, তাগো মইধ্যে কী ক্যাচাল, এইটা কি আর সবাই জানে, জানে হয়তো কেউ কেউ। তো, সেই লোক যে মানী-গুণী, এইটা বোঝা গেল। পরদিন পুলিশ এমন ব্যস্ত হইয়া নামল। আমার বন্ধুরা সেই খবর পাইয়া হাওয়া।

কিন্তু তোমার বন্ধুরা জড়িত ছিল না, থাকলে তুমি জানতে।

আগে শুইনা নেন। মাঝখানে আঙুল দিয়েন না।… সব বন্ধু হাওয়া। আমারে কী ভূতে ধরল, আমি গেলাম না, আমি ভাবলাম আমি তো কিছু করি নাই, আমি ক্যান পলামু। এরকম ভাবা যে ভুল ছিল, এইটা আমি জানতাম। জাইনা-শুইনা ভুলটা করলাম। থাইকা গেলাম। আর একসময় পুলিশ আইসা ধইরাও নিয়া গেল।

পুলিশ তোমাকে ধরল কেন!

আমারে না, আরো পঁচিশ-তিরিশরে ধরল।

কেন?

ধরেন, রাতেই আমি ছাড়া পাইলাম। না পাইলে পরদিন পত্রিকায় যে লেখা হইল এতজন সন্দেহভাজন গ্রেফতার, তার মইধ্যে আমারও নাম থাকত। পুলিশ এসব করে কাজ দেখানোর লাইগা।

তোমাকে রাতেই ছেড়ে দিলো কেন!

পুলিশ ছাড়ে নাই। লতিফভাই আইসা তিরিশ হাজার ট্যাকা দিয়া ছাড়ায় নিল। এত কমে ছাড়ত না। কিন্তু আমরা হইতেছি টাকা দেওনের রেগুলার পার্টি।

ইন্টারেস্টিং।

আমি দুলালভাইরে কইলাম – ভাই, পলানো উচিত ছিল। না পলায়ে ভুল করছি। আপনার তিরিশ হাজার ট্যাকা নর্দমায় গেল। তিনি কইলেন, তুই বোকার মতো কাম করছস – এইটা ঠিক। কিন্তু ট্যাকা কি আমার নি? ট্যাকা আমার না।

টাকা কার?

সেইটা আমিও তারে জিগাইলাম। তিনি হাইসা দিলেন, বললেন – ধর, তোর দুলালভাইরে এই ট্যাকা দিছে মুলালভাই, মুলালভাইরে দিছে চুলালভাই, চুলালভাই নুলালভাই…। আমি কইলাম – আর নুলালভাইরে দিছে ভুলালভাই। এসব কইতে কইতে আমরা হাসাহাসি করলাম।… কী হইল, অমনে তাকায়া আছেন ক্যান!

তালা বাবুল…।

জি… স্যার।

তুমি কী বললে সেটা কি বুঝতে পারছ?

বুঝতেছি না। কী কইলাম!

এই… এই কথাটাই কিন্তু আমি তোমাকে বলেছি।

বাবুল অবাক চোখে বাবরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

বলেছিলাম না – চলো, দুজন মিলে বেরিয়ে পড়ি। খুঁজে দেখি পেছনের দৃশ্যগুলো।

পেছনে আবার কী দৃশ্য!

এই ধরো – কে আমাদের গুলি করল, কেন করল, কী লাভ তাদের, এসব।

স্যার, মইরা যাওয়ার পর এসব খামাখা। জীবিত তো হইতে পারবেন না।

মরেছ তুমি। আমি না। কিন্তু খুঁজতে হলে, আমাদের দুজনকে মিলেই খুঁজতে হবে।

আপনি নিজে যদি নিজেরে জীবিত মনে করেন, আপনি যান।

আহা বাবুল, তোমার সহযোগিতা আমার দরকার। তাছাড়া, তাছাড়া তোমার জানতে ইচ্ছা করে না?

না।

এটা কী বলো, হ্যাঁ, এটা কী বলো! কেন তোমার জানতে ইচ্ছা করবে না!

জাইনা লাভটা কী, এইটাই বুঝতেছি না।

কেন তুমি মারা গেলে, এটা জানবে না?

কী হইব জাইনা? আপনে তো ছাই ল্যাখবেন কাহিনি। জানা দরকার আপনার।

ধরো, কাহিনিই লিখব আমি, তোমাকে থাকতে হবে পাশে, তুমি হবে আমার সূত্র, আমি তোমার হাত ধরে একটার পর একটা ঘটনা মেলাব।… বাবুল, তুমি দন কিহোত পড়েছ? সার্ভেন্তেসের?

শুনেন, অত সহজ না। ওপরে উঠতে একসময় দেখবেন, কিছু নাই।

তাই কি হয়, কিছু না কিছু তো আছেই।

নাই। তখন থই পাইবেন না। এই লাইনে আমার কম দিন হইল না, আমিই কিছু বুঝলাম না।

কারণ তোমার বোঝার দরকার পড়েনি, তুমি বুঝতে চাওনি। তুমি হচ্ছ সাঙ্কোপাঞ্জা।

এইটা আবার কে?

সাঙ্কোপাঞ্জা। ওই যে বললাম, সার্ভেন্তেসের দন কিহোত পড়েছ, পড়েছ কিনা?… ধাৎ, কী যে বলি, তুমি কেন সার্ভেন্তেস পড়তে যাবে!

পড়াশুনার কথা আমারে কইবেন না। অসহ্য।

না না, এটা পড়াশোনা না, এটা কাহিনি।

ওহ।… ছোডবেলায় মায়ে কাহিনি শুনাইত।

তোমার মা না তোমার দু-মাস বয়সে মারা গেছেন!

ওই আর কী, মাঝেমাঝে মনে হয়, শুনাইত।

আচ্ছা, তোমাকে সার্ভেন্তেসের কথা বলি। স্পেনে তাঁর জন্ম। খুব নামকরা লেখক। তাঁর বিখ্যাত বইয়ের নাম – দন কিহোত। দন কিহোত হচ্ছে উপন্যাসের নায়ক। অদৃশ্য শত্রম্নর খোঁজে সে বের হয়। অনেকদিন আগে পড়েছি, মাথার ভেতরও হঠাৎ হঠাৎ কেমন কেমন যেন করে, সব মনে নেই, তবে সাঙ্কোপাঞ্জা ছিল তার সঙ্গী, দুজন একসঙ্গে বেরিয়েছিল তারা…।

আপনে দন, কী যেন কইলেন, আর আমি সাঙ্কোপাঞ্জা?

বাবর মাথা ঝাঁকাল।

একখান কাহিনি লিখবেন, সেইটাতে নিজেরে ওপরে না রাখলে আপনার চলতেছে না। আপনিই ডন।

দেখো তালা, সাঙ্কোপাঞ্জাও খুব বিখ্যাত চরিত্র। যারা সাহিত্য পড়ে, তারা সবাই জানে। লড়াইটা ছিল অশুভের বিরুদ্ধে। অশুভের বিরুদ্ধে আমাদের এখনকার লড়াইয়ে তুমিও আমার সঙ্গী হবে। অর্থাৎ লড়াইটা আমাদের দুজনেরই। আর ডন না, ডন বলতে যা বোঝায়, তা-ও না, এটা হচ্ছে দন, দন।

কিছুটা বুঝলাম।

একটাই সমস্যা, এ-দন কিহোত ছিল কল্পনাপ্রবণ, কাল্পনিক শত্রম্ন খুঁজে নিত কিংবা কাল্পনিক শত্রম্নকে শনাক্ত করত। কিন্তু তুমি আর আমি খুঁজব আসল শক্রকে।… কেমন হবে?

বাবুল কিছু না বলে বাবর আজমের দিকে তাকিয়ে থাকল।

কী, বাবুল? রাজি তুমি?

দেখি, একটু ভাইবা দেখি। কিন্তু ক্যামনে কী করবেন?

আমরা প্রথমে যাব মন্নাফের বাড়ি।

মন্নাফ! মন্নাফ কী করব!

কিছু না কিছু ও নিশ্চয় জানে। তুমি দেখো।

তালা বাবুল হাসতে আরম্ভ করল – মন্নাফ আমার চাইতেও কম জানে। আপনে দেইখেন।

 

চার

শরাফতের চেহারা দেখে বোঝা গেল তার মন ভালো নেই। শুধু তার মন ভালো নেই, তা নয়, সে যথেষ্ট চিন্তিতও। গতরাতে সামাদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা খারাপ হয়নি। সামাদ অবশ্য প্রথমে তাদের পাত্তাই দিতে চায়নি – ঘটনা ঘটায়া তারপর তুমি আমার কাছে আসছ, মেজবা।

মেজবার মুখ যদিও কাঁচুমাচু, তবু সে মুখ বন্ধ রাখেনি – সামাদভাই, আপনি যা-ই বলেন, আসছি কিন্তু আপনার কাছেই।

আমার কাছে আসো, ঝামেলা পাকাইয়া খোলনের ব্যবস্থা না থাকলে, তারপর।

আর আপনে তখন সব গিট্টু কি সহজে খুইলা দেন!

রাখো। এসব কথায় বিরক্তি লাগে। ঘটনা বলো।

মেজবা ঘটনা বলে।

শুনে সামাদ বলে – আরে, এইটা তো বিরাট হইচই ফেলছে।

এটা সামাদের দর বাড়ানোর চেষ্টা – শরাফত বুঝল, মেজবাও। তারা দুজন একবার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিল। মেজবা মাথা নাড়ল – না ভাই, এইটা ছোট ব্যাপার। মাত্র দুইটা পড়ছে।

দুইটা মাত্র হইল! অর্ধেকটা পড়লেই সরকারের ইমেজের কী যে ক্ষতি হয়। আর এদিকে তোমরা লুটপাটের জন্য কী না করতেছ!

ভাই, আসলে পড়ত একটাই।

তারপর? একটা পড়ল দেইখা আরেকটা আত্মহত্যা করল?

না ভাই, আচমকা এন্টি পার্টি আইসা পড়ল, তারাও ফুটাইল।

জায়গা কোনটা বললা?

শুনে সামাদের চোখ যেন মাথায় উঠল – বলো কী, ওই জমির দাম তো হাজার কোটি!

