মায়ের হাতের পিঠা

হাবিব রহমান

জসীম উদ্দীন স্মৃতিকথাসমগ্র
দে’জ পাবলিশিং
কলকাতা, ২০১২
৭৫০ টাকা

স্কুলে পড়াকালে দাদাভাই (রোকনুজ্জামান খান)-সম্পাদিত আমার প্রথম লেখা  নামে একটা বই হাতে এসেছিল। তাতে আমাদের দেশের তেরোজন লেখকের, যাঁরা শিশুসাহিত্যিকও ছিলেন, প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত প্রথম লেখা সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক স্মৃতি-বিবরণ ছিল। বইটি আমার কিশোরমনকে আবিষ্ট করেছিল। এর মধ্যে কবি জসীমউদ্দীনের লেখাটি মনে প্রায় গাঁথা হয়ে রয়েছে। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, আমারও জন্ম ও বেড়ে-ওঠা গ্রামে। আমার ধারণা অন্তত শৈশব-বাল্য-কৈশোর পর্যন্ত গ্রাম-জীবনের নানা কিছুর সঙ্গে সংলগ্ন না থাকলে সে-জীবন ও পরিপার্শ্ব নিয়ে রচিত সাহিত্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায় না। পুরাণকথা-রূপকথা-ছড়া ইত্যাদির ভাণ্ডার জসীমউদ্দীনের সেই অন্ধ দাদার আবিষ্ট-করা কথকতার বর্ণনা, অল্প বয়সে কবির মুখে মুখে গান রচনা ও গাওয়ার প্রয়াস, কবিগানের আসরে ছুটে যাওয়া, পাড়ার চাচা রহিমদ্দিনের সঙ্গে আত্মপ্রকাশের আকুলতায় নিজে সেধে কবির লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া – স্মৃতিতে মুদ্রিত এসব ঘটনা বহু বছর পর আবার পড়ার সুযোগ হলো পুলক চন্দের স¤পাদনায় কলকাতার দে’জ পাবলিশিং-প্রকাশিত জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথাসমগ্র গ্রন্থটি হাতে পেয়ে।
সাড়ে আটশো পৃষ্ঠার এ বিশাল গ্রন্থে রয়েছে জসীমউদ্দীনের জীবনকথা, যাঁদের দেখেছি, ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়, স্মৃতির পট, স্মরণের সরণী বাহি এই পাঁচটি বই আর সংযোজন অংশে সাতটি প্রকাশিত ও দুটি অপ্রকাশিত স্মৃতিনিবন্ধ। ‘জীবন-কথার দু’এক পাতা’ শীর্ষক রচনাটি মনে হয় একটা বড় পরিকল্পনার অসম্পূর্ণ অংশ। কবির কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে সম্পাদক এর সন্ধান পেয়েছিলেন। সংযোজনে আরো আছে আসমানীর কবিভাই ও কবিপতœীর লেখা আমার কবি শিরোনামের দুটি রচনা। আসমানীর কবিভাই প্রচলিত অর্থে ঠিক স্মৃতিকথা নয়, এর সব ঘটনা যে বাস্তবে হুবহু ঘটেছিল তা-ও নয়, তবে কিছু যে ঘটেছিল তাতে বোধকরি সন্দেহ করা চলে না। সম্পাদক জানিয়েছেন, প্রধানত স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা-নির্ভর এ-রচনাটি কল্পনার ভিয়েনে তৈরি একটি আশ্চর্য শিশুতোষ গ্রন্থ, … পাঠককে তার বিচিত্র আস্বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ‘সংযোজন’।’ সম্পাদকের এই কৈফিয়তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। সংযোজনের পরে আছে বহু শ্রমে প্রস্তুত সুদীর্ঘ প্রাসঙ্গিক তথ্য, ১৬৭ পৃষ্ঠাব্যাপী। সূচিপত্রে উল্লে¬খ না থাকলেও গ্রন্থশেষে প্রয়োজনীয় নির্ঘণ্ট রয়েছে। আর গোঁড়ায় আছে প্রকাশকের কথা, সম্পাদকের ভূমিকা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার। আর্ট পেপারে ছাপা জসীমউদ্দীনের মা-বাবা, কবির নিজের, স্ত্রী-কন্যা ও বৃদ্ধ বয়সের আসমানীসহ স্মৃতিকথা সংশ্লি¬ষ্ট মোট ৩১টি ফটোচিত্র গ্রন্থটিকে ভিন্ন একটি মাত্রা দিয়েছে।
