বিশ্বায়নের পা

ই ক তি য়া র  চৌ ধু রী

ডিকের আসার কথা ছিল পাঁচটায় কিন্তু এলো সন্ধে সাতটায়। আমাদের এই আরেক দোষ, সময়কে মান্য করতে চাই না। কৈফিয়ত দিলো, ছেলেকে ভার্সিটিতে নামিয়ে আসতে দেরি হলো। ডিকের ছেলে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। ভার্সিটিতে তার কী কাজ বুঝতে পারলাম না। আমার চোখে প্রশ্ন দেখে ডিকে জানাল, রোকেয়া হলের সামনে নামব। তারপর হেসে যোগ করল, ওর ক্যাডেট কলেজের বন্ধুরা নাকি ওখানে আসবে।

: এতো জায়গা থাকতে হলের সামনে কেন?

: তা তো জানি না।

: জানি না বললে তো হবে না। ছেলে যখন উপযুক্ত, তখন দরকারি কাজটা সেরে ফেল।

: সারব।

: প্রস্ত্ততি চলছে তাহলে।

: ঠিক তা নয়। এ-মাসের শেষে বান্টি চার মাসের  ট্রেনিং প্রোগ্রামে কানাডা যাবে। সেখান থেকে ফিরলে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব ভেবেছিলাম; কিন্তু তা হবে বলে মনে হচ্ছে না।

ডিকের ছেলের নাম বান্টি। জিজ্ঞেস করলাম –

: হবে না কেন?

: কানাডার পর ইউএন মিশনে সিয়েরালিওন যাওয়ার কথা।

: বান্টির বৃহস্পতি তো শিখরে। বেটা-বাপ দুজনকেই অভিনন্দন।

: ওয়েলকাম।

বান্টি আমাদের নিজেদের ছেলে। পেশাগতভাবে খুবই ভালো করছে। কতদিন সেটি পারবে জানি না। কারণ এখন তাদের অনেকে বেসামরিক প্রশাসনে উচ্চপদ নেওয়ার পাশাপাশি করপোরেট সংস্কৃতিনির্ভর হয়ে পড়ছে। তাদের ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পর্যটন ব্যবসা পরিচালনা এ-সংস্কৃতির খানিকটা। আমার ভয়, এতে তাদের পেশাদারিত্ব নষ্ট না হয়ে যায়।

ডিকে আমার পুরনো বন্ধু। স্কুলজীবন থেকে। বহু বছর পর আজ সন্ধ্যায় আমাদের দেখা হলো। ডিকে আসলে সংক্ষিপ্ত নাম। ওইভাবে আমার নাম জেজে। কারো পুরো নামই আজ আমি প্রকাশ করব না। তাতে সমস্যা হতে পারে। কারণ একটু পরেই আমরা মদ খাব। রক্ষণশীল সমাজে মদ খাওয়াকে কেউ ভালো মনে করে না। পবিত্র কোরানে অন্তত তিন জায়গায় মদ্যপানকে নিষিদ্ধের বিষয়ে বলা হয়েছে। আবার কারো কারো মতে পান নয়, কোরান নেশাকে হারাম করেছে। ব্যাখ্যা যাই দেওয়া যাক, দ্রব্যগুণ বলে কথা। জিনিস পেটে পড়লে নেশা অল্পবিস্তর হয়েই যায়। ডিকে এতো যে সিজন্ড পানেওয়ালা সেই বাহাত্তর সাল থেকে, সে পর্যন্ত দ্রব্যগুণে টলে উঠতে চায়। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা তার। জমি কেনাবেচা করে। তবে দালাল নয়। বছরের পর বছর জমি কিনে ফেলে রাখে। সময়মতো ছেড়ে দেয়। মদ খাওয়ার কোনো পর্যায়ে সে যখন বলে, তার এখন মাটি খেতে ইচ্ছা করছে, তখন অনেক বছরের সঙ্গ থেকে বুঝতে পারি, ওর মধ্যে গোলাপি ক্লিক ঝলকানি দিচ্ছে।

