বেঙ্গল সংগীত উৎসব রেনেসাঁসের পদধ্বনি

গোলাম মুস্তাফা

এবারের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব চললো পাঁচ রাত ধরে, ২৭ নভেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত, গত দুবারের মতোই বনানীর সেনা স্টেডিয়ামে। অনুষ্ঠানের সবকিছু সুচারুরূপেই সম্পন্ন হয়েছে। তবু এই উৎসবের মধ্যেও বিষাদ ঘনিয়ে এসেছিল শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে। চতুর্থ রজনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মঞ্চের ওপরই আকস্মিকভাবে লুটিয়ে পড়লেন সংগীতরসিক এই শিল্পী। কিন্তু এই শোকাবহ ঘটনার পরেও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়নি। এরকম মহা-আয়োজন তাঁর কারণে বন্ধ হয়ে যাবে – এটা কাইয়ুম চৌধুরীও চাইতেন না।

গত দুবছর সংগীত উৎসব চলেছে চার রাত্রি ধরে। এবার উদ্যোক্তারা আগেই ঘোষণা করেছিলেন অনুষ্ঠান চলবে পাঁচ রাতজুড়ে। এই ঘোষণায় সংগীতপিপাসুরা উল্লসিত হয়েছিলেন। পাঁচ রাত ধরে সংগীত উপভোগ করা শরীরে সইবে কি না – এই শঙ্কা যে কারো মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু বছরে একবারই তো এরকম সুযোগ মেলে – এই কথা ভেবে সবাই এই আয়োজন খুশিমনেই মেনে নিয়েছেন। এ-বছরের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের উদ্দেশে। পাঁচ রাতের এই আয়োজনে স্মরণ করা হয়েছে প্রয়াত শিল্পী ফিরোজা বেগম, রামকানাই দাস ও সুবীর চৌধুরীকে।

২৭ নভেম্বর সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় শুরু হলো স্কয়ার-নিবেদিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৪। প্রথম বছর বেঙ্গল ফাউন্ডেশন একক উদ্যোগেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। গত বছর থেকে স্কয়ার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকও সহযোগিতা করেছে এ-আয়োজনে। প্রথম রাতের অনুষ্ঠান শুরু হলো তিনটি সমবেত গান দিয়ে। প্রথমে শিল্পীরা গাইলেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, এরপর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গাওয়া হলো, সবশেষে পরিবেশিত হলো কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’। অনুষ্ঠানের ঘোষিকা তিনটি গানকেই বাংলা গান বলে উল্লেখ করলেন। কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা’ যে নিছক রবীন্দ্রনাথের গান নয়, এটি আমাদের জাতীয় সংগীতও – এই তথ্যটি উল্লেখ করা উচিত ছিল। অবশ্য শ্রোতারা জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিতে ভুল করেননি, পরিবেশিত হওয়ার সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে যথাযথ সম্মান জানিয়েছেন। জাতীয় সংগীতসহ তিনটি গান পরিবেশন করেছেন সুবীর নন্দী, ফরিদা পারভিন, ইয়াসমিন মুশতারী, ইফ্ফাত আরা দেওয়ান, শাহীন সামাদ, মিতা হক,&ফাতেমা তুজ জোহরা, অদিতি মহসিন, বুলবুল ইসলাম, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, কিরণচন্দ্র রায়, লাইসা আহমদ লিসা, শারমিন সাথী, চন্দনা মজুমদার ও শামা রহমানের মতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা।

সমবেত সংগীতের পর মঞ্চে এলেন তরুণ তবলাবাদক আজিংক্য যোশী। সাত বছর বয়স থেকেই পন্ডিত সুরেশ তালওয়ালকারের শিষ্য শান্তি শাহের কাছে তাঁর সংগীত-তালিমের শুরু। পরে সুরেশ তালওয়ালকারের কাছেই তবলাবাদনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রায় দশ বছর ধরে। তবলায় পারদর্শিতার জন্য পেয়েছেন বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্কার পুরস্কার। আজিংক্য তিনতালে বেশ কয়েকটি তবলা লহরা পরিবেশন করলেন। দিল্লি ও ফরুখাবাদ ঘরানার কয়েকটি টুকরা, কায়দা, ফরমায়েসি কায়দা ও চক্রধার পরিবেশন করলেন অনবদ্য নৈপুণ্যের সঙ্গে। পিতার রচিত কয়েকটি বোলও বাজিয়ে শোনালেন আজিংক্য। তাঁর সঙ্গে হারমোনিয়ামে সংগত করেন অরুণ ভাদুড়ির সুযোগ্য ছাত্র গৌরব চট্টোপাধ্যায়। গৌরব কণ্ঠসংগীতেরও তালিম নিয়েছেন, প্রথমে তাঁর মা ও পরে আগ্রা ঘরানার ওস্তাদ জয়নুল আবেদিনের কাছে। এবারের উৎসবে বেশ কজনের সঙ্গে সংগত করেন তিনি।

এরপর উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের এই উৎসবকে ঘিরে তাঁর স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতির কথা বললেন :

১৯৪৭ সালের আগে আমাদের এই দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা ছিল। এই উপমহাদেশের অনেক বড় ওস্তাদই এই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছেন, কিন্তু সুযোগের অভাবে তাঁরা চলে গেছেন ভারতে। সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তাঁরা ভারতে নিজেদের সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে পেরেছেন। আমাদের সেই ঐতিহ্য আবার পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এইজন্য চাই বড় আয়োজন। এই চিন্তা থেকেই বেঙ্গল ফাউন্ডেশন উচ্চাঙ্গসংগীতের এই আয়োজন করে চলেছে। বিশ্বের নানা দেশে ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর বসে। কিন্তু শ্রোতাদের আগ্রহ ও সহযোগিতায় এই আসর এখন ভারতীয় সংগীতের বৃহত্তম উৎসবে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে এতজন শিল্পীর পরিবেশনা ও এত দর্শক সমাগম আর কোথাও হয় না। কিন্তু উৎসব অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এই সংগীতে উৎসাহী ও পারদর্শী করে তুলতে হবে। এই ভাবনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়’। পন্ডিত উলহাস কশলকার এই সংগীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছেন। আরো অনেক গুণী শিল্পী আমাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছেন। আমরা আশা করি, আগামী পাঁচ বছর পর রাশিদ খাঁ, উলহাস কশলকারের মতো শিল্পী এদেশে তৈরি হবে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন :

এরকম অনুষ্ঠানে এসে উৎফুল্ল না হয়ে উপায় থাকে না। আমি উচ্চাঙ্গসংগীতের ব্যাকরণ বুঝি না, সুর-তাল সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু শুনে আনন্দ পাই। ১৯৫২-৫৩ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ এসেছিলেন এসএম হলের অনুষ্ঠানে, তিনি অন্যের কাছ থেকে তবলা কেড়ে নিয়ে বাজিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে গুলিস্তানে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। সেই ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সংগীতের সাধনা যত হবে, সংগীতানুরাগী যত বাড়বে তত আমাদের রুচি উন্নত হবে। রুচির উন্নয়ন আজ বড়ো দরকার।

এই সন্ধ্যায় বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ সরণ, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ভরতনাট্যম পরিবেশনের জন্য মঞ্চে এলেন বিদুষী মালবিকা সারুক্কাই। মালবিকা ভরতনাট্যমের এ-কালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরূপে স্বীকৃত। সাত বছর বয়স থেকেই তিনি নৃত্যচর্চা করছেন। তালিম নিয়েছেন তানজাভুর ঘরানার কে. কল্যাণসুন্দরম পিল্লাই ও বাজুভুর ঘরানার এস কে রাজরত্নমের কাছ থেকে। অভিনয়ের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন কলানিধি নারায়ণানের সান্নিধ্যে। কেলুচরণ মহাপাত্র ও রামাণি রাজন জেনার শিষ্যা হিসেবে ওড়িশি নৃত্যেও মালবিকা সমান পারদর্শিতা অর্জন করেছেন।

মালবিকা প্রথমে শিববন্দনা করলেন। নটরাজের উদ্দেশে নিবেদন করলেন ‘নৃত্যাঞ্জলি’। বাঁশির সুরে, শঙ্খ নিনাদে, ফুলের ডালিতে উপচার নিবেদিত হলো নৃত্যরাজের প্রতি। মালবিকার নৃত্যে শুদ্ধতা ছিল। তাঁর ক্ষিপ্রগতির অভিব্যক্তি দর্শকদের মন তৃপ্ত করেছে। নটরাজের প্রতি এই শিল্পীর শ্রদ্ধার কথা সর্বজনবিদিত। ২০১২ সালে তাঁর নৃত্যচর্চার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে অনেকেই একটি জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মালবিকা চলে গেলেন চিদাম্বরমের শিবমন্দিরে। তাঁর পরম আরাধ্য দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে নৃত্য পরিবেশন করলেন নীরবে।

