বীরেন স্যারের চেহারার শেষ পরিণতি

ইকবাল আজিজ

বীরেন স্যার আমার শৈশবের হিরো, আমার দেখা জীবিত মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে রূপবান। বীরেন স্যারের সঙ্গে আমার শৈশবের শিল্পচেতনা ও সৌন্দর্যচেতনার অনেকখানি জড়িয়ে আছে; তাঁর কথা কি আমি ভুলতে পারি? তাঁর চেহারা ছিল অতি বিস্ময়করভাবে নায়ক উত্তমকুমারের মতো। সেই আমলে ষাটের দশকের শুরুতে উত্তমকুমার ছিলেন যে-কোনো বিখ্যাত জননেতার চেয়েও অনেক বেশি জনপ্রিয়। আর নায়িকা সুচিত্রা সেন ছিলেন প্রতিটি বাঙালির মনের মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবীর মতো। হ্যাঁ, এটা ছিল সেই সুচিত্রা-উত্তমের যুগ এবং আমাদের সহজ-সরল মফস্বল নাটোরে আমরা এক অবিকল মফস্বলি উত্তমকুমার পেয়ে গিয়েছিলাম বীরেন স্যারের মধ্য দিয়ে। এ-ব্যাপারে আমার গৌরব ছিল একটু বেশি; কারণ তিনি ছিলেন আমার স্কুলশিক্ষক, সেইসঙ্গে গৃহশিক্ষক। উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর এই শরীর-স্বাস্থ্য, আচরণ ও চেহারার মিলের কথা স্যার হয়তো জানতেন, হয়তো তাঁকে গোপনে অনুসরণ করতেন। তা নাহলে এমন আশ্চর্য মিল হলো কীভাবে? তিনি পাঞ্জাবি ও ধুতি পরতেন উত্তমকুমারের মতো আর যখন হাসতেন, তখন মনে হতো অবিকল সেই টালিগঞ্জের উত্তমকুমার আমাদের পাশে বসে হাসছেন; কারণ তাঁর দাঁতগুলোও ছিল উত্তমকুমারের মতো।

শুধু একটু পার্থক্য ছিল উত্তমকুমারের সঙ্গে আমাদের বীরেন স্যারের; তা হলো স্যারের গোঁফ। স্যারের ঠোঁটের ওপর ছিল খুব সরু গোঁফ, যেন এক গোঁফধারী উত্তমকুমার ষাটের দশকের শুরুতে আমাদের স্মৃতিময় নাটোর শহরে জীবনসংগ্রামের অভিনয়ে নেমেছিলেন। স্যারের ছিল একটি চমৎকার র‌্যালে সাইকেল; প্রতিদিন সন্ধেবেলায় আমাদের নানাবাড়ির দরোজায় স্যারের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ধ্বনি যখন বেজে উঠতো, তখন আশেপাশের বাড়িঘরের জানালা খুলে যেতো; পাড়ার কিশোরী যুবতী বুড়ি প্রভৃতি নানা বয়সের নারী স্যারের চেহারা একনজর দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠতেন; দু-একজন হয়তো মনে মনে স্যারের প্রেমে পড়েছিলেন, তবে হৃদয়ের সেই গোপন কথাটি কোনোদিন মুখ ফুটে বলা হয়নি।

