মান অথবা মন নিয়ন্ত্রণ

মাসউদুল হক

চিত্রনায়িকা মৌনতার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার খবরটি আমরা কেউ পাই অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে। কেউ পাই ব্রেকিং নিউজ অ্যালার্ট সার্ভিসের মাধ্যমে। কেউবা পাই সিএনজি চালকের কাছ থেকে। কাজের ব্যস্ততার জন্য আমরা যারা ওই তিনটি মাধ্যমের সংস্পর্শে আসতে পারিনি তারা সংবাদটি পাই চায়ের দোকানদার বকর মামার কাছ থেকে।

প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা বকর মামার চায়ের দোকানে আড্ডা দিই। আশপাশে আরো কিছু দোকান থাকলেও আমরা আড্ডাস্থল হিসেবে বকর মামার দোকানকেই বেছে নিয়েছি।

যদিও বকর মামার দোকানের চা খুব আহামরি কিছু নয়; কিন্তু অন্য দোকানের মতো ফুটপাতে বসিয়ে রাখা বেঞ্চে, চলন্ত মানুষের কনুই এবং শপিং ব্যাগের গুঁতো খেয়ে, আমাদের সেখানে চা খেতে হয় না। বকর মামার দোকানটি তিন হাত বাই চার হাত পরিসরের ছোট্ট দোকান। ওই ছোট্ট জায়গার মধ্যেই কোনো আর্কিটেক্ট বা ইন্টেরিয়র ডেকোরেটরের সাহায্য ছাড়াই দোকানের অসংখ্য মালপত্রের পাশাপাশি দুটি বেঞ্চও ঢুকিয়ে ফেলেছেন বকর মামা। এক কোনায় জ্বলন্ত উনুনে টগবগ করে চায়ের পানি ফুটতে থাকে। আরেক কোনায় চলতে থাকে আমাদের আড্ডা। সারাদিন অফিস করে কিংবা চাকরির সন্ধান করে ক্লান্ত হয়ে শেষ বিকেলে আমরা ওই দোকানে সমবেত হই। ঢাকা শহরে প্রাণ খুলে আড্ডা দেওয়ার এবং সঙ্গে সীমিত পয়সায় চা-নাশতা করার জায়গার বড় অভাব। এ-কারণে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের যুবকদের ওই ধরনের দোকান ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার উপায়ও নেই। তাছাড়া বকর মামার দোকানটিতে একটা ঘরোয়া আবহ বিরাজ করে। আমরা কেউ পা তুলে, কেউ বেঞ্চে ঊরু ঝুলিয়ে, দোকানের প্লাস্টার ওঠা দেয়ালে নিজের মতো করে হেলান দিয়ে বসি। একটা বেনসন সিগারেট নিয়ে তাতে       চার-পাঁচজন মিলে টান দিই আর খাঁটি গরুর দুধের চায়ে চুমুক দিতে থাকি। এ-সময়ে আমরা মুখের লাঙল চালিয়ে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সারা পৃথিবী চষে ফেলি। বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে সানি লিওন পর্যন্ত কোনো কিছুই আমাদের আড্ডার বিষয় থেকে বাদ পড়ে না।

এসব আড্ডায় বকর মামা সাধারণত অংশ নেন না। তিনি অধিকাংশ সময় চায়ের কাপে চামচ নাড়ানো কিংবা গামছায় ভেজা হাত মুছে সিগারেট সরবরাহে ব্যস্ত থাকেন। তবে সেদিন কী কারণে যেন আমাদের দেখে উৎসুক হয়ে জানতে চান, ‘মোনতা কি আছে, না গেছে গা।’

