বিজয়া রায় : অন্য এক নবজাগরণ

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

২০১৫ সালের ২ জুন, মঙ্গলবার, বিজয়া রায় প্রয়াত হলেন। তিনি প্রায় শতবর্ষের গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আটানববই
বছরের পরমায়ু নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের জীবনাবসান হয়েছিল একাত্তর বছর বয়সে। সে হিসাবে সত্যজিৎ-জায়া বিজয়া রায়ের মৃত্যু যথার্থই পরিপূর্ণ বয়সে ঘটেছে বলা যেতে পারে। সত্যজিৎ রায়-পরিবারের লীলা মজুমদারেরও (সম্পর্কে যিনি সত্যজিতের পিসিমা হতেন) জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল, – নিরানববই বছর। তবু মৃত্যু মৃত্যুই। বিজয়া রায়ের প্রয়াণে তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রসাদরঞ্জন রায় (তিনি প্রবন্ধকার, সরকারি উচ্চপদস্থ আমলা এবং পারিবারিক সূত্রে সত্যজিৎ রায়ের ভ্রাতা) লিখছেন, ‘তাঁকে শেষ প্রণাম জানাবার সময় বুঝলাম আমাদের পরিবারের এই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি আর নেই।… একটা যুগের অবসান হল।’ ২ জুনের সেই দুর্বার রজনীতে কেওড়াতলা শ্মশানে আরো যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের পরিচয়, অতএব ভেঙে পড়েছিলেন তিনিও। তিনিও তাৎক্ষণিক স্মৃতিচারণায় জানালেন, তাঁর শিল্পীজীবন নয় কেবল, ব্যক্তিগত জীবনেরও অনেকটা জুড়ে ছিলেন সত্যজিৎ ও বিজয়া। এমনকি সৌমিত্র নতুন বাড়ি করলে সে-বাড়িতে প্রথম অতিথি হয়ে আসতেন তাঁরা। বিজয়াকে মাতৃসমা মনে করতেন সৌমিত্র।

বিজয়া দাশ। জন্ম ১৯১৭, ময়মনসিংহে। বড় হয়ে-ওঠা পাটনায়, উচ্চবিত্ত পরিবারে, ব্যারিস্টার পিতার বৈভবের মধ্যে। সহসা পিতার মৃত্যু এবং অবস্থা বিপর্যয়, কলকাতায় পিসিবাড়ি উঠে আসা। নাটকীয়ভাবে সত্যজিৎরাও সে-বাড়িতে উঠে আসেন তাঁদের পৈতৃক বাড়িটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর। বিজয়া রায়ের পিসেমশাই সত্যজিতের মামা হতেন। সেই থেকে সত্যজিৎ-বিজয়ার নৈকট্য, যা শেষে বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। আমরা একটু বিশ্লেষণে যাব এ নিয়ে।

উনিশ শতকে বাংলার যে-নবজাগরণ, তার অন্যতম দিকচিহ্ন হলো সামাজিক গড্ডল প্রথাকে ভেঙে ফেলা। সতীদাহ প্রথা রদ যেমন তার একটি অভিজ্ঞান, অন্যটি অবশ্যই তাহলে বিধবা বিবাহ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর মাধ্যমে সামাজিক বিপস্নব এনেছিলেন বললেও অত্যুক্তি হয় না। উপরন্তু তিনি নিজ পুত্র নারায়ণের সঙ্গে বিধবা রমণীর বিয়ে দিয়ে প্রথাটিকে সমাজ-অনুকূল ও সহজ করে তোলার প্রয়াস নিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রতিমা দেবীর বিয়ে দিয়ে আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এমনকি একুশ শতকে দাঁড়িয়েও যখন আমরা বিজ্ঞাপন বেরোতে দেখি, বর্ণ ও কুষ্ঠি বিচারের সঙ্গে মিলিয়ে বিয়ের প্রয়াস নিচ্ছেন অভিভাবককুল, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরকম প্রথানুগ বিয়েই সমাজে কার্যকর, সেখানে যখন দেখি সৈয়দ আমীর আলী বিয়ে করছেন কোনো ইংরেজ তনয়াকে, পরবর্তীকালে যার