বীরেন স্যার বাসায় আমাদের বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শেখাতেন। তবে উত্তমকুমারের সঙ্গে স্যারের যত মিলই থাক না কেন, স্যার কিন্তু উত্তমকুমারের মতো কলকাতার বাংলায় কথা বলতেন না; তিনি কথা বলতেন নাটোরের আদি আঞ্চলিক ভাষায়। স্যার বলতেন, ‘স্বপন, তুই স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্পের বইও পড়বু। তাইলে তোর একটা আলাদা মন তৈরি হবি। আর প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা পড়বু।’ তবে আমার খবরের কাগজ পড়া নিয়ে স্যার আমাকে কোনোদিন হারাতে পারতেন না। কারণ শৈশব ও কৈশোরে অনেক খারাপ অভ্যাসের পাশাপাশি খবরের কাগজ পড়া আমার নিয়মিত অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তখন অবশ্য ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ মফস্বলে খবরের কাগজ পাওয়া যেতো একদিন পরে। অর্থাৎ ঢাকায় সোমবার যে-পত্রিকা প্রকাশিত হতো, তা নাটোরে পাওয়া যেত মঙ্গলবার দুপুরে। পত্রিকার ওপর ছোট হরফে লেখা থাকতো ঢাকা-সোমবার, মফস্বল-মঙ্গলবার। এটা ছিল ষাটের দশকের পত্রিকাজগতের একটি পরিচিত নিয়ম। আমার নানাবাড়িতে আসতো দৈনিক আজাদ। আমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরে সবার আগে পড়তাম পত্রিকা। এরপর যেতাম বাড়ির কাছে গোপাল ডাক্তারের দোকানে দৈনিক ইত্তেফাক পড়তে। এই দুটি বাংলা পত্রিকাই তখন পাওয়া যেতো। আমি তখন প্রতিটি খবর পড়তাম মনোযোগ দিয়ে। তাই পত্রিকার খবর বিষয়ে প্রশ্ন করার সময় স্যার হুঁশিয়ার থাকতেন। আমি এসব বিষয়ে অনায়াসে নানা ধরনের প্রশ্নের জবাব দিতাম। তখন স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে এসব জ্ঞানকে লোকে বলতো ‘আউট নলেজ’। স্যার আমার অতিসমৃদ্ধ আউট নলেজের বিষয়ে গর্ববোধ করতেন। অনেক সময় হয়তো স্কুলের ওপরের ক্লাসের ছাত্ররা বলতে পারতো না, পৃথিবীর প্রথম মহাশূন্যচারীর নাম কী, অথবা চিলি কোন মহাদেশে অবস্থিত; ঠিক তখনই আমার ডাক পড়তো। স্যার আমাকে ডেকে পাঠাতেন। আমি সহজেই এসব বিষয়ে সঠিক জবাব দিয়ে দিতাম। স্যার তখন আমার চেয়ে বয়স্ক ছাত্রদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, ‘এই ছোট্ট চ্যাংড়ার যে-জ্ঞান, তার এক কণাও তোদের মধ্যে নাই। তোরা সব গলায় দড়ি দিয়ে মরেক।’ নাটোরের আদি আঞ্চলিক ভাষায় উচ্চারিত স্যারের এই বাক্যগুলো এখনো আমার কানে বাজে। স্যার আমার সম্পর্কে বলতেন, ‘এই চ্যাংড়া একটা জিনিয়াস। অর যাওয়া উচিত ছিল ঢাকায়। কেন যে নাটোরে পইড়তে আইসলো বুইঝতে পারিছ্ছি না।’

আর স্যার কী সুন্দর বাঁশি বাজাতেন, বাঁশের বাঁশি এমন দরদ দিয়ে বাজাতে আমি আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি; অবশ্য স্যারের বাঁশি শোনার সুযোগ খুব কম ছাত্রই পেয়েছে। স্যার আমার মতো তাঁর দু-একজন অতিপ্রিয় ছাত্রকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ করতেন; সেদিন আমরা তাঁর বাড়িতে খুব মজা করে লুচি, আলুর দম আর মিষ্টি খেতাম। স্যারের বাড়ির ভেতরে খুব বড় জায়গা জুড়ে ছিল একটি ফুলের বাগান। সেখানে ছিল দেশ-বিদেশের নানা ধরনের ফুল, অর্কিড আর পাতাবাহারের গাছ। স্যার আমাদের সবাইকে নিয়ে বাগানের মাঝখানে বসতেন। তারপর তাঁর সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজাতে শুরু করতেন। স্যারের বাঁশির সুরে যেন এক আশ্চর্য জাদু ছিল; আমরা স্তব্ধ বিস্ময়ে শুনতাম সেই মায়াবী মূর্ছনা। বাঁশির সুরে আমরা এক রূপকথার আলাদা জগতে ভেসে বেড়াতাম। তবে স্যারের বাঁশিতে আমরা বেদনার সুরই বেশি শুনতে পেতাম; মনে হতো আমাদের সব আনন্দের আড়ালে আছে দুঃখের অবিশ্রান্ত ঝরনাধারা। বীরেন স্যার তখনো অবিবাহিত ছিলেন; প্রায়ই মনে হতো, স্যার হয়তো তাঁর যোগ্য পাত্রী কোনোদিনই খুঁজে পাবেন না।

কিন্তু বীরেন স্যার একদিন বিয়ে করলেন; স্যারের অতিশয় অসুস্থ মা দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁর একমাত্র পুত্রকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করতে হবে। মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের আদেশ অমান্য করতে পারেননি স্যার। একদিন খুব সকালে তিনি তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, স্কুলের আট-দশজন শিক্ষক আর দু-তিনজন অতিপ্রিয় ছাত্র নিয়ে বিয়ে করতে গেলেন। নাটোর থেকে সান্তাহার লাইনে দু-তিন স্টেশন পরে মাদনগর।

