ভাষার অনুষঙ্গ

পবিত্র সরকার

 

১. মানুষের ভাষা

ভাষা কী, এই প্রশ্নের উত্তরে যেটা মামুলি আর অসম্পূর্ণ উত্তর সেটা হলো, ভাষা হলো ধ্বনি সাজিয়ে অর্থ প্রকাশ করার মানবিক সামর্থ্য ও প্রক্রিয়া। ‘মানবিক’ কথাটা এজন্য ব্যবহার করতে হয় যে, মানুষ ছাড়া আর কারো ভাষা নেই। ভাষা কথাটার রূপক অর্থের বিস্তারে আমরা অবশ্য অনেক কিছুকেই ভাষা বলি, যেমন ‘ফুলের ভাষা’, ‘জ্যোৎস্নার ভাষা’, ‘তারার ভাষা’; এগুলোতে কোনো আওয়াজ নেই, কাজেই এগুলো প্রথমত আমাদের অর্থে ভাষা নয়। আর দ্বিতীয়ত, এগুলো থেকে যদি আমরা কিছু বুঝে নিই তা আমাদেরই কৃতিত্ব, ফুল বা জ্যোৎস্না বা তারা – এরা কেউ সচেতনভাবে আমাদের কাছে কিছু বলতে চায়, তা নয়।

‘সমুদ্রের ভাষা’, ‘সুরের ভাষা’, ‘ঝড়ের ভাষা’ – এগুলোতে নিশ্চয়ই আওয়াজ আছে, কিন্তু তা কণ্ঠে উচ্চারিত ভাষার ধ্বনি নয়। আবার ‘পাখির ভাষা’, ‘কুকুরের ভাষা’, ‘বেড়ালের ভাষা’ নিশ্চয়ই কণ্ঠে উচ্চারিত ভাষা, কিন্তু তা মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত নির্দিষ্ট ধ্বনি জুড়ে অর্থ প্রকাশ করা ভাষা নয়। সেগুলো ‘ডাক’ মাত্র। ‘ডাক’ মানে তাদের নির্দিষ্ট শারীরিক অনুভব প্রকাশ করার উপায় মাত্র। ভয় পেলে তারা একরকম ডাকে, খিদে পেলে আর-এক রকম, প্রণয় জানাতে আরেক রকম, যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশে আর-এক রকম। খিদে না পেলে তারা খিদের ডাক ডাকবে না বা ভয় পাওয়ার উপলক্ষেও খিদের ডাক ডাকবে না। আবার খিদে পেলে খিদের ডাক না ডেকেও পারবে না, মানুষের মতো লজ্জায় পেটের খিদের কথা লুকিয়ে রাখার অভ্যাস তাদের নেই। অর্থাৎ তারা আওয়াজে আর আচরণে নিয়মিত ও ধারাবাহিক মিথ্যা কথা বলতে পারে না।

ভাষা একমাত্র মানুষেরই আছে বলে মানুষ মিথ্যা কথা বলতে পারে। ভয় পেলে সে বলতে পারে, ‘আমি মোটেই ভয় পাইনি’ কিংবা ‘আমার খুব বাথরুম পেয়েছে’, ভালোবাসলে সে বলতে পারে ‘তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ’, কিংবা ‘তোমাকে মোটেই ভালোবাসি না আমি!’ ফেসবুকে বাজে কবিতা পড়ে সে বলতে পারে ‘অসাধারণ লাগল’। ভাষা আছে বলেই মানুষ অতিরঞ্জনও করতে পারে। অতিরঞ্জন সত্য আর মিথ্যার মাঝামাঝি – মানুষ ভাষার যেভাবে অতিরঞ্জন করতে পারে পশুপাখিরা তাদের বুলিতে ততটা পারে না, হয়তো আচার-আচরণে পারে। কবিরা বর্ণনায় অতিরঞ্জন করেন ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ বলে, কল্পনায় মিথ্যার জগৎ গড়ে তোলেন। ঝগড়ায় গালাগালি করতে গিয়ে মানুষ প্রতিপক্ষের জন্ম (‘বেজন্মা’, ‘শুয়োরের বাচ্চা’), শারীরিক আকৃতি (‘রামছাগল’, ‘হাতি’), অভ্যাস ও বুদ্ধিমত্তা (‘শকুন’, ‘গরু’, ‘গাধা’) ইত্যাদি নিয়ে অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা কথা বলতেই পারে। ১. ঝগড়ার লক্ষ্য (প্রতিপক্ষকে ভাষা দিয়ে আঘাত করা) ছাড়াও প্রশংসার জন্য গালাগালির ভাষা ব্যবহৃত হওয়াও বিচিত্র নয় – প্রেমিকা কখন প্রেমিককে ‘দস্যু’ বলে তা আপনারা জানেন। এমনকি ভদ্র সৌজন্যের আচরণেও মানুষ মিথ্যা কথা বলে, তার জন্য কোনো অনুতাপ করে না। যেমন প্রথম দেখায় এক ভদ্রলোক কপালে হাত তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে, কেমন আছেন’, অন্যজন একই অঙ্গভঙ্গি করে উত্তর দিলেন ‘ভালো আছি। আপনি কেমন?’ প্রথমজনও বললেন ‘ভালো’। ২. ভালো থাকুন আর নাই থাকুন, ‘ভালো আছি’ বলাটাই দস্তুর। ইংরেজিভাষীরাও বলে, I’m fine. And you? অন্যজন বলে, I’m fine too. না, এমন আমি বলছি না যে, মানুষ শুধু মিথ্যা কথা বলার জন্যই ভাষা ব্যবহার করে। মূলত সে সত্য বলার জন্যই ভাষা বলে; কিন্তু সত্য বলা ছাড়াও ভাষা দিয়ে সে অনেক কাজ করে। যে কাজই করুক, তার প্রক্রিয়া ওই একই, মূলত কণ্ঠে উচ্চারিত কতকগুলো ধ্বনি পরপর সাজিয়ে তাকে অর্থ প্রকাশ করতে হবে।

