মানুষ এবং মানুষ

মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও

মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও

মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

– ‘দাঁড়াও’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মানুষের ভারে নুয়ে পড়েছে বাসভূমি। পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ, পশু, মাছ, নদী, বিল এসব যেমন প্রয়োজন, তেমনি মানুষেরও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু মানুষ ক্রমে দখলে নিচ্ছে সবটুকু। মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি হয়ে চলছে স্বদেশ। মাহবুব জামাল শামীম মানুষের মিছিলের কথা বলছিলেন তাঁর শিল্পকর্মে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের তৈরি শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য ছিল। আধুনিক শিল্পকলার নির্মাণকৌশল ও ভাষায় চলতি সমাজের টানাপড়েন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাহবুব জামালের কাজে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ভাস্কর্য ভেনাস অব উইলেনডর্ফের আদল পাওয়া যায়। কোনো কোনো কাজে হেনরি মুরের ফর্ম আভাস দেয়। আবার কোনো কাজে দেবী দুর্গার সনাতন ফর্মকে হাজির করে তার সঙ্গে মানুষের সারি জুড়ে দিয়েছেন। মাহবুব মানুষের শরীরের উলস্নম্ব আকৃতিকে ভেঙে চ্যাপ্টা আড়াআড়িভাবে দেখান। কারণ ঊর্ধ্বমুখী শরীরের অবয়বে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। শিল্পী মনে করেন, ঊর্ধ্বমুখী উলস্নম্ব শরীরের আকৃতি ভাস্কর্য হিসেবে দুর্বল হয়। দুর্বল গাঁথুনিতে দুর্বৃত্ত হানা দিতে পারে। এমন ভাবনা থেকেও মাহবুব আড়াআড়ি ফিগার তৈরিতে মনোযোগী হন। তাঁর ভাস্কর্যের গড়নে জ্যামিতিক প্রতীকবাদিতার আশ্রয় রয়েছে। পিকাসোর ঘনকবাদী আচরণের প্রভাব পাওয়া যায় কোনো কোনো কাজে। মিসরীয় সভ্যতার মানুষের মূর্তির গড়ন নিয়ে মাহবুব দু-একটি কাজ করেছেন। তাতে দেখা যায়, মিসরীয় ভাস্কর্যের অতিকায় গড়নের ভেতর জ্যামিতিক আকৃতির উপস্থাপন। মাহবুব জামাল শামীমের শিল্পকর্মের বিষয় – ‘মানুষ’, মানুষের ভারী বা স্থূলদেহের আশপাশ ছাড়িয়ে আছে অজস্র মানুষ। এই মানুষের মধ্যে উদ্বেলতা নেই, উচ্ছলতা নেই, আছে নির্লিপ্ত ধ্যানী রূপ। কেন এমন ভাবনায় শিল্পকর্ম গড়েন সে-উত্তরে শিল্পী বলেন, ‘মনে হয় শিল্পকর্মের মানুষগুলোর মতো শান্ত, স্থির মানুষগুলো আমাদেরই সভ্যতার অংশ। তাই আমার মানুষের চোখের গড়নে ধ্যানীভাব রেখে দিই।’ পশ্চিমা বিষয়ভাবনার সঙ্গে লোকজ, ধ্রম্নপদী, প্রাচীন ভারতীয় মিথ যুক্ত করেন কোনো কাজে। এক্ষেত্রে বলা যায়, ‘দুর্গা’, ‘কালী’, ‘জাংগল অব হিউম্যানিটি’ শিরোনামের কাজগুলোর কথা। এই তিনটি কাজের শক্তি অদম্য। কালো চারকোলে অাঁকা ‘কালি’র অতিকায় দেহভঙ্গিতে এক শক্তি তৈরি হয়েছে। চারকোল ও প্যাস্টেল রঙে অাঁকা দুর্গার অসুর বধের ঘটনায় দুর্গার হাতের ত্রিশূলে তীব্র শক্তি উপস্থাপন দেখা যায়। এভাবে প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের বর্ণনা আমাদের নতুন করে ভাবায়। ‘জাংগল অব হিউম্যানিটি’ কাজটির চারপাশে নীল রঙের ব্যবহারে আকাশ ও জলের আবহ নির্দেশ করে। দেবী দুর্গার দশ হাত আমাদের দশ রকমের শক্তি দেয়। দুর্গার চারপাশে অগণিত মানুষের মুখ ঘিরে আছে। দেবী দুর্গার শক্তির আরাধনায় অজস্র মানুষ প্রার্থনায় রত। এ-কাজে মানুষের সঙ্গে দেবীর বন্ধন দেখা যায়। পুরো ক্যানভাসে নীল রঙের প্রলেপে মানুষ ও দেবী আলোয় আচ্ছন্ন হয়েছে।

