বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভাল

একজন মুগ্ধ শ্রোতার অনুভূতি
সুরাইয়া বেগম
দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা এবং প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে ২৭ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর ২০১৫ অর্থাৎ পাঁচদিন ধরে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে চতুর্থবারের মতো মহাসংগীতযজ্ঞের আয়োজন করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। ভরতনাট্যম দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু এবং শেষ হয় বিখ্যাত ওস্তাদ হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার প্রাণস্পর্শী বাঁশির সুরের সম্মোহনের মধ্য দিয়ে। মাঝে বেজেছে তরঙ্গ তোলা তবলার বোল, ঘটমের আকর্ষণীয় শব্দতরঙ্গ, সন্তুর, সেতার, বেহালা এবং সরস্বতী বীণার স্নিগ্ধ সুরধ্বনি। আমাদের দেশের উচ্চাঙ্গসংগীতের বিস্মৃত গৌরবময় অধ্যায়টির পুনর্জন্ম দিয়েছে এই মহার্ঘ্য উৎসবটি। সুন্দরের সংগীতের প্রোজ্জ্বল আভায় উদ্ভাসিত ছিল পাঁচটি সন্ধ্যা, রাত ও ভোর।
এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর উদ্দেশে, যিনি গতবছর এই অনুষ্ঠান থেকেই অমৃতলোকে যাত্রা করেছিলেন। উৎসবের চতুর্থ দিন শিল্পীর স্মরণে ‘নিসর্গের আঁকিয়ে’ শীর্ষক একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। প্রয়াত এই শিল্পীর প্রতি মর্যাদায় উৎসব প্রাঙ্গণে তাঁর স্থিরচিত্র সমভিব্যহারে সাজানো হয়েছিল, যা ছিল যোগ্য শিল্পীর প্রতি আমত্মরিক সম্মাননাজ্ঞাপন।
উচ্চাঙ্গসংগীতের এই অনুপম অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এবং নিবেদক স্কয়ার। এবারের আসরে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের দেড় শতাধিক শিল্পী, যাঁদের প্রায় সকলেরই মুখে উচ্চারিত হয়েছে যে, ব্যাপ্তি এবং দর্শকের বিচারে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর। এ-আসর সজ্জিত হয়েছে দেশের অঙ্কুর ও নবীন শাস্ত্রীয়সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে উপমহাদেশের প–ত, গুরু ও বিদুষীদের মনোহরণকারী অনবদ্য পরিবেশনা দিয়ে। আমরা সেই দিনের প্রত্যাশায় উন্মুখ, যেদিন দেশের শিল্পীদের উচ্চাঙ্গসংগীত সারারাত ধরে শোনার জন্য এমনিতর দর্শক স্টেডিয়ামে জড়ো হবে। বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা শুভারম্ভের যে-নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, তাতে আমরা বলতেই পারি যে, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়…।
এ-উৎসবটা আমাদের দেশের উচ্চাঙ্গসংগীতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে শাস্ত্রীয়সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হবে।
প্রতিদিনই অনন্য শিল্পীদের অনবদ্য পরিবেশনার মধ্যেও কোনো কোনো শিল্পী একটু বেশি মন ভরিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে বেঙ্গলের অনুষ্ঠানে একাধিকবার এসেছেন এবং প্রথম এসেছেন গান শোনাতে এমন শিল্পী – সবই ছিল।