কী যে আপনি বলেন না… পঞ্চাশ কোটি…।

আমি যে-দাম বললাম, পাঁচ বছরের মধ্যে ওই দামই হইব।

যদি হাতে আসে।

যার হাতেই আসুক।

আমাদের হাতে আসবে। শরাফত বলেছিল। সেজন্যই আপনার কাছে আসা।

সামাদ তাদের আশ্বস্ত করেছিল। তখন মেজাজ কিছু ফুরফুরে হয়েছিল। সেটা থাকেনি বেশিক্ষণ। বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পর উধাও। আজ সে বাড়ি থেকে বের হয়নি। তার মনে হচ্ছে, তাদের পরিকল্পনায় বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। বেশ বড় ভুল, সমস্যা হলো, এই ভুলটা ধরা যাচ্ছে না। তাদের পস্ন্যানটা ছিল এরকম – ওখানে ফেলে দেওয়া একজনকে। তারপর পত্রপত্রিকায় লেখানো – আবাসিক এলাকায় জায়গাটা যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, তা বলে বোঝানো মুশকিল। ওখানে জুয়ার আড্ডা বসছে, নেশার উপকরণ বিক্রি হচ্ছে, পতিতাবৃত্তি চলছে, এমনকি খুনও হচ্ছে। অধিকাংশ পত্রিকা এরকমই লিখেছে। কিন্তু সে যে শুধু মেজবার ব্রিফিং অনুযায়ী, তা না। এখানে ঢুকে পড়েছে আসিফ ও রাহাত। ব্রিফ তারাও করছে। আপাতত তাদের ব্রিফিং একরকম। কিন্তু তা বদলাতে কতক্ষণ! তখন একটা ঝামেলা পাকিয়ে যাবে। আবার কিছু পত্রিকা আছে। ত্যাঁদোড় টাইপ, এমনভাব, যেন – দেশ ও জাতি উদ্ধার করছে। তেমন একটা পত্রিকায় এই জমি নিয়ে প্রভাবশালীদের বিরোধের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এরা যদি এভাবেই রিপোর্ট করে যায়, জট আরো পাকাবে। কে জানে কখন, তাদের নাম-টামও চলে আসতে পারে।… সেটা বিপদের কোনো কারণ না-ও হতে পারে। সে যে জড়িত, এমন কোনো প্রমাণ কোথাও নেই। আর পুলিশেরও অনেক কাজ, তারা কয়টার তদন্ত করবে! তেমন বিখ্যাত কেউ হলে পুলিশ আলাদা গুরুত্ব দেয়। কিন্তু এখানে এক হাফ মাস্তান, ও মেজবা অবশ্য বলল হইচই হতে পারে, যদিও তার তেমন মনে হচ্ছে না, এক লেখক। লেখকদের কোনো সামাজিক মর্যাদা আছে বলে তার মনে হয় না। যারা, সে শুনেছে, দু-চার পয়সার জন্য এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় নানা ধান্ধা নিয়ে, তাদের আবার সামাজিক মর্যাদা কী! সুতরাং কিছু যদি হইচই হয়ও প্রথম দু-তিনদিন, বসে যাবে। এসব দিক বিবেচনা করলে, বাকি ব্যাপার সামলানো কঠিন ছিল না। সে জানত, আসিফও আছে এই জমির পেছনে। তাদের লক্ষ্য ছিল দ্রম্নত ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলে, যাদের যাদের ধরার, তাদের ধরে, কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েই ছিল, জমিটার দখল নেওয়া, অস্থায়ীভাবে নেওয়া, তারপর স্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থা করা। ওদিকে দলিলপত্র যারা বানায়, তাদের একজনের সঙ্গে কথাও বলা ছিল। এসব এখন গুবলেট, না ওমলেট, কী বলে, হয়ে গেছে একই সময়ে আসিফ ঢুকে পড়ায়।

এখন সময় লাগবে। এখন অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ হবে।… হোক, হ্যাঁ, হোক আরো টাকা খরচ, আরো সময় লাগুক, সে পিছিয়ে আসবে না। যদি হাত শেষ পর্যন্ত ধুয়ে ফেলতে হয়, প্রথমে আসিফ ফেলবে, তারপর সে। এটা হচ্ছে কঠিন লড়াই। লড়াইয়ে হারলে একসময় সবাই সেটা জেনে যায়। তখন মুখ দেখানো কঠিন হয়। তখন ভবিষ্যতের লড়াইয়ে অর্ধেক পরাজিত হয়ে নামতে হয়।

শরাফত শেষে হান্ড্রেড পাইপার্সের বোতল খুলল। প্রথম পেগটা শেষ করল এক ঢোকে। দ্বিতীয়টাও। বিষম খেল, বিষম সামলে ফোন করল মেজবাকে।

জি শরাফতভাই?

কথা কও।

কী?

কথা বলতে বলছি তোমারে।

মেজবা চুপ করে থাকল।

চুপ মারছ ক্যান! খবর নাই কোনো? থাকলে কও। না থাকলেও কও – নাই।

আছে। মেজবা মৃদু গলায় বলল।

থাকলে বলতেছ না ক্যান!

মেজবা আবার চুপ করে গেল।

মেজবা…।

ভাসা ভাসা একটা খবর পাইছি…।

সেইটাই কও।

সিওর হইতে চাইতেছিলাম…।

পুলিশ বিট্রে করছে?

না।

সাংবাদিকরা টোপ গিলতে চাইতেছে না?

না ভাই, এসব না।

নেতারা মুখ ঘুরায়া নিছে?

ভাই, এসব কিছুই না।

তাইলে কোন সব? সেইসব বলো।

শরাফতভাই…।

ডিটেলসে বলবা।

আমি আসতেছি, তারপর বলব।

আরে, এখনই বলো।

শরাফতভাই, আমি আসতেছি।

 

আসিফ মস্নান মুখে রাহাতের দিকে তাকিয়ে থাকল। সে অনেকটা মূর্তির মতো, তার শ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না, সেটাও বোঝা মুশকিল। এ-সময় কথা বললে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, রাহাত জানে, তাই সে চুপ করে আছে। এভাবে চুপ করে থাকা দুজনের কারো পক্ষেই অবশ্য সম্ভব না। কারণ, তারা যে-প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তার একটা উত্তর আসিফকে দিতে হবে, আবার, সে-উত্তর নিয়ে রাহাতকেই যেতে হবে। এই এখনই যেতে হবে, এমন না, কিন্তু যেতে হবে, কাল কিংবা পরশু। তারা আসিফকে তাড়া দেয়নি কোনো। রাহাত যতদূর তাদের সম্পর্কে জেনেছে, তাদের তাড়াহুড়ো নেই, তাদের যা আছে তা – আত্মবিশ্বাস, এই যেমন – আসতে যখন বলা হয়েছে – আসবে। আজ না হলে কাল আসবে… কিংবা পরশু – এই তো; সুতরাং যেতে হবে। তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে হবে। এ-সময় আসিফ ধোন্ধা মেরে বসে থাকলে চলবে! রাহাত উশখুশ করতে আরম্ভ করল। সেটা একসময় চোখে পড়ল আসিফের – সমস্যা কী?

জি…?

গায়ে আরশোলা পড়েছে?

জি না।

গায়ে আরশোলা পড়লে পড়েছে আমার। তুমি এমন করো কেন, হ্যাঁ?

আসিফভাই, কাল আমাকে ওদের জানাতে হবে।

জানাও। জানাও গিয়ে।

আমার ওপর রাগ করে কোনো লাভ নেই।

তাহলে কার ওপর রাগ করব? আমার নিজের ওপর?

রাহাত উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকল।

এইটা কি মগের মুলস্নুক? মগের মুলস্নুক?

রাহাতের কিছু বলার নেই, সে চুপ করে থাকল।

কথা বলো না কেন! কথা কেন বলো না?

কী বলব?

এরা জানল কীভাবে, হ্যাঁ?

আসিফভাই, এরা জেনে যায়।

আমার মনে হচ্ছে তুমি নিজেই বলেছ তাদের।

রাহাত সামান্য হাসল – আপনি নিজেও জানেন, এটা ঠিক না।

আসিফ যেন নিজেকে ছেড়ে দিলো – এর কোনো মানে হয়, বলো?

রাহাত হতাশ ভঙ্গিতে দুপাশে মাথা নাড়ল।

সবকিছু গুছিয়ে আনলাম আমরা, আর তারা একটা অর্ডার দিয়ে দিলো। আচ্ছা, সত্যিই তুমি জানো না, এরা কীভাবে জেনে যায়।

আসিফভাই, আমি সত্যিই জানি না। তবে এরা জেনে যায়, এদের অনেক সোর্স, অনেক জায়গায় লোক…। আর এটা তো খুব গোপন কিছুও না।

শরাফত আমার সঙ্গে পারবে না বুঝতে পেরে বলে দেয়নি তো?

আমি বলেছি আপনাকে, এটা ঠিক না।

তুমি হয়তো অথেনটিক খবর পাওনি।

শরাফত সাহেবকেও দেখা করতে বলা হয়েছে। কিংবা তার প্রতিনিধিকে।

সে যাবে?

সেটা আমি বলতে পারব না আসিফভাই। কিন্তু তারা ডাকলে কেউ যাবে না, এমন কখনো ঘটেছে, কখনো শুনিনি।

হুমম।… রাহাত, তুমি ঘটনাটা আবার বলো।

রাহাত ভেতরে ভেতরে বিরক্তবোধ করল – দুবার বলেছি, আসিফভাই।

আবার বলো।

তারা সাতজন। ছোটবেলায় আমরা ক্লাব বানাতাম। নাম রাখতাম – সেভেন স্টার বয়েজ ক্লাব, এরকম। পেঁয়াজ আলী আর রসুন মিয়া আছে। আড়ালে লোকজন তাদের এই নামে ডাকে। তাদের একজন পেঁয়াজ আরেকজন রসুন সিন্ডিকেটের প্রধান ব্যক্তি। আছে দুজন চোরাকারবারি। একজন ঢাকার, একজন চট্টগ্রামের, মাদকের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী আছে, একজন রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার আছে, একজন পরিবহন ব্যবসায়ী। এই সাতজন। এদের সঙ্গে মাঝেমাঝে আরেকজনকে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়। তবে সে, সে কী করে – নিশ্চিত করে কেউ জানে না। একেকজন একেক কথা বলে।

সব সোনার টুকরা। তা তারা এখন আমার জমিটা চায়?

আসিফভাই, জমিটা এখনো আপনার হয় নাই।

আমারই হতো তাই না?

তা হয়তো হতো।

তাহলে ভুল বললাম কিসের!

না, ভুল বলেননি।… আসিফভাই, কে যাবে?

কোথায় যাবে?

ওরা দেখা করতে বলেছে! আমাদের পক্ষ থেকে কাউকে না কাউকে দেখা করতে বলেছে। হয় আপনাকে যেতে হবে, কিংবা আপনার প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে। সময় কম, সিদ্ধান্ত নিন।

 

শরাফতকে খুবই আশ্চর্য দেখাল – মেজবা, এইটা তুমি আমারে কইতে পারলা।

মেজবা গলার স্বর যতটা সম্ভব নরম করল – শরাফতভাই…।

রাখো তোমার শরাফতভাই… কয়খান গু-া বদমায়েশ…। আমার জমি…।

শরাফতভাই, তাদের ক্ষমতা আছে।

কিসের!

টাকার। ক্ষমতা তো টাকারই হয়।

কানেকশন আছে আমাদের, আমরা দেখা করতেছি নেতাদের লগে…।

আর নেতারা তাদের সঙ্গে দেখা করে…।

তুমি তো দেখতেছি ওই দলে চইলা গেছ গা…।

মেজবা হাসল – আমি একেক সময়ে একেক দলে, এইটা ঠিক। কিন্তু যখন যে আমারে হায়ার করে, তাদের জিতায়া আনার চেষ্টা থাকে সর্বাত্মক।… শরাফতভাই, এই খেলা শ্যাষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনার দলে।

কিন্তু তুমি কি আমার হয়ে কথা বলতেছ?

একটু ভাইবা দেখেন – আমি আসলে আপনার হয়া কথা বলতেছি।

তারা আসলে কী চায়, মেজবা?

তারা পুরা এলাকা নিয়া নিব। আপনে চাইছিলেন মাঠ, তারা নিব পুরাটা।

মাঠের বাইরে আরো মাঠ আছে?

ধরেন, মাঠ নিল। তারপর চারপাশের দোকানপাট নিল। তারপর বাড়িঘর নিল। বিশাল একটা জায়গা তাদের হয়া গেল।

সেইখানে তারা নাচানাচি করব?

