বেগম আখতার ফিরায়ে দিয়ো না মোরে শূন্য হাতে

আবুল আহসান চৌধুরী

 

চলচ্চিত্র ও সংগীতে উত্তরকালে খ্যাতির শীর্ষ স্পর্শ করেছেন – যেমন পৃথ্বিরাজ কাপুর, কুন্দনলাল সায়গল, আখতারি বাই, রাজকাপুর, তালাত মাহমুদ কিংবা অমিতাভ বচ্চন – কলকাতা ছিল বাংলা মুলুকের বাইরে থেকে আসা এইসব শিল্পীর প্রেরণার মরমি ধাত্রী। এঁদের পাশাপাশি ভারতীয় মার্গসংগীতের কিছু প্রসিদ্ধ কলাবতের নামও স্মরণ করতে হয়। কেউ এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে, কেউ কর্মসূত্রে, আবার কেউ-বা প্রতিষ্ঠালাভের আশায়। সংগ্রামে-সংকটে, আশা-নিরাশায়, খ্যাতি-প্রতিষ্ঠায় এঁদের মধ্যে আখতারি বাইয়ের কাহিনি একেবারে অন্যরকমের – সে এক আজব আফসানা।

 

দুই

১৯৩২-এ কলকাতার ৭১/১ নম্বর হ্যারিসন রোডের ঠিকানায় এক দোতলা বাড়ির ওপরতলায় জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের (জে.এন. ঘোষ) উদ্যোগে জন্ম নেয় ‘মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি’। এর জন্মক্ষণের সাক্ষী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হীরেন বসু, ধীরেন দাস ও জিতেন ঘোষ নিজে। মেগাফোন কোম্পানির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে এক আন্তরিক বিবরণ মেলে হীরেন বসুর স্মৃতিচর্চায় – ‘পঞ্চবর্ষী’ ছদ্মনামে লেখা তাঁর জাতিস্মরের শিল্পলোক (কলকাতা, ১৩৭০) বইয়ে। যাত্রা শুরু হয় স্বদেশি রেকর্ড কোম্পানি ‘মেগাফোনে’র। অল্পদিনেই মেগাফোনের সংগীত-ভবন নবীন-প্রবীণ, প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীর সমাগমে পূর্ণ হয়ে ওঠে। নজরুলের কারণে ধীরেন দাসসহ অনেকেই এইচএমভি ছেড়ে মেগাফোনে যোগ দেন। হীরেন বসুর সৌজন্যে আসেন কানন দেবী। ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ, ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, গোপালচন্দ্র লাহিড়ী, আববাসউদ্দীন আহমদ, জদ্দন বাই, কমলা ঝরিয়া, সামাদ কাওয়ালের মতো খ্যাতিমান গাইয়ে-বাজিয়ের সমাবেশে সাহেব কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ‘মেগাফোন’। কিছু পরে এইসব গুণী শিল্পীর তালিকায় যুক্ত হয় আখতারি বাই ফৈজাবাদি ওরফে বেগম আখতারের নাম।

আখতারি বাইকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব মেগাফোনের কর্ণধার জিতেন ঘোষের। এক-অর্থে আখতারি মেগাফোনেরই সৃষ্টি – তাঁর খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার জমিন তৈরি এবং তাঁর ‘হয়ে ওঠা’র পেছনে মেগাফোনের অবদান কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। জিতেন ঘোষের ভাইপো কমলকুমার ঘোষ – যিনি পিতৃব্যের অবর্তমানে মেগাফোন-পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন – এক আলাপচারিতায় বলেছেন : ‘বলতে হয় আখতারি বাইয়ের কথা। জ্যাঠামশাই [জিতেন ঘোষ] একবার কোথায় যেন গেছিলেন। পাশের বাড়িতে উনি [আখতারি বাই] রেওয়াজ করছিলেন। ওঁর গান শোনার পরে রেকর্ডিংয়ের জন্য – এখানে যিনি ম্যানেজার ছিলেন – তাঁকে পাঠিয়ে ওঁকে নিয়ে আসেন। বহুদিন উনি এখানে তালিম নিয়েছেন’ (বাঙালির কলের গান, আবুল আহসান চৌধুরী, ঢাকা, নভেম্বর ২০১২, পৃ ৭৫)। রেওয়াজ-তালিমের সুবিধার জন্যে অন্য আরো এক-দুইজন শিল্পীর মতো বেগম আখতারও মেগাফোনের বাড়িতে কখনো কখনো থেকেছেন – একনাগাড়েও কিছুকাল ছিলেন এখানে। জিতেন ঘোষ তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তেমনি আখতারি বাইয়ের শ্রদ্ধা-ভক্তি-কৃতজ্ঞতাও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল জিতেন ঘোষের প্রতি। কমল ঘোষ ওই আলাপচারিতার সূত্র ধরেই এ-বিষয়ে জানিয়েছেন : ‘অনেক জায়গায় দেখেছি, যখন উনি [আখতারি বাই] জলসায় গান করতেন, যে কোনো জায়গায়, জ্যাঠামশাইয়ের [জিতেন ঘোষ] ছবি বের করে নমস্কার করে তারপর গান করতেন। যখন জ্যাঠামশাই মারা গেছেন উনি এসেছেন’ (বাঙালির কলের  গান, পূর্বোক্ত, পৃ ৭৫)। এ-হলো আখতারি বাইয়ের কলকাতাবাসের দ্বিতীয় পর্বের কথা। এবারে শোনা যাক, তাঁর কলকাতা-পর্বের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল।

 

তিন

মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯২৭-এ মা মুশতারি বাইয়ের হাত ধরে কলকাতায় আসেন আখতারি বাই ফৈজাবাদি। সঙ্গে ছিলেন আখতারির গুরু ওস্তাদ আতা মোহাম্মদ খাঁ। মূলত আতা মোহাম্মদের পরামর্শেই কলকাতায় আসা। কেননা সে-সময় কলকাতা ছিল সংগীতেরই শহর, অনেক খ্যাতিমান শিল্পী এখানে তখন অবস্থান করতেন – বাঙালি শিল্পীরও অভাব ছিল না। ওস্তাদজির মতো মাও ভেবেছিলেন এই অনুকূল পরিবেশ আখতারির সংগীতশিক্ষা ও প্রতিভাবিকাশের জন্যে সহায়ক হবে। তাঁদের প্রত্যাশা ও অনুমান যে বিফল হয়নি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তার প্রমাণ দেয়। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার পর অভাব মুশতারি বাইয়ের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। কলকাতাতেও তাই অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে তাঁদের জীবনযাপন করতে হয়। এখানে এসে রিপন স্ট্রিটে ছোট একটি কামরা ভাড়া নিয়ে মা-বেটি থাকতে শুরু করেন। অবশ্য তার আগে বউবাজারে শিল্পীদের এক যৌথ আবাসে অস্বস্তিকর পরিবেশে সামান্য কিছুদিন ছিলেন। অভাবের কারণে তাঁদের দিন-গুজরান কঠিন হয়ে পড়ে। শরাফতি তো দূরের কথা ভদ্রোচিতভাবে চলারও তেমন উপায়-অবলম্বন ছিল না। মা ও গুরুর যৌথ অভিভাবকত্বে আখতারির গান শেখার পাশাপাশি গুরুর সঙ্গে মাঝে-মধ্যে ‘মুজরো’ বা ‘মেহফিলে’ উপস্থিত থাকার সুযোগ হতো। এমনকি সংগীতের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার প্রথম সুযোগ আসে সেও এই কলকাতাতেই। বলা চলে সেই ঘটনাই আখতারির জীবনের মোড় অনেকখানি ঘুরিয়ে দেয়। সাল ১৯৩৪ – আখতারির বয়স তখন কুড়ি। ওই বছরে বিহারে স্মরণকালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প হয়, তাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রচুর। বিহারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্যে কলকাতার নামকরা আলফ্রেড থিয়েটার এক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেন প্রখ্যাত সানাইবাদক ওস্তাদ আমান আলী খাঁ তাঁর প্রিয় শিষ্য ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁর সহযোগে। কিন্তু অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আয়োজকেরা প্রমাদ গুনলেন, এক প্রখ্যাত ধ্রুপদী-শিল্পী শেষ মুহূর্তে আসবেন না বলে জানিয়েছেন। বিষয়টা জানাজানি হতে দর্শক-শ্রোতারা ক্রমে ক্ষিপ্ত-উত্তেজিত-ধৈর্যহারা হয়ে উঠলেন। অবস্থা কীভাবে সামাল দেওয়া যায় উদ্যোক্তারা যখন ভাবছেন, তখনই আখতারির ওস্তাদজি আতা মোহাম্মদ খাঁ সুযোগটা নিলেন। তিনি তাঁর শিষ্যাকে সংগীত পরিবেশনের সুযোগ দিতে অনুরোধ জানালেন। বিকল্প আর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া আমলে নিয়ে এই প্রস্তাবে আয়োজকদের রাজি হতে হলো। জীবনের প্রথম কোনো পাবলিক কনসার্টে অংশ নিতে ভীরু হৃদয়ে কম্পিত পায়ে মঞ্চে উঠতে হলো আখতারিকে। মনে শক্তি সঞ্চয় করে তিনি হৃদয় নিঙ্ড়ে গাইলেন তাঁর খুব প্রিয় একটি গজল : ‘তুম্ না হোতে হরজাই কুছ অ্যায়সি আদা পায়ি/ ত্যক্তা হ্যায় তেরি আউর এক্ তামাশায়ি’। এরপর মুগ্ধ দর্শক-শ্রোতাদের অনুরোধে তাঁকে পরপর গেয়ে যেতে হয় আরো বেশ কয়েকটি  গজল ও দাদরা। এরপর আখতারি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্দেশে উর্দুতে লেখা একটি কবিতাও পড়ে শোনান। শ্রোতাদের প্রশংসা-অভিনন্দনে স্নাত আখতারি তখন বাক্হারা। ওই অনুষ্ঠানে ভাগ্যক্রমে সরোজিনী নাইডুও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর প্রশংসায় আখতারি বিশেষ প্রাণিত হন এবং আত্মবিশ্বাস অর্জন করেন। পরে সরোজিনী একটি খাদি শাড়ি উপহার পাঠিয়ে এই নবীন শিল্পীকে তাঁর আশীর্বাদ জানান। আখতারির সংগীতজীবনে এই-ই প্রথম সম্মাননা ও স্বীকৃতি – সে-কথা তিনি সারাজীবন স্মরণে রেখেছেন।

