মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের সাহিত্য

রফিকউল্লাহ খান

বাঙালি জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা বৈপ্লবিক যুগান্তরের সম্ভাবনায় তাৎপর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসন-বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনের অনিঃশেষ চেতনা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের গণজাগরণ ও বৈপ্লবিক চেতনার স্পর্শে এক অপরিমেয় সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে আমাদের সাহিত্যলোক। সেই উজ্জীবনী শক্তি একাত্তরের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়েও বহমান। সংগত কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমাদের জীবনে ও সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্মৃতি ও বিস্মৃতির দোলাচলে বাঙালি জাতিসত্তা যেরূপ বিভ্রান্তি ও সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, জাতীয় জীবনের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের সেই রেনেসাঁসীয় গতি ও শক্তির পুনঃপর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কেবল বর্তমান প্রজন্মের জন্যেই নয়, বিভ্রান্তিপ্রবণ সমাজমানসের জন্যও এই পর্যবেক্ষণের উপযোগিতা কম নয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে অপরিমেয় ত্যাগ, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সাফল্যের সূর্যোদয়ে গৌরবময়। ইতিহাসের যে গতিশীল ও দ্বন্দ্বময় ধারা পলাশীর বিপর্যয় (১৭৫৭), সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭), কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিভেদের রাজনীতি, পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৪৭-এর অসংগত রাজনৈতিক মীমাংসা, ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত,  ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জীবনে সেই ঐতিহাসিক নিয়মেই চরম পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সামূহিক অস্তিত্বের প্রশ্নে সমগ্র জাতি এক অভিন্ন বিন্দুতে মিলিত হয় এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে করতলগত করে। সুদীর্ঘকালের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নিপীড়নের ফলে জাতির সৃষ্টিশীল চেতনায় যে ক্ষোভ, প্রতিবাদ, রক্তক্ষরণ, সংগ্রামশীল জীবনদৃষ্টি এবং ভবিষ্যৎস্পর্শী কল্পনার জন্ম হয়েছিল, যুদ্ধের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা ও সাফল্যে তার গঠনমূলক রূপান্তরের পথ সুপ্রশস্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধোত্তরকালে বাংলাদেশের সামগ্রিক জীবনকাঠামোতে গুণগত পরিবর্তন ছিল প্রত্যাশিত, প্রয়োজনীয়; কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জাতীয় জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনের গতি অল্প কিছুকালের মধ্যেই হয়ে পড়ল অবরুদ্ধ, রক্তাক্ত। কেবল পরিমাণগত পার্থক্য ছাড়া পাক আমলের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কোনো গুণগত পরিবর্তন জাতীয় জীবনে ঘটেনি। স্বাধীনতা-উত্তর কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯৭৫-পরবর্তীকালে, জাতিশোষণ রূপ নিল শ্রেণিশোষণে, পরিবর্তিত কৌশলে সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রণ করল রাষ্ট্রযন্ত্র, স্তব্ধ করা হলো সত্যকণ্ঠ। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা জাতির চিন্তা-চেতনায়, মন ও মননে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল নিঃসন্দেহে।। বাঙালির প্রত্যাশার দিগন্ত হয়েছিল সুবিস্তৃত। কিন্তু যুদ্ধোত্তর কয়েক বছরের মধ্যেই জাতীয় চৈতন্যে প্রকাশ পেতে থাকল পরাজয়ক্লিষ্টতা। মনে হলো, ‘অতীত যেন বিদ্রূপ করছে; বর্তমান হয়ে উঠেছে পান্ডুর, নির্ভর-অযোগ্য। জাতিসত্তা পুনরায় নিক্ষিপ্ত হলো অতীত গর্ভে; বারুদ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হলো মূল্যবোধের স্তম্ভগুলি; গণতন্ত্র হলো সমরাস্ত্র-শাসিত; জাতিশোষণ রূপান্তরিত হলো শ্রেণিশোষণে; সহস্র কোটিপতির রসদ সরবরাহে আমাদের অস্তিত্বমূল শুকিয়ে গেল। রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হলো ছিন্নমূল সব ভাড়াটে কুশীলব; ছদ্মবেশের আড়ালে দেখা গেল তাদের অতীত কঙ্কাল।’ জাতীয় অস্তিত্বের এই বিবর্ণ পটভূমিতে বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল জীবনস্পর্শী চেতনালোক হয়েছে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। ফলে, স্থুল অর্থে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে সাহিত্যে বিভাগোত্তর কাল অপেক্ষা একটি নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে। সে-বিষয়টি হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু গভীরতর অর্থে, চেতনার পরিমাপে মুক্তিযুদ্ধ একটি ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক রূপ ও স্বরূপে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে অভিব্যক্ত হয়েছে।

দুই

উনিশশো একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন-সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে, এটা স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল। দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, স্বাধীন মানচিত্র, নিজস্ব পতাকা সর্বোপরি সমাজের গুণগত পরিবর্তনের সমূহ সম্ভাবনায় সংবেদনশীল কবিচৈতন্য স্বভাবতই নবতর কাব্যবস্ত্ত সন্ধানে তৎপর হবে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম, বাংলাদেশের কাব্যস্বভাবে সূচিত হয়েছে এক জটিল জঙ্গম, যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পূর্ববর্তী সময়-পরম্পরায় কবিগোষ্ঠীসমূহ কাব্যোপকরণের প্রশ্নে প্রায় অভিন্ন বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। একটা সামাজিক চরিত্রও বাংলাদেশের কবিতা এ-সময়ে অর্জন করে। ভাষা-আন্দোলনের অব্যবহিত পরে অনেকটা এইরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ব্যক্তিসত্তার নব্যবিকাশের সম্ভাবনায় অনেক কবিই সামাজিক বক্তব্য প্রকাশের প্রশ্নে ব্যক্তিরুচিকেই প্রাধান্য দিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনা, গণতন্ত্রায়ন ও শিল্পায়নের অবাধ বিকাশের সম্ভাবনায় নবগঠিত রাষ্ট্রসত্তায় ব্যক্তির আকাশচুম্বী স্বপ্ন একটা সামষ্টিক চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে ষাটের দশকের শেষার্ধে উদ্ভূত অনেক কবি এবং সমকালীন সামাজিক রাজনৈতিক জঙ্গমতার মধ্যে আত্মপ্রকাশকামী তরুণ কবিদের মধ্যে কখনো কখনো চেতনাগত ঐক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুদ্ধোত্তরকালের নবোদ্ভূত কবিদের রক্তিম জীবনাবেগ, সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় সীমাতিরিক্ত প্রত্যাশা ও অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতাবোধ, প্রেম ও নিসর্গভাবনায় প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা প্রভৃতি একটা সামাজিক রূপ লাভ করে। ষাটের দশকের অনেক কবি  স্ব-উদ্ভাবিত পরিণত আঙ্গিকে অভিন্ন কাব্যবস্ত্তকেই যেন প্রকাশ করলেন। ফলে তরুণ কবিদের স্বতন্ত্র কাব্যস্বর অনেকের কাছেই অনুক্ত থেকে গেল। এমনকি, পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং ষাটের দশকের অধিকাংশ কবিই নিজস্ব কাব্য-অবয়বে সমকালের সংরক্ত চেতনা ধারণ করলেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে আবির্ভূত বেশ কয়েকজন কবি এ-সময়ে আত্মপ্রকাশের তীব্রতায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির নির্বাধ আবেগজীবন উন্মোচনের ঐকান্তিকতায় এবং দেশপ্রেমের জনরঞ্জক কাব্যকলা সৃষ্টিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

 বাংলাদেশ ভূখন্ডে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত বিশ শতকের চল্লিশের দশকে। কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের আবেগ-জীবনের যে তীব্র আত্মপ্রকাশ তিরিশের দশকের বাংলা কবিতায় লক্ষ করি সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সমাজ-চৈতন্য ও ব্যক্তি-অস্তিত্বের পাশাপাশি কলোনিয়াল মধ্যবিত্তের ব্যর্থতাবোধ পালন করেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রূপান্তরহীন সমাজ-কাঠামোতে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ যে কতটা বেদনাদীর্ণ, নিঃসঙ্গ ও আত্মরতিপ্রবণ হতে পারে, তিরিশের দশকের অনেকের কবিতায় তা সুস্পষ্ট। ঐতিহ্য, পুরাণ, নিসর্গলোক প্রভৃতির মধ্যে তিরিশের কবিরা আত্মরোমন্থনের ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করেছিলেন। তবে বাংলা কবিতার ইতিহাসে দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়কে মানবীয় সংবেদনের এক চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের শিল্প-ভূখন্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এর কারণ ঔপনিবেশিক সমাজের মধ্যবিত্তের ব্যর্থতাবোধ, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক আত্মমুক্তির আকাঙ্ক্ষা এই সময়ের কবিতায় শতধারায় উৎসারিত হয়েছিল। জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী অভিন্ন সময়ের গর্ভ থেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পরুচির জন্ম দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার এই আয়োজন পরবর্তী কাব্যধারায় দূরসঞ্চারী ভূমিকা পালন করে। সময়ের বিবর্তনে এসব কবির কাব্যবস্ত্তর পরিবর্তন চল্লিশের দশকের সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনানির্ভর কবিতা নির্মাণের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে।

চল্লিশের দশকে বাংলাদেশ ভূখন্ডের যে নবতর অভিযাত্রার সূত্রপাত সেখানেও ব্যক্তির স্বাবলম্বী আত্মপ্রকাশের তীব্রতা মুখ্য হয়ে ওঠে। আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবি চেতনা ও সৃষ্টিতে নতুন কাব্যবস্ত্তর ধারক হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের সৃজন-মননের ভিত্তি প্রস্ত্তত হয়েছিল উপনিবেশিত মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায়। বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বাবলম্বী ও অহংবোধসম্পন্ন যে-কাব্যযাত্রার দিকনির্দেশনা নজরুল ইসলাম থেকে সূচিত হয়, বাংলাদেশ ভূখন্ডের কবিতায় অনিবার্যভাবেই তার অন্তরঙ্গ অঙ্গীকার সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু বোধ বোধি এবং শিল্পরীতি এক জিনিস নয়। নজরুলের অভিন্ন বোধকেই চল্লিশের কবিরা সময়োপযোগী কাব্যবস্ত্তর উপযোগী করতে সমর্থ হলেন। আহসান হাবীবের কবিতায় প্রাধান্য পেল সমাজের মাত্রা, আবুল হোসেনের কবিতায় ব্যক্তির মাত্রা, ফররুখ আহমদ রোমান্টিক ঐতিহ্যলোকে সন্ধান করলেন সমকালের উজ্জীবনমন্ত্র এবং সৈয়দ আলী আহসানও অনেকটা পুঁথি সাহিত্যের লোকায়ত অনুভূতিগুলোকে সমকালীন সমাজমানসের অনুকূলে বিন্যস্ত করলেন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালের দেশ বিভাগ এসব কবির মানসজগতে স্বাভাবিকভাবেই এক স্বপ্নময় প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের নয়া ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিপীড়ন, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা অতি দ্রুত মোহভঙ্গের কারণ হয়ে ওঠে। উনিশশো আটচল্লিশ সাল থেকে সূচিত ভাষা-আন্দোলন ও তার রক্তাক্ত পরিণতি বাংলাদেশের কবিতাকে বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারা থেকে স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। এভাবেই ভাষা-আন্দোলন বাংলাদেশের কবিতার স্বতন্ত্র, স্বাবলম্বী এবং অস্তিত্বময় পটভূমি প্রস্ত্তত করে দেয়।