অনুসৃতি আমরা দেখতে পাব মানবেন্দ্রনাথ রায়, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, অন্নদাশঙ্কর রায় বা অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে, তখন বাঙালি সমাজে যে-বিপস্নবাত্মক পরিবর্তন এসেছিল, তাতে আর সন্দেহ থাকে না। এইভাবে ভিন্ন প্রদেশীয়রাও যখন বিয়ের ক্ষেত্রে জলচল হয়ে ওঠেন, যেমন বাঙালি সুখলতা রাও, সরলা দেবী বা ঠাকুরবাড়ির প্রতিভা দেবীর সঙ্গে যখন বিয়ে হয় যথাক্রমে উড়িষ্যার ড. জয়ন্ত রাও, লাহোরের পঞ্জাবি রামভুজ দত্ত চৌধুরী আর অসমিয়া লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার, সামাজিক নিগড় ভাঙার অন্যতর তাৎপর্য ও মাত্রা যুক্ত হয় এর মাধ্যমে। আবার অন্য ধর্মে বিয়ে, কাজী নজরুল ইসলাম, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ যার প্রবক্তা, হলো আরেক উচ্চাকাঙক্ষী অবরোধ ভাঙার সম্ভ্রান্ত উদাহরণ। এক্ষেত্রে চতুর্থ সমাজবিপস্নব হলো বাংলায় গান্ধর্ব বিবাহের চল। কাকে দিয়ে এর শুরু বলা মুশকিল, তবে প্রমথ চৌধুরী-ইন্দিরা দেবী এক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের প্রণয়, পত্ররচনা আর বিবাহের মাধ্যমে। বিপস্নবের পঞ্চম ও চূড়ান্ত পর্যায়টি হলো, নিকটাত্মীয় এবং আইনের দিক দিয়ে নিষিদ্ধ গান্ধর্ব বিবাহ, যা অতুলপ্রসাদ সেনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল। আর হ্যাঁ, সত্যজিৎ-বিজয়া রায়ের বিয়ের ক্ষেত্রে। উপরন্তু এই দ্বিতীয় ঘটনাটির দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে; এক. সত্যজিৎ ছিলেন বিজয়ার চেয়ে বয়সে ছোট। পাত্রকে যে অবধারিতভাবে বয়সে বড় হতে হবে বিয়েতে, এ-মিথ্যাটিকে ভাঙা হলো এর মধ্য দিয়ে। দুই. সুখী হতে পারেননি অতুলপ্রসাদ আর অন্যদিকে বিজয়া রায়-সত্যজিতের দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল ঈর্ষণীয়ভাবে সুখী, পরস্পর-পরিপূরক ও জটিলতামুক্ত। দুজন দুজনকে অতুলনীয় শ্রদ্ধার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন।

অতএব আমরা বলতে চাই, বিজয়া-সত্যজিতের বিয়ে ঐতিহাসিক, প্রগতিশীল, ব্যতিক্রমী, দুঃসাহসী এবং সম্ভবত দ্বিতীয় রহিত। তবু ১৯৪৮-এর ২০ অক্টোবর বম্বেতে (অধুনা মুম্বাই) তাদের যে-রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়, সামাজিক প্রয়োজনেই তাকে গোপন রেখেছিলেন তাঁরা ১৯৪৯-এর ৩ মার্চ পর্যন্ত, যেদিন ব্রাহ্মমতে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। বিজয়া রায় এ-প্রসঙ্গে তাঁর আত্মজীবনীতে পরিহাস করে লিখেছিলেন, ‘যেখানে একবার বিয়ে হওয়ারই কোনো সম্ভাবনা ছিল না, সেখানে দুবার হল।’

সত্যজিতের সৃষ্টিশীলতায় স্ত্রী বিজয়া রায়ের অবদান বিশাল। যে-চলচ্চিত্রমাধ্যম সত্যজিতের শিল্প বিকাশের পথ উন্মুক্ত ও প্রসারিত করেছিল, মনে রাখা ভালো, সেই চলচ্চিত্রমাধ্যমটির সঙ্গে বিজয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছিল একাধিক ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রে। তাঁর-অভিনীত দুটি বাংলা ছবির দুটিই মুক্তি পায় ১৯৪৪-এ। ছবিদুটির একটি হলো অরোরা ফিল্মের সন্ধ্যা। এ-ছবির পরিচালনায় ছিলেন মণি ঘোষ। প্রমথেশ বড়ুয়ার যুগ সেটা। নায়িকাদের মধ্যে সে-সময় কানন দেবী, যমুনা দেবী, ছায়া দেবী, স্মৃতিরেখা বিশ্বাস, রাণী বালাদের যুগ। ১৯৪৪-এর ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পেল বিজয়া (তখন পদবি ছিল দাশ)-অভিনীত রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত রম্যনাটকের চলচ্চিত্র রূপ শেষ রক্ষা। ছবিদুটিতে বিজয়ার সহ-অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলী, স্মৃতিরেখা বিশ্বাস, নৃপতি চট্টোপাধ্যায় (সন্ধ্যা), পদ্মা দেবী, অমর মলিস্নক, রেবা বসু, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (পরবর্তীকালে ‘মহর্ষি’ নামে খ্যাত, নাটকে বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয়ে খ্যাতিলাভ সূত্রে)। এ-ছবির পরিচালক ছিলেন পশুপতি চট্টোপাধ্যায়। মাত্র আট বছর বয়সে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছিলেন বিজয়া। মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ বিজয়াকে স্থান দিয়েছিলেন নৃত্যনাট্যে। বিজয়া রায় রবীন্দ্রসংগীতে তালিম নেন স্বনামখ্যাত অনাদি কুমার দস্তিদারের কাছে। ছবিদুটিতে অভিনয় করেছিলেন বিজয়া, নিজের গলায় গানও রয়েছে তাঁর দুটি ছবিতেই। সন্ধ্যা ছবিতে বিজয়ার কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছিল ‘চাঁদের লাগিয়া হব না’, ‘হৃদয় জানে না তারে’, ‘সময়টা নয় মন্দ’। শেষ গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। এ-ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন হিমাংশু দত্ত। আর শেষ রক্ষা ছবির সংগীত পরিচালক অনাদি কুমার দস্তিদার স্বয়ং। সে-ছবিতে বিজয়ার কণ্ঠে একাধিক রবীন্দ্রসংগীত শোনা গিয়েছে। ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো’ এবং ‘স্বপ্নে আমার মনে হল’।

