ভূদশ্য ও জীবনের শিল্পনিনাদ

জাফরিন গুলশান

অলকেশ ঘোষ বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্প-পরিমন্ডলে পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট হিসেবে। শিল্পী প্রায় চার দশক ধরে এদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মাঠঘাট, নদী, পাহাড়, সাগর, গ্রাম-শহর এবং অঞ্চলকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক-সামাজিক জীবনের দলিল চিত্রায়ণ করেছেন। ঢাকা আর্ট সেন্টারে তাঁর একক চিত্রকলা প্রদর্শনীতে ভূদৃশ্য ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতির সঙ্গে রয়েছে নাম-না-জানা, অপরিচিত আদিবাসী রমণী ও অন্যদের অভিব্যক্তিময় মুখাবয়বের চিত্রায়ণ। কিছু রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চিত্রমালা। ফলে এ-প্রদর্শনীতে সহজ কিছু বৈশিষ্ট্য নিরূপণ হয়েছে। যেমন, কতগুলো দৃশ্যেপাছানের আয়োজন, যা দৃশ্যগত ভাষা হিসেবে কাজ করেছে। শিল্পীর নির্দিষ্ট কিছু পছন্দ যা উদ্দেশ্য অনুযায়ী  সৃষ্ট হয়েছে এসব কাজে। মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়েছে, যা একটি সময়ে একটি নির্দিষ্ট সমাজের নির্দিষ্ট সংস্কৃতির বহির্জগৎ ও মনোজগতের সদাবহমান অবয়বের দলিলে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু সময়ে খোদ এই ঢাকা শহরে বিগত কিছু বছরে দৃশ্যশিল্প চর্চার ক্ষেত্রে যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি শ্রেণির কাছে গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে তা একটি ডিসকোর্সে পরিণত হচ্ছে, সে-প্রেক্ষাপটে শিল্পী অলকেশ ঘোষ বেশ ব্যতিক্রম।

অলকেশ ঘোষ অধিক চর্চা করেন নিজের দেখা অভিজ্ঞতার তাৎক্ষণিক উপস্থাপনের। জলরঙে রয়েছে তাঁর মুনশিয়ানা। তাই জলরংকে মূল মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তুরাগ নদ, বান্দরবান প্রভৃতি জলরঙের কাজে দ্রুততার সঙ্গে পরিশীলিত মেজাজ লক্ষণীয়। জলবায়ু পরিবর্তনের এই কালসময়ে একসময় হয়তোবা বান্দরবান কিংবা তুরাগ নদকে বুঝতে হলে এ-কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিল্পকর্মের আসলে রয়েছে বহুবিধ কর্তব্যপরায়ণতা। সেটা সচেতন কিংবা অসচেতন দুভাবেই নির্মিত হয়। প্রদর্শনীতে রয়েছে অ্যাক্রিলিক, প্যাস্টেল, পেনসিল ইত্যাদি মাধ্যমের শিল্পকর্ম। পৃথিবীর ইতিহাসে এসব মাধ্যম বহুল এবং ব্যাপকভাবে নানামাত্রায় চর্চিত হয়ে এসেছে; কিন্তু অলকেশ ঘোষ এসব মাধ্যমকে নিয়ে নির্মাণ করেননি কোনো চরম নিরীক্ষামূলক অবস্থা। মাঝামাঝি একরকম সরল ও অ্যামেচার গুণ ধরে রাখা এবং ছবি বিক্রির হিসাব-নিকাশে সফল একজন শিল্পীর যে-মেজাজ বিশ্লেষিত হয়, তা মাত্রা পায় শিক্ষা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এদেশের মূল জনসংস্কৃতি চেতনার সমসাময়িকতার সুস্পষ্ট মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

অলকেশ ঘোষের জন্ম ১৯৫০ সালে। কেন এ-ধরনের কাজ করেন, সেক্ষেত্রে বলা যায়, মফস্বলে বেড়ে ওঠা তাঁর মনস্তাত্ত্বিক জগতের অতীতবিধুর রোমান্টিসিজম প্রোথিত হয়েছে শিল্পভাবনার আঙ্গিকে। দশম ও একাদশ শতাব্দীতে চীনে তাং ও সোং রাজত্বের মুখ্য বিষয় হিসেবে গড়ে-ওঠা সময়ে ল্যান্ডস্কেপ স্ক্রিনের ধারা পরবর্তীকালে ইউরোপে ব্রুইগেল, ক্লোদ লোঁরা, জ্যাকব ভ্যান রুইসডেল, টার্নার, কনস্টেবল প্রমুখ শিল্পীর ক্রমাগত অনুশীলন ও পরে কলোনিয়াল পিরিয়ডে নতুনভাবে এই ভারতীয় অঞ্চলের শিল্পের বিকাশ এবং অতঃপর রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী, এনএফ সুজা, আকবর পদমসী প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পী ল্যান্ডস্কেপে প্রকৃতি ও জীবনের নানা ভাব হাজির করেছেন। ফলে ভাবগত, চেতনাগত কিংবা বাস্তবগত যেভাবেই হোক না কেন, ঐতিহাসিকভাবে এ-বিষয়ের গুরুত্ব বিদ্যমান নিঃসন্দেহে। তাই উত্তরাধুনিক এ-যুগে যখন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় কোনটা শিল্প নয়, তখন অলকেশ ঘোষের সহজ-সরল যাত্রাপথ নানা আঙ্গিকে; নানা প্রশ্নে বিবেচিত হবে এটাই স্বাভাবিক।

২৯ মার্চ শুরু হওয়া প্রদর্শনটি শেষ হয় ৭ এপ্রিল।