ভাঙন

হরিশংকর জলদাস

বগলা নদীর উত্তরপাড়ে টেকেরহাট। আসলে টাকুরহাট। বহু বছর আগে জমিদার দীপেন চৌধুরীর নাতি কুলদীপ চৌধুরী এ-হাটের পত্তন করেন। পড়ন্ত জমিদার বংশের লোক কুলদীপ চৌধুরী। হাতে ক্ষমতা আসার পর তাঁর ইচ্ছা জাগল হাট বসাবার। তিনি একটা হাট বসালেন। দীর্ঘদেহী ছিলেন তিনি, টকটকে ফর্সা। নাক চিলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো। চিকন গোঁফ তার। ইংরেজদের মতো জুলপি কানের লতি ছাড়িয়ে চোয়াল পর্যন্ত প্রসারিত। কুলদীপ চৌধুরীর জুলপিই আছে, চুল নেই। চুল যে একেবারে নেই তা নয়, মাথার মাঝখানের বিরাট একটা অংশ ছাড়া দুই কানের পাশ এবং পেছনের অংশজুড়ে বিপুল চুল। বিরল কেশের টাক সর্বদা চকচক করে। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে সে-টাক থেকে। প্রথম প্রথম এ-হাট কুলদীপহাট নামে পরিচিতি পায়। অঞ্চলের কিছু
মানুষ কুলদীপ চৌধুরীকে টাকু চৌধুরী বলে। এ-কান ও-কান হয়ে টাকু চৌধুরী নামটি গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কুলদীপহাট মানুষের মুখে মুখে টাকুরহাটে রূপান্তরিত হয়। তবে তা আড়ালে-আবডালে। কুলদীপ চৌধুরীর মৃত্যুর পর মানুষের ভয় কেটে গেল। পরবর্তীকালে এই টাকুরহাট টেকেরহাট নামে পরিচিত হয়ে গেল। তবে সে পরের কথা। তারও আগের কথা আছে।
চাঁদপুর, ভৈরব, নারায়ণগঞ্জ এমনকি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকেও মালবোঝাই হয়ে পালতোলা বড় বড় নৌকা এই টেকেরহাটের ঘাটে ভিড়ত। হাটের ঘাট থেকে একটু দূরে আরেকটা ঘাট ছিল, শান বাঁধানো। বিশটা ধাপ ছিল এ-ঘাটের। মানুষের কাছে জমিদারঘাট নামে পরিচিত ছিল এটি। হাট পত্তনের আগুপিছু সময়ে এ-ঘাটটি তৈরি করিয়েছিলেন কুলদীপ চৌধুরী। অসাধারণ রূপসী ছিলেন তাঁর স্ত্রী। অধিক বয়সেই বিয়ে করেছিলেন কুলদীপ। তাঁর মাথার টাক মানুষের নজর কাড়তে শুরু করছিল তখন। ওই সময়ে বিশ বছরের অরুন্ধতীকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন কুলদীপ। অরুন্ধতীর জন্যেই ঘাটটা তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। অরুন্ধতীর বয়সের সঙ্গে মিলিয়েই বিশ ধাপের ঘাটটি বানিয়েছিলেন কুলদীপ। ঘাটের দুদিকে প্রশস্ত জায়গাজুড়ে বসারও ব্যবস্থা ছিল। ঘাটে বাঁধা থাকত বজরা। এই বজরা রবীন্দ্রনাথের পদ্মার বোটের মতো নয়, ছোটখাটো; পাল উড়িয়ে একজন হাল ধরে বসলেই বজরাটি তরতর করে এগিয়ে যেত। কুলদীপ অরুন্ধতীকে নিয়ে নৌভ্রমণে বের হতেন। সন্ধে ছুঁইছুঁই সময়। জোছনা পাওয়া মানুষ ছিলেন কুলদীপ। শুক্লপক্ষ লাগলেই কুলদীপের ভেতরে অন্য এক কুলদীপ আলুথালু করতে শুরু করত। পূর্ণিমায় ভেতরের কুলদীপ বাইরের কুলদীপকে গ্রাস করে ফেলত। গোধূলিতেই অরুন্ধতীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। জমিদারঘাটে বজরা তখন প্রস্ত্তত, হাল ধরে বসা রামলাল।