এরপর শিল্পী পরপর দুটি আখ্যান-নৃত্য পরিবেশন করেন। প্রথমে ‘মারীচবধ’। রাম-সীতা-লক্ষ্মণ তখন বনাশ্রিত। বনের স্রোতস্বিনী-ছন্দ পদ্মের সৌরভ ও পাখির কূজন উপভোগ করেই সীতার দিন কাটছিল। একদিন একটি গতিময় সুন্দর সোনালি হরিণ দেখে সীতা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। রামকে বললেন হরিণটির সোনালি চামড়া তাঁকে উপহার দিতে। বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে সীতাকে রক্ষা করার জন্য লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিয়ে রাম তীর-ধনুক নিয়ে বনে গেলেন হরিণবধের উদ্দেশ্যে। শিকারি রামের অনুসন্ধানী ক্ষিপ্রতা এবং ভীরু হরিণের পলায়নপর গতির বৈপরীত্য অসাধারণ নৃত্য-নৈপুণ্যের সঙ্গে রূপায়িত করেছেন মালবিকা। বনমধ্যে নিঃশঙ্ক হরিণের বিচরণ অংশটি ছিল মনোমুগ্ধকর ছন্দোময়। রাম শেষ পর্যন্ত হরিণকে বধ করলেন। কিন্তু শরাঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই হরিণটি লক্ষ্মণের কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল। হরিণটি ছিল ছদ্মবেশী মারীচ। রাম তখন উপলব্ধি করলেন অসুরের মধ্যেও দেবত্ব থাকে, দেবতার মধ্যে অসুরের লক্ষণ দুর্লভ নয়। স্বর্গের দেবতারা তুষ্ট হয়ে, পুষ্পবৃষ্টি করে রামের এই উপলব্ধিকে উদযাপন করলেন। মালবিকা শিল্পের মধ্যে আত্মোপলব্ধির পথ খোঁজেন। তাঁর ভাষায়, ‘শিল্পসাধনায় সিদ্ধিলাভ ঘটে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে। এভাবেই শিল্প আধ্যাত্মিকতায় উন্নীত হয়।’

দ্বিতীয় আখ্যানটি ছিল কৃষ্ণের ননিচুরির গল্প নিয়ে। যশোদা প্রতিবেশী বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফিরে দেখেন বালক কৃষ্ণ বাড়ির সব ননি চুরি করে খেয়ে ফেলেছেন। ননিপাত্রের ভাঙা টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে বাড়িময়। কৃষ্ণের দুরন্তপনায় বিরক্ত যশোদা তাঁকে হামানদিস্তার হামানের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে চাইলেন, কিন্তু কিছুতেই পারছিলেন না। দড়িটি বারবার ছোট হয়ে যাচ্ছিল। এই দৃশ্য দেখে বিষ্ণু স্বয়ং বালকৃষ্ণের রূপ নিলেন। যশোদা অনায়াসে বন্দি করলেন কৃষ্ণকে। যশোদার পুত্রস্নেহ, কৃষ্ণের নিষ্পাপ দুরন্তপনায় তাঁর বিব্রত হওয়া – এর সবটাই মালবিকার সাবলীল ও সমর্থ নৃত্যশৈলীতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই নৃত্যটি পরিবেশিত হয়েছে কর্ণাটি কাপি রাগে। কর্ণাটি কাপির সঙ্গে হিন্দুস্তানি কাফি রাগ ও ঠাটের মিল নেই। সাধারণত বিলম্বিত ও মধ্য লয়ে পরিবেশিত এই রাগে সঞ্চারিত হয় ভক্তি ও করুণ আবহ।

বালমুরালিকৃষ্ণ-রচিত একটি তিল্লানা পরিবেশন করে মালবিকা দর্শকদের প্রায় আপ্লুত করে ফেলেন। তিল্লানা দক্ষিণ ভারতে মধ্যযুগেও প্রচলিত ছিল, এর বর্তমান রূপটি গড়ে ওঠে উনিশ শতকে। পল্লবী, অণুপল্লবী ও চরণমে বিভক্ত এই সংগীতশৈলীটি বাহুল্যহীন ঋজুতার জন্য শ্রোতাদের কাছে প্রিয়। মালবিকার তিল্লানা ছিল আদিতালে রঞ্জাবতী রাগাশ্রিত একটি কৃষ্ণবন্দনা। এদেশের দর্শক-শ্রোতারা কর্ণাটি সংগীত ও নৃত্যের এ-ধারাটির রসাস্বাদন করার সুযোগ পেলেন। সবশেষে পরিবেশিত হলো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরমে’র নৃত্যায়ন।

মালবিকার সঙ্গে বেহালা সংগতে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন কলাই মামণি কন্যাকুমারীর যোগ্য শিষ্যা ভেঙ্কটরামাণি শ্রীলক্ষ্মী। তাঁর বেহালার সুরেলা বাদন মালবিকার নৃত্যকে আরো মনোময় করে তুলেছে। মুরালী পার্থসারথীর কণ্ঠসহযোগও ছিল অসাধারণ। মৃদঙ্গমে বালাজি আজওয়ার ও নাট্টুবঙ্গমে নীলা সুকন্যা শ্রীনিবাসনের সংগতও ছিল মনোমুগ্ধকর। মালবিকার নৃত্য-উপাদানের অনেক কিছুই ভারতীয় পুরাণাশ্রিত। ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর আনুগত্য আছে, তবে তিনি ঐতিহ্যের মধ্যে উদ্ভাবনের আনন্দ খোঁজেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয় নৃত্যের কলাকৌশলের সঙ্গে এদেশের জীবন-দর্শন ও সৌন্দর্যানুভূতির সমন্বয় করাটাই তাঁর লক্ষ্য। প্রথম রাতের পরিবেশনায় মালবিকা ও তাঁর সঙ্গীরা দর্শক-শ্রোতাদের অনাবিল আনন্দ দিয়েছেন – একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

অনুষ্ঠানসূচি-অনুযায়ী এরপরই বিদুষী গিরিজা দেবীর নাম ছিল। কিন্তু তিনি এলেন না। তাঁর অনুপস্থিতির কোনো কারণও জানাননি উদ্যোক্তারা। তবে গিরিজা দেবীর শিষ্যা রুচিরা কেদার এসে শ্রোতাদের খেদ অনেকটাই মিটিয়ে দিলেন। জয়পুর আতারাউলি ঘরানার এই নবীন শিল্পীর সংগীত-তালিমের সূচনা তাঁর পিতা দিলীপ কালের কাছে। জয়পুর আতারাউলি ঘরানার অলকা দেও মারুকার রুচিরার মধ্যে সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে তাঁকে নিজ ঘরানার সাংগীতিক ঐতিহ্যানুযায়ী গড়ে তোলেন। পন্ডিত উলহাস কশলকারের কাছ থেকে তিনি রপ্ত করেন গোয়ালিয়ার জয়পুর ঘরানার কলাকৌশল। গিরিজা দেবীর কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন কাজরী, চৈতি, দাদ্রা ও ঠুমরির।

রুচিরা প্রথমে শোনালেন বাগেশ্রী। প্রথমে বিলম্বিত লয়ে গাইলেন ‘কৌন গাতা ভাই’। এরপরে দ্রুত একতালে গাওয়া বন্দিশ ছিল ‘বেগ বেগ আও আও, তেরে সেবা যৌবন মে সাইয়া’। তিনি তান ও বোলতানে ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল। দ্রুত লয়ে গাওয়া ‘পিহরবা ঘর আও ঘর আও এরি’ ছিল একটি আবেগঘন পরিবেশনা। সুরেলা কণ্ঠে স্বরের স্বচ্ছন্দ বিহার ছিল অনবদ্য। বড় ওস্তাদদের কাছে শিখেছেন, কিন্তু আলাপকারী, বোল-বিস্তার, মীড়, গমক ও তানকারীতে নিজের স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন। মিশ্র পিলুতে ঠুমরি শোনালেন, ‘অাঁখিয়া কাল না পরমায়ি/ হর পল মুরতি উনহিকি দেখি আয়ি/ নয়ন হামারি/ প্রেম কাটারি/ পিয়াকে দেখি বিনা’। দাদরায় গিরিজা দেবীর প্রভাব স্পষ্টই বোঝা গেল। রুচিরার সঙ্গে তানপুরায় ছিলেন সুনীতা দেবনাথ ও দেবযানী দাস, হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়।

এরপর সরোদে মালকোষ বাজালেন রাজরূপা চৌধুরী। তাঁর পরিবেশনায় নৈপুণ্য ছিল। আলাপে রাগের আবহ ঠিকভাবেই সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি। পরে তিনি বাজালেন হুসেনি কানাড়া। রাগটি সচরাচর শোনা যায় না, এই কারণে অনেকের কাছেই অপরিচিত। কাফি ঠাটের এই রাগটি রাতের দ্বিতীয় প্রহরে পরিবেশনযোগ্য। সময়ানুযায়ী রাজরূপা উপযুক্ত রাগটিই বেছে নিয়েছিলেন। পরিবেশনায় রাগটির প্রতি সুবিচারই করেছেন তিনি।

গতবারের উৎসবে ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খান শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন, এবারো করলেন। রবিশঙ্করের ইতাওয়া ঘরানার শাহিদ পারভেজকে বর্তমানকালের শ্রেষ্ঠ সেতারবাদক গণ্য করা হয়। এর মধ্যে অতিরঞ্জন নেই। রবিশঙ্কর নেই, বিলায়েত খাঁ নেই, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ও গত হয়েছেন অনেক আগেই। শাহিদ পারভেজের মতো যোগ্য সেতারিয়া আর রইলেন কই?

