মৃত্যুর নীলপদ্ম

সেলিনা হোসেন

দুদিন ধরে হামিদের স্ত্রী হাসপাতালে।

মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে। প্রসবের লক্ষণ নেই। থেকে-থেকে ব্যথা উঠছে শুধু। তাও তেমন ব্যথা নয়। তীব্রতা নেই।

সিস্টারকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ডাক্তার বলেছেন আর একদিন দেখবেন। না হলে অপারেশন করতে হবে।

অপারেশন!

শব্দটি কানে ঢুকলে নিজের পকেটের ওপর হাত চলে যায়। দুমাস ধরে চাকরি নেই। গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ। ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা এনেছে। এ দিয়ে চিকিৎসা হয় না, তায় আবার অপারেশন – ও বড় করে ঢোক গেলে।

গাইনি ওয়ার্ডের পেছনের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ায় হামিদ। সিগারেট টানে। ভাত খেতে না পেলেও সিগারেট চাই। অন্য খাবার না খেয়ে সিগারেটের জন্য যত্ন করে টাকা বাঁচায়। নিজেকে আড়াল করার এটি একটি নিরাপদ জায়গা। অন্তত ও তাই মনে করে।

কারণ এখানে নবজাতক মৃত মানবশিশুর স্তূপ জমে। প্রতিদিনই এমন কয়েকজনকে প্রথমে এখানে ফেলা হয়, জন্মের আগেই তাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এবং তাদের চোখ বোজা থাকে। তারা কেউ না। পরিচয়ের ঊর্ধ্বের মানবসন্তান। মর্গে নিয়ে যেতে দেরি হলে তাদের শরীর থেকে গন্ধ ছড়ায়। দুর্গন্ধ। মাঝে মাঝে সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে হামিদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসে এই গন্ধ মিশে যায়। সেটা হামিদের হৎপিন্ড পর্যন্ত পৌঁছে

যায়। না, ওর থুথু আসে না। জগৎ-সংসার ওর সামনে ভেঙে পড়ার আগে ও গলিত শবের চেহারা এই শহরের মানুষের মুখমন্ডলে দেখতে পায়। সিগারেটটা দূরে ছুড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, সবকিছু পুড়ে যাক।

এখানে দুদিন ধরে দাঁড়িয়ে-বসে থাকার সময় ও খেয়াল করেছে, মৃত নবজাতকের লাশ একসময় মর্গে যাবে। সেখান থেকে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে করে যাবে যে-কোনো কবরস্থানে।

আবার একটি সিগারেট জ্বালায় হামিদ। ওর মাথার ভেতরে বিচিত্র ঘূর্ণি। ভাগ্যিস আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নামে একটি সংগঠন ছিল! কিন্তু কেমন করে নিজ সন্তানকে বেওয়ারিশ বানিয়ে ফেলে প্রিয়জনেরা! কেমন করে সম্ভব হয়! হামিদ আবার পকেটে হাত দেয়। খুঁতি খালি থাকলে মানুষ অনেক কিছু পারে না। ও নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।

মানুষের সাধ্য নিয়ে মানুষকে প্রশ্ন করা ঠিক নয়। হামিদ গভীর মনোযোগ দিয়ে মৃত নবজাতকের স্তূপের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূর থেকে মনে হয় আবর্জনার স্তূপ। এই শহরের যত্রতত্র যেমন  আবর্জনার স্তূপ থাকে, তেমন। কাছে এলে শরীর স্পষ্ট হয়।             হাত-পা-মাথা-চুল-বুক-পিঠ ইত্যাদির আকার ঠিক থাকা শিশু। পেটে মরে গেলে বাবা-মা ফেলে রেখে যায়। খুব কম বাচ্চাই বাবা-মায়ের যত্নে কবরে যায়।

কবর একটি নিষ্ঠুর জায়গা।

নাকি শান্তির?

হামিদ সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। ও এমনই। ওর সিদ্ধান্ত নিতে খুব সময় লাগে। কখনো ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। টানাপড়েনে চ্যাপ্টা হয়ে থাকে।

সিস্টারের অনুমতি নিয়ে ফিরোজাকে দেখার জন্য ওয়ার্ডে ঢোকে। বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে আকস্মিকভাবে ওর মনে হয়, ফিরোজার চোখজোড় নিভুনিভু বাতির মতো টিমটিম করছে। ও হাত ধরে নাড়া দেয়।

তুমি?

