বেদনায় ভরা পেয়ালা

হাসান ফেরদৌস

হাসান আজিজুল হকের নতুন উপন্যাস, সাবিত্রী উপাখ্যান (ইত্যাদি, ঢাকা ২০১৩) একটি ধর্ষণের সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে নির্মিত। কিন্তু এটি ধর্ষণের বিবরণ নয়। সে-বিবরণ দেওয়াও লেখকের উদ্দেশ্য নয়। তিনি এখানে সাবিত্রী নামের এক বালিকার অভিজ্ঞতার পুনর্নির্মাণ করেছেন, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য, যে-ভীতি, অনিঃশেষ ক্রন্দন ও পাশবিক নির্যাতনের ভেতর দিয়ে সে বালিকাকে যেতে হয় – একদিন নয়, কয়েক মাস, বস্ত্তত তার জীবনের অবশিষ্ট প্রতিটি মুহূর্ত – তার সঙ্গে কেবল পরিচয় করানো নয়, আমাদের সে-অভিজ্ঞতায় অঙ্গীভূত করা। যেন ধর্ষণের শিকার কেবল সাবিত্রী একা নয়, এই গ্রন্থের প্রতিটি পাঠক।

বেদনা ও ভীতির এমন দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা আগে কখনো পড়িনি। একই সঙ্গে এমন মানবিক, এমন করুণ-কোমল, ভালোবাসার দুহাত দিয়ে আগলে রাখা এমন গল্পও খুব বেশি লেখা হয়নি। শুধু ভালোবাসা দিয়ে, স্নেহের আঁচল বিছিয়ে রেখে সেই বালিকাকে রক্ষা করা গেলে – এখনো, সে-ঘটনার প্রায় ৮০ বছর পরেও – লেখক তাই করতেন। যত পুরনো হোক না কেন সে-অপরাধ, তার অপনোদনের দায়ভার লেখকের, শুধু একজন পুরুষ বলেই নয়, বিবেকবান মানুষের তিনি প্রতিনিধি, সে-কারণেই। এই গল্প পুনর্নির্মাণের ভেতর দিয়ে পাপ স্খলনের চেষ্টা যেমন আছে, তেমনি আছে সাবিত্রী নামে সেই মেয়েটির এবং তার মতো আরো অসংখ্য জানা-অজানা নারীর কাছে – পৃথিবীর সকল বিবেকবান পুরুষের পক্ষে আন্তরিক ক্ষমাভিক্ষার আকুতি। বিবেকের ভেতর যে-ক্ষত, জমে থাকা যে-পুঁজ, তার শুশ্রূষা ও শুদ্ধির জন্যই এই পুনর্লিখন। আর এইখানেই সাবিত্রী উপাখ্যানের স্বাতন্ত্র্য।

ধর্ষণ নিয়ে অসংখ্য গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, বিস্তর নাটক ও ফিল্ম দেখার অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। তাতে সাবিত্রীর মতোই বালিকার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় সন্দেহ নেই, সেসব গল্পে ধর্ষণের শিকার যে-কোনো বালিকার অথবা রমণীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মৌল ভিন্নতাও নেই। কিন্তু এমন একজন কথকের দেখা পাইনি যিনি ঘৃণা ও ভালোবাসা, প্রত্যাখ্যান ও গ্রহণ – এই পরস্পর সংগতিহীন অথচ অবিভাজ্য/ যুগ্ম চেতনার এমন এক নিপাট সম্মিলন ঘটিয়েছেন।

