ভাস্কর নভেরা : প্রায় বিস্মৃতি থেকে মঞ্চের পাদপ্রদীপে

অলোক বসু

নভেরা’ কোনো সাধারণ নাম নয়। এ-নামটি যখন উচ্চারিত হয়, তখন এর সঙ্গে আরো কিছু শব্দ বা অভিধা যুক্ত হয়ে বাঙালি পাঠকের মসিত্মষ্কে একটা ভিন্নমাত্রার ব্যক্তিত্ব, ভিন্ন জীবনাচরণ বোধের সৃষ্টি হয়। টম বয়, রহস্যময়, ফ্যাশনপ্রিয়, অভিমানী, উন্নাসিক, উড়নচণ্ডী, মুডি, ফ্রি মিক্সিংয়ে বিশ্বাসী, স্বেচ্ছানির্বাসিত আরো অনেক শব্দ বা অভিধা মিলেমিশে নভেরা নামের একটি ব্র্যান্ড তৈরি হয়ে আছে আমাদের মনে দীর্ঘদিন ধরে। এই নভেরাই যে আমাদের দেশের প্রথম নারী ভাস্কর তা আমরা সবাই কমবেশি জানি; কিন্তু তাঁর জীবন ও শিল্পকর্মের কতটুকুই বা জানা সম্ভব? অথচ তাঁকে নিয়ে বিদগ্ধ বাঙালি সমাজে আগ্রহের কোনো খামতি নেই। ১৯৯৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরা নামে একটি উপন্যাস ছাপা হলে চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। প্রায়-বিস্মৃত এক শিল্পীর জীবনের কিছু অধ্যায়ের ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’তে পাঠকচিত্ত ঝলমল করে ওঠে।

সম্প্রতি ‘ধ্রম্নপদী’ নামের অ্যাকটিং অ্যান্ড ডিজাইনিং স্কুলের ব্যানারে নভেরা নামে একটি নাটক এসেছে ঢাকার মঞ্চে। নভেরা প্রযোজনায় মঞ্চসজ্জায় তেমন বাহুল্য নেই। কালো পর্দায় ঘেরা মঞ্চ। ডাউন লেফট স্টেজে বসার মতো বেতের একটা সিঙ্গেল সোফা। আপ মিডেল স্টেজে দুপাশ থেকে সিঁড়ির আকারে উঠে-যাওয়া বেদির মতো একটা স্থান। স্বল্প আলোয় বেদির চূড়ায় দর্শকের দিকে পেছন দিয়ে ধ্যানমগ্ন নভেরা। পিঠ বেয়ে নেমে এসেছে দীঘল কালো চুল। মাথার ওপরে সন্ন্যাসিনীর মতো চূড়া করে চুল বাঁধা। এক লহমায় রক্তমাংসের নভেরাই যেন দর্শকদের সামনে হাজির হন। কথকতার ভঙ্গিতে আত্মবয়ান দিয়ে চলেন নভেরা চরিত্র সৃজনের অভিনয়শিল্পী। প্রায় ঘণ্টাখানেকের বয়ানে আত্মজৈবনিক ধাঁচে নভেরা উপাখ্যান উপস্থাপিত হয় দর্শকসমক্ষে।

হাসনাত আবদুল হাই-রচিত ভাস্কর নভেরো আহমেদের জীবনীভিত্তিক উপন্যাস অবলম্বনে নভেরা নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছেন সামিউন জাহান দোলা। নাটকটিতে একক অভিনয়ও করেছেন দোলা। নির্দেশনা দিয়েছেন সাজ্জাদ রাজীব। উপন্যাস পাঠ আর নাটক দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক। দুরকম আনন্দ পাওয়া যায় দুই জায়গায়। যেহেতু নভেরা অনেক বড়মাপের শিল্পী এবং তাঁকে নিয়ে রচিত হাসনাত আবদুল হাইয়ের উপন্যাসটিও আমাদের কাছে প্রামাণ্য একখানা উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত, সেজন্য নভেরা প্রযোজনা দেখার পরে একটা তুলনামূলক বিশেস্নষণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে দর্শকের মসিত্মষ্কে। প্রথমেই বলতে হয়, হাসনাত আবদুল হাই নভেরা উপন্যাস লিখতে গিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন উপন্যাসের ফর্মের ব্যাপারে। কখনো তিনি বর্ণনার ভঙ্গিতে লিখে