এই পাবলিক কনসার্টের পর ধীরে ধীরে আখতারির নাম ফুটতে শুরু করে। ‘মেহফিল’ বা ‘মুজরো’য় ডাক আসতে থাকে। তখনো জীবন-জীবিকার স্থায়ী এবং ভালো কোনো সুরাহা হয়নি। মা-মেয়ের দুঃখকষ্টের সংসারে একটু স্বস্তি ও সুখের জন্যে আখতারি ভালো কোনো উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। দুটো পথ খোলা ছিল : গ্রামোফোন কোম্পানিতে গানের রেকর্ড করা এবং ফিল্মে প্লেব্যাক। কিন্তু ঘোর আপত্তি জানালেন মা এবং গুরু দুজনেই। তাঁদের যুক্তি ছিল, এই দুই মাধ্যম প্রকৃত শিল্পীদের জন্যে নয় – সস্তা জনপ্রিয়তার এই পথে গেলে শিল্পীর শিক্ষার অবমাননা হয়। কিন্তু আখতারিকে রোখা গেল না। ক্রমে তিনি এইদিকেই পা বাড়ালেন, পরে তাঁর প্রতিভা ভিন্নমাত্রা পেল ফিল্মে অভিনয়ের মাধ্যমে।

কেউ কেউ মনে করেন, মেগাফোনের জিতেন ঘোষ আখতারি বাইকে আবিষ্কার ও উপস্থাপিত করার আগেই নাকি তাঁর গ্রামোফোনের ভুবনে প্রবেশ ঘটেছিল এইচএমভির সৌজন্যে। তাঁর প্রথম রেকর্ডটি এইচএমভি থেকেই বেরিয়েছিল এবং তা অভাবনীয় সমাদর লাভ করে। কিন্তু নানা কারণে সূত্রবিহীন এই তথ্যটি মেনে নিতে দ্বিধা থেকে যায়। কেননা তখন জর্জ কুপার এইচএমভির প্রধান কর্তা, রেকর্ডিংয়ের বিষয় দেখাশোনা করেন ভগবতীচরণ ভট্টাচার্য – আখতারির রেকর্ডের কাটতি যদি প্রচুর হতো, তবে এমন শিল্পীকে তাঁরা কি আর ছাড়তেন – অবশ্যই তাঁকে চুক্তির বাঁধনে বেঁধে রাখতেন। আসলে তাঁর নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা অপেক্ষা করছিল মেগাফোনের জন্যেই – হরিণ-মার্কা রেকর্ডেই তাঁর জয়ের পথ সুগম ও প্রশস্ত হয়। সংগীত-সমঝদার ও শ্রোতারা ভালোভাবেই নিয়েছিলেন গ্রামোফোনের এই নতুন শিল্পীকে। সে-অধ্যায়ের কথা পরে কিছু বলা যাবে, তার আগে ‘জনমদুখিনী’ আখতারির ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর আর গান শেখার প্রথম পর্বের কথা কিছু বিবৃত করতে হয় তাঁর জীবনপ্রভাতের বিড়ম্বনা, বঞ্চনা আর সংগ্রামের কাহিনি জানার জন্যে।

 

চার

আখতারি বাইয়ের জন্ম উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ শহরের গুলাববাড়ি এলাকায়, ১৯১৪ সালের ৭ অক্টোবর। তাঁর জীবনীকার এস. কালিদাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এই শহরেই জন্মেছিলেন আরেক কিংবদন্তি-সংগীতশিল্পী ওমরাওজান। আখতারির মা মুশতারি বাই ছিলেন ‘তাওয়ায়িফ’ – নাচে-গানে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ও সুনাম ছিল। আখতারি তাই রক্তের উত্তরাধিকারেই পেয়েছিলেন গানের গলা এবং সেইসঙ্গে গানের প্রতি অনুরাগ। লখনৌনিবাসী এক তরুণ আইনজীবী সৈয়দ আসগর হুসেন ফৈজাবাদের নিম্ন আদালতে আইনপেশায় নিযুক্ত ছিলেন। প্রথম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও রূপসী কলাবতী মুশতারির প্রতি তিনি আসক্ত হন এবং ১৯১৪ সালের গোড়ায় তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু এই বিয়ে তাঁর পরিবার কখনোই মেনে নেননি। তাই মুশতারি কোনোদিনই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাননি। আসগর হুসেন বসবাসের জন্যে তাঁকে ফৈজাবাদের গুলাববাড়ি অঞ্চলে একটি সুন্দর বাড়ি কিনে দেন। তাঁকে হামেশাই আশ্বাস দিতেন যে, তাঁর পরিবার এই বিয়ে মেনে নেবেন এবং অচিরেই লখনৌয়ে মূল পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারবেন। অবশ্য সে-সুযোগ আর তাঁর জীবনে কখনো আসেনি। ১৯১৪ সালের শেষের দিকে মুশতারি যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দেন – জোহরা ও আখতারির। আখতারির ঘরোয়া ডাকনাম ছিল ‘বিবি’। আর ‘বিবি’ তাঁর মাকে ডাকতেন ‘বড়ে সাহেব’ বলে। নানা বঞ্চনার মধ্যেও মুশতারি সন্তান-সংসার নিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারিবারিক চাপে আসগর হুসেনের মুশতারির বাড়িতে আসা অনিয়মিত হয়ে ওঠে। স্ত্রী-কন্যার জন্যে ভিন্ন লোকের হাত দিয়ে তিনি মাঝে-মধ্যে কিছু টাকাপয়সা পাঠাতেন। কন্যাদের নিয়ে মুশতারির ভদ্রোচিত ভরণপোষণের জন্যে এই অর্থ যথেষ্ট ছিল না। আসগর হুসেন ছিলেন বিচিত্র মানুষ। সাহিত্য ও সংগীতে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। স্ত্রী ও কন্যাদের প্রতি কর্তব্য পালনে তাঁর অবহেলা থাকলেও আখতারির প্রতি তাঁর আলাদা রকমের টান ছিল। তিনি এই কন্যার গান শেখা ও ভালো উর্দু উচ্চারণের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। পিতার স্মৃতি আখতারির মনে খুব উজ্জ্বল না থাকলেও শৈশবের এইসব কথা তিনি একেবারে ভুলে যাননি। তাই তিনি যখন খ্যাতিমান তখন খুব কাছের মানুষ যাঁরা, তাঁদের কাছে হঠাৎ কখনো এইসব প্রসঙ্গ তুলতেন।

এদিকে আসগর হুসেনের ক্ষুব্ধ পরিজন ও বিরূপ স্ত্রীর চক্রান্তে মুশতারির এক মেয়ে জহুরার অতি শৈশবেই অপমৃত্যু হয়। এই ঘটনা তাঁকে শোকাকুল করে তোলে – আখতারিকে অাঁকড়ে ধরে তিনি বাঁচতে চান। তাই তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টায় মনোযোগ দেন। ফৈজাবাদ মিশন স্কুলে তাঁকে ভর্তি করান। এই স্কুলে পড়ার সময়ে ছোট আখতারির জীবনে একটি বড়ো ঘটনা ঘটে। কিন্নরকণ্ঠী গওহরজান একবার ফৈজাবাদে মিশন স্কুল পরিদর্শনে আসেন। এখানে শিশু আখতারির কণ্ঠে প্রখ্যাত সংগীতবিদ আমির খসরুর ‘আম্মা মোরি ভেইয়া কো ভেজো রি কে শাওন আয়্যা’ এই গানটি শুনে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেন, যদি ভালো করে শেখার সুযোগ পায়, তবে একদিন সে ‘মালিকা-এ-গজল’ হিসেবে পরিচিত হবে। (Ae Mohabbat… Reminiscing Begum Akhtar, Rita Ganguly, New Delhi, 2008,  p10)। অদ্ভুত দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এই  শিশু-প্রতিভাকে, উত্তরকালে আখতারি সম্পর্কে গওহরজানের এই মন্তব্য ঠিকঠিক ফলেছিল।

স্বামী-পরিত্যক্তা মুশতারি বাই একমাত্র সন্তান আখতারিকে বড়ো করে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। কিন্তু স্বামীর স্বজনেরা একদিন গুলাববাড়ির নিবাসে আগুন দিলো, মা-মেয়েকে পুড়িয়ে মারাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কোনোক্রমে তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু স্পষ্টই বুঝতে পারলেন তাঁদের জীবন বিপন্ন – ফৈজাবাদ তাঁদের জন্যে আদৌ নিরাপদ নয়। এই ঘটনায় তাঁরা নিরাপত্তার খোঁজে বিহারের গয়ায় গেলেন এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে। আখতারির রক্তে ছিল গান, গওহরজান এসে তাঁর চোখে গানের স্বপ্ন এঁকে দিয়ে গেছেন, আর এখানে এসে এক ভিখারিনীর গান তাঁকে আরো সংগীত-অনুরক্ত করে তুললো। ভিখারিনীকে অনুকরণ করে গাওয়া আখতারির গান শুনে মুশতারি বাই তাঁর সংগীতপ্রতিভা সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন এবং তাঁকে এই পথে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হন। মায়ের ইচ্ছে ছিল তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলবেন। কিন্তু বৈরী পরিবেশ ও আখতারির অনাগ্রহে সে-পাট আগেই চুকে গেছে। এরপর এলো গানের পালা – আখতারির হাতেখড়ি বিশিষ্ট সারেঙ্গিবাদক পাটনার ওস্তাদ ইমদাদ খাঁর কাছে। এখানে সাত-আট বছরের আখতারি অল্পদিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন। ইমদাদ খাঁর শাসন ছিল কড়া আর শেখানোর পদ্ধতিও ছিল কঠিন ও উচ্চস্তরের, যা ওই বালিকার পক্ষে ধৈর্য ধরে মনোযোগ দিয়ে শেখা সম্ভব ছিল না। এই প্রথামাফিক শিক্ষার চাইতে তাঁর মন ছুটতো সখীদের সঙ্গে খেলাধুলোয়, তাই সুযোগ পেলেই রেওয়াজে ফাঁকি দিতেন। অল্পদিন পরে সেখান থেকে একেবারে নাম কাটালেন। কিন্তু উত্তরকালে আখতারি তাঁর প্রথম গুরুর কথা স্মরণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেছেন সবসময়ই। গয়াতে খুবই অল্প সময়ের জন্যে আখতারির সুযোগ হয় ওস্তাদ গুলাম মোহাম্মদ খাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণের। উৎকেন্দ্রিক জীবন শেষে মুশতারি মেয়েকে নিয়ে আবার নিজ শহর ফৈজাবাদে ফিরে আসেন ১৯২৩ সাল নাগাদ। এবারে পেলেন মনের মতো গুরু – আখতারিকে গড়ে তোলার পুরো দায়িত্ব নিলেন পাতিয়ালার ওস্তাদ আতা মোহাম্মদ খাঁ। প্রকৃত হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সংগীত তিনি এঁর কাছেই শেখেন অনেক বছর ধরে। আখতারি আতা মোহাম্মদের প্রযত্নে তালিম পান খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা ও গজলের। প্রথম প্রথম এখানেও মন বসতো না, শিক্ষাকে কখনো কখনো ভারী যান্ত্রিক ও বিরক্তিকর বলে মনে হতো। পরে গুরুর স্নেহ ও গুণবত্তা তাঁকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। পুরোপুরি মন দেন গান শেখায়। একটা সময় আখতারি একনাগাড়ে ছ-সাত-আট-নয়-দশ ঘণ্টাও রেওয়াজ করতেন। তাঁর এই নিষ্ঠা-নিবেদনে তুষ্ট ওস্তাদও তাঁকে উজাড় করে দিয়েছিলেন এই গুরুমুখী বিদ্যার যতোটুকু আখতারি গ্রহণ ও ধারণ করতে পারেন। আখতারি ঋণী – গভীরভাবে ঋণী আতা মোহাম্মদের কাছে। তাঁর এই কৃতজ্ঞতার কথা কবুল করতে কুণ্ঠিত হননি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও। এই ওস্তাদ আতা মোহাম্মদের পরামর্শ ও উৎসাহেই আখতারির সংস্কৃতিনগরী কলকাতায় আসা।