কেমন লাগছে?

জানি না।

বাচ্চাটা নড়ছে তো?

বুঝতে পারছি না।

পেটে লাখি দেয় না?

কে জানে।

ভাত খেয়েছ?

হ্যাঁ। তুমি খেয়েছ?

না। টাকা বাঁচিয়েছি।

ধোঁয়া ওড়াওনি?

উড়িয়েছি।

তাহলে আর কি পয়সা বাঁচল!

ফিরোজা অন্যদিকে মুখ ফেরায়।

রাগ করলে?

না। কত আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে, বাড়ি যাও।

বাচ্চার কান্না শোনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। ওর কান্নার প্রথম শব্দ আমি শুনব।

তুমি তো শুনতে পারবে না। আমি শুনব।

ঠিক আছে শোন। ওর যতক্ষণ কান্না শুনতে পাব না, ততক্ষণ আমি মরা বাচ্চাগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকব।

মরা বাচ্চা! ফিরোজার মাথা বালিশে এলিয়ে যায়। সিস্টার এসে ওকে বাইরে যেতে বলে। হামিদ বেরিয়ে আসে।

ভীষণ খিদে পেয়েছে। সেই সকালে ভাইয়ের বাসা থেকে রুটি আর আলুভাজি খেয়ে বের হয়েছে। সারাদিনে আর কিছু খাওয়া হয়নি।

ও বাইরে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে পানি খেয়ে আসে। দেখতে পায় মর্গের সামনে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি। কোনো বেওয়ারিশ লাশ নিতে এসেছে। যাদের সবাই আছে দূরে কোনো গায়ে তারা কোনো কারণে বেওয়ারিশ হয়ে যায়। দুর্ঘটনা, হত্যা কিংবা আত্মহত্যায় মরে যাওয়া মানুষ বা গুম করে মেরে ফেলা। ওহ; মৃত্যুর কত ধরন। শুধু ওরা কিছু বুঝতে পারে  না, যারা পেটের ভেতরে দুচোখ বোজে। ওরা ওয়ারিশ কি বা বেওয়ারিশ কি।

হামিদ দাঁড়িয়েই থাকে।

আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের লোকেরা লাশের জন্য কাফনের কাপড় কাটে। কাফন পরিয়ে নিয়ে যাবে গোরস্তানে।

হামিদ গাড়ির পাশ থেকে সরে যায়। খানিকটা দূরে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর পকেটে একটাও সিগারেট নাই। দিয়াশলাইও না। মেজাজ চড়তে থাকে। মাটির ওপর লাথি দিয়ে বলে, এই সংসার একটা অশান্তির জায়গা। শালা, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাবো।

ও গাছতলায় রাত কাটিয়ে দেবে বলে ভাবে। একটা বনরুটি খাবার জন্য দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। আবার ওর ভেতরে চড়চড়িয়ে ওঠে বিশাল ক্রোধ বিশ্ব-সংসারের বিরুদ্ধে। এবং ও এই সিদ্ধান্তে আসে যে, পেটের মধ্যে মরে যাওয়া বাচ্চাগুলোকে বেওয়ারিশ করার মধ্যে কোনো দোষ নেই! মরেই তো গেছে, তার আবার ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ কি! হাঃ! হামিদ দাঁতের নিচে বনরুটি পেষে। ও নিজেই তো এখন একজন বেওয়ারিশ মানুষ। বেঁচে থাকার জন্য কোনো ওয়ারিশ নাই।

রাত করে ভাইয়ের বাসায় ফেরে। ভাবির আগুনে-চোখ দেখে মিনমিনিয়ে বলে, আমি খেয়ে এসেছি।

কোথায়?

হোটেলে।

তোমার বউ কেমন আছে?

বিকেলের দিকে চোখ দেখে কেমন জানি মনে হয়েছিল।

মানে? কী বলছ তুমি?

ভাবির ধমকে কণ্ঠস্বর মিনমিনে হয়ে যায়।

মানে আর কী, মনে হলো তাই বললাম। আমার দিকে যখন তাকাল, মনে হলো আমাকে দেখতে পাচ্ছে না।

ডাক্তারকে বলোনি?

না। ডাক্তার আর কী –

একটা  আজব লোক তুমি। সকালে উঠেই হাসপাতালে যাবে। আমি বিকেলে যাব।

আপনি যাবেন?