তার এ-প্রশ্নে আমরা কিছুটা বিভ্রান্ত হই। আমরা যারা চিত্রনায়িকা মৌনতার আত্মহত্যা প্রচেষ্টার বিষয়ে পূর্বে অবগত হতে পারিনি এবং চিত্রনায়িকা মৌনতা যে গ্রাসরুট লেভেলের লোকের কাছে ‘মোনতা’ হিসেবে পরিচিত তা জানতে পারিনি তারা একটু বিস্ময় নিয়ে বকর মামার দিকে তাকাই। আমাদের নীরবতা এবং অজ্ঞতার বিষয়টি বকর মামাকে বোধকরি পীড়া দেয়। চায়ের কাপে চামচের টুং-টাং শব্দ বন্ধ করে সে আমাদের মুখোমুখি হয়। সে যেন বলতে চায়, ‘বারাক ওবামা, কারিনা আর অ্যাঞ্জেলিনা জোলিরে নিয়া ফাল পাড়ো আর ঘরের নায়িকা মৌনতারে চিনো না?’ এ-সময় আমাদের বন্ধু ইস্রাফিল দ্রুত বিষয়টি বুঝে নিতে সমর্থ হয়; চিন্তিত এবং বিক্ষিপ্ত বকর মামাকে আশ্বস্ত করতে জানায় যে, ‘চিত্রনায়িকা মৌনতার অবস্থা উন্নতির দিকে।’ তার এই উত্তরে আমাদের সম্বিত ফেরে। আমরা অজ্ঞরা আরো বিশদ বর্ণনা শুনতে নড়েচড়ে বসি।

চিত্রনায়ক সালমান শাহ গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের তারকাজগতের তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ আত্মহত্যা করেনি। আমাদের মেমোরিকে ফাঁকি দিয়ে     দু-একজন যদি আত্মহত্যা করেও থাকে তবে তা জানার বা মনে রাখার সুযোগ আমরা পাইনি। তবে হলিউডে এবং বলিউডে পরপর কয়েকজন তারকা আত্মহত্যা করার পর ঢালিউডে এমন একটি ঘটনা ঘটার সময় এসেছে বলে আমরা কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে ভাবছিলাম। কারণ আমরা পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, পরচর্চা, পরনিন্দা, ঈর্ষাকাতরতা এবং অজুহাত ছাড়া আমাদের নিজস্বতা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ডিশ অ্যান্টেনা এবং ইন্টারনেটের আগমনের পর থেকে আমরা অনেকদিন হলো আমাদের চিন্তা-চেতনা প্রচারমাধ্যমের কাছে বন্ধক দিয়ে বসে আছি। সে-পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ধারণা করি যে, বিদেশের তারকারা আত্মহত্যা করলে আমাদের তারকারাও তা করতে প্রলুব্ধ হবে। কারণ আমরা অনেকদিন ধরে দেখে আসছি যে, আমাদের চিত্রনাট্যকাররা নতুন চিত্রনাট্য লেখেন না, সুরকাররা গানে সুর করেন না, কোরিওগ্রাফাররা নাচের নতুন মুদ্রা সৃষ্টি করেন না। তারা শুধু অনুকরণ করেন। অনুকরণ করতে করতে আমাদের সৃষ্টিশীলতা হাজার বছরের পুরনো ফসিল হয়ে গেছে। এসব কারণে আমাদের বৈকালিক আড্ডায় বিদেশি চলচ্চিত্রের তারকাদের অনুকরণে আমাদের ঢালিউডে এক বা একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটার সম্ভাবনার কথা ইতোপূর্বে একাধিকবার আলোচিতও হয়েছে। তবে হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপনের কারণে আমাদের মনোজগতে তা তেমন গভীর রেখাপাত করতে পারেনি। এবার চিত্রনায়িকা মৌনতার আত্মহত্যা প্রচেষ্টার কারণে আমাদের স্মৃতিশক্তি পুনরায় তৎপর হয়ে ওঠে।

স্বামীকে জীবিত রেখে স্ত্রী আত্মহত্যা করলে তা আর আত্মহত্যা থাকে না। পত্রিকার সুবাদে সেই স্বামী হয়ে যায় ‘পাষন্ড স্বামী’। আর কদাচিৎ যদি স্বামী আত্মহত্যা করে, তবে তিনি হয়ে যান ‘পরকীয়া প্রেমের বলি’। মোবাইল ফোনে মৃত্যুর আগে-পরে যে-কয়টা কল আসা-যাওয়া করে তাদের মধ্য থেকে যুবক বয়সী একটাকে প্রেমিক বানিয়ে আমরা আত্মহত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে চিহ্নিত করি এবং রিমান্ডে নেওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু চিত্রনায়িকা মৌনতার স্বামী না থাকায় এবং পরিবারের সঙ্গে থাকাকালীন আত্মহত্যার চেষ্টা করায় আমরা, পুলিশ বা মিডিয়া নির্দিষ্ট কাউকে প্ররোচনাদানকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হই।

