বিশ শতকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি বিজ্ঞানী

চিত্তব্রত পালিত

 

বিশ শতকের শুরু থেকে যে সমসত্ম কৃতী বাঙালি বিজ্ঞানচর্চায় মগ্ন হন তাঁদের মধ্যে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে পুরোধাই ভাবতে হয়। তাঁর জন্ম ১৮৯৩ সালের ২ জুন। তাঁরা আদিতে বিক্রমপুরের জমিদার বংশের। তাঁর পিতামহ গুরুচরণ ১৮৫৪তে কলকাতায় চলে আসেন এবং রাসায়নিকের ব্যবসায় লিপ্ত হন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন এবং নানারকম সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ব্রাহ্ম সমাজের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুবোধচন্দ্র প্রশান্তচন্দ্রের পিতা। তিনি সে-যুগের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ। এডিনবরা ইউনিভার্সিটি থেকে শারীরবিজ্ঞানে ডক্টরেট হন। ফিরে এসে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের শারীরবিদ্যা বিভাগের প্রধান হন। প্রশান্ত তাঁরই সুযোগ্য পুত্র এবং শৈশবকাল থেকেই বাংলার মনীষীদের সংস্পর্শে বড় হন।

শৈশবের শিক্ষা ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, সারদাপ্রসন্ন দাশ এবং প্রফুলস্নচন্দ্র রায়। বন্ধু হিসেবে পান এক বছরের অনুজ সুভাষচন্দ্র বসুকে। ১৯১৩-তে তিনি পদার্থবিদ্যায় বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরের বছরই ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান।

তিনি কেমব্রিজের কিংস কলেজে যোগ দেন। প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজনের সঙ্গে সখ্যসূত্রে আবদ্ধ হন। পদার্থবিজ্ঞানে ট্রাইপস করার পর প্রশান্তচন্দ্র সিটিআর উইলসনের তত্ত্বাবধানে ক্যাভেন্ডিশ গবেষণাগারে পিএইচ-ডিতে প্রবেশ করেন। এর পর বিখ্যাত Biometrica পত্রিকার পরিচালকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এর একটি সম্পূর্ণ সেট তিনি কিনে নিয়ে ভারতে আসেন। এ-পত্রিকা পড়েই তিনি বুঝতে পারেন কীভাবে পরিসংখ্যানশাস্ত্রটি আবহাওয়াতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

কলকাতায় ফিরে মহালনবিশ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের কন্যা নির্মলকুমারীকে বিবাহ করেন। প্রশান্তচন্দ্র দেখলেন, কলকাতার অনেক বিজ্ঞানী সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে কৌতূহলী। তাঁর প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাকেন্দ্রে তাঁদের নিত্যই আনাগোনা। এঁদের সাহচর্যেই Indian Statistical Institute-এর জন্ম। তাঁদের মধ্যে অর্থনীতির অধ্যাপক প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণিতের অধ্যাপক নিখিলরঞ্জন সেন এবং স্যার আরএন মুখার্জি প্রধান। ১৯৩২ সালের ২৮ এপ্রিল আইএসআই নথিভুক্ত হয়। প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগেই এর কার্য নির্বাহ হতো। সেখানে একে-একে এমএম বোস, জেমস সেনগুপ্ত, আরসি বোস, এমএন রায়, কেআর আয়ার, আরআর বাহাদুর, গোপীনাথ কল্যাণপুর, বিডি লাহিড়ী এবং সিআর রাও যোগদান করেন। এরপর প–ত নেহরুর সচিব পীতাম্বর পন্থ আইএসআইকে যথেষ্ট অনুদান করেন। পন্থ নিজে একজন সংখ্যাবিদ ছিলেন। ১৯৩৩ সালে আইএসআইয়ের বিখ্যাত পত্রিকা সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ থেকে আইএসআইয়ের
পঠন-পাঠন শুরু হয়। মহলানবিশ জেবিএস হলডেনকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন গবেষক অধ্যাপক হিসেবে ১৯৫৭-এর আগস্টে। তিনি থাকেন ১৯৬১-এর ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত। ১৯৫৯ সালে আইএসআইকে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় সদৃশ ঘোষণা করা হয় এবং তারপর থেকেই নিয়মিত কেন্দ্রীয় অর্থানুকূল্য হতে থাকে।

