মান্না দে

শাহাদুজ্জামান

মৃতরা কি পৃথিবীতে থাকে? না থাকে না। যেমন আমার নানা আলী হোসেন নেই; কিন্তু তিনি আমার চোখের নিচে ফুটে থাকেন প্রায়শই। তিনি আমার শৈশব দেখেছেন, দেখেছেন আমার কৈশোর ও প্রাথমিক তারুণ্য আর আমি দেখেছি কেবলই তাঁর বার্ধক্য। অথচ আমাদের পরস্পরের একটা আশ্চর্য রসায়ন ছিল। একটা জাদু ছিল তাঁর। তিনি আমাকে টানতেন। তাঁর আকর্ষণে সুযোগ পেলেই আমি চলে যেতাম বগুড়ার সরিষাকান্দি গ্রামে। কখনো মা-বাবার সঙ্গে, কখনো একা। ঢাকায় দীর্ঘদিন চাকরি করে সেই গ্রামেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর অবসর জীবন কাটাতে। সেটাই তাঁর জন্মস্থান। 

নানাবাড়ি যাওয়ার আমার একটা বাড়তি আকর্ষণ ছিল ঘোড়াচালিত টমটমে চড়া। করতোয়া নদীর এপার থেকে ছয় সিটের ছাদ-খোলা টমটমে আমরা রওনা দিতাম সরিষাকান্দির দিকে। বালক বয়সে টলস্টয় পড়ি। টলস্টয়ের চরিত্ররা সব ঘোড়াগাড়িতে চড়ে এদিকে-ওদিকে যায়। সরিষাকান্দির ধুলা-ওড়া পথে দরিদ্র টমটমে চড়ে আমার কল্পনায় জেগে উঠত রুশ জনপদের আভাস। টমটমের চালক ঘোড়ার লাগাম ধরে টান  দেওয়ার পর যখন ঘোড়া চিঁ-হি শব্দে ডাক দিয়ে ছুটতে শুরু করত, তখন বাতাসে সহসা গত শতাব্দীর একটা ঘ্রাণ জেগে উঠত।

টমটম সরিষাকান্দিতে আমার নানাবাড়ির একেবারে উঠানে গিয়ে থামলে আমার নানি ছুটে আসতেন। উত্তেজিত থাকতেন তিনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমা খেতেন আর বারবার বলতেন – ‘ছোল কোমা বড় হয়্যা গেছে।’ আমার নানা আলী হোসেন আচরণে কোনো উত্তেজনা দেখাতেন না। তবে তাঁর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে থাকত। তিনি সেই প্রচ্ছন্ন হাসি নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন – ‘কেমন আছ নানুভাই?’ নানা বগুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে থাকলেও বরাবর প্রমিত বাংলায় কথা বলতেন। নানা পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাঁর চাকরিজীবনও কেটেছে রাজধানীতে। তিনি কথায় আঞ্চলিকতা ত্যাগ করেছেন দীর্ঘদিন আগে। বগুড়ার প্রাণবন্ত আঞ্চলিক ভাষার ভিড়ে তাঁর কথা কৃত্রিম শোনালেও তার স্বাতন্ত্র্যকে আমার নানি এবং পরিপার্শ্বের সবাই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।

নানি যখন বলতেন – হামার এটি কেমন ফাঁপর ঠেকিচ্চে।

নানা বলতেন – তোমার এখানে হাঁসফাঁস লাগছে তো অন্য কোথাও চলে যাও।

নানি বলতেন – তুমি হামার সঙ্গে ইঙ্কা ক্যাচাল করিচ্চ ক্যান? নানা – ঝগড়া আমি করছি না তুমি করছ?

দুজনের ভেতর এভাবেই চলতো কথোপকথন।

আমার সঙ্গে দেখা হলে নানা বলতেন, ‘ইয়াং ম্যান, ইয়ুথ হচ্ছে একটা প্রজাপতির মতো, সুন্দর কিন্তু স্বল্পায়ু।’ বলতেন, ‘এখনই ঠিক করে নাও কী করবে তুমি জীবনে।’ বলতেন, ‘পৃথিবীতে তিন ধরনের মানুষ আসে, একদল আসে খেলতে, একদল খেলাতে আর আরেকদল খেলা দেখতে। ঠিক করো, তুমি কোন দলে থাকবে।’

আমি যে খেলতে পারব না, খেলাতেও পারব না এবং আমাকে যে খেলা দেখার ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হতে হবে, এটা কি কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপার, নাকি এই পরিণতিই বরাদ্দ আমার জন্য? সেটা নানাকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পাইনি। তিনি পৃথিবীতে নেই। তবে তিনি ফুটে আছেন আমার চোখের নিচে।

নানার সঙ্গে শেষ যেবার দেখা হলো, সেবার বিভিন্ন ব্যাপার ঘটল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষের ছুটিতে গেছি সরিষাকান্দিতে। ক্যাডেট কলেজের ছাত্র আমি। সেখানকার বুট, খাকি পোশাকের কট্টর জীবন থেকে ছাড়া পেয়ে মনে তখন বিপুল ফুর্তি।

যথারীতি টমটমে চড়ে পৌঁছাই সরিষাকান্দি। নানি ছুটে আসেন। আমার গালে, কপালে চুমা দিয়ে যথারীতি বলেন, আমি আরো বড় হয়ে গেছি। নানা তাঁর নিয়মমাফিক বলেন, কেমন আছো নানুভাই?