অতএব কি অভিনয়কলা, কি সংগীত, বিজয়া ছিলেন কৃতী ও সম্ভাবনাময়ী। অতিশৈশব থেকেই প্রমাণিত হয়েছিল সংগীতে বিজয়ার বিস্ময়করতা। এতটাই যে, তাঁর পিতা চারুচন্দ্র দাশের ইচ্ছা ছিল বিজয়াকে প্যারিসে কনজারভেটরিতে পাঠিয়ে বিখ্যাত সংগীতশিল্পী বানাতে। রবীন্দ্রনাথ যাঁকে আট বছর বয়সে ‘বর্ষামঙ্গলে’ সুযোগ দেন, দিলীপ রায়ের প্রশ্রয় পান অতি কৈশোরেই যে-শিল্পী, রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অতুলপ্রসাদের গানেও যে বিজয়া স্বচ্ছন্দ (তাঁর রেকর্ডও বেরিয়েছিল অতুলপ্রসাদী গানের) তাঁকে নিয়ে উচ্চাভিলাষী তো হতেই পারেন পিতা। বিশেষ করে অতি অল্প বয়স থেকেই একদিকে বিজয়া তালিম নিচ্ছিলেন ভারতীয় ধ্রম্নপদী সংগীতে, অন্যদিকে অর্জন করছিলেন পিয়ানো ও পাশ্চাত্য সংগীতে দক্ষতা। বাংলা ছাড়া হিন্দি যে-দুটি ছবিতে নায়িকার ভূমিকা ছিল তাঁর, সেই জনতা এবং রেণুকা ছবিতেও স্বকণ্ঠে গেয়েছেন তিনি। পিতার ইচ্ছাপূরণ হতে পারেনি, কারণ ব্যারিস্টার ও দীর্ঘদিন বিলেত-প্রবাসী চারুচন্দ্র দাশ ১৯৩১-এর ২৯ ডিসেম্বর প্রয়াত হলেন। বিজয়ার বয়স তখন মাত্রই চৌদ্দ।

আমাদের একটু আক্ষেপ হয়, যখন আমরা দেখি সত্যজিৎ রায় বিজয়ার অভিনয়ক্ষমতাও বিশেষ করে সংগীত-প্রতিভাকে যথার্থ কাজে লাগাননি। তপন সিংহ, অরুন্ধতী দেবী, মৃণাল সেন-গীতা সেন বা তরুণ মজুমদার-সন্ধ্যা রায়ের মতো সত্যজিৎ দম্পতি অন্বিত হলেন না, যদিও আমরা জানি, সত্যজিতের ছবির যাবতীয় চিত্রনাট্যের প্রথম শ্রোতা-সমালোচক ছিলেন বিজয়া। আগন্তুক, চারুলতাসহ সত্যজিৎকৃত বহু ছবিতেই শিল্পীদের গলায় গান তুলে দিতেন তিনি। আমরা এও জানি, সত্যজিতের ছবিতে পাত্রপাত্রীর পোশাক নির্বাচনে বিজয়ার প্রায় নিরঙ্কুশ ভূমিকা ছিল। কি ইনডোর, কি আউটডোর শুটিং, বিজয়া রায় গোটা ইউনিটকে নিজস্ব যত্নপরতায় সাবলীল রাখার দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া সাম্মানিক বিষয় হিসেবে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পাশ করা (আশুতোষ কলেজ থেকে ১৯৩৫-এ তিনি বি.এ পাশ করেন) বিজয়া ইংরেজি সাহিত্যে ছিলেন সু-অধীত। আরো উল্লেখ্য, বিজয়া ছিলেন ঘোর গোয়েন্দাকাহিনিভক্ত। সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ ২০১৩-তে এক প্রবন্ধে লিখছেন, ‘১৯৬৫ নাগাদ বাবা লেখালেখি শুরু করেন। ফেলুদা গল্প। সেই লেখার ম্যানুস্ক্রিপ্ট প্রথম মায়ের হাতে যেত। এর একটা কারণ আছে। মা হলেন গোয়েন্দা গল্পের পোকা। বাবার থেকেও অনেক বেশি ডিটেকটিভ গল্প পড়েছেন। বাবা মার কাছে জানতে চাইতেন মোটিভটোটিভগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে দিও। মা সাগ্রহে সে-কাজটি করতেন এবং বাবাকে সাজেস্টও করতেন। বাবা নিশ্চিতভাবে মার সাজেশন

