বিপরীত প্রবৃত্তির সংবেদনশীল সমন্বয়ক

আবুল মনসুর

১৯৯৫ সালে প্রথম বিলেত ভ্রমণে গিয়ে অনেক কষ্ট করে স্টোনহেঞ্জ দেখতে গিয়েছিলাম। মানুষের আদিতম বৃহৎ স্থাপত্য-প্রয়াসের অন্যতম এ-স্থাপনা বইয়ের পাতার ছবিতেই তার সমুন্নত গরিমা ও রহস্যের ঘেরাটোপ দিয়ে তৈরি করে রেখেছিল এক ধরনের ব্যতিক্রমী আকর্ষণ। সল্সবেরি অঞ্চলের সমতল পটভূমির মাঝখানে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নির্মিত বিশাল নিরেট পাথরের মণ্ডলাকারে পরিকল্পিত সমাবেশটির কাছে যখন দাঁড়ালাম, তখন স্তব্ধতা ও অপার্থিবতা-মাখানো এমন একটি অনুভূতির সঞ্চার হলো, যার বর্ণনা ভাষায় দেওয়া সম্ভব নয়। নিওলিথিক যুগের সে-স্থপতির বিবেচনায় কি জায়গাটির ব্যবহারযোগ্যতার পাশাপাশি তার দৃশ্যগত ও অনুভূতিগত প্রয়োজনীয়তার কথাটিও ছিল? সেটি কখনো জানা যাবে না।
তবে আজকে আমরা জানি যে, সৃজনকর্তার কাছে স্থাপত্যের দাবি একটু বেশি রকমের। ঘরবাড়ি, বহুতল অট্টালিকা, প্রার্থনালয়, সমাধি থেকে শুরু করে শপিংমল, ব্রিজ-কালভার্ট, স্টেডিয়াম অথবা কারপার্ক সবারই দাবি, আমাকে ব্যবহারযোগ্যতার পাশাপাশি একটু সুন্দর করেও গড়তে হবে। প্রাচীনকাল থেকেই স্থপতিকুল এ দুয়ের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে গেছেন এবং দর্শনধারী অনুপম সব স্থাপত্যকর্ম, কোনো কোনোটির ভগ্নদশা সত্ত্বেও, এখনো আমাদের অপার বিস্ময়ের আকর হয়ে বিরাজ করছে। এসব অনবদ্য স্থাপত্যের কোনোটি পিরামিডের মতো সরলরৈখিক জ্যামিতি-নির্ভর ও নিরাভরণ, কোনোটি বারোক বা রোকোকো স্থাপত্যের মতো সর্পিল ও কারুকার্যশোভিত। দৃশ্যকলার অন্যান্য শাখায়, বিশেষত চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে, নব-নব আন্দোলন ও ভাবনা-বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্যেও ঘটেছে রূপ ও তাৎপর্য-চিন্তার পরিবর্তন। শিল্পকলায় বিগত শতকের চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকজুড়ে মডার্নিজম বা আধুনিকতাবাদ একটি বিশেষ মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং স্থাপত্যকলাসহ সকল শিল্পশাখায় এর গভীর ও ব্যাপক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
চিত্র-ভাস্কর্যে মডার্নিজম-প্রণোদিত জ্যামিতিক বিমূর্ততার সমাপতন স্থাপত্যে ঘটেছে সরলরৈখিক জ্যামিতিক আকৃতিসমূহের নিরাভরণ ও তাৎপর্যময় ব্যবহারময়তার মধ্যে। ফরাসি স্থপতি কর্বুসিয়ের, মার্কিন স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট ও লুই কান, ওলন্দাজ ভ্যান ডার রোহ প্রমুখকেই আধুনিক স্থাপত্যের পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, যদিও ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস বা আরো কারো নামও আসতে পারে। তবে তাঁদের মধ্যে মাত্রার পার্থক্য রয়েছে। ভ্যান ডার রোহ, লুই কান বা অস্ট্রিয়ান স্থপতি এডলফ লুইস ছিলেন আপসহীন আধুনিকতাবাদী। লুইসের অভিমত, ‘অর্নামেন্ট ইজ ক্রাইম’ বা ভ্যান ডার রোহের ‘লেস ইজ মোর’ স্থপতিসমাজে কিংবদন্তি উক্তি। সে-তুলনায় লয়েড রাইট বা কর্বুসিয়েরের কাজ অনেকটা নমনীয় মনে হতে পারে, যদিও কর্বুসিয়েরের উক্তি ‘ফর্ম ফলোস ফাংশন’ যথেষ্ট আধুনিকতাবাদী, অন্যদিকে লয়েড রাইটের ‘অরগানিক আর্কিটেকচার’ নামের ধারণার মধ্যে মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যের বার্তা রয়েছে। লয়েড রাইটের ‘ফলিংওয়াটার’ (পেনসিলভানিয়া, ১৯৩৭) এই জ্যামিতিক তলের বিবিধ মাত্রিক ব্যবহারের পাশাপাশি পরিপার্শ্বের প্রতি মনোযোগের একটি অনন্য উদাহরণ।