আমি জানতে চাই – আপনি কেমন আছেন নানু?

নানা বললেন, শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের শের আওড়াচ্ছি :

উমরেদসে মাংগকে লায়ে থে চারদিন

দো আরজুমে কট গায়ে, দো ইন্তেজারমে

মানে কি জানো? সৃষ্টিকর্তার কাছে মাত্র চারদিনের ভিক্ষা নিয়ে এসেছিলাম, দুদিন কেটে গেল আকাঙ্ক্ষায় আর দুদিন অপেক্ষায়। আমার অবশ্য জানা হয়নি, নানা ঠিক কী আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন জীবনে আর কিসের জন্যই বা তিনি অপেক্ষা করেছেন?

সরু করে কাটা পটোল আর আলুর সঙ্গে ইলিশ মাছের চ্চচরি দিয়ে দুপুরে ভাত খাই সেদিন। আমার নানির হাতের এই চ্চচরি বিশ্বখ্যাত।

সেবার আমার সরিষাকান্দিতে গিয়ে জ্বর এলো বেশ। কেমন একটা মায়াবী ধরনের জ্বর। খুব তীব্র না কিন্তু সে-জ্বর তার আসল, আঢুল আঙুল দিয়ে আমাকে কেমন বশ করে রাখল। আমি কেমন একটা দুঃখ-মেশানো মজা নিয়ে গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে হেলান দিয়ে উঠানে বসে থাকলাম নানার ইজিচেয়ারে। দেখতে থাকলাম সামনের সুপারিবাগান। ক্যাডেট কলেজে যেমন মার্চপাস্টের জন্য ফল ইন করতাম, মনে হলো সুপারিগাছগুলো সব সটান ফল ইন করে দাঁড়িয়ে আছে যেন।

নানি আমাকে মাগুর মাছের ঝোল খাওয়ালেন। লেবু চিপে জাউ খাওয়ালেন। গ্রাম্য ডাক্তার আমাকে দিলেন অষুধ।

আর নানা আমাকে শোনালেন ‘পালা জ্বরের ইতিকথা’। নানা বললেন, বহুকাল আগে কহোর সরকার নামে এক লেখক এই নামে একটা বই লিখেছিলেন।

গল্পটা এরকম ­- এক কুলীন ব্রাহ্মণের বউকে এক চন্ডাল অপহরণ করে এবং তাকে বিয়ে করে। চন্ডালের ঔরসে সেই ব্রাহ্মণের বউয়ের দুটো ছেলে হয়। একদিন চন্ডাল মারা যায়। ছেলেদুটো বালক বয়সে ঘটনাক্রমে তাদের জন্মবৃত্তান্ত জানতে পারে। তারা নিজেদের ব্রাহ্মণ পরিচয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য মাকে ত্যাগ করে চলে যায় ভিনদেশে। ব্রাহ্মণের বউ তখন আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে। এভাবে দিন গড়ায়। বহু বছর পর সেই ব্রাহ্মণের বউ এক বাড়িতে ভিক্ষা করতে গেলে সেই লোক ভিখারিণীকে তার দাসী করে রাখে। বাড়িতে থাকত সেই লোক আর তার ভাই। দুই ভাই মিলে একসময় এই ভিখারিণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। তারপর একদিন ঘটনাচক্রে আবিষ্কৃত হয় যে, এই দুই ভাই আসলে সেই ভিখারিণী তথা সেই ব্রাহ্মণের বউয়ের হারিয়ে যাওয়া সেই দুই সন্তান। এমন অঘটনে মা, সন্তান উভয়েই প্রচন্ড অনুতপ্ত হয়। মা এবং দুই ছেলে তখন যায় ধর্মরাজের কাছে প্রায়শ্চিত্ত করতে। ধর্মরাজ আদেশ দেন, এখন থেকে প্রথম ছেলে তেহা জ্বর হয়ে মানুষকে কষ্ট দেবে, তেহার জ্বর হচ্ছে সেই জ্বর যা প্রতি দুদিন অন্তর তৃতীয় দিন মানুষকে আক্রান্ত করবে, দ্বিতীয় ছেলে একাজ্বর হয়ে মানুষকে কষ্ট দেবে, যে-জ্বর আসে একদিন অন্তর অন্তর আর মা দেবে রাহাজ্বর, যে-জ্বর আসবে প্রতিদিন। ধর্মরাজ এও বলেন যে, জ্বর আসার পর কেউ যদি এই দুই পুত্র এবং মায়ের কাহিনির আদ্যোপান্ত কাউকে শোনায়, তাহলে তার জ্বর ভালো হয়ে যাবে।

