ব্রিফকেস

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র একটা ব্রিফকেসের গল্প জুড়ে দিলো। তার গলা এমনিতে নিচু, তারপর তোতলামি আছে কিছুটা। আর গল্প যদি বলতেই হয় বাবা, মৌচাকের সামনের জলকাদা আর আবর্জনাময় রাস্তার কাঁধটা কেন বেছে নেওয়া? রাস্তা দিয়ে বাস ট্রাক রিকশা যাচ্ছে যে যার মতো সময় নিয়ে, আর মোহাম্মদ আলী ইনিয়ে-বিনিয়ে মুখ খিঁচিয়ে ব্রিফকেসের গল্প করছে। রাস্তার শব্দ তার গল্পকে গিলে খাচ্ছে, অথচ গল্পটা তো আমাকে বলা, রাস্তার শব্দকে নয়।

আমি একটু বিরক্ত হলাম। একটু আগে পারুল ডায়াগনস্টিকে রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করতে

দিয়ে এসেছি। পূতিগন্ধময় টয়লেটে অন্ধকার আর আরশোলা ডিঙিয়ে একহাতে ইয়ে ধরে অন্যহাতে ছোটগলা টেস্টটিউবে অনেক কসরত করে ধারাটি ঢোকাতে গিয়ে … যা হোক শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে : হাত ভিজে, প্যান্টের সামনা ভিজে, একাকার। অনেকদিন ধরে বহুমূত্রের ভয় আমাকে পেয়ে বসেছে। গাল ভেঙে শরীর শুকাচ্ছে। ওজন কমছে। স্ত্রী তাড়া দিচ্ছে চেকআপের জন্য। আজ পারুল ডায়াগনস্টিক থেকে বেরিয়ে মতিঝিল যাওয়ার কথা। আজ শুভদিন। পূবালী ব্যাংকে ইস্তফা দিয়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে চাকরি শুরু করার দিন আজ। মনটা ফুরফুরে। শরীরে বহুমূত্র যদি থাকেও আমার – আল্লাহ না করুন – মনে কিন্তু আমার বহুমূত্র নেই। মন আমার তরতাজা, গোলগাল। শুধু মাঝে মাঝে মনের মধ্যে অম্ল হয়, পিত্তজ্বালার মতোই কষ্ট হয়, তখন ভাবি আমি কী ছিলাম, কী হলাম। অথবা কী আছি, কী হতে পারতাম।

ভালো করে হাত ধোয়া হয়নি – পানি কোথায় যে ধোব? একটা টিস্যু কাগজ দিয়ে মুছে নিয়েছি। সেই হাত জড়িয়ে ধরে মোহাম্মদ আলী বলেছে, ‘কী সৌভাগ্য, ইকবাল ভাই যে?’

আমি হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ইকবাল ভাই বটে, কিন্তু তুমি কোত্থেকে?’

মোহাম্মদ আলী বলল, সে এখন সিদ্ধেশ্বরী থাকে। সাত সকালে বেরিয়েছে ব্রিফকেসওলার খোঁজে। এক হাতে ব্রিফকেস নিয়ে একজন তার আগে আগে এইখান দিয়ে গেছে। ‘দেখেছেন আপনি, ব্রিফকেস হাতে মানুষটাকে?’

মোহাম্মদ আলীর কোনোকালে মাথা খারাপ ছিল, মনে পড়ে না। এখনো দেখে মনে হচ্ছে না মাথা খারাপ। তবুও, চোখ দেখে সন্দেহ হলো, হতেও পারে। চোখদুটি লাল, আর ঠিকরানো, যেন মরিচের গুঁড়া পড়েছে।

তারপরও তার হাসিতে কোনো পাগলামি নেই। অপাগল হাসি, ক্যাশে বসার আগে হাফ দেয়ালের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন সকালে যে-হাসিটা সে দিত।