খবরের সূত্রে আমরা জানতে পারি, চিত্রনায়িকা মৌনতা দুপুরে বিশটি ঘুমের ওষুধ সেবন করেন। তার আশা ছিল বিশটি ওষুধে কাজ হবে। ঘুমুতে ঘুমুতে তিনি কবরে চলে যাবেন। কিন্তু রাত এগারোটার দিকে ঘুম ভাঙার পর তিনি আবিষ্কার করেন যে, তিনি একটি হিমশীতল ঘরে শুয়ে আছেন। ক্ষণিকের জন্য তার মনে হয়েছিল তিনি লাশকাটা ঘরে আছেন। কিন্তু পরক্ষণেই পাশের বাসা থেকে ‘তরকারিতে লবণ দেস নাই কেন’ চিৎকার, একটি কাচের বাসন ভাঙার ঝনঝন শব্দ এবং একটি শিশুর ক্রন্দনের পর্যায়ক্রমিক উপস্থিতিতে তার সম্বিত ফিরে আসে। বিশটি ওষুধ সেবনের পরও মৃত্যুর নাগাল না পেয়ে চিত্রনায়িকা ওষুধ কোম্পানি এবং আজরাইল উভয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গনের সুতীব্র বাসনা নিয়ে আরো বিশটি ঘুমের ওষুধ সেবন করে ফেলেন।

কিন্তু তারকারা একা জীবনযাপন করেন না বা করতে পারেন না। তাদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে হাজারো মানুষ। আগের দিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত নায়িকার মোবাইল ফোন বন্ধ পেয়ে নির্মিতব্য ছবি ‘চোখের জলের হয় না কোনো রং’-এর প্রোডাকশন ম্যানেজার আবদুস সোবহান চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে খুব ভোরে তার বাসায় উপস্থিত হয়েছিলেন। তার কাছে অত্যন্ত বিশ্বস্তসূত্রের খবর ছিল যে, চিত্রনায়িকা মৌনতা তাদের শিডিউল ফাঁসিয়ে দিয়ে অন্য এক ছবির ডাবিংয়ে চলে যেতে পারেন। অন্য ছবির ডাবিংয়ে গমন রহিত করতে চিত্র-পরিচালকের নির্দেশে তিনি ফজরের আজান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রনায়িকার বাসায় চলে যান এবং বাসায় এসে জানতে পারেন, ‘ম্যাডাম রেস্টে আছেন।’ নায়িকাদের নানা কারণে রেস্ট লাগে। তাই বলে দুদিনব্যাপী রেস্টের খবর শুনে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তার ধারণা এটি একটি ভাঁওতাবাজি। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ভাওয়াল সাফারি পার্কে তিনদিন ধরে শুটিং স্পট সাজানো হয়েছে। নায়িকার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনের জন্য ত্রিশজন এক্সট্রাকে দুদিন ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে – এমন পরিস্থিতিতে এসব ভাঁওতাবাজি মেনে নেওয়া দুষ্কর। যেহেতু নায়িকার পেমেন্ট ক্লিয়ার এবং নায়িকার সঙ্গে আলাপ করে শুটিংয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে নায়িকার এই স্বেচ্ছাচারিতা পরিচালক-প্রযোজক মেনে নিতে রাজি হননি। তাদের নির্দেশনায় আবদুস সোবহান প্রাথমিকভাবে নায়িকার স্বজনদের নায়িকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতে বারবার আবেদন জানান; কিন্তু তারা কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে হিন্দি ও জি-বাংলা দেখায় মত্ত থাকায় কোনটি বাস্তব ঘটনা এবং কোনটি টেলিভিশনের সিরিয়ালের ঘটনা তা  পৃথকভাবে নিরূপণ করতে ব্যর্থ হন। শেষে উপায়ান্তর না দেখে এবং নায়িকার পরিবারের সদস্যদের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো বাধা না পেয়ে প্রোডাকশন ম্যানেজার আবদুস সোবহান নায়িকার রুমের দরজায় সজোরে লাথি মারলে এবং ডেভেলপাররা কমদামি চায়নিজ ছিটকিনি লাগানোর কারণে দরজাটি সহজে ফাঁক হয়ে যায়। আবদুস সোবহান বিছানায় অচেতন অবস্থায় চিত্রনায়িকা মৌনতাকে পড়ে থাকতে দেখেন। এ-সময় আবদুস সোবহান সামগ্রিক ঘটনা পরিচালককে জানালে, পরিচালক মুখে ‘পানির ছিটা’ মেরে, চিত্রনায়িকাকে কোলে তুলে – শুটিং স্পটে নিয়ে যেতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু আবদুস সোবহান এ-কাজে সচেষ্ট হওয়ার আগেই নায়িকার ছোট বোন টেবিলের ওপর ঘুমের ওষুধের চারটি খালি পাতা দেখে তেলাপোকা দেখার আতঙ্ক নিয়ে চিৎকার করে উঠলে আবদুস সোবহানের সম্বিত ফিরে আসে। তিনি নায়িকার হাত-পায়ের শীতলতা অনুভব করেন এবং বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে হার্টবিটের সন্ধান করেন এবং সেখানে মৃদু স্পন্দন শোনার পর নায়িকা মৌনতাকে চ্যাংদোলা করে নিকটস্থ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তাররা তার পেট ধৌতকরণের পর নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য আইসিইউতে রেখে দিয়েছেন।