উপন্যাসটিকে ‘উপাখ্যান’ বলা হয়েছে বটে, কিন্তু এই উপাখ্যানে গল্পের ভূমিকা কার্যত অপ্রাসঙ্গিক। গল্প নয়, অভিজ্ঞতাটিই মুখ্য। একটি কিশোরী, সদ্য বিয়ে হয়েছে, যদিও স্বামীসঙ্গ সে পায়নি, পুরুষ কী তাও সে জানে না। জীবন নিয়ে ছোট ছোট স্বপ্ন তার অবশ্যই আছে, কিন্তু সেসবের অধিকাংশই তার পরিচিত অভিজ্ঞতার বাইরে। পৃথিবীকে সে দেখে গৃহপরিচারিকা – যে তার একমাত্র কাছের বন্ধু, মায়ের মতো স্নেহশীলা, অথচ সে নিজেও কখনো কারো ভালোবাসার আশ্রয় পায়নি – তার মাধ্যমে। যে-ব্রাহ্মণপুত্রের সঙ্গে সাবিত্রীর বিয়ে হয়, সে-যুবক কেবল অথর্বই নয়, এমন সুচিস্নিগ্ধ-অনাঘ্রাতা-সকালে ফোটা ফুলের মতো নির্মল-বালিকার সে সম্পূর্ণ অযোগ্য। সে জানে না, জানার সুযোগও তার হয় না, কেমন সে-ফুলের গন্ধ। স্বামীর ব্যবসায় সাশ্রয় হবে,  সে-কথা জেনে নিজের একগোছা সোনার বালা মেয়েটি বন্ধক রেখে কিছু টাকা ধার করেছিল এক প্রতিবেশী যুবকের কাছ থেকে। নিজে নয়, সেই গৃহপরিচারিকাই টাকাটা এনে দিয়েছিল। স্বামী বালা ফেরত নেওয়ার জন্য টাকা পাঠিয়েছিল, কিন্তু বারবার চেয়েও সে-বালা আর ফেরত মেলে না। অবশেষে এক মধ্যস্থতাকারী – সেও নারী, যার বিবেকের কোনো দংশন নেই, জেনেশুনে এক নিষ্পাপ কিশোরীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে কোনো অপরাধবোধ নেই – এসে জানায়, মেয়েটিকে নিজে যেতে হবে সে-বালা ফেরত নিতে। বোকা মেয়ে, পৃথিবীর অন্ধকার বিষয়ে যার কোনো জ্ঞান নেই – সরল বিশ্বাসে সে বালা ফেরত নিতে এলে তিন পুরুষ-দুর্বৃত্তের হাতে আক্রান্ত হয়। শুধু পুনঃপুন পর্যায়ক্রমিক ধর্ষণই নয়, মেয়েটিকে আটকে রাখা হয় গোপন আস্তানায়। প্রথমে একটি হিন্দু যুবক, তারপর একজন মুসলমান যুবক তার ভোগদখল নেয়। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক শহর থেকে অন্য শহর, যেন সারা পৃথিবী চষে বেড়ানো হয় মেয়েটিকে নিয়ে। সর্বত্রই লোভী পুরুষ – তারা নানা বয়সের, কেউ সমাজের কীট, কেউবা সমাজের মাথা। সহানুভূতির আগ্রহ নিয়ে যারা এগিয়ে আসে, তারাও মেয়েটিকে কেবল নিখরচায় ভোগ্যবস্ত্ত ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না।

লেখক গোড়া থেকে সাবিত্রীর ভেতরের পৃথিবীটা দেখার-জানার চেষ্টা করেছেন। তার দিন-রাত্রির বেদনা ও দুর্ভোগের মানচিত্র কেমন, তা ভাবার চেষ্টা করেছেন। এক বেদনাভরা পেয়ালা সাবিত্রী, সে নিজের মৃত্যু কামনা করে, কারণ এই যে জীবন তা ভার বহন ছাড়া আর কিছু নয়। ভাগ্যের কাছে হার মানে সে, বলে,

আমার ভগোমানের দোহাই তোমাকে, আমাকে এইখানেই মেরে ফেল। যেমন করে তোমাদের খুশি। কেটে কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, বিষ খাইয়ে, জলে ডুবিয়ে যেমন করে খুশি। সে তোমাদের হত্যা হবে না; শুধু মরাকে আবার মারা হবে।

যে-পুরুষদের হাতে সে নিগৃহীত হয়, তারা কেউ সাবিত্রীকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়নি। লেখক সে-চেষ্টা করেছেন। এই অপরাধ সংঘটিত হয় লোকচক্ষুর আড়ালে, কিন্তু আকাশের চাঁদ তার সাক্ষী। সাক্ষী লেখকও, তিনি নিজেই যেন সাবিত্রী, বেদনার পাহাড় বুকে নিয়েও সে অপরাধের আনুপূর্বিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। রাক্ষুসী ক্ষুধা নিয়ে পুরুষ যখন সাবিত্রীর সামনে হাত বাড়ায়, মাথা কুটে সে তখন বলে, ‘আমি হিঁদু, মুসলমান কিছুই নই, আমাকে ছেড়ে দাও, শুধু ছেড়ে দাও।’ সে অস্ফুট ক্রন্দন-ধ্বনি কোনো পুরুষের লালসায় চিড় ধরায় না। ধর্ষক পুরুষ হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, জাত-পাতের ভেদাভেদ তার নেই। নিজের লালসার অগ্নিতে ঝলসানো এক পুরুষ-পশু, এছাড়া আর অন্য কোনো পরিচয় নেই।

