মধ্যরাতে তসিলদার

সৈয়দ শামসুল হক
গল্পপট। পট খুলে যায়। বিস্ময়ের মধ্যে বিস্ময়, আর কারো নয়, জলেশ্বরীর সবচেয়ে হতভাগা গরিবুল্লার মুখ ভেসে ওঠে। আমাদের এ-তল্লাটে সবচেয়ে নিরীহ সবচেয়ে নিরুপদ্রব সবচেয়ে একা মানুষ এই গরিবুল্লা। ছিল তারা এগারো ভাইবোন, বাপ মরার পর ছোট ভাইবোনেরা বলল, তুই তো চাইরের চার বচ্ছর বাপের কোলে একাই উঠিছিস, মায়ের কোলও মুখ রাখি নিন্দও গিইছিস। বাপ-মায়ের সম্পত্তি সব পাওনা উয়াতে তার শোধ হয়া গেইছে। এলা বাড়ি থেকে বিরা।
গরিবুল্লা পথে নেমে আসে। সেই থেকে নিঃসম্বল নিঃসহায় সে একা মানুষ। এমনই তার ঢিল-খাওয়া অবস্থা, ভালো করে কথা মুখে ফোটে না, কারো দিকে ভালো করে তাকায় না, কথার জবাব দেয় একটি বা দুটি শব্দে। এই গরিবুল্লাকে আমরা পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে চেষ্টা করি।
গরিবুল্লা, তুই কী পারিস চাচা?
পারা মানে?
মানে, হাতের কাজ।
গরিবুল্লা কিছু বুঝতে না পেরে আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
কিছু তো পারিস চাচা, নাকি?
তখন আমরা দেখতে পাই ধীরে তার মুখে স্মৃতির আলো ফুটে ওঠে। বলে, পারি। চেষ্টা করিলে পারুম নিশ্চয়।
কী চেষ্টা করিলে?
মাও জননীকে দেইখাছিনু।
কী দেইখাছিলি?
গজা বানাইতে।
গজা?
সরল লাঠির মতো লম্বা খাড়া গজা।
ব্যস? আর?
নারিকেলের মোয়া, পায়রার ডিমের মতো ছোট-ছোট মাও বানাইতো। মুঁই বসি বসি দেখিতম।
আর?
একখান জিলাপি। জিলাপির আড়াই প্যাঁচ নয়, সাত প্যাঁচও নয়। সরল লাম্বা সোনার কাঠি দিয়া সেই জিলাপি। সেই আমার শেষ শিক্ষা জননীর কাছে। তারপর থাকিয়া আমি পথে। তারপর তোমরা আসিয়া এইসব পুরান কথা টানি তুলিলেন।
এতক্ষণ কথা বলার চাপে গরিবুল্লার হাঁফ ধরে ওঠে। বুকে হাত দিয়ে সে দোকানের পাটায় শুয়ে পড়ে।
দোকানের পাটা মানে গরিবুল্লার নিজের দোকান। আমরাই তাকে ঘর তুলে দিয়েছি – আধকোশা নদীর খেয়াঘাটে ঘুমটি ঘরের পাশে। গরিবুল্লার দোকানে দুধ-ছাঁকা চা হয়, গজা হয়, মোয়া হয় আর ওই সোনার পিঁড়ির মতো জিলাপি হয়।
কত রকমের যাত্রী তারা কেউ ধমক পেড়ে, হুকুম করে বলে, এইও, চা লাগা।
আবার কেউ নরম গলায় বলে, মিয়া, তোমার চায়ের খুব সুখ্যাত শুনিছি, শ্বশুরবাড়ি, যাবার পথে দ্যান না এককাপ। গাও চাঙ্গা করি সাগাইবাড়ি ঘুরি আসি। এই লোকটি ফেরার পথে বউ নিয়ে আসে। বসে বসে তারিয়ে তারিয়ে চা খায় তারা। গরিবুল্লার বুকের ভেতরে আনন্দের শাপলাফুল নেচে ওঠে।
দিনরাত্তির কখনোই গরিবুল্লার দোকান বন্ধ হয় না। দোকানেই সে থাকে, দোকানেই সে ঘুমায়। রাতদুপুরে কেউ এলে সজাগ মানুষ হয়ে ওঠে। চা বানিয়ে খরিদ্দারের হাতে দেয়। এতটুকু ক্লান্তি বা বিরক্তির ছাপ নেই। বরং বলে, একখান গজা খান। স্বাদ লাগিবে। না রে, না। গজা খাবার টাইমও নাই, পয়সাও নাই।
ইচ্ছে করলে লোকটিকে বিনা পয়সাতেই একটা গজা দিতে পারত গরিবুল্লা। দেয় না। বিনা পয়সায় গজা দিবার তার এক ঠাই আছে। শুক্রবার জুম্মার দিন সে এক-দেড় কেজি গজা নিয়ে মসজিদে যায় তারপর নামাজ শেষে শিশুদের মধ্যে গজা বিলায়। গরিবুল্লা বিবাহ করে নাই। তার বুকে শত শিশুর হাসিমাখা মুখ এসে আপন সন্তানের হয়ে যায়।
রাত নামে। আধকোশার বুকে জলের শব্দ। ক্রমেই জেগে-ওঠা চারদিকে সুনসান স্তব্ধতার ভেতরে যেন গরিবুল্লাকে বলতে চায়, ঘুমারে গরিবুল্লা। এলাও তোর চক্ষে ঘুম নাই?