১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন-সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়। সমাজসংস্থার সমান্তরালে কবিদের আবেগজীবনেও বড় ধরনের রূপান্তর সাধিত হয়। বিভিন্ন দশকের কবিদের সম্মিলিত পদচারণায় বাংলাদেশের কাব্যস্বভাবে সূচিত হয় এক জটিল জঙ্গম। যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পূর্ববর্তী বিভিন্ন দশকের কবিরা কাব্যোপকরণের প্রশ্নে প্রায় অভিন্ন বিন্দুতে এসে মিলিত হন। একটা সামাজিক চরিত্রও বাংলাদেশের কবিতা এ-সময়ে অর্জন করে। ভাষা-আন্দোলনের অব্যবহিত পরে অনেকটা এইরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ব্যক্তিসত্তার নব্যবিকাশের সম্ভাবনায় অনেক কবিই সামাজিক বক্তব্য প্রকাশের প্রশ্নে ব্যক্তিরুচিকেই প্রাধান্য দিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনা, গণতন্ত্রায়ন ও শিল্পায়নের অবাধ বিকাশের সম্ভাবনায় নবগঠিত রাষ্ট্রসত্তায় ব্যক্তির আকাশচুম্বী স্বপ্ন একটা সামষ্টিক চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে ষাটের দশকের শেষার্ধে উদ্ভূত অনেক কবি এবং সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক জঙ্গমতার মধ্যে আত্মপ্রকাশকামী তরুণ কবিদের মধ্যে কখনো কখনো চেতনাগত ঐক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞতা-উৎস অভিন্ন হলেও অভিজ্ঞান ও জীবনবোধ অনেক কবির আত্মপ্রকাশের স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করেছে। যুদ্ধোত্তরকালের নবোদ্ভূত কবিদের রক্তিম জীবনাবেগ, সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় সীমাতিরিক্ত প্রত্যাশা ও অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতাবোধ, প্রেম ও নিসর্গভাবনায় প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা প্রভৃতি একটা সামাজিক রূপ লাভ করে। ষাটের দশকের অনেক কবি স্ব-উদ্ভাবিত পরিণত আঙ্গিকে অভিন্ন কাব্যবস্ত্তকেই যেন প্রকাশ করলেন। পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং ষাটের দশকের অধিকাংশ কবিই নিজস্ব কাব্য-অবয়বে সমকালের সংরক্ত চেতনা ধারণ করলেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে আবির্ভূত বেশ কয়েকজন কবি এ-সময়ে আত্মপ্রকাশের তীব্রতায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির নির্বাধ আবেগজীবন উন্মোচনের ঐকান্তিকতায় এবং দেশপ্রেমের রক্তিম কাব্যকলা সৃষ্টিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টিতে সমর্থ হন।

কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের আবেগ-জীবনের যে তীব্র আত্মপ্রকাশ তিরিশের দশকের বাংলা কবিতায় লক্ষ করি, সেখানে প্রথম  বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সমাজ-চৈতন্য ও ব্যক্তি-অস্তিত্বের পাশাপাশি কলোনিয়াল মধ্যবিত্তের ব্যর্থতাবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রূপান্তরহীন সমাজ-কাঠামোতে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ যে কতটা বেদনাদীর্ণ, নিঃসঙ্গ ও আত্মরতিপ্রবণ হতে পারে, তিরিশের দশকের অনেকের কবিতায় তা সুস্পষ্ট। ঔপনিবেশিক সমাজের মধ্যবিত্তের ব্যর্থতাবোধ, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক আত্মমুক্তির আকাঙ্ক্ষা এই সময়ের কবিতায় শতধারায় উৎসারিত হয়েছিল। বিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে বাংলাদেশ ভূখন্ডের কবিদের যে নতুন অভিযাত্রা সূচিত হয়, সেখানে ব্যক্তির স্বাবলম্বী আত্মপ্রকাশের তীব্রতার সমান্তরালে সামাজিক দায়িত্বচেতনা ও অস্তিত্বের প্রশ্নে ইতিহাস-ঐতিহ্য মন্থন নতুন মাত্রা পেয়েছে। আহসান হাবীবের কবিতায় প্রাধান্য পেল সমাজের মাত্রা, আবুল হোসেনের কবিতায় ব্যক্তির মাত্রা, ফররুখ আহমদ রোমান্টিক ঐতিহ্যলোকে সন্ধান করলেন সমকালের উজ্জীবনমন্ত্র এবং সৈয়দ আলী আহসানও অনেকটা পুঁথিসাহিত্যের লোকায়ত অনুভূতিগুলোকে  সমকালীন সমাজমানসের অনুকূলে বিন্যস্ত করলেন। এবং সানাউল হক নিসর্গলোকের উদার পটভূমিতে চেতনাবিস্তৃত করে যেন দেশপ্রেমের দীক্ষা নিলেন। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ এই সব কবির মনোজগতে স্বাভাবিকভাবেই এক স্বপ্নময় প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের নয়া ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিপীড়ন, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা অতি দ্রুত মোহভঙ্গের কারণ হয়ে ওঠে। উনিশশো আটচল্লিশ সাল থেকে সূচিত ভাষা-আন্দোলন ও তার রক্তাক্ত পরিণতি বাংলাদেশের কবিতাকে বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারা থেকে স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। এবং বাংলাদেশের কবিতার জন্য স্বতন্ত্র, স্বাবলম্বী ও অস্তিত্বময় পটভূমি প্রস্ত্তত করে দেয়। 

মুক্তিযুদ্ধের পর চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিরা আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব কাব্যবস্ত্তর সন্ধান পেলেন। সৃজন-মননের যৌথ রাগে অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানকে তাঁরা নিজ নিজ বোধের মাত্রা অনুযায়ী রূপ দান করলেন। কিন্তু এতো বড় একটা সামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কাব্যস্বভাবের যতটা রূপান্তরের সম্ভাবনা জাগিয়েছিল, অল্পসংখ্যক কবি ছাড়া অধিকাংশই তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলেন। উল্লেখ্য, বাঙালির ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের যে তাৎপর্য, কেবল কাব্যবিষয়ের মধ্যে তাকে সীমায়িত করে দেখা ঠিক হবে না। জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তনে বস্ত্তজগৎ ও চেতনার বৈপ্লবিক রূপান্তরে কবিতার রূপ, রীতি, শব্দ অর্থাৎ সামগ্রিক প্যাটার্নেরই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন দেখেছি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কবিতা, ফরাসি বিপ্লবের সাহিত্য-শিল্প, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কিংবা রুশ বিপ্লবের কবিতা এবং বিপ্লবমন্থিত লাতিন আমেরিকার কবিতা। আমাদের কবিরা মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী চেতনার রূপান্তরিত রূপ কতটা ধারণ করতে পেরেছেন কবিতায়, তা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এ সময়ে কবিতাচর্চায় সক্রিয় আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান এবং সানাউল হকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ নতুন বোধের উৎসমুখ হয়ে উঠেছে। যেমন,

কোথাও পড়ে না চোখে বধ্যভূমি, অথচ প্রত্যহ

নিহতের সংখ্যা বাড়ে। কোথাও একটিও

লাশ কিংবা কবর পড়ে না চোখে, অথচ প্রত্যহ

শবাধার ব্যস্ত হয়ে হেঁটে যায় এবাড়ি ওবাড়ি।

(আহসান হাবীব)

অনেক শেখানো অনেক পড়ানো

বহু পুরুষের মর্চে ধরানো

ভাগ্যটার

ঝুঁটি ধরে নাড়া দেবার সময়

এসেছে এবার…

(আবুল হোসেন)

                  আমার মনে হয়

সমুদ্রের সামনে যুগযুগান্তের সাক্ষ্য বিদ্যমান –

মহাকালকে এখানে অনুধাবন করা যায় একটি

প্রার্থনার কাম্যে।

(সৈয়দ আলী আহসান)

                                    নক্ষত্রের আলো

মুক্তিসেনা চিতার শরীর, বাংলার ন’মাসী উন্মেষ

কখনো কাতর; অকাতর রক্তক্ষরা ধাবমান তরী,

অশোচ অাঁতুরঘরে সর্ষে ঝাঁঝ, রুদ্ধদ্বার ছায়াকালো :

সেখানে আমার জন্ম – কী আনন্দ স্বাধীন বাংলাদেশ।

(সানাউল হক)

উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুচ্ছ পরিণত অভিজ্ঞতা ও গভীরতর আবেগধর্মের সাক্ষ্যবাহী। কবিরা যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর ট্র্যাজিক জীবনচৈতন্যের অঙ্গীকার আশ্চর্য কুশলতায় উপস্থাপন করেছেন কবিতায়। পঞ্চাশের দশকে উদ্ভূত কবিদের চেতনা ও সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের আবেদন বহুমাত্রিক। অবশ্য যুদ্ধকালীন সক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তাও অনেকক্ষেত্রে কবিদের আবেগ-মননের চারিত্র্য নির্দেশ করেছে। শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, আজীজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দীন, জিয়া হায়দার, আবুবকর সিদ্দিক, শহীদ কাদরী প্রমুখ যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জীবনসমগ্রতার অঙ্গীকারকে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন। সংগত কারণেই জীবনচেতনা ও শিল্পাদর্শের প্রশ্নে এঁরা সকলেই স্বনির্মিত কাব্যাদর্শের বৃত্তেই আবর্তিত হয়েছেন।

ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে সিকদার আমিনুল হক, আসাদ চৌধুরী,  রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, মহাদেব সাহা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান প্রমুখ পঞ্চাশের দশকের কবিতার বিপ্রতীপ এক নতুন ধারা সৃষ্টি করলেন। পঞ্চাশের কবিরা যেখানে সমকালীন জীবনাবেগ রূপায়ণের প্রতি ঐকান্তিক এবং সমাজ ও সমষ্টি-সংলগ্ন, সেখানে ষাটের দশকে উদ্ভূত কবিরা সমকালের আন্দোলন-সংঘাত-রক্তপাত ও উজ্জীবনের পটভূমিতে বিস্ময়করভাবে বহির্জগৎ-বিমুখ, আত্মমগ্ন এবং পলায়নপর। মনে রাখা প্রয়োজন, ষাটের দশকের কবিদের সামনে স্ব^প্ন অথবা পলায়ন এ-দুয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। তাঁদের চারপাশে ছিল বন্দি-মুহূর্ত, অলঙ্ঘ্য দেয়াল, অবরুদ্ধ সমাজ এবং সমাজ-গঠনের জটিলতম রূপ। ফলে সময়ের নখরবিক্ষত এ-সকল কবি কবিতার পূর্বতন ধারা থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন জগৎ সৃষ্টিতে মনোযোগী হলেন। ষাটের দশকের উপান্তে নির্মলেন্দু গুণের সমাজ ও রাজনীতিমনস্কতা, আবুল হাসানের ব্যক্তির আত্মরতি, নৈঃসঙ্গ্য ও আত্মহননেচ্ছা এবং মোহাম্মদ নূরুল হুদার ঐতিহ্যমনস্কতা সমাজ-চৈতন্যের ত্রিমুখী  প্রান্তকে অভিন্ন বিন্দুতে সমন্বিত করার প্রবণতায় বিশিষ্ট। কিন্তু চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে গঠনমানে মধ্যবিত্তের আত্মপ্রতিষ্ঠার তীব্র প্রচেষ্টার প্রতিফলন ঘটেছিল। ফলে প্রত্যেক কবির মধ্যেই এক ধরনের স্বাবলম্বী কাব্যবস্ত্ত নির্মাণের প্রয়াস সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা জানি, প্রত্যেক কবিরই একটা নিজস্ব দর্শন থাকে, সামাজিক অঙ্গীকার থাকে। সময়ের বিবর্তন-পরম্পরার মধ্য দিয়ে তাঁর দর্শন ও সামাজিক অঙ্গীকারকে কবিতায় প্রকাশ করেন। ষাটের দশকের কবিরা তাঁদের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, কাব্যরুচি ও কাব্যভাষা নিয়ে পূর্বতন কবিদের দর্শন ও সামাজিক অঙ্গীকারকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, কাজী নজরুল ইসলামের সামাজিক অঙ্গীকার এবং জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি, নিসর্গলোক এবং বিমূর্ত প্রেমাকাঙ্ক্ষার স্পন্দন পঞ্চাশের দশকের কবিতার দুই প্রধান প্রবাহ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। এ সত্ত্বেও এ-সময়ের কবিরা স্ব-সমাজ ও জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কবিতার জন্য নতুন ভূমিতল ও অনিবার্য প্রকরণ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কবিদের সামাজিক দায়বদ্ধতা রাজনৈতিক সচেতনতায় রূপান্তরিত হয়েছিল। ষাটের দশকের কবিরা পূর্বসূরিদের প্রচলিত পথ ও পন্থাকে সচেতনভাবে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। শৃঙ্খলিত সমাজ, উত্তরণ সম্ভাবনাহীন জীবন ও জীবিকা, প্রেমের প্রথাগত ধ্যান-ধারণায় অবিশ্বাস এবং স্মৃতি ও স্বপ্নের জগতে বসবাসের নিরাপত্তাবোধ এসময়ের কবিকে নতুন বিষয় সন্ধানে উদ্যোগী করে তোলে। ষাটের দশকের শেষার্ধে অবির্ভূত বেশ কয়েকজন কবি স্বাধীনতাযুদ্ধের অব্যবহিত আগে ও পরে আত্মপ্রকাশের তীব্রতায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির আবেগ-জীবন উন্মোচনের ঐকান্তিকতায় এবং দেশপ্রেমের জনরঞ্জক কাব্যকলা সৃষ্টিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাঁদের মধ্যে আসাদ চৌধুরী, মাহমুদ আল জামান, হুমায়ুন কবির, হুমায়ুন আজাদ, সানাউল হক খান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, জাহিদুল হক, অসীম সাহা, সাজ্জাদ কাদির, মাহবুব সাদিক, হেলাল হাফিজ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব কবির মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী কবিতায় আমরা লক্ষ করব সমাজসত্তা ও ব্যক্তিসত্তার টানাপড়েন, আত্মকেন্দ্রিকতার আতিশয্য, ব্যক্তিত্ববর্জিত আত্মরতি ও আত্মকুন্ডলায়ন। তবে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এই বোধগুলো যুদ্ধের অব্যবহিত পরে গৌণ হয়ে পড়ে তাঁদের কবিতায়। এ-সময়ে তাঁদের যে স্বভাবধর্ম সুস্পষ্ট হতে থাকে, তা হলো  – সঙ্ঘচেতনা ও সংগ্রামের প্রশ্নে সমষ্টিলগ্ন মানসিকতা, নাগরিক অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে দ্বিধা এবং প্রায়শই স্মৃতি, নস্টালজিয়া, নিসর্গ ও গ্রামজীবনের প্রতি আকর্ষণ। এই সব বহুমুখী বোধের আলোড়ন এ-সময়ে দু-একজন ছাড়া সকলকেই একটা উৎকেন্দ্রিক কাব্যস্বভাবে চিহ্নিত করে। বরং রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ এবং আবুল হাসান যুদ্ধের অব্যবহিত পরে সমাজ, রাজনীতি এবং ব্যক্তিস্বভাবের বহুমুখী সত্যকে যেভাবে কবিতায় রূপদান করলেন, মুক্তিযুদ্ধোত্তর সংরক্ত চেতনা ও জীবনাবেগের জঙ্গমতায় তার ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। এমনকি চল্লিশের দশকের আহসান হাবীব, পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক এবং শহীদ কাদরীও যুদ্ধোত্তরকালে কবিতার ভাব ও রূপের অনিবার্য রূপান্তর সম্পর্কে সচেতন হলেন। সংগত কারণেই পূর্বসূরিদের পরিণত, প্রাজ্ঞ বোধের রূপান্তর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কাব্যচেতনার ভূমিতলকে যে-পরিপুষ্টতা দান করলো, যুদ্ধোত্তর পর্বের নতুন কবিদের স্বাবলম্ব কাব্যযাত্রার স্বীকৃতির ক্ষেত্র তাতে বহুলাংশে বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু এ-সময়ের অধিকাংশ তরুণ কবিই যুদ্ধের সংরক্ত বাস্তব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, ধাতব অস্ত্রের ইতিবাচক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন, প্রেম ও সংগ্রামের দ্বৈরথকে অভিন্ন চৈতন্যের মর্মমূলে স্থাপন করতে সমর্থ ছিলেন। অথচ এ-সময়ের অনেকেই একটি সত্য অনুধাবনে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন, তা হলো – কবিতার যুগান্তরের মানদন্ড যতটা বিষয়নির্ভর তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকরণগত। যুদ্ধোত্তর চেতনার জঙ্গমতা ও বহুমাত্রিকতার রূপায়ণে কবিতার Paradigm-এর যে পরিবর্তন বাঞ্ছিত ছিল, অসংখ্য মৌলিক উচ্চারণে বিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কোনো কবিই তাকে পুরোপুরি স্পর্শ করতে ব্যর্থ হলেন, যা অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছিলেন রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ এবং আবুল হাসান। তবু আমাদের মনে রাখতে হবে, একটা  যুদ্ধবিধ্বস্ত, সংগ্রামক্লান্ত এবং স্বজন হারানোর মর্মন্তুদ বেদনার অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির বিদীর্ণ মনোভূমি নিয়েও এই সব কবি সংবেদনময় আত্মপ্রকাশের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা লালন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে যেসব নতুন কবি আবির্ভূত হলেন, দ্বিধাহীন আত্মপ্রকাশ-আকাঙ্ক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বস্ত্তগত পটপরিবর্তনের সুখবোধ এবং আনন্দানুভূতি অনেকের স্বপ্নলোককেই করে তোলে বস্ত্তসম্পর্করহিত। প্রেম ও সংগ্রামের দ্বৈরথ অগ্রজদের কারো কারো মতো এঁদেরকে আলোড়িত করেনি। বরং যুদ্ধোত্তর কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় জীবনের বিপর্যয়, মুক্তিযুদ্ধ-অর্জিত চেতনার ক্রমবিলীয়মান রূপ, পাকিস্তানি আমলের পরাজিত দৃষ্টিভঙ্গির পুনরুত্থান, সেনাতন্ত্রের বিকৃত মুখচ্ছবি, গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, পরাজিত সাম্প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবনচেষ্টা এবং সংবিধানের মূলস্তম্ভগুলোর অপসারণ জাতীয় চৈতন্যকে নিক্ষেপ করে গভীর অন্ধকার ও অনিশ্চয়তা-গহবরে। এই পরিস্থিতিতে সংবেদনশীল কবিচৈতন্যের যে-প্রতিক্রিয়া, সমাজ ও সময়ের অন্তঃস্বর অনুধাবনে তার তাৎপর্য অপরিসীম। এ-সময়ের কবিতায় প্রধানত যে-লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট, তাহলো, রক্তাক্ত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার সমান্তরালে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা। বৃহৎ ত্যাগের অনুভবে আত্মমুগ্ধ অবসন্ন চৈতন্যের বাস্তবতা-অতিরেক স্বপ্ন-কল্পনা। ব্যর্থতাবোধের দ্রুত সম্প্রসারণ। এ-ব্যর্থতাবোধ ষাটের দশকীয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, মূলত সমাজনির্ভর। প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের নতুন চারিত্র্য। সংগ্রামী জীবনাকাঙ্ক্ষার নবতর মাত্রা। শ্রেণিবৈষম্য সম্পর্কে সজাগতা ও শ্রেণিসাম্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। এবং এজন্য নবতর সংগ্রামের প্রস্ত্ততি। যতটা সরল রেখায় লক্ষণগুলো উপস্থাপিত হলো, কবিতায় তার রূপায়ণ অবশ্যই ততোটা সরল-বক্ররেখায় চিহ্নিত নয়। যুদ্ধোত্তর প্রথম পর্বের কবিদের মধ্যে আবেগ ও যন্ত্রণার যে-তীব্রতা, সেখানে নিকট-অতীতের সংগ্রামশীল সংরক্ত চেতনা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। মনে হয়, সমাজ ও জীবনের অব্যাহত ভাঙন কবিতার সংহত নিপুণ অবয়বেও এনে দিয়েছে বিস্রস্ত, এলোমেলো ভাব। জীবনের এক পার ভেঙে অন্য পার গড়ে উঠবে, সভ্যতা শিল্পের ইতিহাসে এ-রূপ দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ-বৈগুণ্য কেবল ভাঙনের অব্যাহত প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্বিত করছে। সংগ্রামের ফল ব্যর্থতার কালো রঙে অবগুণ্ঠিত, প্রেম ও নারী সান্নিধ্যে নেই স্বস্তি – চিরপরিচিত নিসর্গলোকের শুশ্রূষার পরিবর্তে ক্ষুণ্ণিবৃত্তির সর্বগ্রাসী ছোবল মানুষকে টেনে নিচ্ছে উদ্বাস্ত্ত স্বপ্নের মোহে।