রাগেশ্রী দিয়েই শাহিদ তাঁর সেতারবাদন শুরু করলেন। খামাজ ঠাটের এই রাগটি শিল্পী বাজালেনও বেশ মিষ্টি করে। দীর্ঘসময় ধরে আলাপ করে শ্রোতাদের মগ্ন করে তুললেন। রূপক তালে জোড়, বিস্তার ও তেহাইয়ের কাজে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখালেন। সঙ্গে তবলায় ছিলেন আজরাদা ঘরানার বিখ্যাত ওস্তাদ আকরাম খান। দুই পারঙ্গম শিল্পীর সওয়াল-জওয়াব জমে উঠেছিল। কয়েকটি বন্দিশের মুখড়াতেও তালকারী ও তেহাইয়ের মনোমুগ্ধকর শৈলী ছিল। গৎ বাজালেন দ্রুত তিনতাল ও একতালে। খামাজ রাগে একটি ধূনও বাজালেন দাদরা তালে। শাহিদের পরিবেশনায় গায়কি অঙ্গের প্রভাব ছিল। জীবনের প্রথমদিকে বাবা ওস্তাদ আজিজ খান ও চাচা ওস্তাদ হাফিজ খানের কাছে কণ্ঠসংগীতের সাধনা করেছিলেন বলে গায়কি অঙ্গের বাদনশৈলী তাঁর পরিবেশনায় প্রত্যাশিত ছিল। সংগীতের ব্যাপারে শাহিদ শুদ্ধতাবাদী, তার প্রমাণ পাওয়া গেল তাঁর সেতারবাদনে। ইতাওয়া ঘরানার বৈশিষ্ট্য তাঁর বাদনে স্পষ্টরূপেই উন্মোচিত হয়।

প্রথম রজনীর শেষ পরিবেশনা ছিল পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও গিটারবাদক দেবাশীষ ভট্টাচার্যের যুগলবন্দি। গিটারে ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত বাজানোর প্রশিক্ষণ দেবাশীষ নিয়েছেন ব্রিজভূষণ কাবরার কাছে। প্রথমে অবশ্য বাবা-মায়ের কাছেই তালিম নিয়েছেন হিন্দুস্তানি সংগীতের। এখন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। অজয় চক্রবর্তী ও দেবাশীষ প্রথমে শোনালেন বসন্ত মুখারি। রাগটি আগে হিজাজ ভাঁয়রো নামে পরিচিত ছিল। স্বরবিন্যাসের নানা রূপ ছিল অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে। দেবাশীষকে প্রথমদিকে একটু আড়ষ্ট মনে হয়েছে, পরে তিনি তাঁর গুরুর সঙ্গে আলাপ, জোড়, ঝাঁপতাল ও বিলম্বিত ঝাঁপতালে সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। অজয় চক্রবর্তী খানিকক্ষণের জন্য ধ্রুপদের ছোঁয়াও লাগালেন তাঁর পরিবেশনায়। বিলম্বিত লয়ে তাঁর বন্দিশ ‘নির ভরণে নিকসি যমুনা কি তীর’ ছিল অনবদ্য। তবলচি যোগেশ সামসির সঙ্গে দুজনের সওয়াল-জওয়াব ছিল অসাধারণ। অজয় চক্রবর্তী শেষে ভৈরবীতে গাইলেন :

বাঁশিতে কে ডেকেছে আমায়

শ্যাম বঁধুয়া কি জাদু জানে হায়

হিয়া ওঠে দুলে দুলে

সব কাজ যাই ভুলে

সুরে সুরে মন দুলে যায় গো।

গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের এ-রচনাটি গেয়েই অজয় চক্রবর্তী তাঁর পরিবেশনা শেষ করলেন। প্রথম রজনীর অনুষ্ঠানও শেষ হলো, ভৈরবীর অনুরণনে মগ্ন হয়েই শ্রোতারা আসর ত্যাগ করলেন।

বাংলাদেশের চারজন শিল্পীর তালবাদ্য দিয়ে শুরু হলো দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান। বিশ্বজিৎ নট্ট, গৌতম সরকার, এনামুল হক ও জাকির হোসেন বাজালেন যথাক্রমে পাখোয়াজ, তবলা, মৃদঙ্গম ও তবলা। হারমোনিয়ামে সহযোগিতা করলেন আলমগীর পারভেজ। হিন্দুস্তানি ও দক্ষিণী বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশনায় বাংলাদেশের শিল্পীরা কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন – একথা স্বীকার করতেই হবে। বেশ কযেকটি পেশকারি পরিবেশন করলেন তাঁরা। কায়দা, রেলা, বিভিন্ন ধরনের লয়কারি ও তেহাই পরিবেশনায় পারদর্শিতা দেখালেন বাদক চতুষ্টয়। চারজনের সওয়াল-জওয়াবের পর্বটিও ছিল তাঁদের বাদনশৈলীর অনবদ্যতার স্বাক্ষর।

সিলেটের সুপ্রিয়া দাস পরিবেশনা শুরু করলেন তাঁর গুরু রামকানাই দাসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। প্রথমে নন্দ কল্যাণ রাগে বিলম্বিত তিনতালে গাইলেন ‘বারে বারে সাইয়া তোহে সকল বনহু ঢুনঢুঁ’। নন্দকল্যাণ রাগটি বিশ শতকের গোড়ার দিকে রচিত হলেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিককালে। সুপ্রিয়া পরে কাফি রাগে গাইলেন ‘কদর পিয়া নাইয়া মোরি ক্যায়সে লাগে পার’ ঠুমরিটি। স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল তাঁর পরিবেশনা, বিস্তার ও মুড়কিতে শিল্পী বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। দুটি বন্দিশেরই রচয়িতা আগ্রা ঘরানার ওস্তাদ মাহবুব খান। ‘দরশপিয়া’ নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর বন্দিশগুলো একসময় গায়কদের মুখে মুখে ফিরত। মাহবুব খান ছিলেন আফতব-ই-মৌসিকি ফাইয়াজ খাঁর শ্বশুর। সুপ্রিয়া এখন তালিম নিচ্ছেন পন্ডিত উলহাস কশলকারের কাছে।

দ্বিতীয় দিনের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি সজীমউদ্দীনের কন্যা হাসনা মওদুদ ও আলিমুর রহমান খান। সংগীতজ্ঞ আলিমুর রহমান সংগীতের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, ‘সংগীত প্রার্থনার মতোই পবিত্র। রুমি সংগীতে নৈঃশব্দ্যের গুরুত্ব বুঝতেন। নৈঃশব্দ্যই তাঁর কাছে সংগীতের প্রকৃত অভিব্যক্তি, বাকি সব অনুকরণমাত্র।’

এই রাতের অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের শিষ্য আবীর হোসেন সরোদে প্রথমে পরিবেশন করেন রাগ ‘জয়জয়ন্তী’ ও ‘মিশ্র পিলু’। আবীর দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপ করে ধীরে ধীরে জয়জয়ন্তীর আবহ তৈরি করলেন। বিলম্বিত ও দ্রুত তিনতাল এবং একতালে জোড়, গমক ও রাগদারির নৈপুণ্য প্রদর্শন করলেন। ওস্তাদ আকরাম খানের তবলা বাদন আবীরের সরোদ বাদনকে আরো উপভোগ্য করেছিল।

রাহুল শর্মা সন্তুরে বাজালেন বিলাওয়াল ঠাটের রাগ কৌশিক ধ্বনি। আলাপেই শ্রোতাদের মুগ্ধ করে দিয়েছেন। লয়কারিতেও পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন তিনি। সত্যজিৎ তালওয়ালকারের তবলাসহযোগে তিনতাল ও মত্ততালে রাহুলের  বাদন ছিল। মত্ততাল ইদানীংকালের শিল্পীরা খুব কমই পরিবেশন করেন। একটি বিরল তালে বাদন শোনার অভিজ্ঞতা হলো শ্রোতাদের। কয়েকটি বন্দিশের গৎ বাজিয়ে শিল্পী তাঁর বাদনকে আরো শ্রুতিসুখকর করেছেন। জোড়, ঝালায় সত্যজিৎ তালওয়ালকার ছিলেন রাহুলের যোগ্য সংগতকার। দ্বিতীয় রাতে রাহুলের এই মনোরম সন্তুর বাদনের কথা শ্রোতাদের মনে থাকবে অনেকদিন। পিতা শিবকুমার শর্মার যোগ্য উত্তরসূরিই বলতে হবে তাঁকে। অথচ অর্থনীতির স্নাতক রাহুল সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত সংগীতশিল্পী হওয়ার ব্যাপারে অনীহ ছিলেন। পরে পিতার পীড়াপীড়িতে পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারায় নিজেকে সমর্পণ করেন।