কণ্ঠে উচ্চারিত হলেও যে-কোনো ধ্বনি নয়, তার ভাষার ধ্বনি। কাশি, হাঁচি, গলাখাঁকারি, হাই তোলা, ঢেঁকুর – সবই কণ্ঠের আওয়াজ, কিন্তু সেগুলো আমরা ‘উচ্চারণ’ করি না, সেগুলো শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে ‘এসে যায়’। ওগুলো ‘প্রাকৃতিক’ (natural) আওয়াজ বা ধ্বনি। ‘উচ্চারণ’ করা মানে স্বেচ্ছায়, পরিকল্পনা করে জিভ, ঠোঁট ইত্যাদির নাড়াচাড়া করে অর্থ প্রকাশের জন্য ধ্বনি বের করা অর্থ সত্য হোক, মিথ্যা হোক, অতিরঞ্জন হোক – তাতে কিছু এসে যায় না।

আর ব্যাকরণের যে-কথাগুলো সবাই জানেন তা এখানে আর-একবার বলি, আমরা কথা বলি মূলত বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে। এই বাক্যগুলোকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – উদ্দেশ্য আর বিধেয়। ৩. এই উদ্দেশ্য আর বিধেয় তৈরি হয় নানা ধরনের ‘বন্ধ’, ‘পদবন্ধ’ বা phrase দিয়ে – বিশেষ্যবন্ধ, ক্রিয়াবন্ধ আর আমাদের মতে ক্রিয়াবিশেষণ পদবন্ধ দিয়ে। ওই বন্ধগুলো আবার তৈরি হয় এক বা একাধিক শব্দ (word) দিয়ে, শব্দগুলো তৈরি হয় ‘রূপ’ ((morph)  দিয়ে। ‘রূপ’-এর মূল উপাদান ধ্বনি। অর্থাৎ আমরা কথা বলি যে-বাক্য দিয়ে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করলে পরপর এই উপাদানগুলোকে ভেঙে ভেঙে পাই –

বাক্য-উদ্দেশ্য+বিধেয়ক্সপদবন্ধ-শব্দ/ পদ-রূপক্সধ্বনি

বাক্য সাধারণত একটিই (যৌগিক আর জটিল বাক্যের ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে) – সরল বাক্য – তারই উপাদান এভাবে সাজানো যায়। উদ্দেশ্য আর বিধেয় দুটি উপাদান। এ দুয়েতেই একাধিক পদবন্ধ থাকতে পারে, প্রতি পদবন্ধে একাধিক শব্দ, প্রতি শব্দে একাধিক রূপ এবং প্রতি রূপে একাধিক ধ্বনি। আমরা বলছি ‘থাকতে পারে’।         থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উদ্দেশ্য আর বিধেয়তে একটি করে পদবন্ধ, প্রতি পদবন্ধে একটি শব্দ, প্রতি শব্দে একটি রূপ, আবার একটি ধ্বনির রূপও হতে পারে। যেমন ‘কে এ?’ বাক্যে উদ্দেশ্য আর বিধেয় দুটি শব্দের। শব্দদুটি পদবন্ধও বটে। এক শব্দের পদবন্ধ। আবার শব্দদুটি এক ‘রূপের’ শব্দ (monomohpemic word)। সেইসঙ্গে ‘এ’ রূপটি একটি ধ্বনির রূপ। আমরা ওপরের ছকটা বক্তার বলা অনুযায়ী সাজিয়েছি – বক্তা আগে বাক্যই বলেন। কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানীরা তাঁদের বিশ্লেষণে আগে ধ্বনিকে লক্ষ করেন, ধ্বনি থেকে রূপে, রূপ থেকে শব্দে, শব্দ বা পদ থেকে বন্ধে, বন্ধ থেকে উদ্দেশ্য আর বিধেয়ে – ধাপে ধাপে এগোতে এগোতে তাঁরা বাক্যে গিয়ে পৌঁছান। অর্থাৎ ভাষাবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণের ক্রমটা হলো –