হ্যাঁ, কেন না?

না মানে, আমাদের এই বাড়িতে থাকা আপনার খুব পছন্দ ছিল না তো, সেজন্য।

হ্যাঁ, ছিলই না তো। কে ঝামেলা সহ্য করতে চায়।

ও, তাই তো। তাই তো। আমিও কোনো ঝামেলা সহ্য করতে পারি না। আমার অনুরোধ, আপনি হাসপাতালে যাওয়ার ঝামেলা সহ্য করবেন না। কী দরকার? আমি একা থাকলেই হবে।

ও তাই। তাহলে তাই করো।

হামিদ ঘুমুতে যায়। যে-কাপড় পরে ছিল, সে-কাপড়েই শুয়ে পড়ে। সকালে উঠে সে-কাপড়েই বেরিয়ে যাবে। সময় নষ্ট করার দরকার কী? জীবন নিয়ে নতুন চিন্তার আর কোনো সম্ভাবনা খুঁজে পায় না হামিদ। যে-শহরে মৃত নবজাতকরা স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে এবং বেওয়ারিশ হয়ে যায়, তার আর নতুন-পুরাতন জীবন কী?

ও বুঝে যায়, আজ ও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে। যা ভাবা তাই হয়। ও নিবিড় ঘুমে পুরো রাত পার করে দেয়। ঘুম ভাঙার পরে মনে হয়, ভাবির কাছ থেকে রুটি আর আলুভাজি খেতে হবে। নইলে সারাদিন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে থাকবে কী করে? আর যদি ডাক্তার অপারেশনের কথা বলে, তার কী হবে?

ঘুমভাঙা চোখে একা-একা হো-হো করে হাসে হামিদ। আজ একটি মজার দিন হবে। ডাক্তার যদি ওকে অপারেশনের কথা বলে, তাহলে হাসপাতালের সবার সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে ও। কেউ ওকে খুঁজে পাবে না। কত লুকোনোর জায়গা আছে, তা তো ও এই দুদিনে দেখেছে। পালানোর জায়গা খোলা আছে।

নাস্তা খাওয়ার সময় বড়ভাই জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার কী বলছে?

অপারেশন লাগতে পারে।

অপারেশন?

বড় ভাইয়ের দুচোখে আতঙ্কিত দৃষ্টি। হামিদ মিয়া একমুহূর্ত ভাইয়ের চোখে চোখ ফেলে দৃষ্টি নামায় রুটি ও আলুভাজির ওপরে।

এখন কী হবে? আমাদের তো এত টাকা নাই। কী করবি তুই?

লুকোচুরি খেলব।

ও বড়ভাইয়ের দিকে সরাসরি তাকায়।

মানে? কী বলছিস?

আমি হাসপাতালে যাই ভাইজান।

হামিদ কোনোদিকে না তাকিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। পেছন থেকে ওর ভাই ওকে ডাকে, কিন্তু ও সাড়া দেয় না। পেছন ফিরে তাকায় না। ভাবে, বেওয়ারিশ মানুষের ওয়ারিশ খুঁজতে যাওয়া ভুল। ও ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। বেশি ভোর বলে রাস্তায় ভিড় কম। ও বেশ জোরে-জোরে হাঁটতে পারে। কারো গায়ে ধাক্কা লাগে না। হাঁটতে-হাঁটতে ও হাসপাতালে পৌঁছে যায়। ও বুঝতে পারে, ওর দম ফুরিয়ে যায়নি। ও টায়ার্ড হয়নি। ওর ভালোই লাগছে ফুরফুরে মন নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে। খুব অনায়াসে গাইনি ওয়ার্ডের বারান্দায় পৌঁছে যায়।

প্রথমেই দেখা হয় একজন আয়ার সঙ্গে।

আপনি?

আপনি তো আমাকে চেনেন বুয়া।

চিনি তো।

তাহলে এভাবে আতঙ্কের দৃষ্টি নিয়ে দেখছেন কেন, আমাকে? আমি আপনাকে একখিলি পান খাইয়েছি না? আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – ছেলে চান না মেয়ে চান। ভুলে গেছেন?

আয়া কথাই বলতে পারে না। তার গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। লোকটাকে আজ একদম অন্যরকম লাগছে। একটু পরে ও ঠিকই একটা ভূত হয়ে যাবে।

বুয়া আপনি কথা বলছেন না যে?