রমাকান্ত গুন্দেচা ও উমাকান্ত গুন্দেচা পরিবেশন করলেন ধ্রুপদ। ধ্রুপদিয়া ওস্তাদ ফরিদ উদ্দীন ডাগর ও ওস্তাদ মহিউদ্দীন ডাগরের কাছ থেকে ধ্রুপদের তালিম নিয়েছেন গুন্দেচা ভ্রাতৃদ্বয়। এখন দুজনই ভারতের খ্যাতিমান ধ্রুপদ-শিল্পী। যোগ রাগে বারো মাত্রার চৌতালে তাঁদের গাওয়া প্রথম বন্দিশটি ছিল :

সুর কি তান, গুণিজন বখান

সুর কি ভেদ সুর কি তান।

সুর কো প্রমাণ জান

তব হো তো ষড়জ জ্ঞান।

পরের বন্দিশটি ছিল এগারো মাত্রার লক্ষ্মীতালে সরস্বতী-গণপতি বন্দনা :

প্রথম নাদ সরস্বতী, গণপতি বুদ্ধিদাতা

চাহি কৃপা ধনলক্ষ্মী পালন করে সব জগৎত্রাতা।

শেষের নিবেদনটি ছিল গুরুমাতা আম্মা শ্রীধর শ্রীগুড্ডা-রচিত একটি গায়ত্রী-স্ত্ততি :

সন্ধ্যা সঞ্জীবনী সুর সমাধিরূপিণী

গায়ত্রী জীবনধাত্রী সাবিত্রী, ত্রিলোকযাত্রী

মহামন্ত্র মহাযন্ত্র মহাতন্ত্রিণী।

গমকের কাজে গুন্দেচা ভ্রাতৃদ্বয় কণ্ঠসামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন। মন্দ্রসপ্তকে বিস্তার ও সরগমে তাঁদের পারদর্শিতা ছিল ঈর্ষণীয়। পাখোয়াজে অখিলেশ গুন্দেচা দুই কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে সমান পারঙ্গমতায় সংগত করেছেন।

কর্ণাটি তালবাদ্যের এক অসাধারণ কলাকৌশল দেখালেন গুরু কারাইকুদি মানি, সুরেশ বৈদ্যনাথন, নারাই নারায়ণম ও অমিত নটরাজ। এঁরা বাজিয়েছেন যথাক্রমে মৃদঙ্গম, ঘটম, থালম ও খঞ্জিরা। কারাইকুদি মানিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মৃদঙ্গম শিল্পীরূপে মান্য করা হয়। কর্ণাটকি বাদ্যচর্চায় শ্রুতি-লয় সংযোজন করে তিনি একটি নতুন বাদনশৈলী সৃষ্টি করেছেন। কণ্ঠ বা কোনো শ্রুতিবাদ্যের (বেহালা, সেতার, সরোদ, বীণা) সহযোগ ছাড়া শুধু তালবাদ্যের পরিবেশনা তাঁরই উদ্ভাবন। ঘটম-বাদনে সুরেশ বৈদ্যনাথনের খ্যাতিও বিশ্বজোড়া। ভারতীয় তাল এবং পাশ্চাত্য সংগীতের লয় সম্পর্কে সুরেশ একজন বিশেষজ্ঞ।

দক্ষিণী বাদ্য তিনটি পর্বের সমন্বয়ে পরিবেশন করা হয় : ধ্বনি, তাল ও প্রকাশন। ধ্বনিতে সুরের জন্ম, তালে তা গতিময় হয়, প্রকাশন-পর্বে ঘটে প্রাণসঞ্চার। সি ভি রমণ বলতেন, ‘মৃদঙ্গমই প্রকাশনের রাজা।’ এই ধরনের বাদ্যে  সুর-তালে গাণিতিক বিন্যাস-সূত্রের প্রয়োগ করা হয়। মাটির ঘটে (ঘটম) তালের আদিরূপ পরিস্ফুট হয় বলে অনেকে মনে করেন। কারাইকুদি মানির বাদ্যদল পরিবেশন করেছেন আটমাত্রার আদি তালম। সমবেত, দ্বৈত ও একক বাদনে এই চার শিল্পী তালের নানা বৈচিত্র্য প্রকাশ করেছেন। ধ্বনি ও তালের এত রকমফের শোনার অভিজ্ঞতা, আমাদের মনে হয় না, বাংলাদেশের শ্রোতাদের আর কখনো হয়েছে। দুই বা তিন বাদ্যের সওয়াল-জওয়াবে অভিভূত ও উল্লসিত শ্রোতারা দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন শিল্পীদের।

রাতের শেষ প্রহরে মঞ্চে এলেন বানারস ঘরানার রাজন মিশ্র ও সাজন মিশ্র। তাঁরা শুরু করলেন বিলম্বিত একতালে ভৈরোঁ রাগের খেয়াল ‘ভোর জাগাও পিহারবা মাইয়কা’। এই খেয়ালে শিল্পীদ্বয়ের মন্দ্রসপ্তকের কাজে ছিল অসাধারণ সংগীত-পারদর্শিতা। রাতের শেষপ্রহরের নিস্তব্ধতায় মিশ্র ভ্রাতৃদ্বয়ের মন্দ্রসপ্তকের গভীর-গম্ভীর সুরবিস্তার এক শান্ত-মায়াময় আবহের সৃষ্টি করেছিল। তখনো ভোর হতে বেশ খানিকটা সময় বাকি; কিন্তু রাজন-সাজনের ভৈরোঁতে ভোর যে উঁকি দিচ্ছিল। এরপরের তিনতালের বন্দিশে ছিল বিশ্বকর্তার কাছে করুণা ও সুখ প্রার্থনা :

মেহের কি নজর কিজিয়ে

সুখ সম্পদ সব দিজিয়ে,

তু করিম করতার

নিশিদিন আস বিহারি।

মাঝখানে একটি অতি পুরনো তারানা – ‘তানুম তা দিয়ানা রে’ গাইলেন তাঁরা দশমাত্রার সুর-ফাঁকতালে। এরপর ললিত রাগে পরিবেশিত হলো কৃষ্ণের সঙ্গপিয়াসী রাধার আকুতি-ভরা একটি বন্দিশ :

যানে না দুঙ্গি কানহা

বাঁসিয়া বাজায়ে বিনা,

করজোড় মাঙ্গু

দ্বিজরূপ মোহে পাস হো

তো অধর পর বিরাজু।

তখন রাত্রি প্রায় শেষ হতে চলেছে। ভৈরবী রাগে রাজন-সাজনের কণ্ঠে শোনা গেল ওয়াজিদ আলী শাহের বিখ্যাত রচনা :

বাবুল মোরা নাইহর ছুটো হি জায়ে

চার কাহার মিলি, মেরি ডোলিয়া উঠাবে

মেরা আপনা বেগানা ছুটো জায়ে, বাবুল মোরা

অঙ্গনা তো পর্বত ভয়ো, আওর দেহরি ভয়ি বিদেশ

জায়ে বাবুল ঘর আপনি ম্যায় চলি পিয়া কি দেশ।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের আগে ওয়াজিদ আলী শাহকে ব্রিটিশ শাসকরা লখনউ থেকে বহিষ্কার করে। লখনউ ছেড়ে যাওয়ার বেদনাকে নওয়াবের মনে হয়েছে পিতৃগৃহ ছেড়ে কন্যার বিদায় নেওয়ার মতোই বিষাদময়। সেই বিষাদমাখা অনুভূতি থেকে রচিত এই বন্দিশটি জনপ্রিয় করেছেন ভীমসেন যোশী।

তৃতীয় রাতের অনুষ্ঠানের শুরুতে শুচিশ্রী রায়ের পরিচালনায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের উচ্চাঙ্গসংগীত শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করলেন সমবেত উচ্চাঙ্গসংগীত ‘কল্যাণ’। এরপর নিশীথ দে সেতারে বাজালেন পুরিয়া ধনেশ্রী। তাঁর সঙ্গে তবলা-সংগত করেছেন ইফতেখার আলম। ইমদাদি ঘরানার অনুসারী নিশিথের বাদনে প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত আছে।

এই রাতের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্বভারতীর এমেরিটাস অধ্যাপক ও ভারতের রাজ্যসভার সদস্য যোগেন চৌধুরী এবং আইটিসি-সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক পন্ডিত বিজয় কিচলু। পন্ডিত বিজয় কিচলু সংগীতের গভীর আবেদনের কথা বললেন। সংগীত মানুষের হৃদয়ে উৎফুল্লতা আনে, কিন্তু সংগীত চরম সুখানুভূতি জাগায় তখনই যখন তা শ্রোতার হৃদয়ে ক্ষরণ সৃষ্টি করে :

কিসিকা গানা শুনতে হে তো হাম জখমি হো যাতে হে,

বরসো গুজর যাতা হ্যায় ইয়ে জখম কভি মিটতা নেহি।

আগ্রা-গোয়ালিয়র ঘরানার মঞ্জুষা কুলকার্নি পাতিল প্রথমে পরিবেশন করলেন রাগ ছায়ানট। ঝুমরা তালে অতি বিলম্বিত লয়ে আলাপ করলেন দীর্ঘক্ষণ – প্রথমে আটচল্লিশ মাত্রায় শুরু করলেন, পরে গাইলেন চবিবশ মাত্রায়। এরপর দ্রুত তিনতালে গাইলেন একটি অতি সুন্দর বন্দিশ :

এরি মালিনিয়া গুলে লাও রে পিয়া ঘর,

চুনে চুনে কলিয়া দো না হারওয়া।

মঞ্জুষার এই পরিবেশনায় প্রিয়জনকে তুষ্ট করার অভিলাষ ও দরদমাখা আকুতি ছিল। এরপর মিশ্র খাম্বাজে পরিবেশন করলেন একটি ঠুমরি :

সাবরে সালোনে বাকে শ্যাম হায়

মোরি মোহনীয়া ব্রিজধাম

যব সে দেখি তোহে সাবরিয়া সুরতিয়া রে..