ধ্বনি-রূপক্সশব্দ/ পদ-পদবন্ধ-উদ্দেশ্য-বিধেয়-বাক্য

আমরা ভাষাবিশ্লেষণের সেই জটিল তত্ত্বের মধ্যে এ-প্রবন্ধে ঢুকব না। বাক্যেরও যে নানা রকমফের আছে তা আমরা স্কুলের ব্যাকরণের পাঠ থেকেই জানি। সরল, যৌগিক, জটিল এবং শেষ দুয়ের মিশ্রিত নানা ধরনের বাক্য ব্যবহার করে আমরা কথা বলি।

কথা বলি, কিন্তু শুধু কথাই কি বলি?

২. কথা বলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি বিষয় : প্রায়ভাষা (paralanguage)

এক হলো কথা বলার ধরন। আপনি শুধু কতগুলো বাক্য উচ্চারণ করছেন না, বাক্যগুলোকে ‘বিশেষভাবে উচ্চারণ’ করছেন। সাধারণত ছাপার অক্ষরে ওই বিশেষভাবে উচ্চারণের কায়দাগুলোর সবগুলোকে ধরা যায় না। আপনার বিস্ময় বা প্রশ্নকে হয়তো বিস্ময়চিহ্ন বা প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করা গেল; কিন্তু আপনি কতটা জোরে বলছেন কথাটা, তা তো ছাপার অক্ষর বলবে না। এই আস্তে-জোরের মাত্রাটা, যাকে ইংরেজিতে বলে volume বা amplitude তার সমস্ত তথ্য মুদ্রিত আকার পেশ করা সহজ নয়। অথচ কথার এই জোরের সঙ্গে কথার অর্থও বদলে যায়। ‘তুমি যাবে?’ কথাটা যদি আমি ধমকে বলি, তার এক অর্থ, আর যদি মিনমিন করে মিনতির স্বরে বলি, তার আরেক অর্থ। আবার এই জোরও সব শব্দে সমানভাবে পড়ে না, যদিও পুরো বাক্যটাই তুলনায় জোরে বা আস্তে নানারকম উচ্চতায় উচ্চারিত হয়।

শুধু বলার জোর নয়। যে-শব্দ বা পদগুলোকে (বাক্যে শব্দ ব্যবহৃত হয় তাকে আমরা ‘পদ’ এই পরিভাষাটা দিয়ে বোঝাতে চাই), আমরা বলছি, সেগুলোকে বলার আরেকটা ধরন আছে – প্রতিটি পদে ওই ধরনটা আসে। তার নাম ঝোঁক বা stress । বাংলায় সাধারণত শব্দের প্রথম দলে বা সিলেবলে ঝোঁকটা পড়ে – ‘আমি বলেছি’তে ‘আ’র ওপর ঝোঁক যেমন। অনেক সময় অর্থও নিয়ন্ত্রণ করে এই ঝোঁক। ‘তুমি যাবে!’ কথাটা একটা নিছক হুকুম হতে পারে, কিন্তু ‘তু’র ওপর জোর দিয়ে বোঝানো যায় যে, অন্য কেউ নয়, আমি বিশেষ করে তোমাকেই যেতে বলছি। আবার ‘তুমি’কে রেহাই দিয়ে ‘যা’র ওপর জোর দিলে মনে হবে আমি বলছি যে, তুমি বসে থাকা বা অন্য কোনো কাজ করবে না, যাবে।

ঝোঁক ছাড়া আছে ‘তান’ বা intonation । এটা হলো কথার সুর। এই সুরের উৎস গলার জোর বা amplitude নয়, সে উৎস হলো উচ্চারণের পর্দা (pitch)। আপনি আস্তে থেকে জোরে নানা ধাপে একটা কথা (ধরুন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’) – মৃদুস্বর থেকে আকাশ ফাটিয়ে বলতেই পারেন, তাতে বাতাসে আপনার