 

পাঁচ

কলকাতায় এসে আখতারি বাইয়ের শিক্ষা যেমন দড় হয়, তেমনি নানা মাধ্যমে তাঁর প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি এবং প্রতিষ্ঠার পথও সুগম হয়। প্রথম পাবলিক কনসার্টে অংশ নিয়ে তিনি আসর মাত করেন কলকাতাতেই। এখানেই সুযোগ মেলে গ্রামোফোন রেকর্ডে গান দেওয়ার। থিয়েটারে নামেন, ফিল্মে অভিনয় ও প্লেব্যাকের শিল্পী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন – বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন – সেও এই শহরেরই সৌজন্যে। তাঁর কণ্ঠে বাংলা গানের জন্মও এখানে। খ্যাতির জমিন তৈরি হয় এভাবেই এখানে। ১৯২৭ থেকে জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্ত নিয়মিত-অনিয়মিত যোগ ছিল কলকাতার সঙ্গে। কলকাতা যেমন তাঁকে ভোলেনি, তিনিও বিস্মৃত হননি তাঁর শিল্পীজীবনের ধাত্রীভূমি কলকাতাকে।

আবার ফিরে আসি গ্রামোফোনের কথায় – মেগাফোনের কথায়। মেগাফোন তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিল। মেগাফোনের জিতেন ঘোষের সঙ্গে আখতারির সূচনা-আলাপটা ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁর উদ্যোগেই হয়েছিল বলে কারো কারো ধারণা। হয়তো আখতারির ওস্তাদ আতা মোহাম্মদের সঙ্গে জমিরুদ্দিনের পূর্ব-পরিচয়ের সূত্রেই এটি সম্ভব হয়েছিল। আখতারি ও তাঁর মা মুশতারি বাই কলকাতায় এসে প্রথম উঠেছিলেন বউবাজারে, সেখান থেকে রিপন স্ট্রিটের এক ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে। তারপর সাময়িক মেগাফোনের বাড়িতে – সবশেষে হ্যারিসন রোড-লাগোয়া আমহার্স্ট স্ট্রিটে বিশাল রয়্যাল হোটেলে। এই হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মেগাফোনের জিতেন ঘোষই। হয়তো মেগাফোনের বাড়ির খুব কাছে হয় বলেই। শোনা যায়, একেবারে কাকভোরে এই রয়্যাল হোটেলে যখন আখতারি রেওয়াজ করতেন, তখন নাকি রাস্তার পাশে সেই সুরেলা আওয়াজ শুনে লোক জমে যেতো। এই হোটেলের সঙ্গে আখতারি বাই ফৈজাবাদির অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রখ্যাত সংগীতব্যক্তিত্ব জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ স্মরণ করেছেন : ‘আখতারি বাইয়ের সঙ্গে যেটুকু পরিচয় হয়েছিল, সেটুকু সাক্ষাৎ বলা চলে না, সেটুকু ত্রিশ-চল্লিশ গজের দূরত্ব থেকে চোখে দেখা মাত্র। আমরা তখন আমহার্স্ট ষ্ট্রীটে একটি বৃহৎ ভাড়াবাড়িতে বাস করি। পশ্চিমদিকের একটি বড় বারান্দার সামনে অপর ফুটপাথের উপর অবস্থিত হোটেল রয়েল। সেই হোটেলের গেট থেকে প্রায় দেখতাম এক সুবেশা তন্বী তরুণীকে একটি বৃহদাকার মোটরগাড়িতে বেরিয়ে যেতে এবং অনেক সময় নজরে পড়ত ঐ হোটেলে নেমে ভিতরে যেতে। তখন অবশ্য জানতাম না কি ওঁর পরিচয়। কিন্তু আমাদের বাড়ির সকলেরই কেন জানি না একটা ধারণা হত – উনি নিশ্চয় কোনও বাঈজি। এ রকম মনে হওয়ার সঙ্গত কোনও কারণও ছিল না, কিন্তু সেদিনের সেই দেখার অন্তত পঞ্চাশ বছর পরে একজন সঙ্গীতে খ্যাতনাম্নী গায়িকার সঙ্গে প্রথম অল্প এবং পরে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের অবসরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বেগম সাহেবা, আপ মুঝে বতা সকতি হৈঁ কি লগভগ উনতিস সাল কে বরাবর ক্যা আপ হ্যারিসন রোডকে পাস আমহার্স্ট ষ্ট্রীট মে হোটেল রয়েল মে কভী ঠহরতে থে?’ বেগম আখতার সামান্য চিন্তা করে বললেন, ‘হুঁ বাবুজি। আপকো ক্যায়সে য়াদ হ্যায়?’ তারপর উনি বললেন, সেই সময় জে.এন. ঘোষবাবু ওঁকে ফৈজাবাদ থেকে কলকাতায় আনিয়ে রেকর্ড করাতেন’ (তহজীব-এ-মৌসিকী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, কলকাতা, অগ্রহায়ণ ১৪০১, পৃ ১৯৯)। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের হিসেবে একটু ভুল আছে – ১৯৩২-এ জিতেন ঘোষের মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠা, তাই ১৯২৯-এ আখতারি বাই কী করে মেগাফোনে গান দেবেন! মেগাফোন আখতারি বাই ফৈজাবাদির প্রথম রেকর্ড বের করে ১৯৩৫-এ। তবে ১৯২৯ সালে আখতারি কলকাতায়ই থাকতেন, রিপন স্ট্রিটে তাঁর মায়ের সঙ্গে।

মেগাফোনে আখতারি বাই প্রথম যে দুটি গান রেকর্ড করেন, তার একটি ছিল মুলতানি রাগে খেয়াল, অপরটি রাগ পিলুতে ঠুমরি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫, বিয়ের আগ পর্যন্ত, তিনি মেগাফোনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বেশ কয়েক বছর বিরতির পর আবার ১৯৫২ থেকে যখন গাইতে শুরু করেন, তখন এখান থেকে কিছু গান রেকর্ড করেন। ১৯৫৮ সালে জিতেন ঘোষের মৃত্যুতে সে-সম্পর্ক শিথিল হয়ে আসে। কমল ঘোষের আমলেও কয়েকখানা গানের রেকর্ড করেন। কিন্তু সেই পুরনো দিন আর ফিরে আসেনি। জিতেন ঘোষ স্নেহে-মমতায়-প্রেরণায়-তিরস্কারে-নির্দেশনায় আখতারিকে গ্রামোফোন কোম্পানির জন্যে গড়ে তুলেছিলেন। জীবনীকার উল্লেখ করেছেন : ‘[Jiten] Ghosh was a mentor and father figure to Akhtari and she had signed a contract for ten years with his recording company’ (Begum Akhtar : The Queen of Ghazal, Sutapa Mukherjee, New Delhi, 2003, p 20). উভয়ের সম্পর্কটা কেমন ছিল সে-সম্পর্কে জানা যায় : আখতারি নিয়মিত রেওয়াজ করছেন না এমন খবর পেয়ে জিতেন ঘোষ তাঁকে একবার মেগাফোনের অফিসে ডেকে পাঠান। তাঁর ভৎর্সনা ও তিরস্কারে আখতারি কান্না চাপতে পারেননি। ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরে আসেন। ওইদিনই জিতেন ঘোষ আখতারির বাড়ি গিয়ে হাজির, বলা বাহুল্য খালি হাতে নয়। এইভাবেই স্নেহে-শাসনে তিনি শিল্পীকে গড়ে তুলতেন।

মেগাফোন থেকে প্রকাশিত প্রথম পর্যায়ে আখতারি বাইয়ের বেশ কয়েকটি রেকর্ড ভালো চলেনি। নতুন শিল্পীর এই দশা দেখে কেউ কেউ জিতেন ঘোষকে আখতারির আর কোনো রেকর্ড বের করার ব্যাপারে ভালো করে ভেবে দেখতে বলেন। জিতেন ঘোষ ছিলেন গানের জহুরি এবং সেই সঙ্গে ঝানু রেকর্ড ব্যবসায়ী। আখতারির মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন বলে তিনি আবার ঝুঁকি নিলেন। পরের রেকর্ডের একটি গান ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’ – লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো। অবিস্মরণীয় জনপ্রিয়তা পেল আখতারির এই গজলটি। বেহ্জাদ লাখনভি-রচিত এই গজলটি ভারতীয় সংগীতের চিরায়ত সম্পদ হয়ে আছে। মেগাফোনের দ্বিতীয় পুরুষ কমল ঘোষ জানিয়েছেন : ‘বেগম আখতারের কতগুলো রেকর্ড তো সুপারহিট, সকলেই জানেন। তার মধ্যে ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে’ (বাঙালির কলের গান, পূর্বোক্ত, পৃ ৭৬)। কেউ বলেছেন, এই গজলটি আখতারি বাইয়ের ‘title song’, কেউবা একে শিল্পীর ‘trade mark’ বলে অভিহিত করেছেন। জনপ্রিয়তার নিরিখে এর পাশাপাশি উল্লেখ করা যেতে পারে শাকিল বদায়্যুনির অপূর্ব কথার বাঁধুনির গজল – ‘অ্যাই মোহাববত তেরে আনজাম পে রোনা আয়্যা’।