লোকালয় থেকে দূরে বগলা নদীর তীরে ডোমপাড়া। ডোমপাড়ার সঙ্গে গা লাগিয়ে চর। তীর থেকে সামান্য ঢালু হয়ে এই চর বগলার জলে নেমে গেছে। ওই চরেই এ-অঞ্চলের শ্মশান। ডোমপাড়া আর শ্মশানের মাঝখানে ঢিলছোড়া দূরত্ব। জমিদারগ্রাম বলে জনসংখ্যাও বেশি। ক্ষমতার কাছেই তো সুবিধালোভীদের ভিড় থাকে। অধিক জনসংখ্যার কারণে শ্মশান সবসময় সরগরম। সরগরম শ্মশান মানে ডোমদের ব্যস্ততা। তাদের ছাড়া তো মরা পোড়ানো যায় না। এই পাড়ার নামকরা ডোম দয়ালহরি। বিশাল দেহকে ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে পুড়িয়ে ফেলার কৌশল জানত সে, তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও তার তৈরি চিতায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যেত। দয়ালহরি বলত – চুলা সাজানোর একটা কৌশল আছে। যেনতেন করে সাজানো লাকড়ির স্তূপে আগুন লাগালে হবে না, চিতায় লাকড়ি সাজাতে জানতে হবে। একটার ওপর একটা লাকড়ি সে এমনভাবে সাজাত, চারদিক থেকে বাতাস চুলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কার বাপের সাধ্য যে চুলার আগুন নেভায় তখন। গলায় এক বোতল ঢেলে দয়ালহরি হাতে গজন্ধরা তুলে নিত। গজন্ধরা মানে মরা পোড়ানোর দশহাতি কাঁচা বাঁশ। গজন্ধরা দিয়েই গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে আধপোড়া মৃতদেহ ছত্রিশখান করত দয়ালহরি। গলগল করে শরীর থেকে পানি বেরোচ্ছে আর আগুনের শিখা ভলকে ভলকে জ্বলে উঠছে। জ্বলে ওঠা লেলিহান আগুনে গজন্ধরার গুঁতায় টুকরা-টাকরা মাংসপিন্ড দ্রুত পুড়ে যাচ্ছে। প্রকট গন্ধ চারদিকের বাতাসে। পোড়া মানুষের গন্ধে জ্যান্ত মানুষের নাড়িভুঁড়ি গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। শ্মশান-আত্মীয়রা নাকেমুখে কাপড় চাপা দিয়ে গন্ধ থেকে রেহাই পেতে আকুলি-বিকুলি করে। দয়ালহরি নির্বিকার। তার নাকে যেন দুর্গন্ধ ঢোকে না, যেন সে বাঁচার জন্যে নাক দিয়ে বাতাস টানে না!
এই দয়ালহরিরই ছেলে রামলাল। রামলালের বয়স যখন দশ, কী একটা তর্কাতর্কিতে বউয়ের বাঁ-কান বরাবর একটা থাপ্পড় বসিয়েছিল দয়ালহরি। ওই এক থাপ্পড়েই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল যশোদার। জমিদারের হাতে-পায়ে ধরে, সারাজীবনের গোলামির খত দিয়ে সেবার রক্ষা পেয়ে গেল দয়ালহরি। বউ চলে গেল, কিন্তু মদ চেপে ধরল তাকে। দিনরাত মদেই ডুবে থাকল সে। এক জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে মত্ত দয়ালহরি বগলাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাদ্রমাসের ভরা যৌবন তখন বগলার।