ধর্ষণ সব সমাজেই একটি অপরাধ। অপরাধ বিবেচনা সত্ত্বেও তাকে ঢেকে রাখার, আগলে রাখার চেষ্টা সর্বত্রই। এই ঢেকে রাখার উদ্দেশ্য : ধর্ষণের মতো নোংরা কলুষতা যেন সমাজে না ছড়ায়। ভেতরের ময়লা ঢাকার জন্য সাফ-সুতরো কাপড় দিয়ে তা আড়াল করার চেষ্টা মাত্র, তাতে সর্বত্র ময়লা কখনো ঢাকা পড়ে না। অন্য উদ্দেশ্য, ধর্ষক – অনেক ক্ষেত্রেই যে সমাজের শক্তিমান প্রতিনিধি, তাকে রক্ষা। সাবিত্রী উপাখ্যানেও সে-নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। ধর্ষণ ও গুমের মতো অপরাধে দোষী জেনেও সবুর নামের এক যুবককে কার্যত নিজের ছাতার নিচে আশ্রয় দেয় তার নিকট আত্মীয়-স্বজন, কাছের-দূরের পরিচিত বন্ধু। পরে, এই অপরাধকে কেন্দ্র করে যখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গার সূত্রপাত হয়, তখন সমাজের মোড়ল-মাতববরদের দায়িত্ব পড়ে দাঙ্গা ঠেকাবার জন্য সে-অপরাধকে আগলাবার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সে-অপরাধ গোপন থাকে না। দাঙ্গার উপক্রম হতেই থানা-পুলিশ-আদালত, সভ্য সমাজের সকল কলকব্জাই সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবারের লক্ষ্য জনসমক্ষে সে-অপরাধের বিচার। যে-অপরাধ তারা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে, এবার তার শব ব্যবচ্ছেদ হবে সর্বসমক্ষে। প্রতিদিন, অসংখ্য পুরুষের জোড়া চোখের সামনে, ঘোমটা খুলে দাঁড়াতে হয় সাবিত্রীকে। যে-অপরাধ এতদিন সংঘটিত হয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে, এবার তারই মহড়া চলে জনসমক্ষে। এই কিশোরী মেয়েটি – এখনো সে কিশোরী বই অন্য কিছু নয় – যার যার গোপন চোখে তাকে দেখে ভোগ্যপণ্য হিসেবে। যার যার ফ্যান্টাসিতে পুনঃপুন ধর্ষিত হয় সে। সে নষ্টা, ধর্ষিতা। হোক না সে শরীরী সম্পর্ক তার সম্মতিবিহীন, কিন্তু সুভোগ্যা তো সে! আদালতে ধর্ষণের বিবরণ, যার আইনি ভাষার প্রতিবেদন লেখক মূল নথি ঘেঁটে উদ্ধার করেছেন, অপরাধ-সীমানার অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো পুরুষের কাছে তা সুপাঠ্য ‘পর্নোগ্রাফি’ হয়ে ওঠে। সাবিত্রী – একাকী, দুঃখী বালিকা, আদালতের সকল তর্ক-বিতর্ক থেকে পালাতে পারলে যে বাঁচে – এইভাবে প্রতিদিন, বারবার ধর্ষণের শিকার হয়। সাধারণ মানুষ, যারা কেবল লোকমুখে শোনা গল্পগাথা থেকে সে-ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হয়, তাদের চোখেও আসল অপরাধী সাবিত্রী। তাকে নিয়ে দু-চারটে গান রচিত হয়ে যায়, গরুর রাখাল, মাঠের মুনিষ সে গান ধরে – ‘সাবিত্রীর এই যাওয়াতে ছেড়েছে পতি – কিসের কারণে মেয়েমানুষ এমন কুকর্মে মতি।’