মাথা ধরেছে। আপনার কথা শুনে আমি কথা বলার কথা মনে করতে পারছি না।

শোনেন বুয়া, ডাক্তার যদি বলে যে আজ আমার রোগীর অপারেশন লাগবে, তাহলে আমি আপনার সঙ্গে লুকোচুরি খেলব।

আপনার বউয়ের অপারেশন লাগবে না। তিনি সন্তান প্রসব করেছেন।

তাই নাকি? যাই দেখি।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, কী হয়েছে? ছেলে, না মেয়ে?

আয়া কথা না বলে হাঁটতে শুরু করে। হামিদ ফুঃ শব্দ করে এগিয়ে যায়। ওয়ার্ডের দরজার মুখে দেখা হয় সিস্টারের সঙ্গে। সিস্টার হামিদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়।

আপনি কখন এলেন?

এই তো এখন। আমার কী বাচ্চা হয়েছে?

আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

কোথায় যাব?

ডাক্তারের কাছে।

চলেন। মনে হচ্ছে আমার সব খবর ভালো। অপারেশন ছাড়াই আমার বউ সন্তানের জন্ম দিয়েছে। হাঃ –

ডাক্তারের টেবিলের সামনে বসে হামিদ ঘামতে থাকে। ডাক্তারের মুখ গম্ভীর। ওকে বসতে বলে নিজের কাজ করছে। কাজ শেষ করে হামিদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, আপনি তো দেখেছেন, আপনার স্ত্রীর সন্তান প্রসবের অবস্থা ভালো ছিল না। লেবার পেইন ছিল কম।

ও কথা না বলে ঘামতে থাকে।

ভোররাতের দিকে আপনার স্ত্রী মৃত সন্তান প্রসব করে।

মৃত! নড়েচড়ে বসে। আকস্মিক বিমূঢ়তায় হকচকিয়ে যায়। তড়িঘড়ি বলে, ওকে কি ওই মৃত বাচ্চাদের সঙ্গে রাখা হয়েছে?

হ্যাঁ, তাই তো।

সিস্টার ঢোক গিলে বলে।

বেশ তো, এখন থেকে ও এক বেওয়ারিশ বাচ্চা।

সন্তান প্রসবের ঘণ্টা-দুয়েক পরে আপনার স্ত্রীও মারা যায়। আমরা বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করি।

ও আচ্ছা, বেশ তো।

হামিদ ঘামতে থাকে। ও আর কিছু বলতে পারে না। চুপ করে বসে থাকে।

ডাক্তার আবার বলে, হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী আমরা আপনাকে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেবো, আপনি লাশ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

আমি ডেথ সার্টিফিকেট চাই না।

হামিদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে।

এক মিনিট বসুন। আমার কথা শেষ হয়নি। আপনি ডেথ সার্টিফিকেট না নিলে তো লাশ নিয়ে যেতে পারবেন না।

হামিদ কিছু না-বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তার আবার বলে, আপনার স্ত্রীর দিক থেকে কেউ নেই, যিনি লাশ গ্রহণ করবেন?

হামিদ নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আছে।

বলুন কে, প্রয়োজনে আমরা যোগাযোগ করব।

হামিদ আবারও নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম।

কী বললেন!

ডাক্তারের বিস্মিত কণ্ঠ উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসে হামিদ। পেছন ফিরে তাকায় না। লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। বুঝতে পারে, মাথা পরিষ্কার হয়ে গেছে – ফিরোজা তার স্ত্রী ছিল। তাতে কী হয়েছে? মরে গেলে তো লাশ। এখন স্বামীই বা কি স্ত্রীই বা কি! ও বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাক। লাশ দাফনের সাধ্য যার থাকে না, তার গ্রহণ এবং বর্জনই কি! পাশে এসে দাঁড়ানোর কেউ নাই ফিরোজার। কেউ খোঁজ না করলে ওর লাশ মর্গে নিয়ে যাবে। নবজাতকের লাশও এভাবে মর্গে যাবে। তিন দিন অপেক্ষা করবে। তারপরও কেউ না এলে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে খবর দেবে। ওরা কাফনের কাপড় পরিয়ে নিয়ে যাবে কবরস্থানে, কবরের জন্য বাঁশ-চাটাইয়ের ব্যবস্থা করবে সিটি করপোরেশনের লোকেরা। কবরস্থানের সোহরাব কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