পরিসংখ্যানতত্ত্বে মহলানবিশের অবদান

মহালনবিশের পরিসংখ্যান বিশেস্নষণতত্ত্ব অনেক শাস্ত্রেরই ব্যাখ্যায় কাজে লেগেছিল। যেমন জুওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর নেলসন অ্যারানডেলের ১৯২০-এর নাগপুরে অধিষ্ঠিত জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ হলে তাঁকে কলকাতার
Anglo-Indian-দের মানুষ মাপার এক পরিসংখ্যান-সংবলিত ব্যাখ্যা প্রস্ত্তত করতে বলেন। প্রশান্তচন্দ্র যেহেতু বায়োমেট্রিকা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেহেতু কাজটি সাগ্রহে গ্রহণ করেন। তাঁরই প্রভাবে এই প্রকল্পটি তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে নির্ধারণ করতে সচেষ্ট হন।
ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের ফলে জাতি ও বংশগত ধারা সমত্মানদের মধ্যে কতটা প্রবেশ করে, তার পরিমাপ তিনি করলেন। তিনি দেখলেন, ইউরোপীয়রা প্রধানত বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এবং ছোটনাগপুরের মহিলাদেরই বিবাহ করতেন এবং প্রায়শই উচ্চবর্ণের বিদেশিরা নিম্নবর্ণের ভারতীয় মহিলাদের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতেন। এই গবেষণার ফলাফল তিনি ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এর থেকে তাঁর বিখ্যাত  Multivariate Distance Measure নামক পদ্ধতির উদ্ভব হয়। এটি এখন D2 নামে অন্যথায় Mahalanobis Distance Theory নামে বহুল প্রচারিত।

এই পদ্ধতি তিনি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের প্রেরণায় পরীক্ষার ফলাফল থেকে আরম্ভ করে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিতে ব্যবহার করেন। তিনি কিছুদিন আবহাওয়াবিদ হিসেবেও কাজ করেন। এরপরে এই একই পদ্ধতি কৃষির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রয়োগ করে তাঁর সম্ভাব্য ভুল-ত্রম্নটি ছকে ফেলেন। এই সময় তাঁর সঙ্গে রোনাল্ড ফিশার নামে এক শাস্ত্রবিদের দেখা হয় এবং দুজনের মধ্যে আজীবন বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। বন্যা-নিয়ন্ত্রণেও তিনি এই পদ্ধতি কাজে লাগান। এরই ফলে তাঁর বিখ্যাত Sample Survey বা নমুনা সংগ্রহ ও বিশেস্নষণতত্ত্ব গড়ে ওঠে। নমুনা-বিশেস্নষণের উপকারিতা নিয়ে তিনি লেখেন এবং ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যে বিচিত্র বিষয়ে তার প্রয়োগও করেন। তাঁর মধ্যে উপভোক্তাদের খরচপত্রের নমুনা, জনসাধারণের চা-সেবনের প্রবণতা, জনমত, কৃষিজমির ব্যবহার, এমনকি উদ্ভিদের অসুখ পর্যন্ত এর আয়ত্তে আসে। ফিশার লিখেছেন, প্রশান্তচন্দ্রের Indian Statistical Institute (ISI) এই অভিনব ক্ষেত্রে সমীক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় প্রশাসনকে বৈজ্ঞানিক করে তুলেছিল। কৃষিক্ষেত্রে তাঁর পদ্ধতির প্রয়োগ Indian Council of Agricultural Research এবং Indian Agricultural Statistics Research Institute ব্যবহার করে প্রশাসনে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিল। পরে অবশ্য তাঁর পদ্ধতি নিয়ে ওই বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় এবং প্রশান্তচন্দ্র সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

ভাষার বিবর্তন নিয়েও মহলানবিশ গবেষণা করেন এবং ISI-তে Quantitative Linguistics নিয়ে একটি গবেষণা বিভাগ খোলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি Speech Pathology-তে ঢুকে পড়েন এবং অন্যান্য সহযোগীর সঙ্গে একত্রে ভাষা ও কথার সংশোধন নিয়ে গবেষণা করেন।

পরবর্তীকালে তিনি যোজনা কমিশনের সদস্য হন এবং দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় থেকে সক্রিয়ভাবে শিল্পায়ন নিয়ে অনেক বিশেস্নষণ করেন। তিনি বিখ্যাত লিয়োনটিয়েফের Input Output Model ভারতীয় ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন এবং দ্রম্নত শিল্পায়নের পথ বাতলান। একই সঙ্গে ড্যানিয়েল থর্নারের অবশিল্পায়ন তত্ত্বেরও পুনর্বিচার করেন।

