মাংস

Badrun Nahar (Rokey Sultana)বদরুন নাহার

রুদ্রপুর গ্রামের কিশোর মোস্তফা কোনো ভিক্ষুক বা ফকির নয়, তবে সে কোনো ছাত্রও নয়। কারণ সে কোনো স্কুল বা মাদ্রাসায় পড়তে যায় না। সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়ানো, গ্রামের অন্যদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলা বা গাছে উঠে ফলটল পাড়া কোনো কাজের কাজ না। এক কাঁদি নারকেল পাড়তে পারলে দুইটা নারকেল মেলে। অতএব মোস্তফা মোস্তফাই, তার ভিন্ন কোনো পরিচয় নেই। যদিও এর-ওর বাড়ি ঘুরে ফেরার সময় বা টুক করে বরইগাছে ঢিল মারার সময় তাকে হারামজাদা বা বেজন্মা বলে সম্বোধন করা হয়ে থাকে, তবে তা তার কোনো পরিচয় নয়। আর মোস্তফার এতো পরিচয় দিয়ে কী হবে, সে তো আর ভিজিটিং কার্ড ছাপাবে না। সংসারে তারা দুইজন মানুষ
মাত্র। সে আর তার মা। মা সারাদিন মাটিকাটার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে হয়তো কখনো-কখনো ক্লান্ত আদুরে গলায় ডাকে – মস্তো বাবজান। কখনো বা ক্লান্তিতে বিরক্ত হয়ে ডাকে – ওই মস্তা, হারামজাদা গেলি কই? সেই মোস্তফা ফকির না হলেও ফকিরের দলে যোগ দেয় মাঝেমধ্যে। যেমন আজ সে প্রতিবেশী বৃদ্ধ ফকির মোজাফর মিয়ার সঙ্গী হয়েছে।
দ্রুত পা চালিয়ে তারা দুজন যখন সৈয়দ বাড়ি পৌঁছালো, তখন সেখানে ছোট একটা জটলা তৈরি হয়ে গেছে। বৃদ্ধ ফকির মোজাফর মিয়া পথের ক্লান্তিতে টেপা মাছের মতো পেট ফুলিয়ে শ্বাস      নিতে-নিতে মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলে – কইছিলাম না, তোর লিগাই দেরি হইয়া যাইবো। মোস্তফার চোখ ভিড় ভেদ করে সামনে এগিয়ে গরুর শরীরে গিয়ে থামে। সে সহসা ভরসাপূর্ণ কণ্ঠে বলে – ও-দাদা এহনো গরু ফ্যালাইনাকা, ওই দেহ গরুডা খাড়াই নইছে।
মোজাফর মিয়ার ঘোলা চোখের সঙ্গে গরুর কাজল কালো চোখের একটা চোখাচোখি হয়ে যায়, কণ্ঠে ফিরে আসে আসন্ন প্রাপ্তির প্রত্যাশা – দেখছোসনি… কত্তবড় একখান গরু কিনছে, মন হয় ইন্ডিয়ান। সৈয়দগো মনডা কইলাম বড়।
মোস্তফা বলে, আইচ্ছা দাদা, এহন তো কোরপানি না, তয় গরু ফ্যালাইবো ক্যা?
মোজাফর মিয়া গোল হয়ে থাকা মাংস প্রার্থীর সারিতে বসতে-বসতে বলে, বড় মানুষগো কত্ত রকম হাউশ। কী জানি এহন কির লাইগ্যা গরু মারবো, তর ওতো কী… গোশত পাইবি হেইডা তো বিষয়। বেশি প্যাঁচাল পারোস।
মোস্তফা দুই পায়ের হাঁটু থুতনির কাছে জড়ো করে বসে দেখে গরুডা কেমন লাল রঙের। তার মনে পড়ে সেই  কোরপানির সময় মাংস খাইছিলো। লাল গরুর মাংস ভারি মিডা। মোস্তফা জিভের রস টেনে গলা ভেজায়। তারপর রসটানা গলায় মোজাফর ফকিরের ফিসফিস কইরে জিজ্ঞাস করে – দাদাগো আইজও মাংস সব বিক্রি কইরা দিবা? খাইবা নাহ্?