মাজহারুল ইসলাম বিদেশে স্থাপত্যশিক্ষা ও স্বদেশে কাজ করেছেন মূলত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, যখন দৃশ্যকলায় মডার্নিজম বা আধুনিকতাবাদের রমরমা অবস্থা। স্বভাবতই তিনি মূলত এই আধুনিক ঘরানারই প্রতিনিধি-স্থপতি। তবে হয়তো তাঁর অবস্থান আধুনিকতাপন্থী দুটি ঘরানার মাঝামাঝি কোথাও। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎও এ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। এদেশের স্থাপত্যজগতে তাঁর অবস্থান অনেকটা চিত্রকলা জগতে জয়নুল আবেদিনের মতো Ñ একই সঙ্গে পিতৃপুরুষ ও সেরা রূপকার। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের প্রেক্ষাপটে জয়নুলকে হয়তো ততটা আধুনিক বলা যাবে না; কিন্তু মাজহারুল ইসলাম যথার্থভাবে প্রথম আধুনিকও। তাঁর স্বাতন্ত্র্যও বিশেষ বিবেচনার বিষয়।
আমাদের নিজস্ব স্থাপত্য-ঐতিহ্যের কিছু তাৎপর্যময় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে তাকে আধুনিকতাবাদের শুদ্ধাচারিতা ও বৈশ্বিক একত্ব ধারণার মাঝে স্থান দেওয়া কঠিন। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ স্থাপত্যকলাকে একটি ব্যবহারিক বিষয় হিসেবে জানে। এর শিল্পমূল্য নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। স্থাপত্যের ব্যবহারযোগ্যতার দিকটি তার নান্দনিক গুরুত্বের দিকটাকে খানিকটা আচ্ছন্নও করে রাখে বটে। এরকম পরিবেশে ব্যবহারিক প্রয়োজনের পাশাপাশি মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্যের শিল্পগুণ নিয়েই শুধু ভাবেননি, প্রাকৃতিক পরিপার্শ্ব ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এর সঙ্গতি বিষয়েও সচেতন থেকেছেন। তাঁর শিক্ষক লুই কান তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছেন, তবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু, সাংস্কৃতিক আবহ, স্থাপত্য-ঐতিহ্য, এসবও তাঁকে ভাবিয়েছে। তিনি ছিলেন প্রখরভাবে রাজনীতি ও সংস্কৃতি-সচেতন মানুষ। নিজের জীবনেও সৌম্য-সরলতা আর সৌন্দর্যচেতনার এক চলমান উদাহরণ। ফলে অন্য যে-কোনো সাধারণ পেশাজীবী স্থপতির মতো শুধু স্থাপত্যিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে তিনি তাঁর স্থাপত্যচিন্তাকে সীমায়িত করেননি।
শিল্প হিসেবে স্থাপত্যের অবস্থান মুক্ত পরিসরে আমজনতার মাঝখানে। ফলে এর ডৌলটিকে হয়ে উঠতে হয় সকলের সংবেদে অনুরণন তুলতে পারে এমন সর্বজনীন আবেদনসমৃদ্ধ ও অর্থপূর্ণ। এ কাজটি সে-বস্তুই করতে পারে, যা স্থান-কাল থেকে বিচ্ছিন্ন নয় অথচ আধুনিক ও সমসাময়িক প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ফলে একজন স্থপতির মধ্যে একজন দার্শনিককেও বাস করতে হয় Ñ অন্যান্য শিল্পমাধ্যম থেকে খানিকটা বেশি করে। মাজহারুল ইসলাম ছিলেন