জি।

নাচের জন্য এত জায়গা লাগে না।

তাদের লাগে।… শরাফতভাই, তারা সম্ভবত ওখানে কমপেস্নক্স বানাবে, জায়গা তো দামি হয়া উঠতেছে। পাঁচ বছর পর…।

আরে, সেইটা ভাইবাই-না আমি…।

এখন বলেন, কে যাবে, আমি না আপনে?

কেউ না গেলে?

কেউ না গেলে কী, এইটা আপনে জানেন শরাফতভাই। বলেন, এইটা আপনে জানেন না?

 

শরাফতের মাথা সম্ভবত ঠিকমতো কাজ করল না। সে মেজবাকে বলল, সে নিজেই যাবে। মেজবার এ-ব্যাপারে আপত্তি ছিল। সে বলেছিল – আপনার যাওনের কী দরকার। আমি যাই। শুনে আসি কী বলে।

তুমি তো শুধু শুনবা। তাই না?

আর কী?

আমি কিছু বলবও।

ওদের?

আর কাদের?

ভাই, আপনার মাথা গরম। আপনে কড়া ঘুমের ওষুধ নিয়া বাড়িতে ঘুমান।

দ্যাশে ঘুমানো মানুষের সংখ্যা বাড়াইতে চাও?

যখন দরকার জাগবেন, যখন দরকার ঘুমাইবেন।

আর তারা ইচ্ছা মতন কাজ সারব।

জি।

অথচ দেখো, পস্ন্যান করলাম আমরা, ট্যাকাও ঢাললাম, কতজনরে ম্যানেজ করলাম… এখন তারা বলতেছে, তারাই সব। তাই আমি তাদের একটু জিজ্ঞাসা করব।

কী?

করব আরকি।

তারা জিজ্ঞাসা পছন্দ করে না।

তাও করব।

তারপর কী হইতে পারে জানেন?

গালমন্দ করব আরকি। কিন্তু কথাগুলা তাদের বলা দরকার। দেশটারে তারা মগের মুলস্নুক পায় নাই।

তারপর কী হইতে পারে ধারণা আছে?

ধইরা নাও আছে, ধইরা নাও নাই।

ধইরা নেন কোনো হাইওয়ের পাশে, কিংবা বাইপাসের, আপনার ডেডবডি পইড়া থাকল। একটা ঘটনা তারা বানায়া দিলো। টিভি চ্যানেল আর পত্রিকা সেইটাই লিখল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে – অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু। জোর তদন্ত চলছে।

হইতে পারে। আফটার অল, এইটা তদন্তের দেশ।

সুতরাং আমি যাই। আপনে বিশ্রাম নেন।

রেস্ট নিব?

রেস্ট।

আসিফে কী করতেছে, জানো?

না, সেই খবর বাইর করতে পারি নাই।

পারবাও না জানি।

শরাফতভাই, তিনিও যাবেন। উপায় নাই।

তুমি যাও।

এখন না। বিকালে সময় দিছে।

এখনই যাও। ওইখানেই যে যাইতে হইব, তা না।

কই যাব?

যেইখানে ইচ্ছা।

 

রাহাত খুব ভেবেচিন্তে একটা ব্যাপার ঠিক করেছে। সে আর আসিফ দুজনই যাবে। খুবই বিনীত ভঙ্গিতে সে কিছু কথা বলবে। তাতে, তার ধারণা, কাজ কিছু হলে হতেও পারে। এটা সে রাহাতকে বললে রাহাত দ্বিধায় পড়ল – আপনিও যাবেন! যে-কোনো একজন গেলে ভালো।

দুজন গেলে তারা আরো খুশি হবে।

রাহাত কিছুক্ষণ ভাবল – হতেও পারে।

হবেই। আসিফকে বেশ বিশ্বাসী দেখাল।

তাহলে চলেন, দুজনই যাই।

আমরা ফুল নিয়ে যাব। আসিফ জানাল।

ফুল দিয়ে তারা কী করবে? রাহাত অবাক গলায় জানতে চাইল।

কিছুই না। আসিফ বলল। পরে ফুল তারা ফেলে দেবে। কিন্তু এটা ভদ্রতা।

তাদের এসব ভদ্রতার দরকার নেই।

আছে। আমি সারেন্ডারও করব, ভদ্রতাও করব।

আপনি ভাবলে এটা ঠিকই আছে।

আমার একটা পস্ন্যান আছে, রাহাত।

রাহাতকে দেখে বোঝা গেল সে মুহূর্তের মধ্যে বিপন্নবোধ করতে শুরু করেছে – পস্ন্যান! কিসের পস্ন্যান, আসিফভাই? আমাকে বলা যাবে?

আছে। ভালো পস্ন্যান।

শুনি। আপনি বলেন আমাকে।

এটা নির্দোষ পস্ন্যান, রাহাত।

আমাকে বলেন আপনি।

ঠিক পস্ন্যানও না, রাহাত। আসলে একটা অনুরোধ।

কোনো অনুরোধ করতে যাবেন না।

শরাফতকে আমি একটা শিক্ষা দিতে চাই।

শরাফত এখানে কেউ না। আপনার যেমন গেছে, শরাফত সাহেবেরও তেমন গেছে। আপনাদের দুজনের মধ্যে মিল বা সম্পর্ক যদি কিছু থাকে, তবে এটুকুই।

হুমম।… রাহাত…।

জি, বলেন।

তোমাকে আমার আর দরকার নেই।

আমার কথাটা শুনুন… আপনার ভালোর জন্য…।

তোমার পাওনা কত হয়েছে?

সেটা আপনিও জানেন।… আসিফভাই…।

মিটিয়ে দিচ্ছি, চলে যাও।

 

পাঁচ

তালা বাবুল বাবর আজমকে ডাকল – দন… দন স্যার…।

বাবর এবার একটু বিরক্তই হলো – বাবুল, তুমি কেন আমাকে বারবার দন বলছো। বলেছি তোমাকে, এই দন তোমাদের ডন না। এটা অনেক পুরনো কাহিনি।

পুরানা হইলে পুরানা। তাতে কী! দন না বললে… কী… কী যেন… হ্যাঁ, কিহোত বলব?

কিছুই বলতে হবে না। বাবর বলল।

না, আমার দন বা কিহোত বলতে ইচ্ছা করতেছে।

তালা বাবুলের ওপর বাবর রাগ করতে পারছে না। তার ধারণাই ছিল না, তালা বাবুল তার পরিকল্পনায় রাজি হবে। সে আশাবাদী ছিল সীমিত পর্যায়ে, তার এরকম একটা ধারণা ছিল – তালা বাবুল রাজি হলেও হতে পারে। রাজি না-হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তবে রাজি যদি হয়, সেটা দারুণ এক ব্যাপার হবে। তা, হলো কী – তালা বাবুল রাজি হয়ে গেল। তার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ সে বলল – ব্যাপারটা খারাপ লাগতেছে না।

শুনে, বাবুল আরো কিছু বলুক, বাবর সে অপেক্ষায় থাকল।

মনে হইতেছে দুইজন একলগে বাইর হইতে পারি।

তুমি সঙ্গে থাকবে, সত্যি বলছো?

থাকলাম না হয়, কিছু দেখলাম। যদিও দেইখা কী লাভ, এই বিষয়ে আমার ধারণা নাই।

ধারণা একটু একটু করে হবে, মানে ক্রমান্বয়ে। তুমি ক্রমান্বয়ে বোঝো?

এইটা একটা বড় সমস্যা।

ভুল। এখানে কোনো সমস্যা নেই।

এই যে বলতেছেন না – একটু একটু কইরা, এইটাই সমস্যা। আমার ধৈর্য কম।

পৃথিবীতে একবারে কিছুই হয় না, বাবুল। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি – এই যে আমরা একটু একটু করে ঘটনার ভেতরে ঢুকব, এটা আমাদের ভালো লাগবে।

সেইটা পরের কথা, আপাতত থাকলাম আপনার লগে।

ভালো লাগবে।

ভালো না লাগলে ফিরে যাবে। অসুবিধা নেই।

জি।

তাহলে শুরু করি আমরা?

জি।

প্রথমে আমরা ইকবালভাইয়ের কাছে যাব।

ইকবাল! কোন ইকবাল!

আমার মেন্টর।

এইটা কী! মেন্টর না কী যেন… !

আমার গুরু। আমার পৃষ্ঠপোষক।

ওহ, আপনাদেরও গুরু থাকে! আমি তো ভাবছিলাম শুধু আমাদের।

শোনো হে, আমাদের এই লেখালেখির জগৎ, এমন অবস্থা, গুরু না থাকলে চলে না।

আচ্ছা।… কিন্তু তার কাছে আমরা যাব ক্যান!

সে বুঝিয়ে দেবে।

সে এই লাইনের লোক?

আহা, সে কেন এই লাইনের লোক হতে যাবে!… তোমাকে বলেছি না, আমার একটা উপন্যাস লেখার কথা। এই উপন্যাস ইকবালভাই আমাকে লিখতে বলেছেন। তাই তার কাছে যাব, তাকে জানাব – উপন্যাসটা আমি এভাবে লিখব…।

অ! তা, আপনে যান। ঘুইরা আসেন। তারপর আমরা রওনা দিব।

না, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। উপকার হবে তোমার।

কী উপকার! আমি তো আর এসব উপন্যাস লেখব না।

ধরো, তুমি বুঝতে পারবে, আমরা কীভাবে কী করছি।

তালা বাবুল বিরস মুখে বলল – আপনি যখন বলতেছেন, যাব। কিন্তু অচেনা মানুষ আমার কখনো ভালো লাগে নাই।

আহা, বাবুল…।

আচ্ছা, চুপ গেলাম।… আমরা কি এই ডেরেসেই যাব?

ডেরেসে মানে!… ওহ। আর কোন ড্রেস?

সাদা ডেরেস আমার পছন্দ না।… একটা সিনেমা দেখছিলাম – নাম মনে নাই। দুই জিগরি দোস্ত। দুইজন দুইখান ডেরেস পরছিল। সেইরাম।

তালা, আমরা কি যাত্রাপালা করতে যাচ্ছি?

তালা বাবুল বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল।

কী বললে, জোরে বলো।

আমার কাছে সবই যাত্রাপালা মনে হয়।

শোনো বাবুল, ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নাও।

আচ্ছা, দন। নিলাম।

আবার! আবার তুমি দন বললে!

আপনিই কইলেন – আপনি দন, আমি সাঙ্কোপাঞ্জা।

আমি ওরকম কিছু বলিনি। আমি বলেছি ওরকম একটা কাহিনি আছে।

আমরা কাহিনির মতোই করব, না? দন শুনতেও ভালো লাগে। ডন ডন শুনায়।… আচ্ছা, এইটা ডন-ওয়ান না ডন-টু?

এটা ওসবের কিছু না। এটা ওসবের কিছু না?

সাঙ্কোপাঞ্জা নামটাও পছন্দ হইছে। সময় কইরা সাঙ্কোপাঞ্জা সম্পর্কে বিস্তারিত বইলেন। যার নামে নাম, তারে চিইনা রাখা ভালো।

এখন কাজের কথায় আসো। আমরা আজ রাতের বেলায় পালাব?

কঠিন।

তাহলে দিনের বেলায়?

আরো কঠিন।

আবার সহজও।

কী কঠিন কঠিন সহজ সহজ করো, ভেঙে বলো।

দিনের বেলা বাইরে পুলিশ।

হুমম।

দিনের বেলা বাইরে সাম্বাদিক।

বুঝলাম।

বাইরে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন। আমার না, আপনার।

আমরা রাইতের বেলায়ই বের হবো।

তুমি না বললে – কঠিন?