স্বাধীনতা-উত্তর বিগত চার দশকের বাংলাদেশের কবিতা কেবল সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করেনি। ব্যক্তিসত্তা বিকাশের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোর উন্মোচন, মানব অস্তিত্বের বহুমুখী সংকট আবিষ্কার, নব্য ঔপনিবেশিকতা ও পুঁজিবাদী বিশ্বের ছদ্মবেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শিল্প-প্রতিরোধ রচনা এবং গণতন্ত্র ও মুক্তচেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিগত তিন যুগে আমাদের কবিরা যে-দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার তাৎপর্য অপরিসীম। কাব্যভাষার ব্যক্তিত্বচিহ্নিত প্রয়োগ কবির আত্মপ্রকাশকে করেছে স্বাবলম্বী।

ব্যক্তির অহং ও আত্মকেন্দ্রিকতার শব্দরূপ নির্মাণে আমাদের কবিরা সব কালেই আত্মনিয়োগ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের কবিতাকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে সমষ্টিজীবনের আঙিনায়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বাস্তবতাই  প্রতিনিয়ত অনিবার্য করে তুলেছে আত্মসন্ধান ও সত্তাসন্ধানের প্রাসঙ্গিকতা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের কবিতার যে মূল লক্ষণ  সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো সামূহিক জীবনজিজ্ঞাসা। প্রত্যাশা, ব্যর্থতা কিংবা যন্ত্রণাও এখানে সমষ্টিলগ্ন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বহুমুখী ভাঙাগড়া, উত্থান-পতন।

ভাষা-আন্দোলনের চেতনাবীজ থেকে যে কাব্যধারার সংরক্ত অভিযাত্রার সূত্রপাত, উনিশশো একাত্তরেও শেষ হলো না তার সংগ্রামী পথচলা। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, প্রগতি ও শ্রেণিসাম্যের প্রতিষ্ঠা এবং সকল প্রকার অপশাসন থেকে মু&&ক্তর সম্ভাবনা নিয়ে যে কবিতার যাত্রা সূচিত হয়েছিল, স্বাধীনতার এতকাল পরেও বাঙালি জীবনে সেই সব প্রত্যাশার বাস্তবায়ন হলো না। এই ট্র্যাজিক বাস্তবতাই বাংলাদেশের কবিতাকে তার মৌল স্বভাবে বারবার জাগ্রত করেছে। ফলে, আমাদের কবিতার রক্তাক্ত ও সংগ্রামী পথচলা এখনো অব্যাহত। বর্তমানে কাব্যভাষা ও রূপকল্পে বাংলাদেশের কবিতা যে-সম্পন্নতা অর্জন করেছে, তার ফলে বাঙালির শিল্প-সংগ্রামের চরিত্র হয়ে উঠেছে আরো তীব্র, তীক্ষ্ণ, গভীর ও ব্যঞ্জনাময়।

তিন

অগ্নিময় ও রক্তরঞ্জিত পশ্চাৎভূমি আর সম্ভাবনাদীপ্ত সম্মুখকল্পনা – যার মাঝখানে তরঙ্গমুখর জাতীয় পরিস্থিতির বিচিত্রমাত্রিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। জীবনাবেগের এই সংরক্ত, তীব্র ও গভীর অন্তর্লক্ষণকে ধারণ করবার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযদ্ধের সাহিত্যকর্মের সাফল্যসূত্র। বিশেষ করে, কথাসাহিত্য বিবেচনার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য প্রযোজ্য। কেননা, উপন্যাসের ক্ষেত্রে জীবনবোধের যে সমগ্রতাস্পর্শী স্বরূপসত্য প্রত্যাশিত, ছোটগল্পে সেখানে মাত্রা-প্রযুক্তির তারতম্য ঘটলেও জীবনাবেগ ও শিল্পাবেগের সমন্বয়ে সৃষ্ট এক সংহত নিপুণ শিল্পরূপ গল্পকারের অন্বিষ্ট। এই অন্বেষণ অবশ্যই জাতীয় জীবনের অন্তর্লীন বিবর্তনের নিগূঢ় নিয়মের  সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সার্বভৌম রাষ্ট্রের মানচিত্র বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের এক মহত্তম প্রাপ্তি। একজন মহৎ শিল্পীর কাছে সেই মানচিত্র বঙ্কিম-সরল রেখা ও কিছু নামের সমষ্টিমাত্র নয়, সামূহিক অস্তিত্বের বিরলদৃষ্ট সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, রক্তক্ষরণ এবং সাফল্যের চৈতন্যময় প্রকাশ।

১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজ সংগঠনে যে-রূপান্তর সাধিত হয়েছে, জাতীয় চেতনার গুণগত বিকাশের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। আর্থ-সামাজিক কাঠামো এবং চেতনার এই বিবর্তনের পটভূমিতেই বিবেচ্য আমাদের কথাসাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, স্বভাবধর্ম। একটা প্রলয়ঙ্করী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত শিল্পীর পক্ষেই কেবল সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের রক্তোজ্জ্বল চেতনার শিল্পরূপ নির্মাণ; কিন্তু মর্মন্তুদ হলেও সত্য, যুদ্ধরত সমগ্র জাতিসত্তার প্রাণস্পন্দনকে শিল্পমন্ডিত করতে গেলে যে গভীর জীবনীশক্তি এবং শৈল্পিক নিরাসক্তি প্রয়োজন, দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের সাহিত্যে সেই অনিবার্য সমন্বয় তেমন লক্ষ করা  যায় না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত উপন্যাসের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও জীবনবোধের সংশ্লেষ সেখানে দুর্লক্ষ্য। সম্ভবত বাস্তব অভিজ্ঞতার দৈন্য অথবা সমধ্যবিত্তের যুদ্ধোত্তর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ এই সীমাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। তবে ঔপন্যাসিকের জীবনচেতনা ও সমাজবোধের গভীরতা কোনো কোনো উপন্যাসকে তীব্র, তীক্ষ্ণ, গূঢ়ভাষী শিল্পকর্মে পরিণত করেছে।

শহীদ আনোয়ার পাশার (১৯২৮-৭১) রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩) আত্মজৈবনিক  অভিজ্ঞতার বস্ত্তনিষ্ঠ শিল্পরূপ। উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন প্রকৃতপক্ষে আনোয়ার পাশারই আত্মপ্রতিবাসের প্রতিচিত্র। পঁচিশে মার্চের সেই কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াল, নির্মম, জান্তব নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত সময়ের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন ঘটেছে এই উপন্যাসে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিমন্ডলে যে অমানুষিক বর্বরতা-তান্ডবলীলা  চলেছিল, আনোয়ার পাশা বাস্তববাদী শিল্পীর নিরাসক্তিতে তাকে রূপদান করেছেন। সুদীপ্ত শাহীনের অভিজ্ঞতায় সেই বীভৎস, দীর্ণ নগ্ন রূপ পাঠককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে বটে, কিন্তু প্রত্যক্ষ অবলোকনের অবিকল উন্মোচন আমাদের জীবনের এক বস্ত্তসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের সংখ্যা চার : জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক ( ১৯৭৩) এবং জলাঙ্গী (১৯৭৬)। যে ব্যাপক, গভীর ও সমগ্রতাস্পর্শী জীবন-অনুধান উপন্যাস নির্মিতির মৌল শর্ত, মুক্তিযুদ্ধ আশ্রয়ী উপন্যাসে শওকত ওসমান সে-শর্ত পূরণে যেন অমনোযোগী। জাহান্নম হইতে বিদায় উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রথম পর্যায়ে স্বদেশভূমি থেকে পলায়নপর মানসিকতা রূপায়িত হয়েছে। দুই সৈনিক ও নেকড়ে অরণ্য মুক্তিযুদ্ধকালীন বিচ্ছিন্ন ঘটনার গ্রন্থমাত্র। দুই সৈনিক উপন্যাসে মখদুম মৃধার পাকহানাদার বাহিনীর প্রতি আনুগত্য সত্ত্বেও তার দুই কন্যা পাকিস্তানি সৈনিকের লালসার শিকারে পরিণত হয়। এবং পরিণামে মুখদুম মৃধা আত্মহত্যা করে। জলাঙ্গীতে মুক্তিযোদ্ধার ভীরুতা ও কাপুরুষতাই শওকত ওসমানের বিবেচ্য প্রসঙ্গ।

