মুনীর চৌধুরীর নাটক ও উত্তরপ্রজন্ম

মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন

বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাভাষা, সাহিত্য,সংস্কৃতির সমৃদ্ধিসাধন এবং জাগরণ-ইতিহাসে সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী শহিদ মুনীর চৌধুরীর কীর্তি সুবিদিত।  তাঁর সৃজনশীল ও মননধর্মী সাহিত্যনির্মাণ এবং জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পমানস গঠনে সক্রিয় ছিল পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, আর্থসামাজিক, রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিক স্তরবহুল ঘটনাপ্রবাহ। সমকাল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ ও মিথাশ্রয়ী জীবনভাবনা তাঁকে করেছে অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক ও বস্ত্তবাদী শিল্পস্রষ্টা। তীক্ষন মননের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল সূক্ষ্ম রসবোধ, যা তাঁর সাহিত্যকর্মকে করেছে প্রাণবমত্ম এবং ভিন্নমাত্রিক। তিনি এদেশের আধুনিক নাট্যকার, সফল অনুবাদক, বিজ্ঞ গবেষক-প্রাবন্ধিক এবং নিপুণ গল্পকার। তবে শেষোক্ত পরিচয়কে খানিকটা আড়াল করে অধিক সমুজ্জ্বল হয়েছে তাঁর নাট্যচর্চা-সম্পর্কিত কার্যক্রম। তিনি একই সঙ্গে নাট্যকার, অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যসংগঠক। বিদগ্ধ এই নাট্যজনের নাটক বর্তমান প্রজন্মের কাছে কীভাবে গৃহীত ও চর্চিত হচ্ছে, সেটাই আজকের বিবেচ্য এবং আলোচ্য বিষয়। আমরা আলোচনার সূচনা করব তাঁর সান্নিধ্যে কারা নাট্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাঁর নাটক কীভাবে গঠিত, অভিনীত ও মূল্যায়িত হচ্ছে ইত্যাদি প্রসঙ্গ দিয়ে।

মুনীর চৌধুরীর নাট্যচর্চার কাল ১৯৪২ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যমত্ম বিসত্মৃত। উলিস্নখিত কালপরিসরে আমাদের নাটক ছিল নানা বাধায় বাঁধা। জাতীয় জীবনের পশ্চাৎপদতা, সমাজের রক্ষণশীলতা, অনুদার মনোভাব এবং নাট্যশালা সৃষ্টির প্রয়াসহীনতাকে অগ্রাহ্য করে যাঁরা নাট্য-উত্তরণের ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন মুনীর চৌধুরী তাঁদের মধ্যে পুরোধা পুরুষ। তখন সারাদেশেই উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক নাট্যগোষ্ঠী নাট্যমঞ্চায়নে মনোযোগী হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্যচর্চাই নাট্য-উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল নাট্যোৎসাহী ছাত্র প্রতিষ্ঠা করেন গ্রম্নপ থিয়েটার মেজাজি গোষ্ঠী ‘ড্রামা সার্কেল’। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-নাট্যকর্মী নুরুল মোমেন ও আসকার ইবনে শাইখের অবদান স্বীকার করেও মুনীর চৌধুরীকেই উচ্চাসনে বসাতে হয়। তাঁর মেধাবী নেতৃত্বে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা মুগ্ধ নাট্যানুরাগী ছাত্রের সংখ্যাই ছিল বেশি। মমতাজউদ্দীন আহমেদ, আবদুলস্নাহ আল মামুন, রামেন্দু মজুমদার, সেলিম আল দীন প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব তার প্রমাণ। মুনীর চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মমতাজউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলা নাটক পাঠের আনন্দ বোধ আমার জাগতই না, যদি না তিনি বাংলা নাটকের ক্ষুদ্র, সামান্য ও অকিঞ্চিৎকর নাট্য ঘটনাগুলো আমার দৃষ্টির মধ্যে এনে দিতেন। তিনিই আমাদের স্বদেশি ও বিদেশি নাট্য বিষয় সম্পর্কে সচেতন করেছেন।… আমি নাটক বানাতে বসে বারবার মুনীর চৌধুরীর কাছে উপস্থিত হই।’ [হৃদয় ছুঁয়ে আছে] আবদুলস্নাহ আল মামুনের ভাষায়, ‘তিনি যে-কোনো নতুনকে, যে-কোনো নবীনকে অভিনন্দন জানাবার, অনুপ্রাণিত করবার এবং আপন হৃদয়ে সেই আধুনিকতা লালন করে আরো তীক্ষনতাদানের আশ্চর্য উদারতা ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।’ [থিয়েটার, মুনীর চৌধুরী স্মারক সংখ্যা] রামেন্দু মজুমদারের স্বীকারোক্তি, ‘আমরা লাভ করেছি তাঁর কাছ থেকে আমাদের অভিনয় জীবনের সত্যিকারের শিক্ষা।’ [ওই] আর সেলিম আল দীনের মূল্যায়ন, ‘ছাত্রজীবনে শ্রদ্ধেয় মুনীর চৌধুরী নাট্যরচনায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতেন এবং আমি স্বয়ং এর সাক্ষী।’ [মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম] অর্থাৎ মুনীর চৌধুরী ছিলেন নাট্যগতপ্রাণ। তিনি নাটক-সম্পর্কিত প্রচুর পড়াশোনা করেছেন; অভিজ্ঞতার আলোকে নাটক লিখেছেন; ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী ও স্বজনদের নিয়ে তা মঞ্চস্থ করেছেন এবং এভাবেই নাটকের প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছেন। মানুষ হিসেবেও তিনি বড়মাপের। অন্যকে সহজেই কাছে টানতে পারতেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের অভিমত, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা সবাই বুঝি জীবন্মৃত। কিন্তু যখন মুনীর চৌধুরীর মতো মানুষের সংস্পর্শে আসি তখন জীবনের অর্থ খুঁজে পাই।’      [থিয়েটার, ওই]