রাত বেশি হইলে বাইর হবো। তখন সাংবাদিক থাকবে না, আপনার বন্ধুবান্ধব থাকবে না।

কিন্তু পুলিশ থাকবে।

রাত বেশি হইলে পুলিশ নাক ডাইকা ঘুমায়।

আচ্ছা, তাহলে রাতে।

রাইতে?

সে-রাতেই তারা বের হলো। একটু চিন্তিত ছিল তারা, যদি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ থাকে তবে ঝামেলা হয়ে যাবে। তবে সেরকম কিছু ছিল না। দরজা খোলাই ছিল। তারা চুপচুপ করে দরজা একটু ফাঁক করে বাইরে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তালা বাবুল ফিক করে একটু হাসল – কী দন, কইছিলাম না?

কী বলেছিল তালা বাবুল, প্রথমে সেটা মনে করতে পারল না বাবর। মনে পড়লে বাবর বলল – পুলিশ?

হু। ওই দেখেন ঘুমাইতেছে। ইচ্ছা করতেছে দুইটা বালিশ দিয়া আসি।

এগোও। ডাক্তার-নার্স এরাও দেখে ফেলে হইচই জুড়ে দিতে পারে। এখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হওয়া দরকার।

দৌড় দিবেন? আসেন, দৌড় দেই।

একটু পর তারা রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

রাস্তায় নেমে তালা বাবুলকে বোকাটে দেখাল। বোকাটে দেখল বাবরকে, সে বাবুলের কাঁধে হাত রাখল – কোনদিকে যেতে হবে?

বাবুল ফিরল বাবরের দিকে – কী কই! ঠাহর পাইতেছি না।… কোনটা যে কোনদিক, বুঝতেছি না।… আপনে পারতেছেন?

বাবর দুপাশে মাথা নাড়ল। না, সে-ও পারছে না।

তাহলে?

দাঁড়াও।

যে-কোনো একদিকে হাঁটা দিমু?

তাতে লাভ?

যেদিক দিয়াই গেলাম, মন্নাফকে পায়া গেলাম।

মন্নাফ না, আমরা প্রথমে ইকবালের কাছে যাব।

ওহ, তাইলে রাস্তা আপনি জানেন।

হুমম।… বুঝতে পারছি না ইকবালভাইয়ের অফিসটা কোনদিকে?

চলেন, হাঁটা দেই।

এখন রাত। চলো, আমরা বরং পার্কে বসে রাতটা পার করি। সকাল হলে, তারপর যাব।… তুমি ইচ্ছে করলে ঘুমাতে পারবা। আমি ভাবব।

 

ইকবালের রুমে লোকজন। বাবর আজম আগেও দেখেছে, ইকবালকে ঘিরে থাকে লোকজন, তাকে একা পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এ কবিতা নিয়ে আসে, ও গল্প, আরেকজন ধারাবাহিক উপন্যাস বা তার সাক্ষাৎকার ছাপানোর বায়না। ইকবাল অনেককেই তাড়াবার জন্য ব্যস্ত থাকেন, তবে তার নিজস্ব কিছু লোক আছে, তারা তাকে ঘিরে থাকলে সেটা সে পছন্দ করে। তারা তখন এদেশের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে ও নির্ধারণ করে নেয় – কে সাহিত্যের জন্য জরুরি নয়, সুতরাং ভালো লিখলেও তাকে কোণঠাসা করে রাখাটা জরুরি, ও কার মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তাকে কিছু বাড়তি সুযোগ দেওয়া দরকার।

বাবর একবার ভাবল, যেহেতু আজকের যে ভিড় তা সহজে হালকা হবে বলে মনে হচ্ছে না, সে তালা বাবুলকে নিয়ে এই ভিড়ের মধ্যেই ঢুকে যাবে। ইকবালভাই নিশ্চয় তাকে সময় দেবে, বাবুলকে দেখেও খুশি হবে, কারণ সে নতুন চরিত্র ভালোবাসে। তবে বাবর নিজেকে বিরতও রাখল। তার পরিকল্পনা সে সবার সামনে বলতে চায় না। যে-অবস্থা, দেখা গেল সে লিখে শেষ করার আগেই কেউ আধাখেঁচড়া লিখে তার লেখার বারোটা বাজিয়ে দিলো। সে তাই অপেক্ষা করতে লাগল। তালা বাবুল বলল – আপনের বস দেখি হেবিব বিজি!

তা একটু। নামকরা মানুষ।

একটা পিস্তল আনা উচিত ছিল।

পিস্তল আনবে কেন! কী কথা বলো!

পিস্তল শো করলে ভিড় পাতলা হইয়া যাইত।

বাদ দাও। ভিড় পাতলা এমনিতেই হবে।

বাবর আজম যেমন বলল, ভিড় এমনিতেই পাতলা হবে, তেমনই হলো। যারা ঘিরে ছিল ইকবালকে, তারা এক এক করে বিদায় নিল। ইকবালকে দেখা গেল চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতে। বাবর তখনই না ঢুকে কিছুটা সময় নিল। তারপর সে দরজার বাইরে থেকে বলল – ইকবালভাই, আসব?

কে?

আমি বাবর। বাবর আজম।

তুমি! তুমি কোত্থেকে?

আপনার সঙ্গে উপন্যাসটা নিয়ে আলোচনা করতে এলাম।

কোন উপন্যাস?

ঈদ সংখ্যায় যেটা লেখার কথা, ইকবালভাই। আপনি লিখতে বলেছিলেন…।

হ্যাঁ, বলেছিলাম বটে। কিন্তু…।

পিস্নজ, ইকবালভাই, কোনো কিন্তু না, খুব সুন্দর একটা পস্নট সাজিয়েছি…।

আচ্ছা, সে দেখা যাবে… কিন্তু তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন…!

আমার সঙ্গে আরেকজন আছে। ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। কিন্তু আপনি আবার কী মনে করেন।

আরে না, আমি আবার কী মনে করব! আসো, ভেতরে আসো।

তালা বাবুল হঠাৎ একটু গাইগুঁই করল – আমার ভেতরে যাওনের কী দরকার! আপনি যান। আমি এইখানে ঘোরাঘুরি করি।

আশ্চর্য কথা! তুমি শুনবে না! না শুনলে বুঝবে কী করে!

বাবুলকে বিরক্ত দেখাল। সে অবশ্য ভেতরে ঢুকল, বাবর তার হাতও ধরে আছে। তাকে চেয়ারে বসিয়ে বাবর পাশের চেয়ারে বসল।

ইকবাল বাবুলের দিকে তাকাল, তারপর বাবরের দিকে – এ কে?

এর নাম বাবুল। অবশ্য একে যারা চেনে, তারা তালা বাবুল নামে চেনে।

তালা বাবুল! মাস্তানদের মতো নাম।

বাবুল হাসল – জি, ঠিক ধরছেন। মাস্তান। তবে বড় না, ছোট।

ইকবালভাই। বাবর বলল। আমরা দুজন সেদিন একই সঙ্গে গুলি খেয়েছিলাম।

ওখানেই, না?… হ্যাঁ, পত্রিকায় পড়েছি ওর কথা। তা, ওর সঙ্গে কী, বাবর?

উপন্যাস যে লিখব…।

পারবে?

আহা, পারব না কেন! শুধু যেভাবেই পারেন, ১০টা দিন বাড়িয়ে দেবেন। তারপর এমন একটা উপন্যাস দেবো আপনাকে…।

বুঝলাম। কিন্তু এই বাবুলকে কেন এনেছ?

দেখেন। বাবরের আগে বাবুল মুখ খুলল। আমি কিন্তু আসতে চাই নাই। তিনি আমারে জোর কইরা আনছেন।

কী বলো, জোর করে হবে কেন! বলতে পার – অনুরোধ করে এনেছি।… ইকবালভাই, উপন্যাসটা যেভাবে সাজিয়েছি, ওকে ছাড়া হবে না।

তোমার কি মৃত ক্যারেক্টার দরকার? আমি যতদূর জানি এই তালা বাবুল ঘটনাস্থলেই মারা গেছে…।

ঠিক ঠিক। তালা বাবুল উৎফুলস্ন হয়ে উঠল। আমি গুলি খাওনের লগে লগেই মারা গেছি।

এইটা বোধহয় ঠিক না, ইকবালভাই। বাবরকে কিছুটা গম্ভীর দেখাল।

এইটাই ঠিক। মারা কিন্তু আপনেও গেছেন। শুধু স্বীকার যাইতেছেন না, এই যা।

ইকবাল মাথা ঝাঁকাল – আমিও সেরকমই শুনেছি। বাবর, তুমি হাসপাতালে আনার পর ঘণ্টাদেড়েক বেঁচে ছিলে!

বাবর বেশ কিছুটা রেগে গেল – ইকবালভাই, আপনিও! বেঁচে আছি কি মরে গেছি, এটা আমি নিজে বুঝি না!

ইকবাল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল – এটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। বাঁচা-মরা, এসব ব্যাপারে আমরা খুব একটা জানি না। সুতরাং এসব যার যার ওপরে ছেড়ে দেওয়া ভালো।

তালা বাবুল আবার বিরক্ত হলো – হ, কইল একখান কথা।… যাউক গা। আমার কী!

হ্যাঁ, তুমি বরং কিছুটা সময় চুপ করে থাকো। ইকবাল বলল। আমি বরং বাবরের কথা শুনি। আমার তাড়া আছে। বাবর…।

ইকবালভাই, আমি দন কিহোতের স্টাইলে গল্পটা সাজাতে চাচ্ছি…।

দন কিহোত!

সার্ভেন্তেসের দন কিহোত…।

না না, সে কাহিনি আমি জানি?… বাবর, তুমি কার অন্তরশূন্যতা দেখাবে? সার্ভেন্তেস যেমন দেখিয়েছিল, দন কিহোত যে-শ্রেণির প্রতিনিধি, সেই সমাজের ফাঁপা কাহিনি, তাদের জুজুর ভয়, অদৃশ্য শত্রম্নর খোঁজে কিহোতের যাত্রা…।

ইকবালভাই, শত্রম্ন কি অদৃশ্য নয়? এখন?… কিংবা অনেকদিন ধরে?… কিংবা ধরেন, শত্রম্ন কি সার্ভেন্তেসের সময়ও, যদিও সার্ভেন্তেস দন কিহোতে সে-কাহিনি লেখেননি, অদৃশ্য ছিল না?

ইকবাল মাথা ঝাঁকালেন – তোমার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শত্রম্ন অদৃশ্যই থাকে।

আমি তাদের খোঁজে বের হবো।

ইকবাল বাবর আজমের দিকে তাকিয়ে থাকল।

কিহোত যেমন বেরিয়েছিল। তার ছিল কাল্পনিক শত্রম্ন। কিন্তু আমার যারা শত্রম্ন, তারা কি কাল্পনিক?

তুমি তালা বাবুলকে বাদ দিচ্ছ কেন?

বাদ দেব না। আমার শত্রম্ন হলে তারা তালা বাবুলেরও শত্রম্ন।

ঠিক শত্রম্ন বলা কি উচিত হবে?

তালা আমাকে বলেছিল, ওদের কাজ ছিল পার্কে ঢুকে একজনকে ফেলে দেওয়া।… ইকবালভাই, ভাবুন একবার, পার্কে ঢুকে একজনকে ফেলে দেবে, ভাবুন একবার – যে-কোনো একজনকে ফেলে দেবে…।

হুমম।… পুলিশ এখনো কিছুই বের করতে পারেনি, সাংবাদিকরাও না…।

তালা বাবুল হাসতে আরম্ভ করল।

কী ব্যাপার? তুমি হাসছ কেন!

