মানবশরীরের গতিনির্মাণ

মোবাশ্বির আলম মজুমদারHuman Box

শরীরগুলো দলবেঁধে কখনো যাত্রা করছে ঊর্ধ্বমুখে, কখনোবা স্রোতের বিপরীতে, আলোর দিকে। রাধাকৃষ্ণানের ব্রোঞ্জ-নির্মিত ২৩টি ভাস্কর্যের বিষয় মানুষের সারি। মানুষ উদ্যত হাতে ছুটে চলেছে। মানুষই এই পৃথিবীর মূল চালক। ছুটে চলা মানুষের গতিকে নির্মাণ করাই রাধাকৃষ্ণানের লক্ষ্য। স্বপ্নের সঙ্গে মানুষ বাস্তবতার মিল খুঁজে পায় না। অতীতের স্মৃতি আর বর্তমানের পথচলাকে একসঙ্গে করে ফেলে মানুষ। শিল্পী মানুষের অবয়ব নির্মাণকে প্রতীকী হিসেবে দেখিয়েছেন। ধ্যান আর স্থান পরিবর্তনের মাঝে যে মানুষের মৌলিক গতি দেখা দেয়, তার প্রতি রাধাকৃষ্ণানের আগ্রহ রয়েছে। যাপিত জীবনের দ্বন্দ্বমুখর মুহূর্তকে শিল্পী আগ্রহভরে অনুশীলন করেন। ভূমি থেকে নির্দিষ্ট উচ্চে তুলে ভাস্কর্যগুলোকে আকাশস্পর্শ করে দেখানোর প্রচেষ্টা শিল্পের সঙ্গে জীবনের খোঁজ এনে দেয়। মৌলিক মানবিক বোধের অভিযাত্রায় নিজেকে যুক্ত করে নির্মিত মানব-মানবীর অবয়বে রূপ-সৌন্দর্য প্রধান না হয়ে শক্তি ও সামর্থ্যের রূপ প্রধান হয়ে শিল্পীর কাছে ধরা দেয়। একজন মানুষের কাছ থেকে আরেকজন দূরত্ব রেখে ঐক্য তৈরি করেছেন। দর্শক, শিল্পী, শিল্পকর্ম – এই তিনের সম্পর্কের কথা ভেবে শিল্পী ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। গ্যালারিতে প্রদর্শিত শিল্পকর্ম দর্শকদের দৃষ্টিসীমার কথা মাথায় নিয়ে রাধাকৃষ্ণান বিন্যাস করেছেন। স্থানিক ব্যবস্থাপনার ছাপ আর্ট লাউঞ্জের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে ঋদ্ধ করেছে। ভারতীয় আধুনিক ভাস্কর্যের জনক রামকিঙ্কর বেইজের স্নেহে বেড়ে ওঠা রাধাকৃষ্ণানের কাজে রামকিঙ্করের অনুকরণ পাওয়া যায় না। তাঁর কাজের সঙ্গে  শর্বরী রায় চৌধুরীর কাজের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

শর্বরী রায় চৌধুরীর ব্রোঞ্জের কাজে পরিশীলিত রূপ দেখা যায়, কিন্তু রাধাকৃষ্ণান মানুষের অবয়বে গতি নির্মাণ করেন। গতিশীল মানুষের দলবেঁধে ছুটে চলাকে ভাস্কর্যে রূপ দেন। দুটি মূল চরিত্রকে তিনি দন্ডের ওপর ভাসমান ভঙ্গি তৈরি করেন। দুটি চরিত্রের একটি হলো ‘মুসাই’, অন্যটি ‘মায়া’। ব্রোঞ্জ-নির্মিত অধিকাংশ কাজই গত দুবছরে করা। ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্যরীতির বিপরীতে একেবারে আধুনিক ভাস্কর্য গড়নের এই উপমহাদেশে খানিক প্রথাবদল হয়েছে। রাধাকৃষ্ণানের চৌকোনা, উল�ম্ব দন্ড, ঘরের আকৃতি, বৃত্তের ঘূর্ণন, উল�ম্ব ফাঁপা গোলকধর্মী বেইস নির্মাণের ধারণার জন্যে শিল্পকর্মে অসীমত্ব প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর উলে�খযোগ্য কাজের মধ্যে ‘ওয়েট হোম’ কাজটি একটি ঘরের আকৃতিকে কেন্দ্র করে। ঘরের মেঝের একদল মানুষের অবয়ব ছুটে চলেছে, আরেক দল মানুষ ঘরের চাল বেয়ে ঊর্ধ্বমুখে ছুটছে। ঘরের দেয়ালে মানুষের উদ্ধত ভঙ্গি উৎকীর্ণ। মানুষ তার আবাস গড়ে তোলে, আবার সেই আবাসস্থলকে কেন্দ্র করেই মানুষ নিত্য ছোটাছুটিতে ব্যস্ত থাকে। ব্রোঞ্জ-নির্মিত এ-কাজটি একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে করা। ‘হিউম্যান বক্স’ শিরোনামের ভাস্কর্যের ভূমি বা বেইস চৌকোনা। ভারী লোহার চতুষ্কোণ আকৃতির ওপর একদল মানুষ উদ্যত ভঙ্গিতে বাঁদিকে ঝুঁকে পড়ছে। মানুষের হাতে হাত রেখে একজনের সঙ্গে আরেকজন সেতুবন্ধ তৈরি করেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষ যূথতা তৈরি করে। এই যুক্ত হওয়া মানুষ একটি শক্তিতে পরিণত হয়। শিল্পীর মনোজগতে এই শক্তিই খেলা করে। পৃথিবীর সকল অশুভ শক্তির বিপক্ষে জয়ী হয় মানুষের ঐক্যে গড়া শক্তি।