প্রগতিশীল স্বাধীনতাকামী মুনীর চৌধুরীর কার্যক্রম পাকিসত্মানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দল মেনে নিতে পারেনি বলেই ১৯৭১-এ শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যিনি বৈরী পরিবেশে, সীমিত সুযোগে নাট্যচর্চার সুষ্ঠু পথনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, স্বাধীন দেশে সে-পথ যখন আলোকিত হতে থাকে, তখন তিনি কেবলই স্মৃতি, সম্বল শুধু তাঁর রচিত নাট্যরাজি। স্বাধীন দেশে কেউ বলেছেন, যুদ্ধ করে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ, বাংলাদেশে নাটক এলো – যেন হইহই করে রাজার হাতি ছুটে এলো। কেউ বলেন, একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, যাঁরা যুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গে নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরাই বাংলাদেশের নাটকে নতুন বিষয় ও আঙ্গিক আনেন। এ-বক্তব্য অমূলক নয়, আবার পুরো সত্যও নয়। কারণ, পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্, সাঈদ আহমদ আধুনিকমনস্ক ও নিরীক্ষাপ্রিয় নাট্যকার হিসেবে প্রশংসিত হন। তবে তখনো আমাদের পাঠক-দর্শক পুরোপুরি পাশ্চাত্য নিরীক্ষাধর্মী নাটকের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। অ্যাবসার্ড, অসিত্মত্ববাদ, চেতনাপ্রবাহ, অভিব্যক্তিবাদ, স্যুরিয়ালিজম-সম্পর্কিত নাটক তাঁদের কাছে প্রায় অচেনা-অজানা। তাই সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্ ফ্রান্সে একাধিকবার মঞ্চস্থ হওয়া উজানে মৃত্যুর মতো আরো আটটি নাটক লিখতে চেয়েছিলেন, অথচ এদেশে নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়া তো দূরের কথা, অনেকে পড়েও দেখেননি জানতে পেরে হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু মুনীর চৌধুরী ছিলেন সর্বদা আশাবাদী। তিনি দেশের সহজ-সরল মানুষকে ভালোভাবেই জানতেন। তাই বিশ্বনাটকের কলাকৌশল সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়েও নাটকে সরাসরি তার প্রয়োগ করেননি। তিনি দেশের ইতিহাস, পুরাণ, ঐতিহ্য, মিথ ও সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ নির্দিষ্ট মাত্রায়, সুনিপুণ দক্ষতায় কোনো কোনো নাটকে প্রয়োগ করেছেন। তাঁর এ-নাট্যসৃষ্টি বিষয়ের গুরুত্বে ও শিল্পগুণে কালোত্তীর্ণ। তাঁর অবিস্মরণীয়, শুদ্ধচেতনাসঞ্চারী ও ‘দৃষ্টি উন্মোচনকারী’ নাটক কবর। তাই ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এ-নাটকের গুলিবিদ্ধ লাশের কণ্ঠে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, ‘আমরা কবরে যাবো না। আমরা বাঁচবো।’ এই বাঁচা-লড়াইয়ের ফলেই একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জন। এখানেই প্রজন্মের পর প্রজন্মব্যাপী মুনীর চৌধুরীর নাটক গুরুত্ব বহন করে আসছে। একুশে ফেব্রম্নয়ারি এলেই আজো আমাদের ফিরে যেতে হয় কবর নাটকের কাছে, হতে হয় উজ্জীবিত।