প্রথম দিন
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন দেশে শুদ্ধ সংগীতচর্চার জন্যে সম্ভাবনাময় শিশু ও তরুণদের নিয়ে গত বছর বেঙ্গল পরম্পরা নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যেখানে উপমহাদেশের স্বনামধন্য সংগীতগুরুদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষাদান করা হয়। এটি যে কত বড় একটা কাজ এবং এর ব্যাপ্তি যে কত গভীর তা সময় বলে দেবে। আমরা তার কিছু নমুনা দেখেছি উৎসবের প্রথম দিন। সেদিন বেঙ্গল পরম্পরার তবলা কীর্তন ছিল আকর্ষণীয় এবং সম্ভাবনাময়। বিশেষ করে ফাহমিদা নাজনীন ও নূসরাত-ই-জাহানের তবলাবাদন আমাদের আশান্বিত করে।
জয়াপ্রদা রামামূর্তি মন ভরিয়েছেন সুরেলা বাঁশির সুরে। সাধারণত পুরুষরাই পাবলিক মঞ্চে বাঁশিতে সুর ছড়িয়ে দেন, জয়াপ্রদা সেখানে ঝড় তুলে দিয়েছেন সবার মনে। আহির ভৈরব, হংসধ্বনি আর হিন্দোলম-রাগাশ্রিত বাঁশির সুরে জয় করে নেন সুরপিপাসুদের হৃদয়। কর্ণাটক ঘরানার পাশাপাশি বাংলায় ‘এসো শ্যামলসুন্দর’ রবীন্দ্রসংগীতের সুর তুলে আরো একবার জয় করে নেন সংগীতানুরাগীদের মুগ্ধতার আবেশসমৃদ্ধ করতালি।
গতবারের তুলনায় এবার কৌশিকী চক্রবর্তীর পরিবেশনায় গভীরতা ছিল। কৌশিকীর একটা বড় গুণ, তিনি দর্শকদের সঙ্গে খুব সুন্দর করে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন, যা সুরের আবেশের সঙ্গে বাড়তি কিছু যোগ করে দর্শককে মুগ্ধ করে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি ইন্টারঅ্যাকশন না করেও কুশল দাস তাঁর অনবদ্য সেতারের সুরের মোহজালে দর্শকদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন অজানা সমুদ্রবন্দরে। বিদুষী বোম্বে জয়শ্রীর অনবদ্য ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে ভোরের মেজাজের সঙ্গে কর্ণাটকি সংগীতের পরিবেশনা শ্রোতাদের আবিষ্ট করেছে। সেই আবেশ সঙ্গে নিয়েই সারাদিন কেটেছে পুনরায় সন্ধেবেলা সংগীতের আসরে পদার্পণের উন্মুখ আকাঙক্ষায়।

দ্বিতীয় দিন
ড. জয়মত্মী কুমারেশ তাঁর সরস্বতী বীণার ইন্দ্রজালে আর্মি স্টেডিয়ামের সব দর্শকের মন দুলিয়ে দিয়েছিলেন এপার থেকে ওপারে, সাক্ষাৎ সরস্বতী ভর করেছিলেন জয়মত্মীর হাতের আঙুলে। সুরের কোন স্তরে যে মন চলে গিয়েছিল! সরস্বতী বীণা বাদ্যযন্ত্রটির সুরের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয় সবাই, কিন্তু জয়মত্মী কুমারেশ আমাদের যন্ত্রটি চেনালেন এবং বীণার সুরে মোহাচ্ছন্ন করে রাখলেন তাঁর জন্য বরাদ্দ সময়টুকুতে। বীণার তারে-তারে সাবলীলভাবে ঘুরে বেড়াল তাঁর কোমল আঙুল, আর ঝরে পড়ল সুরের ঝরনাধারা। সেখানে দর্শক আশেস্নষে অবগাহন করে মন্দ্রিত হলেন।
৮৫ বছরের প্রবীণ খ্যাতিমান কর্ণাটকি কণ্ঠশিল্পী পদ্মবিভূষণ বালমুরালীকৃষ্ণ আমাদের জানিয়ে দেন, সংগীতের প্রতি কি গভীর প্রেমে তিনি নিমগ্ন, যা আমাদের চৈতন্যে শিস দিয়ে যায়। তাঁর সঙ্গে যুগলবন্দিতে রনু মজুমদার তাঁর নিজস্বতাকে চিনিয়ে দেন। দ্বিতীয় দিনের শেষ শিল্পী প–ত অজয় চক্রবর্তী চতুর্থবারের মতো দর্শক হৃদয় জয় করে নিয়েছেন তাঁর মোহাচ্ছন্নকারী খেয়াল পরিবেশনের মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে শেষ পরিবেশনা রাগপ্রধান বাংলা গানের মাধ্যমে।