মনে আছে শীতের সকালে আমরা স্যারের সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে নাটোর স্টেশন থেকে ট্রেনে রওনা হয়েছিলাম আর কত আনন্দের মধ্য দিয়ে স্যারের নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে এসেছিলাম অনেক রাতে। এরপর ঘোড়ার গাড়ি টমটমে চড়ে যার যার বাড়িতে ফিরেছিলাম। কিন্তু স্যারের স্ত্রীর চেহারা আমাদের কারো পছন্দ হয়নি। আমাদের উত্তমকুমার যদি বিয়ে করতে গিয়ে সুচিত্রা সেনকে না পান ক্ষতি নেই; কিন্তু তাঁর স্ত্রী নিদেনপক্ষে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বা সন্ধ্যা রায়ের মতো হওয়া দরকার – এই ছিল আমাদের অভিমত। আমাদের সেই স্বপ্ন এতটুকু সফল হয়নি; স্যারের স্ত্রীর চেহারা কোনো নায়িকার মতোই নয়। আমাদের বীরেন স্যারের স্ত্রী হয়েছেন একেবারে অতি সাধারণ খেঁদি কিংবা পেঁচির মতো। তাঁর গায়ের রং কালো এবং চোখ ট্যারা। তবু সেই কালো ও ট্যারা বউ নিয়ে স্যার বেশ সুখেই ছিলেন বলে মনে হয়। বিয়ের পর স্যার আরো বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্বপন, বউদিকে কেমন লাইগলো?’ আমি বলেছিলাম, ‘স্যার খুব ভালো হয়েছে।’ স্যার একটু চুপ করে থেকে নিজেই বলেছিলেন, ‘মানুষের বাইরের রূপ দিয়ে কী হবি? রূপ আইজ আছে, কাইল নাই। গুণ কিন্তু থাইকে যাবি মৃত্যু পর্যন্ত।’ যাই হোক, স্যারের বিয়ের কিছুদিন পরই আমি নাটোর ছেড়েছিলাম এবং আমার পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়া শহরে চলে এসেছিলাম; তখন শুরু হয়েছিল আমার অন্যজীবন। নাটোর ছাড়ার আগে স্যারের কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম এবং ভক্তিসহকারে তাঁর পা স্পর্শ করেছিলাম। স্যার আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘তুই অনেক বড় হবু স্বপন। আমি আইজ বইলে দিলাম, তুই রাজশাহীর ডিসি হবু।’ স্যার তাঁর কল্পনার সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চাকরির কথাই হয়তো সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন।

এরপর বহু বছর পার হয়ে গেছে। আমিও জীবনের বহু পথ পার হয়ে ঢাকায় স্থায়ী হয়েছি; কিন্তু রাজশাহীর ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার আমি হতে পারিনি। হয়েছি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরম অনুগত গবেষক এবং সেই সংস্থার কাজে প্রায় চল্লিশ বছর পর আবার একদিন হাজির হলাম নাটোর শহরে? জীবনের এই এক অদ্ভুত নিয়ম; পুরনো জীবনের সব সঙ্গীই আবার ফিরে আসে নতুন পরিচয় নিয়ে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে আমার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির শহর নাটোরে গিয়ে মনে হলো, এ-শহরের প্রতিটি মানুষ, বাড়িঘর, বৃক্ষনদী সব যেন এতকাল ধরে আমার অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে। তবে তারা সবাই যেন বদলে গেছে। নিমতলায় দুলালের দোকানে মিষ্টি খেতে গিয়ে শুধু কষ্টই পেলাম; সেই অপূর্ব পানতোয়া, কাঁচাগোল্লা, সন্দেশ সব যেন কেমন বিস্বাদ হয়ে গেছে। দোকানের প্রাচুর্য বেড়েছে; সততা ও আন্তরিকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী সেইসব মিষ্টির মূল স্বাদই হারিয়ে গেছে। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হওয়ায় ব্যবসা গেছে বেড়ে। এরপর অনেক ফাঁকিবাজি দেখলাম। আমার শৈশবের ‘উত্তমকুমার’ বীরেন স্যারের কথা মনে হলো। তিনি কি এখন বেঁচে আছেন?