এখানে-ওখানে চড়-লাথি খেতে খেতে একটা সময়ে জমিদারবাড়িতে আশ্রয় পেয়ে গেল রামলাল। কুলদীপ অর্জুনের হাতে তুলে দিলেন রামলালকে। অর্জুন মালি রাজবাড়ির বাগান দেখাশোনা করে। বাগানের এককোণে ছোট্ট একটি ঘরে থাকে অর্জুন। প্রথম বউটি মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিয়েতে আগ্রহ হারায় সে। বাগান ঘিরেই তার প্রথম স্ত্রীর ভালোবাসা। রামলাল এসে সেই ভালোবাসায় ভাগ বসাল। অর্জুন স্নেহ-ভালোবাসায় রামলালকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলল। অর্জুনের একাকিত্বের জীবনে তৃপ্তি ও আনন্দের পরশ সঞ্চার করল রামলাল। অর্জুন রামলালের হাত ধরে ধরে ফুল চেনাল, গাছ চেনাল, মাটির রূপ-রূপান্তর চেনাল। অর্জুন-পুষ্প-মৃত্তিকার সান্নিধ্যে রামলাল ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল। তরুণ রামলাল ফুলের গায়ে হাত বুলায়, গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে আলগা করে, গাছ থেকে মরাপাতা ছিঁড়ে ফেলে এবং সুযোগ পেলে একটা গোলাপ ছিঁড়ে বারবার সুবাস টানে। সে-সময় মনটা কেন জানি চিড়বিড় করে ওঠে তার। অনেক ভাবাভাবির পরও মনের এই চিড়বিড় করে ওঠার কারণ খুঁজে পায় না রামলাল। রাতের বেলা পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে তার, গোধূলিতে বগলা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে। এই সময়েই কুলদীপ বিয়ে করলেন, অরুন্ধতীকে ঘরে আনলেন। স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্যে তিনি বগলা নদীতে বিশ ধাপের ঘাট তৈরি করলেন, নিজের তৃপ্তির জন্যে বজরা বানালেন। এবং এ-বজরার দেখভাল করার জন্যে রামলালকেই নিয়োগ করলেন কুলদীপ। রামলাল প্রাণ পেয়ে গেল। ফুলবাগানের চেয়ে নদীকে বেশি ভালো লাগল তার, ফুলের চেয়ে জলকে। দিনরাত বজরার পরিচর্যা করে সে। গলুইয়ে জল ঢেলে প্রতিদিন একবার বজরা পরিষ্কার করে, হাল-পালের যত্ন নেয়। যে-বিকেলে জমিদারমশাই স্ত্রী নিয়ে নদী ভ্রমণে আসেন, সে-বিকেলে পাল খাটিয়ে হালে বসে রামলাল। বজরার পাটাতনে কাঠের কক্ষ আছে, সেই কক্ষের দুপাশে জানালা আছে, ভেতরে শোভনীয় শয্যা পাতা আছে। দুপাশের জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস ভেতরে ঢোকে। নদীজল-ছোঁয়া নির্মল বাতাস ওই শয্যায় শোয়ার আগ্রহ প্রবলতর করে। বজরা যেতে যেতে একসময় থেমে যায়। কুলদীপেরই আদেশে থামে। মৃদু স্রোতে নৌকা ভাসে। রামলাল হাল ধরে নৌকা সোজা রাখে। দুপাশের পাড় আবছা আবছা, বজরার পাশে মৃদু গুঞ্জরিত জল। জোছনায় স্নান করছে তখন নদী। ছাদ থেকে ধীর পায়ে নেমে আসেন কুলদীপ, হাতে ধরা অরুন্ধতীর হাত। শোভিত শয্যায় গা এলিয়ে দেন দুজনে। তখন বজরার দুলুনি বাড়ে। কিছু সময় পরে দুজনে বেরিয়ে আসেন কক্ষ থেকে। বড় ক্লান্ত দেখায় কুলদীপকে, বিপর্যস্ত অরুন্ধতীকে। রামলাল আড়চোখে তাকায়। চোরাগোপ্তা অরুন্ধতীর মুখের ওপর চোখ ফেলে। দেখে – বিপর্যস্ততার সঙ্গে একটু বিরক্তিও যেন মিশে আছে অরুন্ধতীর চোখে-মুখে। কোনো কোনো রাতে ছাদে বসে কুলদীপ অরুন্ধতীকে চাঁদ দেখান, নদীজলে প্রতিফলিত জোছনা দেখান, দূরপাড়ের আবছা কাশবন দেখান, কাছে-দূরের ধীবর নৌকার মিটমিটে আলো দেখান।