মাহবুব জামাল চিরচেনা বাংলার বিষয় নিয়েও কাজ করেছেন। ড্রাই প্যাস্টেল ও কাগজে কলমের কাজে বিষয় হিসেবে নিয়েছেন  ‘নৌকা ভ্রমণ’ বা ‘বোট ট্রিপ’কে। ঘন অন্ধকার সন্ধ্যায় নৌকায় ভ্রমণরত নারীর অবয়ব স্থূল। আড়াআড়ি ফর্মে বৃত্তাকার মানুষটির বাহন নৌকা। এ-ছবিতে এক ধরনের প্রতীকবাদী আচরণ দেখা যায়। বাংলাদেশের শিল্পকলায় মানব ও মানবীর শরীরের পেশিবহুল নির্মাণ দেখিয়েছেন এসএম সুলতান। তাঁর ক্যানভাসের মানুষগুলো মাংসল, শক্তিধর, ক্ষীপ্র। মাহবুবের মানুষগুলো স্থূল, শক্তিধর কিন্তু শান্ত-ধীর। মাহবুবের কাজে সুলতানের ফিগারের সরাসরি প্রভাব নেই। সুলতানের ক্যানভাসে অগণিত মানুষের ছুটে চলা দেখা যায়। মাহবুব সেই ক্ষীপ্র গতিকে গ্রহণ করেননি। তাঁর বিষয়ে মানুষের মাঝে অগণিত পদচারণা দেখান আবার প্রত্যেক মানুষের স্থির ভঙ্গি দেখান।

এ-প্রদর্শনীর কাজের দুটি মাধ্যম আমরা দেখি। একটি হলো চিত্রকর্ম, অন্যটি পস্নাস্টার বা পাথরের ভাস্কর্য। ভাস্কর্য তৈরিতে মাহবুব মানুষের অবয়বের নিচের দিক বেশ ভারী, মাথা ও ঘাড়ের দিকে ক্রমে সরু করে তোলেন। এটি হেনরি মুরের ভাস্কর্যে আমরা দেখতে পাই। এমন ভাস্কর্য প্রসঙ্গে তাঁর মত এমন – মানুষের স্থির ও ভারী রূপ আমরা দেখি না। এই ভাস্কর্যগুলোতে দেহাবয়ব ভীষণভাবে স্ফীত, কারণ মানুষ আসলেই প্রকৃতির ওপর এভাবে জেঁকে বসেছে। পাথর ও সাদা সিমেন্টে তৈরি করা ‘হরাইজন্টাল ফিগার’ ভাস্কর্যে মানুষের আকৃতি একেবারে মাটির সঙ্গে আড়াআড়িভাবে প্রায় মিশে আছে। প্রতিটি ভাস্কর্যের গায়ে কোনো আবরণ নেই। তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকাশ্য হওয়ায় আরো বেশি ভার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

নারী দেহাবয়বেও ভারী নিতম্ব তৈরি করে দেহের ভার স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। ‘ওম্যান’ বা ‘নারী’ শিরোনামের ভাস্কর্যে নারীদেহের মাথার স্বাভাবিক গড়ন ক্রমে দেহের নিম্নাংশে ভারী, দু-পায়ের গড়ন বেশ পুরু ও স্থির হয়ে উঠেছে। মাহবুব জামালের ভাস্কর্যে স্থির, শান্ত ও নিমীলিত দৃষ্টি দেখা যায়। মাহবুব নিজে তাঁর স্থিতধী আচরণকে প্রভাবিত করে তাঁর শিল্পকর্ম এভাবেই নির্মাণ করেন হয়তো। ‘জাংগল অব হিউম্যানিটি’ শিরোনামে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় গত ১০ নভেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ২৪ নভেম্বর। r