শওকত আলীর যাত্রা (১৯৭৬), রশীদ হায়দারের খাঁচায় (১৯৭৫) ও অন্ধ কথামালা (১৯৮১), মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন (১৯৭৬), সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬), সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনতরু, রাবেয়া খাতুনের ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময় (১৯৭৫), মিরজা আবদুল হাইয়ের ফিরে চলো (১৯৮১) প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের উপকরণনির্ভর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। গ্রাম এবং নগরজীবনের পটভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বিচিত্র প্রসঙ্গ উল্লিখিত উপন্যাসসমূহে বিন্যস্ত হয়েছে। যাত্রা উপন্যাসে ২৫শে মার্চ-পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনার উপস্থাপন ঘটেছে। অস্তিত্ব প্রশ্নে শঙ্কিত শহর থেকে গ্রামের  দিকে  ধাবমান জনস্রোতের অন্তর-বাহির অনেকটা সার্থকতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে এ-উপন্যাসে। অধ্যাপক রায়হান তার স্ত্রী বিনু,  বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসান, ছাত্রী লীলা এবং আরও কয়েকটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ের তীব্র উত্তেজনা ও অস্থিরতা রূপায়িত হয়েছে। রায়হানের মধ্যে আত্মসুখসন্ধান এবং তজ্জনিত গ্লানিবোধ থাকলেও হাসানের চরিত্র আশাবাদী এবং মীমাংসিত। যুদ্ধজয়ের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় তার উচ্চারণ : ‘এখন আমাদের জীবনের আরেক নাম হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা।’ রশীদ হায়দারের খাঁচায় স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে অবরুদ্ধ নগরজীবনের আলেখ্য। ঢাকা শহরে অবরুদ্ধ ও শঙ্কিত জাফরের মানস-প্রতিক্রিয়ার চিত্র : ‘সমস্ত অনুভূতি নিষ্ক্রিয় হয়ে রাস্তার মতো হয়ে গেছে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা, খাঁচাটা আরো সংকুচিত হয়ে আসছে, খাঁচার চারপাশে উদ্যত মারণাস্ত্র।’ বাইরের জগতে নিষ্ক্রিয় কিন্তু অন্তর্জগতের ক্রিয়াশীলতায় এ-উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্রই যুদ্ধকালীন সময়ের একটা অবস্থাকে অভিব্যক্ত করেছে। অন্ধ কথামালা উপন্যাসের নায়ক বেলাল হোসেন একজন শিক্ষিত গ্রামীণ যুবক। একাত্তরের পঁচিশ মার্চের নিকটবর্তী সময়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের এলাকার সঙ্গে বাইরের প্রধান যোগসূত্র একটি ব্রিজ ধ্বংস করে শত্রুর গতিরোধের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বে অপারেশনের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দিষ্ট সময়েই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোকসেদ শত্রুপক্ষের কাছে ধরিয়ে দেয় বেলাল হোসেন বেলটুকে। এই বন্দি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও মৃত্যুতাড়িত বেলাল হোসেনের স্মৃতিগুচ্ছ এবং অনুভবরাশি এ-উপন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে। সময়ের দিক থেকে কয়েক ঘণ্টার এই কাহিনি। কিন্তু বেলাল নামক ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ায় জাগ্রত স্মৃতি ও অনুভবের মধ্যে রশীদ হায়দার  একটা জনপদ, তার অন্তর্গত ব্যক্তি ও সমাজ, ব্যক্তির প্রত্যাশা অপ্রাপ্তি, সংকট ও যন্ত্রণার যে-প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, তা বাঙালি জীবনের সমগ্রতার স্পর্শ শিহরণে উজ্জ্বল।

সেলিনা  হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রামীণ জীবনের আবেগী শিল্পরূপ। তবে, বুড়ির মাতৃ-ইমেজ হলদি গাঁয়ের সীমাবদ্ধ পরিসর থেকে সমগ্র বংলাদেশেই প্রসারিত করে দেয় যুদ্ধের চেতনাকে। গ্রামীণ জীবনকাঠামো, যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় তার রূপ-রূপান্তর, চরিত্রসমূহের বাস্তবানুগ ক্রিয়াশীলতা এবং সর্বোপরি বুড়ির আত্মোজ্জীবন এ-উপন্যাসের জীবনদর্শনকে সমগ্রতাস্পর্শী করেছে। উপন্যাসের পরিণামে চিত্র, ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণে সেলিনা হোসেনের শিল্পদৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সংকেতময় ও গূঢ়ভাষী।

মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন সমাজসত্তা-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির যুদ্ধকালীন জীবনযন্ত্রণার রূপায়ণ। নাগরিক মধ্যবিত্তের পলায়নপর ও আত্মসুখসন্ধানী মানসিকতাই খোকা চরিত্রের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। মার্চের সেই ভয়াল রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন সময়প্রবাহে প্রতিবাদ ও দ্রোহের পরিবর্তে রতি বা লিবিডোই মুখ্য হয়ে উঠেছে খোকার চৈতন্যে। ‘পলায়ন ছাড়া কোন ভূমিকা নেই’ খোকার এই অনুভব পরিণামে স্থূল শরীরী চিত্রকল্পে পরিণত হয়। তবে সময়ের অনিবার্য পরিবর্তন-পরম্পরা খোকার সমষ্টি-বিচ্ছিন্ন চেতনাকেও এক সময় আলোড়িত করে। তার মনে হয় ‘ঢাকার রাস্তায় মারমুখী জনতা থৈ থৈ করে।’ এবং ‘কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষের মুখের আদল, কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে যাবতীয় দৃশ্যপট, দ্রুত, দ্রুত এবং ধাবমান, গ্লেসিয়ারের মতো ধাবমান, দুর্দম নৃত্যের  মতো, চলমান গ্লেসিয়ার। মানুষ! মানুষ! আর মানুষ। আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায়… গা-ছমছম করতে থাকে খোকার… শস্যক্ষেত, উইঢিবি, বাঁশঝাড়, সাঁকো, শহর-বন্দর গণিকালয় সবকিছু অপ্রতিরোধ্য জলরাশি-বিমর্দিত তোড়ের মুখে অকাতরে ভেসে চলেছে। এ কোন নুহের প্লাবন ভিতরে ভিতরে টাল খায়, তার মাথা দপ দপ করে।’ যুদ্ধে যোগদানের প্রশ্নে মধ্যবিত্তের দোদুল্যমান এবং সময়ের ভয়াবহতার কাছে অনিচ্ছুক আত্মসমর্পণই শেষ পর্যন্ত মুখ্য হয়ে ওঠে এ-উপন্যাসের চরিত্রপাত্রদের জীবনে। জীবনবোধের প্রশ্নে সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবন-তরু তুলনামূলকভাবে সফল সৃষ্টি। এ উপন্যাসের শ্যামল মধ্যবিত্তের মানসিকতা থেকে দূরবর্তী, পিতা-মাতার অজ্ঞাতেই সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তারুণ্য, আবেগ, উদ্দামতা, ঐকান্তিকতা এবং মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনচেতনা অতিক্রম করে যায় শ্যামলের মৃত্যুকে। একটা আশাবাদী মীমাংসায় জীবন-তরু উপন্যাস যুদ্ধকালীন সময়ের মর্মমূলকে স্পর্শ করেছে। আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময় উপন্যাসেও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের নিষ্ক্রিয় আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাই প্রাধান্য লাভ করেছে। যুদ্ধরত একটি জাতির সংগ্রামশীল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এ-উপন্যাসের চরিত্র-পাত্ররা সংযোগহীন।

আমাদের ঔপন্যাসিকদের মুক্তিযুদ্ধ অবলোকনের একটা  বৈশিষ্ট্য তাৎপর্যবহ। যুদ্ধপরবর্তীকালে আবেগের দ্রুততায় যাঁরা উপন্যাস রচনা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনবলয়ের মধ্যেই আবর্তিত হয়ছেন। গ্রামজীবন বাস্তবায়তায় যুদ্ধকালীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণের প্রশ্নে যাঁরা মনোযোগী, তাঁদের চরিত্র-পাত্ররা, মধ্যবিত্তের দোলাচল ও আত্মপরায়ণতা থেকে অনেকাংশে মু্ক্ত। হাঙর নদী গ্রেনেড, জীবন-তরু এবং অন্ধকথামালায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নে নির্দ্বন্দ্ব সক্রিয়তা যুদ্ধকালীন সময়ের সত্য স্বরূপকেই অভিব্যক্ত করে। রশীদ করিমের আমার যত গ্লানি (১৯৭৩) এবং মাহবুব তালুকদারের অবতার (১৯৭৩) মুক্তিযুদ্ধকালীন মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণারই শিল্পরূপ।

উপন্যাস হিসেবে ততটা সাফল্যস্পর্শী না হলেও ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের বন্দি দিন বন্দি রাত্রির (১৯৭৬) চেতনা ও বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের মৌল আবেগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া (১৯৭৩), সৌরভ (১৯৮৪) এবং ১৯৭১ (১৯৮৬) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিবিধ প্রসঙ্গ বিন্যস্ত হয়েছে। শ্যামল ছায়ায় চারজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথন যে অভিজ্ঞতালোক উন্মোচন করে, সেখানে বহির্বাস্তবতার ফ্রেমটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। পরিবারবিচ্ছিন্ন এক তরুণীর আত্মজীবন সৌরভের উপজীব্য হলেও যুদ্ধ নয়, আত্মমগ্ন চেতনাই সেখানে মুখ্য। ১৯৭১-এর কাহিনি অনেকটা সরলরেখায় উপস্থাপিত। রফিকের পরিণাম বাস্তবস্পর্শী হলেও মেজর বখতিয়ারের প্রতিক্রিয়া পাক হানাদার বাহিনীর স্বভাববিরোধী।

    মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের অনুষঙ্গবাহী সার্থক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে যাঁর নাম স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। চেতনার মৌল স্বভাবে অন্তর্মুখী ও মনোবিশ্লেষণপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উপন্যাসে যুদ্ধকালীন ও তার পরবর্তী জীবনের বিশেষ রূপ বিন্যস্ত হয়েছে। নিষিদ্ধ লোবানে রতি চেতনার (libido) আধিক্য থাকলেও বিলকিসের পরিণাম ইতিবাচক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল। তার দেহের আগুনে আকৃষ্ট মেজরকে সে বাধ্য করে প্রদীপে দাহের আয়োজন করতে। অতঃপর :

মেজর এসে বিলকিসকে বলে, ‘এরপর কী?’