সে-সন্ধেয় মাঝনদীতে নোঙর ফেলেছে কুলদীপের বজরা। ছাদে কুলদীপ-অরুন্ধতী। হালে রামলাল। অরুন্ধতী বলে, ‘আমাদের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর পেরিয়ে যেতে চলল, সন্তান তো এলো না কোলে।’
কী বলবেন কুলদীপ ভেবে পান না। আমতা আমতা করে বলেন, ‘বুঝতে পারছি না।’
‘কার অসমর্থতা কে জানে?’ আনমনে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে অরুন্ধতী। তারপর কুলদীপের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এজন্যে দায়ী আমি, না তুমি?’ বলেই নদীজলে চোখ নিবদ্ধ করল অরুন্ধতী।
সে-সন্ধেয় আর আলাপ জমেনি দুজনের মধ্যে। অরুন্ধতী নদীজল থেকে চোখ তোলেনি। কুলদীপ একবার অরুন্ধতীর দিকে আর একবার আলো-অাঁধারে ঘেরা নদীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় পার করেছেন। আগেভাগেই শীত নেমেছিল সেবার। সন্ধে একটু রাতের দিকে গড়িয়ে গেলে গলাটা একটু উঁচু করে কুলদীপ বলেছিলেন, ‘নোঙর তোল রামলাল, চল।’
বগলাপাড়ের চৌধুরী বংশ কালীভক্ত। সাতপুরুষ আগে থেকে এ-বংশে কালীপুজো হয়ে আসছে। যখন ঠাঁটবাট ছিল, কালীপুজো হতো জাঁকজমকে। কুলদীপের সময়ে জমিদারি পড়োপড়ো। পড়ন্ত জমিদার হলে কী হবে কালীপুজোর মর্যাদা আর জৌলুসে কোনোরূপ ভাটা লাগতে দেননি কুলদীপ। কথায় বলে – হাতি মরলেও লাখ টাকা। জমিদারবাড়ির দেয়ালঘেরা বড় উঠানের উত্তর কোনায় কালীমন্দিরটি। দক্ষিণমুখী। তিনশো বছরের পুরনো মন্দিরে লোল-জিহবার কালীদেবী ভয়জাগানিয়া চেহারায় দন্ডায়মান। তাঁর দুপাশে চামুন্ডারা। কালীপুজোর দিন সবার জন্য দ্বার অবারিত। শত শত প্রজার আগমন-নির্গমনে মন্দির এবং মন্দিরচত্বর গমগম করছে। এবার পুজো পড়েছে কার্তিক মাসের ৮ তারিখে। ঘোর অমাবস্যা। পুরোহিত পঞ্জিকা দেখে বলেছেন – পুজোর তিথি রাত এক ঘটিকা গতে অর্থাৎ রাত একটার পরে শ্যামার পুজো সম্পন্ন হলে ওই পুজো শুদ্ধ পুজো বলে পরিগণিত হবে। কুল-পুরোহিতের কথাই শেষ কথা।
জমিদার বংশের অন্য একটি রেওয়াজ – প্রথম মঙ্গলদীপটি জ্বালাবেন ওই বাড়ির প্রধান কুলবধূ। গত সাতপুরুষের এই-ই চল। তাই এবারের প্রথম মঙ্গলদীপটি জ্বালাবার দায়িত্ব পড়েছে অরুন্ধতীর ওপর। ঘোরলাগা অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ সে-অন্ধকারকে আরো ভয়াল করে তুলেছে। মন্দিরচত্বরে শত শত দর্শনার্থী। মন্দির-অভ্যন্তরে কুলদীপ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন। অরুন্ধতী আজ নববধূর সাজে সজ্জিত। সালঙ্করা। পরনে পট্টবস্ত্র; ঝোলানো অাঁচল। পুরোহিত পুজোর প্রাথমিক কাজ নিষ্পন্নে ব্যস্ত। বাইরে ঢুলিরা পুরোহিতের ইশারার জন্যে প্রস্ত্তত। কুলদীপ ও অরুন্ধতী পুরোহিতের সামনে পাশাপাশি দন্ডায়মান। দুজনের কপালে ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে চন্দনের ফোঁটা দিলেন পুরোহিত। তারপর ঢুলিদের লক্ষ করে বাঁহাতে একটা ঝটকা তুললেন। ধুন্ধুমার শব্দে ঢোল, ডগর, করতাল, মন্দিরা, বাঁশি, সানাই বেজে উঠল। পুরোহিত অরুন্ধতীকে লক্ষ করে উঁচু গলায় বললেন, ‘জননী, এবার মঙ্গল প্রদীপটির সলতেয় অগ্নি প্রজ্বালন করো।’