ডিকেকে আমি কাঠের চেয়ারে বসতে দিই। নিজেও টেনে নিই একটা। আমাদের দুজনেরই ব্যাক পেইনের সমস্যা রয়েছে। মুখোমুখি বসলে ডিকের চুলের বিন্যাসের পরিবর্তন নজরে এলো। আগে মাথার বাঁপাশে সিঁথি ছিল, এখন চুল ব্যাকব্রাশ করা। তাতে ওর চেহারায় বনেদিয়ানা এসেছে। ডিকে বনেদিঘরের মানুষ নয়। কিন্তু যখন থেকে মাটির সঙ্গে টাকাটা আসা আরম্ভ হলো, তখন থেকে তার চেহারা খুলতে থাকল। তবে সেটি বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো, সে আমার খুব কাছেরজন। ডিকে জিজ্ঞেস করে-

: এবার থাকবি তো কিছুদিন? অনেকদিন পর এলি।

: তা থাকব কিছুদিন। ধর সপ্তাহপাঁচেক।

: গুড। শালা আফ্রিকায় মানুষ থাকে। জেজে, তুই খালি চিনেছিস পয়সা।

মনে মনে বলি, এ তো স্ববিরোধিতা। ডিকে জমি আর টাকায় এতো মজেছে যে, নেশা হলে মাটি খেতে চায়। সে-ই কিনা বলে, আমি চিনেছি পয়সা। হেঁয়ালি করে উত্তর দিই-

: গরিব মানুষ – কর্ম বলে কথা। কর্ম আমাদের নরকে পর্যন্ত নিয়ে যাবে দোসত্ম‌। আর এ তো আফ্রিকা।

আমার চাকরিস্থল সুদান। আরো নির্দিষ্ট করে বললে দারফুর। জাতিসংঘের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থায়। গত প্রায় পঁচিশ বছর কালো আফ্রিকার গৃহযুদ্ধকবলিত বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছি। জান একেবারে কয়লা হয়ে গেল।

ডিকে নিজেও একবার সেই মধ্যআশিতে বিদেশ যেতে কম চেষ্টা করেনি। সৌদি ওর প্রথম পছন্দ হলেও মিডলইস্টের যে-কোনো দেশেই কাজ করতে মুখিয়ে ছিল। তবে তার একটাই ভয় ছিল, বাজে দালালের খপ্পরে পড়ে পুঁজিটা না খসে যায়। আদম বেপারিকবলিত এলাকার মানুষ আমরা। কতজনকে যে তারা কাপড়ছাড়া করেছে তার হিসাব পাওয়া যায় না। তাদের একজন পাড়াত চাচা তফাজ্জল। আমাদের সমবয়সী। দুবাইয়ে কাজ পেল। দর্জির দোকানে সেকেন্ড মাস্টার। বেপারীর মুখের খবরেই সে আনন্দে পানিতে চিনির মতো হয়ে গেল। দুবাই পৌঁছে জানাল মাস্টার নয়, সে উটের রাখাল। ভিসার মেয়াদ দুবছর নয়, তিন মাস। ডিকের জমি বেচাকেনার সূচনাকাল তখন। ব্যবসায় রমরমা কবে আসবে তা ছিল অনিশ্চিত। ভালো দালাল ধরতেই তিন বছর শেষ। তাতে বরং ক্ষতির চেয়ে  লাভই হলো। সাভারে যে-জমি ডিকে একসময় সাড়ে তিন লাখে কিনেছিল তা অনায়াসে বাইশ লাখে উঠে গেল। সে মিডলইস্ট ছেড়ে সাভার, গাজীপুর ও জয়দেবপুরের মাটি খামচে ধরল। ওকে সে-কথা স্মরণ করিয়ে দিই –

: আমি না হয় আফ্রিকায় ধুঁকছি, তুই তো এককালে মরুভূমিতে মরতে রাজি ছিলি।

ডিকে মৃদু হাসে।

ওর জন্য ডিসেন্ট থেকে স্ন্যাক্স‌ আনাই। আমার বাসা পুরনো ঢাকায়। মতিঝিল ঘেঁষে। আগের বার ঢাকায় এসে আমাদের মহল্লায় ওয়েল ফুড, অলিম্পিয়া, ডিসেন্টের মতো ফাস্টফুড পাইনি। এসব দোকানে ক্রেতাদের ভিড় জানান দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই মজবুত। ডিকে সামান্য স্ন্যাক্স নিয়ে বলে –

: খালি পেটে মদ্যপান ঠিক নয়। লিভারের ক্ষতি।

: সে আর নতুন কী?