নানা বললেন, নানু ভাই তোমাকে গল্পটা বললাম দুইটা ব্যাপার লক্ষ করার জন্য। এক হচ্ছে, খেয়াল করো গল্পটার সঙ্গে ইডিপাসের গল্পের একটা ভীষণরকম মিল আছে। লেখক কি ইডিপাসের গল্প থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন? নাকি পৃথিবীর নানা অঞ্চলের লোককাহিনির ভেতর ইডিপাস জাতীয় কোনো গল্প প্রচলিত ছিল? এটা নিয়ে ভেবে দেখো।

আর দ্বিতীয় যে-ব্যাপারটা তোমাকে লক্ষ করতে বলব, সেটা জ্বর বিষয়ে। গল্পের নাম পালাজ্বরের ইতিকথা। এখানে জ্বর বিষয়টা গল্পের একটা প্রধান চরিত্র। ব্যাপার হচ্ছে একসময় এ-অঞ্চলের মানুষের কাছে জ্বর তো এক বিভীষিকার ব্যাপার ছিল। কতরকম জ্বর, ম্যালেরিয়া জ্বর, কালা জ্বর, যক্ষ্মার জ্বর, নিউমোনিয়া জ্বর। কোনোটা তিন দিন অন্তর আসে, কোনোটা দুদিন অন্তর, কোনোটা প্রতিদিন। জ্বর একটা আতঙ্ক আর ঘৃণার ব্যাপার ছিল তখন সবার কাছে। এ-গল্পে জ্বরকে কুকর্মকারী চরিত্র হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। গল্প দিয়ে জ্বরকে মোকাবিলা করার একটা চেষ্টা এখানে আছে। রোগ নিরাময়ের একধরনের ম্যাজিক চিকিৎসা।

নানা হাসতে হাসতে বলেন, তোমার মনে হয় রাহাজ্বর হয়েছে নানুভাই।

আমি খুব দ্রুত সেরে উঠি। যদিও জ্বরের নেশায় বুঁদ হয়ে ওই সুপারিবাগান আর আরো দূরে সরিষাকান্দির মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত দেখতে দারুণ লাগছিল আমার। আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে নানা বললেন, চলো নানুভাই মাদলদিয়া হাটে যাই। সেখানে সম্রাট মকবুলের মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল চালানো দেখব।

আমি আর নানা হেঁটে রওনা দিই মাদলদিয়া হাটের দিকে। কাছাকাছি পৌঁছে শুনলাম হাটের এক প্রান্তে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে – ‘ভাইসব আসুন আর কিছুক্ষণ পরই শুরু হবে সম্রাট মকবুলের দুর্ধর্ষ প্রদর্শনী মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল চালনা।’