মেগাফোন থেকে প্রকাশিত আখতারি বাইয়ের রেকর্ডে যেসব গজল-ঠুমরি-খেয়াল-দাদরা-কাজরী-নাত পরিবেশিত হয়েছিল তার মধ্যে স্মরণীয় কয়েকটির উল্লেখ এখানে করা যায় : ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’, ‘খুনে দিল কা জব’, ‘না ক্যবু দিল মে তেরা’, ‘লে গ্যয়া জোশে জুনুন’, ‘ক্যায়সা পলক হ্যায় ক্যায়সা হাসিন হ্যায়’, ‘ক্যায়সে এ ধুম মাচায়ে’, ‘আরমান নেহি তো মেরি’, ‘দফ্ কাহে কো বাজায়ে’, ‘রাহনে লাগা হ্যায় দিল মে’, ‘হ্যায় মোহাববত হ্যায় জওয়ানি’, ‘চালি আও চালি এ পূরব নাগরি’, ‘জিস্ দিল মে মোহাববত হ্যায়’, ‘তুহি ভরসা তুহি সাহারা’, ‘আসার যব বেদিল কো দিখানা পড়েগা’, ‘হাম কো নজর ছে তুম ভি গির‌্যা গ্যয়া’, ‘চাঁন কাঁহা হ্যায় ইদ কে দিন’, ‘ক্যয়ে দর্দ কি কোই’, ‘আজা সজনী মেরি পাস’, ‘নাম রোশন ক্যরে দুনিয়া মে’, ‘ঝুটে জগ্ কি ঝুটে প্রীত’, ‘চার দিনো কি জওয়ানি’, ‘অাঁখো মে মেরি পিন্হা’, ‘হোরি খেলান ক্যায়সে যাঁও সখি’, ‘নয়ী মন্জিল পে আয়ে’, ‘বাহার আয়ে খিলে গুল’, ‘ফুলোঁ কো ঝুলানে’, ‘রসুলে খোদা’, ‘মোহাম্মদ হ্যায় আপনে পেয়ার’, ‘আ চ্যলা হো পরদেশিয়া নয়না লাগাকে’, ‘পিয়া মিলন কে হাম যায়ে’, ‘আব তো কুছ্ নহি’, ‘মেরি দিলরুবা’, ‘আব কাঁহা আরাম তুম বিন’ – এ-রকম আরো অনেক গজল-ঠুমরি-দাদরার কথা উল্লেখ করা যায়, যার আবেদন কাল থেকে কালান্তরে বহমান। মেগাফোন কর্তৃপক্ষের কাছে এ-তথ্য নেই যে, এখান থেকে আখতারি বাইয়ের কতো গান রেকর্ড হয়েছিল। তবে তাঁদের অনুমান, একশরও বেশি রেকর্ড বেরিয়েছিল মেগাফোনের তরফে। তাঁর গানের চাহিদা আজো প্রচুর। সেই বিবেচনায় ২০০৭-এ মেগাফোন থেকে বেগম আখতারের ৬৮টি গানের চারটি সিডির একটি সুদৃশ্য অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায়’ নাম দিয়ে। মেগাফোন আখতারি বাইকে ভুলে যায়নি – তাদের সেকালের বড়ো পরিসরের রিহার্সেল রুমে আখতারির             ভরা-যৌবনের একটি মনোরম ছবি নকশা-কাটা ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে। আখতারির খ্যাতির সুরভি যে সবখানে ছড়িয়ে পড়েছিল মেগাফোনেরই কল্যাণে সেকথা জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ যথার্থই বলেছেন : ‘… মনে দাগ দেওয়া একজন শিল্পীর নাম জে.এন. ঘোষের মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানীর দেশজোড়া প্রচারে সঙ্গীতসমাজে ও মানুষের ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হ’ত। সেই শিল্পী তখন ছিলেন আখতারী বাঈ এবং অনেক পরে যিনি হলেন বেগম আখতার’ (তহজীব-এ-মৌসিকী, পূর্বোক্ত, পৃ ১৯৯)।

আখতারি বাই একসময় হিজ মাস্টার্স ভয়েস এইচএমভির সঙ্গেও যুক্ত হন। তবে সেটা কোন্ সময় থেকে তা সঠিক বলা মুশকিল। তবে পঞ্চাশ দশকের আগে নয় বলেই মনে হয়। আখতারি যখন এইচএমভিতে আসেন তখন তিনি অনেক পরিণত ও প্রাজ্ঞ। তাঁর রেকর্ড করা এইচএমভিরও অনেক গান জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু মেগাফোনের সঙ্গে তাঁর যে ঘরোয়া ও আত্মিক সম্পর্ক রচিত হয়েছিল, তা এইচএমভির সঙ্গে কখনোই গড়ে ওঠেনি এবং তা নানা কারণে সম্ভবও ছিল না। এইচএমভিতে বেগম আখতার যেসব ঠুমরি-দাদরা-গজল-পূরবী রেকর্ড করেন তাও শ্রোতার অন্তরকে স্পর্শ করে। সেসব গানের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি : ‘ননদিয়া কাহে মোরে বল’, ‘অাঁখিয়া নিন্দ না আয়ে’, ‘আব কে শাওন ঘর আজা’, ‘মোরি টুট গ্যয়ি আশ্’, ‘জারা ধীরে সে বোলো’, ‘মেরা বালম পরদেশিয়া’, ‘কোয়েলিয়া মাত ক্যর্ পুকার’, ‘ক্যায়সে কাটে দিন রাতিয়াঁ’, ‘ইয়ে ন থি হামারি কিসমৎ’, ‘লায়ে হায়াৎ আয়ে কাজা’, ‘ওহ্ জো হাম মে তুম মে’, ‘মেরে নসিব নে যব মুঝে’। আখতারি তাঁর গানের বাণী নির্বাচন করেছিলেন মির্জা গালিব, মির তকি মির, দাগ, মোমিন, শাকিল বদায়্যুনি, জিগর মুরাদাবাদি, তাসকিন কোরেশি – সেকাল ও একালের বিখ্যাত সব কবির রচনা থেকে। প্রেম-বিরহ-বিষাদ-বিচ্ছিন্নতা-নৈরাশ্য-প্রতীক্ষা-আক্ষেপের অনুভূতি এইসব কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। আখতারি তাঁর নিজের জীবনকাহিনিরই প্রতিধ্বনি যেনো শুনেছিলেন এইসব রচনায়। তাই তাঁর কণ্ঠে এই ভাবানুভূতিই সর্বোচ্চ শৈল্পিক আবেগে প্রকাশ পেয়েছে।

জীবনের শেষপর্বে বেগম আখতার মাত্র কয়েকটি বাংলা গানও করেছিলেন। এর মূলে ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। তাঁর মুখেই শোনা যাক সেকথা : ‘…তখন আমি [কলকাতা] বেতারের লাইট মিউজিক ইউনিটের সঞ্চালক। তখন তাঁর [বেগম আখতার] সঙ্গে আলাপ হয়েছে এবং আমি তাঁর কিছু বাংলা গান, ঠুংরি, দাদরা অঙ্গে প্রস্ত্তত করেছি, বেতারে প্রচারের উদ্দেশ্যে। তিনি সানন্দে তা করেছিলেন এবং তাঁর সেই গানের সমতুল্য গান তিনি রেকর্ডও করতে পারেননি অন্তত একটা কারণে যে, গাইবার স্বাধীনতা তিনি পেয়েছিলেন সময়ের দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে।’ এই কথার সূত্র ধরে জ্ঞানপ্রকাশ আরো বলেছেন : ‘এর অনেক পরে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁকে দিয়ে আমারই রচিত এবং সুরারোপিত চারখানি বাংলা গান গ্রামোফোন কোম্পানীর রেকর্ডে ধরে রাখবার’ (তহজীব-এ-মৌসিকী, পূর্বোক্ত, পৃ ২০০)। ‘পিয়া ভোলো অভিমান’ (১৯৭২), ‘কোয়েলিয়া গান থামা’ (১৯৭২), ‘ফিরে কেন এলে না’ (১৯৭৫) ও ‘ফিরায়ে দিয়ো না মোরে শূন্য হাতে’ (১৯৭৫) – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-কথিত এই সেই ‘চারখানি বাংলা গান’। তবে জ্ঞানপ্রকাশের কথায় সামান্য ভুল আছে – হয়তো স্মৃতিবিভ্রমের কারণে। চারটি গানই তাঁর রচিত নয়, ‘ফিরায়ে দিয়ো না মোরে শূন্য হাতে’ – এই গানটির সুর-যোজনা জ্ঞানপ্রকাশ করলেও গীতিকার ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষের দুখানা গানের রেকর্ড বেগম আখতারের মৃত্যুর পরের বছর প্রকাশিত হয়। আরো চারখানা রাগাশ্রয়ী বাংলা গানের দুটি রেকর্ড ১৯৭১ ও ১৯৭৪-এ এইচএমভি থেকে বের হয় : ‘জোছনা করেছে আড়ি’, ‘এ মৌসুমে পরদেশে’, ‘চুপি চুপি চলে না গিয়ে’ এবং ‘ফিরে যা ফিরে যা বনে’। বেতারে ধারণকৃত বাংলা গানগুলি প্রচারিত হলেও রেকর্ডে প্রকাশিত হয়নি – হলে, বেগম আখতারের অসাধারণ গায়নশৈলীর আরো নিবিড় পরিচয় পাওয়া যেতো। যাহোক, বেগম আখতারের এই রাগাশ্রয়ী বাংলা গান বাঙালিকে যে কতোখানি মোহাচ্ছন্ন করতে পেরেছিল তার বিবরণ দিয়েছেন এক সংগীতবোদ্ধা শঙ্করলাল ভট্টাচার্য : ‘আমজনতা তো ডিস্ক শুনেই মাত, গোটা বাঙালি তখন বেগম বলতে অজ্ঞান, কিন্তু জ্ঞানবাবু বলতেন, ‘‘বাঁধা লেংথ তো রেকর্ডের। রেডিয়ো-র রেকর্ডিং-এ যা দেওয়া গেছে তার সিকি ভাগ।’’ ’ তারপর ওই কথার সূত্র ধরেই বলছেন তিনি : ‘কিন্তু এই সিকিভাগেই তো বাঙালি মাতোয়ারা। যে বছর অকাল-প্রয়াতা হলেন বেগম আখতার সে বছর দুর্গাপুজো, কালীপুজোর প্যান্ডেলে কেবলই ঘুরেফিরে আসছে হয় ওঁর ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’ নয়তো ‘এ মৌসুমে পরদেশে’, হয় ‘চুপি চুপি চলে না গিয়ে’ নয় ‘ফিরে কেন এলে না’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ অক্টোবর ২০১৪)। এখানেও তথ্যের অসংগতি আছে – ‘ফিরে কেন এলে না’ – যে-গানের রেকর্ড তাঁর মৃত্যুর পরের বছর বের হয়, তা কী করে এক বছর আগে পুজোর প্যান্ডেলে বাজবে? সংগীতপ্রিয় বাঙালির কাছে এখনো বেগম আখতারের উর্দু-হিন্দি গজল-ঠুমরি-দাদরার পাশাপাশি এই বাংলা গান কটির আবেদন শেষ হয়ে যায়নি – হয়তো কখনো যাবে না।

