মুঘল বাংলার ক্রন্দন ও অনুষঙ্গ

এস এম সাইফুল ইসলাম

ভারতবর্ষ বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অন্যতম এক পীঠস্থান। এখানেই গড়ে ওঠে অত্যন্ত উঁচুস্তরের বর্ণাঢ্য এক সংস্কৃতি, যা এই অঞ্চলের পরবর্তী বিকাশের ক্ষেত্রে এবং সমগ্রভাবে গোটা প্রাচ্যের, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ও দূরপ্রাচ্যের বহু জাতির সংস্কৃতির অগ্রগতিতে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, বস্ত্তনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত, বিবিধ স্মারকচিহ্ন সংগ্রহ ইত্যাদির ফলে প্রমাণ পাওয়া গেছে, মানবসমাজের একেবারে আদিমকাল থেকেই ভারতবর্ষে জনবসতি বর্তমান ছিল। সেই প্রাচীনকাল থেকেই অনেক  চড়াই-উতরাই, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-পরাজয়, প্রেম-ঘৃণা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ বিকশিত হয়েছে। এসব বিষয়ের প্রতিফলন চিত্রশিল্পে নতুন কিছু নয়, তবে নিঃসন্দেহে চিন্তার সহায়ক।

শিল্পী ফিরোজ মাহমুদের সাম্প্রতিক চিত্রকর্মে ভারতবর্ষের কিছু ঐতিহাসিক বিষয় প্রতিভাত হয়েছে। ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে অনুষ্ঠিত ১৩ থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত মাহমুদের ‘ডিজমাল ক্রাই অব হেরিটেজ’ বা ‘অতীতের বেদনা’ শীর্ষক একক চিত্রকলা-প্রদর্শনীতে সেসবের দেখা মিলেছে। তিনি এ-প্রদর্শনীতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়কালের বিবিধ ঘটনাপ্রবাহকে অনেকটা ইলাস্ট্রেশনধর্মী আমেজের চিত্রপটে প্রকাশ করেছেন। নবাবের চিরপরিচিত প্রোফাইল প্রতিকৃতি, মীর জাফরের সঙ্গে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বিবিধ ষড়যন্ত্রমূলক দেন-দরবার, পলাশীর যুদ্ধ, নবাব ও রানীর দুর্বিষহ দুর্দিন, সেনাপতির যুদ্ধপ্রস্ত্ততি ও রাজনৈতিক কথোপকথনের দৃশ্যসহ নানাবিধ ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতিফলন ঘটেছে মাহমুদের চিত্রকর্মে। ফলে দর্শক কিছু সময়ের জন্য হলেও অতীত ইতিহাসের ভাবনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন।

 তৈমুর লং এবং চেঙ্গিস খানের বংশধর সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর ছিলেন ভারতবর্ষে মহান মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম অভিযানে পানিপথের যুদ্ধ এ-অঞ্চলের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। বস্ত্তত মুঘলদের সুবাদেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নতুন মোড় নেয়। ১৫৩৮ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শেরশাহের নেতৃত্বে যে আফগান রাজত্বের শাসন চলছিল, তার অবসান ঘটে বাবর বংশের মুঘল সম্রাট আকবরের হাতে। বাংলাদেশে এ-সময় ঈশা খান, কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বারো ভুঁইয়ার রাজত্ব চলছিল। এঁরা বাংলায় বারো ভুঁইয়া নামে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন রাজত্ব পত্তন করেছিলেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সুবেদার ইসলাম খান ১৬১৩ সালে বাংলাকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেও সমগ্র পূর্ব বাংলা মুঘলদের সুবা বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয় শায়েস্তা খানের আমলে সতেরো শতকের শেষদিকে। পরবর্তীকালে, প্রকৃতপক্ষে ১৬৮৬ সালেই ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল, ভারত তথা বাংলায় নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ইংরেজদের আগমন ঘটছে। এই সময়ে ইংল্যান্ড থেকে ইংরেজরা নিজস্ব সেনাবাহিনী নিয়ে আসে এবং বিভিন্ন জায়গায় মুঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধে তারা ছোটখাটো যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আপসরফায় ইংরেজরা প্রায় পর্যায়ক্রমে একচেটিয়া বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করতে থাকে। বস্ত্তত এ-সময় মুঘল সম্রাটগণ ভোগ-বিলাসে মত্ত ছিলেন। পাশাপাশি তাঁদের প্রশাসনিক দুর্বলতা, দক্ষ শাসকের অভাব এবং নানা স্থানে প্রচন্ড সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ফলে বিশাল সাম্রাজ্য ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। ১৭১২ সালে বাদশাহ শাহ আমলের মৃত্যুর পর দিল্লির মুঘল দরবার পরিণত হয় ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির আখড়ায়। ফলে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মতো বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাতেও (তখন এই তিন স্থান মিলে ছিল একটি প্রদেশ) একটি স্বাধীন প্রাদেশিক নবাবতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। এই সময় বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁর দক্ষ শাসনব্যবস্থায় (১৭৪০-৫৬) বাংলার সাধারণ মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এদিকে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরে এদিন বাংলার ক্ষমতাসীন শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইংরেজ বেনিয়া ক্লাইভের সেনাবাহিনীর কাছে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে পরাজিত হন। বিদেশি শক্তির সঙ্গে এই ষড়যন্ত্রে হাত মেলান নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলি খান এবং তাঁর আপন খালা ঘসেটি বেগম। নবাব সিরাজকে পরে ষড়যন্ত্রকারীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর এই অকাল ও নির্মম মৃত্যুর ফলে স্বাধীন বাংলা এবং সমগ্র ভারতবর্ষ ইংরেজদের পদানত হয় প্রায় দুশো বছরের জন্য।