এমনই এক বিরল দার্শনিক-স্থপতি। ফলে মডার্নিস্ট হয়েও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে স্থাপত্যের সঙ্গতিকে নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়েছে, ভাবতে হয়েছে এদেশের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়ে। বাংলাদেশের সমভূমেই তাঁর অধিকাংশ স্থাপত্যের অবস্থান, কিন্তু যেখানেই সুযোগ মিলেছে (যেমন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) সেখানে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যকে চমৎকারভাবে স্থাপত্যে সঞ্চারিত করেছেন। এ-কাজটি এমন সুসংগতভাবে এ পর্যন্ত খুব কম স্থপতিই করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। পাহাড় ও প্রাকৃতিক জলাধারকে বিনষ্ট না করে তিনি স্থাপত্যকে প্রকৃতির অংশ রূপে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। আমাদের প্রখর রোদের দেশে আলোছায়ার নানান বুনট রচনার সুযোগ বা বর্ষার বারিধারাকে স্থাপত্যের মধ্যে উপভোগের সুযোগ রচনার কথা তিনি ভেবেছেন। এদেশের স্থাপত্য-ঐতিহ্য বিষয়ে মাজহারুল ইসলাম ছিলেন প্রখরভাবে সচেতন। পলেস্তারাবিহীন লাল ইটের ব্যাপক ব্যবহারের মধ্যেই শুধু তিনি এর পরিচয় রাখেননি, নানান নকশায় ইটের গাঁথুনি ও দুর্গ-সদৃশ মনুমেন্টাল বহির্দেয়ালের প্রচুর ব্যবহারেও বোধ করি এ-সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে।
নান্দনিক বিবেচনায় মাজহারুল ইসলাম একান্তভাবে ‘মডার্নিস্ট’। তাঁর কাজের মেদহীন নিরাভরণ অবয়ব একদিকে ন্যূনতা ও মনুমেন্টালিটিকে ধারণ করে, আবার অন্যদিকে এর মধ্যে এক চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মনের প্রকাশ ঘটে স্রষ্টার নান্দনিক ভাবনা ও স্থাপত্যিক সত্যানুসন্ধে। তাঁকে বলা যায় বিরল এক ভিশনারি, যিনি তাঁর ভাবনা বা দূরদৃষ্টিকে শুধু স্থাপত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, ভেবেছেন সমগ্র দেশের মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানসহ এক সার্বিক মুক্তির কথা, যেখানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে স্থাপত্য।
অসংখ্য স্থাপত্যকর্মে তাঁর কীর্তি বিধৃত রয়েছে, গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে করা তাঁর এসব স্থাপত্যনিদর্শন অর্ধশতাব্দের অধিককাল পার করেও রয়েছে অনতিক্রমিত। ১৯৫৪ সালে করা তৎকালীন আর্ট কলেজ এখনো বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য-নিদর্শনের একটি। ষাটের দশকে এ-প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়ে ছবি আঁকার পাঠ যেমন নিয়েছি, তেমনি এর ভবন ও প্রাঙ্গণ প্রথম উপলব্ধি ঘটিয়েছিল স্থাপত্যিক সৌন্দর্যের। এরপর গত প্রায় পঁচিশ বছরে বিশ্বের অন্তত গোটাবিশেক শিল্প-শিক্ষালয় দেখার সুযোগ ঘটেছে; কিন্তু আমার সেই আর্ট কলেজের চেয়ে সুন্দর কোনো শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান আজো দেখিনি, দেশে-বিদেশে বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপে এ-কথাটি অহঙ্কারের সঙ্গে বলি।
মাজহারুল ইসলাম আমাকে এমন অহঙ্কারের অধিকার দিয়েছেন। তাঁর স্মৃতি অক্ষয় হোক।