মোহাম্মদ আলী, বলতে ভুলে গেছি, পূবালী ব্যাংক ছাতক শাখার ক্যাশিয়ার ছিল। আমি ছিলাম জুনিয়র অফিসার। হাফ দেয়ালের ওপারে আমার টেবিল, এপারে কাউন্টার, খোপে তার উঁচু চেয়ার। না হাসলেও পারত, কিন্তু হাসাটা ছিল তার অভ্যাস। তার হাসিতে ভিজতেন এনামুল হক লাবলুও। ঘোড়েল ম্যানেজার, কাঁচঘেরা ঘরে বসতেন ব্যাংকের এক কোণে। মোহাম্মদ আলীর হাসিটা সেই দূরত্ব অতিক্রম করে তাঁকেও স্পর্শ করত। কিন্তু একদিন মুখের হাসিটা তার মিলিয়ে গেল। দেখা গেল, লাখ সাতেক টাকার কোনো হিসাব নেই। মোহাম্মদ আলীকে সৎ বলে সবাই জানত, অন্তত সে অসৎ, এরকম অপবাদ কাউকে দিতে শুনিনি। তবে সবার চোখে ধরা পড়ত না, তা হলো তার অগোছালো স্বভাব। শৃঙ্খলার অভাব। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, এরকম বেখেয়ালি মানুষের কোনো ব্যাংকের ক্যাশিয়ার হওয়া উচিত নয়।

আমার মনে হওয়াটা ঠিকই ছিল। ক্যাশে তালা না মেরে উঠে গিয়েছে কোনদিন সে চা খেতে, কে জানে। আমিও হয়তো গিয়েছি প্রকৃতির ডাকে, কে জানে। ঘন ঘন প্রকৃতি ডাকে বলেই তো আমার স্ত্রী আমাকে যুদ্ধ করে ঠেলেঠুলে পারুলে পাঠিয়েছে।

মোহাম্মদ আলী আবার আমার নাপাক হাত টেনে ধরে। ‘ইকবাল ভাই, ব্রিফকেস হাতে মানুষটাকে দেখেছেন? আপনি তো এদিক থেকেই আসছেন।’ ‘না, দেখেনি,’ আমি বললাম, ‘কিন্তু কে সেই ব্রিফকেসওলা মানুষ?’

‘এনামুল হক লাবলু’ বলল মোহাম্মদ আলী, আর ঠাঠা করে মৌচাক কাঁপিয়ে হাসল। অনেকক্ষণ।

আমার মনে পড়ল, পুলিশ মোহাম্মদ আলীকে ধরে নিয়ে গেলে খুব হইচই হয়েছিল। ছোট শহর ছাতক, এমনিতে জেগে ঘুমোবার কথা পুলিশের। কিন্তু এক মন্ত্রী গিয়েছেন ছাতকে, একটা মন্ড কারখানা উদ্বোধন করতে। সঙ্গে প্রচুর সাংবাদিক। তহবিল তসরুফের দায়ে মোহাম্মদ আলীকে থানায় ধরে নিয়ে গেলে সাংবাদিকরা সব ছুটেছেন থানায়। কোথায় ম্যাজমেজে মন্ড কারখানা, আর কোথায় তরতাজা তহবিল তসরুফ। সেই সাংবাদিকদেরই একজন দেখা গেল এনামুল হক লাবলু থেকেও ঘোড়েল। ঘণ্টা তিনেকের ভেতর সে খবর পেয়ে গেল আসল রহস্যের।

কালো ব্রিফকেস হাতে এক লোক এনামুল হক লাবলুর ভাড়া করা বাসায় ঢুকেছে হন্তদন্ত হয়ে। গলির মোড়ে লন্ড্রিওলা দেখেছে। তার সন্দেহ হয়েছে, লোকটা অস্থানীয়। লাবলুও অস্থানীয়। আমিও। তবে মোহাম্মদ আলী স্থানীয়, তার বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই।

সাংবাদিকরা মন্ত্রীর সফরসঙ্গী। তাঁদের খুশি করতে হয়। পুলিশ গেছে লাবলুর বাসায়। লাবলু একাই থাকেন ছাতকে, স্ত্রী ও কন্যা থাকে শ্বশুরবাড়ি, ঢাকায়। অনেক চেষ্টা-তদবির করে ঢাকায় বদলি হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত করে এনেছিলেন ভদ্রলোক। লাবলুর বাসাটা দিনের বেলা বন্ধই থাকে, শুধু সন্ধ্যায় একজন বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়।