 

ছয়

আখতারি বাইয়ের গায়নপদ্ধতি সম্পর্কে মন্তব্য এবং তাঁর সংগীতজীবন সম্পর্কে মূল্যায়ন শুধু উঁচুমাপের সংগীতবোদ্ধা ও বিশেষজ্ঞের পক্ষেই সম্ভব। অন্যদের জন্যে তা হবে অনধিকারচর্চা। তাই সেই অচেনা দুর্গম পথে আনাড়ির মতো না গিয়ে বিষয়-অধিকারীর কথাই এখানে শোনাবো। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁর স্মৃতিচর্চায় আখতারি বাই সম্পর্কে সামান্য যে আলোকপাত করেছেন তারই প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ এখানে পেশ করা হলো। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেছেন : ‘আমার মনে আছে সে সময় আখতারী বাঈয়ের নাম গাইয়ে-বাজিয়েদের ঘরে ঘরে। আমার ওস্তাদ মসীত খাঁ ও তাঁর পুত্র করামৎ খাঁকে কতবার যে বেগম আখতারের গান গুনগুনিয়ে গাইতে শুনেছি তা বলা যায় না’ (তহজীব-এ-মৌসিকী, পূর্বোক্ত, পৃ ১৯৯)। ‘ছা রহী কালী ঘটা’ – এটি আখতারি বাইয়ের একটি ‘খুবই বিখ্যাত গান’ – উচ্চাঙ্গসংগীতের একজন বড়ো সমঝদার, চলচ্চিত্রশিল্পী ও জ্ঞানপ্রকাশের বন্ধু রাধামোহন ভট্টাচার্য এই গানের শিল্পী কে তা না জেনেও গানটির মোহে পড়ে বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তিনি এই গানটি জানেন কিনা! জ্ঞানপ্রকাশ নিজে আখতারির গোড়ার দিকের রেকর্ডের একটি গান ‘কৈসী বঁসিয়া বজাঈ’ শুনে একেবারে মত্ত হয়ে যেতেন – ‘শুনে শুনে রেকর্ডটি ঘষে ক্ষয়ে গিয়েছিল’। এ থেকে বোঝা যায়, আখতারির গানের আবেদন কতো ব্যাপক ও গভীর ছিল। তাঁর সংগীতজীবনের সূচনাপর্ব এবং তালিম সম্পর্কে বলতে গিয়ে জ্ঞানপ্রকাশ উল্লেখ করেছেন : ‘বেগম আখতার প্রথমে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছিলেন চুটকি গান – দাদরা, কাজরী, লোকগীতি গেয়ে। তাঁর প্রথম দিকের রেকর্ডে আমরা তা পাই, অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গজল অঙ্গের গানও। ক্রমশ তাঁর রুচি ও অধ্যবসায়ের ফলে তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতের মধ্যে প্রবেশ করেন, যেমন – ঠুংরি, খেয়াল ইত্যাদি। কিন্তু বোধহয় ধ্রুপদ নয়। গুণী ওস্তাদদের তিনি সঙ্গ করতে ভালোবাসতেন, যার জন্য উপযুক্ত দক্ষিণা দেওয়া ছাড়া স্বগৃহে অল্প কিংবা বেশিদিন অবস্থানের ব্যবস্থার জন্য সর্বদা প্রস্ত্তত থাকতেন।… ওঁর নিজের কাছেই শুনেছি যে উনি আতা খাঁ, বরকৎ আলি খাঁ এবং গোলাম আলি খাঁকেও স্বগৃহে আমন্ত্রণ করে তালিম গ্রহণ করেছিলেন’ (তহজীব-এ-মৌসিকী, পূর্বোক্ত, পৃ ১৯৯-২০০)। আখতারি বাইয়ের গানকে ‘অনুপম সৃষ্টি’ এবং শিল্পী হিসেবে তাঁকে ‘স্বনামধন্যা’ বলে আখ্যা দিয়ে তাঁর যে মূল্যায়ন জ্ঞানপ্রকাশ করেছেন তাঁর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার আলোকে, তা উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘… যে গান বেগম আখতারের গানের মধ্যে দিয়ে প্রাণে আঘাত করে, সে গানের ভাষা, উচ্চারণ, ভাবব্যঞ্জনা এবং সবার উপরে তাঁর নিজস্ব কণ্ঠের স্বরধ্বনির বর্ণজাত আবেদন, যা কোনও যুগের গায়ক-গায়িকার একচেটিয়া নয়। বেগম আখতার কেন, কোনও উচ্চমার্গের গানের সঠিক অনুভূতির বিশ্লেষণ বা বর্ণনা সম্ভব নয় কিন্তু অনেক সভায় বেগম আখতার তাঁর সহাস্য সাবলীল ভঙ্গিতে যখন গজল শুনিয়েছেন, জানি না ভাষা-বাণী-উচ্চারণ-ব্যঞ্জনা, কিসের প্রভাবে মন আবেশ-বিহবল হয়ে যেত’ (তহজীব-এ-মৌসিকী, পূর্বোক্ত,            পৃ ২০১)।

 

পন্ডিত রবিশঙ্কর ১৯৮৬-এর ১৬ অক্টোবর এক শ্রদ্ধা-নিবেদনে বেগম আখতার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তা সংক্ষিপ্ত হলেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। রবিশঙ্কর তাঁকে ‘One of the greatest! Not only in India, but in the world caliber’ বলে অভিহিত করেন এবং সেইসঙ্গে আরো বলেন – ‘She had a great capacity to be able to reach the depth of the heart of the listener’. বেগম আখতারের ‘unique voice’ এবং ‘musical sense’ কীভাবে বাণীকে সুরের সহযোগে ব্যঞ্জনা দান করে তারও উল্লেখ করেন। রবিশঙ্কর তাঁর ‘Sindhi Bhairav’ বেগম আখতারের স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করে শেষে মন্তব্য করেছেন – ‘in which she herself was matchless’. রবিশঙ্করের স্মৃতিকথাতেও আখতারি বাইয়ের প্রসঙ্গ এসেছে। আখতারির গায়নশৈলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন : ‘যদি সঠিকভাবে বিচার করো তাহলে ওঁর গানকে তুমি গজলও বলতে পারবে না, পিওর ক্ল্যাসিকালও নয়, আবার ঠুংরীও নয়, আবার তাতে কিছু কিছু দেহাতী ঢঙ, সুরও মিলে-মিশে রয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়েই উনি নিজস্ব যে ঢঙটায় গাইতেন, … ওরকমটা আর কোনও দিনও হবে না, আর আগে কখনও হয়েছে বলেও বিশ্বাস করি না’ (রাগ-অনুরাগ, কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৯, পৃ ৯৮)। রবিশঙ্করের বিবেচনায় ‘আবেদন’ই ছিল তাঁর গানের মূল বৈশিষ্ট্য। কথাটাকে একটু বিশ্লেষণ করে রবিশঙ্কর বলতে          চেয়েছেন : ‘ঐ আবেদন গলা ভেঙে, অত্যন্ত সুরেলা গলায় কথাগুলো উনি এমন ফুটিয়ে তুলতে পারতেন যে, পুরো জিনিসটাই একটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। একটা পার্সোন্যাল ইমেজ… [। ] তুমি শুনছ আর ভাবছ আখতারী যেন তোমাকে উদ্দেশ করেই গাইছেন। তুমিই যেন ওঁর প্রেমিক। এটা ওঁর হল-ভরতি সব শ্রোতারই হত।… এটা যে কতখানি সিদ্ধির ব্যাপার সে কথা কোনও শ্রোতাকেই ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার নেই। এটা খুব বড় জিনিসও বটে – গান-বাজনার তরফ থেকেই বলছি।… বেগমের মত গানকে ঐ পার্সোন্যাল লেভেলে বেঁধে রাখা ভীষণ শক্তির পরিচয়’ (রাগ-অনুরাগ, পূর্বোক্ত, পৃ ৯৮)। আখতারির এই ‘ইরোটিক ভাবে’র সঙ্গে রবিশঙ্কর মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু শিল্পী, বিশেষ করে বিখ্যাত উম্মে কুলসুমের তুলনা করতে চেয়েছেন। ‘আওয়াজের মধ্যেই দারুণ ইরোটিসিজম’ উম্মে কুলসুমদের মতো আখতারির মধ্যেও তিনি আবিষ্কার করেছেন এবং ‘কথাগুলোকে… জীবন্ত’ করে তোলার ক্ষমতাও যে আখতারির পরিপূর্ণভাবে ছিল তাও উপলব্ধি করতে পেরেছেন। রবিশঙ্করের ভাষায় : ‘আখতারী বাঈ ছিলেন একটা ইন্স্টিট্যুশন। ওর সঙ্গে কারো ঠিক তুলনা চলে না। উনি নিজেই নিজের দৃষ্টান্ত’ (রাগ-অনুরাগ, পূর্বোক্ত, পৃ ৯৮)।

 