কথার ঢেউগুলো খুব উঁচু উঁচু হবে। সাধারণত এক পর্দায় থেকেই গলার জোরের এই তারতম্য করা যায় – ‘সা’ পর্দায় থেকেই আপনি ‘সা’কে আস্তে থেকে জোরে করতে পারেন। কিন্তু পিচ্ মানে গানের পর্দা বদলানো। আপনি যদি বাদ্যযন্ত্রের স্কেলের একটা উঁচু পর্দায় –  ‘সা’র জায়গায় ‘গা’, ‘পা’ বা ‘নি’তে একটা কথাকে বলেন তখন তা তুলনায় তীক্ষ্ণ শোনাবে, আর কথার ঢেউগুলো ঘনঘন (পরস্পরের বেশি কাছাকাছি) হবে। মনে রাখবেন, গলায় জোরের বেলায় ঢেউগুলো কিন্তু বেশি উঁচুনিচু হবে, ঘনঘন নয়। ইংরেজিতে যাকে বলে frequency – তাই বেশি হবে ঢেউয়ের ক্ষেত্রে। জোর আর পর্দার মধ্যে সম্পর্ক নেই তা নয়, কিন্তু আমরা বোঝার সুবিধার জন্য এ-দুটিকে আলাদা করেই বলছি। যারা গান করেন তাদের এই পর্দার ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। হারমোনিয়াম বা ওই ধরনের যন্ত্রের এক-একটা ‘রিড’ই এক-একটা পর্দা।

লক্ষ করবেন, শুধু শব্দ বা সিলেবল নয়, বাক্যকেও তফাত করে ওই তান। বাক্যটা নিছক উক্তি, সংবাদ, না প্রশ্ন, না বিস্ময় প্রকাশ, না হুকুম তা অনেক সময়ে বাক্যের সুর দিয়েই ধরা পড়ে। সেজন্য আমাদের অনেক সময় মনে হয় বাক্যের ওই সুরটাই হয়তো আমাদের মনে আগে তৈরি হয়েছে, আমরা কথাগুলোকে পরে সুরের অধীন করেছি। কথা না বলে অর্থাৎ শব্দ ব্যবহার না করে যদি শুধু ‘উঁ?’ বলি তাহলেও প্রশ্নের সুর এসে যায়। কিংবা যদি পর্দা অনুসারে নিচের অর্থহীন শব্দগুলোকে ওপরে-নিচে সাজাই তা হলেও, সাজানো খুব নিখুঁত না হলেও, আপনারা ধরে ফেলবেন এটি প্রশ্ন, অন্য কিছু নয়।

হিজি?       খাবে?

হিজ্          ভাত

হিজিবি   তুমি কি

অর্থাৎ শুধু বাক্যের মধ্যে সাজানো ধ্বনি দিয়ে তৈরি শব্দ নয়, উচ্চারণের আরও নানা মাত্রা আমাদের কথার অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা যা বলতে চাই তাকে সুনির্দিষ্ট করে। জোরে কথা না বললে লোকে শুনতে পায় না, সেটা সামান্যই সমস্যা, জোরে বলতে বললে তার সমাধান হয়। কিন্তু কথার সুর ব্যবহার না করে, রোবটের এক সুরের কথার মতো একঘেয়ে ভাবে কথা বলে গেলে কোনটা প্রশ্ন, কোনটা উক্তি, কোনটা বিস্ময়বাক্য তা বোঝা যেতই না বলা চলে, অর্থের ওলটপালট হয়ে যেত। তাই শুধু শব্দময় বাক্যটিতেই পুরো অর্থ প্রকাশিত হয় না।

এই যে কথার তান, তা ভাষার একটা প্রথম অনুষঙ্গও। আমাদের ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে তা সবসময় জড়িয়ে থাকে। এমনই স্বাভাবিক। ‘স্বাভাবিক’ (natural) কথাটা ব্যবহার করার অবশ্য বিপদও আছে। ধরুন রোজকার কেজো ভাষা ব্যবহারে আপনি গলার যতটা জোর বজায় রাখেন, ফিসফিস করে বললে সেই জোরটা থাকে না। ফিসফিস করে বলা কি তাহলে অস্বাভাবিক? ধমক দিয়ে বলা? কাঁদো-কাঁদো গলায় বলা? ন্যাকামির সুরে বলা? এ নিয়ে আমাদের কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেই। কারণ মানুষের ভাষা ব্যবহার আবেগহীন কাজ নয়। শিশিরকুমার ভাদুড়ী নাকি কাউকে কাউকে তিরিশ রকমভাবে ‘না’ বলে দেখাতেন। তিরিশ হোক, আর চল্লিশই হোক, সবই তো ‘না’র নানারকম অর্থ প্রকাশের জন্য। সে তো অর্থ প্রকাশের প্রয়োজনেই। প্রত্যেকটা ‘না’র অর্থ শুধু নিছক ‘না’ নয় – তার সঙ্গে আরো নানা আবেগ জড়িয়ে আছে।

আওয়াজের জোর আর স্বরপর্দার নানা কারিগরিই হলো প্রায়ভাষা বা paralanguage। আবৃত্তিশিল্পী, সংগীতশিল্পী আর অভিনয়শিল্পীদের এই প্রায়ভাষা সম্বন্ধে খুবই সচেতন থাকতে হয়। প্রায়ভাষার বদলে যে অর্থের মাত্রাও বদলে যায়, এমনকি উলটেও যেতে পারে তা আপনারা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটা এরকম নানাভাবে বলে দেখুন –

