মানুষের গল্পের কথা

রিজিয়া রহমান

গল্প নিয়ে বিদগ্ধ বাক্যমালা সাজানোর যোগ্যতা আমার মোটেও নেই। জ্ঞানবুদ্ধি বা অধ্যয়নের বিজ্ঞতায় গল্পের ব্যবচ্ছেদ করার দুঃসাহসও রাখি না। ধৃষ্টতাবশে দু-চারটি গল্প কখনো কখনো লিখেছি। সেগুলো আদৌ গল্পের কঠিন শিল্পবিচারে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা যে রাখে না, সেটাও জানি। তবু কেন গল্পের কথা নিয়ে হঠকারিতা করতে যাওয়া? করজোড়ে পাঠকবৃন্দের কাছে শুধু বলতে চাই, আমাদের সবার জীবনেই গল্প আছে, গল্প আছে চেনাজানা দূরের-কাছের সব মানুষেরই। সেসব গল্প কেউ বলে, কেউ বলে না। তবু নিজের গল্প অন্যকে বলা, বা অন্যের গল্পগুলো শ্রুতি ও বোধ দিয়ে অনুভব করা তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। যে-ভঙ্গিতে, যে-শিল্পকাঠামোতেই গল্পকে সাজাই না কেন, মূল কথাটি তো গল্প, মানুষের গল্প। বস্ত্ত পাত্রের আধার, না পাত্র বস্ত্তর আধার – এই নৈয়ায়িক বিতর্ক প্রাচীন শাস্ত্র-দর্শনের কথা। আধুনিক শাস্ত্রজ্ঞের বিতর্ক অন্য – ভাষা গল্পের চাইতে বড়, নাকি গল্পই ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, অথবা গল্পের জন্য শিল্প, না শিল্পের জন্য গল্প!

গল্পে রোমান্টিক আবেগ প্রবল হবে অথবা বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদ প্রধান্য পাবে – এই যুক্তিতর্কও কম হয়নি। এসবের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার মতো সরল-সহজ বর্ণনার মোটা দাগের শিল্পজ্ঞানহীন অর্বাচীন তবু কেন যে ভাবি, মানুষের গল্পগুলো সব হয় তো বলা হয়নি। যে-গল্প মানুষেরা  অনন্তকাল ধরে বহন করে চলেছে, সেসব গল্প তো অচেনা অজানা না-শোনাই রয়ে গেল।

সেই যে সেই বছর চারেকের ছোট্ট ছেলেটি এদেশের এক মহাদুর্ভিক্ষ-কালের এক রাতে এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের দরোজায়। বগলে একটা মাটির  শানকি, কঙ্কালসার অবয়ব, খুব নির্বিকার প্রশ্ন ছিল তার – আমারে আপনেগো বাইত্ রাখবেন? মনের বাসনা পূর্ণ হয়নি তার।  কিন্তু কী হয়েছিল তার শেষ পর্যন্ত? অন্ধকার রাতে সে কি কোনো নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিল? গলির মোড়ের ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট খুঁজে মুরগির ফেলে-দেওয়া পচা নাড়ি গোগ্রাসে গিলেছিল? নাকি শহরের  ফুটপাতে হেঁটে হেঁটে একসময় ভেজা ন্যাকড়ার মতো পড়েছিল ল্যাম্পপোস্টের নিচে! খুব ভোরে যখন মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক শহরের পথে পথে পড়ে থাকা বুভুক্ষের লাশ তুলতে বেরিয়েছিল, ক্ষুধার রাজ্যে একাকী সৈনিক খাদ্য-আশ্রয় খুঁজে হতাশ-ক্লান্ত শিশুটির লাশও কি ট্রাকের লাশের স্তূপে চাপা পড়েছিল? গল্পটি তো আজো বলা হয়নি, শোনাও হয়নি।

তবু এখনো তাকে আমি খুঁজি। মানুষের কল্পনাশক্তির অলৌকিকতায় যদি সে এখনো শিশুটিই থেকে যায়, তাহলে কি তাকে আমি চিনতে পারব? ভাতের শূন্য শানকি বগলে, ছেঁড়া ইজের পরা কঙ্কালসার বছর চারের বয়সী এক শিশু!

জানি না, এই গল্পটি যদি কখনো আমি লিখতে বসি, কোন বিষয়টিকে আমি প্রাধান্য দেব। সাংকেতিক, ইঙ্গিতবাহী, প্রতীকী ভাষাকে? নাকি আঙ্গিককে? ক্ষুধাকে আমি কোন আঙ্গিকের ফ্রেমে আটক করব? নান্দনিকতার কোন সূত্রটি বেছে নেব?

পুঁজিবাদের সাম্প্রতিকতম আজ্ঞাবাহক উত্তরাধুনিকতার অবিন্যস্ত বুননে এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে কি বুনে নেওয়া সম্ভব! পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম বিকাশে ভেঙেপড়া পুরনো প্রতিষ্ঠানের বিভ্রান্তির হাহাকার, আর প্রাচ্যদেশীয় সমাজকাঠামো তো সমমাত্রিক হতে পারে না। আফ্রিকা আর এশীয় দেশগুলো এখনো ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলছে কলোনিয়াল শাসনের দুঃসহ স্মৃতির ক্ষতমুক্ত হতে। তবু উন্নয়ন-প্রয়াসী অবকাঠামোর দরোজায় এখনো এসে কড়া নাড়ে ক্ষুধা-দারিদ্রে্যর প্রতীক চার বছরের পরিবারবিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ শিশু। এমন শিশুদের গল্পকে কেমন করে পুঁজিবাদী নন্দনতত্ত্বের প্রতারণার মুখোমুখি দাঁড় করতে পারি! শিল্পচাতুর্যহীন সেই গল্প অভিজাত নন্দনতত্ত্বের  উঁচু দেয়ালের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো জানে না, মুখের ওপর দরোজা বন্ধ করে দিয়ে তাকে বলে দেওয়া হবে – এখানে হবে না, যাও, অন্য কোথাও দেখ। পুঁজিবাদের শিল্পসংজ্ঞার বিচ্ছিন্নতাবোধ আর যা-ই হোক দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধার্ত শিশুর জন্য নয়।

সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা অথবা দক্ষিণ এশীয় কোনো দুর্ভিক্ষ-স্মৃতি বহনকারী দেশের মানুষের জন্যও নয়।

তবু থেমে থাকে না মানুষের গল্প। কলোনিয়াল, পোস্ট-কলোনিয়াল, পোস্ট-স্ট্রাকচারাল বা পোস্ট-মডার্নিজমের উন্নয়ন-বীতশ্রদ্ধ উন্মাদনা নিয়েই বলে  যেতে হয় সেইসব পুরনো অথবা নতুন আখ্যান-উপাখ্যান কিংবা অশিল্পিত মানুষের চিরন্তর গল্পের কথা।]

 

এক

পৃথিবীর তাবৎ গল্প তো মানুষকে নিয়েই, গল্পের কথা বলতে গেলে দিশেহারাই হতে হয়। শুরুটা যে কখন, কোথায়, কীভাবে থই পাওয়াই ভার।