বিলকিস সাড়া দেয় না।

তার পেছনে নদীর জল হঠাৎ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।

পোড়া মাংসের গন্ধে পেটের ভেতর থেকে সব উল্টে আসতে চায়, সে সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও। আগুনের প্রবল হল্কা অনুভব করে। নাক-মুখ ঢাকার চেষ্টা করে মেজর প্রাণপণে বিলকিসকে আকর্ষণ করে।

ঠিক তখন বিলকিস তাকে আলিঙ্গন করে। সে-আলিঙ্গনে বিস্মিত হয়ে যায় মেজর। পরমুহূর্তেই বিস্ফারিত দুই চোখে সে আবিষ্কার করে, রমণী তাকে চিতার ওপরে ঠেসে ধরেছে, রমণীর চুল ও পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার নিজের পিঠ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রমণীকে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু রমণীকে আগুন দিয়ে নির্মিত বলে এখন তার মনে হয়। তার স্মরণ হয়, মানুষ মাটি দিয়ে এবং শয়তান আগুন দিয়ে তৈরি। জাতিস্মর আতঙ্কে সে শেষবারের মতো শিউরে ওঠে।

মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে ঠেসে ধরে রাখে বিলকিস।

জলেশ্বরীর প্রতীকে সমগ্র বাংলাদেশকেই যেন এ-উপন্যাসে ধারণ করেছেন ঔপন্যাসিক। পঁচিশে মার্চ-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, ব্যক্তি ও সমষ্টির উত্তেজনা, নিরস্তিত্বের যন্ত্রণা এবং অস্তিত্বময়  জীবন-অভীপ্সা রতির তীব্রতাকে শেষ পর্যন্ত ম্লান করে দেয়। নীল দংশনে নজরুল ইসলামের চরিত্রভাবনায় সৈয়দ শামসুল হক বিদ্রোহী কবির সত্তারূপকে জাতীয় চৈতন্যের সমগ্রতায় স্থাপন করেন। তাঁর দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪) বিষয় ও আঙ্গিকে এ-ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। শিক্ষক তাহেরের স্মৃতিচারণা ও আত্মোপলব্ধি মুক্তিযুদ্ধের পরিসরকে ব্যপ্ত সমগ্র ও দূরসঞ্চারী চেতনায় উদ্ভাসিত করে। বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১৯৮৯-৯০) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মহাকাব্যিক আয়তনে রূপায়িত হয়েছে। যুদ্ধের অনুষঙ্গবাহী এক যুবকের ছায়াপাত (১৯৮৭) উপন্যাসের নামও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। নিষিদ্ধ লোবান থেকে বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ পর্যন্ত উপন্যাসসমূহ বিশ্লেষণ করলে কেবল সৈয়দ হকের শিল্পীসত্তা নয়, বাঙালি জাতিসত্তার ক্রম রূপান্তরের ইতিহাসও অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। রতির অন্ধকার থেকে তিনি আমাদের আকর্ষণ করেন রক্তকরোজ্জ্বল, প্রাগ্রসর চেতনার দিকে, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অভিন্ন বিন্দুতে মিলিত।

হারুন হাবীবের প্রিয়যোদ্ধা, প্রিয়তম (১৯৮২) উপন্যাসের উপকরণ নির্বাচনের পটভূমি স্বতন্ত্র। বাংলাদেশ এবং যুগোস্লাভিয়ার মুক্তিসংগ্রাম এ-উপন্যাসে অভিন্ন বোধের কেন্দ্রে মিলিত, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বিজয়ের উল্লাস আর ত্যাগের মহিমা যেমন ছড়িয়ে আছে  এ-উপন্যাসে, তেমনি আছে হাসান-ইয়াসমিনের রোমান্টিক প্রেমের প্রতীকে শাশ্বত বিশ্বজনীনতা। ‘একাত্তরের মৃত অথবা জীবিত স্বাধীনতা সংগ্রামী আবুল হাসানরাই বাংলাদেশ’, অথবা ‘বায়ান্ন থেকে সত্তরের যে ইতিহাস সেই ইতিহাসই বাংলাদেশ’ প্রভৃতি উচ্চারণে স্বাধীনতাযুদ্ধের মৌল সত্যই অভিব্যক্ত। হরিপদ দত্তের অজগর (প্রথম খন্ড ১৯৮৯, দ্বিতীয় খন্ড ১৯৯১) উপন্যাসের ঘটনাক্রম বিভাগোত্তর কাল থেকে স্বাধীনতা-উত্তর কাল পর্যন্ত প্রসারিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের আদি-অন্তকে নিরাসক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিক। সমগ্র জনগোষ্ঠীর জীবন পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সময়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বস্ত্তনিষ্ঠ একাগ্রতায় উন্মোচিত হয়েছে। বাঙালি জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বর্তমানেও যে অনিঃশেষ, জয়নালের জীবনধারা ও পরিণামী উচ্চারণে সে-সত্যই প্রতিফলিত।

আবু জাফর শামসুদ্দীনের (১৯১১-৮৮) শেষ ও শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি দেয়াল (১৯৮৬) মুক্তিযুদ্ধের ইতিবাচক চেতনার শিল্পরূপ। ব্যক্তিজীবন রূপায়ণের অনুষঙ্গে ঔপন্যাসিক সমগ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তার রূপ-রূপান্তরকে বিন্যস্ত করেছেন উপন্যাসে। উপন্যাসের সূচনা ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল কালরাতের আরণ্যক, হিংস্র অন্ধকারে। অতঃপর ফ্লাশব্যাক পদ্ধতিতে লেখক উপন্যাসে বিধৃত জীবনের অন্তর্লোক ও বহির্লোক উন্মোচন করেছেন। আবদুল্লাহ সাহেবের ব্যক্তিজীবনের ভাঙাগড়া ও রূপান্তরের ছকে এ-উপন্যাসের কাহিনি রূপায়িত হয়েছে। সারাজীবন পাকিস্তানি আদর্শের বংশবদ আবদুল্লাহর জীবনে পঁচিশে মার্চের ঘটনা নতুন তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেয়। তার জীবনের আদর্শবোধ ও সাধনা নিক্ষিপ্ত হয় ব্যর্থতার অন্ধকারে। পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির পর পাকিস্তানি প্রশাসনে দায়িত্ব পালনকালে তার স্ত্রী ও কিশোরী কন্যা পাকসেনাদের ঘৃণ্য লালসার শিকারে পরিণত হয় ও মৃত্যুবরণ করে। এই মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার ফলে আবদুল্লাহ সাহেবের চেতনা ও কর্মের রূপান্তর হয় অনিবার্য। একজন ব্যক্তির জীবনকথা রূপায়ণের অনুষঙ্গে আবু জাফর শামসুদ্দীন সময়, সমাজ ও জীবন সত্যের মর্মমূল স্পর্শ করেছেন।

চার

যুদ্ধক্ষত সময়ের রক্তাক্ত অনুভূতিপুঞ্জের সামগ্রিক অঙ্গীকার সত্ত্বেও যা জীবন্ময়; শত ব্যর্থতা, আত্মত্যাগ ও রক্তরঞ্জিত স্মৃতিযন্ত্রণার মধ্যেও যা এক অন্তর্লীন আশাবাদে সম্মুখসঞ্চারী, সেই অনিঃশেষ বৈচিত্র্যে গতিশীল চেতনার শিল্পপ্রয়াসের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছোটগল্পের গৌরবময় স্বাতন্ত্র্য। সংখ্যাগত দিক থেকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত গল্প নিঃসন্দেহে প্রাচুর্যের সাক্ষাৎবাহী। মনে করা সংগত যে, কবিতা কিংবা উপন্যাস অপেক্ষা ছোটগল্পের অবয়বেই বাংলাদেশের কথাশিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য শিল্পরূপ নির্মাণে বেশি মাত্রায় সমর্থ হয়েছেন। এর কারণ সম্ভবত জীবনের পূর্ণরূপ অপেক্ষা খন্ডরূপের প্রতি শিল্পী-চৈতন্যের অধিকতর আকর্ষণ। অবশ্য এ কথাও সত্য যে, ছোটগল্পের সীমিত আয়তনে যে-জীবন প্রতিবিম্বিত হয় তা খন্ড  খন্ড  হলেও সমগ্রের অংশ -ব্যক্তির স্বতন্ত্র শিল্প-অন্বেষা সেখানে সামগ্রিক জীবন-চৈতন্যের অন্তর্ময় অণু-পরমাণু। এজন্যেই বলা যায়, জাতীয় চৈতন্যের খন্ড খন্ড  শিল্প-রূপায়ণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এক অখন্ড চেতনাকে নির্মাণ করেছেন আমাদের গল্পকাররা।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী-সম্পাদিত বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১) সংকলন। সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার তীব্র, তীক্ষ্ণ, রক্তাক্ত অনুভবই সংকলনভুক্ত গল্পসমূহের বৈশিষ্ট্য। প্রসঙ্গত সম্পাদকের মন্তব্য স্মরণ্য : ‘ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সাহিত্য নানা মোড় ফিরেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে, জনমানসের প্রতিরোধ চেতনাকে বিস্তারলাভে আরো সাহায্য করেছে। বর্তমানে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধেও বাংলাদেশের গল্প ও কবিতার ভূমিকা তাই গৌণ নয়। বাংলাদেশ কথা কয় গ্রন্থে সন্নিবেশিত বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণ ও প্রবীণ কথাশিল্পীর লেখা গল্পগুলো তাই নিছক যুদ্ধ-সাহিত্য নয়; বরং বাঙালি জাতীয় মানসের বর্তমান বিপ্লবী প্রতিরোধ চেতনার কয়েকটি রূপরেখা।’ গ্রন্থ-অন্তর্ভুক্ত ষোলোটি গল্পের সবগুলোই যে সাফল্যস্পর্শী হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে সময়ের তীব্র টান প্রতিটি গল্পেই বিধৃত। গল্পগুলোর তালিকা নিম্নরূপ : ‘সাদা কফিন’ (বিপ্রদাশ বড়ুয়া), ‘শেষ যাত্রা নয়’ (নির্মলেন্দু গুণ), ‘লাল পল্টন’ (আবদুল হাফিজ), বুলি তোমাকে লিখছি’ (সুব্রত বড়ুয়া), ‘চরিত্র’ (ফজলুল হক), ‘রক্ত প্রজন্ম’ (আসফ-উজ-জামান), ‘সোলেমান ভাই’ (বুলবন ওসমান), ‘নীল নকশা’ (কামাল মাহবুব) ‘শব্দতাড়িত’ (অনু ইসলাম), ‘কমলা রঙের রোদ’ (আসাদ চৌধুরী), ‘পরীবানুর কাহিনী’ (সত্যেন সেন), ‘অন্যের ডায়েরি থেকে (ইলিয়াস আহমদ), ‘সময়ের প্রয়োজনে’ (জহির রায়হান), ‘শেষ বাজি’ (কায়েস আহমেদ), ‘আলোক-অন্বেষা’ (শওকত  ওসমান) এবং ‘রোদের অন্ধকারে বৃষ্টি’ (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী)। প্রত্যক্ষ জীবনাভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ গল্পসমূহের অধিকাংশ অনুভূতির নিঃসংকোচ রূপায়ণে বিশিষ্ট। সত্যেন সেন পরীবানুর মধ্য দিয়ে নারীত্বের যে স্বরূপ উন্মোচন  করেছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের অকথিত কাহিনির জীবন্ময় খন্ডাংশ। প্রচলিত সংস্কার এবং নারীত্বের স্বেচ্ছা বিসর্জনের মধ্যে পরীবানু এক জাতিসত্তার উজ্জীবন প্রত্যক্ষ করে। তার আত্মবিসর্জন এ-কারণে গৌরবময় যে, পাক হানাদার বাহিনীর রক্তে পরীবানুর হাত রঞ্জিত হয়েছে। ‘মেঝেতে  পুডিং-এর মতো জমাট রক্ত’ – এই অভিজ্ঞতা জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পের কথক পুরুষের। মৃত্যুভীতি, যুদ্ধভীতি যার দৈনন্দিন জীবনের অংশ ছিল, রক্তদর্শনের আকস্মিকতায় তার জীবননীতির মৌল স্বরূপ রূপান্তরলাভ করে। এই রূপান্তর যুদ্ধকালীন সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনেই সংঘটিত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগ্রন্থের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। ‘আমাদের গল্পকারদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর নির্বিচার পীড়ন, নির্যাতন ও গণহত্যার মধ্যে বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ ছিল আমাদের গল্পকারদের অনুপ্রেরণার উৎস।’ প্রবীণ-নবীন উভয় ধারার গল্পকাররাই মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ অনুষঙ্গবাহী প্রচুর গল্প রচনা করেছেন এবং শিল্পমানের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গল্প কালোত্তর মহিমায় অভিষিক্ত। কেবল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প সংকলনের সংখ্যাও কম নয়। যেমন বশীর আল হেলালের প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২), হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), আবু জাফর শামসুদ্দীনের রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭), আবুবকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৭৭), সাদেকা সফিউল্লাহর যুদ্ধ অবশেষে (১৯৮০), খালেদা সালাহউদ্দিনের যখন রুদ্ধশ্বাস (১৯৮৬), এহসান চৌধুরীর একাত্তরের গল্প (১৯৮৬), সৈয়দ ইকবালের একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প (১৯৮৬), সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০) বিপ্রদাস বড়ুয়ার যুদ্ধ জয়ের গল্প (১৯৮৫), সাদা কফিন (১৯৮৪) ও মুক্তিযোদ্ধারা (১৯৯১); কাজী জাকির হাসানের যুদ্ধের গল্প (১৯৯১) সেলিনা হোসেনের পরজন্ম মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবন ও তৎসংলগ্ন চেতনার বিচিত্রমাত্রিক অনুভবের শব্দরূপ। এছাড়াও সৈয়দ শামসুল হকের প্রাচীন বংশে নিঃস্ব সন্তান (১৯৮১) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মু হীন মহারাজ (১৯৭৪), শওকত আলীর লেলিহান সাধ (১৯৭৭), রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (১৯৮৬) রশিদ হায়দারের  তখন (১৯৮৭) হারুন হাবীবের বিদ্রোহী ও আপন পদাবলী (১৯৮৫) প্রভৃতি গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ-আশ্রয়ী গল্প  অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আবুল হাসনাত-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩) হারুন হাবীব-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫) এবং মুক্তিযোদ্ধার গল্প (১৯৯১) গ্রন্থের প্রবীণ ও নবীন গল্পকারদের মুক্তিযুদ্ধ-আশ্রয়ী জীবন-চেতনার বিন্যাস ঘটেছে। বিষয় ও ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্পে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি ভাষা ব্যবহার এবং অলঙ্কার-সৃজনেও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপস্থিত। ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে ছোটগল্প রচিত হয়েছে, কখনো-বা ছোটগল্পের মৌল ভাব সৃষ্ট হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে। কোনো কোনো ছোটগল্পে স্বাধীনতার সপক্ষীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং বিপক্ষীয়দের প্রতি ঘৃণাবোধ উচ্চারিত হয়েছে। আবার কোথাও-বা ছোটগল্পের বহিরঙ্গে লেগেছে মক্তিযুদ্ধের স্পর্শ। মুক্তিযুদ্ধের উপাদানপুঞ্জ ব্যবহার করে বাংলাদেশের  প্রায় সব গল্পকারই রচনা করেছেন ছোটগল্প।

আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কলিমদ্দি দফাদারে’ (রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা)  জীবনের বর্ণনাধর্মী উপস্থাপন সত্ত্বেও সময়ের বস্ত্তনিষ্ঠ অনুভব এ-গল্পকে করেছে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শওকত ওসমানের ‘দুই ব্রিগেডিয়ার’ গল্পের সয়ীদ ভূঁইয়ার পরিণতির মধ্যে এক রক্তাক্ত প্রশ্নবোধক চিহ্ন পঁচিশে মার্চের সেই আরণ্যকে রাত্রির যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতির ইঙ্গিতবাহী। মানবিক দায়িত্বচেতনা এবং পৈশাচিকতার মাত্রাভেদ গল্পের উপজীব্য হলেও একটা মানবিক জিজ্ঞাসার লেলিহান রক্তশিখা অনিঃশেষ বেদনায় থাকে অম্লান। সত্যেন সেনের পরীবানুর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালে জাতিসত্তার যে-উজ্জীবনকে প্রত্যক্ষ করি, কলিমদ্দি দফাদারে তাই ভিন্নতর অবয়বে প্রকাশিত। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘রূপান্তর’  (আমার রক্ত স্বপ্ন আমার) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিল্পসফল গল্পসমূহের মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধের আকস্মিকতায় নাগরিক তারুণ্যের রক্তাক্ত জাগরণকে সমগ্রতার পটভূমিতে স্থাপন করেছেন গল্পকার। জীবনের ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত, বিচূর্ণ অনুভূতিপুঞ্জের অনুষঙ্গেই এ গল্পের বাক্যবিন্যাস ছেঁড়া-ছেঁড়া ক্রমভঙ্গ। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বগত কথনের মধ্যে যুদ্ধকালীন জীবনের অন্তর্গত ও বহির্গত – উভয় রূপই বিন্যস্ত হয়েছে। ফ্যান্টাসিধর্মী হলেও ‘স্বপ্নে আমার’ মুক্তিযুদ্ধকালে নিহত এক নারীর মনোবেদনা ও ইতিবাচক জীবনাকাঙ্ক্ষার গল্পরূপ।

হাসান  আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন গ্রন্থের প্রতিটি গল্পই বিষয় ও আঙ্গিকের অন্তর্বয়নে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জীবনচেতনার সার্থক শিল্পরূপ। ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিমেয় জীবনীশক্তির বিন্যাস ঘটেছে। ‘ঘরগেরস্তি’ গল্পে যুদ্ধোত্তরকালের জনজীবনের অনিশ্চিত বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বরূপ হয়ে উঠেছে ইঙ্গিতময়। সর্বহারা রামশরণ ও ভানুমতির বাস্ত্তভিটায় প্রত্যাবর্তন প্রকৃতপক্ষে এক রক্তাক্ত স্মৃতিলোক থেকে আরেক হা-হা শূন্যতাময় ভবিষ্যতের অভিযাত্রা। জীবন ও শিল্পবোধের ইতিবাচক অন্বেষায় লেখক এক নির্বিশেষ সত্যের পটভূমি নির্দেশ করেছেন গল্পের সমাপ্তিতে; ‘কিন্তু লঞ্চে যাবে না রামশরণ। লঞ্চ ধরে কোথাও যাবার নেই তার। তবে কোথাও সে নিশ্চয়ই যাবে।’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কেয়া আমি এবং জারমান মেজর’ (মুক্তিযুদ্ধের গল্প) গল্পটি প্রতীকী তাৎপর্যে ব্যঞ্জনাময়। বাস্তব পরিস্থিতি এবং সংলাপের  সমান্তরাল বিন্যাসে  যুদ্ধকালীন তীব্র উত্তেজনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুভবরাশি গল্পের পটভূমিকে বিস্তৃত আয়নতবদ্ধ করছে। যুদ্ধরত সময়ের সংরক্ত আবেগ ও সচেতন অনুভবের প্রকাশরূপ হিসেবে গল্পটি তুলনারহিত।

সৈয়দ শামসুল হকের গল্পে মুক্তিযুদ্ধের অন্তর বাহির নগরজীবন-গ্রামজীবন, দেহী ও বিদেহী – বিবিধমাত্রিক বিন্যাস ঘটেছে। অবরুদ্ধ সময়ের বিপন্ন অস্থিরতা ‘কথোপকথন : তরুণ দম্পতির’ গল্পের উপজীব্য। যাদের কাছে স্বাধীনতা স্বপ্নের মতো মোহময়। যাদের একজন উচ্চারণ করে, ‘স্বাধীন বাংলায় শুনে শুনে আমার ইচ্ছা করে একটা ট্রেঞ্চের ভেতরে রাইফেল হাতে বসে থাকতে, অ্যামবুশ শব্দটা আমার ভারী ভালো লাগে, তারপর ক্যামোফ্লেজ কি সুন্দর না?’ কিন্তু সেই স্বপ্নাচ্ছন্ন মোহময় অন্ধকারে স্বামীর সম্মুখেই তার স্ত্রী হানাদারদের পৈশাচিক শক্তির হিংস্র থাবার শিকারে পরিণত হয়। জলেশ্বরীর গল্পগুলো গ্রন্থের অধিকাংশ গল্পই মু&&ক্তযুদ্ধের নিগূঢ় চেতনার গল্পরূপ। ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না’  গল্পে উচ্চারিত হয় ‘কন বাহে, শুনি হামারা। মুক্তিযুদ্ধ কি ফির শুরু হয়া গেইছে।’ যুদ্ধোত্তর জীবনের শূন্যতা ও অনিশ্চয়তাবোধ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘ঘরে ফেরা’ (মুন্ডহীন মহারাজ) গল্পের উপজীব্য। জীবনবোধের আলোকোজ্জ্বল, ইতিবাচক রূপ প্রতিফলিত হয়েছে সুচরিত চৌধুরীর ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’ (মুক্তিযুদ্ধের গল্প) গল্পে।  মুক্তিযুদ্ধ যে অনেক প্রেমকে করেছে রক্তাক্ত এবং রেখে গেছে এক অনিবার্য অচরিতার্থ সম্মুখভূমি – শওকত আলীর ‘কোথায় আমার ভালোবাসা’ (লেলিহান সাধ) তার অন্তর্ময় শিল্পরূপ। ব্যক্তিগত প্রতিশোধস্পৃহা সমষ্টিগত জীবনলগ্ন হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ‘পুনর্বার বেয়নেট’ গল্পে। আবদুল হাফিজের ‘লাল পল্টন’ গল্পে (মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প) এক সাধারণ শ্রমিকের মুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তর ঘটেছে। পরিস্থিতির অনিবার্যতাই এ রূপান্তরের কার্যকারণ। আবুবকর  সিদ্দিকের ‘খতম’ (মরে বাঁচার স্বাধীনতা) গল্পে যুদ্ধকালীন সময়ের অন্যতর রূপ উন্মোচিত। শ্রেণিসংগ্রাম বনাম জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতি রূপায়ণের মধ্য দিয়ে তিনি জনবিচ্ছিন্ন কিছুসংখ্যক তরুণের হঠকারী সিদ্ধান্ত ও তার পরিণাম নির্দেশ করেছেন।

পঁচিশে মার্চের কালরাতের ঢাকা নগর অন্তর্বর্তী অবরুদ্ধ ও উদ্বেগাকুল জীবনের চিত্র রশিদ হায়দারের ‘প্রথম দিনে’ (তখন-১৯৮৭) গল্পে প্রতিবিম্বত। ‘এ কোন ঠিকানা’ (উত্তরকাল-১৯৮৭) গল্পের পরিণামী সংলাপে শিল্পীচৈতন্যের মৌল সংরাগ বর্ধিত :

‘তোমাদের বাসার সামনে যুদ্ধ হয়েছিল?