 

সহজ সৎ আবেগে : আমি তোমাকে ভালোবাসি।

গর্জন করে : আমি তোমাকে ভালোবাসি।

মিনমিন করে : আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ভেংচিয়ে : আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ন্যাকামির সুরে : আমি তোমাকে ভালোবাসি।

বোঝানোর সুরে : আমি তোমাকে ভালোবাসি।

অসহিষ্ণুভাবে : আমি তোমাকে ভালোবাসি।

 

ভাবতে থাকুন, কোন্ উক্তিটার কী অর্থ দাঁড়াবে।

 

৩. কথার আরেক অনুষঙ্গ : অঙ্গভাষা (bodily gestures)

এটা খুব ভালো বুঝতে পারবেন টেলিভিশন দেখতে দেখতে তার আওয়াজটা বন্ধ করে দিলে। দেখতে পাবেন, লোকে কথা বলছে তো তাদের চোখ কখনো গোল হচ্ছে, কখনো ছোট হচ্ছে, কখনো বা একেবারে বন্ধ হচ্ছে, মাথা এদিক-ওদিক দুলছে বা সামনে ঝুঁকে আসছে, হাত নানাভাবে নড়ছে, হাতের আঙুলের নানা মুদ্রা তৈরি হচ্ছে – মুঠো করা থাকে, তর্জনী দেখানো বা বুড়ো আঙুল দেখানো। বসে থাকা অবস্থায় ঊর্ধ্বাঙ্গের এই সব ক্রিয়াকর্ম চলছে – আরো অনেক রকম ক্রিয়াকর্মের সম্ভাবনা আছে। বসে থাকা অবস্থায় পায়েরও কাজকর্ম চলতে পারে, উত্তেজনায় পায়ের হাঁটু কেউ প্রবলভাবে দোলাতে পারে, দাঁড়িয়ে থেকে কথা বললে বক্তা বা শ্রোতার পিঠ চাপড়ে দিতে পারে, ঘুষি বাগিয়ে তেড়ে যেতে পারে, মারপিটও শুরু করতে পারে। ঝগড়ার সময় দর্শকরা তো বলেই দেন ‘আরেদ্দাদা, হাত থাকতে মুখে কেন?’

কথা বলার অনুষঙ্গী এই যে সব শারীরিক ভঙ্গি, আমরা যাকে বলি অঙ্গভাষা, তা কিন্তু ‘সংকেত-ভাষা’ বা sign language নয়। সাংকেতিক ভাষা হলো ভাষার বিকল্প এক প্রকাশপদ্ধতি, ভাষা ব্যবহার না করে শুধু নানা অঙ্গের দ্বারা, বিশেষত হাত-আঙুলের নানা মুদ্রার দ্বারা, বার্তার আদান-প্রদান। মূক ও বধির ছেলেমেয়েরা যেসব সংকেত দিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে তা একটা ‘সংকেত-ভাষা’। মূক ও বধিররা ছাড়াও সংকেত-ভাষার ব্যবহার ব্যাপক। বয়স্কাউটদের একটা সংকেত-ভাষা আছে – তাতে শ্রোতার যদি কথা শোনানোর মতো নৈকট্যে না থাকে তা হলে পতাকার নানারকম দুলুনির সাহায্যে, কখনো-বা আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডুলী তৈরি করে, জাহাজযাত্রী বা ওপরে প্লেনযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বড় বড় অক্ষরে মাটিতে SOS (Save Our Souls) লিখে কতভাবেই না বিপন্নতার বার্তা দেওয়ার উপায় তৈরি হয়েছে। তাছাড়াও বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নানা বিকল্প সংকেত-ভাষা তৈরি হয়েছে, যেমন ASL (American Sign Language) বা BSL (British Sign Language)। এগুলো সংস্কৃতির সচেতন সৃষ্টি এবং এই সংকেতগুলো যে-নীতি মেনে তৈরি হয়েছে তা অনেকটা ভাষার মতোই, অর্থাৎ এগুলোর অর্থের সঙ্গে সংকেতগুলোর কোনো সাদৃশ্য বা নিত্য সম্পর্ক নেই – এগুলো ভাষাবিজ্ঞানের কথায় arbitrary, আরোপিত বা আপতিক। ফেসবুকে মুঠো-করা হাতের বাঁকানো বুড়ো আঙুল ওপরের দিকে তোলা থাকলে ষরশব বা পছন্দ বোঝায়, আর নিচের দিকে হলে অপছন্দ। কিন্তু ভেবে দেখুন তো,  মুঠো-করা হাতের বাঁকানো বুড়ো আঙুলের সঙ্গে আমার পছন্দ-অপছন্দের কী সম্পর্ক আছে? লোকে ওই চিহ্নগুলোকে মেনে নিয়েছে, তাই – অর্থাৎ convention এ চিহ্নগুলোকে ওই অর্থ দিয়েছে। সংকেত-ভাষার অর্থগুলো মূলত ‘আরোপিত’(arbitrary), আর গোষ্ঠীসম্মত (conventional)। মানুষের ভাষাও তাই। ভাষার প্রতিটি শব্দের অর্থও আরোপিত আর গোষ্ঠীসম্মত। তাই সংকেত-ভাষা আমাদের ভাষা প্রকাশের অপরিহার্য অঙ্গ নয়, তা একটি বিকল্প, সমান্তরাল উপায়।