বৃদ্ধ চাপা ধমকের সুরে বলে, ইশ শখ কত, খাইবি… ত্যাল মসলা লাগে নাহ। ভাত পাইনাই চা খাইবার চায়। সে গলাটা আরও নিচু করে বলে, মাংস কইস না গোশত ক, গোশত।
মোস্তফার মুখে জমা খুশির রোদ লেগেই থাকে, সে উজ্জ্বল মুখে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠেই বলে, হঁ, পাঁডা হইলো মাংস আর গরুর হইচে গোশত…।
সেই কবে মাংস খেয়েছে। গতবছর কোরবানির ঈদে। তার মা আর সে মিলে প্রায় কেজি পাঁচেক মাংস টুকিয়ে পেয়েছিল। তার মধ্যে চার কেজি গঞ্জের ভাতের হোটেলে বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে তারা চাল-ডাল-পেঁয়াজ-মসলা কিনেছিল। এরপর কতদিন গেছে, মাংসের কোনো খোঁজ নেই। মাস তিন আগে একবার মাংস পেলেও খাওয়া হলো না। খলিফা বাড়ির বড় ছেলে কঠিন রোগ থেকে সেরে উঠলে, একটা খাসি ছদকা হয়েছিল। কিন্তু সেই মাংস মোস্তফার খাওয়া হলো না, বড়-বড় পাঁচ টুকরা মাংস! কিন্তু বাড়িতে নিয়ে যেতেই মা বলল, কই দেহি… পলিথিনটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। খুশি কণ্ঠে বলে ওঠে, পাডার মাংস…
মোস্তফাও উচ্ছ্বসিত – হঁ মা… আইজ কিন্তু মাংস খামু…
সহসায় ময়নার কণ্ঠে ঝাঁঝ জেগে ওঠে, দূর-দূর খাসির মাংস খাবি কি… কেমন দুধ-দুধ গন্ধ…
মোস্তফা উৎসাহী হয়ে এসে মায়ের হাতের পলিথিনে মুখ ঝুঁকিয়ে শুঁকে নিয়ে, কই… দেহি… দেহি…
ময়না ঝাপটা মারে – যা-যা হইছে…
মোস্তফা লম্বা এক শ্বাস নিয়ে বলে, মিডা নাহ…
ময়না সেদিকে নজর দেয় না, বলে, তুই ঘরে থাক, আমি বাজারে বেইচা আসি…
সহসা মোস্তফা চিলের মতো ছোঁ মেরে ব্যাগটা টেনে ধরে, না… আমি মাংস খামু…
ময়না ছেলের হাত ছুটিয়ে নেয়, ঘরে চাইল নাই, উনি গোশত খাবো…
মোস্তফাও ছাড়ার পাত্র না, সে টেনে ধরেই বলে – আমি আনছি না…
ময়না এবার ছেলের কাছে ঘন হয়ে আসে, বাজানরে… গোশত রানতে কত্ত তেল-রসুন লাগে… আমাগো কি হেইতা আছেনি…
সেদিন বা তারপর আজ পর্যন্ত মোস্তফার আর মাংস খাওয়া হয় নাই। যদিও বাড়ি ফিরে মা তাকে তিন টাকা দামের একটা দুধ মালাই কিনে দিয়েছিল, কিন্তু তাতে খাসির মাংসের মতো দুধ-দুধ গন্ধ পাওয়া যায় নাই।

দুই
সৈয়দ বাড়ির কামলা রশিদ একপাশে তালগাছের একটা টুকরা কাঠের সঙ্গে বালি দিয়ে সাঁই-সাঁই শব্দে ছুরি ধার দেয়। তখন মাওলানা সাহেব উপস্থিত হলেন। মাওলানা সাহেবের তাড়া আছে, সে লোকটিকে উদ্দেশ করে বলে, রশিদ মিয়া, এক্ষণো শানাইনা হয় নাইকা? আমার কইলাম টাইম কম। ইশরাকের নোমাজ পড়তে হইবো।
রশিদ মিয়া একচিলতে বালির সঙ্গে তালের কাঠে আরো ঘন শব্দ তুলে বলে – হুজুর এই শ্যাষ।