আমি এবং নানা সম্রাট মকবুলের প্রদর্শনীর কাছে গিয়ে দুটি টিকিট কিনি। কাঠ দিয়ে তৈরি একটা কূপ তৈরি করা হয়েছে। মাটির নিচে না, মাটি থেকে উপরে উঠে গেছে সেই কূপ। কূপের শেষ মাথায় উঁচুতে, কূপের কিনার ঘিরে রয়েছে বৃত্তাকার মঞ্চ। দর্শকরা সিঁড়ি বেয়ে সেই মঞ্চে উঠে সম্রাট মকবুলের প্রদর্শনী দেখবেন। সম্রাট মকবুল একটা মোটরসাইকেলে চড়ে এই কূপে চক্রাকারে ঘুরবেন। মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে একবার তিনি কূপের উপরে উঠবেন, একবার নিচে নামবেন। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। মোটরসাইকেল একেবারে শূন্যে ভেসে থাকার মতো। যে-কোনো সময় উল্টে পড়ে যেতে পারেন, মৃত্যু হতে পারে তার। কূপের চারপাশে বহু মানুষের ভিড়। বেশ একটা উত্তেজনা। সম্রাট মকবুলের মোটরসাইকেলটা স্টার্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। মোটরসাইকেলে কোনো সাইলেন্সার নেই। ফলে বিকট শব্দে মাইকে সেই মোটরসাইকেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাইলেন্সারবিহীন মোটরসাইকেলের গগনবিদারী আওয়াজ আবহ আরো খানিকটা নাটকীয় করে তুলেছে।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে মৃত্যুকূপের ওপরের মঞ্চে উঠি। আরো অনেক দর্শকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা মৃত্যুকূপের নিচে তাকাই। নিচে সম্রাট মকবুলের মোটরসাইকেলটা স্টার্ট দিয়ে রাখা। তাতে বিপুল শব্দ। মাইকে ঘোষণা হতে থাকে – আর কিছুক্ষণ পরই সম্রাট মকবুল তার দুর্ধর্ষ যাত্রা শুরু করবেন। কিছুক্ষণ পর সম্রাট মকবুল মোটরসাইকেলের পাশে আসেন। তার গায়ে জরি চুমকি লাগানো একটা পোশাক, সম্রাট ধাঁচের। তিনি সবাইকে হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানান। হাততালি দিয়ে ওঠেন সবাই। সম্রাট মোটরসাইকেলে ওঠেন, গিয়ারে বারকয়েক চাপ দেন। মোটরসাইকেল ভোঁ-ভোঁ করে ওঠে। এরপর একপর্যায়ে একসেলেটরে চাপ দেন তিনি। ছুটে চলে তার মোটরসাইকেল। তিনি কূপের দেয়াল বেয়ে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠতে থাকেন। রুদ্ধশ্বাসে দেখে দর্শকরা। এক পর্যায়ে দুহাত ছেড়ে মোটরসাইকেল চালান তিনি। মোটরসাইকেল মাটির সমান্তরালে ঘুরতে থাকে। দর্শকরা তুমুল করতালি দেয়। যে-ইনারশিয়াতে মোটরসাইকেল ঘুরছে, স্টার্ট বন্ধ না হয়ে গেলে পদার্থবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী সেটা পড়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। ফলে যতটা প্রচার করা হয়েছে ঝুঁকি আসলে ততটা নেই। তবু একটা ঝুঁকির আবহ তৈরিতে তারা সফল হয়েছে নিঃসন্দেহে। আমি দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখি। মুখ হাঁ করে তারা দেখছেন।

লক্ষ করি, আমার নানা বেশ একাগ্রতার সঙ্গে সম্রাটের মোটরসাইকেল চালনা দেখছেন। তিনি উপভোগ করছেন। তাঁর চোখেমুখে একটা বালক ভাব। এই মোটরসাইকেলকে ঘিরে যে একটা উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যে কৃত্রিম জন্ম-মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা এই মাদলদিয়া, সরিষাকান্দি এলাকায় বিরল। নানু  কি এই উত্তেজনার ভেতর কিছুক্ষণ নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে তাঁর বিগত জীবনের কোনো আবহে ফিরে যাওয়ার আনন্দ পাচ্ছেন? সম্রাট মকবুল নিরাপদে তাঁর মৃত্যুকূপ যাত্রা সমাপ্ত করে সবাইকে রুমাল নাড়িয়ে বিদায় জানান। দর্শকরা আবার হাততালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে কূপের মঞ্চ থেকে নামেন। আমরাও নেমে আসি। মাইকে সম্রাটের পরবর্তী শো-র ঘোষণা হতে থাকে।

আমি নানাকে জিজ্ঞাসা করি – নানু এ-লোক সম্রাট কেন? কোন সাম্রাজ্যের সম্রাট সে?

নানা হাসেন, বলেন, নামের সঙ্গে সম্রাট থাকলে কেমন একটা বেশ, যাকে বলে ‘অরা’ তৈরি হয় না? গ্রামের লোকের কাছে তাকে লার্জার দেন লাইফ মনে হয়। একটা অন্য গ্রহের মানুষ মনে হয়। পারফরমারের কাজই তো এই। আসলে লোকটা তো দরিদ্রই হবে। কতই আর ইনকাম তার। তবু মোটরসাইকেলে চড়ে নিজেকে সম্রাট ভেবে যে-তৃপ্তিটা সে পায়, সেটাও বা কম কী?

এসব বলতে বলতে আমরা মাদলদিয়া বাজার থেকে সরিষাকান্দির ফিরতি পথে রওনা দিই। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি আর নানা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। নানা চিন্তার এক বন্দর থেকে নোঙর তুলে প্রায়শই অন্য বন্দরের দিকে পাল ওড়াতে ভালোবাসতেন।

নানা হঠাৎ বলেন, তোমার দরবেশের কথা মনে আছে?

আমি – কোন দরবেশ?