বাসার শোবার ঘরে চৌকির নিচ থেকে ব্রিফকেস বেরুলো। কালো রঙের। ভেতরে দুই লাখ টাকা।

আসল রহস্যের খবর পাওয়া গেছে বলেছিলাম, আসলে অর্ধেক রহস্যের। কারণ লাবলু অস্বীকার করলেন। প্রবলভাবে অস্বীকার করলেন। বললেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। কে ফাঁসিয়েছে? কেন মোহাম্মদ আলী। বটে, কিন্তু মোহাম্মদ আলীর ঘর তন্নতন্ন করেও তো টাকাটা পাওয়া গেল না। হ্যাঁ হ্যাঁ, পাবেন কী করে। আসল জায়গাই তো দেখেননি। একটা কার্ডফোন থেকে থানায় জানানো হলো কথাটা। ছাতকের একমাত্র কার্ডফোন থেকে। থানা থেকে একশ গজ দূরে যার অবস্থান। কিন্তু কার্ডফোনের ধারেকাছে কেউ নেই। কেউ বলতে পারল না, ঠিক কে ফোন করেছে এখান থেকে একটু আগে। আধাঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে ৮১ জনের সন্ধান দিলো মানুষ। বেচারা পুলিশ।

আসল জায়গা হচ্ছে রামকানাইয়ের ফ্রিজ-টিভির দোকান আরকে ইলেকট্রনিক্স। মোহাম্মদ আলী পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে একটা টিভি কিনেছে। টিভিটা বাড়িতে নেয়নি, পুরো টাকাটাই বায়না করে গেছে গত সন্ধ্যায়। রামকানাই বলল, মোহাম্মদ আলী নিজে আসেনি, লোক মারফত পাঠিয়েছে। কোন লোক? কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফওলা এক ভদ্রলোক, কথা শুনে মনে হয়েছে ভাটির দিকের মানুষ।

সব শুনে মোহাম্মদ আলী বলল, স্টুপিড, আমি কেন আরেকজন মানুষের হাতে দিয়ে টাকা পাঠাব? পুলিশ বলল, সেটা আদালতে বলবেন।

এনামুল হক লাবলু এবং মোহাম্মদ আলীর চাকরি গেল। অনুসন্ধানে দেখা গেল, বিভিন্ন সময়ে এই ব্যাংক থেকে ৪৭ লাখ টাকা এভাবে খোয়া গেছে। কিন্তু লাবলু রিপোর্ট করেননি হেড অফিসে, অথবা জোনাল অফিসে। অবাক কান্ড! এমন নিখুঁত জালিয়াতি, সহজে চোখে পড়ার কথাও নয়। ম্যানেজারের দায়িত্ব পেল ওয়াহিদুজ্জামান। লোকটা দারুণ অভদ্র। আমার ভালো লাগত না কখনো। তাছাড়া মোহাম্মদ আলী নেই, লাবলু নেই। ব্যাংকে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। চেষ্টা-তদবির করে বদলি হলাম ঢাকায়। পেছনে তার স্ত্রী থাকেন। আমি লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ডাচ্-বাংলায় ঢুকেছি, সেই অর্থে আমি সফল। এবং আমার সাফল্যের পেছনে আছে আমার স্ত্রী।

অথচ পারুল ডায়াগনস্টিকে আজকের মাখামাখি সকালটা সেই সাফল্যের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। তার ওপর মোহাম্মদ আলী।

‘এনামুল হক লাবলু এসেছেন ব্রিফকেস হাতে, এই রাস্তা দিয়ে?’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।

‘এনামুল হক লাবলু। হ্যাঁ।’ প্রতিটি শব্দ সে জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করে। ‘সাত লক্ষ টাকা নিয়ে এসেছেন। সাত লক্ষ টাকা ফেরত দিয়ে আমি চাকরি ফেরত পাব। তারপর এনামুল হক লাবলুকে আমি দা দিয়ে কুটিকুটি করে কেটে সুরমা নদীতে ফেলে দেব।’

মোহাম্মদ আলীর ক্রোধ তার মুখের হাসিটা মুছে ফেলে, কিন্তু আমার দিকে তাকাতে তাকাতে সেই হাসিটা আবার ফিরে আসে। ‘আপনার তো তাকে দেখবার কথা, ইকবাল ভাই। দেখেন নাই? এই দিকেই তো গেল।’ সে জিজ্ঞেস করে।

আমি মাথা নাড়ি। তার সঙ্গ আর ভালো লাগছে না। এখন আমার ইচ্ছা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে উড়ে যাওয়া, কাজে যোগ দেওয়া, এবং যোগ দেওয়ার আগে বাথরুমে ঢুকে সাবান দিয়ে ঘষেডলে হাত ধোয়া। আমার মনে হচ্ছে হাত থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে।

মোহাম্মদ আলী বলল, সে এই রাস্তার মোড়ে প্রতিদিন একবার এসে দাঁড়ায়, ব্রিফকেস হাতে সেই মানুষটির আশায়।