সাত

অভিনয় আখতারি বাইয়ের শিল্পীজীবনের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ উজ্জ্বল দিক। থিয়েটার ও ফিল্মের সঙ্গে কলকাতাতেই জড়িয়ে পড়েন। মঞ্চে ও রুপালি পর্দায় তিনি একই সঙ্গে অভিনেত্রী ও গায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হন। মঞ্চেই প্রথম তিনি অভিনয়ে নামেন। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে তাঁর অভিনয় ও গান দর্শক-মনোরঞ্জনে সমর্থ হয়। কলকাতার কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের মতো সেকালের নামী প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করার সুযোগ করে নেন। মূলত পৌরাণিক নাটকেই তিনি বেশি অংশ নিয়েছেন। সীতা এবং নল-দময়ন্তীতে তাঁর অভিনয় বিশেষ প্রশংসা পায়। নয়ি দুলহান নাটকে তিনি অভিনয়ের সঙ্গে একটি ভজনও পরিবেশন করেন। আবার থিয়েটারে তিনি ভিন্ন ধরনের চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। এ-সম্পর্কে – ‘Some old-timers remembered her playing the vamp, dressed in a black velvet, western dress and smoking a cigarette with a long black holder’ (Begum Akhtar : Love’s own voice, S. Kalidas, New Delhi, 2009. p. 24). মঞ্চে অভিনয়ের কালে তাঁর বড়ো প্রাপ্তি ওস্তাদ ঝান্ডে খাঁর মতো সুরস্রষ্টার সান্নিধ্যলাভ। নিজের সংগীতচর্চা ও ফিল্মের জন্যে মঞ্চের সঙ্গে যোগ ধীরে ধীরে কমে আসে। একসময় পুরোপুরি ছেড়েই দিতে হয়। কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের সঙ্গে ছাড়া-ছাড়া ভাবে অবশ্য সম্পর্কটা তারপরও অনেকদিনই থেকে গিয়েছিল। কলকাতার বাইরেও এই প্রতিষ্ঠানটি নানা জায়গায় থিয়েটার করতে যেতো – সময় ও সুযোগ পেলে আখতারি বাইও এদের সঙ্গে থাকতেন। চল্লিশ দশকের কোনো এক সময় আখতারি কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের সঙ্গে লখনৌয়ে আসেন এবং মঞ্চে নামেন। এই বোধহয় মঞ্চে তাঁর শেষ অভিনয়।

গায়িকা ও মঞ্চের অভিনেত্রী হিসেবে আখতারি বাইয়ের যখন মোটামুটি পরিচিতি এসেছে, তখন চলচ্চিত্রে অভিনয় ও প্লেব্যাকের প্রস্তাব আসে। এ-ছিল আখতারির স্বপ্নপূরণের এক আকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়। মঞ্চের অভিনয় তাঁকে তেমন তৃপ্ত করতে পারেনি, এই মাধ্যমে তিনি শিল্পী হিসেবে খুব একটা আর্থিক সুবিধাও পাননি। সেই রকমের একটা টানাপড়েনের মুহূর্তে সুযোগ এলো চলচ্চিত্রের ভুবনে প্রবেশের। উল্লেখ করার বিষয়, এই সুযোগও তিনি কলকাতাতেই পান। কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি আখতারিকে ফিল্মে অভিনয়ের জন্যে আমন্ত্রণ জানান। ১৯৩৩-এ আখতারির প্রথম ছবি নল দময়ন্তী মুক্তি পায়। ওই একই বছরে তিনি আরো দুটি ছবিতে অভিনয় করেন – নাচরং ও এক দিন কি বাদশাহতে। তখন এদেশের চলচ্চিত্রের এক নতুন সম্ভাবনা সূচিত হয়েছে। এর মাত্র দুবছর আগে অর্থাৎ ১৯৩১-এ ভারতীয় চলচ্চিত্র সবাক যুগে প্রকাশ করেছে। পরের বছর দুটি (১৯৩৪ : মমতাজ বেগম ও আমিনা) এবং তার পরের বছর আরো দুটি (১৯৩৫ : জওয়ানি কা নেশা ও নসিব কা চক্কর) ছবিতে কাজ করেন আখতারি। এসব ছবিতে তাঁকে অনেকটাই সেকালের রেওয়াজ অনুসারে গানও গাইতে হয়। জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে প্রথমে সাতশো টাকায় চুক্তিবদ্ধ হলেও পরে আখতারির সেই বেতন বেড়ে দুহাজার টাকায় পৌঁছয়। মা-মেয়ের সংসারে সচ্ছলতা আসে এবং সেইসঙ্গে তিনি ফিল্মের জগতে তাঁর আসন পাকা করে নেন। চলচ্চিত্রের চুক্তিবদ্ধ মাসমাইনের শিল্পী হওয়ার ফলে তাঁর সংগীতের চর্চায়, তালিম-রেওয়াজে বিঘ্ন ঘটে, ফলে তিনি রুপালি জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আবার পুরোপুরি গানের ভুবনে মন দেন। ১৯৪২-এ তিনি কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে লখনৌয়ে চলে যান। অর্থ ও খ্যাতি তখন আখতারি বাইয়ের করায়ত্ত। ওই সালেই তিনি বিখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক মেহবুব খানের অনুরোধে তাঁর রোটি ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। রোটিতে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন কত্থক নাচের নামী শিল্পী সিতারা দেবী। এই ছবিতে আখতারি প্লেব্যাকও করেন। অন্তত দুটি গানের কথা বলা যায়, যা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল সেইসময়ে : ‘ফির ফস্লে বাহার আয়ি হ্যায় দিলে দিওয়ানা’ এবং  ‘বেহ্নে লাগা হ্যায় দিল্ মেঁ আন্ধেরা তেরে বাঘহের’। এরপর তিনি চলচ্চিত্রকে ছুটি জানালেন। কিন্তু না, অভিনয় না করলেও দানাপানি ও এহসান – এই দুটি ছবিতে প্রায় এক যুগ পরে গান গাইতে হয়। রোটিতে অভিনয়ের ষোলো বছর পর আবার সত্যজিৎ রায়ের আমন্ত্রণে তিনি জলসাঘর (১৯৫৮) ছবিতে ছোট্ট একটি দৃশ্যে দুর্গাবাই চরিত্রে গায়িকার ভূমিকায় অংশ নেন। এই-ই তাঁর জীবনের শেষ ছবি।

 

আট

আখতারি বাইয়ের সংগীতজীবনের সঙ্গে বেতারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। ঘটনাক্রমে বেতারে তাঁর গান দেওয়ার ব্যাপারটাও ঘটে কলকাতাতেই। জদ্দনবাই – সেকালের এক তুলনাহীনা সংগীতশিল্পী- চিত্রনায়িকা নার্গিসের মা – তাঁর হাত ধরেই আখতারি অল্ ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে গান দিতে যান। জদ্দনবাই ছিলেন আখতারির প্রেরণা ও আদর্শ – সারাজীবন তাঁর কথা আখতারি শ্রদ্ধা-ভক্তি-কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করেছেন। জদ্দনবাইয়ের সুপারিশে তিনি গান গাওয়ার সুযোগ পান। বেতারে জীবনের প্রথম অনুষ্ঠানে তিনি একটি দাদরা পরিবেশন করেন। তাঁর ওই গান সাড়া জাগিয়ে তোলে এবং তিনি রেডিওর নিয়মিত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর থেকে তিনি কলকাতা বেতারে নিয়মিত গান গেয়েছেন। যতোদিন কলকাতায় ছিলেন বেতারের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ছিল তাঁর সম্পর্ক। কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার পর যখনই এখানে আসতেন বেতারে তাঁর গান পরিবেশন বাঁধাধরা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ জানিয়েছেন, পরিণত বয়সেও তিনি কলকাতা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান করেছেন, বাঙালি সংগীত-সমঝদারদের উদ্দেশে বাংলা গান উৎসর্গ করেছেন এই কেন্দ্রের মাধ্যমেই।

অল্ ইন্ডিয়া রেডিওর লখনৌ বা দিল্লি বা আহমেদাবাদ কেন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। বিশেষ করে চল্লিশের দশক থেকে লখনৌ কেন্দ্র বেগম আখতারের গান নিয়মিত প্রচার করেছে। বিয়ের পর বেগমের বাইরে গানবাজনা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। মূলত লখনৌ কেন্দ্রের বেগমের অনুরাগী কর্মকর্তাদের উদ্যোগে-অনুরোধে এই ব্যবস্থা রহিত হয় এবং তিনি আবার আগের মতো সংগীতজগতে ফিরে এসে নির্বাধে বেতার, পাবলিক কনসার্ট, সংগীত সম্মেলন, অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক সফর শুরু করেন। পরিস্থিতির কারণে নির্বাসিত এক যুগন্ধর শিল্পীকে আবার গানের জগতে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেতার এক ফলপ্রসূ আন্তরিক ভূমিকা পালন করেন। শিল্পীর এই পুনর্জন্মের জন্যে লখনৌ বেতার কর্তৃপক্ষের কাছে শিল্পী ও তার অনুরাগীবৃন্দ নিঃসন্দেহে কৃতজ্ঞ। বেগম আখতার সব ধরনের প্রচারমাধ্যমেই গান করেছেন – সর্বশেষ টেলিভিশনে। দিল্লি দূরদর্শনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি ছিলেন এর সঙ্গে যুক্ত।

 

নয়

মানুষ হিসেবে আখতারি বাই ওরফে বেগম আখতার কেমন ছিলেন, তা জানার আগ্রহ তাঁর অনুরাগী শ্রোতাদের অত্যন্ত স্বাভাবিক। একেবারে শৈশব থেকেই অভাব কাকে বলে তা আখতারি খুব ভালোভাবেই জানার সুযোগ পান – সেইসঙ্গে স্নেহের অভাবও তাঁকে পীড়িত করে। বড়ো হয়ে যখন গান গেয়ে ও অভিনয় করে প্রচুর উপার্জনের সুযোগ এসেছে তখন দুহাতে খরচ করতে দ্বিধা করেননি। বন্ধুস্বজনদের নিত্যই দামি দামি উপহার দিতে ভালোবাসতেন। রামপুরের নবাব রাজা আলি খানকে একবার তাঁর লখনৌয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন আখতারি। এই অনুষ্ঠানের জাঁক দেখে সকলকে বিস্মিত হতে হয়। আপ্যায়ন-অভ্যর্থনায় আখতারি তাঁর সাধ্যের শেষসীমায় পৌঁছে দেদার খরচ করেন। এমনকি নবাবকে আনা-নেওয়ার জন্যে একটি নতুন মোটরগাড়িও কিনে ফেলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানশেষে আখতারি দামি কার্পেট থেকে শুরু করে আসবাব-তৈজসপত্র মায় মোটরগাড়িটিও আত্মীয়বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। এই যে দান-উপহারের ব্যাপার এটা তাঁর জীবনে ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। একবার তাঁর ঘনিষ্ঠ লখনৌ বেতারের এক পদস্থ কর্মকর্তা বেগমের আঙুলের একটি আংটি দেখিয়ে ‘খুব সুন্দর’ এই কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মৃদু হেসে দামি আংটিটি খুলে তাঁর হাতে তুলে দেন। নিজে স্নেহের কাঙাল ছিলেন বলে পরিণত বয়সে তাঁর স্নেহের পরশ থেকে আত্মীয়-বন্ধু-শিষ্য-শিষ্যা কাউকে বঞ্চিত করেননি। বিয়ের পর ঘরোয়া বেগম আখতারের ভিন্ন রূপের পরিচয় মেলে। কখনো রান্নার কাজে হাত লাগাতেন, পতিসেবায় নিষ্ঠ-মনোযোগী হয়ে উঠতেন, নজর রাখতেন গৃহকর্মের কাজের প্রতি, আবার অতিথি-আপ্যায়ন ও অভ্যর্থনায় যোগ্য নবাব-ঘরণীর পরিচয় দিতেন।

উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। শিল্পীর কোনো দেশ-কাল, জাত-ধর্ম থাকে না – বেগম আখতারেরও ছিল না। তাঁর এক প্রিয় শিষ্যা শান্তি হিরানন্দ একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যার ভেতর দিয়ে ভিন্ন এক বেগম আখতারকে খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬২-এর মার্চে বেগম আখতার গান গাইতে পাকিস্তান-সফরে যান, সঙ্গে ছিলেন শান্তি হিরানন্দ। ওয়াগাহ্ সীমান্তে পাসপোর্ট পরীক্ষার জন্যে তাঁদের থামতে হয়। কাস্টমসের এক বড়ো অফিসার একটু বিস্মিত ও বিরক্ত হয়েই যেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘শান্তি হিরানন্দ আখতার! এ আবার কী ধরনের নাম?’ ধীর-শান্তভাবে বেগম আখতার জবাব দিলেন, ‘ও আমার মেয়ে।’ অফিসার বিশ্বাসই করতে পারেন না একজন মুসলিম রমণীর মেয়ের নাম ‘শান্তি’  হয় কী করে! বেগম আখতার বললেন, ‘পাকিস্তানে কেমন জানিনে, তবে ভারতে               এ-রকম হয়।’ বরাবরই তিনি এ-ধরনের চোখা জবাব দিতে অভ্যস্ত ছিলেন। আবার শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মসম্মানবোধ কতো প্রখর ছিল সে-গল্প বেগমের জীবনীকার শান্তি হিরানন্দকে শুনিয়েছেন গ্রামোফোন কোম্পানি অব্ ইন্ডিয়ার (এইচএমভি) বোম্বের এক কর্তাব্যক্তি – বেগমের গুণমুগ্ধ ও সুররসিক জি.এন. জোশি।

বেগম আখতার ছিলেন সহজ-সরল-অহংকারশূন্য মানুষ ও শিল্পী। সে কেমন তা বোঝাতে গেলে উত্তরকালের এক দুঁদে আমলার যৌবনের একটি খন্ডস্মৃতির সহায়তা নিতে হয়। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বর মাসের এক রমণীয় সন্ধ্যার গল্প। ভারতীয় সেন্ট্রাল সার্ভিসের জনকুড়ি শিক্ষানবিশ তরুণ যাঁদের বয়সও গড়পড়তা ওই কুড়িই, তাঁরা দূরপাল্লার ট্রেনে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। নবযৌবন, নতুন চাকরি, সবান্ধব মুক্তভ্রমণ – সবমিলিয়ে এঁদের উচ্ছলতা-প্রগলভা-কোলাহল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অন্য যাত্রীরা বিরক্ত – তার ওপর জানা গেল পাশের কোচে এই তরুণ তুর্কিদের সহযাত্রী বেগম আখতার – পুরো ঘটনায় তাঁরও প্রসন্ন থাকার কথা নয়, সে-বিষয় ট্রেনের কোচ-অ্যাটেন্ডেন্ট অবহিত করার পর এই তরুণেরা খুবই লজ্জিত ও বিব্রত হলেন। তাঁরা নিজেরা আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলেন বেগম আখতারের কাছে গিয়ে এজন্যে মাফ চাইবেন। চারজনের একটি দল দুরুদুরু বুকে বেগমের কোচের দরজায় গিয়ে টোকা দিলেন। বেগমের শিষ্যা সংগীতশিল্পী অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় দরজা খুলে তাঁদের ভেতরে আসতে বললেন। রাত নেমেছে – বাইরে তখন জোছনার প্লাবন, বেগম গুনগুন করে আনমনে সুর ভাঁজছেন। কুঁকড়ে যাওয়া তিন তরুণ ও এক তরুণী ক্ষমাপ্রার্থনা ও দুঃখপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই, এইচ. খাসনবিশ ওই চারজনের একজন জানাচ্ছেন : ‘Begum Akhtar burst into wild laughter and made the atmosphere so friendly that we were overtaken by her charming simplicity’ (The Statesman, 7 October 2014). একটা স্বস্তির ভাব নিয়ে তাঁরা ফিরে এলেন তাঁদের কামরায়। এরপরে যা ঘটলো তা অভাবনীয়-অবিশ্বাস্য – বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতো ঘটনা। তরুণদের কামরায় হাসিমুখে প্রবেশ করলেন বেগম আখতার। তারপর সহজ-সাবলীলভাবে তাঁদের সঙ্গে মেতে উঠলেন গানের আড্ডায়। যে-যা জানেন গাইতে বললেন দু-চার লাইন করে। তারপর মাঝরাতে ট্রেনের কামরায় খালি গলায় গান শুরু করলেন বেগম আখতার। প্রায় ঘণ্টাখানেক তিনি গাইলেন। খাসনবিশ জানাচ্ছেন : ‘She transpored us to a different world. We learnt from her that music had no frontier and that language did not matter in appreciating a song if properly rendered’ (The Statesman, 7 October 2014). এমনই সাধারণের মধ্যে অসাধারণ ছিলেন বেগম আখতার, কি শিল্পী কি মানুষ হিসেবে।

 

দশ

চল্লিশের দশকের গোড়ায় কলকাতা থেকে লখনৌয়ে ফিরে এসে আখতারি বাইয়ের জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হলো। ততোদিনে গ্রামোফোন রেকর্ড আর সিনেমার কল্যাণে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এবার তাঁর সংগীতের সুর-বিস্তারের জন্যে বেছে নিলেন মেহফিল, মুজরো, পাবলিক কনসার্ট, সংগীত সম্মেলনকে। লখনৌয়ে এসে তিনি নিজেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে আরো বেশি করে সমর্পণ করেন। উচ্চাঙ্গসংগীতের উচ্চতর শিক্ষার জন্যে তিনি নাড়া বাঁধলেন কিরানা ঘরানার এক খ্যাতিমান গুরু লাহোর থেকে আসা ওস্তাদ আবদুল ওয়াহিদ খাঁর কাছে। এখানে তিনি ভারি মন লাগিয়ে শিখলেন খেয়াল ও ধ্রুপদ। লখনৌয়ে নিজেকে তিনি পুরোপুরি ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের পেশাদার শিল্পী হিসেবে উপস্থাপিত করতে চাইলেন এবং তাতে খুব ভালোভাবেই সফল হলেন। এরপর তিনি বিরতিহীন অংশ নিতে শুরু করলেন সংগীত সম্মেলন, পাবলিক কনসার্ট, মেহফিল ও মুজরোয়। নবাব-রাজা-জমিদার-শ্রেষ্ঠীর ‘হাভেলি’ ও ‘দরবারে’ সংগীত পরিবেশনও            নিত্য-নিয়মিত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে লখনৌ ছাড়িয়ে তাঁর ডাক আসতে থাকলো দেশের নানা প্রান্ত থেকে। সাধারণের জন্যে দুর্ভেদ্য সামন্তশ্রেণির ‘হাভেলি’ ও ‘দরবার’ শুধু নয়, – সংগীত সম্মেলন ও পাবলিক কনসার্টের মাধ্যমে তিনি পৌঁছে গেলেন সংগীতমনস্ক আমজনতার কাছে – বৃত্তাবদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে আখতারি বাই হয়ে উঠলেন সর্বজনীন এক শিল্পী।

১৯৪২ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যে কোনো এক সময়ে দুই হাজার টাকা মাসোহারায় আখতারি রামপুরের নবাব সংগীতরসিক রাজা আলি খানের সভাগায়িকা নিযুক্ত হন। এর আগে তিনি হায়দরাবাদের নবাব বাহাদুরের আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানেও কিছু সময় কাটান। এতো খ্যাতি-যশ অর্থ-প্রতিপত্তি এসব প্রাপ্তির মধ্যেও কোথাও যেন একটা নিঃসঙ্গতা-হতাশা-বিষাদ তাঁর মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। এসব থেকে মুক্তি পেতেই অথবা ভুলে থাকতে তিনি নিয়মিত সুরাপান ও সেইসঙ্গে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কখনো কখনো তাঁর এই পানাকাঙ্ক্ষা মাত্রা ছাড়িয়ে যেতো। বোঝা যায়, অপ্রাপ্তির বেদনা আর শূন্যতার হাহাকার তাঁর জীবনে কতো তীব্র হয়ে উঠেছিল।

 