কিন্তু অঙ্গভাষা ভাষার বিকল্প নয়, তা ভাষার অনুষঙ্গী। প্রায়ভাষার মতোই। তবে প্রায়ভাষা মূলত কণ্ঠস্বরের তারতম্যনির্ভর আর অঙ্গভাষা শরীরের নানা অঙ্গের চালনানির্ভর – যদিও কোনো কোনো সময় প্রায়ভাষা আর অঙ্গভাষার মধ্যে তফাৎ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। গলা দিয়ে তো আমরা শুধু আওয়াজের তারতম্য করি না, আমরা হাঁচি দিই, কাশি, নাকের ‘ঘোঁত’ আওয়াজ করি, গলাখাঁকারি দিই – এবং এগুলো যে কখনো কখনো কথা বলার কাজে লাগে না, তা নয়। কেউ আড্ডায় বসে বান্ধবীর কাছে জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা বলছে, তখন আর-এক  (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ) বন্ধু জোরে কপট হাঁচি দিয়ে বান্ধবীকে সতর্ক করতেই পারে। অনেক সময় কাশিও এই সতর্কবাণী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোনো একটা কথাকে উপেক্ষা করতে নাকের ‘ঘোঁত’ আওয়াজ আমরা করতেই পারি। লক্ষ করবেন, হাসিও অনেক সময় কথার অর্থ সম্বন্ধে ইঙ্গিত দিতে পারে। হাসির ‘হা হা হা’-র বদলে একটি জোরদার এবং তাচ্ছিল্যসূচক ‘হা!’ বা ‘হো!’ আগের সংলাপ সম্বন্ধে প্রগাঢ় ইঙ্গিত বহন করে। এই হাঁচি, কাশি, ‘ঘোঁত’ আওয়াজ, ‘হা!’ ‘হো’ ইত্যাদি অনেকটা ইংরেজি interjection -এর মতো। এগুলো পুরোদস্তুর কথা নয়, এগুলো অভিধানের কোনো শব্দ ব্যবহার করছে না, কিন্তু অন্যের সংলাপের ওপর যেন একটি মন্তব্য করছে – এতে আলাপের ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে, তাতে যতই ধাক্কা লাগুক। এ সবের প্রতিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী বক্তাদের মেজাজ খারাপ হতে পারে, আলাপ ক্রমশ ঝগড়ার দিকে এগোতে পারে, কিন্তু এগুলোও কথার অঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। আর এগুলো যেন একটি বাক্যেরই মতো, শোনা বাক্যটি সম্বন্ধে একটি বিশেষ মনোভঙ্গি প্রকাশ করছে।

অঙ্গভাষাকে কণ্ঠের এই নানা ক্রিয়াকলাপের থেকে আমরা একটু আলাদা করে দেখতে চাই। তারও দুটি স্পষ্ট ভাগ আছে। এক হচ্ছে, স্বতঃসিদ্ধ বা স্বয়ংক্রিয় অঙ্গভাষা। আর হলো গোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা কিছু অঙ্গভাষা। প্রথমটা, যেমন রেগে কথা বলার সময় চোখ লাল হওয়া, হাত মুষ্টিবদ্ধ হওয়া, বেশি বেশি মাথা নাড়ানো। এগুলো আপনা থেকেই কথার সঙ্গে চলে আসে, বক্তা অনেক সময় বুঝতেও পারেন না যে, তাঁর এসব শারীরিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বা গভীর আবেগে প্রেমের কথা বলার সময় চোখের পাতা নত হওয়া। এগুলো আমরা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, এবং এগুলো যে ঘটছে তাও আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না। এই স্বয়ংক্রিয় প্রতিফলন (reflex)-গুলো বাদ দিয়ে কথা বলা – অসম্ভব না হলেও কষ্টকর। অন্তত তাতে সচেতন চেষ্টার দরকার হয়। খুব রাগের কথা দাঁতে দাঁত চেপে কৃত্রিম শান্তমুখে বলাই যায়, মিষ্টি হেসেও বলা যায়। কিন্তু আমাদের মনে হয়, এতে বক্তা স্বাভাবিক প্রকাশের পথটা এড়িয়ে যাচ্ছেন, তার সজ্ঞান চেষ্টায় অন্য একটা ভঙ্গি, অনেকটা ছদ্মবেশের মতো, তুলে নিচ্ছেন। মনে হয়, আমাদের আবেগের একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ আছে, যাতে ওই সব অঙ্গভাষা গোষ্ঠীচৈতন্যে

সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রকাশিত হয়। তবে স্বাভাবিক আবেগকে আমরা নানাভাবে নিয়ন্ত্রণও করতে পারি, তখন ওই অঙ্গভাষাগুলো ততটা কার্যকর হতে পারে না।

কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলতে বাঙালি যে মাথা সামনে এক বা একাধিকবার ঝোঁকায়, আর ‘না’ বলতে দুপাশে ঝাঁকায় – সেটা তার সংস্কৃতির দান। দক্ষিণ ভারতীয়রা আবার মাথাটাকে পেন্ডুলামের মতো দুদিকে নাড়ায় ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়ে। হয়তো আগে এই ইঙ্গিতের ভাষাটাই ছিল, পরে তার সঙ্গে ভাষা যুক্ত হয়েছে। লক্ষ করুন, এই অঙ্গভাষা ব্যবহার না করেও বাঙালি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে পারে, কথায় ওই দুটো শব্দ ব্যবহার করে এবং তার সঙ্গে প্রায়ভাষা জুড়ে তাতে অগাধ বৈচিত্র্য আনতে পারে, অভিনেতারা যেমন করে থাকেন।

আমরা বলছিলাম অস্বয়ংক্রিয় অঙ্গভাষার কথা, যা সাংস্কৃতিক নির্মাণ। মাথার ঝাঁকুনি দিয়ে ‘হ্যাঁ’-‘না’ বোঝানোর কথা তো আগেই বলেছি। আবার আমরা হাতছানি দিয়ে অল্পস্বল্প দূরের লোককে ডাকি, হাতের তালুর বহির্মুখী ঝাঁকুনি দিয়ে কোনো কিছুকে নিয়ে যেতে বলি, অধ্যাপক ক্লাসে পড়াতে গিয়ে কতভাবে নিজের হাতদুটোর নানা ভঙ্গি করে তাঁর কথাকে জোরদার আর চিত্রল করার চেষ্টা করেন, বাচ্চারা কড়ে আঙুল বার করে ‘আড়ি’ করে, কেউ-বা ঠোঁট উলটে অভিমান প্রকাশ করে, কারো পেটে ঘুষি মেরে কেউ ঠাট্টা করতে চায় – এসব শরীরী সংকেত নৃবিজ্ঞানীর তালিকা ও বিশ্লেষণের বস্তু। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের এসব চালনা আমাদের কথাবার্তায় নতুন অর্থের মাত্রা যোজনা করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এসব অঙ্গভাষা ছাড়াও কথা বলা যায়। অর্থাৎ ‘ওদের মুখে আমি লাথি মারি’ বলতে গিয়ে কেউ মেঝেতে লাথি মারতেও পারেন, আবার নাও মারতে পারেন। এগুলো reflex বা স্বয়ংক্রিয় প্রকাশ কিনা তা হয়তো ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে (অর্থাৎ কেউ কেউ এসব অঙ্গভাষা ছাড়া কথাই বলতে পারেন না, এমন হতেই পারে), কিন্তু এসব অঙ্গভাষা ছাড়াও কথা বলা যায়। কাজেই  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো স্বয়ংক্রিয় নয়। এর সবগুলো নিজেদের গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নির্মাণ নাও হতে পারে, ভাষার শব্দের মতোই তা অন্য সংস্কৃতি থেকে ধার করাও হতে পারে। শব্দঋণের মতো অঙ্গভঙ্গি ঋণ। দু-হাত জুড়ে কাছে বা কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার যেমন আমাদের (হিন্দু) সংস্কৃতির ভঙ্গি, ডান হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক আবার অন্য সংস্কৃতির ভঙ্গি, যা আমরা আমাদের আচরণেও গ্রহণ করেছি। এরকম আর-একটা অঙ্গভাষা হলো ‘শ্রাগ’ (shrug) করা। মার্ক টোয়েনের এক বিখ্যাত ব্যাঙের গল্পে একটি ব্যাঙের কথা পড়েছিলাম, যে নানা লাফানো প্রতিযোগিতায় জিতে মালিকের ঘরে প্রচুর অর্থ এনেছিল। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগী মালিক তাকে প্রচুর হুইস্কি খাইয়ে দেওয়ায় আসল সময়ে সে না লাফিয়ে নাকি ‘ফ্রেঞ্চম্যানের মতো’ শ্রাগ করেছিল। তা থেকে ধরে নিচ্ছি শ্রাগ করাটা আধুনিক সভ্যতা ফ্রেঞ্চম্যান বা ফরাসিদের কাছ থেকে নিয়েছে। আমরাও নিয়েছি। এটা একটা ধার-করা অঙ্গভাষা, আগে উল্লিখিত ষরশব-এর চিহ্নটি যেমন আর-একটি ধার-করা অঙ্গভাষা।