মৃদু হেসে জবাব দেয় বাসেন, আপনিই বলুন, দেশের কোথায় যুদ্ধ হয়নি? মনে করে দেখুন তো।’

যুদ্ধোত্তর জাতীয় পটভূমির সামগ্রিক অসংগতি, মুক্তিযোদ্ধার  বিবর্ণ পরিণাম, হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার-আলবদরদের সামাজিক ও বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধার বিলুপ্তপ্রায় অস্তিত্বের সাহসী পুনরুত্থান প্রভৃতি বিন্যস্ত হয়েছে সেলিনা হোসেনের ‘ভিটেমাটি’ গল্পে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিপর্যস্ত অনিশ্চিত এবং অবসাদগ্রস্ত জাতীয় চৈতন্যের পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই যে পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিহিত, ‘ভিটেমাটি’তে তারই অভিজ্ঞানমন্ডিত ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ‘যুদ্ধজয়’ গল্পে সেলিনা হোসেন সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ, বিপন্ন চেতনার শুশ্রূষার বাণী রূপায়িত করেছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অপঘাত’ গল্পে যুদ্ধাকালীন জীবনের তীব্র আর্তি ও যন্ত্রণা শব্দরূপ পেয়েছে। উত্তরবঙ্গের নিস্তরঙ্গ জনপদে হানাদার বাহিনীর অবস্থান ও অমানবিক কার্যক্রম, এজন্য মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু এবং অন্য এক স্বাভাবিক মৃত্যুর সমান্তরাল অন্তর্ময় বিন্যাস প্রভৃতি প্রসঙ্গকে নিরাবেগ সততায় উন্মোচন করেছেন তিনি। ‘অপঘাত’ গল্পের প্রাণশক্তির মূলে রয়েছে মোবারক আলীর আত্ম-উন্মোচন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুত্রের খবর জনসমক্ষে প্রকাশ পেলে অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় যে সন্ত্রস্ত, সেই মোবারক আলীই গোপন সংবাদের সরল ঘোষণার মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হয় এক দ্বিধাহীন, আলোকোজ্জ্বল অনুভবলোকে। কায়েস আহমেদের ‘আসন্ন’ যুদ্ধের বস্ত্তনিষ্ঠ গল্পরূপ, রবিউল হাসানের ‘মাটির মেডেল’ এবং বিপ্রদাশ  বড়ুয়ার ‘সাদা কফিন’ যুদ্ধকালীন সংরক্ত অনুভবের বাঙ্ময় প্রকাশ। তাপস মজুমদারের ‘মাটি’, সিরাজুল ইসলামের ‘যাত্রার নায়ক’, আহমদ বশীরের ‘অন্য পটভূমি’ এবং ইমদাদুল হক মিলনের ‘প্রস্ত্ততিপর্ব’ গল্পে অভিজ্ঞতার রূপায়ণই মুখ্য। তবে আহমদ বশীরের গল্পের উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ নয়, যুদ্ধ অপেক্ষা ভয়াবহ জীবনযুদ্ধের অনিশ্চিত সম্মুখভূমি। মাহবুব তালুকদারের ‘শরণার্থী’ দেশত্যাগী তারুণ্যের বিভ্রম ও আত্মজয়ের শব্দরূপ।

যুদ্ধোত্তর বিপন্ন হতাশাগ্রস্ত তারুণ্য, মুক্তিযোদ্ধার বহুমুখী চেতনা, যুদ্ধকালীন জীবনের বিকৃত অবস্থার অবলম্বন,               মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের পটভূমিতে রচিত অধিকাংশ গল্পের  প্রধান উপজীব্য। অবশ্য সৈয়দ ইকবালের ‘একদিন বঙ্গবন্ধু’ গল্প জাতীয় চৈতন্যের রক্তাক্ত আত্মপীড়নের সার্থক শিল্পরূপায়ণ। একটি মৃত্যুর মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। এক উলঙ্গ পাগলির আচরণে জাতীয় অস্তিত্বের সে-আত্মক্ষয়ের গ্লানিময় অবস্থাই যেন প্রতীকায়িত। ঘাতকের হাতে পিতার মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি শ্রমজীবী মালেককে কীভাবে এক অসাধারণ মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করে এবং একজন রাজাকারের প্রতি হঠাৎ জাগ্রত সব বেদনা সেই স্মৃতির অনিবার্য রক্তঋণে পুনরায়  হয়ে ওঠে নির্মম ক্ষমাহীন – মাহবুব সাদিকের ‘জন্মান্ধ-যোদ্ধা’ গল্পে জীবনের ওই স্বরূপসত্য বিন্যস্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সেই নির্মম, ক্ষমাহীন অথচ কল্যাণ-প্রত্যাশী চেতনার অঙ্গীকারই সচেতন শিল্পীর আরাধ্য হওয়া উচিত।

পাঁচ

সমবায়ী শিল্পমাধ্যম নাটকে মুক্তিযুদ্ধ বিচিত্র রূপে অভিব্যক্ত। যুদ্ধের  অব্যবহিত আগেই আমাদের নাট্যকাররা চেতনা প্রসারিত করেছিলেন রক্তগর্ভা সময়ের বেদিমূলে। যুদ্ধকালীন সময়ে রচিত মমতাজউদ্দীন আহমদের নাটকের বিষয় ও প্রকরণে  সময়স্বভাব গভীরভাবে বিধৃত হয়েছে। তাঁর এ-সময়ে (১৯৭১) রচিত নাটকগুলো হচ্ছে – স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম, এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭২ সালে তিনি রচনা করেন বর্ণচোর। তাঁর এসব নাটকে যুদ্ধের নির্মম বস্ত্তময় সত্য চরিত্র-পাত্রের আচরণ ও সংলাপে রূপায়িত হয়েছে। কি চাহ শঙ্খচিল (১৯৮৫) নাটকে পাক হানাদারদের নারী নির্যাতনের মর্মন্তুদ চিত্র রূপায়িত হয়েছে। এ ধারার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছে – আলাউদ্দিন আল আজাদের নিঃশব্দ যাত্রা (১৯৭২) ও নরকে লাল গোলাপ ( ১৯৭৪),  জিয়া হায়দারের সাদা গোলাপে আগুন (১৯৮২) ও পঙ্কজ বিভাস (১৯৮২), নীলিমা ইব্রাহিমের যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মক্তিযুদ্ধ-অবলম্বী মঞ্চসফল কাব্যনাট্য সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ( ১৯৭৬)। মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনাবাহী কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে – কল্যাণ মিত্রের জল্লাদের দরবার (১৯৭২), সাঈদ আহমদের প্রতিদিন একদিন (১৯৭৮), আল মনসুরের হে জনতা আরেকবার (১৯৭৪), রণেশ দাশগুপ্তের ফেরী আসছে প্রভৃতি।

    মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবাদী  ও সংরক্ত চেতনা আমাদের নাটকের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পালাবদল ঘটিয়েছে, সাহিত্যের অন্যান্য আঙ্গিক অপেক্ষা তার প্রভাব অনেক বেশি দূরসঞ্চারী এবং ইতিবাচক। আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখ সে-ধারাকেই পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ করে চলছেন।

 ছয়  

বাঙালির  স্বাধীনতাকামী ও সংগ্রামশীল অস্তিত্বের আত্মপ্রকাশ বিগত চার দশকে বিষয় ও শিল্পরূপের দিক থেকে যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। আমরা জানি, বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভাষা-আন্দোলন তাৎপর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ১৯৪৮ সাল থেকে সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন হিসেবে অঙ্কুরিত হয়ে, ১৯৫২ সালে একটা গণআন্দোলন থেকে ক্রমান্বয়ে গণজাগরণে রূপ নেয় এবং পরিণামে অবরুদ্ধ জাতীয় চৈতন্যের আত্মসন্ধান সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তা সন্ধানের রক্তিম প্রতীকে পরিণত হয়। সময়-পরম্পরায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রাম, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বক্ষত আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার সংগ্রামশীল ও রক্তিম চেতনার রূপ ও রূপান্তরের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। স্বাভাবিকভাবেই মানব-মানবীর   অন্তর-বাহিরের বহুমুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার রূপকল্পসমূহ ওইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়  অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমাদের উপন্যাসের উপকরণ ও বিষয়ের পরিধি যেমন বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি তার শিল্পরীতিও অবলম্বিত জীবনের অনিবার্যতায় স্বতন্ত্র রূপ লাভ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি ও অর্থ-উৎপাদন কাঠামোর রূপ-রূপান্তরের বহুকৌণিক অভিঘাত গ্রাম ও নগরজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে উদ্ভিন্নমান মধ্যবিত্ত ও সংবেদনশীল চৈতন্য এসব অভিজ্ঞতায় আন্দোলিত ও আলোড়িত হয়েছে। জিজ্ঞাসায়-বেদনায়-আর্তনাদে, সংকটে-সংগ্রামে-দ্বন্দ্বে ও দ্বন্দ্বোত্তরণের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বাঙালির সমাজমানস। আমাদের  লেখকরা সমাজজীবনের এই বহুমুখী সত্যকেই রূপ দিয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মে। ফলে বিষয়ের বৈচিত্র্য ও জঙ্গমতায় বিভিন্ন সাহিত্যরূপের গঠনশৈলীতেও সূচিত হয়েছে নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা। লেখকদের আবেগজীবন, ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা, রুচি, অধীতি ও অনুশীলনও এক্ষেত্রে পালন করেছে কার্যকর ভূমিকা। স্বাধীনতা-উত্তরকালের ক্রমবর্ধমান সমাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং মানব-অস্তিত্বের নানামুখী সংকট কবিতা-গল্প-উপন্যাস ও নাটকের বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পরূপকেও প্রভাবিত করেছে। এ পর্যায়ে সাহিত্যেও উপকরণের ক্ষেত্র যেমন বিস্তৃততর হয়েছে, তেমনি সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার বহুলাঙ্গিক প্রকাশ লেখকদের চেতনাকে করেছে দ্বন্দ্বক্ষত ও জটিলতা-আক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধোত্তর চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও গতির রূপায়ণে আমাদের লেখকরা কালোপযোগী চেতনা ও শিল্পরীতিকে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে  গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।