‘এনামুল হক লাবলুর জন্য তোমার এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা’ আমি তাকে বলি, না-প্রশ্ন না-বক্তব্যের মতো করে। যেন আমি অপ্রশ্ন করছি তাকে।

‘কে বলছে এনামুল হক লাবলুর জন্য আমি প্রতীক্ষা করছি, ইকবাল ভাই?’ মোহাম্মদ আলী বলে, আর হেসে ওঠে, যেন একটা গুরুতর হাসির কথা বলেছি আমি।

‘কেন, একটু আগেই যে বললে তুমি? আরো বললে তাকে পেলে তুমি কেটে কুটিকুটি করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে।’

‘না। লাবলুর ওপর আমার রাগ নেই, তারও কোনো চাকরি নেই, আমার মতো।’ মোহাম্মদ আলীর হাসি মিলিয়ে যাওয়া চোখেমুখে আবার কাঠিন্য জমে। ‘তাছাড়া … লাবলুর ব্রিফকেস কোথায় যে হাতে করে নিয়ে আসবে?’

‘ও,’ আমি নিস্পৃহভাবে বলি, সাক্ষাৎকার সংক্ষিপ্ত করার জন্য।

‘ব্রিফকেস হাতে মানুষটা অবশ্য এদিক দিয়েই গেল, ইকবাল ভাই, অথচ আপনি ধরতে পারলেন না। কী যে হয়েছে আপনার। যান অফিস যান। দেরি করিয়ে দিলাম।’

‘হ্যাঁ যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাই’ বলে আমি একটা রিকশার দিকে পা বাড়াই। মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। বেচারা।

‘নতুন ব্যাংক, মাইনেপত্র নিশ্চয় ভালো, তাই না ইকবাল ভাই?’ মোহাম্মদ আলী জিজ্ঞেস করল। ‘তেমন আর কী, এই চলে যাবে,’ বলতে বলতে আমি রিকশায় উঠে বসলাম। কিন্তু বসতেই মনে হলো, এই নতুন চাকরির কথা মোহাম্মদ আলী জানল কী করে! অবাক কান্ড। তার সঙ্গে আমার দেখাই হলো বছর তিনেক পরে। এর মধ্যে লোক মারফতও যোগাযোগ হয়নি। আবার পাগলামির ভাবভঙ্গিও দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে।

 

দুই

কিন্তু ভাবাভাবির সময় নেই। নতুন ব্যাংক, কাজের প্রথম দিন। ব্যাংকে ঢুকতেই সামনাসামনি পড়েছেন ম্যানেজার, হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অভ্যাসবশত হাত মিলিয়েছি। তারপর মনে পড়েছে, হাত ধোয়া হয়নি। বিরক্তির ভাব এলো মনে, কিন্তু তার পরই একটু কৌতুকেও লাগল। ম্যানেজারের হাতে এখন আমার শিশিরের স্পর্শ, তার গন্ধ। কৌতুক বোধ হতেই নতুন পরিচিত হওয়া সবার সঙ্গে হাত মেলালাম। সবার হাতেই এক ফোঁটা করে শিশির। হা হা।

লাঞ্চের সময় হাঁটতে হাঁটতে স্টক এক্সচেঞ্জে গেলাম। সূচক নেমেছে, সেই কবে থেকেই নামছে। কিন্তু তাতে আমার তেমন একটা যায় আসে না। শেয়ারবাজারটা যখন চৌরাস্তার মাতালের মতো টালমাটাল ছুটছে, পড়ে যাবার গন্ধটা তাড়িয়ে নিচ্ছে তাকে, তখনি আমার শেয়ার কেনা এবং বেচা হয়ে গেছে। বিকিকিনির মূল পাট চুকে গেছে। নিজের লাখ দশেক, স্ত্রীর দুই। এখন সে টাকা কাচ্চা-বাচ্চা বিইয়ে নাতিপুতি গজিয়ে এক কোটির ওপর। ওমর ইমাম সিকিউরিটির ইমাম ভাই বলেছেন, ‘একটা ফ্ল্যাট দেখব আপনার জন্য, ইকবাল সাহেব? রিয়েল এস্টেটে মন্দা যাচ্ছে। এখুনি কিনে ফেলেন।’