পেশাগত জীবনে আমরা কাজের চাপে অস্থির থাকলেও    এ-ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা যেভাবেই হোক কিছুটা সময় বের করে নিই। এবং এ-ধরনের ঘটনার পেছনে পর্দার অন্তরালের ঘটনা অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এমনিতে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে যে-কোনো অঘটন ঘটলে আমরা এবং মিডিয়া একসঙ্গে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়েও দ্রুত অপরাধী শনাক্ত করতে সমর্থ হই। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চেয়ে খানিকটা বেশি। তবে আমরা শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মতো অপরাধী শনাক্ত করে জাতির বিবেকের কাছে সমর্পণ করে ক্ষান্ত হই না। ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীকে হাতের নাগালে পেলে শাস্তিও প্রদান করে থাকি। রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার বাইরে বাংলাদেশের পাবলিক পরিচালিত দ্রুত বিচার আদালত         যে-কোনো প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা তো বটেই; সামরিক আদালতের চেয়েও কঠোর এবং নির্মম। অধিকাংশ সময় বাংলাদেশের পাবলিক পরিচালিত দ্রুত বিচার আদালতে মৃত্যুই হয় প্রথম এবং একমাত্র সাজা। আমরা বিগত দিনে আদালতের কোনো কোনো বিচার নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াকে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে আস্থাহীনতার কথা প্রকাশ করতে দেখেছি। কিন্তু তাদেরকেই আবার পাবলিক পরিচালিত দ্রুত বিচার আদালতের মৃত্যুকে ‘গণপিটুনি’ বলে অভিহিত করে তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী দশ-বারোজন লোককে এক ধরনের ইনডেমনিটি প্রদান করতে দেখেছি। ফলে দিন দিন আমরা সবার ওপর আস্থা হারিয়ে একক এবং দলগতভাবে প্রাইভেট ডিটেক্টিভ হয়ে উঠেছি। আমরা আমাদের এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সব অভিজ্ঞতা এক করে পর্দার অন্তরালের ঘটনা উদ্ঘাটনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে থাকি।

এমনিতে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে, ‘পাখি জামা’ না কিনতে পেরে এবং ‘পাখি জামা’ কিনে দিতে না পারার মতো ছোট-বড় নানাবিধ কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিনই এক-দুজন আত্মহত্যা করে। গ্রামাঞ্চলে এখনো কিছু গাছপালা থাকায় গাছের ডালে ঝুলে আত্মহত্যা করার ট্রেন্ডটা চালু আছে। শহরের মানুষ গাছপালা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এ-কাজটি সিলিং ফ্যান ব্যবহার করে সমাধান করে আসছিল। ইদানীং বৈদ্যুতিক পাখা যথেষ্ট মজবুত না হওয়ায় এবং হাউজিং কোম্পানির নবনির্মিত ফ্ল্যাটগুলোর সিলিং যথেষ্ট উঁচু না হওয়ায় নগর-মানুষের আত্মহত্যার জন্য ঘুমের ওষুধের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে বলে আমরা একমত হয়েছি অনেক আগেই। কিন্তু একজন মানুষ তো আর হুট করে ঘুমের বড়ি খায় না? তার পেছনে বেশকিছু কারণ থাকে। সে-কারণগুলো জানতে আমরা ব্যাপক উৎসাহবোধ করতে থাকি। তবে বাংলাদেশে প্রতিবছর একশজনে কতজন আত্মহত্যা করে কিংবা বিগত দশ বছরে জিডিপি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতা কি বেড়েছে, না কমেছে – সে-বিষয়ে পত্রিকা মারফত কোনো তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপিত না হওয়ায় আমরা আমজনতা তো বটেই, সুশীল সমাজও নায়িকার আত্মহত্যার পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করতে পারে না। যদি নায়িকা বিবাহিত হতো এবং স্বামীগৃহে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যার চেষ্টা চালাত তবে আমরা তার স্বামী, ননদ, দেবর এবং অবশ্যই শাশুড়িকে সরাসরি দায়ী করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু চিত্রনায়িকা ছিলেন তার নিজ পরিবারের সঙ্গে। এমতাবস্থায় সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।