মঞ্জুষা পাতিল তাঁর সংগীত-শিক্ষা শুরু করেছিলেন পন্ডিত চিন্তুবুয়া মাইসকারের কাছে নাড়া বেঁধে। পরে সংগীতাচার্য ডি ভি কাবেয়ার কাছ থেকে আগ্রা-গোয়ালিয়র ঘরানার তালিম নিয়েছেন। এখন তিনি পন্ডিত উলহাস কশলকারের শিষ্যা।

পন্ডিত শিবকুমার শর্মা সন্তুর বাজাচ্ছেন ষাট বছর ধরে। কাশ্মিরের এই লোকবাদনযন্ত্রে ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত বাজানোর পথিকৃৎ তিনি। গত বছরও তিনি বেঙ্গলের সংগীত উৎসবে এসেছিলেন। এবার অনুষ্ঠানে বাজানোর আগে তিনি বললেন :

সংগীত আমাদের কাছে প্রার্থনার মতো। মনের ক্ষুধা মেটাতে সংগীতের বিকল্প নেই। এর ভাষা সর্বজনীন। ব্যাকরণ না জেনেও সংগীত উপভোগ করা যায়। মানুষের অনুভূতির কাছেই এর আবেদন। সংগীত উপভোগের জন্য চাই অখন্ড মনোযোগ।

শিবকুমার শর্মা প্রথমে বাজালেন রাগ চারুকেশী। শিবরঞ্জনীর মতো এটিও দক্ষিণী রাগ। কর্ণাটকি সংগীতে এর নাম তরঙ্গিনী। আলাপে শিল্পী সৃষ্টি করলেন ধ্যানমগ্ন পরিবেশ। পরে দশমাত্রার ঝাঁপতাল, আদ্ধা ও তিনতালে পরিবেশন করলেন জোড়-ঝালা। ঝাঁপতালে বাজানো গৎ শ্রোতারা বেশ উপভোগ করেছেন। যোগেশ সামসি তবলা সংগত ছিল এই পরিবেশনার বিশেষ আকর্ষণ। দুজনের সওয়াল-জওয়াবও ছিল হৃদয়গ্রাহী। শিল্পী পরে একটি ধূন বাজালেন পাহাড়ি রাগে। শিবকুমার সন্তুরের প্রবাদপ্রতিম পন্ডিত। কিন্তু এই রাতে তাঁকে খানিকটা অবসন্ন মনে হলো। আগের রাতে রাহুল শর্মার বাদনে যতটা প্রাণোদ্যম ছিল, শিবকুমারের বাজনায় ততটা ছিল না। বয়োধর্ম?

বাংলাদেশি শিল্পী অসিত রায়ের কণ্ঠে ধ্রুপদ শোনার এক অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা হলো এই আসরে। বঙ্গদেশে ধ্রুপদের চর্চা আজকাল হয়ই না। বিষ্ণুপুর ঘরানাও কোনোভাবে টিকে আছে। এই কারণে অসিত রায়ের পরিবেশনা ভালো লাগল। অবশ্য তিনি গেয়েছেনও বেশ কুশলতার সঙ্গে। বাগেশ্রীতে প্রথমে পরিবেশন করলেন, ‘একদিন ব্রিজরাজকি মন্দির মোরি’। চৌতাল ও দ্রুত ঝাঁপতালের পরিবেশনায় পাখোয়াজে সংগত করলেন পন্ডিত মোহন শ্যাম শর্মা। এরপরের বন্দিশ ছিল :

চঞ্চল প্রীতম আজু ঘর না আয়ে

পল পর না দেখে উসে মোর জিয়া ঘবড়ায়ে

সব বন ঢুনঢ ফিরি কানহা কি বাঁসুরি

কাহা হো মুরলিধারী আজ রাধা পুকারে।

অসিত রায় শ্রোতাদের আশাতীত আনন্দ দিয়েছেন, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

তৃতীয় রাতের আসর মাৎ করেছেন কর্ণাটি শিল্পী বিদুষী অরুণা সাইরাম। মাতা রাজলক্ষ্মী সেতুরমণ তাঁর প্রথম গুরু, পরে তালিম নিয়েছেন সংগীত কলানিধি শ্রীমতী বৃন্দার কাছ থেকে। প্রথমে শিবস্ত্ততি করলেন, ‘সর্বমঙ্গলা মঙ্গলে শিব সর্বদা’ গেয়ে। এরপর হিন্দোলম রাগে ‘মা মবতু শ্রীসরস্বতী’ উৎসর্গ করলেন বিদ্যা দেবী সরস্বতীকে। হিন্দোলম রাগটি হিন্দুস্তানি মালকোষেরই দক্ষিণী রূপ। সুরেলা কণ্ঠে স্বচ্ছন্দ স্বরবিহারের অনুপম নৈপুণ্য প্রদর্শন করলেন অরুণা। তাঁর পরিবেশনাগুণে অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত দক্ষিণী সংগীত উপভোগ করতেও শ্রোতাদের কোনো অসুবিধে হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ সরগমও করলেন তাঁর পরিশীলিত কণ্ঠে। সরগমে তাঁকে বেহালায় সঙ্গ দিয়েছেন রাঘদেব রাও।

স্বামী পুরন্দর দাসের একটি রচনাও পরিবেশন করলেন অরুণা সাইরাম। পুরন্দর ষোড়শ শতকের কর্ণাটি সংগীতজ্ঞ ও সংগীত-রচয়িতা। তাঁকে কর্ণাটি সংগীতের পিতামহ নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর সংগীতগুলো কন্নড় ভাষায় রচিত। তাঁর ‘রাম নাম পায়েস, কৃষ্ণ নাম সিকরি’ পরিবেশন করেন অরুণা সাইরাম। এ-রচনাটির অর্থ কৃষ্ণ নাম শর্করা ও রাম নাম পায়েসতুল্য। এঁদের নাম জপ করেই সাধনার অমৃত পান করা যায়। শিল্পীর ‘কদনা কুতুহলম’ রাগে পরিবেশিত ‘মথুরাপুরী হৃদয়নিবাসী’ এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত করেছে শ্রোতাদের মনে। পাশ্চাত্যের গির্জা-সংগীতে অনুপ্রাণিত হয়ে এটি রচনা করেছেন অরুণা। দক্ষিণী সুরে পাশ্চাত্য গির্জা-সংগীতের মেজাজ এনেছেন তিনি। এটাকে একটি সার্থক ফিউশন বলা যেতে পারে।

শিল্পীর টোড়ি রাগের পরিবেশনাও বেশ সুরেলা ছিল। দক্ষিণী টোড়ি অবশ্য হিন্দুস্তানি টোড়ির মতো নয়, অনেকটা ভৈরবীর কাছাকাছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক আলাপ করে শ্রোতাদের অভিভূত করেছেন শিল্পী। কৃষ্ণের উপদ্রবে অতিষ্ঠ গোপীদের যশোদার কাছে অভিযোগ নিয়ে পরিবেশিত রচনাটিও উপভোগ্য ছিল। শ্রোতাদের সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছেন তিনি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে কে দিয়েছে গালি’ গানটি গেয়ে। বাংলা উচ্চারণ যথাযথ ছিল না, কিন্তু কমল দাশগুপ্তের সুরারোপিত এই শ্যামাসংগীতের পরিবেশনায় কোনো সাংগীতিক ত্রুটি ছিল না। অরুণা তাঁর অনুষ্ঠান শেষ করলেন কালীয়দমনের কাহিনি অবলম্বনে অষ্টাদশ শতকের তামিল কবি উত্তুকারু ভেন্কট আইয়ারের একটি তিল্লানা দিয়ে। শিল্পীর সঙ্গে মৃদঙ্গম ও ঘটম বাজিয়েছেন যথাক্রমে সাই গিরিধর ও এস ভি রামাণ। অরুণা শ্রোতাদের মাতিয়ে তুলেছিলেন। শ্রোতারাও দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়ে এই অসাধারণ গুণী শিল্পীকে তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানালেন।