মানুষের আগমনেই হয় তো পৃথিবীতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল গল্পের অাঁতুড়ঘর। প্রাগৈতিহাসিক মানবগোষ্ঠীতে ভাষার জন্ম এবং পরস্পরের ভাববিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত তৈরি হতে থাকে গল্প, অজস্র গল্প – শিকারের গল্প, বাইসন, রেইনডিয়ার, গন্ডার, ম্যামথের গল্প। আগুন খুঁজে পাওয়ার  গল্প, ঝরনা, নদী আর তৃণভূমির গল্প। পাহাড়, গুহা, তুষারপাত, ভূমিকম্প, অগ্ল্যুৎপাতের গল্পও। গল্প – পাথর ঘষে অস্ত্র তৈরির, আগুনের মশাল নিয়ে নেকড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার, অতঃপর অস্ত্র আর যুদ্ধ থেকেই তৈরি হয় দখল এবং বীরত্বের গল্পগুলো।

গুহার পাথুরে শরীরে এমন অনেক গল্প অাঁকা হয়ে যায়। অাঁকা থাকে অযুত-নিযুত কাল ধরে। আদিম মানুষের আদি সংস্কৃতি এমনভাবেই গল্পনির্ভর হয়ে ওঠে। সেসব গল্প জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার, অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার, শিকার আর গোত্রের, স্থান থেকে স্থানান্তরের, গুহা থেকে গুহান্তরের, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর খাদ্য-সংকটের বিপত্তির মুখোমুখি হওয়ারই কাহিনি।

জ্যোৎস্নারাতে অথবা ঘোর অমাবস্যায় অগ্নিকুন্ড ঘিরে মানুষেরা নাচে-গায়, সুর দিয়ে অভিজ্ঞতার গল্পগুলো বলে কিংবা প্রয়াত পূর্বপুরুষদের কাহিনি বলতে থাকে নেচে-নেচে গেয়ে-গেয়ে। মানুষেরা শোনে, উৎফুল্ল হয়, বিমর্ষ হয়, ভীত হয়, হাসে-কাঁদে। আদিকাল থেকেই মানুষ আবেগী, সংবেদনশীল, সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন প্রাণী।

গুহাবাসীরা একসময়ে সমতলে, নদী-উপত্যকায় বসত গড়ে, গড়ে তোলে গ্রাম, হয়ে ওঠে সমাজবদ্ধ মানুষ। উৎসবে-পার্বণে সুর দিয়ে তখনো গায় গল্পের কথা। নেচে-গেয়ে শুনিয়ে যায় পুরনো ইতিবৃত্ত, বংশপরম্পরায় মানুষের অভিযান, আগ্রাসন আর অভিবাসনের কাহিনি যত। স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখে মানুষেরই ইতিহাস। মানবসভ্যতার ঊষাকাল থেকেই তৈরি হয়ে গেছে মানুষের জীবনের সঙ্গে গল্পের অচ্ছেদ্য বন্ধন। প্রবহমান জীবনধারায় ক্রমে ঠাঁই পেয়েছে সুর আর ছন্দের ব্যঞ্জনাময় কাহিনি-কাব্যের বিনোদন।

প্রাচীন গ্রিসে ক্রিট দ্বীপে, সিসিলিতে চারণকবিরা একসময়ে অতীতের শৌর্য-বীর্য আর দেবদেবীর অলৌকিকতার কাহিনি গেয়ে বেড়াত। দুশো-আড়াইশো বছর আগেও আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ান গ্রামগুলোতে দেখা যেত গল্প-ফেরি-করা গল্পবুড়োদের। পৃথিবীর প্রায় সব পুরনো সমাজেই ছিল গল্পগাথা-গেয়ে-বেড়ানো গল্পকারেরা।

কবিতাই ছিল আদি গল্পের বাহন। মানুষকে চিরকালই আকৃষ্ট করেছে ছন্দ আর সুর, তাই গদ্যে নয়, পদ্যেই প্রাচীনতম ঐতিহ্যে উজ্জ্বল ছিল গল্প – আঙ্গিকের শিল্পচাতুর্য।

সৌন্দর্যের উপলব্ধি মানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত এক বোধ, ভালোলাগার আনন্দে মোড়া। গুহাচিত্রের অভিনিবেশ থেকে আধুনিক শিল্পকলা অবধি যার বিস্তার। মানুষই তো সেই প্রাণী, যার রয়েছে শিল্পবোধ ও শিল্পসৃজনের ক্ষমতা। মানুষের এই বিশেষ সৃজনক্ষমতাই মানবসংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে এসেছে কাল থেকে কালান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। ধারণ করে আছে মানবসভ্যতার বিবর্তনকে, মানুষের জীবনের আনন্দ-বেদনার ইতিহাসকে, মানুষের গল্পকে।

 

দুই

এদেশে একসময়ে চারণকবিরা অতীতের গল্পগুলো ছন্দ আর সুরের বাঁধনে আকর্ষণীয় করে তুলতেন। গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে মানুষকে শুনিয়ে যেতেন গ্রামীণ ভাষায় রচিত কাহিনিকাব্য। এমন করেই লোককাব্যের শুরু। এমনভাবেই কবিয়াল, বয়াতি আর গায়েনরা তৈরি করে দিলেন লোকসাহিত্যের ধারা, জারিগান, পালাগান, যাত্রাগান, লেটো আর ঝুমুর দলের গান। অজানা কাল থেকে বাংলার গ্রামে গ্রামে আরো কত যে কাব্যগাথা মানুষকে গল্প দিয়ে এসেছে, প্রাণ পেয়েছে ধর্ম-অধর্মের, সুখ-দুঃখের, জয়-পরাজয়ের কাহিনি। মূর্ত হয়েছে সমাজ, মানুষ, ধর্ম আর প্রকৃতি এবং মানব-মানবীর প্রেম। বাংলা ভাষার প্রাচীন কাব্যসাহিত্য চর্যাপদের আধ্যাত্মিক আবেগ প্রকাশের উপমায় এসেছে মানুষেরই গল্প। ধর্ম, সম্পদ, সম্মানবঞ্চিত নির্যাতিত অধিকারহীন দলিত মানুষের জীবনের কথাই বলেছেন চর্যার রচয়িতারা।

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী

হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী

(কাহ্নপাদ, চর্যা ৩৩)

অথবা,

নগর বাহিরে রে ডোম্বী তোহারি কুড়িয়া

ছোই ছোই যাইসি ব্রাহ্মণ নাড়িয়া

(কাহ্নপাদ, চর্যা  ১০)

অতি দূর-অতীতের এই কাব্যে শবর, ডোম, নিষাদ, অচ্ছুৎ, নিম্নবর্গীয় দরিদ্র মানুষের গল্পগুলো প্রদোষের কুয়াশা ভেঙে ভেঙে প্রবহমান থেকেছে মানুষের সমাজে। এমনভাবেই পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সংগৃহীত মহুয়া, মলুয়া বা সখিনার গল্প কিংবা বরিশালের গুনাই বিবির গানে দুর্ভাগা নারীদের কাহিনি গল্প হয়ে উঠেছে।

কখনো গৃহবধূ, কখনো অচ্ছুৎ শবর-বালিকারা গল্পের নায়িকা হয়ে শতাব্দী অতিক্রম করে গেছে। কখনো আবার ইতিহাসের কোনো নির্মম ঘটনাকে গল্পকারেরা করে তুলেছেন কাব্যগানের গল্প।

উত্তরাধিকারের যুদ্ধে পরাজিত সম্রাট শাহজাহানের পুত্র সুজার সপরিবারে আরাকানে আশ্রয় খুঁজতে যাওয়া এবং তাদের নির্মম পরিণতি নাফ নদীর এপারে দুঃখের গল্প তৈরি করে দেয়। বিধর্মীর হাতে বন্দিনী সুজার তনয়া আমিনা ও সহধর্মিণী পরীর নির্মম মৃত্যুতে তৈরি হয় দুঃখের গান বারামাইস্যা।

