মেঘমল্লার : বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিনের ইঙ্গিত

এন রাশেদ চৌধুরীMegh-Mallar

বাংলাদেশে জীবনঘনিষ্ঠ, শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ ও এর প্রসারে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছে ‘বেঙ্গল চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম’। তরুণ চলচ্চিত্র-নির্মাতা গড়ে তোলার পাশাপাশি এর কয়েকটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে নানারকম চলচ্চিত্র নির্মাণ, এর বিপণন ও পরিবেশনে। এ উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদান ২০১৩ ও বেঙ্গল এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের যৌথ প্রযোজনায় দেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে সম্প্রতি জাহিদুর রহিম অঞ্জনের পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে বেঙ্গল এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মেঘমল্লার। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্ষার টানা তিন দিনের কাহিনি নিয়ে মেঘমল্লার ছবির বিয়োগান্ত আখ্যান গড়ে উঠেছে। মেঘমল্লার চলচ্চিত্রের গল্পসংক্ষেপ এরকম –

বাংলাদেশের একটি মফস্বল শহরের সরকারি কলেজের রসায়নের শিক্ষক নূরুল হুদা গল্পের মূল চরিত্র। স্ত্রী আসমা ও পাঁচ বছরের মেয়ে সুধাকে নিয়ে তার সুখ-দুঃখের মধ্যবিত্ত সংসার। তাদের সঙ্গে থাকে আসমার ছোট ভাই মিন্টু। কাউকে কিছু না বলে মিন্টু একদিন মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়; কিন্তু নূরুল হুদাকে ফেলে যায় জীবন-মৃত্যুর সংকটের মধ্যে। তার পরও নূরুল হুদা নিয়মিত কলেজে যায়, পাকিস্তানপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। মধ্যবিত্তের শঙ্কা, ভয়, পিছুটান তাকে অসহায় করে তোলে। ঘোর বর্ষণের এক রাতে মুক্তিযোদ্ধারা কলেজে এবং পাশের আর্মি ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। কোনো কারণ ছাড়াই পাকিস্তানি আর্মি নূরুল হুদা এবং তার বন্ধু আবদুস সাত্তারকে ধরে নিয়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যে যাওয়ার সময় আসমা তাকে মিন্টুর একটা ফেলে যাওয়া রেইনকোট পরিয়ে দেয়। পাকিস্তানি আর্মির সামনে নূরুল হুদা প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। প্রমাণ করার চেষ্টা করে, সে একজন শিক্ষক মাত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্রব নেই; কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। আঘাতে নূরুল হুদার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। রক্তের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই তার মিন্টুর কথা মনে হয়; সে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবতে শুরু করে। যার জন্যে মৃত্যু বা আত্মদান কোনো ব্যাপারই না। সে বলে, আমি সবকিছু জানি, কিন্তু কিছুই বলব না। এরপর মেজরের একটা গুলিতে নূরুল হুদা নিথর হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু যুদ্ধ অনেক মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, আর ক্ষত রেখে যায় কাছের মানুষের হৃদয়ে। আসমা আর সুধার জীবনে যেমন।

গল্পের আখ্যানই বলে দিচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অংশ-বহির্ভূত এ-গল্পে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে একটি সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের এক যুবক ছাত্রের স্থানীয় গেরিলাযুদ্ধে যোগ দেওয়া ও তাঁকে ঘিরে যুদ্ধাধীন বাংলাদেশে পরিবারের অন্য সদস্যদের অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে মেঘমল্লার চলচ্চিত্র বিস্তারলাভ করে। এ-গল্পের নায়ক অসহায় কলেজ-শিক্ষক নূরুল হুদা, যিনি আরো অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালির মতো সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সাহস করেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হোক – এ-বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ একজন দোদুল্যমান ব্যক্তি এই নূর। একসময় মনে হয়, তিনি কি সত্যিই চান বাংলাদেশ স্বাধীন হোক! অনেকে কলেজ ছেড়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেলেও তিনি চাকরি রক্ষায় বদ্ধপরিকর একজন নাজুক হৃদয় ব্যক্তি, যিনি অকারণে দেশের এমন দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও কলেজে যাওয়া-আসা করেন (স্ত্রীর ভাষায় – ছাত্র নেই, কিছু নেই এখনো কলেজে যাচ্ছো …) প্রিন্সিপালকে তুষ্ট করতেই যেনবা। এ-সময়ই এই ভীতু গোবেচারা শিক্ষকের জীবনে নতুন আপদ হয়ে দেখা দেয় নিজ শ্যালকের যুদ্ধে যোগদান, তাও আবার স্থানীয় গেরিলা দলে! মিন্টুর ওপরই যেন তাঁর যত বিরক্তি, ওর জন্যেই যেন দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে নূরের কলেজজীবন। এ-গল্পে কলেজ-শিক্ষকদের টিচার্সরুম একসময় হয়ে ওঠে দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ প্রকাশের ও এদেরই কতিপয়ের একপ্রকার গা-বাঁচানো সংস্কৃতিরও আকর হিসেবে। কিন্তু চাইলেই কি পারা যায় নিজেদের স্বাধিকার আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জনস্রোতস্বিনী এ-যুদ্ধ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে? তাই অনিবার্য পরিণতির মতোই নূরও একসময় এর শিকার হন – নিজ শ্যালকের যুদ্ধে যোগদানের দায় থেকে নিজেকে এড়াতে ব্যর্থ হওয়ার মাধ্যমে। সবাই সন্দেহ করেন – নূর নিজেও জানেন তাঁর শ্যালক কোথায় আছেন!