তৃতীয় দিন
বিশ্ববরেণ্য ধ্রম্নপদী শিল্পীদের পাশাপাশি আমাদের দেশের শিল্পীরাও যে পারদর্শী এবং সংস্কৃতিমনস্ক, তার প্রমাণ রাখলেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাব ও তার ট্রুপ মণিপুরি নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। অনবদ্য নৃত্যশৈলীতে প্রস্ফুটিত হয়েছে দলীয় নৃত্য ও একক নৃত্যের ছন্দোময় উপস্থাপনা। ওয়ার্দার দল পরিবেশন করে মণিপুরি নৃত্যালেখ্য – ‘লেই চান’, ‘কথক চাবা’, ‘বসমত্ম’, ‘গোষ্ঠক্রীড়া’ ও ‘জয় জয় দেবা’। পোশাক ও দলীয় সুসংবদ্ধ উপস্থাপনা জানান দেয়, এদেশে ধ্রম্নপদী নৃত্যগীত সামনে আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে। ‘লেই চান’ পরিচালনা করেন ভারতের প্রথিতযশা মণিপুরি নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক বিম্বাবতী দেবী।
এরপর বেহালার সুরে দর্শককুলকে বিমোহিত করেন তিন প্রজন্মের চার শিল্পীর মধ্যমণি ড. এন রাজম। মেয়ে সঙ্গীতা শংকর এবং দুই নাতনি রাগিণী শংকর ও নন্দিনী শংকরকে নিয়ে এন রাজম বেহালার ছড়ের টানে সুরসাগরে ভাসান দর্শককে। তাঁরা পরিবেশন করেন রাগেশ্বরী রাগ এবং বানারসি ঠুমরি। পরিবেশনার মাঝ পর্যায়ে এন রাজম একই রাগ কণ্ঠে এবং বেহালায় কেমন সুর তোলে তা করে দেখান। দক্ষতার উৎকর্ষ কোন পর্যায়ে পৌঁছলে এটা সম্ভব, তা আমাদের জানিয়ে দেন। ভালো লেগেছে বিভিন্ন শিল্পী বাংলাদেশকে সম্মান জানিয়ে বাংলা গান বাজিয়ে এবং গেয়ে শোনানোর চেষ্টা করেছেন। এন রাজম ‘ব্রজগোপী খেলে হোলি’ গানটি বাজিয়ে শুনিয়েছেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠান যে উচ্চমার্গীয়, এবং তা যে আনুগত্যের দাবি রাখে – শিল্পীদের বাংলা গান নির্বাচনে তা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
কর্ণাটকি মৃদঙ্গম শিল্পী কড়াইকুড়ি মুনি মৃদঙ্গম বাজিয়ে দর্শকদের মন জয় করে নেন। বিদুষী শুভা মুডগালের জলদ-স্বরে খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা পরিবেশন রাতের শেষ প্রহরে উন্মাদনার তরঙ্গে দোলায়িত করেছে আমাদের মন, অমত্মর এবং শ্রোতা পান করেছেন আকণ্ঠ-গীত সুধারস। মনকে যা ভরিয়ে দিয়েছে পরিপূর্ণতায়। রাতের আকাশ রণিত হয়েছে বিদুষী শুভার কণ্ঠের মধুরতায়।

চতুর্থ দিন
চতুর্থ দিনটি ছিল একেবারেই যেন প্রথমবারের মতো উৎসবে যোগদানকারী উস্তাদ জাকির হোসেনের দিন। তবলার বুকে বোল তুলল ঘূর্ণির বেগে তাঁর হাতের দশটি আঙুল। এতটাই বেগ যে, তাঁর আঙুল দৃশ্যমান ছিল না। সেইসঙ্গে সমানতালে মুগ্ধ করেছে তার কথার বোল, যা রসবোধের উচ্চমার্গীয় স্তরে নিয়ে যায়। অদ্ভুত ছিল প্রাকৃতিক উপমার সঙ্গে তার তবলার বোলের সংগত। বৃষ্টির টুপটাপ, অঝোরধারার বর্ষণ এবং মেঘের গুরুগম্ভীর মন্দ্রিত আবহ কি