দুদিন একটি সন্তানের জন্য হাসপাতালে অপেক্ষা করে এতকিছু জেনেছে হামিদ। পুরো নাম আবদুল হামিদ মিয়া। গ্রাম হলতা। ইউনিয়ন-ডৌয়াতলা, উপজেলা-বাসনা,  জেলা-বরগুনা; ঢাকা শহরে একজন গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে কাজ করেছে। বারান্দা পার হয়ে গেটের কাছে এলে পকেটের ওপর হাত যায়। নিজেকে বলে, সবই ঠিকঠাক মতো হয়ে যাবে। তফাৎটা এটুকু যে, দাফন হবে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। পাশে দাঁড়িয়ে কেউ চিৎকার করে কাঁদবে না। এতে ভাবনার কিছু নেই। শূন্য পকেট নিয়ে কাঁদাকাটি করে লাভ কী? লাশের পরিচয়েরই বা দরকার কী?

ও হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। নিজে নিজে যে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ভাবনায় ও বেদনার্ত হয়ে যায়। এতক্ষণে ওর চোখে পানি আসে। একদিন দুজনে দুজনকে ভালোবাসার কথা বলেছিল। একদিন এক সানকিতে পান্তা ভাত খেতে-খেতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ঢাকায় এসে গার্মেন্টসকর্মী হবে। জীবন তো এতটুকুই।

গর্ভে সন্তান আসার পরে একদিন ফিরোজা হাসতে হাসতে বলেছিল, পোলা হইলে তুমার। মাইয়া হইলে মোর। ও ফিরোজাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, না, মাইয়া হইলে মোর।

ও রাস্তায় থমকে দাঁড়ায়। মৃত সন্তানটি ছেলে না মেয়ে তাও জানা হয়নি। ফিরে যাবে কি? পরক্ষণে ভাবে, থাক। লাশের আর ছেলে বা মেয়ে কি!

ও হাঁটতে-হাঁটতে নিউমার্কেট পর্যন্ত আসে।

মনে হচ্ছে বুকের ভেতর প্রবল তোলপাড়। চারদিক হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। ও একবার থমকে দাঁড়ায়। পরক্ষণে নীলক্ষেতের মোড়টা পার হয়ে কাঁটাবনে ঢোকার চিন্তা করতেই কোনোদিকে না তাকিয়ে রাস্তা পার হতে চায়। মাঝরাস্তায় মিনিবাসের ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। ওর আর জ্ঞান ফিরে আসে না।

তিনদিন মর্গে রাখা হয় ওকে।

কেউ খোঁজ করতে আসে না। তারপর একদিন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া হয় ওর মরদেহ। জুরাইন কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে ওকে। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার মুহূর্তে মর্গের ভেতর থেকে ছুটে আসে রমেন ডোম। কাঁদতে থাকে। কাঁদতে-কাঁদতে গাড়ি চাপড়ায়। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের একজন কর্মী বলে, তুমি কাঁদছ কেন রমেন?

ওকে একা-একা মর্গে থাকতে হয়েছে। কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। সেজন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। আমার ডোম জীবনের দুদিন সময়ে ওর মতো একজন বন্ধু হয়নি। সেজন্য কষ্ট হচ্ছে।

তুমি কাঁদ। আরো অনেকটা সময় নিয়ে কাঁদ। আমরা তো এমন কত লাশই নিয়ে যাই। তোমার মতো কাউকে কাঁদতে দেখিনি। আমাদের এই বেওয়ারিশ লাশ খুবই ভাগ্যবান।

গাড়ি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরও রমেন চোখের জল মুছে শেষ করতে পারে না। বলে, বন্ধু তোমার সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলতে ভালো লাগতো। ও বলেছিল, বলধা গার্ডেনে ঘুরতে যেত ও। বাগানে নীলপদ্ম দেখে ওর মনে হয়েছিল জীবনের রং তো এমনই হওয়া উচিত। বন্ধু তোমার কাছে নীলপদ্মের কথা শুনে আমি তোমাকে বন্ধু মেনেছিলাম। বন্ধু তুমি সুখে থাকো।

রমেন নিজের চোখের জল মুছতে ভুলে যায়।