কলকাতার সেতারিয়া এই রাতে বাজালেন পন্ডিত রবিশঙ্কর-সৃষ্ট রাগ পরমেশ্বরী। কুশল দাসের পিতা শৈলেন দাস ছিলেন রবিশঙ্করের শিষ্য, এস্রাজ বাজাতেন। পিতার কাছেই তালিম শুরু করেছিলেন, পরে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় ও অজয় সিনহা রায়ের কাছ থেকে। কণ্ঠসংগীতের সাধনা করেছেন পন্ডিত মানস চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে। কুশল সেতারের পারঙ্গম শিল্পী – এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর বাদনে শ্রবণসুখকর মিষ্টত্ব আছে। আলাপে রাগটির প্রতি সুবিচার করেছেন। জোড়-ঝালা ছিল অসাধারণ। শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সংগত করেছেন যোগেশ সামসি।

তৃতীয় রজনীর শেষ শিল্পী ছিলেন পন্ডিত উলহাস কশলকার। প্রথমে ললিত রাগে গাইলেন :

ইয়ে ভোর হি আয়ে

যোগিয়া তুম আয়ে

যোগিয়া তুম আলোক জাগাও

ইয়ে শবরী ভোর মোহন মাথে তিলক লাগাও।

রাতের শেষপ্রহরে ষোলোমাত্রার বিলম্বিত লয়ে উলহাস কশলকারের এই পরিবেশনায় ভোরের আমেজ ছেয়ে গেল। দরদ দিয়ে গেয়েছেন শিল্পী। এরপর দ্রুত তিনতালের গাইলেন :

পবতা ইয়ারদা যৌবন

তুঝে নজরে না আতা..

যোগীবেশী ভোরকে আবাহনের পর দ্রুত তিনতালে গাইলেন একটি তারানা, ‘দানি উদানা দিম দিম দানি’। এরপর দেশকার রাগে দ্রুত তিনতালে পরিবেশন করলেন খেয়ালের একটি বন্দিশ, ‘ঝাঝরিয়া ঝনকে ঝনকে বাজে মোর পাও।’ পুকার, মুড়কি, বোল বিস্তার ও গমকে শিল্পী তাঁর অনায়াস সামর্থ্যের পরিচয় দিলেন। তাঁর পরিবেশনা শেষ হলো বিখ্যাত ঠুমরি ‘যমুনা কি তীর’ দিয়ে। কিরানা ঘরানার আবদুল করিম খাঁ ও ভীমসেন যোশীর কণ্ঠে শোনা ঠুমরিটি উলহাস কশলকারও ভালো গেয়েছেন। শিল্পীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন সামিহান কশলকার, তবলায় সংগত করেছেন যোগেশ সামসি, হারমেনিয়াম বাজিয়েছেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়।

চতুর্থ রাতের অনুষ্ঠান শুরু হলো অমিত চৌধুরীর ভরতনাট্যম পরিবেশনা দিয়ে। চট্টগ্রামের রুণু বিশ্বাসের কাছে তাঁর নৃত্যচর্চার শুরু। রুণু বিশ্বাস আজ এক বিস্মৃত নাম। একসময়ে চট্টগ্রামের নৃত্য-মঞ্চে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় শিল্পী। অমিত চৌধুরী নৃত্যে রবি-শশীর বন্দনা করলেন, প্রদর্শন করলেন নাতিশা কটভব, নটরাজের বন্দনা করলেন নৃত্যে। পূরবী রাগ ও রূপক তালে তিল্লানারও নৃত্যরূপ দিলেন। শিল্পীর প্রয়াস ভালো, তবে আরো সাবলীল হওয়ার সাধনা তাঁকে করতে হবে।

স্বরূপ হোসেন তবলায় প্রথমে বাজালেন তিনতাল, এরপর পাঁচটি তালের সমন্বয়ে পরিবেশন করলেন একটি তালনামা। চার-পাঁচশো বছর আগে লালকিল্লার এক বাদকের অনুসরণে রচিত একটি তালও বাজালেন। তবলায় বোল-বাণীর ধ্বনিও শোনা গেল তাঁর বাদ্যপ্রয়াসে। শিল্পীর মধ্যে সম্ভাবনার ঝলক দেখা গেছে, তবে পরিশীলিত হওয়ার জন্য অনুশীলনের বিকল্প নেই – এ কথা মনে রাখতে হবে।

আলোচনা-অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা-পরিচালক তপন চৌধুরী। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বেশ সাবলীল ও গোছানোভাবে বললেন :

আজ আমি অতীতের দিকে ফিরে যাব। ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হয়। এদেশে তখন চিত্রকলার চর্চা ছিল না। খুলনার মহেশ্বরপাশায় কিছু লোকশিল্পী দেখা যেত। এদেশে শিল্পচর্চা হোক, পাকিস্তানি শাসকরা তা চাইত না, ইসলামের দোহাই দিত। তারা লাহোরের মেয়ো আর্ট কলেজ নিয়ে গর্ব করতো, কিন্তু পূর্ববাংলায় শিল্পচর্চার অনুকূল পরিবেশসৃষ্টিতে আগ্রহী ছিল না। সেই সময়ে জয়নুল আবেদিন এদেশে শিল্পচর্চার সুযোগসৃষ্টির জন্য আর্ট কলেজ করলেন। শুধু কলেজ খুলেই তিনি থেমে যাননি, শিল্পী তৈরির সঙ্গে তিনি শিল্প-আন্দোলনেরও সূচনা করতে চেয়েছেন। তিনি বলতেন, ‘কেউ শিল্পী হয়ে তখনই যখন সে অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।’ তিনি শিল্পের সঙ্গে সংগীত ও সাহিত্যকে সমন্বিত করার চেষ্টা করেছেন। আর্ট কলেজে মোমতাজউদ্দীন, আবদুল আলীম আসতেন, কানাইলাল শীল এসে দোতারা বাজাতেন। লোকশিল্পীরাও আসতেন। তিনি কারো ওপর কিছু চাপিয়ে দিতেন না। জসীমউদ্দীন, আববাসউদ্দীন আসতেন। জয়নুল আবেদিন একজন অদম্য পুরুষ ছিলেন। কানাইলাল শীলের কাছে জয়নুল আবেদিন দোতারা শিখতেন। সংগীত ভালোবাসতেন বলেই তাঁর ছবিতে আমরা তাল-লয় অনুভব করতাম। এদেশে গুল মোহাম্মদ খান, মাস্তাঙ্গানা, খাদেম হোসেন খান, মীর কাসিম খান, ফুলঝুরি খানের মতো শিল্পী ছিলেন। ফুলঝুরি খানের নাম ছিল রইস উদ্দীন খান। তাঁর বাদনে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন ফুলঝুরি খান। এইসব শিল্পী পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। সুযোগের অভাবে আলাউদ্দীন খাঁ চলে গেলেন মাইহারে, বাহাদুর হোসেন খাঁ কলকাতায়। সত্তর বছর আগে জয়নুল আবেদিন যে-আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার ফলে বাংলাদেশের চিত্রশিল্প আজ বিশ্বমান অর্জন করেছে। আমার আক্ষেপ, আবুল খায়ের কেন সত্তর বছর আগে জন্মালেন না। আবুল খায়েরও অপ্রতিরোধ্য। সত্তর বছর আগে আবুল খায়ের জন্মালে আমাদের সংগীতও আজ বিশ্বমান অর্জন করত।

এটুকু বলে তিনি মঞ্চে গিয়ে তাঁর আসনে বসলেন। ভাষণ দেওয়ার জন্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই সময়ে কাইয়ুম চৌধুরী আসন ছেড়ে আবার এলেন মাইক্রোফোনের কাছে। বললেন, ‘আমি একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ সেই অকথিত কথা আর বলতে পারলেন না। হঠাৎ মঞ্চের ওপর পড়ে গেলেন। দ্রুত তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। উদ্যোক্তারা ঠিক করলেন, অনুষ্ঠান চালিয়ে যাবেন। মঞ্চে উঠলেন আমান আলী খান ও আয়ান আলী খান। তাঁদের সরোদ-বাজনা চলছিল, এরই মধ্যে মোবাইল বার্তার মাধ্যমে অনেকেই জেনে গেলেন কাইয়ুম চৌধুরী আর নেই। আমান-আয়ানের অনুষ্ঠান শেষ হতেই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আনিসুজ্জামান জানালেন সেই দুঃসংবাদটি। মৃত্যুসংবাদ জানাতে গিয়ে তিনি স্মরণ করলেন কাইয়ুম চৌধুরীর অবদানের কথা। প্রচ্ছদচিত্র, তৈলচিত্র, জলরং ও মুক্তিযুদ্ধের চিত্র অংকনে কাইয়ুম চৌধুরীর কৃতিত্বের কথা বললেন। এই সংবাদে উৎসবস্থান শোকের বিষাদে ছেয়ে গেল। কাইয়ুম চৌধুরী নিজে ছিলেন সংগীতের গুণগ্রাহী ও সমঝদার। এ-ধরনের অনুষ্ঠান বিঘ্নিত হোক – এটা তিনি চাইতেন না। এ-বিবেচনায় অনুষ্ঠান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আনিসুজ্জামান বললেন, ‘অনুষ্ঠান চলবে, যেমন জীবন বয়ে চলে।’