সজ্জিত কুলার মধ্যে ছোট ছোট মাটির প্রদীপ জ্বলছিল। ওখান থেকে একটি প্রদীপ নিয়ে প্রধান প্রদীপটি জ্বালাতে গিয়ে অরুন্ধতীর অাঁচলে আগুন লাগল। মুহূর্তেই পট্টবস্ত্র দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অরুন্ধতীকে আগুনে ঘিরে ধরল। সবাই হায় হায় করে উঠল। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কুলদীপ কপাল চাপড়াতে লাগলেন, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেল রে! আপনারা ওকে বাঁচান! এই, তোরা কে কোথায়, আমার অরুন্ধতীকে বাঁচা তোরা।’ কুলদীপের হাহাকারে নিকটজনদের মধ্য থেকে কেউ এগিয়ে এলো না। চাকর-বাকররা দূরে সরে যেতে লাগল। অাঁধারের ভেতর থেকে হঠাৎ রামলাল ছুটে এলো। হাতে ছেঁড়া-ফোঁড়া একটা কম্বল। কালীমন্দির-সংলগ্ন তার আস্তানাতেই ছিল সে। হইচই শুনে নিমিষেই সে-ব্যাপারটি অাঁচ করতে পারল। কম্বল হাতে ছুটে গিয়ে অরুন্ধতীকে জড়িয়ে ধরল রামলাল।
সে-যাত্রায় অরুন্ধতী বেঁচে গেল। কিন্তু অগ্নিদেব খালি হাতে ফিরে গেলেন না। অরুন্ধতীর কানসমেত ডান গালে একটা থাবা বসিয়ে গেলেন। অরুন্ধতীর চুল-হাত-পা-দেহের অন্যান্য অংশ যথাযথ থাকল, শুধু পুড়ে গেল গালের ডান-অংশ। গভীর ক্ষত নিয়ে অরুন্ধতীর নতুন জীবন শুরু হলো।
বছরখানেক কেটে গেল। কুলদীপ এখন আর নদী ভালোবাসেন না। কূলপ্লাবী জোছনা, নদীর কলরোল, দূরের মেছো নৌকা, পাড়জোড়া কাশবন এখন আর তাকে আকুল করে না। সন্ধে লাগলে অরুন্ধতীকে নিয়ে তিনি এখন আর নদীজলে বজরা ভাসান না। তার কাছে এখন অরুন্ধতী-সান্নিধ্য অসহনীয়। তিনি সৌন্দর্যের পূজারি। অরুন্ধতীর দেহ, যৌবন – সব আছে, কিন্তু অরুন্ধতীতে সৌন্দর্য নেই। কুলদীপ মনে করেন – অগ্নিদেব তার সৌন্দর্যের প্রায় সবটাই কেড়ে নিয়েছেন। অগ্নি-প্রজ্বলিত অরুন্ধতী, মুখমন্ডলীয় শ্রীহীন অরুন্ধতী কুলদীপ চৌধুরীর কাছে এখন অপ্রয়োজনীয়। এখন তিনি অরুন্ধতীকে অবহেলা দেখান না, কিন্তু এড়িয়ে চলেন। তিনি এখন জমিদারিতে মগ্ন, তিনি এখন শকুন্তলায় নিমগ্ন। শকুন্তলা অরুন্ধতীর সেবাদাসী। শকুন্তলা এখন কুলদীপের সেবা করে। কুলদীপের নদী, জোছনা, কাশবন, সন্ধের ঘোর – সবই এখন শকুন্তলা।
একাকী জীবন অরুন্ধতীর। তার চারপাশে সবই আছে, সবাই আছে, নেই শুধু ভালোবাসা; নেই শুধু সান্নিধ্য। চিকিৎসা শেষে ফিরে এলে কুলদীপ তাঁর শয্যা অন্যত্র সরিয়ে নেন। ফলে অরুন্ধতীর রাতটা নিরানন্দে ভরে গেল; সকাল-দুপুর-বিকেল রাজবাড়ির এ-ঘরে ও-ঘরে ঘুরে বেড়ায় অরুন্ধতী। বাড়ির দাসদাসী, সরকার, দূর ও নিকট-সম্পর্কের আত্মীয়রা সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায়। আগের মতোই সবাই সম্মান করে অরুন্ধতীকে। কিন্তু এই সম্মান-সম্ভ্রম কুলদীপের অবহেলাকে ভুলিয়ে দিতে পারে না। এক টেবিলে আগের মতো খেতে বসেন কুলদীপ, কিন্তু একবারের জন্যও আগের মতো বলেন না, ‘তুমি এত কম খাচ্ছ কেন অরুন্ধতী? আজ মাছের মাথাটা তোমাকেই খেতে হবে কিন্তু!’ পাশাপাশি বা মুখোমুখি বসে খাওয়া শেষ করে দ্রুত উঠে যান কুলদীপ। কখনো চোখাচোখি হলে সে- চোখে প্রেম খোঁজে অরুন্ধতী, খোঁজে আগ্রহ; কিন্তু কুলদীপের চোখ নিস্পৃহ, প্রেমহীন।