অবলীলায় তবলায় তুলে নিয়ে এলেন তিনি। আমরা মুগ্ধবিস্ময়ে শুনে গেলাম সেই অপূর্ব বোল। তবে তৃপ্ত হয়নি মন। আরো শুনতে চেয়েছে কিন্তু সময় যে বাঁধা। মনের গহিনের অতৃপ্ত কাউন্টডাউন শুরু করেছে আগামী বছরের জন্যে। ক্লাসিক্যাল মিউজিক যে কত মধুর – ইনস্ট্রুমেন্ট আর কণ্ঠ উভয়ের ক্ষেত্রে – তা আমাদের অনুভূতিতে প্রোথিত করে দিয়ে গেল এ-উৎসব। সন্তুর নিয়ে এবারো শিবকুমার শর্মা শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। শিবকুমার ব্যক্ত করেন যে, সুর তাঁর কাছে বিনোদনের চেয়েও বেশি কিছু, সুর হচ্ছে শামিত্ম। এই সুর আমাদের এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়, যেখানে শুধু আনন্দই থাকে না, থাকে তার চেয়েও গভীর কোনো অনুভূতি। একথা যে কতটা গভীর সত্য বহন করে, তা উৎসবে আসা অনেকেই অনুধাবন করেছেন। সুর আমাদের নিয়ে গেছে এক অতীন্দ্রিয় জগতে, যেখানে সাংসারিক জগতের যাবতীয় কিছু বিলীন হয়ে যায়; শুধু বিরাজ
করে আকাশের মতো প্রসারতা, রাতের গভীরতা। যেখানে শুধুই অবগাহন করা যায়, আর কিছু নয়। যা গড়ে দেয় মানুষে-মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন। এদেশে নতুন প্রজন্মের মাঝে সুরের এই নতুন যন্ত্র পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন গত বছর, আর এ-বছর অনুরাগী সৃষ্টি করে দিয়ে গেলেন। শুভ্রতার প্রতীক হয়ে তিনি সবটুকু উজাড় করে রাঙিয়ে দিয়ে গেলেন এ-উৎসব। যোগ কোষ দিয়ে শুরু করে আলাপ, জোড় আলাপ, ঝালা, রূপক ও তিন তালের কম্পোজিশন ছিল তাঁর পরিবেশনায়।
গুরু রাজা ও রাধা রেড্ডির যুগল উপস্থাপনা ছিল কুচিপুরি নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে। তাঁরা পরিবেশন করেন গণপতি বন্দনা, শিবাতা-ব, কৃষ্ণ কালিঙ্গা নর্তনাম ও নটবর তরণী তরঙ্গম। তাঁদের সহযোগিতা করেন ভাবনা রেড্ডি ও ইয়ামিনি রেড্ডি। তাঁদের পরিবেশনা এবং আলারমেল ভালিস্নর পরিবেশনা আমাদের জানিয়ে দেয়, নৃত্যে আমরা কোথায় অবস্থান করছি আর আমাদের কোথায় যেতে হবে। নাচে তাঁদের সহায়তা করেছেন কণ্ঠশিল্পীরা, যা একটি পূর্ণাঙ্গ দল সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে।
সরোদে তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রাখেন। উস্তাদ জাকির হোসেন বাজানোর পর প–ত উলহাস কশলকরের পরিবেশনা দর্শকনন্দিত হতে পারেনি গতিময়তার কারণে। জাকির হোসেন দর্শকদের যে উত্তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তারপর দর্শকদের সেখান থেকে নেমে আসায় অনীহা ছিল। অথচ উলহাস কশলকরের গোয়ালিয়র, আগ্রা ও জয়পুর ঘরানার গায়কি এবং অনবদ্য কণ্ঠ ছিল মুগ্ধ করার মতো।

পঞ্চম দিন
পাঁচদিনের অনুষ্ঠানের শেষ বাঁশি বাজালেন প–ত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, যিনি বাঁশিকে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। এসব উচ্চমার্গের শিল্পী যখন কোনো কিছু পরিবেশন করেন, তখন মনে হয় যেন তাঁরা নিবেদন করছেন নিজেকে সুরের কাছে। মগ্নতায় আবিষ্ট হয়ে যেতে হয়। শিল্পী এবং রসপিপাসু শ্রোতার মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি হয়, ঈশ্বরের প্রতি নিবেদনের চিত্র মূর্ত হয়ে ওঠে। প–ত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া মাত্র আট বছর বয়সে বাঁশি হাতে তুলে নেন, আজো তা সচল আছে।