শত-শত বছর ধরে বারমাইস্যার গায়কেরা শুনিয়ে চলে করুণ কাহিনি –

নসীবের লিখা কভু যায় না খন্ডন

চাটিগাঁ ছাড়িতে বাদশা করিল সমন…

তারপর –

দক্ষিণ-মুখ্যা আইল তার হাতীর উপর

চড়ি রে

হায় হায় দুক্ষে মরি রে

বারমাইস্যা গানের গায়ক ‘পরীবিবির হাঁহলা’ আখ্যানের বর্ণনায় নাটকীয়তা সৃষ্টি করেছেন এইভাবে –

ন যাইও, ন যাইও পরী রোসাইঙ্গ্যার দেশে

ধন-দৌলত হারাইবা, জান দিবা শেষে।

…ন যাইও, ন যাইও পরী মুরঙ্গ্যার ঠাঁই

মানুষের গোস্ত খায় তারা হিজাই হিজাই

এক পাও যাইতে আর আমি মানা করি রে

হায় হায় দুক্ষে মরি রে \

গ্রামীণ গল্পকারেরা যুগে যুগে এমনভাবেই শুনিয়ে এসেছেন বাস্তব ঘটনার গল্পগাথা।

তারপর যুগ পালটেছে, সময় বদলেছে, বদল হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। দেশে রাজা আসে, রাজা যায়, হাতবদল হয় রাজসিংহাসনের। গল্পগুলো কিন্তু থেকেই যায়, তবে বিষয় বিস্তৃত হয়। নিপীড়িত মানুষের গল্পে স্থান পায় রাজা-বাদশাহ, দেওয়ান-জমিদার, ফৌজদার, তালুকদার। স্থান পায় অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ঘটনা, যুক্ত হয় পীর-দরবেশ-ওলিআল্লাহর অলৌকিক শক্তিমত্তার কথা। সারিন্দা, দোতারা, ঢোল-ডগর-কাঁসি-খঞ্জনির ঐকতানে গল্প-গানের আসর মাঠে, হাটে, নদীর ঘাটে জমজমাট হয়।

সময়ের সঙ্গে কাহিনিকাব্য লেখ্য রূপ পেয়ে যায়, একসময়ে। মানুষেরা পড়ে গল্পের স্বাদ উপভোগ করে। পড়ার দক্ষতা না থাকলেও শোনায় ব্যাঘাত ঘটে। না। বর্ষা-বাদলায় মাঠঘাট জলে থইথই, ঘরের দাওয়ার পুঁথিপাঠক গল্প পড়ে শোনায় –

…ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল

সাত মাসের পথ মর্দ সাত দিনে গেল।

স্বল্পশিক্ষিত পুঁথি-পাঠকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কখনই প্রশ্ন ওঠে না বিমোহিত শ্রোতাচক্রে।

রাজ্যপাট বদলায়, বিদেশি শাসক আনে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের  ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা-দীক্ষা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা রেনেসাঁসে আলোকিত মধ্যবিত্তের উত্থান বদলে দেয় আবহমান লোককাহিনির অবয়ব। পদ্যের বাঁধন কেটে গল্পকে এনে স্থান দেওয়া হয় ভিন্ন আবাসে। পদ্য-কাহিনিকে হটিয়ে সামনে আসে গদ্য-কাহিনি। তালপাতার পুঁথি নয়, শিলালিপি নয়, পোড়ামাটির সচিত্র লেখন বা পুঁথিপাঁচালি নয়, এসব পেছনে ফেলে সগৌরবে আত্মপ্রকাশ করে ছাপাখানা। গল্পের স্থান হয় পুস্তকে।

তবু পালাগান, লেটোগান, ঝুমুর গান, জারি, সারি, গম্ভীরা ইত্যাদি গ্রামীণ বিনোদন থেকে যায় গ্রামগঞ্জে। অপরদিকে নাগরিক জীবনে গল্প থাকে বইয়ের পাতায়, স্থান পায় পুস্তক-বিক্রেতার দোকানে, পাঠাগারে। গল্পের শ্রেণিবিভাগ বা শ্রেণিবৈষম্যের সৃষ্টি তখন থেকেই, গ্রামীণ ও নাগরিক দুই শ্রেণির মানুষের জন্য তৈরি হতে থাকে দুই আঙ্গিকের গল্প।

ইংরেজি সাহিত্যের অনুকরণে উপন্যাস আখ্যায়িত দীর্ঘ গল্পের প্রচলন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতেই। সংস্কৃত শব্দাবলি-কণ্টকিত লেখ্য গদ্যকে সংস্কার করে আধুনিক বাংলা গদ্য তৈরি করলেন তিনি সাহিত্য লেখার প্রয়োজনে।

পরিশীলিত মার্জিত গদ্যের মাধ্যমে ছোটগল্পের উদ্ভাস পরে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে গল্প শোনানোর সীমিত আকারের শিল্পিত বাহনটি তিনিই সৃষ্টি করে গেলেন।

ইয়োরোপীয় সাহিত্যাঙ্গনে ততদিনে ছোট আকারের গল্প অর্থাৎ ছোটগল্প পূর্ণ যৌবনের শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

বাংলা ছোটগল্পের জন্ম দেরিতে হলেও তার কিন্তু শৈশব নেই। শুরুতেই তাকে যৌবনের মহিমা দিয়ে দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই। তারপর থেকে বাংলা ছোটগল্প থেমে থাকেনি। আজো অব্যাহত গতি তার।

 

তিন

গল্পের প্রতি মানুষের আসক্তি শিশুকাল থেকেই। শিশুদের তুষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের মায়েদের অথবা দাদি-ঠাকুরমাদের গল্পের কারিগরির শুরু কতকাল আগে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের সংগৃহীত ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলি কত যুগ ধরে এদেশের শিশুরা শুনে আসছে সে-তথ্য সম্ভবত দক্ষিণারঞ্জনও দিতে পারেননি। বাংলাদেশের  জনপ্রিয়  শিশুতোষ গল্পগুলির মধ্যে টুনটুনির গল্প, শেয়াল-কুমিরের গল্প কিংবা রাখালের পিঠাগাছের গল্প এখনো প্রচলিত। এসব গল্পের উৎপত্তি কত যুগ আগের জানা সম্ভব না হলেও গল্পগুলিতে অতীতের মানুষ ও তার পরিবেশের খবরটি পেয়ে যেতে অসুবিধা হয় না। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে যাঁদের বৈদগ্ধ্য, তাঁরাই জানিয়েছেন, প্রাচীন বাংলা গ্রামে বসতবাড়ির আশপাশেই ছিল টুনটুনি পাখিদের আবাস। গল্পের টুনটুনির পায়ে বেগুনকাঁটা ফুটে যাওয়ার সঙ্গে সেকালে ঘরের পাশে বেগুন চাষের তথ্যটিও পাওয়া গেছে।

ইতিহাসেই পাওয়া যায় বেগুনের খবর।

প্রাচীনকাল থেকেই নাকি এদেশে গৃহস্থের ঘরের পাশে আদা, হলুদ ও বেগুনের চাষ হতো। আবহমান বাংলার গল্পে তাই টুনটুনির পায়ে বেগুনকাঁটা ফুটে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে কাহিনির শুরু। আরেক গল্পে রাজার টাকা কুড়িয়ে নিয়ে এক টুনটুনি ঘোষণা দেয় – রাজার ঘরে যে-ধন আছে, টুনির ঘরেও সে-ধন আছে। গল্পটিতে প্রচ্ছন্ন থাকে, নিধন মানুষের একটিমাত্র কুড়িয়ে পাওয়া টাকায় নিজেকে রাজার সমকক্ষ ধনী কল্পনা করার সুখ। এমন কল্পনা স্থান পায় হতদরিদ্র রাখালের বাড়ির ছাইগাদায় রাতারাতি একটি ফলন্ত পিঠাগাছ গজিয়ে ওঠার গল্পেও। পিঠা তৈরির উপকরণ-সংস্থানে অপারগ দরিদ্র মানুষ অলৌকিকভাবে একটি পিঠাগাছ সৃষ্টি করে কল্পনায় অনিবৃত্ত বাসনাকেই তৃপ্ত করেছে।