অরুন্ধতী ভাবে – কুলদীপ তাহলে তাকে ভালোবাসেনি, বেসেছে তার রূপকে। রূপকেও বলব কেন, বেসেছে তার ডান গালকে। তার তিলসমেত বাম গাল আছে, সে গালে আছে পূর্বের মতো লোভনীয় মসৃণতা, আছে তার পুরুষ্টু স্তন, আছে গ্রীবা, চোখে আছে কটাক্ষ, আছে অপূর্ব দেহবল্লরী আর আছে কুলদীপে মগ্ন একটা মন। তা সত্ত্বেও কুলদীপ তাকে পরিহার করে চলে। আজ তার ডান গালের দগ্ধ কপোলের কাছে তার দেহ, তার যৌবন, তার মন সবকিছু হার মানল! মাঝেমধ্যে অরুন্ধতী জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কেমন আছো কুলদীপ, আছো তো ভালো?’ অরুন্ধতীর এই প্রশ্নে কুলদীপ প্রথমে থতমত খায়, খাবার মুখে না পুরে চকিতে অরুন্ধতীর দিকে তাকায়। চোখ, নাক, ঠোঁট ঘুরে তাঁর চোখ আটকে যায় অরুন্ধতীর পোড়াগালে। ভেতরে অস্বস্তির একটা শিহরণ জাগে, সেই অস্বস্তি মন থেকে চোখে বিস্তৃত হয়। চোখ আপনিতে কুঁচকে যায় কুলদীপের। নিজেকে সংযত রেখে স্বস্তিকর একটা উত্তর দিতে চায় কুলদীপ। কিন্তু নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘খারাপ থাকার তো কোনো কারণ দেখি না! কোনো কিছু না থাকলে মানুষ ভালো থাকে না। আমার তো কোনো কিছুর অভাব নেই।’ বলেই চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে কুলদীপ। হায় রে কুলদীপ! তুমিই তো আমার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে একদিন। আমার ভালোমন্দের তদারকিতে তোমার অধিকাংশ সময় কাটত। আজ কী প্রশ্নের কী উত্তর দিলে তুমি? তোমার যেসব আছে তা তো বুঝতেই পারছি। আমায় ছেড়ে শকুন্তলাতে উপগত তুমি। আমি সব জানি, সব দেখি। তোমার যেমন দেহ আছে, সেই দেহে ক্ষুধা আছে, তেমনি করে আমারও তো যৌবন আছে, ভেতরে লালসা আছে। শকুন্তলাকে দিয়ে তোমার লালসা মেটাচ্ছ? আমি কাকে দিয়ে মেটাবো? ছিঃ ছিঃ আমি কী ভাবছি? ডানে-বাঁয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়ে অরুন্ধতী।
রামলাল এখনো প্রতি বিকেলে বজরার গলুইয়ে গিয়ে বসে থাকে। গেল এক বছরে একদিনের জন্যেও রামলাল বজরাটির প্রতি অযত্ন করেনি। প্রতিদিন আগের মতো বজরাটির আগাপাছতলা সাফসুতরা করেছে। হালে রং লাগিয়েছে। পালের রশি বদলেছে, ভেতরের শয্যার যত্ন নিয়েছে। আর আশায় আশায় থেকেছে – আজ বুঝি জমিদারবাবু স্ত্রীর হাত ধরে বিশ ধাপের শান বাঁধানো ঘাটে উপস্থিত হয়ে বলবেন, ‘রামলাল, পাল তোলো, হালে বসো। আজ আমাদের ওইখানে নিয়ে চলো, একেবারে কাশবন ঘেঁষে ওইখানে।’ কিন্তু গত এক বছরে জমিদারবাবু এলেন না, রানী এলেন না। রামলাল মনে মনে অরুন্ধতীকে রানী বলে। বলে সুখ পায় বলে অরুন্ধতীকে সে মনে মনে ওই নামে সম্বোধন করে। রানী এখন কেমন আছেন কে জানে? সে রাতে কম্বল জড়িয়ে রানীর শাড়ির আগুন নেভানোর পর তাড়াতাড়ি তাকে ভেতর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে খবর পেয়েছিল – শহর থেকে বড় ডাক্তার আনা হয়েছিল। বেশ কিছুদিন যন্ত্রণাভোগের পর সুস্থ হয়ে উঠেছেন রানী – এও শুনেছিল সে। প্রায় এক বছর ধরে হালে হাত রেখে একাকী সন্ধেবেলায় বসে থাকতে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর খারাপ লাগে না রামলালের। প্রথম প্রথম আশা নিয়ে বসে থাকত – এই বুঝি জমিদারবাবু রানীকে নিয়ে এলেন। ধীরে ধীরে ওদের না আসার ব্যাপারটি রামলালের মন সয়ে নিল। এখন বসে থাকে অভ্যাসে। শুধু কি অভ্যাসে? শুধু অভ্যাসে বসে থাকে বললে মিথ্যাচার হবে। রামলালের মন থেকে এই আশাটুকু একেবারে নির্বাপিত হয়ে যায়নি যে, এক বিকেলে জমিদারবাবু হয়তো ঘাটে আসবেন, তার পাশে থাকবে রানী।
একদিন গোধূলিবেলায় অরুন্ধতী ঘাটে এলো। একাকী। রামলাল তখন হালে ডান হাত রেখে দূরের নদীজলে তাকিয়েছিল আনমনে। অরুন্ধতীর আগমন সে টের পায়নি। ‘কোথায় গেলে রামলাল, তোমার বজরা ঠিক আছে তো? নিয়ে যেতে পারবে তো আমাকে ওই কাশবনের কাছে?’ চমকে ফিরে তাকাল রামলাল। একি অবিশ্বাস্য! রানী? ঘাটে? কিন্তু জমিদারবাবু কোথায়?
‘কী? জবাব দিচ্ছ না কেন রামলাল? নিয়ে যেতে পারবে না?’ অরুন্ধতী কোমলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
সম্বিৎ ফিরে পায় রামলাল। দু’চারবার চোখের পলক ফেলে বলে, ‘পারব, পারব। আসেন, বজরায় উঠে আসেন।’ রামলাল ভালো করে তাকিয়ে দেখে একটা কালো চাদরে ঘোমটা দিয়ে রানী বজরায় উঠছেন। সে সন্ধেয় নদীবুকে বেশিক্ষণ থাকেনি অরুন্ধতী। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এসেছিল। কূলে উঠে দেখতে পেয়েছিল – বেশ কজন প্রহরী ঘাটে বসে আছে, পালকি নিয়ে বেহারারাও।
এইভাবে অরুন্ধতীর অন্য এক জীবন শুরু হলো। স্বস্তি খোঁজার জীবন। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে অরুন্ধতী এসে উপস্থিত হয় ঘাটে। রামলাল প্রস্ত্তত থাকে বজরা নিয়ে। তারপর কখনো পালতোলা বজরার দূরনদীতে পাড়ি, কখনো মৃদু ঢেউয়ে দুলতে দুলতে অপর পাড়ের দিকে যাত্রা, কখনো মাঝনদীতে নোঙর ফেলে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা। নোঙর পাতা বজরার ছাদে বসে উদাস চোখে তাকায় অরুন্ধতী – কখনো সন্ধে তারার দিকে, কখনো খলবল করে এগিয়ে যাওয়া জলের দিকে, কখনো দোলায়মান কাশবনের দিকে। অরুন্ধতী তাকায় আকাশ, জল আর কাশফুলের দিকে, আর রামলাল তাকায় অরুন্ধতীর দিকে। অরুন্ধতী আকাশ-নদী দেখে স্বস্তি পায়, হালে বসা রামলাল অরুন্ধতীকে দেখে শান্তি পায়। এইভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যাবার পর স্বস্তি-শান্তির দিকে মুখ ফেরায় একদিন।
অরুন্ধতী জিজ্ঞেস করে, ‘ঘরে তোমার কে কে আছে রামলাল?’