মাওলানাকে দেখে উপস্থিত জনগণের মধ্যে, এমনি গরুর মধ্যেও চঞ্চলতা দেখা দেয়। সে অনবরত লেজ দিয়ে বাতাস কেটে মশা তাড়ায় আর হাম্বা… হাম্বা… স্বরে চিৎকার করে। এর মধ্যে গরু ফেলানোর বিষয় সম্পর্কে জানা যায়। সৈয়দবাড়ির ছোট ছেলের একমাত্র পুত্র আট বছরের পা দিয়েছে এবং তার সুন্নাতে খতনা ভালোমতো সম্পন্ন হয়েছে। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই সদকা। মোস্তফা কি মনে করে এতক্ষণ থুতনিকে ঠেকিয়ে রাখা হাতটা দুই পায়ের ফাঁক বরাবর ভূমি থেকে উঁচুতে থাকা জায়গায় হাত রাখে। সহসা তার হাতে উঠে আসে ছোট্ট পুরুষাঙ্গ, প্যান্টের ছেঁড়া ফুটো দিয়ে এতক্ষণ বাইরেই মাথা বের করে ছিল! মোস্তফা গিলাফ পরানো পুরুষাঙ্গ ধরে নিশ্চিত হয়, এখনো তার খতনা হয়নি। কী ভাবনায় আনমনে সামনে তাকাতেই গরুর চোখে চোখাচোখি! লজ্জায় রঙিন হয়ে সহসা সে হাত সরিয়ে নেয় এবং একটু কুঁচকে বসে যেন জিনিসটা আর দেখা না যায়।
কয়েকজন মিলে গরুকে শুইয়ে ফেলতে যায়। গরু লম্বা দমে হা-ম্বা, হা-ম্বা করতে করতে মোস্তফার দিকে তাকায়। গরুর চোখ বেয়ে পানি পড়ে। গরুর চোখে পানি দেখে মোস্তফার মন খুশিতে ভরে ওঠে। তার মনে হয়, খতনা সম্পন্ন হওয়া সৈয়দবাড়ির নাতির আল্লাহর নেক-নজর আছে। এই কথা সে জেনেছিল বছর দুই আগে এক কোরবানির ঈদে। গ্রামে সরাফতউল্লার বাড়িতে সেইবার গরুটা চোখ দিয়ে ম্যালা পানি পড়তে থাকলে, মাওলানা সাহেব বললেন – আলহামদুলিল্লাহ্, বহুত নেকি হাসিল হইচ্ছে। ইয়া রাবুল আলামিন তোমার অসীম কৃপা।
মোস্তফা স্কুলে যায় না, মাদ্রাসায় যায় না, তবু তার ধর্মীয় জ্ঞান কিছুটা হাসিল হয় এই কোরবানির ঈদ আর শবেবরাতের রুটি কুড়ানোর সময়। সে খুব ভালো করে জানে, কোরবানির মাংস তিনটা সমান ভাগ করা লাগে, সেই এক ভাগে তার হক। সে যখন তার হকের মাংস বুঝে নেয়, তখন কোরবানি দেওয়া লোকদের অনেক ছোয়াব হয়। কথাটা মনে হলেই তার ভেতরের একটা গরম বাতাস বেড়ে ওঠে। এই জায়গায় নিজের গুরুত্ব সে বুঝে নিতে চায়। গত বছর যখন মাংস কুড়ানো প্রায় শেষ তখন এক বাড়িতে সে মাংস আনতে গেলে বাড়ির গিন্নি তেড়ে আসে, ওই যা-যা বিলান শ্যাষ।
সহসা মোস্তফার মনে গরম বাতাস চলে আসে, সে বলে বসে, দ্যান না একটা টুকরা, গরিবের হক আছে তো, মাইরা খাইয়েন না।
ভেতর থেকে একজন পুরুষের গলা শোনা যায়, কত্ত বড়ো সাহস… আমারে হকের কথা কইতে আইছেনি…
মহিলাটি তখন, আর তুমি থামো… ও রাফিজা… আমাগো রানধনের গোশত থেইকা এক টুকরা দিয়া দে… গরিব মানুষ…
অন্ধকারে মোস্তফার বাড়িয়ে রাখা হাতে থপ করে একটুকরা মাংস পড়ে, সে মাংসটা শুঁকে দেখে গরুর, না খাসির?
তারপর হাতের বড় গরুর টোপলা মাংসের ভেতর ছেড়ে দেয়।
এতক্ষণে গরুর গলা থেকে মাথা ছিন্ন, লাল স্রোতের দিকে তাকিয়ে মোস্তফার কিছুই মনে হয় না। কিন্তু প্রথম যে-বছর তার বাবার সঙ্গে কোরবানির মাংস আনতে গিয়েছিল, সেবার নাকি ভয়ে সে কেঁদে-কেটে একাকার। মায়ের কাছে এ-গল্প সে বহুবার শুনেছে। মোজাফর মিয়া ধাক্কা দিয়ে ভিক্ষার থালা তুলে ধরে বলে, ওই মস্তো… যা তো দেহি আমার লিগা কল থন একডু পনি নিয়া আয়।
মোস্তফা দ্বিধান্বিতভাবে থালাটা ধরে কিন্তু সাথে সাথে উঠে যায় না। মোজাফর মিয়া ঠ্যালা দেয়, যা… ফাত কইরা একডু পানি আন, গলাডা শুকাইয়া গ্যাছে।
অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়িয়ে আশপাশ দেখে, দাদা জায়গাডা কেউ নিয়া নিবো না তো?