‘এয়ার বাউন্ড মায়া’ একটি ফিগার নিয়ে গড়া ভাস্কর্য। দুটো পা ও একটি হাতের উদ্যত ভঙ্গির সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাস্কর্যের ভূমিকা বেইস, প্রশ্নবোধক চিহ্ন আকৃতির ধাতবপাত। তার সঙ্গে আরেকটি চৌকোনা বেইস স্থির হয়ে মানুষী ফিগারকে স্থিতি দিয়েছে। এটি দৃষ্টিসীমার বাইরে না গিয়ে ক্রমশ দর্শকদের আকাশের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ‘ম্যান ইন্টারেস্টেড ইন দ্য হিউম্যান ওয়েব’ শিরোনামের কাজে আলোকোজ্জ্বল হারিকেন কৌণিকভাবে ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে মানুষের স্রোত। এটি শিল্পীর স্বপ্নের রূপায়ণ। আলোর দিকে ধাবিত হওয়া মানুষের দল অন্ধকারকে পেছনে ফেলে রাখে। রাধাকৃষ্ণান এ-ভাস্কর্যে মানুষের সঙ্গে আলোর যুগলবন্দি তৈরি করেছেন। ঢালু বেইসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মাঝে ‘মুসাই’ চরিত্রকে বড় করে হাতে ভর দিয়ে শূন্যে ওড়ার অবস্থা নির্মাণ করেছেন – ‘মুসাই এজ ট্রাফটি অন দ্য র‌্যাম্প’ ভাস্কর্যে। মানুষের মস্তক আকৃতির সঙ্গে যুক্ত করা নৌকাবোঝাই মানুষের শূন্যের দিকে ধাবিত হওয়াতে আমরা অসীমের পানে সাহসী মানুষের পদচারণার খোঁজ পাই। ভাস্কর্য ও স্থাপত্যরীতির সনাতন নির্মাণপ্রক্রিয়ার বিপরীত সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে এসেছেন এস রাধাকৃষ্ণান। মিশরীয় সভ্যতার মানব অবয়বের পুনর্ব্যবহার ভাস্কর্যগুলোতে নির্দেশ করলেও সমকালীন পথপরিক্রমায় রাধাকৃষ্ণান এগিয়ে গেছেন তাঁর সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে। বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে এ-প্রদর্শনীটি শেষ হয় গত ২১ সেপ্টেম্বর।

 

ভাস্কর কেএস রাধাকৃষ্ণান

জন্ম ১৯৬৬ কেরালা, ভারতে।  ১৯৮১ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। এ পর্যন্ত তিনি দেশে-বিদেশে ২৩টি একক প্রদর্শনী এবং বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক শর্বরী রায় চৌধুরী এবং রামকিঙ্কর বেইজের সঙ্গে কাজ করার জন্য ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জাতীয় বৃত্তি, ১৯৮১ সালে দিলি�র ললিতকলা অ্যাকাডেমির ফেলোশিপ, ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জুনিয়র ফেলোশিপ এবং ২০১১ সালে কেরালা সরকার কর্তৃক প্রদত্ত কেসিএস পত্রিকার পুরস্কার লাভ করেন।