কলেজ ক্যাম্পাসের কাছেই কোথাও ঘাঁটি গেড়েছে স্থানীয় আর্মি ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধা দলের কলেজের ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তাই আর্মিদের সহজ সন্দেহ জাগে নূর ও তাঁর মতোই আরেক অসহায় শিক্ষকের ওপর। ক্যাম্পে নেওয়ার পর এই ভীত সাধারণ শিক্ষকের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য। এদিকে শিক্ষকের স্ত্রী ও তাঁর অবুঝ মেয়ে সুধার তখন পরিবারের একমাত্র ভালোবাসার এই গোবেচারা স্বজনটির খোঁজে চলছে বিষাদময় আর্তনাদ। ভালোবাসার স্বজনকে ফিরে পেতে ও মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে এ-খবর পৌঁছে দিতে স্ত্রী আসমার প্রায় পাগল হওয়ার দশা।

এভাবেই সাধারণ গোবেচারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই কলেজ-শিক্ষক জড়িয়ে পড়েন নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধের মরণপণ সংসর্গে। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে থেকেই শুরু হয়েছে মুষলধারায় বৃষ্টি। এ যেন বর্ষার আবহকালে মেঘমল্লারের নিনাদ। চলচ্চিত্র মেঘমল্লার তাই হয়ে উঠেছে যুদ্ধের মতো মানব পরিণতির এই অনিবার্য সংকটের প্রেক্ষাপটে এক বিষাদময়তার কাব্য।

নানা কারণে মেঘমল্লার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র! প্রথমত, বাংলাসাহিত্যের শক্তিমান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ও কাহিনির ভিন্নতা এ-গল্পকে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের মাঝেও ভিন্নতর দৃষ্টিকোণের মর্যাদাদান করেছে, উপরন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ভিন্নতর অ্যাপ্রোচ একে অনন্য চলচ্চিত্রের ভাষা জুগিয়েছে। এ-ছবির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রগ্রাহক, জাহিদুর রহিম অঞ্জনের পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নকালীন সতীর্থ সুধীর পালসানে। এর আগে সুধীর প্রয়াত চলচ্চিত্র-নির্মাতা তারেক মাসুদের মাটির ময়না ছবিটির চিত্রগ্রহণ করেছিলেন। মেঘমল্লার চলচ্চিত্রটি অত্যন্ত মিনিমাল ধাঁচের মিজোসিন দৃশ্যালেখ্যে গাঁথা। কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সততা ও মনোযোগ দুই-ই পরিচালকের কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। ছবিতে ব্যবহার্য সংগীতও ছবির গল্পের মেজাজে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। সর্বোপরি এটি একটি যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র, যে-যুদ্ধ সকল ক্রূর রাজনীতির বাইরে বসবাসরত সাধারণ মানবগোষ্ঠীর জীবনধারাকেও ক্ষত-বিক্ষত করতে ছাড়েনি। চিরদিনের মতো বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে প্রিয়জনের সঙ্গে প্রিয়জনদের। হয়তোবা সুধার মতো উত্তর-প্রজন্মের স্বার্থেই নূরের এই আত্মাহুতি! এক স্বাধীন দেশের ঠিকানা দিয়ে যাওয়া পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের নিরাপদ আবাসের জন্য।