কিন্তু অন্তরে তিনি ছিলেন সংস্কৃতির পূজারি এবং কবি রবীন্দ্রনাথের সচিব। বিশেষ করে কবির বিদেশযাত্রার সময়ে তিনি সঙ্গেই থাকতেন। বিশ্বভারতীর চিমত্মাভাবনার সঙ্গেও তিনি গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মবিভূষণ উপাধি লাভ করেন। এ ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে Weldon Memorial Prize প্রদান করে। তিনি Royal Society-র Fellow নির্বাচিত হন। ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতিও হন। American Econometric Society-র Fellow, Soviet Russia-র Academy of Sciences-এর বিদেশি সভ্য, Royal Statistical Society-র Fellow, American Statistical Association-এর ফেলো এবং দেশের শ্রীনিবাসন রামানুজন স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত হন। ২০০৬ থেকে ভারত সরকার তাঁর জন্মদিন ২ জুনকে National Statistical Day হিসেবে ঘোষণা করেছে।

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পরে বড়মাপের বিজ্ঞানী হিসেবে মনিলাল ভৌমিককেই মনে পড়ে। তিনি যদিও এখন মার্কিন নাগরিক ও সে-দেশে প্রবাসী, কিন্তু শুরুটা হয়েছিল তাঁর মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে। তখন তিনি ছিলেন একান্তই দরিদ্র, এখন ট্রিলিওনেয়ার। এই সাফল্যের কারণ কী? তিনি নিজেই সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, প্রায় চার মাইল হেঁটে তাঁকে তাঁর গ্রামের ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে পৌঁছতে হতো। শৈশবটা তাঁর কেটেছে দুর্ভিক্ষ, বন্যা ও সশস্ত্র স্বাধীনতা-সংগ্রামের বাতাবরণে। তিনি প্রথম জীবনে স্কটিশ চার্চ কলেজের স্নাতক এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি হন। তাঁর প্রতিভায় আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বোস আকৃষ্ট হন এবং তাঁকে সর্বপ্রকারে উৎসাহিত করেন। এরপরে ভৌমিক খড়গপুর আইআইটি থেকে কোয়ান্টাম ফিজিক্সে প্রথম পিএইচ-ডি হন। সালটা ছিল ১৯৫৮, তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল Resonant Electronic Energy Transfer। এই জ্ঞানকে তিনি পরে তাঁর লেজারের গবেষণার কাজে লাগিয়েছিলেন। তাঁর এই কাজের জন্য পরে তিনি সেস্নান ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে লস

অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে পরবর্তী গবেষণা শুরু করেন। ১৯৬১-তে তিনি কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স ডিভিশন বলে খ্যাত জেরক্স কোম্পানির প্যাসাডেনা ল্যাবরেটরিতে চলে আসেন। তারও পরে তিনি তাঁর পছন্দমতো Northrop Corporate Research Laboratory Loser-এর অধীনে তাঁদের Teachnology Laboratory-র Director হন। এখান থেকেই তাঁর যুগান্তকারী laser গবেষণাগুলো পরীক্ষেত ও প্রচারিত হয়। তাঁর গবেষণার ফলাফল তিনি ডেনভার কলোরাডোতে অনুষ্ঠিত Optical Society of America-তে ১৯৭৩ সালে প্রকাশ করেন এবং এই গবেষণার বাণিজ্যিক ব্যবহারের সূচনা করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ ফল হলো চোখের ল্যাসিক সার্জারি এবং চোখের অন্যান্য শল্যব্যবস্থায় লেজারের ব্যবহারের তিনি প্রবর্তক। এই আবিষ্কার তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দেয় এবং তিনি American Physical Society-র Fellowship এবং Institute of Electrical and Electronics-এরও ফেলো নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে তিনি তাঁর বিখ্যাত জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক বইগুলি, যেমন Code Name God এবং Cosmetic Detective প্রভৃতি লেখেন। তাঁর গবেষণা-প্রবন্ধের সংখ্যা ৫০-এর উপরে এবং একডজনেরও বেশি আবিষ্কার তিনি পেটেন্ট করেছেন। তাঁর সর্বাধুনিক নিবন্ধ Unified Field – The Universal Blue Print তাঁকে Quantum Physics জগতে এক জ্যোতিষ্ক করে তুলেছে। এই লেখাটি International Journal of Mathematics and Mathematical Sciences পত্রিকার ফেব্রম্নয়ারি ২০০০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তিনি সারা পৃথিবীতে আমন্ত্রিত হয়ে তাঁর Laser গবেষণা সম্পর্কে বক্তৃতা করেছেন। যেমন জ্ঞানের জগতে, তেমনি আর্থিক সাফল্যে তিনি একজন ধনকুবের হয়ে  উঠেছেন। কিন্তু সেই অর্থ তিনি শুধু নিজের ভোগে লাগাননি। জনসেবায়, বিশেষ করে দরিদ্র ভারতবাসীর সেবায়, ব্যয় করেছেন এবং এখনো করছেন।