নানা বলেন,  ওই যে আমাদের গ্রামের সরকারপাড়ার দরবেশ।

আমার মনে পড়ে। সরকারপাড়ার এই চরিত্রের কথা আমি জানি। তাঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছে আমার। নানার কাছেই জানতে পারি, একদিন ঘুম থেকে উঠে সরদারপাড়ার ফজলুর রহমান দেখতে পান যে, তাঁর চুলে জট দেখা দিয়েছে। এটা আল্লার কুদরত হিসেবে বিবেচিত হয়। চুলের এই স্বতঃস্ফূর্ত, আকস্মিক জট এই বার্তা নিয়ে আসে যে, আল্লাহ তাঁকে  বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। ফজলু চুল কাটা বন্ধ করে দেন এবং বছর ঘুরতেই তিনি জটাধারী চুলের অধিকারী হয়ে পড়েন। জ্যামাইকার রাস্তাফারিয়াদের যেমন চুল থাকে। যেমন ছিল গায়ক বব মার্লির। সেই থেকে সবাই ফজলুকে ডাকে দরবেশ। দরবেশ নামের সঙ্গে মানানসই একটা দাড়িও হয় তাঁর। তবে পোশাকে তিনি থাকেন ব্যতিক্রমী। দরবেশ বরাবর জিন্স এবং ফতুয়া পরেন।

জটা দেখা দেওয়ার পর থেকে খুব কম কথা বলেন দরবেশ। কেবল তাঁর ভেতর থেকে নির্দেশ এলেই তিনি কথা বলেন। একবার তিনি মেম্বার মফিজ সরকারকে বললেন, এক মাসের ভেতর মফিজ সরকার যেন গ্রামের বাইরে না যান; কিন্তু মফিজ সরকার পরের সপ্তাহে ঢাকা রওনা দেন। মফিজ সরকার যেদিন যাত্রা করবেন সেদিন ভোরবেলা দরবেশ তাঁর বাড়ি গিয়ে আবার তাঁকে ঢাকায় যেতে নিষেধ করেন। বলেন, ভেতর থেকে এমন নির্দেশই পেয়েছেন তিনি। মফিজ সরকার বলে, ‘হামি এই বিসমিল্লাহ কয়া ভিউত পা থুলাম, হামার কিচ্চু হবি না।’ কিন্তু সেবার বাসে ঢাকার পথে রওনা দিয়ে সিরাজগঞ্জের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মফিজ সরকার।

এই ঘটনায় পর স্বভাবতই তাঁর দরবেশত্বের সুনাম যারপরনাই বিস্তার লাভ করে। গায়েবি উৎস থেকে প্রাপ্ত তাঁর নির্দেশ শোনার জন্য উৎসুক শ্রোতার সংখ্যা বাড়ে। সে-শ্রোতারা সরিষাকান্দি, মাদলদিয়া ছাড়িয়ে ঢাকাতেও বিস্তৃত।

কিন্তু আমার নানার বক্তব্য – ‘বুঝলে নানুভাই, ও-বেটা আসলে একটা বদমাশ।’ তবে দরবেশকে বদমাশ ভাবলেও এ নিয়ে নানার বিশেষ উচ্চবাচ্য করবার উপায় ছিল না। কারণ দরবেশের ভক্তকুলের ভেতর আমার নানিও একজন।

আমার সরিষাকান্দি ভ্রমণের কোনো এক পর্বে একবার নানি দরবেশকে দাওয়াত করেন খাওয়াতে। সেবারই দরবেশকে দেখি আমি। লম্বা দাড়ি, জটাধারী চুল, জিন্সের প্যান্ট আর সবুজ একটা ফতুয়া। মাদুরে বসে গভীর মনোযোগের সঙ্গে নানির রান্না করা ভাত-তরকারি খান দরবেশ। এবার ইলিশ মাছ না, নানি রান্না করেছেন বাইম মাছের চ্চচরি। নানা দরবেশকে এড়িয়ে চলেন। দরবেশ বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই নানা চলে গেছেন ঘরের বাইরে। খাওয়া শেষে নানি আমাকে দরবেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। নানি বলেন, ‘হামার বড় লাতি, ক্যাডেট কলজত পড়ে। একনা দোয়া কর‌্যা দেন।’

দরবেশ আমার দিকে অর্ধনিমীলিত চোখে তাকান। আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। তার দোয়া নেবার কোনো আগ্রহ আমার নেই। চোখ বুজে থেকে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন – কোন ক্যাডেট কলেজে?

বলি, মির্জাপুর।

দরবেশ – তোমাগো অ্যাডজুটেন্ট কি ক্যাপ্টেন না মেজর র‌্যাঙ্কের।

আমি উত্তর দিই।

দরবেশ নীরব থাকেন কিছুক্ষণ। তার চোখ বন্ধ।

একপর্যায়ে বলেন,  আকাশে একটা রংধনু, তুমি তার ওপর হাঁইটা যাইতাছ, এমন স্বপ্ন দেখছ কোনোদিন?