১৯৬৪ সালে জীবনকথা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হওয়ার আগে সাপ্তাহিক চিত্রালী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সে-সময়ে অনেক পাঠক পত্রিকাদপ্তরে চিঠি লিখে নিজেদের আনন্দময় অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন। একজন পাঠক লিখেছিলেন, জসীমউদ্দীনের জীবনকথা পড়িতেছি না মায়ের হাতের পিঠা খাইতেছি।’ এ-তথ্য কবি নিজেই জানিয়েছেন। এই ‘পিঠা’র যথার্থ স্বাদ সৃষ্টি-আস্বাদন ভিন্ন অন্য কারো পক্ষে ভোক্তাকে জোগানো সম্ভব নয়। সে-চেষ্টায় যথাসম্ভব বিরত থেকে বর্তমান গ্রন্থটির পরিকল্পনা ও সম্পাদকের কৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করাই বরং বেশি দরকার। সম্পাদকের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার কারণ দেখি না যে-বিষয়ের বৈভব ও বিস্তার অর্থাৎ ‘সমাজের বহুমানিত পুরোধা পুরুষদের কর্মকাণ্ড  ও উজ্জ্বল কীর্তিগাথার পাশে জায়গা করে নিচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর হতদরিদ্র অকিঞ্চিৎকর নিম্নবর্গীয় জনের অন্তরঙ্গ উপাখ্যান।’ – বাংলা স্মৃতিকথা সাহিত্যে এমন দৃষ্টান্ত বোধকরি আর নেই। দ্বিতীয়ত, স্মৃতিবর্ণনায় জসীমউদ্দীনের কথকতার কুশলীভঙ্গি ও নিরাভরণ সহজ-সরল; কিন্তু স্বতঃসাবলীল গদ্য যে-কোনো স্তরের পাঠককে চু¤¦কের মতো আকর্ষণ করে। পুলক চন্দ এরই টানে এই দুঃসাধ্য – তাঁর ভাষায় ‘অবিশ্বাস্য’ – কাজে ব্রতী হয়েছেন। সেজন্য কষ্ট স্বীকার করে তিনি ঢাকা এসে কবিপুত্র জামাল আনোয়ারের সহযোগিতায় এ-গ্রন্থের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।
স্মৃতিকথাসমগ্র নিঃসন্দেহে একটি সুসম্পাদিত গ্রন্থ। সম্পাদকের ছোট কিন্তু সুলিখিত ভূমিকাটি প্রমাণ করে, তিনি আকর্ষণীয় এক গদ্যশৈলীর অধিকারী। তাঁর শ্রমশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে দীর্ঘপরিসর প্রাসঙ্গিক তথ্য অংশে। এখানে বহু ব্যক্তি ও বিষয়ের ওপর টীকা-টিপ্পনি লেখা হয়েছে। কিন্তু একটা মুশকিল ঘটেছে স্মৃতিকথায় যে, যে-বিষয়ে টীকা লেখা হয়েছে তা চিহ্নিত না করায় পাঠকালে সেটি চট করে ধরতে পারা সহজ নয়, অনেক ক্ষেত্রে বরং অসম্ভব। দৃষ্টান্ত দিলে সমস্যাটি অনুধাবন সহজ হবে। যেমন ‘সাধুকে দিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম’ – এই অংশের টীকা লেখা হয়েছে। কিন্তু পাঠক কী করে বুঝবেন যে, জসীমউদ্দীনকে  যে ‘সাধু’ বলা হচ্ছে, সম্পাদক তারও টীকা লিখেছেন। প্রাসঙ্গিক তথ্যে নির্দেশ করা হচ্ছে ১৪৮/৭, অর্থাৎ ১৪৮ পৃষ্ঠার সপ্তম পঙ্ক্তিতে এ-কথাটি আছে। আমাদের বিবেচনায় এই জটিল পদ্ধতিতে না গিয়ে সহজ উপায় অবল¤¦ন করলে ভালো হতো। গবেষকদের রেফারেন্স ব্যবহারের মতো ১, ২, ৩  ইত্যাদি সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করতে সম্পাদকের যদি আপত্তি থাকে, তাহলে প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি ও স্থান নাম বা অন্যান্য বিষয় বাঁকা বা মোটা হরফে চিহ্নিত করে ভূমিকায় সেটা উল্লে¬খ করে দিলে সবদিক থেকে সুবিধা হতো।
এবার একটা দুঃখের কথা বলি। এ-দুঃখ বাঙালি মুসলমানের দীর্ঘকালের। ভূমিকাংশে আল মাহমুদের নাম লেখা হয়েছে আল মামুদ। সম্পাদককে যাঁরা নানাভাবে সাহায্য করেছেন তাঁদের একজন সৈয়দ মুজতবা সিরাজ। এ-নাম আগে কখনো শুনিনি। একজনের কথা জানি, যিনি কিছুকাল আগে প্রয়াত হয়েছেন, তিনি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। সম্পাদক কি তাঁর কথাই বলেছেন? যদি তা হয় তাহলে তাঁর নামটি ওভাবে কেন? এই বিভ্রাট বা বিভ্রান্তি আরো কতকাল চলবে কে জানে!
মনের মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা পোষণ না করেও বলা বোধকরি অসংগত হবে না যে, জসীমউদ্দীনকে নিয়ে এ-ধরনের কাজ, বিশেষ করে তাঁর রচনাবলি প্রকাশের ব্যবস্থা বাংলাদেশ থেকেই অনেক আগে হওয়া প্রত্যাশিত ছিল। কলকাতার দে’জ পাবলিশিং কর্তৃপক্ষ পুলকচন্দের পরিশ্রমী সম্পাদনায় কবির সমগ্র স্মৃতিকথাকে যে দুই মলাটের মধ্যে এনে প্রকাশ করেছেন, সেজন্য তাঁরা বাংলাভাষী সকল পাঠকের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ পাবেন। গ্রন্থটির প্রকাশনার মান সবদিক থেকে এতখানি উন্নত যে, এটি চোখে দেখলেই হাতে পেতে ইচ্ছে করে।