মুনীর চৌধুরী সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। মানবিক উদার চেতনাকে লালন করেছেন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মুসলমানদের যে-বিজয় হয়, তাঁকে দিয়ে সেই বিজয়গাথা রচনার চেষ্টা হয়েছিল। তিনি সেই যুদ্ধকে প্রেক্ষাপটে রেখে রক্তাক্ত প্রামত্মর নাটকে যুদ্ধবিরোধী ও হৃদয়বৃত্তিক চেতনার প্রাধান্য দিয়েছেন। গতানুগতিক ঐতিহাসিক নাট্যধারা-বহির্ভূত, মিথ্যাশ্রয়ী ট্র্যাজেডিধর্মী নাটকটি কবরের মতোই নবোদ্ভূত আঙ্গিকে গঠিত এবং সমকাল অতিক্রমী নন্দিত শিল্পকর্ম।

মুনীর চৌধুরী গুণী শিক্ষক, ছাত্রদের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। তিনি ছাত্রছাত্রীদের মান-অভিমান, আনন্দ-বেদনা, স্নেহ-ভালোবাসার আলোকে রচনা করেন নাটক চিঠি, আপনি কে?, দ-ধরদ-কারণ্য নাট্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন ছাত্রছাত্রীদের ‘কোমল কঠিন করে’। নাটক রচনার পর তিনি সমমনা সহকর্মী, ছাত্র ও স্বজনদের পড়ে শোনাতেন। শ্রোতাদের খোলামেলা মতামত প্রত্যাশা করতেন। রণেশ দাশগুপ্ত ও মমতাউদ্দীন আহমেদ কবর নাটকের শেষাংশ মূল নাটকের উত্তাপকে খানিকটা শীতল করেছে বলে মমত্মব্য করেন। উদারচেতা মুনীর চৌধুরী এর উত্তরে বলেন, প্রয়োজন হলে প্রযোজক নাটকের শেষাংশই বর্জন করতে পারেন।

মুনীর চৌধুরী মৌলিক নাটক রচনার পাশাপাশি বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও রূপামত্মর করেছেন। এ-পর্যায়ের নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁর গভীর জীবনবোধ, নিখুঁত শিল্পদৃষ্টি ও আধুনিক নাট্যজ্ঞানের পরিচয় মেলে। পাশ্চাত্য নাট্যকলা সম্পর্কে বাঙালি নাট্যকর্মীদের অবগত করানো এবং বাংলার নাট্যমঞ্চকে সমৃদ্ধকরণের অভিপ্রায়ে তিনি অনুবাদ-রূপামত্মরকর্মে মনোযোগী হন। তাঁর অনূদিত-রূপামত্মরিত নাটক বেতার-টেলিভিশনে অভিনীত হয়, পাঠক-দর্শকপ্রিয়তা পায়। তুলনামূলক বিচারে দেখা গেছে, যদি একই নাটক মুনীর চৌধুরীসহ দু-তিনজন অনুবাদ-রূপামত্মর করেন, সে-ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীর অনুবাদ-রূপামত্মরই শ্রেয় বিবেচিত হয়েছে। ট্র্যাজেডির চেয়ে কমেডি নাটকের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। শেক্সপিয়র, বার্নার্ড শ, গল্সওয়ার্দি, স্ট্রিন্ডবার্গ প্রমুখ নাট্যকারের নাটক তাঁর অনুবাদ-রূপামত্মরের অমত্মর্ভুক্ত হয়েছে। বর্তমানে মুনীর চৌধুরীর উত্তরসূরি বহু অনুবাদক বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলাভাষায় নাটক অনুবাদ-রূপামত্মর করছেন। ফলে বাংলা নাট্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে।

মুনীর চৌধুরী ছিলেন নাট্যসংগঠক ও নির্দেশক। তাঁর অনুপ্রেরণায় নারী শিল্পীরা মঞ্চে আসেন। স্ত্রী লিলি চৌধুরী ও বোন ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর হাতেই গড়ে ওঠা নন্দিত শিল্পী। তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তরা প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যগোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে থিয়েটার গোষ্ঠী বাংলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ করে অমর নাটক কবর। ফেরদৌসী মজুমদারের নির্দেশনায় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পাবলিক লাইব্রেরিতে মঞ্চস্থ হয় চিঠি নাটক। পরবর্তীকালে এ-নাটক মঞ্চস্থ করে থিয়েটার স্কুল। আশির দশকে ‘থিয়েটার’ মঞ্চে আনে ওথেলো। ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম নাটক একতালা দোতালা মুনীর চৌধুরীর রচনা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রচার করে তাঁর মুখরা রমণী বশীকরণ