আমি বলি, না।

দরবেশ – দেখবা। যেদিন দেখবা, যেখানেই থাকো তাঁর এক সপ্তাহের মইধ্যে সরিষাকান্দি আইসা আমার সঙ্গে দেখা করবা। এর পরের কথা আমি তখন তোমারে বলব।

এই রহস্যময় সংলাপের পর দরবেশ মাদুর থেকে উঠে নানির কাছ থেকে বিদায় নেন। যাওয়ার আগে নানিকে বলেন, আপনার উত্তর দিকের পাঁচিলের পেয়ারাগাছটা কাইটা ফেলবেন কালকের মধ্যে।

নানি কাঠুরে ডাকিয়ে পেয়ারাগাছটা কেটে ফেলেন পরদিনই। নানার কোনো আপত্তি এখানে ধোপে টেকে না। আমি এখনো অবশ্য রংধনুর ওপর হেঁটে যাওয়া স্বপ্নটা দেখিনি। সময় ফুরিয়ে যায়নি। অপেক্ষায় আছি স্বপ্নটা দেখবার।

সম্রাট মকবুলের মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল চালানো দেখে ফেরার পথে নানা বলেন, বুঝলে নানুভাই সেই বদমাশটা তো একটা কান্ড করেছে।

আমি কৌতূহলী হই।

নানা আমাকে দরবেশের সাম্প্রতিক কীর্তির কথা জানান। সন্ধ্যা নেমে গেছে। হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি নানার কাছ থেকে দরবেশের সাম্প্রতিক কাহিনি শুনি।

নানা বলেন, মাদলদিয়ার কোনো এক লোক মারফত ঢাকার উত্তরা নিবাসী এক ইঞ্জিনিয়ার মুরিদ হয়েছেন দরবেশের। মাঝে মাঝে তিনি এই গ্রামের সরকারপাড়ায় আসেন দরবেশের সঙ্গে দেখা করতে, তাঁর কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে যেতে। গত মাসে এসেছিলেন সেই ইঞ্জিনিয়ার। দরবেশ তাঁকে জানিয়েছেন – তিনি ভেতর থেকে নির্দেশ পেয়েছেন যে, ইঞ্জিনিয়ারের মেয়েকে আগামী পরশুদিন সুর্যাস্তের আগেই বিয়ে দিতে হবে তাঁর আরেক মুরিদ সরকারপাড়ার সোবহানের সঙ্গে। সোবহান ছোটখাটো গৃহস্থ, পরহেজগার যুবক।

দরবেশের এই ভেতর থেকে নির্দেশ পাওয়ার ব্যাপারটা ভয়ংকর। এই নির্দেশ পালন তাঁর ভক্তের জন্য প্রশ্নাতীত একটা কর্তব্য। ফলে সেদিনই উত্তরা নিবাসী সেই ইঞ্জিনিয়ার মুরিদ ছুটে যান টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। তাঁর মেয়ে পড়ে ভারতেশ্বরী হোমসে। সে-রাতেই তিনি তাকে ছাড়িয়ে আনেন ভারতেশ্বরী হোমসের হোস্টেল থেকে। হোমসের প্রধান শিক্ষিকার বাধা, তাঁর মেয়ের অবিরাম কান্না কিছুই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না ইঞ্জিনিয়ারকে। হোমস থেকে মেয়েকে উত্তরা নিয়ে আসেন তিনি। রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে মেয়েকে নিয়ে সোজা আসেন বগুড়ার সরিষাকান্দিতে। ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী, মেয়ের মায়ের কোনো আপত্তিও ধোপে টেনে না। নির্ঘুম, কান্নায় ফোঁপাতে-থাকা মেয়েকে নিয়ে তিনি হাজির হন দরবেশের কাছে। তখনো সূর্যাস্তের অনেকটুকু সময় বাকি। একজন কাজি ডেকে দরবেশ সোবহানের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারের মেয়েকে বিয়ে দেন সূর্যাস্তের আগেই। দরবেশ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন।

নানা আমাকে বলেন, বুঝলে নানুভাই, মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেছি আমি। কী বলবো তোমাকে, অপরূপ সুন্দরী, প্যারাগন অব বিউটি। মেয়েটার বিয়ে হওয়ার এই পুরো কাহিনিটা ওর কাছ থেকেই শুনেছি আমি। ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েরা প্রতি বছর বিজয় দিবসে একটা চমৎকার সিনক্রোনাইজড ফিজিক্যাল ডিসপ্লে করে, টিভিতে দেখেছ নিশ্চয়ই। এই মেয়েটা ছিল সেই ডিসপ্লে টিমের মেইন ইনস্ট্রাক্টর। এমন একটা মেয়েকে এক রাতের ভেতর ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে গবেট সোবহানের সঙ্গে।  মেয়েটাকে বলা হয়েছে, বোরকা ছাড়া তার ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। বুঝে দেখো অবস্থাটা। আর এই বদমাশটার মুরিদ হয়েছে তোমার নানি। কাকে কী বলব বলো? সোবহানও দরবেশের মুরিদ বলে মেয়েটাকে মাঝে মাঝে পাঠায় তোমার নানির কাছে।