আমান আলী খান ও আয়ান আলী খান প্রথমে পরিবেশন করলেন খামাজ ঠাটের শেষসন্ধ্যার রাগ ঝিনঝোটি। তাঁদের পরিবেশনা ছিল নিপুণ। রাগের আলাপ-জোড়-ঝালা সব পর্বেই তাঁরা ছিলেন স্বচ্ছন্দ। সাড়ে নয়মাত্রার তালে শিল্পীদের সঙ্গে পারদর্শিতার সঙ্গে সংগত করেছেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার। পাখোয়াজ বাজিয়েছেন পন্ডিত ফতেহ সিং গঙ্গানি। দ্বিতীয় রাগটি ছিল রাগেশ্রী। বাজিয়েছেন দ্রুত ও অতিদ্রুত তিনতালে। সঙ্গে আড়া চৌতালের কিছু নমুনাও শোনা গেল। তবলা-পাখোয়াজের সঙ্গে সওয়াল-জওয়াবও জমে উঠেছিল। এই দুই ভাই ভাটিয়ার রাগে একটি ধূনও শোনালেন, দ্রুত একতালে। শেষ করলেন একটি রাগমালা পরিবেশন করে।

তরুণ শিল্পী সামিহন কশলকার যখন মঞ্চে এলেন তার আগেই কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হয়েছে। সামিহান বললেন, একটু আগে গ্রিনরুমে বসে এক বড়মাপের শিল্পীর প্রয়াণ দেখলাম। এই শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই আমার সংগীতের মাধ্যমেই। প্রয়াত এই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিবেদন করছি মালকোষ রাগ। মালকোষের পর শিল্পী শোনালেন সোহিনি। মালকোষে তাঁর বন্দিশ ছিল,

দেখ দেখ মনতল চাহিরে

পিয়াকি দরশ ভরি বারি।

পন্ডিত উলহাস কশলকারের পুত্র ও শিষ্য সামিহান কশলকার রাগদারি ও লয়কারিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। গোয়ালিয়র ঘরানার যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে চলেছেন তিনি – এই সম্ভাবনা এখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও গণেশ রাজাগোপালন এরপর মঞ্চে উঠলেন যথাক্রমে সরোদ ও বেহালা নিয়ে। দুজনই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে পারঙ্গম। তেজেন্দ্রনারায়ণ হিন্দুস্তানি ও রাজাগোপালন কর্ণাটকি সংগীতের শিল্পী। এই দুই শিল্পীর যুগলবন্দি শোনার জন্য শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে ছিলেন। তাঁরাও শ্রোতাদের নিরাশ করেননি। তাঁদের সঙ্গে তবলা ও মৃদঙ্গমে সংগত করেছেন যথাক্রমে যোগেশ সামসি ও রবিশংকর ভদ্রাচার। প্রথমে তাঁরা শোনালেন মালকোষ ও হিন্দোলমের যুগলবন্দি। উত্তর ভারতীয় রাগ মালকোষের দক্ষিণী রূপ হিন্দোলম। এরপর দুজনের কাছ থেকে শোনা হলো রাগ চারুকেশী। দুটি রাগই চমৎকারভাবে পরিবেশন করলেন শিল্পীদ্বয়। সরোদে-বেহালায় মালকোষ-হিন্দোলমের আলাপে অনেকটা সময় নিলেন তেজেন্দ্র ও রাজাগোপালন। সুমিষ্ট রাগ মালকোষ-হিন্দোলম তাঁদের পরিবেশনাগুণে আরো মিষ্টি মনে হলো। তারপর জোড়ে দুই শিল্পী তাঁদের বাদন কুশলতা দেখালেন। সওয়াল-জওয়াব হয়েছিল বহুমাত্রিক। সরোদের সঙ্গে তবলা ও পাখোয়াজের, পাখোয়াজ ও তবলার, বেহালার সঙ্গে আবার তবলা-পাখোয়াজের। চারুকেশী রাগেও তাঁদের অনবদ্যতা শ্রোতারা বেশ উপভোগ করেছেন। শেষে তাঁরা পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘বাবু সেলাম বারে বার’ ও ‘রঙিলা রঙিলা রঙিলা রে’ গানের ধূন বাজিয়ে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিলেন শ্রোতাদের।

কৌশিকী চক্রবর্তী প্রথমে শোনালেন রাগ বাগেশ্বরী। বেশ মেজাজ নিয়েই গাইলেন। তিন সপ্তকেই স্বরের স্বচ্ছন্দ বিহারে মোহিত করলেন শ্রোতাদের। সরস্বতীর বন্দনা করে গাইলেন একটি বন্দিশ :

আও সাজাও মন্দির আজ

বিদ্যাদায়িনী মাতাকি পূজা করো,

বোল  হারি রয়না চরণ ঘরেরি

সব মিলে আনন্দ গান গাও।

আলাপ, পুকার ও দ্রুত তানের পারদর্শিতায় শিল্পীর পরিবেশনা হয়ে উঠল মনোমুগ্ধকর। এরপর শোনালেন পিতা অজয় চক্রবর্তী-রচিত পিলু রাগের একটি ঠুমরি :

সাজনওয়া কব আওগে

ম্যায় কিথে গুজারু দিন সারা,

সাজনওয়া দিন নাহি চেইন

রাত নাহি নিন্দিয়া, ম্যায় বাবরিয়া।

এরপর গাইলেন একটি দাদরা :

রঙ্গিন শাড়ি গোলাবি চুনরিয়া রে

মোহে মারে রে

নজরি সাবরিয়া রে

যাও জি যাও করো না বাতিয়া।

ঠুমরি ও দাদরার পরিবেশনায় কৌশিকী অনবদ্য। তবে তাঁর বচনে, গায়কিতে, অভিব্যক্তিতে পিতার ছায়া খুবই প্রকট। তাঁর সঙ্গে তবলায় সংগত করেছেন যোগেশ সামসি।

রাতের শেষ প্রহরে বাঁশিতে আহির ভৈরবের সুর তুললেন পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। আলাপেই এক অতীন্দ্রিয় সম্মোহন তৈরি হলো। তাঁকে কলির কৃষ্ণ বলার কারণ বোঝা গেল। একটি কীর্তনের সুর বাজিয়ে রাধা-কৃষ্ণের বৃন্দাবনের আবহ সৃষ্টি করলেন। শেষে দুটি ধূন বাজালেন, শ্রোতাদের অনুরোধে। প্রথমে পাহাড়িতে, পরে ভৈরবীতে। তৃপ্ত শ্রোতারা তাঁর ধূনের অনুরণন নিয়েই বাড়ি ফিরলেন, তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

শেষ ও পঞ্চম রাতের অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনটি সমবেত গান গাইলেন দেশের প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন শিল্পী। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ দিয়ে শুরু হলো সংগীতানুষ্ঠান। এরপর লালনের ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’ এবং শেষে ‘এই পদ্মা এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদীতটে’ গানটি পরিবেশিত হয়।

আগের রাতে কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুর শোক তখনো সবার মনে। এই রাতের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ফজলে হাসান আবেদ, বিশেষ অতিথি মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম এবং আবুল খায়ের শ্রদ্ধা জানালেন প্রয়াত শিল্পীর প্রতি। আগামী বছরের অনুষ্ঠান শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর নামে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের।

এরপর নৃত্য পরিবেশন করেন বেনারস ঘরানার কত্থকশিল্পী বিশাল কৃষ্ণ। বিশাল কৃষ্ণ গতবারও এই উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন, নৃত্যরসিকদের মুগ্ধও করেছিলেন। এবারে প্রথমে পন্ডিত সুখদেব মহারাজ-রচিত ‘ওম নম শিব’ দিয়ে করলেন শিব-বন্দনা। তারপর শিবের তান্ডব নৃত্যের রূপ দেখালেন। এরপর একে একে তিনতালে বন্দিশ, ঝাঁপতালে তেহাই পরিবেশন করলেন তাঁর অনুপম নৃত্যশৈলীতে। পাখোয়াজের বোল নৃত্যে রূপায়িত করলেন, ‘মেশিন গান’ নামে খ্যাত একটি রচনা পরিবেশন করলেন। রচনাটি কিষণ মহারাজ ও সিতারা দেবীর। আল্লারাখা খানের বোলের চলন এবং পিতা পন্ডিত মোহনকৃষ্ণ মিশ্রের বোলের নৃত্যায়ন দেখালেন। চক্রধারের পরিবেশনায় মুগ্ধ করলেন দর্শকদের।  তেহাইয়ে ঘোটক-চলন প্রদর্শন করলেন। দেখালেন ময়ূরের নৃত্যের গৎ। তবে তিনি মাতিয়ে দিলেন থালি-নৃত্য করে। তবলার বোল ও সেতারের ঝঙ্কারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থালির ওপর নৃত্যপারঙ্গমতা দেখিয়ে দর্শকদের দিলেন অনাবিল আনন্দ। বিশাল কৃষ্ণের সঙ্গে কণ্ঠসংগত করেছেন দেবাশীষ সরকার, নন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বাজিয়েছেন সেতার, বোল-পঠনে ছিলেন পিতা মোহনকৃষ্ণ মিশ্র।