নতুন নয় এজন্য যে, এই তথ্য ডিকে আমাদের বহুবার দিয়েছে। শুধু দেওয়াই নয়, হালকা খাবার ছাড়া তাকে কখনো পানরত পাইনি। তার কাছে জানতে চাই আজ রাতে সে কী খাবে। স্কচ, না অন্য কিছু। ডিকে অ্যাবসোলুট ভদকা পছন্দ করল। বলল –

: শীতে ভদকাই ভালো। আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম ডিয়ার ফ্রেন্ড। কবে যে সাইবেরিয়ার তুষারপাত ভদকায় ঠেকিয়ে দিতে পারব।

ডিসেম্বরের ঢাকা। শীত পড়েছে। তবে মাত্রায় সাইবেরিয়ান শীতের অনেক বিঘত দূরে। সেখানকার অধিবাসীরা ঢাকার এই আবহাওয়াকে বলবে সামার। উত্তর দিলাম –

: আজ রাতে ঢাকার সামার ঠেকাও। পনেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আবার শীত নাকি। তা ব­vডি, মেরি, না ভার্জিন মেরি চলবে।

: ভার্জিন।

ডিকের বরাবরই ভার্জিনের প্রতি আসক্তি। আমি গৃহকর্মী রেখাকে কমলার রস আর বরফ দিতে বলি। রেখা পুরনো মানুষ। যখন দারফুরে থাকি, সে আর তার স্বামী আমার বাসা সামলায়। রেখার আসল নাম নজিরন। বাড়ি জামালপুরে। বম্বের (মুম্বাই) এক সময়ের নায়িকা রেখার নাম ধারণ করে ঢাকায় কাজ করছে। ওর চুলের স্টাইল রেখার চুলের মতো। আর নিজেকে রাখে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। কমলার রস আর বরফ এলে ডিকে বলে –

: এশার ওয়াক্তের দেরি নেই। এখন বসলে সালাত কাজা হবে।

সে বাথরুমে বেশ সময় নিয়ে যত্ন করে ওজু সারে। আমি জায়নামাজ এনে দিই এবং ওর প্রার্থনার একাগ্রতায় মনোনিবেশ করি। তাতে আমার এই উপলব্ধি হয় যে, ডিকে এ-মুহূর্তে আল্লায় নিরঙ্কুশ সমর্পিত।

ভার্জিন মেরিতে চুমুকের সঙ্গে দুজনের গল্প শাখা-প্রশাখায় ছড়াতে থাকে। বরাবরের মতো এর অনেকটা জুড়ে থাকে আমাদের কৈশোর। এর কারণ মনে হয় মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, ততোই তারা পেছনটায় ফিরতে চায়। আমাদের কথোপকথনে সেসব বিষয় বেশি আসতে থাকে, যা ছিল আনন্দের। একই গ্রামে বাড়ি আমাদের। আলাপচারিতার বেশিটা জুড়ে থাকে সেখানকার বন্ধুরা। তাদের একজন মাজেদ। মাজেদ কেন? বিড়ির ফাটাফাটি টান আর রসিকতার জন্য সে ছিল বিখ্যাত। চোষা টানের পর তর্জনীর টোকায় বিড়ির গোড়া এতো জোরে ছুড়ত যে, তা মারিয়ামদের সামনের উঠোন পেরিয়ে হালটে গিয়ে পড়ত। মারিয়ামের মেজভাই বারাকাত ছিল আমাদের বন্ধু। ওর ঘরে বসে আমরা সারাদিন আড্ডা দিতাম। তাই যদি হয়, তাহলে তো মারিয়ামদের উঠোন না বলে বারাকাতদের বলা শ্রেয়। আসলে একধরনের দুর্বলতা থেকে এমনটা বলা। ততোদিনে মারিয়াম ডিকেকে ভালোবাসতে শুরু করায় সে আমাদের কাছেও কতকটা স্বপ্নপরীর মতো হয়ে উঠছিল। অবশ্য মারিয়াম-ডিকের প্রেম শেষ পর্যন্ত বিয়ে অবধি পৌঁছেনি। প্রেমের খবর চাউর হলে অভিভাবকরা সাবধান হলেন। তখন পাকিস্তানি জমানা। একদিন ডিকেকে বললাম –

: তোরা পালিয়ে যা। তোদের  দুজনকে আমরা হিজবুল বহরে তুলে দেবো।

: হিজবুল বহরটা আবার কী?