চলেছেন, কখনোবা মজলিশি আড্ডার ঢঙে আবার কখনো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার ভঙ্গিতে লিখেছেন। কখনো লেখক নিজেই সরাসরি স্বনামে একটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন নভেরা উপন্যাসে। এসব কারণে পাঠক উপন্যাস পাঠের মধ্য দিয়ে এক বহুমাত্রিক নভেরাকে আবিষ্কার করতে পারেন। কিন্তু নভেরা যখন মঞ্চে একক অভিনয়ের নাটক হিসেবে উপস্থাপিত হয়, তখন উপন্যাস পাঠের স্বাদ আর থাকে না। যে-ছবিটা উপন্যাস পড়তে-পড়তে মনের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়, সেটা আর মঞ্চে থাকে না; থাকার কথাও নয়। কারণ দুটো মাধ্যমই আলাদা। আমি প্রযোজনা-পরিকল্পনার দোষ দিচ্ছি না। চ্যালেঞ্জটা হলো মিডিয়াম ট্রান্সলেশনের। এ-কারণে নভেরা উপন্যাস যেসব দর্শকের আগে থেকে পড়া ছিল, তারা অনেককিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। আগেই উপন্যাসের বহুমাত্রিকতার কথা উলেস্নখ করেছি। সেই বহুমাত্রিকতা ব্যাহত হয়েছে একক অভিনয়ের নাটক- পরিকল্পনায়। নভেরাকে বুঝতে গেলে তার সময়কে বুঝতে হয়, তার আশপাশের মানুষকে বুঝতে হয়। উপন্যাসের নভেরা এক বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী হয়ে ওঠেন তাঁর সময়ে, যাদের সংস্পর্শে তিনি এসেছিলেন তাদের বিশেস্নষণে। এক্ষেত্রে বিষয়টি অনুধাবন করার প্রয়োজনে দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও সংগীতকার খান আতার সঙ্গে পরিচয় পর্বে নিজের সম্পর্কে নভেরা বলেন, ‘বাঙালি মেয়ে বলতে যেমন জড়ভরত, লজ্জাশীলা, পুরুষের অনুগত একটি জীব বোঝায়, তেমনি হবার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।’ নভেরার এই উক্তি খান আতা যখন তার বন্ধুমহলে প্রকাশ করেন, তখন দুটি ব্যাপার ঘটে। প্রথমত, নভেরার চরিত্রের ঋজুভঙ্গিটি সবার কাছে প্রকাশ পায়, একই সঙ্গে ফরাসি দার্শনিক সিমন দ্য বভোয়াঁর দ্য সেকেন্ড সেক্সের প্রভাব কিংবা ফরাসি লেখক ও দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের কথা ‘আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই অ্যামে’র অনুরণন পাওয়া যায় নভেরার জীবনবোধে। দ্বিতীয়ত, সেই সময়কার অগ্রবর্তী তরুণ তুর্কি লেখক-শিল্পী-কবিদের মধ্যে নভেরাবিষয়ক আড্ডায় যে ভিন্নমত প্রকাশ পেয়েছে নানাজনের নানা মন্তব্যে, তাতেও নভেরা সম্পর্কে একটি মিশ্র ধারণা তৈরি হয় পাঠক মহলে। হাসনাত আবদুল হাইয়ের উপন্যাসে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে নভেরাবিষয়ক আড্ডা কিংবা মন্তব্যে যাদের পাই তাঁরা হলেন – বজলুস সাত্তার, মাহবুবুল আলম চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী, কায়সার হক, কমরুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদিন, খান আতাউর রহমান, সাঈদ আহমদ, নাজির আহমদ, হামিদুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, শামসুর