গল্পগুলো শিশুতোষ হলেও আবহমানের শোষিত দীন-দরিদ্র মানুষেরই গল্প। বাংলার আদি মানুষের বসবাস ছিল নদ-নদী, বিল, হাওর-বাঁওড় ঘিরেই। গাছপালা-গভীর বনের সঙ্গে ছিল একান্ত পরিচয়। সহাবস্থান ছিল সাপ, বাঘ, হাঙর, কুমিরের সঙ্গে, শেয়াল ছিল তাদের ঘরের কাছের পড়শি। লোকগল্পে তাই স্থান পেয়েছে প্রকৃতির এসব অনুষঙ্গ। প্রাচীন গল্পকারেরা সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য বাঘের গল্প, শেয়াল আর কুমিরের গল্প। যুগপরম্পরায় এসব গল্প শিশুদের মাঝে অনাগত শ্রোতা বা পাঠক সৃষ্টির ভিত গড়েছে। তৈরি করেছে পরিণত পাঠক। লোকসাহিত্যেই জেগে থাকে গল্পের দাবি। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলা সাহিত্যের গল্পের ভান্ডারটি ক্রমেই বর্ধিত হয়ে পরিপুষ্টি লাভ করেছে। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানুষের গল্প।

 

 চার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর থেকে বাংলা ছোটগল্প শুধু সমৃদ্ধিই লাভ করেনি, সৃষ্টি করেছে কাল-উপযোগী আঙ্গিক, যা বাংলা গল্পকে দিয়েছে বিশিষ্ট শিল্পমাত্রা। তিরিশোত্তর কাল বা বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালেই বাংলা গল্পের আঙ্গিক ও বিষয়ভাবনার পরিবর্তন ঘটেছে। মূলত, এই সময়ের গল্পকারেরা ইয়োরোপীয় সাহিত্যের চিন্তা-চেতনা ও আঙ্গিক-ভাবনার প্রতি পূর্ণমাত্রায় আকৃষ্ট হয়েছেন। বাংলা কবিতাই কেবল ফরাসি বা জার্মানি ইত্যাদি দেশে উদ্ভূত নন্দনতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি, বাংলা গল্পেও ইয়োরোপীয় আধুনিকতার প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। বৈদেশিক প্রভাবের ধারাবাহিকতায় বাংলা গল্প মার্কসবাদের প্রভাবকেও উপেক্ষা করতে পারেনি। ধরে নেওয়া হয়, মার্কস এঙ্গেলসের অনুসরণেই গল্পকে সাধারণ মানুষের গল্প করে তোলা যায়। বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে এলিয়টের ‘পোড়ামাটি’ বা ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ ধারণাপ্রসূত নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, হতাশার নান্দনিক বলয়ে অনেকটা স্বেচ্ছায় প্রবেশ করেছিল এদেশের অতি-আধুনিক সাহিত্যধারা। ফলে একই সময়ে বাংলা ছোটগল্প কন্টিনেন্টাল সাহিত্য-ভাবনাকে যেমন নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছে, তেমনি মার্কসবাদী আদর্শকেও প্রাধান্য দিয়েছে। সাহিত্য-বিশ্লেষকেরা অনেকে এ-সময়টিকে রবীন্দ্র-পরবর্তী দ্বিতীয় আধুনিকতার যুগ বলে মনে করেন।

এই আধুনিকোত্তর যুগই ছোটগল্পে বিবর্তন আনে। রবীন্দ্র-গল্প যুগের রোমান্টিকতা অতিক্রমে সম্পূর্ণ সার্থক না হলেও এই সময়ের ছোটগল্প মানবজীবনের বাস্তবতার অনেক কাছাকাছি চলে আসে। মানুষের  জৈবিক ও মৌলিক চাহিদার বাস্তবতাই মুখ্যতা পায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি এর যথার্থ উদাহরণ বলে ধরে নেওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের সৃজন-মানসে উচ্চমার্গীয় নন্দনতত্ত্ব – শিল্পের জন্য শিল্প – তেমন গুরুত্ব পায়নি, বরং পেয়েছে শুচি-শুদ্ধ ‘সত্যম সুন্দরম’-প্রভাবিত  মানুষের সৌন্দর্যবোধের রূপায়ণ। জীবন ও প্রকৃতি সর্বত্রই এই অমলিন সৌন্দর্যের চর্চায় নিবেদিত ছিল তাঁর নিজের ও সমসাময়িক সাহিত্যিকদের সাহিত্য-ভাবনা। এ-সময়ের গল্পে ইয়োরোপীয় রেনেসাঁসপ্রসূত মানবতাবাদকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি যেখানে মানুষ হয়ে ওঠে, সেখানেই শুদ্ধতা, সত্য ও সুন্দরের সার্থক প্রকাশ বলেই ধরা হয়েছে।

যুদ্ধোত্তর কালের আধুনিকোত্তর কথিত সময়ের গল্পকারেরা পূর্ববর্তী সাহিত্যতত্ত্বের নান্দনিকতাকে সরাসরি উপেক্ষা করতে চাইলেও মৌলিক কিছু সৃষ্টি করতে পারেননি। ইয়োরোপীয় সাহিত্যকে তাঁরাও সর্বতোভাবে অনুসরণ করেছেন। কল্লোল, কালিকলম ও পরিচয় পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীর অনেকে এর সপক্ষে ছিলেন সোচ্চার। সাহিত্যে এই নবীন আন্দোলনের প্রবক্তা বুদ্ধদেব বসু। তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্য-সম্পৃক্তির কথা সরাসরিই গর্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রকেও প্রচন্ড প্রভাবিত করেছিল তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, তুর্গেনিভ, শেকভ, গোর্কি প্রমুখ রুশ সাহিত্যিক, একই সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যও এ-যুগের গল্পে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। পৃথিবীর ক্রান্তিকালের এ-সময়টি সারা পৃথিবীর চিন্তা-ভাবনায় যে-পরিবর্তনের ঢেউ এনেছিল, বাংলা গল্পও সেই অস্থির সময়কে ধারণ করতে চেষ্টা করেছে। তিরিশোত্তর বা যুদ্ধোত্তর কিংবা কল্লোলগোষ্ঠীর সাহিত্যে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা, ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব এবং নিম্নবর্গীয় মানুষ গল্পে প্রাধান্য পেলেও মানুষের গল্প বলার ষোলোকলা পূর্ণ কিন্তু হয়নি।

তবু স্বীকার করতেই হয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ছোটগল্পে মানুষের কথকতার নবযাত্রার শুরু এই সময় থেকেই। জীবনের অলিগলি চোরাবাঁকে যেমন আলোক প্রক্ষেপিত হয়েছে, তেমনি সামাজিক বৈষম্যের শিকার মানুষেরা ছোটগল্পের পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

 