জানতে চাইল ডিকে।

: জাহাজ। তবে যাত্রীবাহী কিনা জানি না।

: তো?

তখন চিটাগাং-করাচি প্যাসেঞ্জার-শিপ যাতায়াত করত। উত্তর দিলাম।

: হিজবুল বহর না হোক যে-কোনো একটা জাহাজে তুলে দেবো তোদের। করাচি চলে যাবি। এখানে তোদের বিয়ে কেউ মানবে না।

চিটাগাং-করাচি জনপ্রতি জাহাজ ভাড়া ছিল সত্তর-আশি টাকা। ডিকে আর আমরা তার বন্ধুরা ওই টাকা জোগাড় করতে না পারায় মারিয়াম পর্ব শেষ হয়ে গেল।

ভার্জিন মেরিতে যতটা না চুমুক তার চেয়ে বেশি চলে কথা। ডিকেকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করি –

: চার দশকের বেশি হয়ে গেল। মারিয়ামকে কি তোর মনে পড়ে?

ডিকে সলজ্জ হাসে। কিছুটা যেন বিব্রতও। জবাব দেয় –

: না, পড়ে না।

আমি একটু আশ্চর্য হই। বলি –

: কখনো মনে পড়ে না।

: না।

: বলিস কী!

: সত্যিটা সবসময় একরকম থাকে না। ওই সময় মারিয়াম সত্যি ছিল, এখন বান্টির মা।

: কোনো খোঁজ কি জানিস?

: সিডনি না মেলবোর্ন কোথায় যেন থাকে।

ডিকের হ্যান্ডসেটে কল আসে। আমি তার কথা অনুসরণ করতে না চাইলেও শব্দগুলো কানে আসে। যখন বুঝতে পারি আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে তখন মনোযোগ না দিয়ে পারি না। ডিকে বলছে –

: তুই ঠিকই শুনেছিস, জেজে এখন ঢাকায়। শুধু ঢাকায় নয়, সে এখন আমার সামনে। কী বললি বহুদিন হলো ওকে খুঁজছিস। জায়গামতো খুঁজতে হবে দোসত্ম‌। কোনোদিন নিজ থেকে তো কল দিস না। আজ দরকার পড়ল তবেই না। তা জায়গামতো দিয়েছ। নে জেজেকে দিলাম।

আমি বুঝতে পারি না, কে আমাকে বহুদিন হলো খোঁজ করছে। কল রিসিভ করার আগে তাই জানতে চাই –

: কে রে ডিকে?

: ধরেই দেখ না।

ডিকের সেলফোন কানে ঠেকিয়ে বলি –

: হ্যালো।

: শেষ পর্যন্ত তোমারে পাইলাম। দেখ তো, গলা শুইনা চিনতে পার কিনা।

আমি চিনতে পারি। গলা আর বাচন দুটোই পরিচিত। চল্লিশ বছরের অশ্রবণও তা ভোলাতে পারেনি। ফোনের অপর প্রান্তে আমাদের স্কুলজীবনের ফাটাফাটি বিড়ি টানের নায়ক মাজেদ। জবাব দিই-

: তোমাকে না-চেনা তো পাপ। তা তুমি এতোকাল পরে এভাবে, কী আশ্চর্য!

: আশ্চর্য হয়ো না। দেশে আসছ শোনার পর থাইকা তোমারে বিছরাইতেছি। আইজকা পাইলাম।

: বিছরাইতেছ? তোমার সঙ্গে তো আমার অলমোস্ট চল্লিশ বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নাই। আমি যে ঢাকায় জানলে কীভাবে?

: জানার রাস্তার কি অভাব আছে? তোমার গ্রামের বাড়িত থাইকা খবর নিছি। তুমি যে দ্যাশে, সে-ধারণা অবশ্য করি নাই। ট্যাটনরে মোবাইল মারছি – সে আমারে তাজ্জব বানাইয়া কয় তুমি নাকি ঢাকায়।

ট্যাটন আমার দূরসম্পর্কের চাচাত ভাই। কিশোরকালে বহু দুষ্কর্মের সঙ্গী। মাজেদ আর ডিকেও ওইসব অভিযানের দুর্ধর্ষ সদস্য ছিল।

: তারপর?