 

আনন্দমোহন চক্রবর্তী

আর একজন প্রবাসী বাঙালি বিজ্ঞানী হলেন স্বনামধন্য আনন্দমোহন চক্রবর্তী। আনন্দের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৪ এপ্রিল বীরভূমের
সাঁইথিয়ায়। তাঁর পড়াশোনা সাঁইথিয়া উচ্চবিদ্যালয়, বেলুর বিদ্যামন্দির এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতায়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫-তে Microbiology-তে পিএইচ-ডি। এরপর আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং General Electric Company, New York Factory-তে গবেষণাকেন্দ্রের অধিকর্তা হন। এই সময়ে তিনি জীবকোষ বিভাজন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিউডোমোনাস নামে এক ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন (১৯৭১)। এই ব্যাকটেরিয়া পেট্রোলিয়াম খাদক। সমুদ্রে অনেক সময় তেলবাহী জাহাজডুবি হলে এবং সেই তেল সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়লে এই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করে হটিয়ে ফেলা হয়েছিল। এর জন্য তিনি জগদ্বিখ্যাত হন এবং তাঁর কোম্পানি এটিকে পেটেন্ট করে।

তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে কেস করে বিজ্ঞানী নিজে আবিষ্কারের স্বত্ব ফেরত পান। এটি যুক্তরাজ্যেও পেটেন্ট হিসেবে গৃহীত হয়। যদিও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি, তবু তাঁর এই আবিষ্কার জীবকোষ-সংক্রান্ত আরো বহু তথ্য ও তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে এবং সারা বিশ্বে তিনি সাড়া তুলেছেন। এরপর তাঁর গবেষণাকে ক্যান্সার নিরাময়ের দিকে পরিচালিত করেছেন এবং আজুরিন নামে একটি বিশেষ প্রোটিন ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেছেন, যার সাহায্যে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। জি ই কোম্পানি ছেড়ে দিয়ে তিনি ২০০১-এ নিজস্ব কোম্পানি CDG Therapeutics প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর গবেষণা বিসত্মৃত করে শিকাগোতে আরো পাঁচটি পেটেন্ট সৃষ্টি করেন। কিন্তু সেগুলোকে তাঁর কোম্পানি থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এবার তিনি তাঁর গবেষণা ভারতের দিকে ধাবিত করলেন এবং Amrita Therapeutics নামে আরেকটি কোম্পানি ২০০৮-এ আমেদাবাদে রেজিস্ট্রি করলেন। তাঁর এই ক্যান্সারনিবারণী প্রচেষ্টা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাঁর Bio-Technology বিভাগকে গবেষণা বাড়ানোর জন্য দু-বছরের অনুদান দেয়। তিনি ভারত ও আমেরিকার বহু গবেষণাকেন্দ্রের সদস্য বা ফেলো নির্বাচিত হন। আমেরিকা, কানাডা, সুইডেন, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে যেখানেই তাঁর বিষয়ে গবেষণা করা হয়, সেখানেই তিনি উপদেষ্টা পদে আসীন হন। তাঁর লব্ধ বহু পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে আমেরিকার Industrial Research Organisation-এর Scientist of the Year পুরস্কার, যেটি পান ১৯৫৭ সালে। এরপরে America-র Environmental Protection Agency-র তরফে ‘Distinguished Scientist’ পুরস্কার, America-র National Institute of Health থেকে মেরিট পুরস্কার এবং Bio-Philosophy-তে তাঁর অবদানের জন্য ২০০৭ সালে Golden Eurydise পুরস্কার পান। ভারত সরকারও তাঁকে একই কাজের জন্য ২০০৭-এ পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে।

 

 

অশেষপ্রসাদ মিত্র

অশেষপ্রসাদ মিত্র বিজ্ঞানের জগতে আরেকটি বিখ্যাত নাম। তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালের ২ ফেব্রম্নয়ারি কলকাতায় এবং মৃত্যু ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭, নয়াদিলিস্নতে। তাঁর প্রধান কাজকর্ম প্রধানত রেডিও স্পেস ফিজিক্সের ক্ষেত্রে। তিনি কর্মজীবনে দিলিস্নর National Physical Laboratory-র Director এবং ১৯৮৬ থেকে CSIR-এরও Director হন। তাঁর বহু কাজের মধ্যে বিখ্যাত হলো –
পৃথিবী-সংলগ্ন পরিবেশ নিয়ে গবেষণা, পৃথিবীর উচ্চসত্মরে Cosmic Radio Noise নিয়ে গবেষণা। এর ফলে আয়োনোস্ফিয়ার, সোলার ফিজিক্স এবং কসমিক রে-র জগতে বহু গবেষণার সূত্রপাত হয়। তাঁকে বিলেতে এফআরএস সম্মানে ভূষিত করা হয় এবং ভারত সরকারও তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধি দেয়।