গরিবুল্লা এর উত্তর দেবার দরকার বোধ করে না। নদীর প্রশ্ন বুকের নীরবতায় উত্তর পেয়ে যায়।
গরিবুল্লা হাতবাক্সোটি কোলের কাছে নিয়ে পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কতক্ষণ সে ঘুমায়, সে জানে না।
ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ সে টের পায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে তার দোকানের সমুখে। মাঝরাতের কোনো যাত্রী কি চায়ের জন্য এসে থেমেছে, ঘুমন্ত চাঅলাকে জাগাতে ইতস্তত করছে?
লাফ দিয়ে সে উঠে পড়ে।
আরে একি! আই বাপ! জগৎ কি উলটপালট হয়া গিইল!
সমুখে সে মানুষ নয়, রাজবাড়ির থামের মতো দুইখান থাম্বা চোখে দেখে ওঠে। ধীরে ওপরের দিকে চোখ তোলে। মাথা দেখা যায় না। মাথা যেন উত্তরের তারা পর্যন্ত ছুঁয়ে আছে। গরিবুল্লা নিচের দিকে চোখ নামায়। পায়ে চকচকে পাম্পশু নজরে আসে। লোকটির গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির গলায় কড়ই কাঠের টুকরায় তসবি ঝুলছে আর হাতে তার আধকাটা লাউয়ের খোল। সেই খোলটিও ভাতের হাঁড়ির মতো এত বড়। লোকটি বলে, ওরে গরিবুল্লা, তোর কাছে মোকে পাঠেয়া দিলে।
কাঁই?
তাকে তো দেখ নাই, কেবল তার গলা শুনিছি। বাঁশবনে ঝড় উঠিলে যে সাঁই সাঁই সোঁ সোঁ শব্দ ওঠে, তারই মতো গলা।
কন কী বাহে?
সত্যই কই। এই দ্যাখ আমি উঁচাও নয়, লাম্বাও নয়, তোরে মতো মানুষ। এই দ্যাখ – বলতে বলতে লোকটি পাহাড়ের উচ্চতা থেকে চোখের পলকে সাধারণ মানুষের আকার পায়। বলে, মোকে তোর কাছে পাঠাইলে। তোর কাছে কিছু ঋণ আছে। সে ঋণ শোধ করিবার কারণে মোকে তসিলদার করি পাঠাইলে।
গরিবুল্লা ভেবে কূল পায় না। কার কাছে কবে সে ঋণ করেছিল, তার তো মনে পড়ে না। সে ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, কত টাকার ঋণ?
লোকটি বলে, তাও হামাকে কয় নাই। কইছে কেবল শোধ করি দিবার ক। তারপর লোকটি গলার তসবিতে হাত রাখে, বাতাসে মিলিয়ে যায়।
অনেক ভেবেচিন্তে গরিবুল্লা তার মালিকের জামাই তসর মিয়ার কাছে যায়। বলে, একখান লোক আসিছিল।
ব্যবসায়ী মানুষ তসর মিয়া। লোক আসার কথা শুনে চমকে ওঠে। কী ব্যাপার। কীসের জন্য আসিছিল?