মোজাফর বিরক্ত হয়। নিজের থলিটা পাশে নামায় রেখে বলে, যা-যা জায়গা রাখুমানে।

তিন
মোস্তফা থালাভর্তি পানি মোজাফরের হাতে দিয়ে বসতে-বসতে দেখতে পায় গরু ইতিমধ্যে চার টুকরা হয়ে চার কোনায় শতটুকরো হতে ব্যস্ত। গরুর গবরিগুলো কয়েকজন মহিলা টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পাশের ডোবায় ধোবে। মোস্তফার খুব মায়ের কথা মনে পড়ে। ‘মায় আইজও কাম শেষ কইরা আইবার পারল না। তাইলে গবরির ভাগ পাওয়া যাইতো।’ ওখানে খালি মেয়েদের অধিকার, মোস্তফার মতো ছোটরা বা আগত পুরুষ লোকরা তা ধরতে পারবে না। মোস্তফার কাছাকাছি বসা কসাই ছুরির সঙ্গে যেন যুদ্ধে নেমেছে। এত জোরে কোপাচ্ছে! সহসা একচিলতে পদ্মার মতো মাংস উড়ে এসে মোস্তফার চোখের কোনায় লাগে। মোস্তফা ত্বরিত গতিতে লেপটে থাকা মসলিনের মতো মিহি মাংসটুকু খুলে হাতের মুঠোয় নিতে-নিতে খেয়াল করে আশপাশের অনেকেই ঈর্ষার চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে বৃদ্ধ ফকির মোজাফরের দিকে চেয়ে এক লাজুক হাসি হেসে বলে – ছিইডা আইলো…
মোজাফরও অস্ফটু ম্রিয়মাণ হাসি মিলিয়ে দিয়েই তাকিয়ে তাকিয়ে মাংস চিরে চাপাতির দুরন্ত কামড় দেখে। মোস্তফা কোমরে গুঁজে আনা পলিথিন ব্যাগ বের করে ছুটে আসা মাংস ভরে রাখে, যা পলিথিনের গহ্বরের নিজের অস্তিত্ব হারায়। একপাশে পড়ে থাকা গরুর মাথা, চোখ দুটো স্বচ্ছ কাচের মতো, যেন এখনো জেগে আছে। আর পাটির মাঝে ক্রমশ পিরামিডের মতো জমে উঠছে মাংসের পাহাড়। মোস্তফার মনে হয় গরুডা এক্কাবারে পিডানো মাংসে ভরা আছিল। গরু যত্তখানি ডাঙ্গর দেখা গেছিল, মাংস তো তার চাইতেও ম্যালা মণ কয়। সে মোজাফর ফকিরের কনুইয়ে খোঁচা মেরে বলে – দাদা, দেখছোনি, গরুডার চামড়ার মধ্যে মাংসে ঢাসা আছিল!