পাইল।… পুলিশ আর সাংবাদিকরা বাইর করব কইলেন…।

তো, তারা বের করে না? তুমি পুলিশ আর সাংবাদিককে কী ভেবেছ?

যা দেখছি, তা-ই ভাবছি। বাদ দেন।… দন, আপনে কথা শেষ করেন। এই আবালের লগে ভালো লাগতেছে না।

ইকবালের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, সে কঠিন চোখে তাকাল তালা বাবুল ও তারপর বাবরের দিকে – তুমি কাকে সঙ্গে এনেছ, বাবর?

না না, ইকবালভাই। ইকবালভাই। ওর ক্লাসটা আপনাকে বুঝতে হবে। এসব কিন্তু ওদের কাছে গালি না।… বাবুল, তোমার কিছু বলতে হবে না, তুমি চুপ করে থাকো।… হ্যাঁ, ইকবালভাই, যে-কথা হচ্ছিল। শত্রম্ন না হয় না-ই বললাম, মানে, আমার সরাসরি শত্রম্ন না, কিন্তু আমাদের সবারই শত্রম্ন, না?

তোমার এ-কথাটা মানছি।

তালা বাবুলকে সঙ্গে নিয়ে আমি তাদের খোঁজে বের হবো। বাবুল জানে ওকে কে গুলি করেছিল। তার কাছে যাব। তার কাছে যে-তথ্য পাব, সেটা ধরে আরেকজনের কাছে। এভাবে যেতে যেতে গোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করব।

গোড়ায়? ইকবাল সামান্য হাসল।

হ্যাঁ, গোড়ায়। ইকবালভাই, আপনি কিন্তু উপন্যাসটা শেষ করার জন্য আমাকে দশদিন বেশি সময় দিচ্ছেন।

 

ইকবালের সঙ্গে কথা শেষ করে বাবর বাবুলকে নিয়ে বের হয়ে ফুটপাতের এক কোণে দাঁড়াল। স্বসিত্মতে দাঁড়ানো অবশ্য কঠিন। মানুষ এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে, মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় কারো ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়তে হতে পারে। তবে কিছু মানুষ নির্বিকারও বই। তারা অত সব যানবাহন, তাদের ছুটে আসা তাচ্ছিল্য করে কখনো নাক, কখনো পাছা চুলকোতে চুলকোতে বা কখনো ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছে। এই দৃশ্যের দিকে বাবর কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকল। বাবুল অধৈর্য গলায় জিজ্ঞেস করল – আমরা কি এখানে দাঁড়ায়া থাকব!

কী করব?

কী করব – সেইটা আমি জানি? সেইটা জানেন আপনে।

মন্নাফের বাসায় যাব।

চলেন। দাঁড়ায়া থাকতে ভালো লাগতেছে না।

তার আগে দুপুরের খাবারটা সারা দরকার। তারপর যাই।

বাবুল ভাবল সামান্য সময় – নাহ্, ওর ওইখানে যামু রাইতে। দিনে হয়তো গেলাম – পাইলাম না।

হয়তো গেছে কোথাও ভাড়ায়?

হ। কওন যায় না। রাইতে যাব। ফিরব তো।

কিন্তু ধরো, জটিল কোনো কাজে গেল। ঝামেলা হলো। তারপরও কি ফিরবে, না পালাবে?

সেইটা আসলে পরিস্থিতি বুইঝা…।

তুমি কখনো পালাওনি?

পলাইছি।

কখন?

পরিস্থিতি বুইঝা। বাবুল হাসল। ধরেন, যখন বুঝি – পুলিশ যখন মনে করে – এই কেসে তারে কাজ দেখাইতে হইব, ওপর থেইকা চাপও আসে, তখন পুলিশ ছোট-বড় কাউরে ছাড়ে না, তখন পলাইতে হয়।… এখন পুলিশ দৌড়াদুড়ি শুরু করলে মন্নাফও পলাইব, যদিও সে ছোট, সে কিছুই করে নাই।

মন্নাফ কিছুই করেনি! তুমি না মরলে মন্নাফের গুলিতে!

হ্যাঁ, সেইটা মরলাম, ঠিক আছে। কিন্তু মন্নাফই কি আমারে মারছে?

মারেনি! গুলি ওর, গুলি ছোড়াও ওর…।

ছুড়ছে। আমার গায়ে লাগছে। মরছি। কিন্তু মন্নাফের দোষ দেখি না।

আমিও না। বাবর আজম বাবুলের দিকে তাকিয়ে থাকল।

 

ছয়

ঠিক হয়েছে, এই এখন যাওয়ার মানে যেহেতু হয় না, মন্নাফ বাসায় না-ই থাকতে পারে, থাকলেও ওয়াচে থাকতে পারে সে, যদি ঘটনা তেমন গুরুতর দিকে গড়ায় এর মধ্যে। আরো কত কি, তাই তারা রাতে যাবে। এই যে সময়টুকু, তারা যদিও ভাবল নানারকম, শেষে ঠিক হলো, আবার তারা পার্কে বসে পার করে দেবে।

পার্কে দুজন পুলিশ আছে। গতরাতেও ছিল। বাবর সেটা বুঝতে পারেনি। এক কোণে জবুথবু হয়ে তারা ছিল। বাবুল ঠিকই বুঝেছিল – ওই যে, দেখছেন?

হ্যাঁ, দুজন বসে আছে। এত রাতে এখানে কী করে!

ডিউটি দেয়। পুলিশ।

পুলিশ! অন্ধকারে আমি কিছু বুঝতে পারছি না, তুমি বুঝলে কী করে!

গন্ধ পাইতেছেন না?

গন্ধ! পুলিশের! তুমি পুলিশের গন্ধ পাও?

পাই। এইটা অবাক হওয়ার কিছু না।

কীভাবে পাও পুলিশের গন্ধ? আর সবারও গন্ধ পাও?

কীভাবে পাই, এইটা বলতে পারব না। পাই আরকি।

আমি তো পাই না…।

পান। হয়তো পান, টের পান না। হয়তো লেখক গো গন্ধ পান… আমি পুলিশ আর মাস্তান গো পাই…।

এই নিয়ে গত রাতে তাদের বেশ অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। তালা বাবুল পুলিশ ও মাস্তানের গন্ধ পায়, এটা বাবর আজম বিশ্বাস করেনি, তালা বাবুলও চায়নি তাকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়তে, কিন্তু এই নিয়ে তাদের কথাও বন্ধ হয়নি। পুলিশ দুজন অবশ্য সকাল পর্যন্ত ছিল না। তারা ভোর হওয়ার বেশ আগেই উঠে চলে গিয়েছিল।

এখন, এই দুপুরে দুজন পুলিশকে আবার দেখা গেল। আশপাশের কোনো দোকান থেকে দুটো চেয়ার এনে বসে তারা গল্প করছে। পার্কজুড়ে রোজকার কাজ চলছে। যেমন থাকে সবসময়, আশপাশের দোকানের নানা কাজ, একপাশে গাঁজার আসর, কিছু বাচ্চার দৌড়াদৌড়ি, তেমন।

বাবর বলল – কী আশ্চর্য!

কোনটা? তালা বাবুল জানতে চাইল।

সবকিছু একদম ঠিকঠাক।

সবকুছ বিলকুল ঠিকঠাক?

অবশ্য এরকমই হওয়ার কথা। ঠিকই আছে।

বাবুল হো-হো করে হাসতে আরম্ভ করল। এই হাসির জন্য বাবর প্রস্ত্তত ছিল না, সে অবাক গলায় জানতে চাইল – কী হলো, হাসো কেন?

আপনি অন্যরকম ভাবছিলেন। ভাবছিলেন, এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, লোকজন এখানে কালোপট্টি বুকে লাগাইয়া শোকদিবস পালন করব।… ভাবেন নাই?

আরে না না, কী বলো! জানি আমি।

কী জানেন?

এসব কোনো ব্যাপার না, বাবুল। জানি, এসব কোনো ব্যাপার না।

কিন্তু মনে মনে ভাবতেছিলেন, এসব যদি ব্যাপার হইত! যদি আইসা দেখতেন এই এলাকা কবরস্থান হইয়া আছে…।

আরে না, তা-ই হয় নাকি!… আসো, আমরা অন্য গল্প করি।

কী গল্প?

কীভাবে তুমি মাস্তান হয়ে উঠলে, সেই গল্প শুনি।

একটু ভেবে নিল তালা বাবুল – নাহ দন, আমার গল্পে নতুন কিছু নাই। আপনি বরং আপনার গল্প বলেন, সেইটা শুনি।

আমার গল্প?… আমার গল্প শুরু হয়নি, বাবুল। লেখক হবো, আমি লেখক। এই লেখক হওয়াটাই হবে আমার গল্প। তার আগে আমার কোনো গল্প নেই। বাবর আজমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাবুল বলল – জটিল।

 

রাত কিছু হলে তারা তালা বাবুলের মহল্লার দিকে রওনা দিলো। মন্নাফের বাড়িও সেখানেই। কিছুক্ষণ হেঁটে তারা সে-মহল্লায় পৌঁছে গেল। বাবুল বলল – মহল্লার মইধ্যে আইসা পড়ছি। খুব সাবধান।

কেউ যেন দেইখা না ফেলে।

মন্নাফকে বের করবে কীভাবে? নাকি আমরা ওর ঘরে বসে কথা বলব?

দাঁড়ান, দেখতেছি।

তালা বাবুল একটু ঘুরে একটু এগিয়ে একতলা এক বাড়ির এক জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু সময় নিল, তিন পাশে তাকিয়ে জানালায় আঙুল দিয়ে সামান্য শব্দ করল। মন্নাফ বোধহয় ঘুমোয়নি। শুয়েছিল কিংবা বসে, কয়েক সেকেন্ড পর সে সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল – কে?

আমি।

আমি কে?

আমি সাঙ্কোপাঞ্জা। দন-রে নিয়া আসছি।

কে?

পুলিশ।

মন্নাফের শিথিল গলা শোনা গেল – হ, পুলিশ! পুলিশের আর কাম নাই, রাত হইছে দেইখা চোর-পুলিশ খেলতে আইছে।

তালা বাবুল মুখ দিয়ে বাবরের অচেনা এক শব্দ করল। সে-শব্দ মন্নাফের চেনা। সে মুহূর্তের মধ্যে বলে উঠল – বাবুইল্যা, তুই!

মন্নাফ, বাইরে আয়, তোর লগে জরুরি কথা আছে।

আসতেছি। কিন্তু মন্নাফ, তুই তো মরছস?

সেইটা জানি। মরছি বইলা কথা কবি না?

না না, এইটা কী কইলি! কিন্তু বাইর হইয়া তোরে পামু? কইতেছিলাম – তুই তো নাই।

আমার বসও নাই, যদিও তিনি এইটা মানেন না।

এসব আজেবাজে কথা বলবে না বাবুল। বাবর চাপা গলায় বলল।

তোর বস কে? তারে আমি চিনি?

চিনস না। তবে ওইখানে ছিল। আমরা আগে-পরে গুলি খাইছি।

ভেতরে মন্নাফ কাঁদতে আরম্ভ করল।

আরে, কান্দস ক্যা! অই বেকুব, তুই কান্দস ক্যা!

বাবুইল্যা, তুই নাই।

তুই আছস?

