মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা, এস. ওয়াজেদ আলি ও নজরুল ইসলাম

হাবিব রহমান
উনিশ শতকের উপান্তে এসে বাংলার হতচেতন মুসলমান সমাজের অতিক্ষুদ্র শিক্ষিত অংশটি আত্মসম্বিৎ ফিরে পেয়ে যখন জাগরণের এষণায় সচেষ্ট হয়ে উঠছে, তত দিনে হিন্দু সমাজ শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিত্ত-বৈভবে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটির দুরবস্থা তাদের চিন্তা-চেতনায় বিশেষ কোনো স্থান পায়নি। এমতাবস্থায় জাগরণকামী মুসলিম লেখক-বুদ্ধিজীবীরা উপলব্ধি করেছেন যে, উন্নতি করতে হলে তাদের স্বতন্ত্রভাবে ও স্বতন্ত্র পথেই তা করতে হবে। একে তারা বলেছেন মুসলমানের জাতীয় উন্নতি। এই উন্নতির একটা বড় উপায় মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা। এই সাহিত্য বিষয়ে ও প্রকরণে হবে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সংস্কৃতি-নির্ভর। বাঞ্ছিত এই সাহিত্যকে কেউ বলেছেন ইসলামি বা মুসলিম সাহিত্য, আবার কেউ বলেছেন মুসলমানের জাতীয় সাহিত্য। পুরো ব্রিটিশ শাসনকাল, এমনকি পাকিস্তান আমলে এসেও এই মনোভাব যথেষ্ট জোরালো ছিল।
এই মনোভাবের পেছনে যে দুটো বড় কারণ ছিল তার একটি হচ্ছে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা তথা অতিমাত্রায় ধর্মার্ততা, আর অন্যটি হচ্ছে ভয়। ভয় এ-কারণে যে, এ থেকে বিচ্যুত হলে, দেশীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করলে কিংবা দুই সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনের প্রয়াস পাওয়া হলে হিন্দু সংস্কৃতি তাদের গ্রাস করে ফেলবে। সেটা হবে আত্মঘাতী। এ মনোভাবের বাইরে যে কেউ ছিলেন না তা নয়, কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। অধিকাংশই ছিলেন প্রবল ধর্মবোধ দ্বারা তাড়িত। এদের মধ্য উচ্চশিক্ষিত বড়মাপের মানুষও ছিলেন। যেমন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও এস. ওয়াজেদ আলি। এরা দুজনই নিজেদের বাঙালি পরিচয়ে কুণ্ঠিত তো ছিলেনই না, বরং এ নিয়ে প্রশংসনীয় রচনাও লিখেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনিবার্যভাবে তাঁরা আত্মবিরোধের শিকার হয়েছিলেন। বর্তমান রচনায় নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে এস ওয়াজেদ আলির কিছু কর্মকাণ্ড ও কবি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন থেকে এই আত্মবিরোধের পরিচয়দানের প্রয়াস পাওয়া হয়েছে।
সমকালে নজরুল সম্পর্কে তাঁর নিজের সমাজে মোটাদাগে চিহ্নিত দুই ধরনের মনোভাব ক্রিয়াশীল ছিল – একদিকে অনুরাগ, অন্যদিকে বিরাগ। বিরাগীরা নজরুলকে যা ইচ্ছে তাই বলে গালাগালি করতেন। তাঁকে শায়েস্তা করার হুঙ্কার দিতেন। এস. ওয়াজেদ আলি ঠিক হুঙ্কার দেননি, তবে একটা গল্প ফেঁদে তাঁর মতো সংস্কৃতি সমন্বয়ধর্মী কবির ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
১৯২৮ সালের কথা। নজরুল তখন সওগাত পত্রিকায় কর্মরত। তাঁর অনুরাগী সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ও ‘সওগাত সাহিত্য মজলিশে’র উদারপন্থী সভ্যবৃন্দ নজরুল ইসলামকে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সংবর্ধনা আয়োজনের লক্ষ্যে একটি অভ্যর্থনা সমিতি গঠনের জন্য সাপ্তাহিক সওগাতে অক্টোবরের ৫ তারিখে ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরে এক জনসভায় যোগদানের আমন্ত্রণপত্র মুদ্রিত হয়। তাতে ওয়াজেদ আলির স্বাক্ষরও ছিল। তিনদিন পর ৯ অক্টোবর কলকাতা মাদ্রাসার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বিরোধীদের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত সভায় যে-অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হয় তার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় ওয়াজেদ আলিকেই। তিনি তখন কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। বিএ (ক্যান্টাব), বার-অ্যাট্-ল ডিগ্রিধারী চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক এই ব্যক্তিত্ব কলকাতার মুসলিম সমাজে ছিলেন