‘টাকাটা এভাবেই খাটুক, ইমাম ভাই। চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বাঁধতে নেই।’ আমি বলি। কিন্তু এ-কথাটা আর বলি না যে, একটা ফ্ল্যাট আমার ইতোমধ্যে কেনা হয়ে গেছে, মালিবাগে।

 

তিন

স্ত্রীকে ফোন করে বলি, পারুল থেকে রিপোর্ট নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা বাজবে।

মৌচাকের উল্টোদিকেই রাস্তা ঘেঁষে ওঠা উঁচু একটা দালানে আমি থাকি। আমরা থাকি। পারুলে ঢুকতে ঢুকতে মনে হলো, না, আধাঘণ্টা আগেই পৌঁছে যাব।

কাউন্টারে বসা বিরস চেহারার একটা লোক তাচ্ছিল্য ভরে একটা খামে ঢোকানো রিপোর্টটি দিলো আমার হাতে। আর তাতেই হাতে পায়ে যেন কাঁপন লেগে গেল। যদি রিপোর্ট লেখে, মহা ডায়াবেটিস আমার? তরল শর্করায় থইথই করছে আমার শরীর? তাহলে? খুলে দেখতে ভয় হচ্ছে, কিন্তু প্রবল একটা আকর্ষণও আছে। কিন্তু হাতের ঠকঠকানির জন্য খুলতে পারছি না। কড়া নিয়নের আলোয় আমাকে একটা ক্লাউন অথবা ভূত দেখা মানুষের মতো লাগছে।

ধুত্তুর। বাসায় গিয়ে দেখব।

পারুল থেকে বেরিয়ে একটুখানি পথ, তারপর মৌচাকের সামনের ত্রিরাস্তা। কিন্তু পথ দখল করে দাঁড়িয়ে আছে মোহাম্মদ আলী।

মোহাম্মদ আলী?

‘আরে, ইকবাল ভাই যে? কি সৌভাগ্য! একদিনে দুবার দেখা?’

‘তাই তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে কেন?’

‘ইকবাল ভাই, ওই ব্রিফকেসের কথাটা বলেছিলাম মনে আছে? এবং ওই ব্রিফকেসওলার কথা?’

আমি বিরক্ত হচ্ছি মনে মনে, কিন্তু সেই বিরক্তি প্রকাশ করা চলবে না, পাগল বলে কথা।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিন্তু কে সেই ব্রিফকেসওলা?’

‘কে আবার, এনামুল হক লাবলু।’

আমার এবার ক্রোধ হয়। ‘দ্যাখো মোহাম্মদ আলী, একটা লম্বা দিন গেছে। মনমেজাজ ভালো নেই। এখন হেঁয়ালি শোনার সময় আমার নেই। আরেকদিন।’

আমার শার্ট টেনে ধরল সে। ‘আমার দিনটাও খুব লম্বা গেছে, ইকবাল ভাই।’ সে বলল, ‘চাকরি নেই, টাকা নেই, থাকার মতো জায়গা নেই। সিদ্ধেশ্বরীতে থাকি বলেছিলাম, তাই না? হা হা।’ খলখল করে হাসে মোহাম্মদ আলী, খলখলিয়ে বলে, ‘থাকাই বটে, একটা দোকানের পেছনের ঘরের একটা বেঞ্চিতে। হা হা।’ তার হাসি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। ‘অথচ’, হাসি থামাতে থামাতে সে বলে, ‘আপনি কত আরামে থাকেন। বাড়ি হয়েছে। নিজের বাড়িতে হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে কেমন লাগে, ইকবাল ভাই? শুনেছি নিজের বাড়িতে মানুষ ন্যাংটো ঘুরে বেড়াতে পারে। এমনি সুখ।’

আমার শরীর হিম হয়ে যায়। তিন বছর দেখা নেই ইকবালের সঙ্গে। অথচ আমার খবর সব জানে।

কেন? কীভাবে? কেনইবা?

‘এনামুল হক লাবলু হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমাকে টাকাটা দেবে। সাত লাখ টাকা। সেটা জমা দিয়ে চাকরি ফেরত পাব। তারপর ডায়াবেটিস চেক করাব। লম্বা ক্লান্ত দিন কাটাব অফিসে। তারপর সন্ধ্যায় লাবলুকে খুঁজে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব। তারপর কেটে ভাসিয়ে দেব সুরমায়।’

‘আমাকে যেতে হবে মোহাম্মদ আলী, পথ ছাড়’, আমি বলি।

‘না, এখন নয়। এখন এনামুল হক লাবলুকে ব্রিফকেস সমতে ধরতে হবে। তারপর আপনি যেতে পারবেন।’

‘কি আশ্চর্য, লাবলুর জন্য কি দাঁড়িয়ে থাকব এইখানটায়, সারা রাত? তুমি কি পাগল হয়েছ?’