রাহমান, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আবদুলস্নাহ খালেদ প্রমুখ। এ ছাড়া প্রসঙ্গক্রমে এসেছে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, এসএম সুলতান, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, হাসি চক্রবর্তী প্রমুখের কথাও। প্রগতিশীল উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, লেখক ইসমত চুগতাই, চলচ্চিত্রকার শাহিদ লতিফ, মুম্বাইয়ের নৃত্যশিল্পী বৈজয়মত্মীমালা প্রমুখের সঙ্গে নভেরার সাক্ষাৎ, পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার প্রসঙ্গটিও চমৎকারভাবে উঠে এসেছে উপন্যাসে। বিলাতফেরত নভেরার ঢাকায় অবস্থানকালে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এক মমতাময়ী মায়ের চরিত্র হিসেবে দেখা যায়, যিনি তাকে সেণহে ধন্য করেন তিনি হামিদুর রহমানের মা। উপন্যাসে রক্তমাংসের এসব চরিত্রের উপস্থিতি নভেরাকে বুঝতে, বিশেস্নষণ করতে সহায়তা করে। যেমন নভেরাকে নিয়ে সাঈদ আহমদের উক্তি – ‘শি ডিড নট নো, হু শি ওয়াজ’ কিংবা ‘নভেরার লাইফটাই মনে হইব স্ক্যান্ডালস, ফুল অব স্পাইস।’ এসব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের প্রবল অনুপস্থিতি আমরা লক্ষ করি নভেরা নাটকে। এখানে নভেরা উপস্থাপিত হন অনেকটা একরৈখিকভাবে। মাহবুবুল আলম চৌধুরী, জয়নুল আবেদিন, হামিদুর রহমান, নাজির আহমদ এবং তাঁর মায়ের (তিনি সাঈদ আহমদ ও হামিদুর রহমানেরও মা) উপস্থিতির কিঞ্চিৎ আলামত প্রযোজনাটিতে পাওয়া গেলেও তা পাঠকের আগ্রহের তুলনায় খুবই কম। এটি অত্যন্ত বড় একটি ত্রম্নটি বলেই মনে হয়। তার পরও বলতে হয়, উদ্যোগটির মধ্যে একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। একক অভিনয়ের মঞ্চরূপে বহুমাত্রায় নভেরাকে হয়তো পাওয়া যায়নি এ-প্রযোজনায়, তবু বলতে হয়, যা পাওয়া গেছে তাই বা কম কী। নভেরাকে যে ভুলতে বসেছিল এদেশের মানুষ, তাই তাঁর মৃত্যুর পরে দ্রম্নততম সময়ে ধ্রম্নপদী যে-কাজটি করেছে তা অনন্য। এই মহান শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে? নভেরা নাটকের ডিজাইন অত্যন্ত সাদামাটা। তবে অভিনয়শিল্পী সামিউন জাহান দোলা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেছেন মঞ্চে নভেরাকে উপস্থাপন করতে। সেক্ষেত্রে তিনি সাফল্যও পেয়েছেন। তবে আলো ও আবহ-সংগীতের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো মনোযোগ দরকার। নাট্যকর্মের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত কিংবা যাঁরা উপন্যাসটি পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে হয়তো এক ধরনের অতৃপ্তি কাজ করবে; কিন্তু সাধারণ দর্শক নভেরাকে জানতে পারবে, বুঝতে পারবে এ-নাটকের মধ্য দিয়ে। ধ্রম্নপদীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এ-ধরনের প্রযোজনা মঞ্চে আনার জন্য। তাঁদের উদ্যোগ সফল হোক। আরো বেশিসংখ্যক মানুষ জানতে পারুক নভেরাকে, নভেরার জীবনকে, তাঁর কাজকে।