বস্ত্তত বাংলার এই ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিই ফিরোজ মাহমুদের চিত্রকর্মের মূল উপজীব্য। চিত্র-প্রকল্পের জন্য যে-কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা, পুরাণ, মহাকাব্য ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত আকষর্ণীয় হতে পারে। তবে তা সর্বদা বাস্তবানুগ ইমেজ দ্বারা সম্ভব – এ-কথা ঠিক নয়। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে বিষয়ের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তি ও যথাযথ আবেগের সম্মিলন না ঘটলে তা স্রেফ একটি নান্দনিক ইমেজে পর্যবসিত হয়। মাহমুদের সৃজনে পরিশ্রম ও একাগ্রতার সুস্পষ্ট ছাপ আছে। নানাবিধ নিরীক্ষায় অর্জিত অভিজ্ঞতা ও কুশলতার প্রাদুর্ভাব আছে। কিন্তু তাঁর কাজে বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে প্রয়োজনীয় আবেগের রসায়নে সৃষ্ট ব্যঞ্জনা প্রায়শ নিখোঁজ রয়ে গেছে। তিনি ইতিহাস ধারণ করেছেন অনেকটা দূর থেকে, একপ্রকার নির্লিপ্ত ও নির্মোহ অভিপ্রায়ে। ফলে ইতিহাসের ভেতরের বহুস্তর বিশিষ্ট অন্য এক ইতিহাসের যে-ডিসকোর্স, সূক্ষ্ম সংকেত, ব্যাপ্তি ও রহস্য তা চিত্রে অনেকটা উপেক্ষিত হয়েছে। চিত্রকর্মের করণকৌশল নিয়ে মাহমুদ নিয়ত নিরীক্ষাপ্রবণ, এ-প্রদর্শনীতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি লেপা পদ্ধতিতে চিত্রিত করেছেন তাঁর ভাবনার বিষয়, অনুষঙ্গ, যা আমাদের গ্রামবাংলায় মাটির ঘরবাড়ির লেপন পদ্ধতিতে লক্ষণীয়। এভাবে চিত্রের জমিন প্রস্ত্ততের পর বিবিধ অনুষঙ্গের স্টেনসিল টেপ দ্বারা আবৃত হয়ে গেলে সুনির্দিষ্ট ড্রয়িং শেষে তা কেটে নিতে হয়। অতঃপর ফাঁকা পরিসরটুকু পুনর্বার রঙের পরতে পূরণ করে নিলেই উদ্ভাসিত হয় ইমেজ। পটভূমির ইলাস্ট্রেশনধর্মী আভাস কমানোর জন্য লেপন পদ্ধতিতে রঙের সংমিশ্রণ করার প্রয়োজন হয়। মাহমুদ অসীম ধৈর্য ও পরিশ্রম সহযোগে এভাবেই সম্পন্ন করেছেন প্রতিটি চিত্রকর্ম। রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমিত উজ্জ্বল রঙের সঙ্গে তিনি সামগ্রিক শীতল আবহকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মুঘল অনুচিত্র, পান্ডুলিপি চিত্র, ডাকটিকিটের চিত্র, মুদ্রার চিত্র, ইলাস্ট্রেশন এবং গ্রাফিক আর্টের কিছু মিশ্ররূপ তাঁর চিত্রকর্মে দেখা মেলে। স্টেনসিলের ব্যবহার অধিক হওয়ায় চিত্রে অনেক ক্ষেত্রে পরিসর বাধাগ্রস্থ হয়েছে, ফলে বেশকিছু ছবির জমিনে প্রয়োজনীয় পরিসরের অভাব অনুভূত হয়। শিল্পী ফিরোজ মাহমুদের চিত্রকর্মে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যে বিষণ্ণ প্রতিফলন ঘটেছে তা অবশ্যই ইতিবাচক, তবে চিত্রশৈলী ও আঙ্গিক নিয়ে তাঁর আরো চিন্তার সুযোগ আছে।