১৯৭২ সালে ‘থিয়েটার’ গোষ্ঠীর নাট্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা থিয়েটার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ‘মুনীর চৌধুরী স্মারক সংখ্যা’ হিসেবে। এ-গোষ্ঠী ১৯৮৯ থেকে গুণী নাট্যজনদের ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’ পদক প্রবর্তন করে। মুনীর চৌধুরীর নাটক এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে কবর, উচ্চ মাধ্যমিকে রক্তাক্ত প্রামত্মর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে তাঁর নাটক পড়ানো হয়। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা নোটনির্ভর পড়াশোনাতে অভ্যস্ত হওয়ায় মুনীর চৌধুরীর নাটকের প্রকৃত শক্তি-সাফল্য সম্পর্কে সঠিক অবগত হচ্ছে না। অন্যদিকে গবেষক-প্রাবন্ধিকবৃন্দ তাঁর নাট্যকর্ম মূল্যায়ন-বিশেস্নষণে অধিক আগ্রহী হচ্ছেন। মুনীর চৌধুরী সম্পর্কিত এ-যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : আনিসুজ্জামানের মুনীর চৌধুরী [১৯৭৫], কবীর চৌধুরীর মুনীর চৌধুরী [১৯৮৭], জিয়াউল হাসানের মুনীর চৌধুরীর নাটক [১৯৯০], মোহাম্মদ জয়নুদ্দীনের মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম [১৯৯৮, ২০০৯] এবং মো. ফরহাদ হোসেনের বাংলা নাট্যসাহিত্যে মুনীর চৌধুরীর অবদান [২০০৮]। শেষোক্ত গ্রন্থদুটি পিএইচ-ডির অভিসন্দর্ভ।

মুনীর চৌধুরীর অমত্মর্দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ এবং বহুদূরপ্রসারী। তাই তাঁর নাটকের বিষয়মূল্য অসীম-মানবকল্যাণকর, সাহিত্যগুণান্বিত ও চিরায়ত। নাটকের আঙ্গিকে নতুনত্ব আছে, তবে মঞ্চায়ন পরিকল্পনা আড়ম্বরহীন। সংলাপ রচনায় তাঁর সাফল্য তুলনারহিত। অসাধারণ নাটকীয়তাযুক্ত, বেগবান, বুদ্ধিদীপ্ত, বিদ্রূপ ও হাস্যরসাত্মক এ-সংলাপ। কাজেই বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁর নাটকসমূহ অভিনন্দিত হওয়ারই কথা।

তবে সময়ের পরিবর্তনে নাট্যকলারও পরিবর্তন ঘটছে। আধুনিক থেকে উত্তর-আধুনিক ভাবনা নাটককে অধিক সমৃদ্ধ করছে। মঞ্চায়নরীতিতে আসছে আমূল পরিবর্তন। নাট্যগীতি ও লোককলার অপূর্ব মিশ্রণে নাটক নবরূপ পাচ্ছে। পরিবর্তিত পাশ্চাত্য নাট্যরীতির সঙ্গে এদেশের নাট্যকর্মীরাও আজ একাত্ম। তাই মুনীর চৌধুরীর নাটক মঞ্চায়নে বর্তমান প্রজন্মকে তেমন আগ্রহী মনে হচ্ছে না। তবে তাঁর নাট্যসাহিত্যের ঘটনাবৃত্ত, চরিত্রগঠন, ভাষার ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করার মতো স্পর্ধা কারো নেই। মুনীর চৌধুরীর নাট্যপ্রেরণা ছিল বলেই মমতাজউদ্দীন আহমেদ, আবদুলস্নাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীনের মতো নাট্যকার পেয়েছি, পেয়েছি আতাউর রহমান, আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদারের মতো দক্ষ অভিনেতা-নির্দেশক এবং পেয়েছি নাগরিক, থিয়েটার, নাট্যচক্র, ঢাকা থিয়েটার, পদাতিকের মতো অসংখ্য নাট্যগোষ্ঠী ও নাট্যকর্মী – যাঁরা গ্রম্নপ থিয়েটারের আদর্শে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ গ্রম্নপ থিয়েটার ফেডারেশন আজ বিশ্বনাট্য সংস্থার অন্যতম সদস্য এবং বর্তমান বিশ্বনাট্য সংস্থার সভাপতি মুনীর চৌধুরীর স্নেহধন্য রামেন্দু মজুমদার।

মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, আমরা সেই নাটক চাই, যে-নাটক আমাদের নাড়াতে পারে, বাড়াতে পারে। আজ শহিদ মুনীর চৌধুরী আমাদের মাঝে নেই, আছে তাঁর অবিনাশী নাট্যকর্ম। প্রত্যাশা রাখি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর নাট্যকর্মকে লালন করে নিজেদের বিকশিত করতে সমর্থ হবে। r