তবে কোনো কোনো অঙ্গভাষা অনেক সময় বেশি জরুরি হয়ে ওঠে, তা অনেক সময় ভাষাকে কিছুটা অবান্তর করে তোলে। ‘নমস্কারে’র ভঙ্গিটি অনেকটা এরকম, তা ‘নমস্কার’ কথাটির প্রতিকল্পও হয়ে উঠতে পারে, কথাটি নাও বলতে পারি আমরা। অর্থাৎ কথার সহায়ক অঙ্গভঙ্গিগুলোর মধ্যে একটা স্তরবিন্যাস বা hierarchy আছে। এগুলো নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন।

 

৪. কাজেই ‘ভাষা’…

কাজেই ভাষা মানে নিছক ধ্বনি সাজিয়ে অর্থ প্রকাশ নয়। তাতে প্রায়ভাষা আর অঙ্গভাষা যোগ করে তার একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন্ত মূর্তি তৈরি হয়। চমস্কি হয়তো এগুলোকে বাইরের Performance factor বলবেন, কিন্তু এগুলোকে বাদ দিয়ে জীবন্ত ভাষা ব্যবহার কল্পনা করা সম্ভব নয়। এই কারণেই ইদানীং ব্যঞ্জনাবিজ্ঞান বা Pragmatics -এর ভাষা ব্যবহারের এসব অনুষঙ্গ-মাত্রাগুলোকে ধরে নিয়ে অর্থ বা ব্যঞ্জনার বিচার শুরু হয়েছে। আমাদের মনে হয়, ভাষা যে শুধু শুকনো ব্যাকরণ নয়, কেবল শব্দনির্মাণ, পদবন্ধনির্মাণ, বাক্যনির্মাণ মাত্র নয় – সেই ব্যাপকতর ধারণা ভাষাবিজ্ঞানে ক্রমশ গৃহীত হচ্ছে। জীবন্ত ভাষা ব্যবহার শুধু আক্ষরিক অর্থ প্রকাশ করে না, তা নানারকম ব্যঞ্জনাও প্রতিক্ষণেই ফুটিয়ে তোলে – সে-সম্বন্ধে আমরা ক্রমশ সচেতন হচ্ছি। ‘আমি এখন বাড়ি যেতে চাই’ – প্রয়োগ-প্রতিবেশ এবং প্রায়ভাষা আর অঙ্গভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই একটি বাক্যই কত অর্থ প্রকাশ করতে পারে, সে-সম্বন্ধে ভাষাবিজ্ঞানের বোধ ক্রমশ বাড়ছে।

 

১. এ-বিষয়ে আমার লোক : ভাষা সংস্কৃতি নন্দনতত্ত্ব বইয়ে (চিরায়ত প্রকাশন), ‘বাংলা গালাগালের ভাষাতত্ত্ব’ প্রবন্ধটি দেখা যেতে পারে।

২. ভাষার এই একটা কাজের নাম phatic communion বা ‘সৌজন্য সম্ভাষণ’। এতে আমরা যা কথা বলি তা নেহাতই সৌজন্য প্রকাশের জন্য, সামাজিক শিষ্টাচার রক্ষার জন্য – যথার্থ সত্যজিজ্ঞাসা বা সত্যভাষণের জন্য নয়। কেউ উত্তরে ‘ভালো নেই’ বললে ওই শিষ্টাচারের শর্তের বাইরে চলে যাবেন বক্তা, যেটা সবসময় বাঞ্ছিত নয়।

৩. আমি ইচ্ছা করেই নোয়ান চমস্কির i (Noun Phrase (NP) আর Verb Phrase (VP) কথাদুটিকে ব্যবহার করছি না। ‘উদ্দেশ্য’ আর ‘বিধেয়’ সবাই বোঝেন, আর চমস্কির NP, VP -র একাধিক অর্থ তৈরি হওয়ায় আমার মতে ভাষাবিজ্ঞানে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, যদিও ‘S’ বা Sentence -এর সঙ্গে এ-দুটির সাক্ষাৎ যোগ দেখিয়ে চমস্কি বিভ্রান্তি কাটানোর সুযোগও রেখেছেন। তবু পরিভাষার দ্ব্যর্থকতা কোনো সময়েই বাঞ্ছনীয় নয়।