মন্নাফ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল – আছি।

আমি নাই, তুই আছস – তফাত কী?

মন্নাফের ফোঁপানি থামল – কইতে পারমু না। ভাবি নাই।

অহন বাইরা না। দন জরুরি কথা নিয়া আসছেন। না, জানালা খোল, আমরাই ভেতরে আসতেছি।

মন্নাফ জানালা খুললে তালা বাবুল আর বাবর আজম ভেতরে ঢুকল। মন্নাফ হালকা-পাতলা গড়নের ছেলে। থুতনিতে কয়েকটা দাঁড়ি, চোয়াল ভাঙা, গায়ের রং ফ্যাটফেটে সাদা। সে প্রথমে বাবরকে খেয়াল করল, সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না, তখন সে তালা বাবুলের দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর কয়েক পা এগিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল – দোস্ত এটা যে ঘইটা গেছে, এইটা নিশ্চয় তুই বুঝছস।

বাবুল – কী যে কস, এইটা বুঝতে টাইম লাগে!

আন্দাগোন্দা ছুড়তে ছিলাম বুঝছস। আসমানের দিকে। হঠাৎ পেছন থেইকা কার যেন ধাক্কা খাইলাম, ঘোড়া নাইমা গেল। গুলি গেল বরাবর…।

আর আমি ছিলাম বরাবর, সামনে। এই তো ঘটনা?

মনে কিছু নিস না দোস্ত।

আরে না, এইটা তো ঘটনাই। ঘটছে আরকি।

মন্নাফ এগিয়ে বাবুলের সঙ্গে কোলাকুলি করল – তুই বুঝছস তাই কলিজা ঠান্ডা হইল, এই একটু আগেও পুড়তে ছিল।… কিন্তু দোস্ত, মন্নাফ গলা নামাল। তুই সঙ্গে কারে আনছস, দন-ফন কী কইলি, বুঝলাম না।

তিনি একজন লেখক।

সাম্বাদিক?

সাম্বাদিক না। লেখক। গল্প-কবিতা পড়ছস না স্কুলে?

সেইসব কি মনে আছে?

মনে রাখনের দরকার নাই। সেইসব যারা লিখে, তারা লিখক।

অ।… তিনি কী চান, বাবুল।

শোনো। বাবর বলল। সার্ভেন্তেস নামে খুব নামকরা একজন লেখক আছে…।

থাকুক না…।

আচ্ছা, আমি বলতেছি। তালা বাবুল বাবর কিছু বলার আগেই তাকে থামাল। মন্নাফ ধর, আমরা তো ফুটাইতে গেলাম। আমাদের বলছিল একজনরে ফেলতে, তোগো কী বলছিল, জানি না। এখন ধর, কারা বলছিল…।

দুলালে…।

আহা। বাবর কিছুটা চেঁচাল। এই যে দুলাল সে তোমাদের হায়ার করেছিল। এই এইটুকুই তোমরা জানো। কিন্তু দুলাল কাদের হয়ে কাজ করেছিল, তা কে তোমাদের হায়ার করেছিল, এসব কিছু জানো?

জাইনা কী করব! মন্নাফকে বোকা বোকা দেখাল।

বাবর একবার তাকিয়ে নিল বাবুলের দিকে। মন্নাফের দিকে ফিরে মুখ খুলতে নিল, তার পাশে বাবুল মুখ খুলল – কিন্তু মন্নাফ, লিখকদের এইসব দরকার।

মন্নাফ বুঝল না।

ধরো লিখক এইসব নিয়া লিখবেন।

লিখে তো সাম্বাদিকরা। একবার আমার ইন্টারভিউ নিছিল, তারপর লিখা বাইর হওনের পর দেখি সব বানায়া বানায়া লিখছে।

শোনো মন্নাফ, বানিয়ে বানিয়ে লেখকরা লেখেন। তবে ঠিক বানিয়ে বানিয়ে নয়, তারা কিছু কল্পনার আশ্রয় নেন…।

এই যেমন ধরো মন্নাফ, দন কল্পনার আশ্রয় নিছেন যে, তিনি বাঁইচা আছেন।

ধাৎ, আমি বেঁচে আছি কি মারা গেছি, এটা আমি বুঝি না।

আচ্ছা আচ্ছা, আপনে জ্যাতা। এখন মন্নাফরে বুঝায়া কন।… মন্নাফ, দন যা যা জিগাইব, ঠিক ঠিক উত্তর দে।

শোনো মন্নাফ, কেউ তো তোমাদের ভাড়া, মানে হায়ার করেছিল, তাই না?

জি, দনভাই।… স্যার বলব?

না না, ভাই। আচ্ছা, যে ভাড়া করেছিল সেই দুলালই কি আসল লোক?

এইটা আমি ক্যামনে বলব!

আন্দাজ করে বলো।

দুলাল।… দুলাল… নাহ, দুলাল শুধু আমাদের ভাড়া করে…।

তাহলে কী দাঁড়াল? দুলালকেও কেউ ভাড়া করে, না?

জি। সেই রকমই।

এই যে ধরো, বলা হলো একটা-দুটা লাশ ফেলতে হবে, এর পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে। কারণ ছাড়া কেন লাশ ফেলতে বলবে!

এত ভাবি নাই। কিন্তু এখন মনে হইতেছে নিশ্চয় কারণ আছে!

সেই কারণ তুমি জানো?

আমি! কী বলেন এইসব!

তালা বাবুল, তুমি?

কী?

তুমি জানো?

জানলে সেই কখন বইলা দিতাম।

তোমরা জানো না, আমিও জানি না। কিন্তু সুতো ধরে এগোলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে।

সুতা ধরবেন! সুতা কই!

তোমরা যেটা বলবে সেটাই সুতা। এই যেমন দুলালের কথা তোমরা বলেছ। হয়তো আরো কিছু বলবে তোমরা। সেই সূত্র ধরে আমরা এগোব…।

একটু আগে বললেন সুতা, এখন বলতেছেন সূত্র…।

ওই একই। শোনো, এভাবে আমি এগোব, মানে আমরা, আমি আর বাবুল, একসময় পেয়ে যাব মূল কাহিনি, কেন কারো লাশ ফেলার প্রয়োজন হলো, কেন তোমরা দুই পার্টি হলে, কারা এই সবকিছুর নেপথ্যে, এসব পেয়ে যাব। তখন এটা একটা জমজমাট উপন্যাস হবে।… মন্নাফ, বলো দেখি তুমি আর কী কী জানো।

মন্নাফের কাছে বেশি তথ্য পাওয়া গেল না। বরং বলা ভালো, নতুন কোনো তথ্য সে দিতে পারল না। বারবার ঘুরেফিরে দুলালের কথা। একটু যদি আশ্চর্য হতে হয়, এই জায়গায় আশ্চর্য হওয়া যায় – তালা বাবুল আর মন্নাফ – দু-গ্রম্নপকেই অস্ত্র দিয়েছিল দুলাল। কাজ শেষ করে দু-গ্রম্নপই অস্ত্র তার কাছে ফেরত দেয়। দুগ্রম্নপের বেশ কয়েকজনের নিজস্ব অস্ত্র আছে। কিন্তু এ-ধরনের ভাড়া খাটতে যাওয়া অপারেশনে তারা কখনো নিজেদের অস্ত্র ব্যবহার করে না।

দুলাল তাহলে খুব পাওয়াফুল। বাবর বলল।

এইটা তো আমরা কখনো ভাবি নাই।

দেখো, এত এত অস্ত্র যে নিজের কাছে রাখে, তাকে পাওয়ারফুল না হলে চলে!

এইটা ধরেন ঠিক। সব সে ম্যানেজ কইরা থুইছে।

কিন্তু এই দুলালই সব না।

জি, আরো দুলাল আছে। আমরা পার্টিও কি কম?

তা তোমরা কম না, কিন্তু আমি ঠিক সে-কথা বলছি না। ধরো, দুলাল একা কি সব সামলাতে পারে। এমন হতে পারে সে অস্ত্র রাখে আরেকজনের কাছে, যাকে তোমরা চেনোই না। দরকারের সময় দুলাল সে লোকের কাছ থেকে অস্ত্র এনে তোমাদের মধ্যে বাটোয়ারা করে। আবার সেই লোকও হয়তো কিছু জানে না। কারণ তার মাথার ওপরও আরেকজন আছে।

মাথার সংখ্যা দেখি বাইড়া যাইতেছে।

বাড়বে। মাথা অনেক। আমাদের ছোট ছোট মাথা থেকে বড় বড় মাথায় যেতে হবে। আমরা ওপরে উঠতে উঠতে কিংবা নিচে নামতে নামতে টের পাব, কে, হ্যাঁ, কে সেদিনের ঘটনা ঘটিয়েছিল।

বাবর ঠিক করল, সে আর তালা বাবুল এখন দুলালের ওখানে যাবে। দুলালের কাছ থেকে যে-তথ্য পাওয়া যাবে, তার ওপর নির্ভর করে যাবে পরের জনের কাছে। বাবুলের এতে আপত্তি নেই, তবে তার সামান্য দ্বিধা – মন্নাফও কি যাবে তাদের সঙ্গে!

না না, মন্নাফ কেন! তাহলে দুগ্রম্নপের সবাইকে নিতে হয়।

সমস্যা আরো আছে। বাবুল বলল। মন্নাফের নাম দিবেন কী? নিউ সাঙ্কোপাঞ্জা, না সাঙ্কোপাঞ্জা টু?

শোনো বাবুল, আমি চাই তোমার মধ্যে কিছু সিরিয়াসনেস আসুক। কারণ ব্যাপারটা সিরিয়াস। এখন তুমি যদি আমার মতো সিরিয়াস না হও, আমরা আমাদের শত্রম্নকে খুঁজে বের করতে পারব না।

জি জি, বুঝছি। আমি সিরিয়াস। দুলালের ওইখানে চলেন, দেখবেন।… মন্নাফ, তাইলে যাই গিয়া দোস্ত?

মন্নাফ এগিয়ে এসে তালা বাবুলকে জড়িয়ে ধরল – আবারো বলতেছি দোস্ত, মনে কিছু রাইখো না।

আরে না, আমার মন ফকফকা। তোমারে বন্ধু জানি।

যাও তাইলে।… বাইর করতে পারলে আমারে খবর দিও।

শুধু তোমাকে না, মন্নাফ। বাবর বলল। আমি যখন এটা নিয়ে উপন্যাস লিখব। শুধু কি তুমি, সবাই জানতে পারবে।

দুলাল প্রথমে তাদের পাত্তাই দিতে চাচ্ছিল না। পারে তো বাড়ি থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়, এমন অবস্থা। কিছুই জানে না সে, অস্ত্রের কোনো ব্যবসা তার নেই। সুতরাং ভাড়া দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, দরকার হলে পুলিশ ডেকে সে তাদের ধরিয়ে দেবে – এসব বলে সে যখন ক্ষিপ্ত, বাবুল বলল – আমারে চিনেন?

দুলাল বলল – আরে মিয়া, তুমি দুই পয়সার কে, তোমারে চিনতে হইব?

না, সেইটা চিননের দরকার নাই। আমার নাম-পরিচয় দিয়া কী করবেন!

আমিও তা-ই বলি। তাইলে?

আমি কিন্তু মৃত।

কী কও, তুমি কত?

আমি জীবিত না, মৃত। ভূত।

তুমি ভূত!

ভূত। থাবড়া দিব?

দুলাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বাবুলের দিকে, বাবরের দিকেও একবার তাকাল, বাবুলের দিকে ফিরে বলল – বিশ্বাস গেছি।
থাবড়া দিও না।… ইনিও কি ভূত?

জি, ইনিও ভূত। তবে সেইটা তিনি স্বীকার করেন না।

দুলাল হতাশ গলায় বলল – দেশে ভূতের সংখ্যা দেখি বাড়ছে।… তা, কী করতে হবে কও?

বাবর জিজ্ঞেস করল – সেদিন এদের মধ্যে আর্মস ডিস্ট্রিবিউট করতে কে আপনাকে অর্ডার দিয়েছিল। এইটা আমাদের জানা দরকার।

ভাই, আপনে দেখি আমার ব্যবসা নিয়া টানাটানি করতেছেন?

না, আপনার ব্যবসা আপনারই থাকবে। আমরা শুধু মূল মানুষকে খুঁজে বের করতে চাই। আপনার সঙ্গে আমাদের ব্যাপার নাই।

ওহ্, তাইলে আমি দোষী না?

না, আপনি অংশ, নাম বলেন।

হ, নাম বলেন, তিনি আবার উপন্যাস লিখবেন।

দুলাল তাকাল বাবর আজমের দিকে – ল্যাখালেখির কী দরকার! ল্যাখলেও আমার নাম বাদ বা বদলায়া দিয়েন। আপনে তো আমার প্যাটে লাথি মারতে পারেন না। পারেন?

আর আপনার জন্য যে এত এত লোক মারা যায়…?

ভাই, এইটা তো ব্যক্তিগত কিছু না। কারো লগেই আমার ব্যক্তিগত শত্রম্নতা নাই, আমি শুধু নিয়ম মাইনা ব্যবসা চালাই।

সংলাপটা ভালো। এটা আমি ব্যবহার করব। এখন নাম বলেন।

রববানী।

রববানী?

জি, রববানী। ঠিকানা দিতেছি। সে দুইটা কুত্তা পালে।

বাবর আজম আর তালা বাবুল ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রববানীর বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বাবর বাবুলকে জিজ্ঞেস করল – আমরা কিন্তু এগোচ্ছি।

কোথায় গিয়া থামব, বুঝতেছি না।

যখন বুঝতে পারব, যখন খুঁজে পাব।

তারপর?

তারপর কী – সেটা আমরা দুজনই দেখব, বাবুল।

 

রববানী লোকটা ধূর্ত টাইপের। বাবর আর বাবুলের দিকে সে  এমনভাবে তাকিয়ে থাকল, তারা কী বলছে, তার কিছুই সে বুঝতে পারছে না। এমনকি দুলাল নামটাও তার কাছে অপরিচিত ঠেকল – আপনারা কোন দুলালের কথা বলতেছেন?

যে-দুলাল আপনার নাম-ঠিকানা দিয়েছে, তার কথা বলছি।

আমি কোনো দুলালরে চিনতেছি না।

থাবড়া দিমু?

থাবড়া দিবেন মানে। কী কন?

আমি কিন্তু ভূত।

শুনেন ভাই, জীবনে বহু ভূত দেখছি। এইখানে সুবিধা করতে পারবেন না। ফুটেন।

আপনি, যা জিজ্ঞেস করেছি, বলে ফেলেন। আমরা চলে যাচ্ছি।

আরে। কী বলব আমি! বাইর হন, নাইলে পুলিশ ডাকলাম।

তার আগে খেইল দেখবেন। আপনে মিয়া আমার প্রেস্টিজে হাত দিছেন।… দন, এরে দেখামু?

দেখাও দেখাও।

তালা বাবুল রববানীর দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর সে শূন্যে দুহাত উঠে গেল – দেখেন, কোনো মন্ত্র পড়ি নাই কিন্তু, এমনি এমনি উঠছি।

রববানী যত না ভয় পেল, তার চেয়ে বিরক্ত হলো বেশি – এইসব কী, এইসব কী! নামেন?

আপনে ওপরে উঠবেন?

না। ওপরে উঠনের দরকার কী!

তা হলে নাম বলবেন?

আমি কি একবারও বলছি নাম বলব না!

রববানীর কাছ থেকে নাম-ঠিকানা নিয়ে তারা সাইফের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

আমরা এগোচ্ছি কিন্তু। বাবর এবারো বলল।

সাইফের বাড়ির দিকে? বাবুল জানতে চাইল।

না না, ঘটনার মূলের দিকে।

বুঝলাম।… কিন্তু এখনো বুঝতেছি না এইটায় কী লাভ।

কীসে?

এই যে বললেন, ঘটনার মূলের দিকে না কী যেন…।

আশ্চর্য কথা বলছ, বাবুল! তোমার জানতে ইচ্ছে করে না, কে এই ঘটনা ঘটাল, কেন ঘটাল? কাদের কারণে তুমি মারা গেলে?

জাইনা?

‘জাইনা’ কী, সেইটা পড়ে। কিন্তু জানতে হবে না?

কী লাভ? আমরা বাঁইচা উঠব? সিংগি মাছের মতো ফাল পাড়ব?

তা হয়তো হবে না… মানে, ধরো, সেরকম কিছুই না, কিন্তু তোমার বুঝতে হবে – জানার ইচ্ছাটা মানুষের মৌলিক।

বাবুল নীরস গলায় বলল – চলেন।

 

সাত

শরাফত বড় করে দুবার শ্বাস ফেলল। সামনে মেজবা বসে আছে। মেজবার দিকে শরাফত একবারো তাকাচ্ছে না। মেজবার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চাচ্ছে, বারদুতিন মুখ খোলার মতো করেছেও সে, কিন্তু শরাফতের থমথমে নীরস মুখ দেখে সে প্রতিবারই তার কথা গিলে ফেলেছে। তবে শরাফত কী বলে সেটা শোনা জরুরি। মেজবা পেশাদার বটে, একেক সময় একেকজনের কাজ করে, তবে যখন যার কাজ করে, তার ভালোটা দেখা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, না হলে পেশাদারিত্ব থাকে না, বাজারে বদনাম হয়। বদনামের ভাগিদার হতে মেজবা রাজি নয়। তাছাড়া এখানে শুধু ভাগিদার হওয়া না-হাওয়ার ব্যাপার না, এখানে সাময়িক সখ্যের
যে-ব্যাপার আছে, সেটাও নিতান্তই বাধ্য না হলে মেজবা এড়িয়ে যেতে চায় না।

তারা এখন আর মাঠে নেই, এটা সে শরাফতকে স্পষ্ট করে বলেছে। কেন নেই – এটাও সে বিস্তারিত জানিয়েছে। জানিয়েছে, কেন এখান থেকে হাত ধুয়ে সরে পড়া ভালো। ওরা যে হাত ধুয়ে সরে পড়ার সুযোগ দিচ্ছে, এটাকে বড় সুযোগ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত, সে তো বটেই, শরাফতও এটা বুঝেছে। তবে ভেঙে পড়েছে সে, নুয়ে পড়েছে, মুখ-চোখের অবস্থা এমন হয়েছে, যেন কয়েক রাত তার পার হয়েছে নির্ঘুম। লোকটার জন্য মায়াই হলো মেজবার। লোকটার লোভের কারণে দুজন নিরীহ মানুষ, যাদের এই  ঘটনার সঙ্গে কোনোই যোগাযোগ নেই, খুন হয়েছে। মেজবা জানে, এটা তেমন একটা বড় ঘটনা নয়। এরকম ঘটনা রোজ কত কত ঘটছে। বরং তুলনা করতে গেলে শরাফতের এই ঘটনা নিতান্তই সাধারণ ও সাদামাটা বলতে হবে। যদি কেউ অপরাধ বলতে চায় এটাকে, সাদামাটা অপরাধ বলতে হবে। অমন একটা সাদামাটা অপরাধ ও জমিটা পাওয়ার ক্ষেত্রে শরাফতের আন্তরিকতা – এই দুই বিচার করলে, জমিটা শরাফতের প্রাপ্যই ছিল। অথচ এখন হঠাৎ করে… আচ্ছা, এই যে দৃশ্য বদলে গেল, কিংবা বদলে দেওয়া হলো – এটাকেও কি সাদামাটা অপরাধ বলা যাবে? তেমন অস্বাভাবিক কিছু না, সুতরাং সাদামাটা অপরাধ এটাকে বলা যায়।… যায়? নাকি কঠিন বা ভয়ংকর অপরাধ বলতে হবে? তেমনও বলা যায় বোধহয়, যদি…। মেজবা গুছিয়ে ভাবার আগে শরাফতের গলার আওয়াজ শুনতে পেল – মেজবা…।

জি, ভাই, আছি। বলেন।

ডেগচি আমার।

জি?

ডেগচি আমার না? রান্ধনের ডেগচি?

জি জি, আপনার।

মাংস আমার।

জি, এটাও আপনার।

মশলা?

আপনার।

চুলা?

আপনার।

সময় নিয়া পাক করল কে?

আপনি।

কও, এখন খাওন নাকি অন্যের!

শরাফতভাই, আপনেরে তারা হাত ধুইয়া ফেলতে বলছে।

সাবানের নাম কয়া দিছে।

মেজবা চুপ করে থাকল।

সামাদ সাবেও কিছু করতে পারব না।

মেজবা দুপাশে মাথা নাড়ল।

তুমি কথা বলছিলা সামাদের সঙ্গে।

না, কথা বলি নাই।

আশ্চর্য কথা বলতেছ, মেজবা! কথা বলবা না!

তার সঙ্গে কথা বললে কোনো লাভ হইত বইলা আপনি মনে করেন?

সেইটা তুমি আগে থেকেই বলতে পার না।

শরাফতভাই…।

থাইমা যাও কেন! যা বলনের বইলা ফেলাও।

আমি যদি সামাদভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইতাম…।

আবার থামলা!

তিনি দেখা করতেন না।

ক্যান! তার সমস্যা কী?

কারণ তিনিও জানেন তিনি এইখানে কিছু করতে পারবেন না।

শরাফত সোজাসুজি তাকাল মেজবার দিকে। তাকিয়ে থাকল। দুপাশে মাথা নাড়ল, বলল – এক কাজ করো মেজবা…।

জি, বলেন।

নতুন জমি খুঁজো, আমরা সেইটা দখল নিব।

ঝামেলা আছে, এমন জমিই তো, তাই না? মানে, আবার লাশ!

সমস্যা! লাশ যদি পড়তে হয়, পড়বে। সমস্যা!

মেজবা দুপাশে মাথা নাড়ল – নাহ্, সমস্যা কীসের! লাশই তো।

তাইলে খোঁজ লাগাও।

লাগাব।… আমি কি আপনারে একটা বুদ্ধি দিব?

দাও।

আপনে দল বাড়ান। লোকজন টানেন। একা ব্যবসার দিন শ্যাষ।

টিম বানাব?

সিন্ডিকেট। সরকারের লোক রাখেন, ক্ষমতার লগে যারা পাছা ঘষে, তাদের রাখেন।

রাখলাম।

তারপর একটা ব্যাংক দেওনের চেষ্টা করেন।

এইসব লম্বা সময়ের ব্যবসা, মেজবা, এইসব আমার স্বভাবে নাই।

এইসব ছোট সময়ের ব্যবসা। একবার যদি একটা অনুমতি বাইর করতে পারেন, তারপর দুই বছরের মধ্যে কেল্লা ফতে।

ক্যামনে?