খুবই মান্যগণ্য ও সম্মানিত। নজরুল সংবর্ধনার অভ্যর্থনা সমিতির তাঁরই সভাপতি হওয়ার কথা। যা-ই হোক, কিঞ্চিদধিক এক বছর পর ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর (২৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৬) এলবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনিই মানপত্র পাঠ করেন। এটি কে লিখেছিলেন জানতে পারিনি, কিন্তু ‘গুণমুগ্ধ বাঙালীর পক্ষে নজরুল সংবর্ধনা সমিতির সভ্যবৃন্দের দেওয়া এই মানপত্রে স্বাভাবিকভাবেই নজরুল প্রতিভার উচ্ছ্বসিত ও সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়  – ‘তোমার অসাধারণ প্রতিভার অপূর্ব অবদানে বাঙালীকে চিরঋণী করিয়াছ তুমি। আজ তাহাদের কৃতজ্ঞতাসিক্ত সশ্রদ্ধ অভিনন্দন গ্রহণ কর।’
এর ঠিক এক মাসের মধ্যে মওলানা আকরম খাঁর মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় এস. ওয়াজেদ আলির ‘বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য-সাধনার পথ’ শীর্ষক একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে তাঁর বক্তব্যের সারাৎসার হচ্ছে – মুসলিম সাহিত্যিকদের উচিত ইসলামি বা মুসলিম সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে সাহিত্য রচনা করা। হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় তিনি সমর্থন করেন না। কেন করেন না তা দেশ-বিদেশের সাহিত্যের আদর্শ থেকে দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন। প্রাচীন গ্রিক, ভারতীয়, এমনকি একালের ইউরোপীয় তথা ইংরেজি সাহিত্যেও চসার, শেক্সপিয়র থেকে বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস পর্যন্ত সকলেই ‘জাতির ইতিহাস এবং Tradition ধর্ম এবং রাজনৈতিক আদর্শ আচার এবং অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টি করে আসছেন।’
এখানে একটা কথা বলতেই হয়, আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের উপকরণ গৃহীত হয়েছে গ্রেকো-রোমান প্যাগান সংস্কৃতি থেকে। এ তথ্য ওয়াজেদ আলির অজানা থাকার কথা নয়। কেন সে-বিষয়টি তিনি অনুল্লেখ রাখতেন তা বুঝতে পারা বোধকরি অসম্ভব নয়। তারপর আসে মানুষের ইউনিভার্সাল বা বিশ্বজনীন সত্তার কথা। ওয়াজেদ আলি তাকে খুবই মানেন এবং বলেন যে, বিশ্বজনীনতার অংশ যে-সাহিত্যে যত বেশি থাকবে, সে-সাহিত্যের মূল হবে তত বেশি। তবে এখানে একটা কথা আছে; সেই ‘বিশ্বজনীন ভাবকে প্রকাশ করতে হবে তার বিশেষ কালচারের বহিরাবরণের মধ্য দিয়ে; আত্মপ্রকাশের অন্য কোনো সুষ্ঠুতর এবং যোগ্যতর উপায় তার নাই।’ নিজস্ব সংস্কৃতির ‘বহিরাবরণের মধ্যে দিয়ে’ বিশ্বজনীন ভাব প্রকাশের এই উপায়টির স্বরূপ অনুধাবন সহজ নয়। সে যা-ই হোক, ওয়াজেদ আলির মত হচ্ছে, হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে ঘটাতে চাওয়া হলে মুসলমানের জীবনে সর্বনাশ ঘটবে। কী সেই সর্বনাশ তা তিনি আবুল হুসেনের ‘তরুণের সাধনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ (সওগাত, আষাঢ় ১৩৩৬) ও নজরুলের কবিতার দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। প্রাসঙ্গিকতার কারণে এখানে কেবল নজরুল সম্পর্কে তাঁর মতামত তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন –
আমাদের প্রতিভাশালী কবি কাজী নজরুল ইসলামই হিন্দু-মুসলিম কালচার সমন্বয়ের এই অপূর্ব স্বপ্নটি দেখেছেন। তার সাহিত্য সাধনার ধারা দেখে মনে হয়, … হিন্দু পৌত্তলিকতার সঙ্গে ইসলামের তৌহিদকে মিলিয়ে তিনি নূতন একটা কিছু সৃষ্টি করতে চান।… মনে হয়, হিন্দু পুরাণই হবে তাঁর প্রস্তাবিত কালচার-খিচুড়ির প্রধান উপকরণ, আর তাকে মুসলমানের মুখরোচক করবার জন্য ইসলামিক কালচারের একটা ফোড়ন দেওয়ার ব্যবস্থা হবে মাত্র।
এই সেদিনের (১৮ই আশ্বিন ১৩৩৬) নবশক্তিতে দেখলুম কাজী সাহেব দুর্গতিনাশিনী, দশপ্রহরণধারিণী, দশভুজা মার এক বন্দনা গান গেয়েছেন। সে বন্দনায় নব ভারতের নব পূজারী দল কাজী সাহেবের মুখ দিয়ে বলছেন, ‘চাই না তোর শুভদ আশীষ (আশিস), চাই শুধু ঐ চরণতল।’ ‘যে চরণে তোর বাহন সিংহ, মহিষ, অসুর মথিয়া যাস’ ইত্যাদি। তারপর কবির ‘রক্তাম্বরধারিণী মার’ বন্দনার কথাও পাঠক শুনেছেন। …