আমরা সাতদিন মেয়াদের ইন্টারনেটের মিনি প্যাক কিন্তু হ্যাভি ব্রাউজিং প্যাকেজ কিনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকি আর বের হই। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনে সমর্থ হই না। এবং দুদিনের মাথায় আমরা জানতে পারি, নায়িকার আত্মহত্যার পেছনের কাহিনি উদ্ঘাটনে আমরা সফল না হলেও নায়িকার আত্মীয়-স্বজন হাসপাতালের ডাক্তারদের কোনো কারণ ছাড়াই নায়িকাকে দিনের পর দিন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রেখে বিল তোলার যে-চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সেই ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনে সফল হয়েছে। এবং হঠাৎ অতি আপনজন হয়ে নাজেল হওয়া ডাক্তারদের ‘রোগীর যদি কিছু হয় – আমাদের দায়ী করতে পারবেন না’; ‘অবস্থা কিন্তু এখনো ক্রিটিক্যাল’ ইত্যাদি ভয়ভীতির মধ্যেও তারা সাহস করে রোগীকে আইসিইউ থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। এ-খবরটি পেতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগে না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা, যারা মূলত ব্রেকিং নিউজ সরবরাহের সঙ্গে জড়িত, তারা দুপুর নাগাদ উত্তরবঙ্গের দু-একটি জেলায় টেম্পো এবং নসিমনের মুখোমুখি সংঘর্ষের সংবাদ ছাড়া অন্য কোনো বড় সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে ‘চিত্রনায়িকা মৌনতা এখন আশঙ্কামুক্ত। তাকে আইসিইউ থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে সরিয়ে আনা হয়েছে’ শীর্ষক ব্রেকিং নিউজ পরিবেশন করে। এতে করে আমাদের পর্দার অন্তরালের কাহিনি উদ্ঘাটনের উৎসাহে ভাটা পড়ে। আমরা সাধারণত সদ্যমৃত বা মৃত্যুর আশঙ্কাযুক্ত মানুষদের নিয়ে গবেষণা করতে ভালোবাসি। যেহেতু চিত্রনায়িকা মৌনতাকে আশঙ্কামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেহেতু আমরা আচমকাই এ-বিষয় নিয়ে আলোচনায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। কিন্তু পরদিন একটি প্রিন্ট মিডিয়ায় চিত্রনায়িকা মৌনতার ছবিসহ বিশাল নিউজ আমাদের মনোজগতে নতুন করে ঝড় তোলে। চিত্রনায়িকা মৌনতার নাভি বের করা ছবির ওপরে শিরোনাম দেখি ‘ওষুধের নামে আমরা কী খাচ্ছি?’

ওষুধ সংক্রান্ত খবরে আমরা ইতোপূর্বে শিরোনামের নিচে টেবিলে ছড়ানো কতগুলো খোলা রঙিন ক্যাপসুল এবং পাতায় মোড়া কয়েকটি ওষুধ এবং কমপক্ষে একটি সুই-সমেত সিরিঞ্জ এবং একটি স্যালাইনের ছবি থাকতে দেখেছি। কিন্তু এই প্রথম পত্রিকাটি পাঠকদের খবর পাঠে প্রলুব্ধ করতে ওষুধ সংক্রান্ত আলোচনায়ও নায়িকার ছবি ব্যবহার করে বসে। আমাদের, যাদের তিনবেলা খাওয়া-দাওয়ারই নিশ্চয়তা নেই এবং তিনবেলা খেলেও তার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত একুশশো ক্যালোরি কিনা তা নিয়ে সর্বদা সন্দেহগ্রস্ত থাকি, তাদের – ওষুধের নামে কী খাচ্ছি – তা জানা এক ধরনের বিলাসিতা বলে গণ্য হয়।  কিন্তু নায়িকার নাভি বের করা ছবির কল্যাণে খবরের ভেতর প্রবেশ করতে বাধ্য হই এবং আবিষ্কার করি নায়িকার উদাহরণ টেনে পত্রিকাটি দাবি করেছে, নায়িকা যে-ধরনের ঘুমের ওষুধ সেবন করেছেন, তাতে মৃত্যুর জন্য ১০টি বড়িই যথেষ্ট; কিন্তু নায়িকা চল্লিশটি ওষুধ সেবনের পরও মৃত্যুবরণ না করায় ওষুধের গুণাগুণ ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তারা দাবি করেন, নায়িকা মৌনতার বেঁচে থাকাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের ওষুধের মান নিয়ন্ত্রিত হয় না।