ভারতেশ্বরী হোমস বলাতে আমি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। আমাদের মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের খুব কাজেই এই হোমস। আমাদের বড় আপসোস ছিল,  নারী-বর্জিত খাকি পোশাক পরা বালকদের এই ক্যাডেট কলেজের মরুভূমির এত কাছে একঝাঁক বালিকার মরূদ্যান ওই ভারতেশ্বরী হোমস অথচ আমাদের পরস্পরের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমি ক্যাডেট কলেজে থাকতে সুযোগ ঘটেছিল একবার। ক্যাডেট কলেজের কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একবার বিশেষ আয়োজনে ভারতেশ্বরী হোমসের দুজন মেয়ে এসেছিল নাচতে।  সেই দুই বালিকার জন্য ক্যাডেট কলেজের চত্বর জুড়ে আমাদের সে কী উত্তেজনা, কৌতূহল সেদিন। কলেজের নিয়মমাফিক রাত দশটায় লাইটস অফ। অন্ধকার বিছানায় শুয়ে আমাদের সবার চোখের নিচে সেই মেয়ে দুজনের লাল ঘাগড়া, আর কানে তাদের ঘুঙুরের শব্দ। সেবার আমার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম কারণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইবার সুবাদে মেয়ে দুজনকে গ্রিন রুমে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার, কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। ফলে এই মেয়ে দুজনের চুলের দৈর্ঘ্য, ঠোঁটের গঠন, স্তনের মাপ বিষয়ে সবার যে বিপুল গবেষণা, তার তথ্য সরবরাহের নির্ভরযোগ্য সূত্র ছিলাম আমি।

ভারতেশ্বরীর সিনক্রোনাইজড ডিসপ্লে করা একটা মেয়ের জীবন কাছের এই সরকারপাড়ার কোনো এক অন্তঃপুরে সমাধিস্থ হয়েছে জেনে মনে একটা গোপন কষ্ট জাগে। এরই মধ্যে মা আমাকে ঢাকায় ফিরে আসার তাগাদা পাঠায়। আমি যাওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিতে গেলেই বাদ সাধেন নানি – ‘এখনই যাওয়া হবার লয়। জ্বর থেকে উঠেছি কেবল, সুতরাং আমি এখনও যাওয়ার জন্য প্রস্ত্তত না, এই হচ্ছে নানির মত। অথচ আমি তখন রীতিমতো সুস্থ। নানাকে বললাম, নানু থাকলাম তো অনেকদিন, এবার গুডবাই বলি?

নানা বলেন,  নানু, দেয়ার ইজ নাথিং গুড ইন গুডবাই? তারপর আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ :

 

ক্ষমা করো,  ধৈর্য ধরো

হউক সুন্দরতর

বিদায়ের ক্ষণ।

মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়,

নহে বিচ্ছেদের ভয়

শুধু সমাপন

শুধু সুখ হতে স্মৃতি

শুধু ব্যথা হতে গীতি

তরী হতে তীর –

খেলা হতে খেলা শ্রান্তি

বাসনা হইতে শান্তি

নভ হতে নীড়।

 

আমি থেকে যাই আরো সপ্তাহখানেক। এর মধ্যেই ঘটে যায়  সেই কাকতালীয় ব্যাপার। একদিন কী একটা কাজে নানা বগুড়ায় যান। সেদিন বিকেলেই দেখি বোরকাপরা একজন মেয়ে এসেছে নানির সঙ্গে দেখা করতে। জানতে পারি, এই সেই সোবহানের স্ত্রী, ভারতেশ্বরীর সেই মেয়ে। চকিতে একটা উদ্বেলতা জাগে আমার মনে। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা এই অদেখা নারীর গল্প আমি জানি ভেবে পুলকিত হয়ে বসে থাকি উঠানে। মেয়েটা ভেতরের ঘরে নানির সঙ্গে আলাপ করে। আমি বাইরের উঠানে গভীর কৌতূহল নিয়ে বসে থাকি। ভাবি, যদি চকিতে কোনোভাবে একবার দেখে ফেলবার সুযোগ হয় অভিনব এই অন্তঃপুরবাসিনীকে!