গ্রহণও করতেন। শঙ্কুর গল্পের ম্যানুস্ক্রিপ্টে মাকে পেনসিল দিয়ে মার্ক করে দিতে দেখেছি।’ অতএব এটা স্পষ্ট, বিজয়া সত্যজিতের যোগ্য স্ত্রী যেমন, সত্যজিৎও তেমনি বিজয়ার যোগ্য স্বামী। অথচ তাঁর পরিচয় সীমাবদ্ধ হয়ে রইল চারুলতা ছবিতে চারু রুমালে যে কারুকাজ করেছে, তার শিল্পী হিসেবে। যে-বিজয়া সত্যজিতের সুর ঠিক করে দিতেন (ওই একই নিবন্ধে জানিয়েছেন সন্দীপ), বা আগন্তুক ছবিতে ‘বাজিল কাহার বীণা’ গানটি রুমা গুহঠাকুরতার মেয়ে শ্রমণাকে শেখাতেন, সেখানে সত্যজিতের কোনো ছবির নেপথ্য গায়িকা হিসেবে বিজয়াকে তো প্রত্যাশা করতে পারতেনই।

লেখালেখিতেও মনোযোগী ছিলেন বিজয়া একসময়। তবে অক্ষরশিল্পে তাঁর অবিস্মরণীয়তা শাশ্বত মর্যাদা লাভ করেছে ১৯৫২ থেকে ’৯২, এই চার দশক ধরে লেখা তাঁর ডায়েরিতে। এই ডায়েরির ভিত্তিতেই তিনি পরবর্তীকালে তাঁর অনবদ্য আত্মজীবনী আমাদের কথা রচনা করেন, যা সত্যজিৎ রায়ের শিল্পীজীবনেরও অক্ষয়-স্মৃতিভা-ার। মেরি শেলিকে মনে পড়বে আমাদের এ-প্রসঙ্গে, মনে পড়বে ডরোথিকে। কবি শেলি আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যরচনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রেখে গিয়ে এঁরা যেরকম অসামান্য ইতিহাসবোধের পরিচয় দিয়ে গেছেন, বিজয়া রায়ও তেমনি। ও আরো অধিক, কেননা এ-গ্রন্থে কেবল সত্যজিৎ রায় নন, আছে সমগ্র রায় পরিবার, আছে বিজয়া রায়ের বংশেরও অবিসংবাদিত মহত্ত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা, আছে তৎকালীন বঙ্গসমাজ ও বাঙালির কারু বাসনার ইতিবৃত্ত। রাসসুন্দরী থেকে সরলা দেবী বা পরবর্তীকালে সরলাবালা সরকার, মীরাদেবী (রবীন্দ্রনাথের কন্যা), বেগম সুফিয়া কামাল, রাণী চন্দ, মণিকুন্তলা সেন, জাহানারা বেগম বা লীলা মজুমদার, তাছাড়া আরো অসংখ্য বাঙালি নারীর আত্মজীবনী রচনার কথা জানা আছে আমাদের। কিন্তু বিজয়া রায় আমাদের কথা আত্মজীবনীটিতে যে অনন্যতা এনেছেন, কি বৃহদায়তনের দিক থেকে, কি বিষয়বৈচিত্রের বিচারে, আর কি রচনার প্রসাদগুণে, এটিকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিতেই হয়। বইটিতে সত্যজিতের এমন কতকগুলি পরিচয় তুলে ধরেছেন তিনি, যা অন্য কোথাও পাইনি আমরা। সত্যজিতের অসম্ভব সন্তানবাৎসল্য, একমাত্র ছেলের রোগব্যাধি হয়েছে কি একেবারে মুষড়ে পড়া, সত্যজিতের মাংস ও দইপ্রীতি, তাঁর হাজারো ইনডোর গেমসের ব্যাপ্ত জগৎ এবং মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধের পর্যায়ে পড়ে অতিথিপরায়ণতা, আত্মীয়স্বজনের বিপদে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ানো, সামাজিক কর্তব্য সুচারুভাবে পালন করা। এর ভূরি-ভূরি দৃষ্টান্ত আমাদের কথায় লভ্য। ‘আমাদের’ অর্থে কিন্তু সত্যজিৎ-বিজয়ার দ্বিবচন নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে আত্মীয়পরিজন, চলচ্চিত্র-ভুবনের লোকজন আর দেশি-বিদেশি অসংখ্য মানুষের কথা এ-বই; অতএব বহুবচন।