পাঁচ

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য খুঁজতে গেলে অবিভক্ত বঙ্গের সাহিত্যের উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি এসে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভূগোলের সীমানা নির্ধারিত হলেও ভাষা ও সাহিত্য অবিভাজ্যই থেকে যায়। অনির্দিষ্টভাবেই দীর্ঘকালের সৃষ্ট বাংলা ভাষা সাহিত্যের যৌথ মালিকানাটি বিভক্ত বাংলার দুই অংশের জন্য নির্ধারিত থাকে।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্মের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ছোটগল্প যাঁদের কলমে রূপ পেয়েছে, তাঁদের মাঝে একটি বিভ্রান্তি  সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। বাংলা সাহিত্যের যৌথ মালিকানার উত্তরাধিকারী লেখকেরা তাঁদের গল্পে পূর্ববর্তী আধুনিক ও আধুনিকোত্তর যুগের প্রভাবাধীনতা উপেক্ষা করতে যেমন পারেননি, তেমনি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের ইসলামি তমদ্দুন-কথিত নব্য সংস্কৃতির অনুসরণেও অনেকে অনীহা দেখাননি। অনেক সিদ্ধহস্ত ছোটগল্প-লেখক কল্লোলগোষ্ঠীকে অনুসরণ করে নাগরিক জীবনের গল্প-রচনায় মগ্ন থেকেছেন (যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে সাহিত্যে বলিষ্ঠ আসন নেওয়ার মতো নগরজীবনভিত্তিক জটিলতা এখানে গড়ে ওঠেনি)। আবার অনেকে মনোনিবেশ করেছেন ইসলামিক ধ্যান-ধারণায় ইসলামিক ঐতিহ্যিক ভাষা ও বিষয়-উদ্ভাবনে।

এ-সময়ের গল্পকারেরা কিছুটা বিভ্রান্তিগ্রস্ত হলেও অচিরেই তা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হন, নিজস্ব সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াসে ভূগোলভিত্তিক বাস্তবতায় দৃষ্টিক্ষেপণ করেন। এই সময় থেকেই লক্ষণীয় বাস্তবতাটি হচ্ছে, বাংলাদেশের ছোটগল্পে গ্রামীণ সমাজ ও মানুষের সকুণ্ঠ ও অকুণ্ঠ উপস্থিতি এবং সংলাপে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ। অনেকে একে আঞ্চলিক সাহিত্য হিসেবে পরিগণিত করেছেন। কিন্তু মূল বাস্তবতা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ তখন প্রকৃত অর্থে বিভিন্ন অঞ্চলের সমন্বয়ে নদীবিধৌত কৃষিপ্রধান একটি ভূখন্ড। নাগরিক সমাজ এখানে তখনো তেমন পূর্ণত্ব পায়নি। কৃষি-নিয়ন্ত্রিত সমাজই ছিল মূল সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি। সুতরাং নদীমাতৃক খাল-বিল-হাওর-পরিবেষ্টিত দেশটির সাহিত্যে যদি অঞ্চলভিত্তিক মানুষের জীবন ও সমাজ প্রাধান্য পায় তাকে আঞ্চলিক সাহিত্য আখ্যা দেওয়ার যুক্তি থাকে না। বরং সেটাই হয় দেশের সামগ্রিক সমাজসংলগ্ন মানুষের কথা। এসব মানুষের জীবনই এদেশে ভূগোলভিত্তিক নিজস্ব সাহিত্যের প্রথম সোপানটি তৈরি করে দিয়েছিল। এই সোপানে পা রেখেই আমাদের গল্পকারেরা দেশ ও দেশের মানুষকে নতুন করে চিনতে চেষ্টা করেছেন, খুঁজে নিতে পেরেছেন গল্পের নতুন ভুবনটিকে।

আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের মধ্যপর্যায়ে লেখা বাংলাদেশের ছোটগল্পে কয়েকটি প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমবঙ্গীয় উত্তরসূরীয় বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা ও নগরজীবনের যন্ত্রণা কথিত যুগ-যন্ত্রণার বাহন গল্পগুলিতে অনেক সময়ে চমকপ্রদ আঙ্গিকের চর্চা থাকলেও কৃত্রিমতার বন্দিত্ব প্রকট হয়েছে। এ-সময়ের বহুল প্রশংসিত গল্প শাহেদ আলীর ‘জিবরাইলের ডানা’ বাংলা সাহিত্যে বলিষ্ঠ সংযোজন। গল্পের ভাষায় পাকিস্তানি তমদ্দুনের আত্মপ্রকাশ প্রচ্ছন্ন থাকলেও গল্পের বিষয়টি ‘প্রলেতারিয়েত’ সমাজেরই। ধর্মীয় অধ্যাত্মবাদের অলৌকিকত্বের প্রেক্ষাপটে হতদরিদ্র বঞ্চিত এক শিশুর মনস্তত্ত্বে আল্লাহ্র অপার শক্তিমত্তা নিয়ে লেখক জটিল এক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। মার্কসবাদী বিশ্বাসের উত্তরাধিকারের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসকে তিনি সমান্তরালভাবে স্থাপন করেছেন। শিক্ষা-সম্পদহীন এক ভিক্ষাজীবী নারীর মাধ্যমে লেখক সম্পদ-বৈষম্যের সব দায় সৃষ্টিকর্তাকেই দিয়েছেন। সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভকে প্রতিষ্ঠিত করেননি। ‘জিবরাইলের ডানা’ গল্পে দুস্থ মানুষের অসহায়ত্ব নিয়তির কাছেই সমর্পিত হয়েছে। বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদী চেতনা সময়ের কারণেই হয়তো অলৌকিকতার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। ‘জিবরাইলের ডানা’ মানুষের গল্প বললেও এর লেখক হয়ে উঠেছেন সময়ের হাতের ক্রীড়নক।

ধর্মীয় রাজনীতির স্বার্থান্ধতায় রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিটেমাটি ছেড়ে উন্মূল হয়ে যাওয়া এবং অন্য দেশের অচেনা ভূমিতে স্থিত হতে গিয়ে  অভাব-অনটন, দুঃখ কষ্ট ও কঠিন জীবনসংগ্রাম, বিভক্তি-পরবর্তীকালে প্রশ্নের জন্ম দিলে এদেশের তরুণ সমাজ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে আস্থা হারায়। বাম রাজনীতিই তখন বাংলাদেশের তরুণ সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধর্মের রাজনীতির নিগড় ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এদেশের তরুণেরা মার্কসকেই আঁকড়ে ধরে। পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি জোরালো হয়ে ওঠে। এই সময়েই অনেক কবি-সাহিত্যিক নতুন করে মার্কসবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হন।