 

অশোক সেন

বর্তমানকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন। ১৯৫৬ সালে এলাহাবাদে জন্ম। এখানকার হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইন্স্টিটিউটে যোগদান করেন এবং ক্রমে ক্রমে সম্মানিত অধ্যাপক পদে বৃত হন। পরবর্তীকালে আমেরিকার MIT-তে অতিথি অধ্যাপক হন। তাঁর প্রধান গবেষণাক্ষেত্র String Theory। সেইসঙ্গে Fundamental Physics Prizeও লাভ করেন। এই বিশেষ ধরনের গবেষণার জন্য এই বিষয়ের প্রতিপাদ্য হলো যে, পদার্থবিদ্যার সমসত্ম তত্ত্বই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। জীবনের শুরুতে Presidency College কলকাতা থেকে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি উপাধি লাভ করেন। পরবর্তীকালে কানপুর আইআইটি থেকে ডিএসসি এবং তারও পরে আমেরিকার Stony Brook University থেকে পুনরায় ডিএসসি লাভ করেন। তাঁর অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে GD Birla Award For Scientific Research 1996, Fundamental Physics Prize 2012, পদ্মভূষণ ২০১৩, আর Dirac Medal 2014। ১৯৯৮ সালে তাঁকে England-এর Royal Society-রও Fellow করা হয়। Stephen Hawking তাঁকে সুপারিশ করেন। এখন তিনি Blackhole সম্পর্কে গবেষণায় রত।

বিকাশ সিনহা (সিংহ)

তিনি একজন সমকালীন প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর ক্ষেত্র নিউক্লিয়ার ফিজিক্স আর হাই এনার্জি ফিজিক্স। এরই সুবাদে তিনি সাহা নিউক্লিয়ার ইন্স্টিটিউটের ডিরেক্টর এবং Variable Energy Cyclotron Centre-এরও ডিরেক্টর হন। অবসরগ্রহণের পরেও শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানে তাঁকে হোমি ভাবা Chair Professor করা হয়েছে। তিনি এখনো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একজন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। ২০১০ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিকাশ Cambridge বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের ট্রাইপস এবং লন্ডন ইউনিভার্সিটির পিএইচ-ডি এবং পরে ডিএসসি উপাধি পান। তারপর প্রায় বারো বছর লন্ডনের Rutherford High Energy Physics Laboratory-তে কর্মরত ছিলেন। পদার্থবিদ্যায় তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিভা। ২৫০টির বেশি গবেষণা নিবন্ধ আছে তাঁর। কোয়ার্ক গস্নুয়ন পস্নাজমার ওপরে গবেষণা করে তিনি জগদ্বিখ্যাত।

ভারতেও তিনি প্রায় প্রতিটি প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে তিনি এলাহাবাদের National Academy of Science-এর ফেলো, Indian Academy of Science Bangalore-এরও ফেলো এবং National Institute of Technology Durgapur-এ কর্মরত চেয়ারম্যান।

 

উপসংহার

উনিশ-বিশ শতকের এই বিজ্ঞানের কুশীলবদের আলোচনায় এটাই প্রমাণিত যে, বাঙালিরা বিজ্ঞানেও যথেষ্ট অগ্রণী এবং বিশ্বমানের ছিলেন। এক বিশেষ ধরনের মানসিকতার জন্যই বাঙালির এই নব-নব উন্মেষশালিনী প্রতিভা বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা কখনো স্বীকার করেননি। এর কারণ বাঙালির চূড়ান্ত হীনমন্যতা এবং পাশ্চাত্যের সবকিছুই বাঙালির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে নেওয়া।

বাম বুদ্ধিজীবীরা তো বাংলার রেনেসাঁসকেই অস্বীকার করেছেন, বিজ্ঞান তো দূরের কথা। এছাড়া এর পেছনে বাঙালির মোসাহেবি মনোবৃত্তি কাজ করে। ইতালির বিজ্ঞানীদের নাম বাঙালির মনে অনুরণন তোলে কিন্তু বাঙালি বিজ্ঞানীর জয়যাত্রা তাঁরা স্বীকার করে নিতে পারেন না। প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে, গভীরভাবে চর্চিত কঠিন বিজ্ঞানেও বাঙালির অবদান অনস্বীকার্য।