ধর্ষণ ও সহিংসতার মধ্যে সম্পর্ক অনিবার্য, কিন্তু ধর্ষণ ও যৌন আনন্দ, এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র রয়েছে? হাসান আজিজুল হকের উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে এমন প্রশ্ন জাগে। যে নির্বিকার ও হিতাহিত-বিবর্জিত তাড়নায় প্রতিটি পুরুষ সে-ধর্ষণে অংশ নেয়, তাতে এ-প্রশ্নের উত্তর যে ‘হ্যাঁ’-বাচক, তাতেও কোনো সন্দেহ থাকে না। যৌনতার একটি সম্মিলিত, তথা ‘কালেকটিভ’ চরিত্র রয়েছে। ফ্রয়েডের মাধ্যমে আমরা জানি, জাতি-ভাষা-ধর্ম ও বয়সের তারতম্য সত্ত্বেও, অধিকাংশ পুরুষের ‘যৌন ফ্যান্টাসি’র চরিত্র অভিন্ন। এর শুরু শৈশবে, জনক-জননীর যৌন-সম্ভোগ দৃশ্য অবলোকনের মাধ্যমে। শিশুর চোখে পিতা ঘাতক, সে আক্রমণকারী, ফলে যৌনতার প্রতি তার বিবমিষা জন্মে। অথচ মাতার চোখে-মুখে শীৎকারের আনন্দ শিশুর মনে দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। এই দুই বিপরীতমুখী বোধ ও বৃদ্ধি দ্বারা পুরুষের যৌনতাড়না পরিচালিত। ফলে, আপাতনিন্দা সত্ত্বেও গোপনে সে ধর্ষণে আনন্দ আবিষ্কারে সমর্থ। আদালতে যখন গফুর ও তার সতীর্থদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, তাতে থাকে যৌন সহিংসতার প্রতি বিবমিষা। কিন্তু কাঠগড়ায় কেবল গফুর ও তার বন্ধুরাই নয়, সাবিত্রীও। আর তাতেই প্রকাশিত হয় পুরুষের যৌন ফ্যান্টাসি।

কৌতূহলের বিষয় হলো, সাবিত্রীর অভিজ্ঞতার এই পুনর্নির্মাণ ঘটেছে এক পুরুষ লেখকের হাতে। দেশ বিভাগের আগে, বীরভূমের এক অখ্যাত গ্রামের একটি ঘটনা, তাকে প্রতীক হিসেবে নির্বাচন করে সকল ধর্ষক ও তার সহযোগীদের অপরাধী চিহ্নিত করেছেন তিনি, যারা সে-ধর্ষণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের হয়ে সাবি দেবীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। এই গ্রন্থের নির্মাণ সেই ক্ষমাভিক্ষারই অংশ। ধর্মীয় বিভক্তির প্রশণটি লেখকের মনে ছায়ার মতো ঘোরে, তিনি একটি হিন্দু বালিকার একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতরচিত্র নির্মাণ করেছেন, এই সচেতনতা থেকেও তিনি কখনো বিচ্যুত হন না। জাত-পাত ও ধর্মে শত বিভক্ত উপমহাদেশ, অথচ নারীদেহের প্রতি পুরুষের লালসা – তা সে যে-ধর্মের বা বর্ণেরই হোক না – সবার সমান।

উপমহাদেশের সাহিত্যে ধর্ষণ নিয়ে উপন্যাসের অভাব নেই। সেসবের অধিকাংশই লিখিত হয়েছে পুরুষের হাতে, যাতে ব্যক্তিগত নৈতিকতার প্রশ্নটিই কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে। হাসান আজিজুল হকও নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত নৈতিকতার বদলে সম্মিলিত নৈতিকতা – ও তার অনুপস্থিতির – কথাতেই তাঁর আগ্রহ। সাবিত্রীর প্রতি যে-আচরণ তার জন্য একা দুর্গাপদ, বটা ও সবুর দায়ী নয়, যারা এই ঘটনার নীরব সাক্ষী, তারাও প্রত্যেকে সে-অপরাধের সহযোগী। এমনকি আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতিনিধি, যাদের দায়িত্ব ছিল এমন ঘটনার প্রতিকার, তারাও অপরাধী। যারা জেনে অথবা না জেনে সাবিত্রীকে নষ্ট মেয়ে ভেবেছে, তারাও। যারা এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা করে, তারাও। এক অর্থে, সাবিত্রী উপাখ্যান ‘শুধু পুরুষ’ এভাবে পরিচিত মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আহত, নিরুদ্ধ বেদনায় ক্লিষ্ট এক বাঙালি লেখকের সক্রোধ বিচারদন্ড।