যেহেতু আমরা সবাই-ই কমবেশি নানাবিধ ওষুধ সেবন  করি; কিন্তু জীবনে কখনো গ্যাসের সমস্যা, খোস-পাঁচড়া,  দাউদ-অ্যাকজিমা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি জীবনঘনিষ্ঠ শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তিলাভ করি না, সেহেতু আমরা পত্রিকার অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সত্য বলে নিশ্চিত হই এবং একজন আরেকজনকে রিপোর্টটি দেখিয়ে বলি, ‘কেমন দ্যাশে জন্ম নিলাম, ওষুধের মধ্যে পর্যন্ত দুই নম্বরী।’ বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো যে দিনের পর দিন আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে সে-বিষয়ে আমরা আগে সন্দেহগ্রস্ত ছিলাম; এবার আমরা নিশ্চিত হই। এবং যথারীতি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে ওষুধ প্রস্ত্ততকারকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের এই ঝাঁপিয়ে পড়াটি অরাজনৈতিক ঝাঁপিয়ে পড়া হলেও পরবর্তীকালে তা একটি রাজনৈতিক রূপ নেয়। কারণ ওষুধ কোম্পানির মালিকদের মধ্যে একজন মন্ত্রী ও দুজন সরকারদলীয় এমপি থাকায় সরকারবিরোধী ফেসবুক ইউজাররা এ-কাজটি সরকারি ছত্রছায়ায় হয় বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। এ-অবস্থায় সরকারি দলের লোকজনও বসে থাকে না। তারা বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুজন সাবেক মন্ত্রী ও দশজন সাবেক এবং বর্তমান সাংসদকে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয় – যারা ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি বা প্রকারান্তরে জড়িত। ফলে দ্বিধাবিভক্তির কারণে প্রতিবারের মতো এবারো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে জনমত তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্ট্যাটাস প্রদান চলতেই থাকে।

এ-দুইয়ের আক্রমণের সঙ্গে যোগ হয় হারবাল ওষুধ কোম্পানি। বাংলাদেশের মানুষের অ্যালোপ্যাথি ওষুধের ওপর এরূপ সন্দেহের সুযোগ নিয়ে আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্ত্ততকারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রচারণা বৃদ্ধি করে। তারা মানুষ জীবনেও দেখেনি এমন কিছু পাহাড়ি গাছ-গাছড়ার ছবি দিয়ে লোকাল টিভি চ্যানেল ও যেসব জাতীয় চ্যানেল প্রচারের জন্য যথেষ্ট বিজ্ঞাপন বিশেষত মোবাইল টেলিফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন পায় না, সেসব চ্যানেলে প্রচারণা চালাতে থাকে। এতদিন চিকন স্বাস্থ্য এবং দ্রুত বীর্যপাত – হারবাল কোম্পানির দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষের মূল শারীরিক সমস্যা বলে চিহ্নিত হয়ে আসছিল। এবং এ-দুটি রোগ নিরাময়ে তারা রাত-দিন গবেষণা করে যাচ্ছিল। কিন্তু মানুষের অবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তারা এখন বাংলাদেশের মানুষকে পার্শবপ্রতিক্রিয়াহীন ঘুম পাড়ানোর বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে। এ-ধরনের প্রচারণা তেমন কোনো কাজে আসবে না বলে বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা ওষুধ কোম্পানিকে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু নায়িকা মৌনতা যে-কোম্পানির ওষুধ সেবন করেছিলেন সে-কোম্পানির মাঠ জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, তাদের ওষুধ বিক্রি ব্যাপক হারে কমে গেছে এবং স্থানীয় চ্যানেলে প্রচারের কারণে পার্শবপ্রতিক্রিয়াহীন পাহাড়ি গাছ-গাছড়া থেকে তৈরি নানাবিধ ঘুমের ওষুধের বিক্রি বেড়ে গেছে।