এ-যুগের বিভিন্নমুখী চেতনাকে যে শক্তিশালী লেখক তাঁর গল্পে সার্থকভাবে ধারণ করেছেন তিনি আলাউদ্দিন আল আজাদ। মার্কসবাদে বিশ্বাস অনেক সময়ে তাঁর লেখাকে স্লোগানধর্মী করে তুললেও তিনি তাঁর গল্পকে অসামান্য বৈশিষ্ট্য দিতে সমর্থ হয়েছেন। অবশ্য শ্রেণিসংগ্রামের পরিণতিতে তিনি স্বনির্মিত এক রোমান্টিকতার ভুবনে প্রবেশ করে প্রমাণ করেছেন, মূলত তিনি রোমান্টিক লেখক। মার্কসবাদের বাস্তবতা ও নিজ অন্তর্নিহিত রোমান্টিকতার দ্বন্দ্ব নিয়েও আজাদ গ্রামীণ মানুষ ও সমাজ এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের কথা লিখতে পেরেছেন। তাঁর ‘ছাতা’ এবং ‘বৃষ্টি’ গল্পদুটি এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ভাষার কাব্যিক কারুকার্য এবং ফ্রয়েডীয় চেতনায় ‘বৃষ্টি’ গল্পটিতে রোমান্টিকতার ব্যবহারই প্রবল হয়ে উঠেছে। ‘ছাতা’ গল্পটি বরং আজাদের চর্চিত রোমান্টিকতাকে অতিক্রম করে অবিস্মরণীয় এক শিল্পময় কথকতা হয়ে উঠেছে। এই সময়েই পাশ্চাত্য সাহিত্যনির্ভরতা, পাশ্চাত্য রীতি এবং নিরীক্ষাধর্মিতা অনেক গল্পকারের লেখায় স্বতন্ত্র মাত্রা এনেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এবং সৈয়দ শামসুল হক এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের গল্পেই সরল বক্তব্যপ্রধান কথকতা পর্যবেশিত হয় আঙ্গিকপ্রধান শিল্প-আধারে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’ এদেশের ছোটগল্পে আঙ্গিক ও শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সব প্রয়াসকে পেছনে রেখে স্বমহিমায় উচ্চস্থান পেয়েছে। ব্যক্ত এবং অব্যক্তের মাঝে ব্যবধানে যে নতুন শিল্পযাত্রা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন তা অভূতপূর্ব। যদিও পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্ব তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে, তবু একে আত্মস্থ করার দক্ষতা তাঁর ছিল, ফলে বাংলাদেশের ছোটগল্পে শিল্পময় সমাজমনস্ক আধুনিকতার পথনির্দেশে ওয়ালীউল্লাহ্র সার্থকতা অস্বীকার করার উপায় নেই।

সৈয়দ শামসুল হকের আবির্ভাব পঞ্চাশের দশকে হলেও প্রথম থেকেই উপন্যাসের মতো গল্পের ক্ষেত্রেও তিনি সর্বতোই আঙ্গিকাশ্রয়ী এবং নিরীক্ষাধর্মী। ভাষার কাব্যিক আবহসৃষ্টির প্রবণতা এই লেখকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন কাব্যগাথার ভঙ্গিমা তাঁর গদ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে এবং সেদিকে তিনি বিশেষ যত্নশীলও। তাঁর প্রথম দিকের লেখা ‘রক্তগোলাপ’ গল্পে ভাষার কারুকার্যের সঙ্গে রোমান্টিকতা ও বাস্তবধর্মিতার আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে। পরবর্তীকালে সৈয়দ শামসুল হকের গল্পের আরো উত্তরণ ঘটেছে। বেশ কয়েকটি অসাধারণ গল্পে তিনি অঞ্চলের মানুষ, গ্রামের মানুষ, অতিসাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। প্রাচীন লোককাব্য-অনুসারী ভাষার ব্যবহার তাঁকে একক বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। আমাদের গল্প-সাহিত্যে এই দুই গল্পকার নিজস্ব সাহিত্যধারার প্রধান দ্বার-উদ্ঘাটক। সাতচল্লিশ-পরবর্তী পঞ্চাশের গল্প-সাহিত্যের পট সম্পূর্ণই বদলে যায় বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে।

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের অবদানেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও নিজস্ব ‘আইডেনটিটি’র নির্ধারণ। এই প্রথম বাঙালি তার সঠিক আত্মপরিচয় খুঁজে পেল এবং তা নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমেই। ধর্মের ভিত্তিতে নয়, ভাষার ভিত্তিতেই নতুন রাজনৈতিক চেতনার উৎসারণ ঘটল। অসাম্প্রদায়িক চেতনা-সংবলিত শিক্ষিত নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি উজ্জীবিত হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধে। অর্থনৈতিক শোষণ ও প্রতারণা এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর পাকিস্তানি শাসকবর্গের আগ্রাসনে একুশের চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবোধকে আরো সম্প্রসারিত করে দিলো। নিজস্ব ভূখন্ডের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি হয়ে উঠল বাঙালির জাতীয়তার প্রেক্ষাপট। কলকাতাশ্রয়ী অতি-আধুনিকতায় বিশ্বাসী কবি-সাহিত্যিকদের রবীন্দ্রবলয় উপেক্ষার আন্দোলন এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া আখ্যায় বর্জনের ঘোষণা নস্যাৎ করল বাংলাদেশে বায়ান্নর ভাষা-চেতনা। রবীন্দ্রনাথ বিপুল সম্ভারে ফিরে এলেন বাঙালির জীবনে, জাতীয়তাবোধে। বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব রবীন্দ্রনাথেই আরোপিত হলো। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হলো নাগরিক প্রচেষ্টায় বিশাল আয়োজনে। বাঙালি আইডেনটিটিতেই কেবল নয়, রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন প্রতিবাদের অস্ত্র।

বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে উদ্বেলিত হলো আত্মবিকাশের প্রবল গতিবেগ। বাংলাদেশের ছোটগল্প অতীতমুখীনতা বর্জন করে নতুন ধারায় আত্মপ্রকাশ করল। দ্রোহে-ক্ষোভে, সংক্ষোভে-প্রতিবাদে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ী সাহিত্যের সূচনা করল ষাটের দশকের নবাগত গল্পকারেরা। এই দশকের উল্লেখযোগ্য গল্পকার হাসান আজিজুল হক, নবতর আঙ্গিকে যে নতুন ধারা সৃষ্টি করলেন, তাতে বাংলা ছোটগল্প অনিন্দ্য এক শিল্পমাত্রা অর্জন করল। তাঁর নিরীক্ষাধর্মী প্রকরণে ভাষার গুরুত্বটি প্রাধান্য পেলেও ব্যক্ত এবং অব্যক্তের মধ্যবর্তী রহস্যসৃষ্টিতে ইঙ্গিতবাহী তীক্ষ্ণ সমাজ-বক্তব্য তীব্র হয়ে উঠেছে। মানুষের গল্পগুলোকে হাসান আজিজুল হক আশ্চর্য এক শিল্প-আঙ্গিকে তুলে আনতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর ছোটগল্প তাই নান্দনিকতার নবমাত্রায় বিশিষ্ট হয়েছে। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘শকুন’ কিংবা ‘পাতালে হাসপাতালে’ প্রভৃতি প্রতিটি গল্পেই মানুষ, প্রকৃতি, সমাজ সবই ইঙ্গিতবাহী মননধর্মী ও প্রতীকাশ্রয়ী সৃজনধর্মিতায় তাঁকে একক বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।

এ-সময়ের আরেক গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তও এই একক বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট। প্রথম থেকেই তিনি ছোটগল্পসৃষ্টিতে সর্বতোভাবে নিরীক্ষাধর্মী ও পাশ্চাত্য সাহিত্য-প্রভাবিত। প্রথমদিকের রচনায় চৈতন্যপ্রবাহের পাশ্চাত্য রীতিটি তিনি সচেতনভাবেই অনুসরণ করেছেন। পরে অবশ্য পাশ্চাত্য সাহিত্যের ও নান্দনিকতার সূত্রকে আত্মস্থ করে নিজ ধারায় এদেশের মানুষের অন্তরজগৎ ও বহির্জগতের গল্পগুলো বলে গেছেন। যদিও তাঁর রচনায় অনেক সময়ে গল্পের উপস্থিতি প্রচ্ছন্ন কোনো স্বপ্নছায়ার আভাস দেয় মাত্র, ভাষা, ফরম এবং অতিমাত্রায় শিল্প-সচেতনতা তাঁর ছোটগল্পকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসকের দমননীতির বিরুদ্ধে এই সময়ের গল্পলেখকেরা সাহিত্যকেই প্রতিবাদের অস্ত্র করে তুলতে প্রয়াসী হন, তবু অস্বীকার করা যায় না, পাশ্চাত্য সাহিত্যই হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের আরাধ্য ক্ষেত্রে পৌঁছে যাওয়ার সরল পথ। বৈশ্বিক শিল্প-সাহিত্যের প্রভাবমুক্ত হতে চেষ্টা করেননি তাঁরা।