অনেক শিক্ষিত লোককে বলতে শুনেছি, কাজী সাহেবের লেখাকে উচ্ছ্বাস (Poetic effusion) হিসাবেই দেখা উচিত। তার অধিক কোনো গুরুত্ব তাকে দেবার দরকার নাই। দুঃখের বিষয় আমি তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। কাজী সাহেব একজন শক্তিশালী লেখক। নিজের লেখাকে তিনি যথেষ্ট Seriously নেন, আর তাঁর স্তাবকেরা তাঁর চেয়েও Seriously নিয়ে থাকে। আর তাঁর স্তাবক এবং পাঠকের সংখ্যাও নিতান্ত অল্প নয়। সুতরাং তিনি যে Principle বা উসুলের উপর সাধনা করছেন এবং অন্যকে করতে আহ্বান করেছেন, তার দোষ-গুণ বিচার করার প্রয়োজন আছে।
এরপরই ওয়াজেদ আলি একটা গল্প ফেঁদেছেন। গল্পটি খুব সংক্ষেপে এরকম; একবার আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে জাহাজডুবিতে বেঁচে-যাওয়া এক ইংরেজ সমুদ্রের তীরে বসতি স্থাপন করে। কাছেই বাস করতো নরখাদক কাফ্রি সম্প্রদায়। প্রথম দিকে দুই দলে সংঘর্ষ চলতে থাকে। কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে না পেরে শেষে আপসের মাধ্যমে তাদের মধ্যে মিতালি স্থাপিত হয়। উভয় দলের ভাবপ্রবণ তরুণদের কেউ কেউ দুই বিরোধী সংস্কৃতিকে মিলিয়ে ব্যাপকতর এক সভ্যতা সৃষ্টির স্বপ্ন দেখতে থাকে। ইংরেজ দলের এক তরুণ কবি মিলনের এক অপূর্ব আদর্শ তার সমাজের সামনে হাজির করে। কিন্তু সে-আদর্শ নিজেদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব স্বেচ্ছায় বিলোপ সাধনেরই নামান্তর। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত তেলে-জলে মিশ খায়নি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকানরা ইংরেজদের ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আর সেই কবি নির্মমভাবে নিহত হয়েছে তার নিজেরই সমাজের হাতে। কাফ্রি নেতারা পরম আয়েশে পুদিনার চাটনি দিয়ে নিহত কবির মাংস ভক্ষণ করেছে।
এই গল্পের অন্তর্মূলে যে কেবল রসিকতা নয়, প্রচ্ছন্ন কিন্তু তীব্র বিদ্রƒপ রয়েছে তা না বললেও চলে। মনে স্বতঃই প্রশ্ন জাগে, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ও মানপত্র পাঠক আর এই প্রবন্ধের লেখক কি একই ব্যক্তি? তিনি কি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক হিসেবে সমাজের মুখরক্ষা অথবা নিজের প্রতিষ্ঠাগত অবস্থান বজায় রাখার জন্য ওই মানপত্র পাঠ করেছিলেন, যার অনেক বক্তব্য হয়তো তিনি সমর্থনই করেন না? আরো বিস্মিত হতে হয় মাসিক গুলিস্তা পত্রিকার নজরুল সংখ্যায় (১৩৫২) কবির গান সম্পর্কে তাঁর এই মূল্যায়নটি পাঠ করলে –
সংগীতে নজরুল বাংলাদেশে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন। নজরুল-গীতি নিজ গৌরবে এ দেশে এক অতি গৌরবের স্থান অধিকার করে আছে এবং চিরকাল থাকবে। আধুনিক সংগীতকলা যে নজরুলের কাছে কতটা ঋণী তা সুর-শিল্পী ও সুর-রসিকেরা খুব ভালো করেই জানেন। এ কথা আমরা জোরের সঙ্গে বলতে পারি যে, নজরুল জন্মগ্রহণ না করলে বাংলার সুর-শিল্প তার বর্তমান গৌরবময় অবস্থায় পৌঁছতে পারত না।
এই মূল্যায়নের যাথার্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই সত্য; কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে এ-প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, নজরুলের যে-জাতীয় কবিতা সম্পর্কে ওয়াজেদ আলির আপত্তি, সেই জাতীয় গানও তো তিনি কম লেখেননি। শিব-পার্বতী, রাধা-কৃষ্ণ, কালী প্রভৃতি ভারতীয় পুরাণ বা হিন্দু-ধর্মাশ্রিত বিষয়ক গান সম্পর্কে লেখক কিন্তু নীরব। বোঝা যায়, অনেক মুসলিম লেখক-বুদ্ধিজীবীর মতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত এস ওয়াজেদ আলিও আত্মবিরোধকে এড়াতে পারেননি। বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ইতিহাস আলোচনায় তাঁদের এই মানস-বৈশিষ্ট্যটিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেননা সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের যে-সংকটে তাঁরা দীর্ঘকাল ভুগেছেন এবং এখনো কেউ কেউ ভোগেন, এ তারই সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।