এবারের উৎসবে বিদুষী কিশোরী আমোনকারের আসার খবর জেনে সংগীতরসিকরা বেশ উৎসুক হয়ে ছিলেন। কিশোরী আমোনকারের মা মোগুবাই কুর্দিকার ছিলেন জয়পুর ঘরানার একজন বিখ্যাত শিল্পী। মায়ের কাছেই তাঁর সংগীতশিক্ষার সূচনা। কিশোরী অবশ্য নির্দিষ্ট ঘরানার মধ্যে সীমিত থাকেননি। গত শতকের চল্লিশের দশকে ভেন্দিবাজার ঘরানার আনজানি বাই মালপেকারসহ আরো বেশ কয়েকটি ঘরানার পন্ডিতদের কাছে সংগীতের তালিম নিয়েছেন। বিভিন্ন ঘরানার বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে তিনি জয়পুর ঘরানাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছেন। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পীদের মধ্যে কিশোরী আমোনকারের স্থান বেশ উঁচুতে।

অনুষ্ঠানে কিশোরী আমোনকার প্রথমে পরিবেশন করলেন কেদার রাগ। কল্যাণ ঠাটের এই রাগটির চলন খুব একটা সরলরৈখিক নয়, পরিবেশন করাও সহজ নয়। কিশোরী আমোনকার কুশলী ও সম্পন্ন শিল্পী, তিনি অনায়াস সাবলীলতায় রাগটির রূপ তাঁর কণ্ঠে রূপায়িত করেছেন। তবে সেই রাতে তাঁর কণ্ঠের সুস্থতা ছিল না, কাশির জন্য বারবার থামতে হয়েছে, কিন্তু রাগের রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন অনবদ্যরূপে। ‘পাইও পাইও মোহে মদনা’ বন্দিশটি গাইলেন প্রথমে বিলম্বিত ত্রিতালে। আদ্ধাতালে গাইলেন ‘ঝনক ঝনক মোরি পায়েল বাজে’। নানা ধরনের তান প্রয়োগ করে শিল্পী তাঁর পরিবেশনাকে শ্রোতাদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুললেন। কণ্ঠসংগতে কিশোরী আমোনকারের পৌত্রী তেজশ্রী বিভাস আমোনকার ছিলেন অনবদ্য। তবলায় ভারত কমোদ, বেহালায় মিলিন্দ রায়কর, দ্বিতীয় কণ্ঠসহযোগী নন্দিনী বাড়েকর শিল্পীকে সহযোগিতা করেছেন যথাযথভাবেই।

বাংলাদেশের এম মনিরুজ্জামান বাঁশিতে বাজিয়েছেন বাগেশ্রী। রাগের রূপ উন্মোচনে তিনি কুশলতা দেখিয়েছেন। দ্রুত তেহাইয়ের সুর তুলে শ্রোতাদের আপ্লুত করেছেন। তাঁর সঙ্গে সংগত করেছেন তবলায় ইফতেখার আলম, পাখোয়াজে সুশীলকুমার রায়।

জয়পুর আতরাউলি ঘরানার অশ্বিনী ভিদে দেশপান্ডে প্রথমে পরিবেশন করলেন রাগ যোগ। বিলম্বিত তিনতালে গাইলেন গুরুর কাছ থেকে পাওয়া একটি পুরনো বন্দিশ :

প্রথম মান আল্লা

জিনর চোহে নূর পাক নবিজি

রাখো ইমান রে সুজন।

এরপর দ্রুত ত্রিতালে গাইলেন একটি তারানা। পরজ রাগে গাইলেন :

পবন চলত অলি কিও চোরি গেন্দ

চলো মিতওয়া বালম পদওয়া

হাম তুম পিয়া পদওয়া

কর রঙ্গ রলিয়া।

শিল্পীর সঙ্গে তবলা ও হারমোনিয়ামে সহযোগিতা করেছেন যথাক্রমে যোগেশ সামসি ও গৌরব চট্টোপাধ্যায়।

উদয় ভাওয়ালকার পরিবেশন করলেন ধ্রুপদ। বেহাগ রাগে আলাপ করলেন দীর্ঘসময় ধরে। মন্দ্রসপ্তকে অসাধারণ স্বচ্ছন্দ তিনি, পারদর্শিতা দেখালেন গমকেও। পাখোয়াজের সঙ্গে ধামার তালে পরিবেশন করলেন শৃঙ্গার রসাশ্রিত একটি ধ্রুপদ বন্দিশ :

কাহাসে তু মদ পিকর আয়ে হো

সবরো জানি ধরতি ডগমগাতা।

মদ দ্ব্যর্থবোধক। নেশার পানীয় এবং ভক্তি-রস – দুই অর্থেই। তবে এই পদে ভক্তি-রস ছিল না। এরপর দশ মাত্রার সুর-ফাঁক তালে গাইলেন :

মাধো মন ভায়ো চবনজাত বখানি

পায়ো সুখানন্দ শ্যামরূপ সুহানি

কন্সারি গিরিধারী

মনোহারি সুখকারি।

উদয় ভাওয়ালকার ধ্রুপদের সম্পন্ন শিল্পী, পরিবেশনায় কুশলতার ছাপ আছে। শিল্পীর সঙ্গে পাখোয়াজ বাজিয়েছেন প্রতাপ আওয়াধ। কণ্ঠসংগত করেছেন চিন্তন উপাধ্যায়।

উৎসবের শেষ শিল্পী ছিলেন ওস্তাদ আমজাদ আলী খান। সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম করেছিলেন। সেই কথা উল্লেখ করে বললেন :

আমার বাবা ওস্তাদ হাফিজ আলী খানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল। তাঁর মুখে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ ভৈরবী ও খামাজ রাগ দুটি খুব পছন্দ করতেন। আজ আমি রবীন্দ্রনাথের সেই প্রিয় দুটি রাগই বাজাবো।

তবে তিনি অনুষ্ঠান শুরু করলেন কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত ও লোকগীতির ধূন বাজিয়ে। মনে হচ্ছিল, আমজাদ আলী শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের দিকেই মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু না, খামাজ রাগ বাজানো শুরু করতেই শিল্পী তাঁর জাত বুঝিয়ে দিলেন। নিমগ্ন হয়ে আলাপ করলেন। মীড় ও গমকের শিল্পীর অসাধারণ নৈপুণ্যে শ্রোতাদের মন ভরে গেল। ভৈরবী শুরুর আগে যোগিয়ায় বাজালেন বিখ্যাত ঠুমরি ‘পিয়া কি মিলন কি আস’। এরপর ভৈরবী পরিবেশন করলেন তন্ময় হয়ে। কিছুক্ষণ টোড়ি রাগের ছোঁয়াও পাওয়া গেল, তিনতাল ও দ্রুত একতালে। যোগিয়া, গুণকলি, ললিত, ভূপালি টোড়ি, বৈরাগী ও আনন্দ ভৈরবীর রাগমালা বাজিয়ে এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী শেষ করলেন তাঁর সরোদবাদন। তাঁর সঙ্গে সত্যজিৎ তালওয়ালকারের তবলা ও পন্ডিত ফতেহ সিং গঙ্গানির পাখোয়াজও শ্রোতাদের অপরিসীম তৃপ্তি দিয়েছে।

বেঙ্গল সংগীত উৎসবের পাঁচটি রজনী শ্রোতাদের অনাবিল আনন্দ দিয়েছে। এবারের উৎসবের আয়োজন ছিল বেশ ছিমছাম। শ্রোতাদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য এ-বছর তেষট্টি হাজার সংগীত অনুরাগী নিবন্ধিত হয়েছেন। দেশের সবপ্রান্ত থেকেই শ্রোতারা এসেছেন সংগীত উপভোগের জন্য। চতুর্থ রাতের অনুষ্ঠানে শ্রোতার সংখ্যা ছিল পঞ্চান্ন হাজার। সেই রাতে ময়দানের সীমানা ছাড়িয়ে শ্রোতারা ঠাঁই নিয়েছিলেন গ্যালারিতেও। চৌরাসিয়া যখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন তখন গ্যালারিতেও জায়গা হচ্ছিল না।

এই আয়োজনের প্রশংসা করেছেন অজয় চক্রবর্তী, পন্ডিত বিজয় কিচলু, যোগেন চৌধুরীসহ অনেকেই। সকলেই বলেছেন, ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান এখন বেঙ্গলের সংগীত-উৎসব। বাংলাদেশের শ্রোতাদেরও প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। এই উৎসব সম্পর্কে বিদুষী অরুণা সাইরামের মন্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বললেন :

আমরা এখন সবাই নভেম্বর মাসের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। বেঙ্গলের সংগীত উৎসব আজ সবখানেই সাড়া জাগিয়েছে। সবকিছু দেখে এই বিশ্বাস জাগছে যে, বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের রেনেসাঁস শুরু হয়েছে। সেই রেনেসাঁসে আমরা সবাই আলোকিত হবো।

অরুণা সাইরামের কথায় অতিরঞ্জন আছে বলে মনে হলো না। সত্যি বুঝি বাংলাদেশে সংগীত-রেনেসাঁসের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।