জাতীয়তাবোধের বিস্ফোরণে পাকিস্তানের ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন আসন্ন হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিলুপ্তিতে জাতীয় নেতৃত্বেরও উত্থান ঘটে। সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে লাখ-লাখ মানুষের মৃত্যু ও অবর্ণনীয় দুর্দশায় শাসকবর্গের উদাসীনতায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রভুক্তির বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। সত্তরের নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাবলি এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো দূরদর্শী নেতার উত্থানে বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীন ভূখন্ড অবধারিত হয়ে ওঠে। একাত্তরের পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের সমাজ ও জীবনে নতুন চেতনার জোয়ার নিয়ে এলো। পুরনো শিবিরের সমাজ-সংস্কৃতির যুগের অবসান ঘটল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পূর্ণ নতুন প্রারম্ভের দ্বার উদ্ঘাটিত করল। অজস্র নতুন গল্প নিয়ে জেগে উঠল নতুন বাংলাদেশ।

 

ছয়

বায়ান্নর ভাষা-সংগ্রামেই স্বাধীন বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাটির উন্মেষ ঘটেছিল। হয়তো সেই কারণেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় নব উদ্যম প্রকাশ পেয়েছিল। পাকিস্তানি গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অবলম্বনে লেখা হতে থাকল অজস্র গল্প। শৈলীগত উৎকর্ষ অপেক্ষা বিষয়ই বেশি প্রাধান্য পেল লেখকের লেখায়। গল্পগুলো হয়ে উঠল শত্রুকবলিত বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধকালীন বিপর্যয়, সেইসঙ্গে স্বাধীনতাকামী বাঙালির মরণপণ যুদ্ধের গৌরবগাথা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া দেশের শহরে-বন্দরে গ্রাম-গ্রামান্তরে জেগে উঠল অসংখ্য গল্প – শহীদের গল্প, গণকবর আর অগ্নিদগ্ধ ফসলের গল্প, পরিজনহারা নিঃস্ব মানুষের আহাজারির গল্পের সঙ্গে অবয়ব পেল দেশদ্রোহী বিশ্বাস-হন্তারক নব্য মীরজাফরদের নৃশংসতার কাহিনিও। ধর্ষিতা বাংলাদেশের অশ্রুহীন দৃষ্টিতে লেখা ঘৃণা আর দ্রোহের গল্পগুলোই রইল বলার অপেক্ষায়।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অধ্যায়। পূর্ববর্তী সাহিত্য-ভাবনার উত্তরাধিকার বিলুপ্ত হলো, কথাশিল্পের অঙ্গন পূর্ণ হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের শোক-দুঃখ-নির্যাতনের ভয়ংকর স্মৃতি এবং যুদ্ধজয়ের গৌরব ও উচ্ছ্বাস নিয়ে। স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর আত্মপ্রত্যয়ী অহংকারে এদেশের প্রতিটি মানুষের মতো বাংলা সাহিত্যও নতুন আবেগে উদ্বেল হলো। মানবিচারে বা শিল্প-উত্তীর্ণতায় মুক্তিযুদ্ধের সব গল্পই যে সার্থক হয়েছে এমন হয়তো বলা যাবে না। তবু এ-সত্য মানতেই হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এদেশের সাহিত্যের নতুন যাত্রা শুরু হলো। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের গল্পলেখকেরা সত্তরের দশক ও পরে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হলেন। নবীন লেখকদের আত্মপ্রত্যয়ী পদার্পণ ঘটল গল্পের ভুবনে। এ-সময়ের দুই লেখক মাহমুদুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে সম্পূর্ণই বাংলার যুদ্ধোত্তর কালের সার্থক রূপকার বলা যায়। সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতা কিংবা দূরবর্তী লাতিন আমেরিকায় আবিষ্কৃত নব্যবাস্তবতাবাদ (পাশ্চাত্য বিজ্ঞজনেরা যাকে জাদুবাস্তব আখ্যায় প্রচার করেছেন) তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পেল না। মাহমুদের ভাষার অসামান্য দ্যুতি এবং প্রাগ্রসর প্রয়াসী সমাজের ভাঙাগড়া, মূল্যবোধের টানাপোড়েন অসাধারণ বাস্তবতায় তাঁকে বলিষ্ঠ কথাকারের মর্যাদা দিলো। ইলিয়াসও ভাষার পরীক্ষায়, আঞ্চলিকতার ব্যবহারে, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপাত্মক বা স্যাটায়ারধর্মিতায় বিশিষ্টতা অর্জন করলেন। গ্রাম ও শহরের অতিসাধারণ মানুষের জীবনকে তিনি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষ শল্যচিকিৎসকের মতো ব্যবচ্ছেদ করতে দ্বিধা করেননি। তাঁর প্রতীকাশ্রয়ী বর্ণনায় অসুস্থ, অবদমিত সমাজ, রাজনীতি ও মনস্তাত্ত্বিক জগৎ আশ্চর্য বাস্তবতায় উন্মোচিত হয়েছে।

যুদ্ধ-পরবর্তী অবিন্যস্ত দেশে সমাজের অবক্ষয়ের ভাঙনের পর্ব অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ’৭৫-এর রক্তপাত ও ক্ষমতাদখলের কুখ্যাত অধ্যায়ের শুরু। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধীর উত্থানে ও দুর্নীতি সম্প্রসারণে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির উত্থান-পতনকে নিক্ষেপ করা হয় অপার নিরাশা ও হতাশার অন্ধকারে। স্বৈরাচারী সামরিক শাসন, বাঙালির হাজার বছরের অর্জনকে যখন কারাবন্দি করেছে,  তখনো তৈরি হয় গল্প। সে-গল্পগুলো লেখা হয় কি, হয় না, সে বোধ নিয়ে মাথা ঘামায় না। অপরাজনীতির হুংকারে নির্বীর্য বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা শিল্প-সাহিত্যে এক পলায়নী মনোবৃত্তি অনেক সময়ে প্রবল হয়ে ওঠে। গল্পে পাশ্চাত্য ব্যাকরণবাহিত মেদহীন সহজ গদ্যের আগমন ঘটে পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুশীলিত মেদহীন (ঝরঝরে!) গদ্য এদেশের অনেক গদ্যকারের আদর্শ হয়ে যায়। ঝরঝরে, নির্মেদ গল্পভাষার ব্যবহারে প্রথম সার্থক হন হুমায়ূন আহমেদ। শঙ্খলীল কারাগার ও নন্দিত নরকের লেখক তাঁর গল্পের ভাষায় সহজ গদ্য ব্যবহার করে রোমান্টিক-মধ্যবিত্ত কাহিনি জনপ্রিয় করে তোলেন। পঞ্চাশ থেকে সত্তর ও পরবর্তীকালে যেসব শক্তিশালী গল্পলেখক মানুষের গল্পকে নানা আঙ্গিকে উপহার দিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে দুটি ধারা লক্ষ করা যায় : ’৪৮ থেকে পঞ্চাশের আবু রুশদ্, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শওকত ওসমান,  শাহেদ আলী প্রমুখ, পরে রাবেয়া খাতুন, রশীদ করীম, জহির রায়হান ও অন্যরা যে প্রথাসিদ্ধ আঙ্গিকে গল্প বলেছেন, তাঁদের গল্পে সমাজবাস্তবতা, মানুষের মনস্তত্ত্ব ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনাধর্মী বক্তব্য প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁদের গল্প যথার্থই সময় ও সমাজকে বিধৃত করেছে। ষাট ও সত্তরের দশকে শওকত আলী, শহীদ আখন্দ, সেলিনা হোসেন, রশীদ হায়দার, রাহাত খান, বশীর আল হেলাল, বিপ্রদাশ বড়ুয়া ও অন্যদের গল্পে আঙ্গিক পরিচর্যার সঙ্গে কাহিনি মুখ্য হলেও সময়কে তাঁরা প্রচন্ডভাবে ধারণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আবুবকর সিদ্দিক ব্যতিক্রমী। সত্তরের দশকের দক্ষ গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ খুব সহজ সংযত ভাষায় লেখা তাঁর বিষয়ের শিল্পিত প্রকাশে, মানুষের জীবনের সাধারণ ঘটনাকে অসাধারণত্ব দিয়েছেন। তাঁর ‘জলিল সাহেবের পিটিশান’  মুক্তিযুদ্ধের সার্থক গল্পই শুধু নয়, সমগ্র ছোটগল্পের ভান্ডারে মূল্যবান সংযোজন। অনেক পরে লেখা হুমায়ূনের ‘চোখ’ এক আশ্চর্য সৃষ্টি।