মোজাফর ফকির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে – যহন পাবানে, তখন তো একটুডু দেহা যাবেনে… বলে হাতের পাঁচ আঙুলের সমন্বয়ে একটা গুহাকৃতির বিস্তৃতি দেখায়। সেদিকে তাকিয়ে মোস্তফার মুখে মেঘের ছায়া জমে ওঠে। সে মাটির দিকে তাকায়।
ইতিমধ্যে রোদ যেমন তেতে উঠেছে, সেইসঙ্গে হইচইও তেতেছে। একদিকে চাপাতির সঙ্গে মুগুরের বাড়ি আর হাড়ের কড়কড় শব্দ, অন্যদিকে মাংসপ্রার্থী মানুষের চাপাস্বর সমন্বিত হয়ে একটা ক্যাউকাবারি আওয়াজ। তবে সবকিছুকে পিছে ফেলেছে পাঁচ-ছয়টি কুকুর। গরুর লেজ নিয়ে তারা কজন কু-উ…উ, ক্যা… ক্যা শব্দে অতিষ্ঠ করলে কেউ একজন লাঠি নিয়ে ধাওয়া দেয়। কুকুরেরা লেজ থেকে দাঁত না সরিয়েই আথালি-পাথালি খেয়ে ঢালের দিকে নেমে যায় গড়িয়ে। পাঁচ-ছয়টা কুকুর যখন পোল্টি খেয়ে ঢালে স্থির হয়, তখন তাদের দাঁত লেজের যে যে অংশে ছিল তা বিচ্যুত হয়ে নতুন অবস্থানে সরে যায়। তখন তাদের দাঁতের স্থানিক  সুবিধা-অসুবিধার দ্বন্দ্বে বেরিয়ে আসা চাপা ঘরঘর গর্জন নতুন মাত্রা পায়।
চাপাতি-মুগুরের সঙ্গে কসাইদের সম্পর্ক ক্রমশ শ্লথ হয়ে আসছে। মাংস কাটা প্রায় শেষের দিকে, মোস্তফা এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। তার মা ময়না বেগমের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে আসার কথা ছিল। কিন্তু কোথাও মাকে না দেখতে পেয়ে মোস্তফা বুঝে যায়, মা ছুটি পায় নাই। সে এলে দুজন আলাদা ভাগে মাংস পেত… এখন একার ভাগ পাবে মাত্র। অনেকে পরিবারের তিন-চারজন মিলে এসেছে। মোস্তফার মনে হয় তার যদি ছোট বা বড় কোনো ভাইবোন থাকতো! তাইলে তারা আরও বেশি মাংস পেতে পারতো।

চার
বৃত্তবন্দি মানুষ এবার সারিবদ্ধ হয়ে লাইন হয়ে যায়। কারণ ইতিমধ্যে মাংসের পাটিটাকে গোল বৃত্ত থেকে সরিয়ে এ-কোণে সোজা করা হয়েছে। সারিবদ্ধ মানুষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি আর ঠেলাঠেলি লেগে থাকে। সৈয়দ বাড়ির বান্ধা কামলারা তিন-চারজন সিটকির ডালের লাঠি হাতে শপাং-শপাং বাড়ি মারে দু-চার ঘা, যেন লাইন সোজা না হলে মাংস বিতরণ করার নিয়ম নেই। মোস্তফা কখন লাইনে যুক্ত হয়েছে তা মনে নেই। তবে সে তার সামনে বা পেছনে প্রতিবেশী দাদা, বুড়ো মোজাফর ফকিরকে খুঁজে পায় না। সে লাইনের সামনের দিকের অংশে আছে। তার চোখ লাইন বরাবর খুঁজে-খুঁজে একেবারে শেষের দিকে দেখতে পায় মোজাফরকে। কামলাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বয়স্ক সে মাংস বিতরণ সম্পর্কিত ঘোষণার দায়িত্বে নিযুক্ত হয়। হাতে ধরা কাঁচা সিটকির ডাল লাইন বরাবর মানুষগুলোর উদ্দেশে উঁচিয়ে ধরে বলে – ব্যাকতি লাইন ধইরা আগায়াইবা, লাইন ছাড়া কেউই, এক টুকরা গোশত পাইবা না। একজন-একজন কইরা গোশত নিয়া ওই সামনের দোপ দিয়া নাইমা যাইবা। কেউ যদি একবার নিয়া আবার লাইনে খাড়াও, তাইলে তার ব্যাবাক গোশত ফেরত নেওয়া হইবো।
লাইন ক্রমশ সামনে এগোয়। তবু কেউ-কেউ মাংস নিয়ে নড়ে না, বলে – দেহ-দেহ খালি চর্বি আর চর্বি, দুই টুকরা থোপা গোশত দ্যাও না, ক্যা আ।
কেউবা বিলাপ করে ওঠে – হায় আল্লাহ এইডা কোনো ইনসাফ হইল, খালি হাড্ডি আর হাড্ডি… আরে গোশত দিবা না। কেউ থপ করে দু-চার পিস বাড়তি পায়, কেউ পায় সিটকির ডালের বাড়ি – হর… হর… যা পাইছোস তাই সই…। মাংস সবাই একবোরে কম পাইতাসে তা না। এমন সময় গরু ফলোনো হবে তা তো সবাই জানে না, তাই বলা যায় ভিড় কমই। নাইলে আরো হতো। মোস্তফারে মোজাফর ফকির না কইলে তো জানতোই না। কাইল খয়রাত করতে-করতে সৈয়দ বাড়ি তমাত আইসিলো বলেই তো মোজাফর বিষয়টি জানতে পেরেছে।