সুযোগ সত্যি ঘটে যায়। কথা ছিল বগুড়া শহর থেকে ফিরে নানা মেয়েটাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবেন। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়, নানা আসেন না। মেয়েটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে বাড়ি ফিরতে। এরপর নানি আমাকেই দায়িত্ব দেন মেয়েটাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। নানি আমাকে বলেন, ‘যা তো চ্যাংরা, অক এনা ঘরত থুয়া আয়। উই তোক ঘাটা দেখে দিবি।’

নানিকে কী করে বলি যে, মেয়েটা আমাকে পথ চিনিয়ে না দিলেও আমি ওকে পৌঁছে দেব। কিছুক্ষণ পর নানির ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কালো কাপড়ে ঢাকা সেই নারীমূর্তি। আমি বোরকা পরিহিতা মেয়েটাকে নিয়ে গ্রামের পথে নামি। মেয়েটার দেহ, মুখ সবকিছুই বোরকার আড়ালে অদৃশ্য। আমি দেখতে পাই চাঁদের আলোয় গ্রামের ধুলো-মাখা পথে গাছের পাতার  কারুকাজ। আমার পাশে কোনো অশরীরী জীবের মতো সেই বোরকাধারী মেয়ে ধীর পায়ে হাঁটে। আমরা কোনো কথা বলি না। আমি শুধু তার হাতের চুড়ির শব্দ শুনতে পাই।

হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে বলি, আপনি তো ভারতেশ্বরী হোমসে পড়তেন?

বোরকার আড়াল থেকে মৃদু স্বরে মেয়েটা বলে, হ্যাঁ।

আমি বলি, আমি পড়তাম মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে।

মেয়েটা  খুব নিচু স্বরে বলে – তাই?

কিছুক্ষণ চুপ থাকে সে, তারপর বলে, আমি একবার গিয়েছিলাম মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে।

আমি – আচ্ছা? আমি কলেজে থাকতে আপনাদের ওখান থেকে দুজন মেয়ে এসে নেচেছিল আমাদের অনুষ্ঠানে।

এবার মেয়েটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায় আমার দিকে। এক টানে সরিয়ে ফেলে তার মুখ ঢেকে রাখা নেকাব। আমি চাঁদের আলোয় দেখতে পাই, প্যারাগন অব বিউটি। মেয়েটা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি আর আমার বন্ধু তনুশ্রীই গিয়েছিলাম আপনাদের কলেজে। আমরা দুজনই নেচেছিলাম, ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো।’

আমি ভালো করে তাকাই তার দিকে, বলি – হ্যাঁ তাই তো, আপনিই তো। আপনিই সোহেলী? আমার মনে পড়ে যায় তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ নিয়েই তো গবেষণা করেছি আমরা।

মেয়েটাও আমার মুখের দিকে দেখে ভালো করে তাকায়, উত্তেজনায় বলে, হ্যাঁ আমিই সোহেলী। আর আপনিই তো মান্না দের গান গেয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে, তাই না?

আমি বলি – হ্যাঁ, গেয়েছিলাম তো।

কোইন্সিডেন্সের নাটকীয়তায় আমি খানিকটা বিমূঢ়। রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত। বাড়িঘরগুলো বেশ দূরে দূরে। জ্যোৎস্নায় আমরা দুজন দাঁড়িয়ে গ্রামের পথে। মেয়েটা বলে – সেদিন যে- গানটা গেয়েছিলেন, কাইন্ডলি দু লাইন গাইবেন?

আমি ইতস্তত করি। বলি, ঠিক মনে পড়ছে না তো কোনটা গেয়েছিলাম।  মেয়েটা চোখেমুখে হাসি ফুটিয়ে বলে – ওই যে  ওই গানটা আমি বলি, যদি কাগজে লিখো নাম?

মেয়েটা – না, না,

আমি – আমি সাগরের বেলা তুমি দুরন্ত ঢেউ?

মেয়েটা – না, ওটাও না।

আমি –  পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন, ফিরে আর আসবে কি কখনো?

মেয়েটা – না, না। দাঁড়ান আমি সুরটা একটু ধরিয়ে দিই

আপনাকে। তার পরপর মেয়েটা গুন গুন করে একটা সুর ভাঁজে। আমি বলি – ও মনে পড়েছে, ‘কতদূর আর নিয়ে যাবে বলো’

মেয়েটার চোখ জ্বলে ওঠে – হ্যাঁ ওই গানটা। একটু গান না প্লিজ। বাড়িঘর সব অনেক দূরে, কেউ শুনবে না এখানে।

দুপাশে সরিষাকান্দির ধানক্ষেত আর চরাচরব্যাপী জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে অর্ধেক শরীর বোরকায় ঢাকা এক প্যারাগন অব বিউটিকে আমি শোনাই  মান্না দে –

কতদূর আর নিয়ে যাবে বলো, কোথায় পথের প্রান্ত

ঠিকানা হারানো চরণের গতি হয়নি কো তবু ক্লান্ত …

পেছনের পথে উঠেছে ধুলি

সমুখে অন্ধকার।