বাংলাদেশে ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারায় সাম্প্রতিককালের শ্রেষ্ঠতম সংযোজন – জাহিদুর রহিম অঞ্জনের মেঘমল্লার চলচ্চিত্রটি।  ২-কে রেজুলেশনে নির্মিত ও রতন পালের ৫.১ সারাউন্ড সাউন্ড শব্দ-সংমিশ্রণে সমৃদ্ধ এ-ছবির দৃশ্য-শব্দপ্রয়োগ এককথায় অনন্য। মেঘমল্লার ছবির সংগীত ও সম্পূর্ণ পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ হয়েছে কলকাতা ও মুম্বাইয়ে সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তিতে, যার জলজ্যান্ত চিহ্ন বহন করছে ছবিটির নান্দনিক কারিগরি উপস্থাপন। আমার বিশ্বাস, চলচ্চিত্রটি প্রকৃত চলচ্চিত্রপ্রেমী তথা সাধারণ দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করতে সমর্থ একটি প্রয়াস, যা তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেই মর্মান্তিক বিয়োগান্ত স্মৃতিতে – মানবতার বিপক্ষে সংঘটিত এক অসম যুদ্ধের দিনগুলোয়। পাশাপাশি চলচ্চিত্রের শিক্ষক জাহিদুর রহিম অঞ্জন সম্পূর্ণ সমর্থ হয়েছেন তাঁর উত্তর-প্রজন্ম তথা অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাণ-আগ্রহীদের এই মর্মে উজ্জীবিত করতে যে, চলচ্চিত্র-নির্মাতা যদি সিরিয়াস হন, বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ বাংলাদেশেই সম্ভব! শুধু প্রয়োজন নির্মাতার একাগ্রতা আর সংশ্লিষ্ট কাজে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন আত্মনিয়োগ।

দীর্ঘকাল ধরে স্বদেশি চলচ্চিত্র আর দৃষ্টি কাড়ে না আমাদের রসজ্ঞ চলচ্চিত্রামোদীদের। কদাচিৎ স্বাধীন ধারার দু-একটি চলচ্চিত্র দেশের বাইরে আলোড়ন সৃষ্টি করলে আমাদের দর্শক আশায় বুক বাঁধেন, চলচ্চিত্রটি নিশ্চয়ই তাঁর দীর্ঘ তৃষিত মানস পূর্ণ করবে জীবনের অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত সৃষ্টিশীল বারিধারায়। চলচ্চিত্র-শিল্প নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করার অভিজ্ঞতায় সেই অনুভূতি যে জীবনে খুব বেশি আসেনি, তা-একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলতে পারি। বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি অতীত নিয়ে গর্ববোধ ও স্মৃতিকাতরতায় অনেক ভুগেছি আমরা। কিন্তু সেও অনেককাল আগের কথা। এরপর অন্তত চার-চারটি মূল্যবান দশক পেরিয়ে গেছে। অনেক সত্যিকারের স্বদেশপ্রেমী চলচ্চিত্র পুরোধা ও চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকর্মীদের আশাহত করে এদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি পূর্ণাঙ্গ কোনো চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চলচ্চিত্র উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বিএফডিসি পরিণত হয়েছে আমলাসর্বস্ব পরিকল্পনাহীন দক্ষিণ ভারতীয় তামিল-তেলেগু চলচ্চিত্রের অবিকল নকল অনুশীলনকারী এক ভাগাড়ে (কোনো এক অজ্ঞাত কারণে)। মরি মরি করেও এর তথাকথিত ঐতিহ্যগত ভাবগাম্ভীর্য (!) নিয়ে কয়েকটি ভবন এখনো দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক কারওয়ান বাজার সীমান্তে সময়ের নিঠুর সাক্ষী হয়ে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক রুগ্ণ চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ। এহেন মর্মান্তিক সময়ে অঞ্জনের মেঘমল্লার দর্শককে এক খাঁটি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতায় সিক্ত করবে।

পরিশেষে, বেঙ্গল চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরামসহ বেঙ্গলের চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা সংস্থাগুলোকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। বেঙ্গলের কর্ণধার, বিশিষ্ট সংস্কৃতিসেবী  আবুল খায়েরকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দেশের চলচ্চিত্র-শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর সময়োচিত পদক্ষেপ নিশ্চয়ই একদিন আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্বদরবারে বুক উঁচু করে দাঁড়াতে সাহস জোগাবে।