মোস্তফার পলিথিনের মধ্যে গোশত পড়লে মনটা খুশিতে ভরে যায়। তবু সে মুখটা শুকনো করে একটা চেষ্টা চালায় – কাহা… মায় কামে গেছে… আইবার পারে নাই। মাইর ভাগ আমারে নিয়া যাইবার কইছে।
একজন কামলা হইহই করে ওঠে – তোর মাইর আবার ভাগ কি এ্যা… যা… যা…
মোস্তফা তবু বলে – নাইলে মাইর লিগা আডু মাংস দেন…
একজন কামলা আরও খানিকটা মাংস মোস্তফার পলিথিনে চালান দিয়ে, সিটকির লাঠি দিয়ে পায়ে একটা বাড়ি মারে… যা যা ফাত্ কইরা কাইটা পর…।
মোস্তফা বাড়ি খাওয়া ঠ্যাংটারে হাওয়ায় ভাসিয়ে খুশিতে লাফিয়ে ঢাল পার হয়। ঢালের পর সৈয়দ বাড়ির হালটে দাঁড়িয়ে মোজাফর ফকিরের অবস্থান খোঁজে। লাইনে এখনো সে বেশ খানিকটা পেছনে। মোস্তফা এবার পলিথিনে মুখ-চোখ ঢুকিয়ে দেখে ম্যা… লা খানিক! এখন সে কি করবে একবার ভাবে। তার তর সইছে না। মোজাফরের জন্য অপেক্ষার কোনো ইচ্ছে তার নাই। বাড়িতেও যাবে না, বাড়ি গেলে মা সব মাংস বিক্রি করে দেবে। আজ ম্যালা মাংস। সে ঠিক করে কিছুটা বিক্রি করবে, আর কিছুটা বাড়ি নিয়া যাবে। সে আজ নিজেই বাজারে মাংস বেচতে যাবে। মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটা শুরু করে। কিছুদূর যেতেই তার মনে পড়ে তাদের বাজারের হারু কসাই মাংসের দাম কম দেয়, পাশের গ্রামের বাজারে বাবু কসাইয়ের কাছে নাকি বেশি দাম পাওয়া যায়। সে আল পরিবর্তন করে নতুন পথে হাঁটে। কিছুদূর যেতে সে একটা গাছের নিচে বসে, দুপুর রোদে ফাঁকা মাঠেও তার কেমন রান্না মাংসের গন্ধে পেট ফুলে ওঠে। সে পলিথিনে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠ মাংস এনে শোঁকে। নাহ… পাডার মাংসের মতো দুধ-দুধ গন্ধ নাই, ফাইন ঘেরান। মাইও গরুর মাংস পছন্দ করে। সে পলিথিনটা এক হাতে ঝুলিয়ে ধরে বোঝার চেষ্টা করে… মন হয় কেজি… দুই… না না… দেড় কেজি…। সে কোমর থকেে আরো একটা পলথনিি বরে কর,ে মার জন্য এনেছিল। তারপর মনে-মনে এক কেজি মাংস ধরে প্রথম পলিথিনে রেখে দেয় আর হাফ কেজি ধরে কিছুটা মাংস নতুন পলিথিনে ভরে। এক কেজি সে বাবু কসাইয়ের কাছে বিক্রি করবে আর হাফ কেজি তারা খাবে। সে গুনে দেখে হাফ কেজি ভেবে যে মাংস রেখেছে তা মোটে চার টুকরা। কিন্তু তার মনে হয় ব্যাটারা টুকরা গুলান বড় করছে, মায়ের কাছে দিলে এই চার টুকরা কমছে কম ১০-১২ খান  হবে। একটা পরিতৃপ্তি এসে ভর করে তার মাঝে। সে বিক্রির জন্য হাতে ধরা মাংস আর রান্নার মাংসের পলিথিনটা কোমরের সুতার সঙ্গে বেঁধে দৌড়াতে থাকে।

পাঁচ
মোজাফর ফকির মাংস নেওয়া হইলেও সৈয়দ বাড়ির সামনে হালটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাইনের শেষ অবধি দেখে। মাংস বিলি শেষ হলে সে একজন কামলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঢাল বেয়ে আবার ওপরে উঠে আসে – আইচ্ছা মেভাই, ঢাকাথন সৈয়দবাড়ির কেউ আহে নাই।
মোজাফর ফকির কথার ফাঁকে-ফাঁকে কর্তব্যরত রাখালের পায়ের নিচের পাটির দিকে তাকায়, সেখানে গুঁড়ো মতো মাংসের আঁশ, ভুসির মতো হাড়ের গুঁড়ো তাকে যেন চুম্বকের মতো টানে। কামলাটা চেহারায় আভিজাত্যের ছায়া এনে বলে – ক্যান গো মিয়া, আমারার কি তোমার এই বাড়ির নোক মনে হয় না। এহন তো আমারাই এই হানে থাহি।
মোজাফর তেলতেলা একটা হাসি দিয়ে বলে – তা তো ঠিকয়… ঠিকয়… তারপর সামনে দাঁড়ানো এক কামলাকে উদ্দেশ করে বলে – ভাইজান কি সপটা ঝাড়বেননি।
কামলাটা গায়ের ঘাম মুছতে-মুছতে বলে – না… হুইয়া থাকুমানে।
মোজাফর লজ্জা পায়, বলে – আমি একডু… ওই গুঁড়াগুলান নিয়া শপটা ঝাইগা দেই?