কথাগুলো শেষ হতেই সিনেমার নায়কের প্রতিধ্বনিত ডায়ালগের মতো শুনতে পেলাম, একজন ভারি গলায় বলছে, ‘লাবলুর জন্য আর দাঁড়াতে হবে না।’

চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। একটা রিকশার আড়াল থেকে হাল্কা আলোয় পা ফেলে ফেলে এগিয়ে এলেন লাবলু, কথাগুলো বলতে বলতে। তার চোখে চশমা উঠেছে, দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু হাতে ওটা কী?

একটা কালো ব্রিফকেস।

আমি স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকি। মোহাম্মদ আলী বলে, ‘লাবলুকে ধরেন ইকবাল ভাই। ধরেন। না হলে পালাবে।’

‘আমার পালাবার কোনো কারণ নেই।’ বেশ জোর গলায় বলেন লাবলু। হয় জোর দিয়ে বললেন, না হয় গলির বদ্ধ বাতাসে তার কথাগুলো জোরে শোনা গেল। ‘পালিয়ে কোথায় যাব? কোন চুলায়?’

‘লাবলুর ব্রিফকেসটা নিন,’ মোহাম্মদ আলী বলল। এবং নিজেই লাবলুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে গেল সেটি।

‘খবরদার’, হুংকার দিয়ে বললেন লাবলু। ‘এই বাক্স তোমার হাতে যাবে না। এটি ইকবাল সাহেবের প্রাপ্য।’

‘আমার প্রাপ্য?’ আমি জিজ্ঞেস করি, যদিও গলাটা হঠাৎ করে যেন বসে গেছে একহাত।

‘আপনার প্রাপ্য। আমার বাড়িতে। রামকানাইয়ের দোকানে বেশ কিছু টাকা আপনাকে রেখে যেতে হয়েছিল। আড়াই লাখের মতো। সেগুলো পুলিশ ফিরে পাওয়ায় অবশ্য দুই বছর থেকে সতেরো দিন কম সাজা মিলেছে আমার। সতেরোটি আস্ত দিন জেলের ভাত খেতে হয়নি। ভাবা যায়?’

নিশ্চুপ সময় যায় আমার।

‘নিন ব্রিফকেসটা’ বলে আমার হাতে কালো ব্রিফকেসটা তুলে দিয়ে হাঁটা দেন লাবলু, এক হাতে ইকবালের কনুই টেনে ধরে।

একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল দুজনে। হাত নাড়িয়ে যেন বলল, বাই, যাই। অথবা এরকম কিছু। অথবা কিছুই বলল না। কিন্তু কিছু দেখাও গেল না, শোনাও গেল না। কেননা, ভয়ংকর একটা শব্দে ব্রিফকেসটা তখন ফেটেছে। দশটা ট্রাকের চাকা একসঙ্গে ফাটার মতো। ব্রিফকেসটা একটা রাগী বেড়ালের মতো শূন্যে লাফ দিলো। আমার হাতের অর্ধেকটাও। আর, লাবলু এবং ইকবালকে যে দেখব, তারা কোথায়? অথবা যে শুনব, তারা কি বলছে, কীভাবে? চোখ দুটো না হয় বাঁচল – কীভাবে, কে জানে – কান তো ধেন্দা হয়ে গেছে ব্রিফকেসটা ফাটার শব্দে। শুধু নিজের রক্তের আতঙ্কিত শন শন দৌড়ানো শুনছি। তাছাড়া, আমি তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। হাঁটু ভেঙে ধপাস করে মাটিতে পড়েছি। লোকজন ছুটে আসছে। মাটিতে শুয়ে শুয়ে মানুষের ছুটে আসা পা, জুতা-স্যান্ডেল,  প্যান্ট-পাজামা-লুঙ্গি, এসবই তো দেখা যায়, আর কি।

এসব প্যান্ট-লুঙ্গি-পাজামা দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো, যাঃ হাতের সঙ্গে হাতে ধরা পারুলের রিপোর্টটাও যে উড়ে গেল। আমার বহুমূত্র হয়েছে কিনা, আর জানা হবে না।

আফসোস।