শেষদিন মঞ্চে আবির্ভূত হন ওস্তাদ রশিদ খান। যাঁদের কণ্ঠের জাদুর কথা এযাবৎকাল শুনে এসেছি, তাঁদের সামনাসামনি বসে গাইতে দেখতে পাওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার, দৃশ্যমানতা অনুপ্রাণিত হতে সাহায্য করে। রশিদ খানসহ অন্যদের দেখা এবং সারারাত জেগে তাঁদের গান শোনা – এর আমেজ, এর বৈভব, এর অমত্মর্গত গভীরতাই আলাদা। যে কখনো এই উৎসবে যেতে পারেনি সে বুঝতেই পারবে না এই মহার্ঘ পাঁচটি রাতে কী অমিত সুধারসে নিজেদের রঞ্জিত করে নিয়েছিলাম।
উৎসবে শ্রোতাদের মধ্যে তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল নজরকাড়া। আয়োজকদের নান্দনিক উপস্থাপনা আমাদের প্রাণিত করে যে, আমাদের মেধা এবং যোগ্যতা আছে এই ধরনের আমত্মর্জাতিক মানের অনুষ্ঠান আয়োজনের। এত সুশৃঙ্খল এই বিপুল আয়োজন যে, উপস্থিত না থাকলে জানা যাবে না। মাঠের মাঝখানে চাঁদোয়ার নিচে মায়াময় আলোকসজ্জাশোভিত পরিমিত উচ্চতার বিশাল মঞ্চ। তাতে সংগীতের ভাবের সঙ্গে সংগতি রেখে আলোর প্রক্ষেপণ। মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে সুর ও নৃত্যের সঙ্গে নান্দনিক দৃশ্যের উপস্থাপনা সেইসঙ্গে অনুপম শব্দ-সঞ্চালন। মাঠের বিভিন্ন পাশে গুণী শিল্পীদের পরিচিতিমূলক কর্নার, প্রবেশপথে গত আসরের শিল্পীদের আলোকচিত্র। খাবারের আয়োজন, ক্লাসরুমের টেবিল-চেয়ার দিয়ে মাঠে বসে গান শোনা মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আমরা এখনো সুরের ছাত্রছাত্রী।
দেশের বিদ্যমান নানা অসহিষ্ণুতা এবং অসুরের প্রতিবাদে সুরের মোহনবাঁশি অব্যাহত রেখেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। ধ্রম্নপদী সংগীতাসরটি পরিণত হয়েছিল সুররসিকদের প্রাণের মিলনমেলায়। নির্ঘুম রাত-জাগানিয়া উৎসবে মগ্ন থেকেছে হাজার হাজার
নারী-পুরুষ। বয়সের সীমারেখা এখানে একাকার হয়েছিল। শ্মশ্রম্নম–ত প্রবীণ সুরের মগ্নতায় নিমজ্জিত – এ-দৃশ্য বিরল ছিল না। হালকা শীতের আমেজ ছিল শেষ রাতের দিকে। তাতে দর্শকরা আরো উজ্জীবিত হয়েছেন ধূমায়িত চা-কফির সঙ্গে সুর, তাল এবং গায়কি সুধা পানে।
সুর মানুষকে অসুরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে,
মানুষের মধ্যে কোমলতা, সহৃদয়তা, উদারতা বাড়িয়ে দেয় এবং ভালোবাসায় রাঙিয়ে তোলে মন, যার প্রকাশ আমরা দেখেছি উৎসবস্থলে। এই ভালোবাসাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবনকে রসময় করে তোলে। আমরা বেঁচে থাকার উপকরণ পাই। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন হচ্ছে সেই জিয়নকাঠি, যা আমাদের আরো একটা বছর বেঁচে থাকতে সহায়তা করে আবার উৎসবে যাওয়ার আনন্দে উজ্জীবিত হয়ে ওঠার জন্যে। এ-উৎসব আমাদের। একে ধরে রাখতে হবে।