কামলাটা হাতের সিটকির ডালটা ফেলে কাছারি ঘরের ছায়ায় যেতে যেতে বলে – ফাত্ কইরা করো।
বুড়ো মোজাফর হামু দিয়ে ঝুকে লেপটে থাকা মাংস খুঁটে, রোদের মধ্যে খুঁটতে খুঁটতে ক্লান্ত হয়ে মোস্তফার উদ্দেশে গাল দেয় – পোলাডা এক্কেবারে কামের না, এহন থাকলে ফাত কইরা খুঁটবার পারতো।
মাংস যখন ভালো পরিমাণের জমছে তখন বৃদ্ধ ফকির লাভের আশায় রুদ্রপুরের বাজার ছেড়ে সোনাডাঙ্গার বাজারে ঢোকে। সেও আজ বাবু কসাইয়ের কাছে মাংস বিক্রি করবে। এমনিতেই দুপুরবেলা বাজারে ছাপড়া দোকানি ছাড়া কাঁচা সবজির লোকজন প্রায় থাকে না। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে যেতেই পেছনের দিক থেকে একটা শোরগোলের আওয়াজ পাওয়া গেল। মোজাফর ফকির ভাবে কী হইছে। এমন সময় পেছন থেকে একটা সাইকেল টুংটাং শব্দে বেরিয়ে এলে মোজাফর ফকির জিজ্ঞাস করে – মিয়া ভাই ভিতরে কী হইচ্ছে?
সাইকেলওয়ালা জোশে প্যাডেল মেরে যেতে যেতে বলে –  গোশত চোর ধরছে…
মোজাফর ফকির সামনে এগোতেই মাছ-মাংসের পাকা বাজারের জটলাটা দেখতে পায়। বাজাইরাদের কথায় ব্যাপক উত্তেজনা, যেন বিশাল এক কাজ করে ফেলেছে তারা। এসবের ভেতর থেকেও একটা গোঙানোর ক্ষীণ আওয়াজ মোজাফরের কানে। সে এগিয়ে যায়।
– একডু বয়সেই চুরি শিখছে…
– ছ্যারারে লাগা আর দুইচারডা মুগুর…
একজন বলে – থ্যাইক… হেইতের আর খাড়াইবার শক্তি হইবো না, এমতেই শেষ হইবেনে…।
মোজাফর ফকির ভিড় ঢেলে সামনে যেতেই দেখতে পায় মোস্তফার রক্তাক্ত শরীর, হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা পলিথিন।

ছয়
ময়না বেগম চুলার জাল ঢেলে দিতে-দিতে নাকি কান্নার গীত গায় – হাইরে… আমার বাজান রে… তোরে যারা মারছে তাগো হাতে কুষ্ঠো হইবো…
মোজাফর ফকির দাওয়ায় হেলান দিয়ে বসে – পোলাডারও দোষ আছে… আমার লিগা দেরি করলে কি আর এমুনডা হইতো…
ময়না বেগম মাংসের হাঁড়িতে ওরনের ঘুটনি দিতে দিতে সুর করে বলে – হেইতি তো পোলাপাইন মানুষ… গোশত খাওনের লিগা পাগল হইছিল, ক্যা… বাবু কসাই জানে না… সৈয়দগো বাড়ি গরু ফেলাইছে…
মোজাফর বলে – সে তো অন্যগ্রামের মানুষ… থাউক আর কাইন্দো না…
ময়না বেগম খড়ি জাবার দিকে একগাল থুথু ছুড়ে বলে – ব্যাডা একটা কসাই…
ঘরের মধ্যে ব্যথায় কোঁকাতে থাকা মোস্তফা, ঘুমের মতো আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে বলে – ব্যাডা মিছা কইছে… ব্যাডা মিছা কইছে…
আসলে মোস্তফার হাতে মাংস দেখে বাবু কসাইয়ের মাথায় নতুন চিন্তা ধরে, সে বাজারের লোকজন কেউ তাকায় আছে কিনা দেখে নিয়ে বুদ্ধিটা আঁটে। এখন এমনিতেই মাংসের দাম বেশি, তারপর এতটুকু ছোকরাকে পাকড়াও করা কোনো ব্যাপার না ভেবেই সে মোস্তফার হাত থেকে পলিথিন নিতে-নিতে বলে – কতটুকু গোশত আনছোস?