এ প্রেক্ষাপটে অনন্যোপায় হয়ে ওষুধ কোম্পানিটি একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় একটি বিশাল বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে এবং বড় বড় হরফে লেখে, ‘একটি আকুল আবেদন।’

আমরা যারা সরকারি এবং সরকারি টাইপ প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যেখানে আসলে তেমন কোনো কাজ নেই, সময় পার করাই মূল কাজ, তারা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আকুল হয়ে জানানো আবেদনটি পাঠ করি এবং অবগত হই যে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাদের উৎপাদিত ব্রোমেজেপাম গ্রুপের অন্তর্গত ওষুধের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে, তার বাজার নষ্ট করার মানসে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রকৃত ঘটনা এই যে, নায়িকা মৌনতা একসঙ্গে চল্লিশটি ওষুধ সেবন করেননি। তিনি বিগত চল্লিশ দিন ধরে একটি একটি করে চল্লিশটি ওষুধ সেবন করে আসছিলেন। কিন্তু পরপর দুদিন শুটিংয়ের ব্যস্ততার কারণে ওষুধ খেতে পারেননি। ফলে তৃতীয় রাতে ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়া একসঙ্গে তিনটি ওষুধ সেবন করে ফেলেন। এবং ওষুধ আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় তার ঘুম দীর্ঘায়িত হয়েছে মাত্র। উপরোক্ত ওষুধ ৩০ মিলিগ্রাম একসঙ্গে খেলে ঘুম দীর্ঘায়িত হওয়া ছাড়া আর কোনো বিপত্তির সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু কিছু কিছু পত্রিকার সাংবাদিক বিষয়টি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে খালি পড়ে থাকা চারটি ওষুধের পাতাকে একই দিনে সেবন করা ওষুধ বলে প্রচারণা চালিয়েছেন,  যা সংবাদ পরিবেশনে সততা ও বস্ত্তনিষ্ঠতার মানদন্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ভবিষ্যতে এ-ধরনের মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন থেকে দূরে থাকার জন্য সবাইকে সতর্ক করার পাশাপাশি প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের একটা হালক হুমকিও প্রদান করা হয়। আমরা বিজ্ঞাপনের প্রথম অংশটুকু সিরিয়াসলি পাঠ করলেও ‘আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ কথাটি পাঠ করার সময় আমাদের মুখের কোণে কী কারণে যেন একটু হাসি ফুটে ওঠে।

আমরা বকর মামার দোকানে বিকেলের আড্ডায় গিয়ে ওই ওষুধ কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ আকবরভাইয়ের কাছে শুনি যে, পত্রিকায় প্রকাশিত আকুল আবেদনটি আকারে বিশাল হওয়ায় এবং ভাষাটি জটিল ও দুর্বোধ্য হওয়ায় সাধারণ মানুষ আবেদনটি পড়তে আগ্রহবোধ করেনি। উপরন্তু শিরোনামে ‘আকুলতা প্রকাশ’ বাংলাদেশের কনজিউমারের মনোজগতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের কনজিউমার আকুলতাকে সন্দেহের চোখে দেখে। ভাবে, ‘এত এত ট্যাকার মালিক আমার মতো লোকের কাছে আকুল আবেদন জানায় ক্যান? নিশ্চয়ই কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে।’

এসব ভাবনায় এবং টাকা খরচ করে কোনো ফল লাভ না করায় মালিকপক্ষ ম্যানেজমেন্টের ওপর প্রচন্ড খেপেছে। তারা তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছে, যাতে করে ওষুধের বিক্রি আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ম্যানেজমেন্ট বাজার ধরে রাখার চেষ্টার অংশ হিসেবে ডাক্তারদের জন্য নিজস্ব ঘুমের ওষুধের নাম ও ছবিসংবলিত একটি নতুন প্যাড ও একটি নতুন উন্নতমানের কলম প্রস্ত্তত করেছে। প্রমাণস্বরূপ আকবরভাই আমাদেরকেও বিনা পয়সায় সরবরাহযোগ্য একটি করে নতুন প্যাড ও কলম উপহার দেন। আমরা অতি যত্নের সঙ্গে সেসব কলম ও প্যাড পকেটে পুরতে পুরতে বলি, ‘ওষুধটা আসলে খারাপ না।’