গল্পে গ্রামীণ মানুষের জীবনকে সহজ ভঙ্গিতে বলার পারদর্শিতায় ইমদাদুল হক মিলনের সার্থকতাও যথেষ্ট। মইনুল হাসান সাবেরও এই ধারার গল্পকার। তাঁদেরই ধারাবাহিকতা অনুসারী গল্পকার আনিসুল হক ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

বাংলা ছোটগল্পের নিরীক্ষামূলক ধারার লেখকের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। পাশ্চাত্য প্রভাববলয়ের এই লেখকেরা আলাউদ্দিন আল আজাদ থেকে শুরু করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত প্রমুখ গল্পের শিল্পগত কাঠামোকে প্রাধান্য দিলেও গল্পের অবস্থানটি বিনষ্ট করেননি। তরুণ গল্পকারদের কেউ কেউ এ-ধারাটির অনুসারী হয়েছেন। নাসরীন জাহান, শহীদুল জহির, অদিতি ফাল্গুনীর গল্পগুলোতে আঙ্গিক-ভাবনা ও শিল্পের নান্দনিকতা উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে হরিশংকর জলদাস, সুশান্ত মজুমদার, প্রশান্ত মৃধা, ইমতিয়ার শামীম, হুমায়ুন মালিক, ওয়াসি আহমেদ গল্পকেই কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন।

নিবন্ধটিতে কলেবর-সম্প্রসারতা-নিরোধের জন্য আরো অনেক ছোটগল্পকারের উল্লেখ সম্ভব হলো না। ছোটগল্পের ধারাবাহিকতার ইতিহাস রচনা আমার উদ্দেশ্য নয় (সে-যোগ্যতাও রাখি না), তাই প্রতিটি গল্প বা গল্প-লেখককে নিয়ে বিশদ আলোচনাও এখানে স্থান দিতে অপারগ হয়েছি।

সাম্প্রতিক ছোটগল্পে অতি-তরুণ যে-গল্পকারদের আবির্ভাব, তাঁদের সম্পর্কে মন্তব্য এ-মুহূর্তে অপূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে যতটুকু অনুধাবন করতে পারি – তিরিশোত্তর কালের অবিভক্ত বাংলা সাহিত্যে যে অতি-আধুনিক উচ্চকণ্ঠ লেখকেরা পূর্ববর্তী আধুনিক ধ্যান-ধারণাকে উপেক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলেন, আমাদের তরুণতম গল্পকারেরাও তেমন নতুন কিছুর অনুসন্ধানে উদ্বেল বলেই মনে হয়। ভাষায় তাঁরা নতুনত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কথ্য আঞ্চলিকতাকে কখনো আশ্রয় করছেন, কখনো ভাষায় মিশ্ররীতিতে মনোনিবেশ করছেন, সর্বোপরি উত্তর-আধুনিকতার প্রতি রয়েছে তাঁদের মোহগ্রস্ততা। তাঁরা নিঃসঙ্গতাবোধ ও বিচ্ছিন্নতার কাছেই মানুষের অন্তর্নিহিত ভাবনার জগৎটিকে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী। ধারণা করা যেতে পারে, এসবই আমাদের ছোটগল্পের সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ, প্রথাসিদ্ধ আবদ্ধতা তো অচলতারই কথা জানায়। সময়বদলের সঙ্গে সমাজ-মানুষের জীবনযাপন, পেশা, পরিবেশ মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মাঝেও প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়। সাহিত্যিকের কাজ সঠিক সময়ের মানুষকে গল্পে তুলে আনা। মানুষের গল্পকে মানুষের জন্যই নির্মাণ করা। এতে যদি বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন প্রাধান্য পায় বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকে না। কারণ এমনি হয়, হয়ে আসছে।

বিশ্বায়নের কারণে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরসংলগ্নতা বা পরস্পরনির্ভরতা। ক্ষমতাবান সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটেছে তো কবেই, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই এখন শাসন করছে বিশ্বকে। নিষ্কণ্টক পুঁজিবাদের বাজার অর্থনীতি পরোক্ষে মানুষকে ভোগবাদের দাসে পরিণত করতে চলেছে, উপরন্তু প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার ও অবাধ তথ্যের কারণে মানুষ এখন ‘সব পেয়েছি’র জ্ঞানে বৃদ্ধ, কম্পিউটারের ইন্টারনেট, ফেসবুক, ব্লগের তথ্যবিনিময়ে সহজতায় এখন মানুষ সম্পূর্ণই যন্ত্রনির্ভর প্রাণী। উপরন্তু আকাশ-সংস্কৃতির বদৌলতে অডিও-ভিডিওর সুবিধা সারাবিশ্বে মাল্টিন্যাশনাল সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করে চলেছে, এতে মানুষের জ্ঞানের রাজ্য কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে সে আলোচনায় না গিয়ে বলা যায় – বর্তমান বিশ্ব একটি বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে, মানুষ এই বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাই শুধু নয়, ভোক্তা বা খাদকও নয়, সম্পূর্ণভাবেই পরিণত হয়েছে উদ্যোক্তার উৎপাদিত পণ্যে। মানুষের হৃদয়বৃত্তি, সৌন্দর্যবোধ ও মানবিক সম্পর্কসমূহ পণ্যের মানে যাচাই হয়ে যাচ্ছে।

এই বিশ্ব-সামাজিক পরিস্থিতিতে মানুষের গল্পগুলো হয়তো অসহায় হয়ে যাচ্ছে। ভাতের শূন্য শানকি হাতে চার বছরের ক্ষুধার্ত নিঃসঙ্গ শিশুর মতো সভ্যতা-অগ্রসরমান উন্নয়ন কাঠামোর দরোজায় এসে দাঁড়াচ্ছে, প্রশ্ন তার – আমারে কি আপনেগো বাইত্ রাখবেন?

এ-প্রশ্নটি রইল মানুষের গল্প যাঁরা নির্মাণ করতে চান সেইসব তরুণতম গল্পকারদের কাছে।