মোস্তফা খুশির চোটে একটা বাড়িয়েই বলে – কেজি দুই হইবো।
হালায় কয় কী? এতটুকু গোশত দুই কেজি!
মোস্তফা বলে – তয় মাইপা দেহেন কতখানিক হয়…
এমন সময় বাবু কসাই পুরো মাংসটা নিজের কাটা মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। মোস্তফা বলে ওঠে – করেন কি… না মাইপা মিশান ক্যান?
বাবু কসাই বলে – ওই কি হইছে? কী মিশাইছি? কী মিশাইছি?
মোস্তফা চিৎকার করে ওঠে – আমার মাংস…
বাবু কসাই ততক্ষণে বেদি থেকে নেমে মোস্তফার কান পেঁচে একটা থাপ্পড় মারে…
– মারেন ক্যা?
– ওই আবার কথা… যা…
তাদের চিৎকার শুনে দু-একজন এগিয়ে আসতেই বাবু কসাই জানায়, ছোড়া মাংসচোর। তার এইখান থেকে মাংস চুরি করেছে। তারপর আর বাবু কসাইয়ের কিছু করতে হয় নাই। মুহূর্তেই কিল-থাপ্পড়-লাথি এবং বাজারেদের মব তৈরি হয়ে যায়।
শেষবেলায় ময়নার রান্না শেষ হয়, সারাবাড়ি মাংসের গন্ধে ভরপুর। ঘুমের আছন্নতা কাটিয়ে, ব্যথাও কাটাছেঁড়া শরীরের ভেতর থেকে মোস্তফা বলে ওঠে – মা.. জব্বর বাসনা।
ময়না থালায় করে ভাত আর মাংস নিয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে ভেজা কণ্ঠে বলে – হয়ই বাজান…
তারপর ভাতের থালাটা পাশে রেখে, ছেলের মাথা কোলে তুলে নেয় – তোরে খুব মারছে নাহ, বাজান?
মোস্তফা সে-উত্তর না দিয়ে বলে – আগে একখান মাংস দে মা।
ময়না একটুকরা মাংস ছেলের মুখে পুড়তেই, মোস্তফা থু করে ফেলে দেয় – মারে মাংসে পুড়ে…
ছেলের কাটা ঠোঁটে হাত বুলাতে বুলাতে ময়না বলে – ভাতের সাথে ভরাইয়া দেই…
মোস্তফা তখন মুখটাকে বড় হাঁ করে ঝাল কমাতে বড়-বড় শ্বাস নেয়। বলে – না মা, মাংসে পুড়ে…
ময়নার চোখ বেয়ে পানি ছেলের মুখে পড়লে মোস্তফা বলে – জানোস মা, গরুডারও না চোখ দিয়া পানি পড়ছিলো… মাওলানা সাব কইছে গরু কানলে বহুত নেকি।
ময়না বলে, চুপ কর বাজান, একটু ভাত মুখে দে…
ময়নার বাড়িয়ে দেওয়া ভাত নেয় না। মোস্তফা বলে – বাজারে আমিও অনেক কানছি, হেরা কেউ আমার কথা হুনে নাই। তারপর বলে, আইচ্ছা মা, এই যে গরুডা কানলো… আমি কানলাম… সৈয়দবাড়ির নাতির কি তার লিগা অনেক নেকি হইবো?
ময়না কোনো উত্তর দেয় না। দুই হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মোস্তফার ব্যথায় জর্জরিত শরীর – চোখ ঝিম ধরে আসে, সে ভাবে, নেকিটা কেমনে আসে… বৃষ্টির মতো… নাকি কুয়াশার মতো… ক্রমশ তার চোখের সামনে অজস্র সাদা-সাদা মাংসের টুকরা হয়ে নেকি ঝরে।