আমাদের বন্ধু আকবরভাই সন্ধ্যানাগাদ চা খেয়ে, মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে ডাক্তারদের চেম্বারের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময় আমাদেরকে চোখ টিপে জানান, ‘সবে তো শুরু; আরো চমক আসতেছে।’

আমরা চমকটি কী বা কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে বসি। নতুন কলম এবং প্যাডের মতো আরো কিছু প্রাপ্তিযোগ আছে কিনা বা আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরো কোনো উপহার পেতে পারি কিনা সে-বিষয়ে জল্পনা-কল্পনায় লিপ্ত হই। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কলম এবং প্যাড ছাড়া আর কিছু না পেলেও জাতীয় পর্যায়ে ওষুধ কোম্পানিটিকে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির আওতায় মেয়েদের ভলিবল লীগ স্পন্সর করতে দেখি এবং বিদেশি একটি খেলার চ্যানেলে লাইভ খেলার ফাঁকে ফাঁকে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পাই।

সেখানে আমরা দেখি বিদেশি এক সাদা চামড়ার মডেলের ঘুম আসছে না। তিনি ঘুম না আসার দুঃখে মাঝরাতে নাইটি পরে সমুদ্রের পারে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। এমন সময় একটি মুখ আটকানো কাচের বোতল স্রোতের ধাক্কায় তার পায়ের কাছে চলে আসে। তিনি কৌতূহলবশত সেই বোতলের মুখ খুলে ফেলেন। আর তখনই বোতলের ভেতর থেকে একটি দৈত্য বের হয়ে আসে এবং দৈত্যটি বলে, ‘হুকুম করুন; আমার রানী। আপনার কী চাই?’

বিদেশি মডেল অত্যন্ত কাতর গলায় বলে, ‘আমাকে পৃথিবীর সেরা ঘুমের ওষুধ এনে দাও। আমি অনেকদিন ধরে প্রাণভরে ঘুমাই না।’

তার এ-কথায় দৈত্য হো-হো করে বিকট হাসি দিয়ে বাতাসে একবার হাত ঘোরায় এবং পরক্ষণে সে মুঠো খুললে আমরা দেখি, তার হাতে চিত্রনায়িকা মৌনতা যে-ওষুধটি খেয়ে মৃত্যুবরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সে-ওষুধটি রাখা। পরের দৃশ্যে আমরা সাদা চামড়ার মডেলকে গভীর ঘুমে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখি।

মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটি আমাদের পুরনো বিশ্বাস ভেঙে দেয়। কারণ বিজ্ঞাপনটি কোনো দেশি চ্যানেলে প্রচারিত হয়নি। দেশি চ্যানেলকে যেমন আমরা সন্দেহের চোখে দেখি, তেমনি দেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনকেও আমরা সন্দেহের চোখে দেখি। কিন্তু বিদেশি চ্যানেলে প্রচারের কারণে আমরা নতুন করে ওই ঘুমের ওষুধটির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি। সাদা চামড়ার এক সুন্দরী স্মার্ট মডেল যখন বাংলাদেশের তৈরি ঘুমের ওষুধ খায় তখন আমাদের খেতে আর কোনো বাধা থাকে না। আমরা আবার ওষুধের দোকানে ফেরত যাই এবং দলে দলে ঘুমের ওষুধটি কিনে খেতে থাকি। এখন আর ওষুধটি আমরা শুধু ঘুমের জন্য খাই না, ওষুধটি খাওয়া এখন আমাদের জীবনযাপনের স্টাইলে পরিণত হয়। আমরা ঘুম না এলে এবং ঘুম না আসার সম্ভাবনা দেখলে উভয় ক্ষেত্রে ওষুধটি সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।

(পরবর্তীকালে আমরা শুনতে পাই যে, ওই ওষুধ কোম্পানির সিইওকে অন্য একটি মোবাইল ফোন কোম্পানি উচ্চ বেতনে নিজের কোম্পানিতে নিয়োগ দিয়েছে। এবং আরো দুবছর পর আমরা শুনতে পাই যে, ঢাকার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় তার এমবিএর সিলেবাসে ওই ঘটনাটিকে একটি সফল মার্কেটিং কৌশল হিসেবে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে)। ৎ