: তারপর আর কী? তোমার কন্ট্যাক্ট নম্বর নিলাম। বহু ফোন মারছি। তুমি ধরো নাই। আমি অবশ্য কিছু মনে করি নাই। ভিআইপি মানুষ তোমরা। আননোন নম্বর ধরাটা তোমাদের খাটে না।

মাজেদ বলল বটে কিছু মনে করেনি; কিন্তু ফোন রিসিভ না করায় সে যে নাখোশ তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। আমি সেদিকে না গিয়ে বললাম –

: আগে তোমার নম্বরটা বলো দেখি, সেভ করে নিই।

: তোমার ফোনে মিস কলে সার্চ দিলেই পাইবা। ভিআইপি নম্বর, বুইজলা। শেষের ছয়টা নম্বর ৭৭৮৮৯৯। না হইলেও বিশবার কল দিছি।

আমি ভাবি, মেলানো বা সিরিয়াল ডিজিট দিয়ে তা হলে তথাকথিত ভিআইপি নম্বরের চল হয়েছে। মাজেদের কথায় অন্তত তাই মনে হয়। এবার তার একটু আগের নির্দোষ খোঁচা ফিরিয়ে দেওয়া যায়। বললাম –

: ভিআইপি মানুষ ভিআইপি নম্বর। মিসড‌ কলে না পেলেও অসুবিধা নেই। আমি ডিকের কাছ থেকে নিয়ে নেব।

মাজেদ সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে একেবারে যে খোঁজ নেই তাও না। আমি জানতাম বিএ ডিগ্রির পর সে রেলে ঢুকেছে। ঈশ্বরদীতে কর্মরত ছিল। সেখানে বাড়ি করার কথাও শুনেছিলাম একবার। দেশে এলে যোগাযোগ কমবেশি সবার সঙ্গেই হয়। কেন জানি না, সে-ই ব্যতিক্রম। মাজেদের গলা শুনতে পাই –

: চুদুর্কি মাইর না। রেলের গার্ড আবার ভিআইপি।

ইয়ার্কির বদলে মাজেদ বরাবরই চুদুর্কি বলে, তা বহুকাল পর আবার আমার মনে পড়ে গেল। বললাম –

: তা কী জন্য স্মরণ করেছ?

: না, তেমন কিছু না। বহুকাল কথাবার্তা হয় না আর একটু দরকারও পইড়া গেল।

: তা আগে তোমার খবর বলো। চলছে কেমন?

: ভালো। রিটায়ার্ড করেছি – জানো না মনে হয়।

: না। তা অবসরের পর কোথায় সেটেল্ড‌ করলে?

: এখনো করি নাই। পিআরএল চলতাছে। জীবনের প্রায় পুরাটা  ঈশ্বরদীতে থাকলাম। বাকি সময়টাও মনে হয় সেখানেই কাটব।

: ওখানে কি বাড়ি করেছ?

: না। তবে তিন কাঠার একটা পলট আছে।

: ছেলেমেয়ের খবর কী?

: মেয়ে তো নাই। ছোট ছেলেটার বিষয়ে একটু কথা বলার জন্য ফোন দিলাম।

: বলো, আমি শুনছি।

: ওরে তোমারে একটু টান দিতে হইব।

: বুঝলাম না।

: আমার তিন ছাওয়ালের বড় দুইটাই বিদেশ থাকে। ছোটটারেও পাঠাইতে চাই।

: কী করে তোমার ছেলেরা?

: বড়টা আছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। গ্রোসারি শপ চালায়। ব্যবসা তার ভালোই চলতাছে তবে কাউলাদের দ্যাশে নানা গ্যাঞ্জাম।

: কী রকম?