ইতিপূর্বে ধর্ষণভিত্তিক যে-সাহিত্য আমরা পড়েছি, তাতে নারীর শরীর ও সে-শরীরের মর্যাদা লঙ্ঘনের বিষয়টিই অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের সমাজে নারীর সতীত্বের প্রতি একটি আরোপিত ও অতিরঞ্জিত গুরুত্ব রয়েছে, সে-মূল্যবোধের প্রতিফলনই দেখি সাহিত্যে। এমনকি মহিলা লেখকেরা যখন এই বিষয়ে আলোকপাত করেন, তাতেও নারীর শরীর অলঙ্ঘনীয় – কারণ এটি পবিত্র – এই বোধের প্রকাশ দেখি। যৌন আগ্রাসন নিয়ে যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা অনেকেই নারীর দেহকে তার ব্যক্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু ‘অবলোকন ও নির্যাতনে’র (সারভেইল্যান্স অ্যান্ড অ্যাগ্রেশন) প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। নারীর দেহ যে পুরুষের লালসার শিকার, সে-প্রশ্নে হাসান আজিজুল হকের উপসংহার খুব যে ভিন্ন তা নয়, কিন্তু সে-উপসংহারে পৌঁছতে তিনি একই সঙ্গে যৌনতার সহিংস তীব্রতা ও সে-আগ্রাসনের মুখে নারীর অসহায়ত্ব – এই বাইনারি সম্পর্কজাল অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। কখনো কখনো নারীর প্রতি পুরুষের সহিংস যৌন আগ্রাসন সাহিত্যের পাতায় পুরুষের গোপন যৌন বাসনার প্রকাশ ও সে-প্রকাশের প্রতি অনুচ্চ সমর্থন হিসেবে প্রকাশিত হয়। যেমন, উইলিয়াম ফকনারের সাংচুয়ারি উপন্যাস নিয়ে সে-অভিযোগ আছে। কিন্তু হাসান আজিজুল হক নারীর শরীর নয়, সে-শরীরের লঙ্ঘন – তার বিরুদ্ধে নিরন্তর আগ্রাসনকে – তার বিবেচনার কেন্দ্রীয় বিষয় করেছেন। যারা সে-লঙ্ঘনে অভিযুক্ত, তাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনাতে লেখকের বিবমিষা। সে মানুষ নয়, বড়জোর ষন্ডা একটি মোষ অথবা শূকর।

এর মধ্যে ষন্ডা মোষটা উঠে গিয়ে ঘাসে মুখ মুছছে। মনে হচ্ছে, এখন সাবিত্রীর ওপর সটান শুয়ে পড়েছে সবুর। সবিত্রীর শরীরের অনেকটাই এখন খেয়ে-নেয়া, হু-হু জ্বলছে সর্বাঙ্গ, চামড়া ঢাকা হাড়গোড় পড়ে আছে মাটিতে। সবুর সময় নিচ্ছে অনেকটা, তার যেন তাড়াহুড়ো নেই। বেশ আরেস্তার সঙ্গে খেতে চাইছে, দাঁত-নখ মেলে ধরেনি সে, তার দাঁত এখনো রক্তমাখা হয়নি, ফোঁটার ফোঁটায় রক্ত ঝরছে না তার জিভ থেকে। যেন সে মর্গের টেবিলে শোয়া একটা গোটা শব পেয়েছে এখন।

ধর্ষণের ধরন সব সময়েই এক, তা সত্ত্বেও লেখক পুনঃপুন সে-অভিজ্ঞতার দীর্ঘ বর্ণনার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন, সম্ভবত এই উদ্দেশ্যে যে, সাবিত্রী যে পীড়ন ও যন্ত্রণায় দগ্ধ, পাঠককে সে-অভিজ্ঞতার অঙ্গীভূত করা। তিনি সচেতনভাবে কখনোই হরিপদ, সবুর বা অন্য পুরুষদের চোখে সে-ধর্ষণের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন না। তেমন চেষ্টার ফলে লেখকের অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্পূর্ণ বিপরীত ফললাভ ঘটতে পারে। পুরুষ পাঠক তার অজ্ঞাতে সে-ধর্ষণের একজন নীরব অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু হাসান আজিজুল হক ধর্ষণের কাহিনি নির্মাণে তাঁর লক্ষ্য থেকে কখনোই বিচ্যুত হন না। সাবিত্রীর শরীর নয়, তার বেদনাকে তিনি ছুঁতে চান, তাকে ভাগাভাগি করতে চান। সাবিত্রীর অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য একটি প্রতীকী অস্ত্র, সে শুধু আগ্রাসনের শিকার নয়, প্রতিরোধের ও প্রতিবাদের অশ্রুত কণ্ঠস্বরও বটে। এই প্রতিবাদটি যতটা না সাবিত্রীর, তার চেয়ে অনেক বেশি লেখকের। সাবিত্রীর শরীর পুনঃপুন লঙ্ঘিত হচ্ছে, প্রতিরোধের সকল শক্তি তার নিঃশেষিত। লেখক তাকে নিজের শক্তি ধার দিতে চান। অসহায় সাবিত্রী ভাগ্যের কাছে হার মানে, সমাজের কাছে হার মানে। এই হার মানাকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে চান লেখক। আমরা দেখি এই গল্পে সাবিত্রী তার শরীর ও মন দুটোই হারায়। লেখকের হাত ধরেই আমরা সে-কথা জানি, কিন্তু আমরা এ-কথাও উপলব্ধি করি যে, তিনি পাঠককে বলতে চান, ‘এই পরাজিত মানব শিশুকে রক্ষার দায়িত্ব তোমারও ছিল, এখনো আছে। পৃথিবীতে আর কখনো যেন কোনো সাবিত্রীকে এই দুঃসহ বেদনার ভেতর দিয়ে যেতে না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তোমার।’