পরিচিত একজন জানালেন, স্যার শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে হেমাঙ্গিনী সেতুর কাছে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে হোমিওপ্যাথ প্র্যাকটিস করছেন। আমার শৈশব-কৈশোরের হিরো এখন কেমন ডাক্তার হয়েছেন – তা খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। নাটোর শহরে নারদ নদীর ওপর হেমাঙ্গিনী সেতুর সঙ্গে আমার কৈশোরের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেতুর কাছেই স্যারের দোকান। একটি বড় সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা আছে ‘হ্যানিমান হোমিও হল’। তার নিচে কিছুটা ছোট হরফে লেখা আছে – ‘এখানে বীরেন স্যারের দক্ষ চিকিৎসায় জটিল রোগ নিরাময় হয়।’ বুঝলাম এখনো শিক্ষক হিসেবে এ-শহরে স্যারের প্রধান পরিচিতি। বীরেন পালকে এখনো সবাই বীরেন স্যার হিসেবে চেনে, চিকিৎসক হিসেবে নয়। আমার খুব কৌতূহল হলো, এতকাল পরে স্যারের চেহারা কেমন হয়েছে তা দেখার। আমার স্বপ্ন ছিল, আমাদের কৈশোরের তরুণ উত্তমকুমার হয়তো প্রবীণ উত্তমকুমারের স্নিগ্ধ শান্ত রূপ ধারণ করেছেন; কিন্তু ‘দেখিলাম এ কোন ভূত?’ বাস্তবিকই, এত পরিবর্তন কি কোনো মানুষের হয়? যিনি নিজেকে বীরেন স্যার হিসেবে পরিচয় দিলেন, তিনি এক বৃদ্ধ কঙ্কালসার ব্যক্তি। তাঁর চোয়াল বসে গেছে, চোখ কোটরাগত এবং নাক ও কপাল বিদ্ঘুটে রূপ ধারণ করেছে। আমাদের শৈশবের উত্তমকুমারের এতটুকু অবশিষ্ট নেই তাঁর মধ্যে।

নিজের পরিচয় দিলাম। স্যার হাসলেন, মনে হলো প্রেতের কান্নাময় হাসি; সেই প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর নয়, কেমন যেন ঘর্ঘর শব্দ বের হলো তাঁর গলা থেকে – ‘তুই সেই স্বপন? কেমন আছু বাবা?  এখন কী করতিছু? আমি মাস্টারি ছাইড়ে দিছি অনেক আগে। এখন হোমিওপ্যাথ ডাক্তারি করতিছি? তবে প্র্যাকটিস একেবারে খারাপ না।’

এতদিন পরে মনে হলো, স্যার আমাকে বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্কের পাশাপাশি ভূগোলও পড়াতেন। আমার মনে আছে বীরেন স্যার ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন সম্পর্কে বলতেন, ‘স্বপন, এই যে নদী, পাহাড়, বন, সমতলভূমি সবই বদলায় – তুই কি ব্যাপারটা বুইঝতে পারতিছু? লক্ষ বছর ধইরে এই পরিবর্তন। নদী শুকায় যায়, চিরসবুজ বন মরুভূমি হয়। পাহাড় ক্ষয়ে যায়, হাজার বছর ধইরে বাতাসের ঘর্ষণে তার চেহারা বদলায়। পরিবর্তনই জগতের নিয়ম।’

আমার মনে হলো, আমি সেই মহাপরিবর্তনশীল জীবন ও প্রকৃতির মুখোমুখি হয়েছি। পাকিস্তানি আমলের শেষদিকে ঢাকার চলচ্চিত্রে একজন বিদ্ঘুটে কঙ্কালসার অভিনেতা ছিলেন। তাঁর নাম রবিউল। তিনি অভিনয়ের সময় কান নাড়াতে পারতেন। দর্শকরা খুব আনন্দ পেত তাঁকে দেখে। আমার মনে হলো, সময়ের বিবর্তনে আমার কৈশোরের উত্তমকুমার ‘বীরেন স্যার’ আজ অভিনেতা রবিউলে পরিণত হয়েছেন। উত্তমকুমারের চেহারার এতটুকু অবশিষ্ট নেই তাঁর মধ্যে। এতদিন পরে অনুভব করলাম, স্যারের সে-কথাটি কতখানি সত্য। আর তা হলো, পরিবর্তনই জগতের নিয়ম। জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথার অন্যতম মনে হলো এই কথাটিকে।

আমি যখন এসব বিচিত্র দর্শনের কথা ভাবছি, তখন বীরেন স্যার বলে চলেছেন, ‘স্বপন তুই এতোদিন পরে আসলু। তোর কথা আমি কতোবার ভাবিছি। আমার এখন কেউ নাইরে! তোর বউদি স্বর্গে গেছেন। ছেলেমেলে দুইজনই কইলকাতায়। আমাক অদের কাছে থাইকতে বলে। আমি বলিছি, আমার দেশ ছাইড়ে আমি কোথাও যাবো না। স্বপন, তুই এতোদিন পরে আসলু কেন বাপ? তোর মতো ছাত্র আমি আর পাইনি। এতদিন তুই কোথায় ছিলু? আমার হইছে ডায়বেটিস, ত আর সাইরবে বইলে মনে হইচ্ছে না। কতো চিকিৎসা করাইলাম। এতদিন পরে নাটোরে আইসে তুই কোথায় উঠিছ…।’

আমার শৈশবের উত্তমকুমার আমার দিকে তাকিয়ে অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন, যদিও তাঁর চেহারার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। চশমা-­পরা এক উদ্ভট প্রেতের মতো উত্তমকুমার আমার চোখের সামনে বসে কথা বলছেন।