রামলাল বলে, ‘আমার আমি ছাড়া আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে।’
‘কী বললে? তোমার তুমি! বেশ বললে তো -!’ বলেই বহু বহুদিন পর খিলখিল করে হেসে উঠল অরুন্ধতী।
রামলাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে অরুন্ধতীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
কোনো গোধূলিতে অরুন্ধতী রামলালকে উদ্দেশ করে বলে, ‘হালটা জলে আলতো করে ভাসিয়ে রেখে এদিকে এসো রামলাল।’ বজরা তখন নোঙরে। বজরা সোজা রাখার জন্যে হালটা আলতো হাতে ধরে বসেছিল রামলাল। অরুন্ধতীর আদেশ পেয়ে বজরার ছাদে এগিয়ে গিয়েছিল রামলাল।
অরুন্ধতী বলেছিল, ‘বসো।’
অরুন্ধতীর পায়ের কাছে পাটাতনে বসে পড়েছিল রামলাল। ডেকচেয়ারে বসা ছিল অরুন্ধতী, পা জোড়া সামনে প্রসারিত। অরুন্ধতীর পা দুটো রামলালের মর্মতল হঠাৎ করে মথিত করতে শুরু করল। নিষ্পলক নির্লজ্জ দৃষ্টিতে রামলাল অরুন্ধতীর পা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল। রামলালের শরীরে কী জানি কেন উথালমাতাল ঢেউ উঠল।
এই সময় অরুন্ধতী জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখছ রামলাল?’
রামলাল সন্ত্রস্ত চোখে একবার অরুন্ধতীর দিকে তাকিয়ে চোখ নত করল।
অরুন্ধতী ভাবল – কী দেখছ তুমি রামলাল? তোমার চোখের রং আমাকে বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবছ। তুমি এই মুহূর্তে মাথা নত করে থাকলেও তোমার ভেতরটা ভাঙছে আমি দেখতে পাচ্ছি। সে-ভাঙা যে কামের তোমার মুখ, কপাল আর গালের বিন্দু বিন্দু ঘাম প্রমাণ দিচ্ছে। আমার ভেতরটাও কিন্তু এখন এ-মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কাউকে অাঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে আমার। আমার ভেতরের প্রজ্বলিত আগুন নেভাবার জন্যে একটা জলাধার দরকার। রামলাল, আমি দীর্ঘদিনের বুভুক্ষু একজন নারী। তুমি আমাকে শীতল সরোবরে অবগাহন করাও রামলাল।
অরুন্ধতী আস্তে করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এসো।’
রামলাল কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’
‘যেখানে যাচ্ছি আমি।’ বলেই বজরার ছাদ থেকে নামতে শুরু করল অরুন্ধতী।
দুজনে শয্যাঘরে ঢুকল। আগে অরুন্ধতী, পরে রামলাল।
তেল কুচকুচে রামলালের শরীরে যৌবনের গন্ধ। সেই গন্ধে মাতোয়ারা বহুদিনের ক্ষুধার্ত অরুন্ধতী। নিস্তরঙ্গ নদীর বুকে খরস্রোতা জল, সেই জলের ওপর মৃদু কম্পমান বজরা।
বজরার ভেতরে, শয্যাঘরে জল থইথই।