তখন গরিবুল্লা বলে, ঋণ আদায় করিতে।
ঋণ? কার ঋণ? তোর না হামার?
কইলে তো হামার।
তোর আবার ঋণ কীসের? ন্যাড়া ন্যাংটা মানুষ, তার আবার ঋণ। ঋণ যদি থাকে তো আল্লার কাছে আছে। আল্লা তোকে
আমার খেয়াঘাটের পাশে পার্মানেন্ট জাগা করি দিচ্ছে। ঋণ থাকে তো তারে কাছে তো। যা দোকানে যা, শুতি পর। চান্দ ডুবিতে এলাও দুই প্রহর।
এসব কথা শুনে গরিবুল্লার মনে শান্তি আসে না। ঋণ ঋণ ঋণ – তার মাথার ভেতরে বোলতার মতো গুঞ্জন করতে থাকে। ঋণ ঋণ ঋণ। তারপর বুকের ভেতরে ঢাকের বাদ্যের মতো বোল জাগিতে থাকে। শোধ করি দে। শোধ করি দে। শোধ করি দে।
বহুদিন বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজারে যাওয়া হয় নাই। গরিবুল্লা ভোর ফজরে মাজারে যায়। মাজারের খাদেম তখন মাজার প্রাঙ্গণে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। গরিবুল্লা তার সমুখে গিয়ে ডাক দেয়, বাবা।
কে রে, কাঁই?
মুই গরিবুল্লা। নদীর ধারে চায়ের দোকান করোঁ।
তো, কী কথা?
গরিবুল্লা মাথা চুলকে বলে, একখান আজদাহা অদ্ভুত মানুষ আসিছিল। কয়, আমার নাকি তার কাছে ঋণ আছে। শোধ করি দে, শোধ করি দে, কয়া সে আসমানে উঠিয়া যায়।
মাজারের খাদেম হা-হা করে হেসে ওঠেন।
বলেন, তুই না একবার কামাখ্যা কামরূপের দ্যাশে গিয়াছিলি? শয়তানের সেই দ্যাশ হতে এইসব অপকুপো ছবি ধরিয়া আনিছিস। যা, মাজারে যা কিছু পারিস, দিয়া যা, সালাম করি যা। বাবার গুণে সব দোষ কাটিবে। সেই লোক আর না আসিবে।
কিন্তু সে আসে। এবারে শাদা রং মানুষের আকার ধরে। আসে এশার নামাজের পরপরই। তাকে দেখে বুক চেপে ওঠে গরিবুল্লার। বলে, আবার কেনে?
আসিলোম, শোধ নিতে।
চারদিকে আগুনের শব্দ, বাঁশের ভেতরে মানুষ পুড়ছে। শিশু পুড়ছে। নববিবাহিত দম্পতি পুড়ছে। আর উৎকট চিৎকারে দেশের সমস্ত শুভ কণ্ঠ ডুবিয়ে দিতে চাইছে। গরিবুল্লা ধীরে পা নামায়। তার পা পাহাড়ের মতো বিশাল হয়ে যায়, পায়ের চাপে মুহূর্তে আগুন নিভে যায়।
কীসের শোধ? কীসের শোধ?