বিজয়া রায়ের কৃতি জমা হয়ে আছে সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও। প্রসাদরঞ্জন রায় জানাচ্ছেন, ‘মানিকদার মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই যখন নলিনী দাসও মারা যান, তখন (সন্দেশ পত্রিকা) সম্পাদনার দায়িত্বও নিতে হয়েছিল তাঁকে – প্রথমে লীলা মজুমদারের সঙ্গে যৌথভাবে, পরে একাই।’ প্রসাদরঞ্জনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী বিজয়া রায়ের লেখা ছোটগল্পেরও সন্ধান পাই আমরা, ‘দুই পড়শী’। আর সত্যজিৎ রায়ের মাকে (সুপ্রভা রায়) নিয়ে লেখা স্মৃতিচারণমূলক ‘মামণি’র কথাও জানি আমরা; কিছু সময়ের জন্য শিক্ষকতাও করেছেন কমলা গার্লস ও বেথুন স্কুলে। সরকারি চাকরিও করেছেন কিছুদিন। কিন্তু হাঁপানির মতো কঠিন রোগ নিয়ে নিয়মিত পরিশ্রমের ধকল সইতে পারেননি তিনি।

বিয়ের পর চাকরিসূত্রে সত্যজিৎ বিলেত যান জাহাজযোগে, সঙ্গে বিজয়া। ছবি তৈরির প্রাথমিক প্রেরণায়। তার আগে থেকেই সত্যজিৎ গঠন করেছিলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশীচন্দ্র গুপ্ত, নিমাই ঘোষ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত প্রমুখের সহযোগে। বিলেতে গিয়ে নিয়মিত ছবি দেখতেন দুজনে, আর ছবি করার সংকল্প নিয়ে ফেলেন সত্যজিৎ এবং কলকাতায় ফিরে এসে পথের পাঁচালীতে হাত দেন। অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যেত ছবির কাজ। সে-সময় ত্রাতার ভূমিকায় বিজয়া। তাঁর অলংকার বন্ধক দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছিল এক পর্যায়ে, ছবির শুটিং চালিয়ে নিয়ে যেতে। অথচ নির্মাল্য আচার্য ও দিব্যেন্দু পালিত-সম্পাদিত শতবর্ষে চলচ্চিত্র গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খ– সত্যজিৎ রায়ের এন্ট্রি রয়েছে যথাক্রমে ১০৭ ও ৪৪টি; কিন্তু বিজয়া রায়ের নামে কোনো এন্ট্রি নেই। ইতিহাস কেমন উদাসীন হত্যাকারী। কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে কখনো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সৌমেন্দ্র রায় অথবা হীরক সেন, সন্দীপ রায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়রা তুলে ধরেছেন কোথাও-কোথাও বিজয়ার জীবনের খ-চিত্র, এই পর্যন্ত। দীর্ঘ আটানববই বছরের ঋদ্ধ আর শীলিত শিল্পিত জীবন, অতুলপ্রসাদ সেন আর চিত্তরঞ্জন দাশের মতো দুর্লভ আত্মীয়-পরিবেশে, তাঁর কি এতটা অবহেলা প্রাপ্য? তাঁর অভিনীত ছবিগুলির মূল্যায়ন কি সম্ভব নয়, বা তাঁর গানের রেকর্ডের পুনঃপ্রকাশ? রেখে যাওয়া ডায়েরির মুদ্রণ? এভাবেই তাঁকে স্মরণ করার মহান উদ্যোগ নেওয়া উচিত আমাদের, ২০১৭-এ তাঁর আসন্ন জন্মশতবার্ষিকীর দিকে তাকিয়ে।