: ভাইরে দ্যাশে দ্যাশে এখন চাঁদাবাজি। মাঝে মাঝেই দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে কাউলারা হামলা কইরবার চায়।

: ও।

: পরেরটা আছে ওমানে। তার অবশ্য বড়টার মতো চাঁদাবাজি সামলাইতে হয় না। কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে সুপারভাইজারের চাকরি।

সন্তানদের অর্জনে মাজেদের গলায় আত্মতৃপ্তি। ডিকের গ্লাস খালি হয়ে গিয়েছিল। আমি তাতে ভদকা ঢালতে ঢালতে মাজেদকে বলি –

: খুব ভালো খবর। তা দুছেলে তো বাইরে আছে। ছোটটাকে না হয় নিজের কাছে রাখো।

: থাকতে চায় না। ট্রেন-পরিচালকের চাকরি নিয়া দিলাম তাতেও মন নাই। আর আমারও ইচ্ছা বিদ্যাশেই যাক।

আমি তার ছোট ছেলের চাকরির ধরন বুঝতে পারি না। জিজ্ঞেস করি –

:  ট্রেন-পরিচালকের চাকরি – ঠিক বুঝতে পারলাম না মাজেদ।

সে তখন ফোনের অপর ধার থেকে হেসে জবাব দেয় –

: বুইজলা না। যা লাউ তা-ই কদু। সোজা বাংলায় ট্রেন-পরিচালক হইল গিয়া রেলের গার্ড। বোঝই তো সমাজে চলতে-ফিরতে হয়। স্ট্যাটাসটা তাই নিজেদের মতো কইরা বাড়ায়া নেওয়া।

আমি হাসতে হাসতে জবাব দিই –

: মাজেদ, তুমি এতোকাল পরেও আগের মতোই আছ। তা বলো, আমি তোমার কী কাজে লাগতে পারি।

: বললাম তো, আমার ছোটটারে একটু টান দাও। তুমি তো সুদানে আছ – তবে সেইখানে না। ছোটটা আবার কাউলা-ঝাউলার দ্যাশে যাইতে চায় না। তার পছন্দ কানাডা।

: কানাডা। সেখানে কাউকে পাঠানোর ক্ষমতা কি আমার আছে?

: তুমি একটু টান মারলেই হবে।

: কী যে বলো না তুমি। ছেলে তোমার দেশেই তো ভালো করছে। এখনকার সময়ে একটা জব পাওয়া অনেক বড় কথা। তারপরেও যদি সে বিদেশ যেতে চায়, সাউথ আফ্রিকা তার জন্য ভালো হবে। সেখানে সহজেই বড় ভাইয়ের ব্যবসায় ঢুকে যেতে পারবে।

: তা আমি জানি জেজে। তারপরেও কথা কি জান, ছেলেরা আমার ছড়ায়া থাকুক সেটাই আমি চাই। একেক জায়গায় একেকজন। ধরো গিয়া কতকটা ফ্যামিলি লেগের মতন। কানাডায় যদি যাইতে পারে তাহলে সাদা দুনিয়ায়ও একটা লেগ পড়ল আর কি।

মাজেদের  বিশেস্নষণে আমি উঁচু শব্দে হেসে উঠি। বলি –

: কথাটা তুমি ভালোই বলেছ দোসত্ম‌। তবে শোনো, আমি আর ডিকে একটু বসেছি। তোমার সঙ্গে না হয় পরে কথা বলব।

: সমস্যা নাই। সুবিধামতো কল দিও।

ফোন ছিন্ন করে আমি এবার ডিকের গস্ন­vসে কমলার রস ঢেলে দিই। সঙ্গে বরফ। নিজেও নিই। ভদকার দোলায় রাতের প্রথম প্রহর তখন ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ডিকে বলে –

: আমি আর খাব না।

: কেন মাটি খেতে ইচ্ছা করছে?

: না, তা না। হালকা গোলাপির মতো হয়েছে মাত্র। তবে এই ভালো। আমাকে তো আবার গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরতে হবে।

: বান্টিকে তুলবি না?

: না, ও চলে যাবে নিজের মতো।

ডিকে একটুখানি ভার্জিনের তলানি নিয়ে বসে থাকে। আমি তাকে কোনো অনুরোধ জানাই না। কিছুক্ষণ আগের মাজেদের ‘ফ্যামিলি লেগ’ কথাটা আমার কাছে বেশ তাৎ‌পর্যপূর্ণ মনে হতে থাকে। মনে হয় কথাটা ফ্যামিলি লেগ না হয়ে গেস্নাবালাইজেশনের লেগ হলেই হয়তো ভালো হতো। r