গরিবুল্লার মাথার ভেতরে সব আলুথালু হয়ে যায়। বারকোশের ওপরে নারিকেলের আধমাখা মোয়া পড়ে থাকে। গজার সরল কাঠি ভাজার অপেক্ষায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। আর সেই সোনার পিঁড়ির মতো আশ্চর্য জিলাপিটি গরম তেলে আপনা থেকেই ভাজা হতে থাকে।
গরিবুল্লা জ্ঞান হারায়।
এরকম আপনা থেকে জিলাপি ভাজা এ তো অবাক কা-। গজার সরল দীর্ঘ শরীর চোখের সমুখে বড় হতে থাকা এও এক অবিশ্বাস্য। নারিকেলের আধমাখা মোয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে গরিবুল্লা লক্ষ করে, তারা নিখুঁত মোয়ায় পরিণত হচ্ছে আপনা থেকেই। জ্ঞানহারা কিংবা জ্ঞানহারা নয় গরিবুল্লা উঠে দাঁড়ায়। লোকটিকে সন্ধান করে। কোথাও তাকে দেখা যায় না। শুধু শোনা যায় বাঁশবনে ঝড়ের শব্দের মতো সেই গলা, তোর কাছে ঋণ আছে, অনেক ঋণ, তুই ঠাহরও করিতে পারিস নাই। নাই নাই নাই শব্দটি মাথার ওপরে ভোরের প্রথম পাখির মতো ডেকে ওঠে।
গরিব, গরিব রে, জাগি ওঠ, চিন্তা করি দ্যাখ, ঋণ তোর আছে কি নাই।
সোনার দরজা খুলে যায়। গরিবুল্লার মনে হয়। আছে, আছে, আছে।
তার মনে পড়ে যায় ফ্রেমে বাঁধা পুরাতন ছবির মতো সেই সন্ধ্যাকাল।
পাঞ্জাবিরা নদী পার হবার জন্যে ঘাটে আসিছিল আর তুই দোকান ছাড়ি লাফ দিয়া পানিতে নামিয়া খাড়া হয়া গিইছিল। তোর মাথা আকাশ ভাঙি শেষ তারার কাছে পৌঁছাইয়া ছিল আর তোর পায়ের কাছে পাহাড়ের থামের প্রসারে নদীর ঘাট বন্ধ হয়া গেইছিল, মনে নাই?
বাঁশবনে ঝড়ের শব্দ। তোর মনে নাই। দ্যাশ তো তোরে কাছে ঋণী।
মোর কাছে? মুই যে গরিবের গরিব। কত বড় মানুষ আছে, তয় মোর কাছে ক্যানে?
বাঁশবন, ঝড়ের স্বরে উত্তর দেয়, মুঁই তো বড় মানুষের পক্ষে নয়, মুঁই গরিবের পক্ষে। আর তুই এ বাংলার গরিবের সব গরিবের একজন। আমার এখনো মনে আছে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আওয়াজ শুনিয়া খেয়াঘাটের মাঝি তো পালায়া গেল। তুই লাফ দিয়া পানিতে নামলি। তোর পা পাহাড়ের মতো বিশাল হতে থাকল, মাথা গিয়ে আকাশে পৌঁছাইলো। তোর কাছে আমার ঋণ।
শোধ করি দিবার যে কথা কও, কীসে শোধ করিবে? আবার বিশাল বিপুল হয়া উঠিবে। আমার কাছে এই তোর ঋণ। আর তোর কাছে এই সেই ঋণের পরিশোধ।
হঠাৎ পায়ের কাছে ভাঁজ ভেঙে গল্পপট খুলে যায়। সারা শহর বিদ্যুতের মতো সংবাদটি পায়। গল্পপটে নারিকেলের মোয়া লাল আভা পায়। গজার সরল দ- তার মাথায় সোনার পিঁড়ির মতো জিলাপিটি বসে যায় যেন সোনার পতাকা ওড়ে।
শহরের লোকেরা চারদিক থেকে ভিড় করে আসে। আমরা শুনেছি গরিবুল্লা সেই পটের সমুখে দাঁড়াতেই চ্যাপ্টা হতে-হতে পটের বুকে সটান ছবি হয়ে যায়।
লোকেরা অবাক হয়ে যায়। তারপর পটের বুকে সটান সে দাঁড়িয়ে পড়ে। গরিবের গরিব গরিবুল্লা মাথার ওপরে লাল সূর্য ধরে হাতে সোনার পতাকা বিশাল এক পটচিত্র হয়ে যায়।
নীলপট – তার মাথায় সুনীল আকাশ। আকাশে লাল সূর্য, তার পাশে গরিবুল্লার হাতে সোনার পতাকা।
আকাশের নীল হালকা হতে হতে ক্রমেই সবুজ হয়ে যায়। বাংলার বাঁশবনের সবুজ।
গল্পপট, গরিবুল্লাকে তুলে নিয়ে নীল ওই পটচিত্র বাংলার আকাশে উড়ে যায়। 
অনুলিখন : আনোয়ারা সৈয়দ হক
২৪/৯/২০১৬, সকাল
ইউনাইটেড হাসপাতাল