এগারো

তাঁর অপরিসীম মানসিক অবসাদের কালে আখতারি অনেকটা হঠাৎ করেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ এর আগে তাঁর গানের স্বার্থেই অনেক নবাব-রইসের বিয়ের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দেন। এমনকি রামপুরের নবাব রাজা আলি খান তাঁর প্রতি এতোটাই দুর্বল হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁকে বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করেন, কিন্তু আখতারি রাজি হননি। শেষতক আখতারি নিজের গরজে অন্যের মাধ্যমে তদবির করে আর-কখনো গান না-গাওয়ার শর্ত মাথায় নিয়ে কাকোরির নবাব ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ আববাসির সঙ্গে পরিণীতা হন। ব্যারিস্টার আববাসি ছিলেন শরিফ খানদানের সুদর্শন, রুচিশীল, সংস্কৃতিবান ও সৌজন্যশাসিত মানুষ। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও বিয়ের কাবিনে স্ত্রীর সংগীতচর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞার শর্ত চাপিয়ে দেন। আখতারিও তা মেনে নেন, কেননা তারও মন যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে একটি সুখের সংসার, মধুময় দাম্পত্যজীবন ও সামাজিক মর্যাদা চেয়েছিল। এইভাবে তাঁর সারাজীবনের সাধনার ধন সংগীতকে বিসর্জন দিয়ে তিনি বাই থেকে বেগম হলেন – আখতারি বাই ফৈজাবাদি রূপান্তরিত হলেন বেগম আখতারে। বনের মুক্ত গানের পাখি বন্দি হলো সোনার খাঁচায়। আববাসি-আখতারের দাম্পত্যজীবন বাইরে থেকে দেখলে সুখেরই ছিল বলে মনে হবে। আববাসি নবাবি-কেতায় বেগমের সবরকমের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করলেন এবং রইস-পরিবারের আচার-আচরণে অভ্যস্ত করে তুললেন তাঁকে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৪ – প্রায় তিরিশ বছর তাঁদের দাম্পত্যজীবনের কাল। গান বন্ধ – কোনো সন্তান হয়নি, শুধু এই বিত্ত-বৈভবের আর শরাফতির সামন্ত-জৌলুশের ভেতর বেগম কতোটুকু ভালো ছিলেন! এ-নিয়ে বেগম কোনো অনুযোগ কখনো কোনো নিকটজনের কাছেও করেননি। সুরাপান ও ধূমপানের পুরনো অভ্যাস আবার ফিরে আসে – কখনো বাড়াবাড়ি রকমে। ভেতরে ভেতরে বেগম হয়তো নিঃশব্দে ভাঙ্ছেন – চোখের সামনে দেখছেন প্রিয় তানপুরায় ধুলো জমেছে – এ-যেনো পানাসক্ত কারো সামনে মদিরার পূর্ণ পাত্র, কিন্তু পান করা তো দূরে থাক, স্পর্শেরও হুকুম নেই। অর্ধযুগ এইভাবে কাটলো – তারপর ১৯৫১-তে তাঁর জীবনসর্বস্ব মা মুশতারি বাই চলে গেলেন। এই ঘটনা বেগমের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আসলে মা মুশতারিই তো তাঁকে পক্ষিমাতার মতো আগলে রেখে শতসংকটেও রক্ষা করেছেন – গানের জগতে প্রতিষ্ঠার জন্যে সম্ভব-অসম্ভব সবকিছুই করেছেন। সেই মায়ের মৃত্যু তাঁকে উদ্ভ্রান্ত-শোকব্যাকুল করে তোলে। তাঁর মানসিক বৈকল্যের আশঙ্কার কথা চিন্তা করে চিকিৎসক ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা নবাব আববাসিকে অনুরোধ করেন বেগমকে গানের জগতে ফেরার অনুমতি দেওয়ার জন্যে – লখনৌ বেতারের আধিকারিকেরা তো আগেই আরজি পেশ করেছিলেন এই বিষয়ে। সহৃদয় স্বামী বাস্তবতার আলোকে সবকিছু উপলব্ধি করে তাঁদের প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। শুধু তাই নয়, এরপরে তিনি সবরকমের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণাও জোগাতে এগিয়ে আসেন। বেগম আখতার দীর্ঘ বিরতির পর আবার গানে ফিরলেন।

 

বারো

পঞ্চাশের দশকের প্রায় গোড়াতেই সংগীতে বেগম আখতারের রাজকীয় প্রত্যাবর্তন এক স্মরণীয় ঘটনা হয়ে রইলো। স্বাগত জানালেন বেগমভক্ত সংগীতানুরাগীরা। এ-হলো বেগম আখতারের সংগীতজীবনের তৃতীয় বা শেষপর্ব। তানপুরার ছেঁড়া তার আবার বাঁধা হলো। সুরে সুরে ভরিয়ে দিলেন ভুবন। আবার বেতারে গাইতে শুরু করলেন – রেকর্ডের পর রেকর্ড বের হতে লাগলো মেগাফোন-এইচএমভি থেকে – দেশের সব প্রান্তে মিউজিক কনফারেন্স-পাবলিক কনসার্ট-মেহফিলে গান গেয়ে মুগ্ধ-অভিভূত করে তুললেন মানুষকে – গানের পাখি উড়াল দিলো দেশ ছাড়িয়ে পাকিস্তানের করাচি, আফগানিস্তানের কাবুল, আবার আরো দূরে সোভিয়েত রাশিয়ায়। বিশ্রাম নেই – বিরতিহীন গান গেয়ে চলেছেন। শরীর ও মনের সব অ-সুখের শুশ্রূষা এই গান – এই গানই তাঁর জীবন, এই গানই তাঁর মরণ। কল্লোলিত নদীর মতো দর্শকশ্রোতাদের সুরের তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। মৃত্যুর সাত-আট বছর আগে থেকেই শরীর বেশ খারাপ হতে থাকে – ১৯৬১-তে প্রথম হৃদ্যন্ত্রের বৈকল্য জানান দেয়। তাঁর বিশ্রাম দরকার – প্রিয়জনদের এই পরামর্শ উপেক্ষা করে বেগম আরো বেশি গানের ভুবনে মগ্ন হন – অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠানে ব্যস্ত সময় কাটাতে শুরু করেন। চারণের মতো গান গেয়ে ফিরতে থাকেন দেশে-বিদেশে। নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার নেশায় তিনি মজে ওঠেন। ১৯৭৪-এর অক্টোবর মাস – ২২ তারিখে অল ইন্ডিয়া রেডিও আহমেদাবাদ কেন্দ্র বেগম আখতারের রেডিও সংগীত সম্মেলনের পরিবেশনা সরাসরি সম্প্রচার করে – এই অনুষ্ঠানে তাঁর শেষ গজলটি ছিল – ‘ম্যায় ধুঁঢ্তা হুঁ জিসে ওহ্ ইহাঁ নহি মিলতা’। ওই মাসেরই ২৬ তারিখে স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে তিনি আহমেদাবাদেই এক পাবলিক কনসার্টে সংগীত পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেন। অসুস্থ শরীরে তিনি সবটুকু দরদ ঢেলে একের পর এক গজল-দাদরা-ঠুমরি গেয়ে চলেছেন। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি এসে গান থেমে গেলো – হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মঞ্চেই অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। তাঁর অসমাপ্ত শেষ গানটি ছিল শাকিল বদায়্যুনির সেই চিরায়ত আবেদনের গজল – ‘আয়ে মোহাববত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া’। জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের শেষে চারদিন পর ৩০ অক্টোবর তিনি চলে গেলেন। পরদিন লখনৌয়ের পসন্দ্ বাগে মা মুশতারি বাইয়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁকে যেখানে দাফন করা হয় সেই মনোরম প্রশস্ত স্থানটি আগে পুরোপুরিই উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু পরে অবৈধ স্থাপনার দেয়াল তাঁর সমাধিসৌধটি ঘিরে ফেলে। এখানেই অনাদরে-অবহেলায় শুয়ে আছেন ‘মালিকা-এ-গজল’ আখতারি বাই ফৈজাবাদি ওরফে বেগম আখতার – হয়তো বহুদূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে তাঁরই কণ্ঠে প্রিয়তম কবি মির্জা আসাদুল্লাহ্ খাঁ গালিবের গজলের সুর : ‘ইয়ে ন থি হামারি কিসমৎ…’।

 

স্বীকৃতি :

বেগম আখতার সম্পর্কে এ-পর্যন্ত যেসব বইপত্র বা প্রবন্ধ-নিবন্ধ-স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি-ত্রুটি-ভুল-অসংগতিমুক্ত নয়। কেউ কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা কাহিনি পরিবেশন করেছেন। সাল-তারিখ, ঘটনা-বিবরণ, নাম-ধাম একটার সঙ্গে একটা মেলে না। খোদ মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি বেগম আখতারের যে সিডি-অ্যালবাম বের করেছে, তাতে শিল্পী-পরিচিতির অংশেও ভুল বের করা কঠিন হয় না। আর যাঁরা বেগমের জীবনী লিখেছেন, তাঁদের কেউ কেউ বেগম আখতারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সম্পর্ক ছিল পারিবারিক পর্যায়ে, এক-দুজন আবার গানের সূত্রেও কাছের মানুষ ছিলেন – শিষ্যস্থানীয়া তাঁরা। শিল্পী যখন বেঁচে ছিলেন, এঁরা তাঁকে দিয়ে স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখাতে পারতেন – বড়ো করে সাক্ষাৎকার গ্রহণেরও সুযোগ ছিল – কিংবা  তাঁর কাছ থেকে শুনে তাঁর জীবনীর উপকরণ সংগ্রহ তাঁদের পক্ষে কঠিন ছিল না। কেউ হয়তো করেছেন, কিন্তু সেই চেষ্টা প্রশংসনীয় হলেও তা যে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে, সে-কথা বলা যায় না। তাই এখন বেগম আখতারের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর একটি প্রামাণ্য জীবনী রচনা ও প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া অতি জরুরি।

 

বর্তমান রচনায় যেসব বই-পত্রিকার সহায়তা নেওয়া হয়েছে তার বিবরণ এইরকম : জাতিস্মরের শিল্পলোক, পঞ্চবর্ষী (আনন্দধারা, কলকাতা, ১৩৭০), তহজীব-এ-মৌসিকী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ (বাউলমন প্রকাশন, কলকাতা, অগ্রহায়ণ ১৪০১), রাগ-অনুরাগ, রবিশঙ্কর (আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, ডিসেম্বর ১৯৯৯), বাঙালির কলের গান, আবুল আহসান চৌধুরী (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, নভেম্বর ২০১২), Begum Akhtar : The Queen of Ghazal, Sutapa Mukherjee (Rupa & Co., New Delhi, 2003), Begum Akhtar : The Story of My Ammi, Shanti Hiranand (Viva Books Pvt. Ltd., New Delhi, 2005), Ae Mohabbat… Reminiscing Begum Akhtar, Rita Ganguly (Stellar Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 2008), Begum Akhtar : Love’s Own Voice, S. Kalidas (Roli Books, New Delhi, 2009)’, আনন্দবাজার পত্রিকা (দৈনিক, কলকাতা, ১১ অক্টোবর ২০১৪), The Statesman (Daily, Kolkata, 7 October 2014)। ব্যক্তিঋণ : অমলকুমার ঘোষ (মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি, কলকাতা), অমিত গুহ (সূরাজ-শ্রুতি সদন, কলকাতা), সলিল চক্রবর্তী (কলকাতা), দেবযানী চলিহা (মৈতৈ জগোই, কলকাতা), সুদীপ বিশ্বাস (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা), অনুপম হায়াৎ (ঢাকা), লালিম হক (কুষ্টিয়া) ও শহীদুল ইসলাম (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া)।