সহজে। ব্যাংকটারে উপ্তায়ে খায়া ফেলবেন।

 

রাহাতকে চলে যেতে বলেছিল আসিফ, রাহাত যায়নি। সে পাওনা বুঝে নিয়েছিল, আনুষ্ঠানিক বিদায়ও নিয়েছিল আসিফের কাছ থেকে। তবে সে খেয়াল রেখেছিল ঘটনার ওপর। এটা তার জানা ছিল, সে ভুল করছে। সে যে খেয়াল রাখছে, এটা সিন্ডিকেটের কানে বা চোখে গেলে তার খবর হয়ে যাবে। তবে ইতোমধ্যে তার মেজবার সঙ্গে কথা হয়েছে। মেজবা বলেছে, ব্যাপারটা তার পছন্দ হয়নি। এই যে তারা, শরাফত তো বটেই, ওদিকে আসিফও, কষ্ট করে একটা প্রজেক্ট দাঁড় করাল, তারা দুজন নেপথ্যে থেকে গুছিয়ে দিলো অনেক কিছু, তা, জমিটা কারো একজনের হতো, হয় শরাফতের নয় আসিফের, হতো তো তাদের কারোর না কারো, অথচ মাঝখান থেকে কিছুই না করে একদল টান দিয়ে সেটা নিয়ে নেবে, এটা কোন ধরনের ন্যায্য কথা। মেজবা বলেছে, এই প্রজেক্ট বাতিল হলেও সে কিছুদিন থাকবে শরাফতের সঙ্গে। চেষ্টা করবে নিজেকে শরাফতের কোনো কাজে লাগানোর। সেটা যদি পারা যায়, তখন, ‘ভবিষ্যতেও আছি, শরাফতভাই’ বলে হাসিমুখে বিদায় নেবে। রাহাত এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। ভেবে এরকম সিদ্ধান্তে সে পৌঁছেছে, আসিফ নিজেই যদিও বিদায় করেছে তাকে, তার হাত মুছে চলে আসা উচিত হবে না। এই প্রজেক্ট যে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু পরের কোনো প্রজেক্ট?… এই যে মেজবা যেমন ভাবছে, একটা কিছু পাইয়ে দিয়ে সে ফিরতে চায়… যেমন সে বলল – বুঝলেন ভাই, পেশাদার হইতে পারলাম না। ধরেন, কাজ শ্যাষ। কাজ যে শ্যাষ, এইখানে আমাদের কিছু করনের নাই। সব কাজ সবসময় নামানো যায় না, এই কাজ আমরা তো আমরা, আমাদের আববারাও নামাইতে পারবেন না। সুতরাং গিল্টি ফিলিংস নাই কোনো। তবু মনে হইতেছে শরাফতভাইরে কিছু একটা কইরা দিয়া যাই। একটা বুদ্ধি আছে। সময় লাগবে। শরাফতভাই অনুমতি দিলে তদ্দিন থাকি।… এইটাই হইতেছে প্রমাণ, প্রফেশনাল হইতে পারি নাই।… কেন রে মেজবা, এই কাজ তো শ্যাষ, কাজের কি অভাব, তুই অন্য জায়গায় যা, এইখানে ক্যান পাছা ঘষাঘষি করবি!

শুনে রাহাতের হাসি – শরাফতভাই লোক কেমন!

বুঝাইলে বুঝে। জ্বইলা উঠে যেমন, নেভেও তেমন।… আসিফ সাব শুনছি মেজাজি?

মেজাজি খুব একটা মনে হয় নাই, তবে বোঝে কম।

পরামর্শ নেয় না।

না। ভাবে সে যেটা ঠিক করেছে সেটাই ঠিক।

সমস্যা।

এই ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি নাকি নিজে ওদের সঙ্গে কথা বলবেন। বোঝেন?

কোনো লাভ নাই। ঝাড়ি খায়া ফিরবেন।… খারাপ না। নিজেই বুঝবেন।

মেজবাভাই, আমার পেমেন্ট মিটিয়ে আমাকে বিদায় করেছেন। তবু ঠিক করেছি, আমি তার সঙ্গে থাকব।

কেন! মেজবার চোখ ছোট হয়ে গেল।

আমিও ভেবে দেখলাম, এই প্রজেক্ট গেছে, নতুন একটা প্রজেক্টে তাকে কিছু সহায়তা করতে পারি কিনা…।

আপনেও দেখি প্রফেশনাল না…।

না, ভাই ঠিক সেরকম না। আপনি যদি শরাফতভাইয়ের সঙ্গে থেকে তাকে কিছু পাইয়ে দেন, আর আমি যদি আসিফ সাহেবকে ছেড়ে সরে পড়ি, বাজারে আমার ডিমান্ড কমে যাবে। ছোট বাজার তো। মুহূর্তেই পাঁচ কান হয়ে যাবে। রাহাত হাসতে আরম্ভ করল।

আসিফ ওদের সঙ্গে দেখা করে ফিরেছে, জানার পর ঘণ্টাখানেক সময় নিল রাহাত। ওখানে কী ধরনের কথা হয়েছে, তার কিছুই তার জানা নেই। জানা থাকলে কথা বলতে সুবিধা। তবে এটুকু সে আন্দাজ করতেই পারে, ওখানে আসিফের পক্ষে কোনো কথা হয়নি। তাকে কতটা স্পষ্ট করে ‘না’ বলা হয়েছে, এটা তার জানা না
থাকলেও সে জানে, তাকে ‘না’ বলা হয়েছে, কারণ যারা তাকে ডেকে নিয়েছিল তারা সেরকমই বলে। এই ‘না’ তারা কতটা হেলাফেলায় অথচ কঠিন করে বলেছে, জানা থাকলে কথা শুরু করতে সুবিধা। উপায় নেই, তাকে বিস্তারিত না জেনেই কথা বলতে হবে। সে হাসল সামান্য, তারপর ফোন করল। একবার দুবার তিনবার। ফোন ধরল না আসিফ। সে ফোন ধরল চতুর্থবার – কী ব্যাপার, তুমি কেন…!

আমি রাহাত…।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তুমি কেন!

আমি একটু দেখা করতে চাই।

তোমার পেমেন্ট ক্লিয়ার?

জি, ক্লিয়ার।… পেমেন্টের ব্যাপারে না।

তা হলে?

আছে ভাই। ফোনে না বলে সামনাসামনি বলতে চাচ্ছি।

আমার শোনার ইচ্ছা নেই।

আমি বেশি সময় নেব না।

বললাম না – আমার শোনার ইচ্ছা নেই।

আমি সত্যিই বেশি সময় নেব না।

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা গেল।… আসিফভাই – রাহাত বলল।

আচ্ছা, আসো।

আপনি বাসায় থাকেন।

আমি বাসায়ই। তোমার কতক্ষণ লাগবে?

পাঁচ মিনিট। আমি কাছেই আছি।

রাহাত পাঁচ মিনিটই সময় নিল। আসিফ ভেতরের ঘরে ছিল। সে যখন রাহাতের সামনে এসে বসল, তাকে বিধ্বস্ত মনে হলো। রাহাতের মনে হলো আসিফের শরীর পাথরের, তাতে অসংখ্য চিড়, এক ধাক্কায় সেটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। রাহাত সামান্য হাসার চেষ্টা করল। আসিফ তার হাসিটুকু ফিরিয়ে দিলো না, বলল – কী বলবে?

ভাই, তাড়া না থাকলে ধীরেসুস্থে বলি।

আসিফ মৃদু গলায় কী বলল বোঝা গেল না।

গিয়েছিলেন? রাহাত জিজ্ঞেস করল। জিজ্ঞেস করেই তার মনে হলো এটা জিজ্ঞেস করা তার উচিত হলো না। সে আসিফের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাইল। আসিফের মুখে সামান্য হাসি, সে বলল – তুমি আসায় ভালো হয়েছে, রাহাত। আমার মন ভালো না।

আমার খুব একা একা লাগছে।

 

সাইফ মানুষ হিসেবে হাসিখুশি। আন্তরিক গলায় সে জানতে চাইল – আমার কাছে আপনাদের দরকার?

দরকার তার কাছেই নিশ্চিত হওয়ার পর সে তাদের ভেতরে নিয়ে বসাল – দরজায় দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই কথা হয় না, ভাই। আসুন, আমরা ভেতরে বসে কথা সেরে নেই।

তাদের বসিয়ে সাইফ ভেতরে চলে গেল – এই ফিরছি আমি… একটু।

সে আড়াল হতেই বাবুল প্রায় চ্যাঁচাল – এরে তো সুবিধার মনে হইতেছে না।

একটু অপেক্ষা করি, বোঝা যাবে।

সাইফ ফিরে এলো প্রায় তখনই, বসতে বসতে তাদের দিকে তাকাল – জি, বলুন।

বাবর আর বাবুল একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, অস্বসিত্ম হচ্ছে তাদের। কিছু কথা ছিল – বাবর গম্ভীর গলায় বলল।

কথা তো আছেই, না হলে আসবেন কেন।… বলুন।

আমার নাম বাবর আজম, ওর নাম বাবুল। অবশ্য তালা বাবুল নামেই বেশি পরিচিত।

আচ্ছা, আপনার নাম বাবর, ওনার নাম বাবুল।… বলুন।

নাম দুটো কি পরিচিত লাগছে আপনার কাছে?

সাইফ তাকিয়েই ছিল তাদের দিকে, নাম দুটো পরিচিত লাগছে কিনা – এ-প্রশ্নে সে যেন আবার তাকাল, তাকিয়েই থাকল।

কখনো শুনেছেন?

সাইফ দুপাশে মাথা নাড়ল – নাহ্।… আমার কি শোনার কথা?… সত্যি কথা হলো, নাম দূরের কথা, আমি আপনাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।

কিন্তু আমরা জানি আপনার সম্পর্কে। আপনি শহরের বড় আর্মস ব্যবসায়ীদের একজন।… ঠিক না?

আরে! সাইফের হাসি দেখে মনে হলো সে বেশ মজা পেয়েছে। আরে, আপনারা এটা জানেন! আপনারা পুলিশ না, সংস্থার লোক না, রাজনীতিরও না, ব্যবসায়ীও মনে হচ্ছে না, কিন্তু আপনারা জানেন! ইন্টারেস্টিং! তা, কীভাবে জানেন?… দাঁড়ান, চা খেতে খেতে শুনি।

আখরোট, কাজু, বিস্কিট, মিষ্টির সঙ্গে চা। আপনারা নিজেরা একটু হাত লাগান, পিস্নজ। আমি আবার সব এলোমেলো করে ফেলব – সাইফ তাদের দিকে তাকিয়ে হাসল।

বাবুল এক প্লেটে সব তুলে নিল। বাবরের খুব ইচ্ছা করছিল দুটো মিষ্টি খেতে, কিন্তু সে কয়েকটা কাজু তুলে নিল, তারা সিরিয়াস কথা বলতে এসেছে, এ-সময় ওসব রসালো হোক শুকনো হোক, মিষ্টি তো, ভালো দেখায়।

সাইফ বলল – হ্যাঁ, আমরা কথা শুরু করতে পারি।… দেখুন, আমার বেশ অবাক লাগছে। আমার আরো কয়েকটি ব্যবসা আছে। আমি ভেবেছিলাম আপনারা কেবল ওসব সম্পর্কে জানেন। এখন ওটা সম্পর্কেও জানেন বলে মনে হচ্ছে…। বলুন, কী দরকার আমার কাছে।

মিষ্টিমুখে গলা খাঁকারি দিলো বাবুল – আমাদের নাম তো শুনেন নাই বললেন?

সাইফ আবার দুপ%B