সাবিত্রী উপাখ্যানে হাসান আজিজুল হক একদম গোড়া থেকেই এই দায়িত্ববোধ দ্বারা চালিত হয়েছেন। প্রথম অধ্যায়ে একটি অলক্ষ্য কণ্ঠস্বর – যেন একটি তৃতীয় পক্ষ – তার মাধ্যমে সাবিত্রীর গল্পটি আমরা শুনি। কিন্তু না, তেমন অলক্ষ্য কণ্ঠস্বরে লেখকের উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়। গল্প বয়ানে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করতে চান, তাঁর কণ্ঠস্বর তাতে যুক্ত করতে চান, কারণ এই গল্পের বোঝাপড়া তাঁর নিজের ও পাঠকের মধ্যে। সাবিত্রীকে তিনি চেনেন, তার বেদনার ভাষার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। তার চেয়েও বড় কথা, এ-গল্প শুধু সাবিত্রীর একার নয়, তাঁরও। যারা সাবিত্রীর কৈশোর হরণ করেছে, বিবাহিত জীবনের আনন্দ লুণ্ঠন করেছে, যারা তাকে একটি নির্জীব বেদনার বরফ-পাথরে পরিণত করেছে, সেই সব মানুষ – হায়! তবু তাদের মানুষই বলতে হয় – তাদের সঙ্গে একটি পুরনো হিসাব মেটাতে চান তিনি। আদালত তাদের কী বিচার দিলেন বা দিলেন না, কিচ্ছু আসে-যায় না। এখন তিনি নিজে বিচারক, রায় ঘোষণার সকল দায়িত্ব কেবল তাঁর একার। হরিপদ অথবা সবুর, সৈয়দ সাহেব অথবা হুদা, তারা বেঁচে থাকুক অথবা মৃত, তাতেও কিছু আসে-যায় না। মানুষের স্মৃতিতে তারা জন্ম-জন্মান্তরে পরিচিত হবে ধর্ষক হিসেবে। মানুষ অথচ মানুষ নয়। এই তাঁর রায়।

মহাফেজখানা খুঁড়ে তিনি এই কাহিনি উদ্ধার করেছেন শুধু এই জন্য যে, একজন সাবিত্রী যেন হারিয়ে না যায়। ইতিহাসে সে হারাক তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু আমাদের বিবেকে যেন তার স্থান সুনির্দিষ্ট থাকে।

আশি বছর আগের ঘটনা, এতদিনে সেই সাবিত্রী মাটির সঙ্গে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু না, একজন লেখকের ক্ষমতা আছে সাবিত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার – আমাদের স্মৃতিতে, আমাদের চেতনায়, আমাদের বিবেকের নিবু-নিবু লণ্ঠনের পাশে।

এই ভাঙ্গাচোরা চূর্ণ-বিচূর্ণ সাবিত্রী তার দেহটিকে বিনাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও আটকাতে পারেনি। কিন্তু তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে একজন অনশ্বর সাবিত্রী। তার দেহ নেই তবু সে অলৌকিক নয়, অতিপ্রাকৃতিক নয়। ঠিক জীবন যেমন সে-ও তেমনি। রোদ মেখেছে, বাতাসে ভেসেছে, জলে ভিজেছে, ফুলের ঘ্রাণ নিয়েছে, কখনো বা একটি-দুটি মল্লিকার সাথে মৃদুকণ্ঠে আলাপও করেছে।

হাসান আজিজুল হক, সাবিত্রী উপাখ্যান গ্রন্থটির জন্য আমাদের বিনম্র কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। লেখক হিসেবে নিজের দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। পাঠক থেকে মানব হবার দায়িত্ব এখন আমাদের নিজেদের।